ভালোবাসার রংধনু,০৬,০৭
৬
__________
(১১)
ইশি আপুর হলুদ এবং মেহেদির প্রোগ্রাম আজ। বারোটার পর থেকে নাকি মেহেদি শুরু হবে। মাউইমা আমায় কোচিং-এ যেতে নিষেধ করে দিলেন। ওদিকে আপা এসে বলল কোচিং মিস করবার দরকার নেই। ক্লাসটেস্ট আছে বলে যেন বেরিয়ে যাই। আমিও ভাবছিলাম এটাই বলব। ইনতিসারকে সুবিধার লাগছে না। আজ দেখলাম আমার ঘরে ঢুকেছিল। খোঁজ করছিল আমার? এটা তো একদমই ঠিক কথা নয়৷ গতবার ঝামেলা এড়ানো গেছে, এবার আর যাবেনা। ভাগ্যিস মাফিনকে নিয়ে ছাদে গেছিলাম তখন নইলে তো কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতো। তবুও মনটা খচখচ করছে। ছেলেটা ঘরে ঢুকেছিল। বাড়িতে এত লোকজন, কি না কি ভেবে বসবে! আপার চিন্তা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু কীভাবে বোঝাই আমি ওর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলেও, ও আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়।
কি করতে পারি আমি!
কোনো বিশেষ কারণবশত কোচিং এর ক্লাস অফ থাকবে, মাত্র মেসেজ এলো ফোনে। ফোন হাতে চুপচাপ বসে আছি। এখন তাহলে কি করবো? এই ভয়ংকর বাড়িটায় থাকতে হবে? হুট করে ইনতিসার ঘরে চলে এলে কি করবো? ভয়ে কান্না আসছে। আমার ধারণা ও জানতে পেরে গেছে ইশি আপুর ফুপু শ্বাশুড়ি আমার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ পাঠিয়েছেন, এজন্যই খুঁজছে। এবার কি করবে? গালিগালাজ করুক অথবা অভিশাপ দিক সমস্যা নেই কিন্তু বাড়িতে কোনো অশান্তির সৃষ্টি না করুক।
ভাবনার ভেতর হাতের মধ্যে ফোনটা দু’বার ভাইব্রেট করে উঠল। তাকিয়ে দেখলাম মেসেজ এসেছে। একটা অচেনা নাম্বার থেকে। সচরাচর অচেনা নাম্বারের কল/মেসেজ আসেনা আমার ফোনে। ভিআইপিদের মতো রেস্ট্রিক্টেড নাম্বার আমার। আজ এই প্রথম অচেনা নাম্বার দেখে বেশ কৌতুহল জাগলো। মেসেজটা ওপেন করলাম তড়িৎ।
লেখা, “ঠিক বিকাল পাঁচটায় ছাদে চলে আসবা নীরদ। তোমার সাথে কথা আছে আমার।
ইনতিসার ”
ইনতিসার!
এই মেসেজ ইনতিসার পাঠিয়েছে, সত্যি? দু’বার বেশি করে চোখ কচলে নিলাম। ঠিক, ওর নামই তো। আমার ফোন নাম্বার পেলো কোথায় ও?
ইশশ বয়ে গেছে আমার বাঘের সামনে যেতে। পানি ছাড়া আস্ত গিলে খাবে । নাহ্ আর এক মুহুর্তও এই বাড়িতে থাকবো না আমি। যে করেই হোক বেরুতে হবে। দরকার হলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো তবুও থাকবো না এখানে।
ফোন রেখে জলদি হাতে রেডি হতে শুরু করলাম। পূর্বেও এমন ভদ্র ভাষায় ডেকেছিল ইনতিসার৷ চার বছর আগে। তখনও যাইনি৷ তারপর কি? ধৈর্য্যহারা হলো, সিনক্রিয়েট করলো। মাঝরাস্তায় আমায় ধাক্কে ফেলে দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল,
— কি মনে করো তুমি নিজেকে? প্রিন্সেস ডায়না নাকি হেলেন অব ট্রয়? মনে করো তোমার পেছনে পাগলের মতো ঘুরবে ছেলেরা! আমি ডেকেছি আসোনি কেন তুমি? ভেবেছিলে প্রপোজ করার জন্য ডাকব? এত ভাব! উমহ্ যে দাদুমা’র মতো লুক নিয়ে ঘোরে তার এত ভাব কই থেকে আসে? শোনো ভাবের চোটে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মেয়েটা, তোমার ওপর আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমি তো শুধু নোটস গুলো দেয়ার জন্য ডেকেছিলাম তোমাকে।
বলে ও নোটস ছুঁড়ে দিলো আমার গায়ে। আশেপাশে অনেক ক্লাসমেট দাঁড়িয়ে ছিল। মজা দেখছিলো তারা। রাগের চোটে চোখে পানি টুলটুল করছিলো আমার। কিন্তু কাঁদিনি। উঠে দাঁড়িয়ে ওর নোটস পাল্টা ওর মুখে ছুঁড়ে মেরে হনহন করে হেঁটে চলে এসেছি।
তারপর আর একবারও রুচি হয়নি ওর মুখের দিকে তাকাতে। পরে এক সপ্তাহ লজ্জায় কোচিং-এ যাইনি।
এদিকে ও করেছে কি প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে রাত্রিবেলা আমার ঘরে এসে ঘুমন্ত আমার কোমর সমান চুলের বিনুনিটা অর্ধেকের বেশি কেটে দিয়েছে। এই করে শান্ত হয়নি। বিনুনির কাটা অংশ শিয়রের পাশে সাজিয়ে রেখে ওতে ছোট্টো কাগজ আটকে দিয়েছিল। যেখানে লেখা ছিল,
“দাদুমা রাস্তায় ওভাবে অপমান করলে কেন আমাকে? এত ভাব কে দেখে তোমার? ভাবের গোড়া এই পেত্নীর সমান বিনুনিটা না? তখন কেমন বিনুনি দিয়ে বাড়ি মেরে চলে গেলে আমাকে। নাও তোমার ভাবের গোড়া এখন কেটে দিলাম। আর লাগতে আসবা আমার সাথে?”
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শখের চুলগুলোর এমন বারো অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হওয়ার জোগাড় হয়েছিল আমার। সেদিনই বেরিয়ে আসতে নিয়েছিলাম ঐ বাড়ি থেকে। কিন্তু আপা আটকে দিল৷ বললাম এবারে ওর একটা শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আপা বলল করবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত করলো না। উল্টো দুঃখে শোকে আমি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গেলাম। একশো চার ডিগ্রি জ্বর। সে জ্বর আর নামেনা। জ্বরের ঘোরে আজেবাজে কল্পনা আসে। দেখি ইনতিসার আমার ঘরে এসে ধারালো ব্লেড দিয়ে আমাকে ন্যাড়া করে দিচ্ছে। একবার দেখি কথা শুনছি না জন্য গাল চেপে ধরছে শক্ত করে, তারপর শাঁসাচ্ছে চাকু দিয়ে গলা কেটে দেবে।
জ্বরের মধ্যেই ভয় পাই আমি, গায়ে কাঁপুনি ধরে যায় আমার। আপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিনতি করে বলি, আমাকে অন্য কোথাও রেখে আসো আপা। এই বাড়িতে থাকলে আমি মরে যাবো।
আপা আমার বেহাল দশা দেখে সমানে কাঁদে। দোয়া পড়ে মাথায় ফু দিয়ে দেয়। দুশ্চিন্তার ওরও ঘুম হয়না। কোন ডাক্তারের কাছে নেবে সেটাও বুঝতে পারেনা। পরে মাউইমা আর বড় ভাবির সহায়তায় এক ডাক্তারের কাছে নেয়া হয়। ডাক্তার বলে জ্বরটা ভয়ের কারণে। ভয়ের জায়গা থেকে মাইন্ড ডাইভার্ট করে দিলে আমি সুস্থ হয়ে উঠবো।
আপা জানতো আমার ভয় ইনতিসার। কিন্তু ওকে সরানোর উপায় কি?
অবশ্য আপাকে দুশ্চিন্তা করতে হয়না আর। ইনতিসারের এডমিশান গুলো শুরু হয়ে যায়। ওরও ট্রাভেল শুরু হয়। এ শহর থেকে ওই শহরে। ও বাড়ি ছাড়ার পরেই আমি সুস্থ হই। কিন্তু কোচিং পুরোদমে বন্ধ। আপা শুনে রাগ করে। বলি টাকা খরচের দরকার নেই, স্কুলেই টিউশন ব্যবস্থা আছে। সেখানেই ভর্তি হয়ে যাব। মুখের কথায় প্রথমে বিশ্বাস করেনা আপা। নিজে গিয়ে খোঁজ নেয়। শিওর হওয়ার পর স্কুলে পড়ার পারমিশন পাই। ক্লাস ছিলো আমার মর্নিং শিফটে। সাড়ে সাতটায় ক্লাস। ছ’টায় বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতাম। একদম টিউশন শেষ করে ফিরতাম বিকেল তিনটে;সাড়ে তিনটেতে। কখনো চারটা বেজে যেত৷
ইনতিসারের সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। কখনও ওর পরীক্ষার শিডিউল এর কারণে, কখনওবা বাড়ির মানুষ উপস্থিত। একদমই যে দেখা হতো না তা নয়। চোখাচোখি হতো। আমি চোখ সরিয়ে চলে আসতাম। এমন ভাব করতাম ও অচ্ছুৎ বা নোংরা কিছু, তাকালেও পাপ হবে। ওকে ইগনোর করতে খুব মজা লাগতো আমার। ভাব আমার নাকি ওর? কি মনে করে ও নিজেকে? সবাই ওর পেছনে পাগল হয়ে যাবে! এসেছে কোন ডালিমকুমার।
এই করে করে কাটলো আরো দুটো মাস। অদ্ভুতভাবে আমার অভিশাপ লেগে গেল ইনতিসারের ভাগ্যে। পছন্দের ইউনিভার্সিটিতে হলো না ওর। যেখানে হলো সেখানে আবার পছন্দের সাবজেক্ট পেলো না। তাই ভর্তিও হলো না। আঙ্কেল খুব রাগারাগি করলেন এসব নিয়ে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে খুব ভালো জায়গায় পড়াশোনা করেছে। সাবজেক্ট দিয়ে কি হবে? প্রতিষ্ঠান ভালো হলেই তো হলো। ও পাল্টা রাগ দেখালো বাবার ওপর। সাবজেক্টটাই আসল। পছন্দের সাবজেক্টে পড়তে পারলে সেখানে নিজের সেরাটা দেয়া যায়। নিজের সেরাটা দেয়া মানে সেরা স্টুডেন্ট হওয়া। তখন প্রতিষ্ঠান ম্যাটার করেনা।
এসব নিয়ে বাপ-ছেলের খুব তর্কবিতর্ক চলল। আমি ঘর থেকে শুনলাম চুপচাপ। আঙ্কেল একদফা রাগারাগি শেষে বলে দিলেন, ওকে আর পড়াতে পারবেন না। নিজের ব্যবস্থা যেন ও নিজে করে নেয়। ও নিজেও কম যায়? দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলল, নিজেই করে নেবে নিজের ব্যবস্থা।
দু বাপ-ছেলের মাঝখানে পড়ে গেলেন বেচারি মাউইমা। একবার ছেলেকে শান্ত হতে বলেন একবার স্বামীকে!
আমি এদিকে মুখ বাঁকিয়ে আপনমনেই বললাম, কিছু করার মুরোদ নেই শুধু নাকের ডগায় রাগ।
কিন্তু আমি তো ভুল ছিলাম। শুধু রাগ না, রাগের পাশাপাশি বুদ্ধিও ভরা ওর মাথায়।
পরদিনই কোত্থেকে টাকা পেয়ে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে এলো। সবাই প্রথমে ভেবেছিল বড় ভাই হয়তোবা ভর্তি ফিসটা দিয়েছেন। কিন্তু পরে জানা গেল ওর নামে ব্যাংকে ওর দাদু কিছু টাকাপয়সা রেখে গিয়েছিলেন। সেগুলো উঠিয়ে ভর্তির কাজে ব্যবহার করেছে। আঙ্কেলের সিগনেচার লাগতো কিছু পেপার্সে, ভদ্রলোক সিগনেচারটাও নকল করেছে। এসব শুনে সবাই চমকাবার বদলে মজা পেলো বেশি। ওর বদমাইশি বুদ্ধিমত্তায় খুশি হয়ে বড় ভাই একটা বিশাল এমাউন্টের টাকা ওকে গিফট করে দিলেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ছোটোখাটো ব্যাপারেও এদের গিফট! এসব কাজকারবার দেখলে আমার মনে হতো টাকাপয়সা জিনিসটা আসলে কিছুই না এদের কাছে। স্রেফ হাতের ময়লা।
,
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরপর ও আবার আমার পেছনে লাগল। কিভাবে যেন সময়ের ব্যাপারটা ধরে ফেলল। সকালে উঠতে পারতো না বলে সকালটা বেঁচে যেতাম কিন্তু ফেরবার পর সুযোগ পেলেই এক চুলও ছাড় দিতো না৷
একদিন হলো কি স্কুল থেকে ফিরে আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছিল কিন্তু ইনতিসারের ভয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারছিলাম না৷ ওদিকে ক্ষুধাও সহ্য করার মতো নয়। আপাও বাড়িতে নেই। মাফিন আমার কাছে ঘুমিয়ে ছিলো। ক্ষুধার জ্বালায় ওকে টেনে তুললাম, তারপর পাঠালাম ইনতিসার কোথায় তার খোঁজ নিতে। যদি নিজের ঘরে থাকে তাহলে আমি শুধু বাইরে গিয়ে খাবারটা নিয়েই আসবো। মাফিন গুটুর গুটুর পায়ে গেল খানিক বাদে ফিরে এসে বলল ইনতিসার নেই। আমি তো মহা খুশি। নাচতে নাচতে খাবার নিতে গেলাম ডাইনিংয়ে।
গিয়ে দেখি বদমাশটা আমাকে বোকা বানিয়েছে।
চিলের দৃষ্টি নিয়ে সে ডাইনিংয়েই বসে আছে চেয়ারের ওপর পা তুলে। মুখোমুখি পড়ে যাওয়ার পর আমি এখন পালাবো কি করে! বোকার মতো ওর দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে পিছু ঘুরে যেই না দৌড় দিব ঐ সময়ে ও আমার বিনুনি টেনে ধরলো। ব্যথায় মুখ কুঁচকে গেল আমার। রাগে কটমট করতে করতে ফিরে তাকাতে নিলে এক হাতে ঘাড় চেপে ধরলো, ফিরতে দেবেনা। অগ্নিশর্মা হয়ে আমি দাঁতে দাঁত পিষে বললাম,
— এসব কোন ধরনের ফাইজলামি হচ্ছে?
— ফাজিল কে আমি নাকি তুমি? ফাইজলামি করছে কে? তুমিই করছো।
ভেঙ্গাতে ভেঙ্গাতে বলল ও। আমি পুনরায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
— আপনি আমাকে ছাড়বেন নাকি চিৎকার করবো?
— চিৎকার কেন করবা? চুমু খেয়েছি তোমাকে?
— আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন বললাম।
— এখন আরও ছাড়াবো।
ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে ফট করে ঘাড়ে একটা চুমু খেয়ে ফেললো ও। আমি হতভম্ব। ও আমাকে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে দিতে কানের সাথে ঠোঁট চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
— তোমার ঘামে ভীষণ গন্ধ গ্লুমি ওয়েদার৷ ভাদ্র মাসের গরমের মতো বিশ্রী। ঠিকমতো গোসল করোনা তুমি। দিনে তিনবেলা ডাভ সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে গোসল করবে। ইশশ আমার নাকটাই পঁচে গেল!
মুখ বিকৃত করে সরে গেল ও। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে একটুখানি থেমে আবারও বলল,
— আর শোনো চাবায় চাবায় কথা বলবা না। তোমার চাবানো কথা শুনলে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছে করে আমার।
ওর এত স্পর্ধা দেখে আমি শেষে অবাক হতেই ভুলে গেলাম। রাগবো যে সেই অনুভূতিও নেই। কেবল বোকার মতো চুপচাপ ওর প্রস্থান দেখলাম।
__________
(বর্তমান)
বাড়ি থেকে বেরুনোর মুহুর্তে আপা কোত্থেকে ছুটতে ছুটতে এসে পাকড়াও করলো আমাকে। ওর ফোনটা কানে ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় বোঝালো কথা বল। আমি ভ্রু কুঁচকে ফোন ধরে প্রথমে সালাম দিলাম। ওপাশ থেকে বড় সুরে সালামের জবাব আসাতেই বোঝা গেল ইশি আপুর সেই ফুপু শ্বাশুড়ি। আমার হালচাল জিজ্ঞেস করে উনি বললেন ওনার ছেলে আজ এক্ষুণি আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি অবাক হয়ে আপার দিকে তাকালাম। আপা ইশারায় বোঝালো যেন রাজি হই, সে হ্যাঁ বলে দিয়েছে। এখন আর না করে লাভ আছে? অগত্যা রাজি হয়ে গেলাম। আন্টি আমার ফোন নম্বর নিলেন। এবং কল ডিসকানেক্ট করবার এক মিনিটের মাথায় ওনার ছেলের সঙ্গে ফার্স্ট মিটের লোকেশনটা মেসেজ করে দিলেন।
আমি অসহায়ভাবে আপার দিকে তাকালাম। বললাম,
— এখন আবার ঐ ছেলের সাথে দেখা করবার জন্য প্রিপারেশন নিতে হবে?
আপা ভ্রু কোঁচকালো,
— কিসের প্রিপারেশন?
— এমন নর্মাল গেটআপে যাব?
— অবশ্যই। বিয়ে ভাঙতে হলে এভাবেই তো যেতে হবে। তোকে এত সাধারণ দেখে অমন ফার্স্টক্লাস জব করা ছেলে শুরুতেই রিজেক্ট করে দেবে।
— তোমার মান-সম্মানের ওপর কোনো আঁচ লাগবে না তো?
— কিসের আঁচ। শুধু যদি সুমুন্দি না হতো ওরা তাহলে মুখের ওপর না বলে দিতাম আমি। এখন তো আমার হাত বাঁধা।
— আপা আমার ভয় লাগছে।
আপার হাত ধরে কাতর স্বরে বললাম আমি। আপা আমার কাঁধে হাত বুলিয়ে ভরসা দিয়ে বলল,
— কিচ্ছু হবে না। ভরসা রাখ।
— তাহলে বেরিয়ে পড়ি? আমি একা যাব? নাকি আমার ফ্রেন্ডকে..
— না না দরকার নেই। একাই যা তুই। দেখি অ্যাড্রেসটা?
আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে অ্যাড্রেসটা দেখে নিলো আপা। তারপর বলল,
— চল তোকে রিকশায় তুলে দিচ্ছি আমি।
— হ্যাঁ চলো।
রিকশায় তুলে দিয়ে ভাড়াটাও হাতে গুঁজে দিলো আপা। মন্থর গতিতে এগোচ্ছে রিকশা। আমি ভাবছি, এ হলো জীবনের আরেকটা পরীক্ষার সময়। কে জানে উত্তীর্ণ হতে পারবো কি না! নাকি অনেকের মতো মাঝপথে এসে ভেঙে যাবে আমার ভবিষ্যতের জন্য সাজিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো!
চলবে,
sinin tasnim sara
ভালোবাসার রংধনু
৭
__________
(১২)
পথে যেতে যেতে হঠাৎ জ্যামে আটকে গেলাম। ঘড়ি ধরে পুরো আড়াই ঘণ্টা হয়ে গেল, একচুল নড়বার উপায় নেই। সুযোগ পেলে শুধু ফাঁকে ফোক্করে ঢুকে যাচ্ছে রিকশাওয়ালা আর খানিক পরপর গলায় ঝোলানো নিজের গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বিরক্তির সাথে বলছে,
— এত গাড়িঘোড়া হইছে শহরটাত! শান্তি নাই। সমায়ের কাজ সমায়ে করা সম্ভবে নোয়ায় এ্যাটে। ধুর্। গরমটাও ওটছে একেবারে। রইদ ফিট লাগাবে সবাক।
রিকশাওয়ালার বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ আমার রাগের মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিতে থাকলো। গোসল করে বেরুনো তো হয়নি। রাজ্যের গরম আমাকেই লাগছে। ঘামে গোসল করে উঠছি মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে নেটে লোকেশনটা দেখে নিয়েছি। হাইফাই ধরনের এক ক্যাফেতেই ডেকেছে লোকটা। সাধারণত ঐ ধরনের জায়গায় শৌখিন মানুষরা ছাড়া যায়না। আমি তো মোটেই স্যুইটেবল না ঐ জায়গার জন্য। এতক্ষণ বিষয়টা ভেবে আনন্দ লাগছিলো কিন্তু এখন বিরক্ত লাগছে, খানিক ভয়ও। বিয়ে না-হয় ভাঙলো কিন্তু মান-সম্মানের যে ত্যাখ্যাচড়া অবস্থা হবে সেটার বেলা? এমনিতেই লোকের কথা খুব ম্যাটার করে আমার কাছে। ঘেমে-নেয়ে অস্থির আমাকে দেখে যদি মানুষ হাসাহাসি করে তখন? ওখানেই তো বোধহয় কেঁদে ফেলবো।
নাহ্ আর যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে ফিরে যাই বাড়িতে। একবার বলতেও চাইলাম রিকশাওয়ালাকে রিকশা ঘোরাক। তারপর ভাবলাম নাহ্ দেখাসাক্ষাৎ ব্যাপারটা পেন্ডিং রাখার দরকার নেই। পরবর্তীতে আবার প্যারা মনে হবে। তারচাইতে আজই দেখুক আর দেখেই না করে দিক ব্যাস!
দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা পর আস্তে আস্তে জ্যাম খুলতে শুরু করলো। সাথে শুরু হলো রিকশাওয়ালারও উড়োজাহাজের গতিতে চলা। যেতে যেতে একবার ফিরে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
— আপা হুডটা ধরি বসেন। হাওয়ার বেগে উড়ি যামো এবার।
বিরক্তির মাঝেও লোকটার কথা শুনে হেসে ফেললাম আমি। হুড চেপে ধরে হাসতে হাসতেই শুধলাম,
— বাড়ি কই আপনার?
— জ্বী আপা?
মনে হয় শুনতে পায়নি প্রথমবার, ফিরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো।
— বাড়ি কই?
— রমপুর।
— রংপুর! ওটাই তো একটা বিভাগীয় শহর। তো ঐ শহর ছেড়ে এত যানযটের শহরে কেন?
— বউডা গার্মেন্টস করে আপা। এত বড় শহরে একা থাকতে ডর লাগে তার । তারে সঙ্গ দিবার জন্যই আসছি আরকি।
লাজুক হেসে বলল রিকশাওয়ালা। কথাটা চমকপ্রদ লাগলো আমার কাছে। অজান্তেই হেসে ফেললাম।
— নতুন বিয়ে?
— অমনে, তিনবছর হইলো।
— বাহ্ ভালো তো। দোয়া করি সুখে থাকেন আপনারা।
আমার কথায় রিকশাওয়ালা পুনরায় মুচকি হাসলো। বাকি পথটা তার সাথেই গল্প করে কাটালাম৷
গন্তব্যে যখন নামিয়ে দিলো তখন মাথার ওপর চড়া রোদ। পাওনা টাকা বুঝিয়ে দেবার পর ব্যাগ হাতে জড়োসড়ো হয়ে আমি ক্যাফের দিকে হাঁটা ধরলাম। কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকতে হবে। হাত বাড়িয়েছি মাত্র ঐ মুহুর্তে সশব্দে ফোনটা বেজে উঠলো। হাত নামিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলাম। আপার কল!
কলটা রিসিভ করে আড়ালে যেতেই ওপাশ থেকে আপা খানিক গম্ভীর হয়ে বলল,
— নীরদ কই তুই?
— এসেছি ক্যাফের সামনে। কেন কি হয়েছে?
ভয় মিশ্রিত গলায় বললাম আমি। লেইট করেছি বলে আপা কি এবার রাগ করবে?
— মাত্র পৌঁছালি?
— হু।
— আর ভেতরে ঢুকতে হবেনা তাহলে।
— মানে!
— বিয়ে ভেঙেছে তোর।
— বলো কি? দেখাসাক্ষাৎ না করতেই বিয়ে ভাঙলো?
— হু। ঘড়ি দেখেছিস একবারও? কত লেইট তুই। ছেলে তো বিরক্ত হয়ে ফিরে গেছে বাসায়। বলেছে যে মেয়ের টাইম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই তাকে সে লাইফ পার্টনার বানাতে আগ্রহী নয়।
শেষ কথাটা খানিক উচ্ছ্বাস নিয়েই যেন বলল আপা। খুশিতে চকচক করে উঠলো আমার চোখজোড়া।
— সত্যি?
— হ্যাঁ। এক্ষুণি ইশির ফুপু শ্বাশুড়ি কল করেছিলেন। বেশ লজ্জিতভাবেই বলল কথাটা। আমি সম্ভাব্য তোর জ্যামে আটকে যাওয়ার কথা বললাম। উনি বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা সাথে ছেলের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষমাও চাইলেন।
— উফফ আপা কতবড় গুড নিউজ দিলে তুমি!
খুশিতে লাফিয়েই উঠলাম আমি।
আপা হয়তোবা হাসি চাপার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তবুও পূর্বের গাম্ভীর্য্য ফিরিয়ে এনে বলল,
— হয়েছে আর রাস্তাঘাটে লাফাতে হবেনা। বাইরে রোদ অনেক, সময় নষ্ট করিস না। বাসায় ফিরে আয়।
— এক্ষুণি?
মন খারাপ করে বললাম আমি।
— তাহলে কি একটু বাইরে সময় কাটাতে চাস? কাটা তাহলে। টাকাপয়সা আছে?
— আছে কিছু।
— ওতে হবে?
— হু হয়ে যাবে।
— তাহলে একটু ঘোরাফেরা কর। বিকেলের আগে ফিরিস কিন্তু।
— আচ্ছা ঠিকাছে। কি করছো তুমি? মেহেদি পরেছ হাতে?
— আমার কি সেই সময় আছে? কাজকর্ম করতে হবে না?
— আচ্ছা তুমি কাজ করো ফেরার সময় আমি মেহেদি কিনে ফিরবো। আজ রাতে তোমায় মেহেদি পরিয়ে দেব আপা। আমি খুব সুন্দর ডিজাইন পারি।
— হয়েছে থাক । ওসবের কোনো দরকার নেই
টাকা নষ্ট করতে হবে না। যাও ঘোরো তুমি, পছন্দের খাবারদাবার খেও। রাখছি।
— আচ্ছা আপা।
ফোন রেখে বড় করে সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করে নিলাম, তারপর খুব দ্রুত পরিকল্পনা করতে শুরু করলাম খুশিটাকে সেলিব্রেট করবো কীভাবে!
পরিকল্পনা করতে করতে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবো, পিছু ঘোরা মাত্র ফট করে খুব শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে দ্রিম করে পড়ে গেলাম মাটিতে। আর টপাটপ কয়েকটা শক্ত জিনিস আমার গায়ে আর মুখের ওপর এসে পড়লো। ব্যথায় মৃদু চিৎকার দিয়ে চোখ কুঁচকে তাকাতেই দেখলাম বেশ কয়েকটা বই এসে পড়েছে আমার ওপর। একটা বই হাতে তুলে নিতেই সামনে থেকে এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
— আরেহ্ দেখে চলবেন তো।
সাথেসাথেই ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি। ভুলটা আমার নাকি সামনের লোকটার? বই রেখে চোখ তুলে তাকালাম লোকটার দিকে। লোক তো নয় কমবয়সী একটা ছেলে। আমার চাইতে অবশ্য বড়ই হবে বয়সে।
এক পলক তাকিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললাম,
— ভুল আমার নাকি আপনার? আপনি ওপাশ থেকে আসছেন, সামনে কে আছে না আছে দেখে চলবেন না?
— আমি কীভাবে জানবো আপনি আড়ালে লুকিয়ে আছেন?
— এক্সকিউজ মি!
কোঁচকানো ভ্রু আরেকটু কুঁচকে গেল আমার।
— এই আপনি সেকেন্ডে সেকেন্ডে ভ্রু কোঁচকাচ্ছেন কেন এভাবে? ভ্রু কোঁচকালে আপনাকে একদম ভালো লাগেনা।
নিচু হয়ে বসে আমার চোখে চোখ রেখে বলল ছেলেটা। আমি অবাক হয়ে গেলাম এমন অকপট কথা শুনে। ছেলেরা এমন মুখখোলা হয় সত্যি?
চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। হাতের বইটা শব্দ করে মাটিতে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বললাম “ননসেন্স”
ছেলেটা ভ্রু কোঁচকালো এবার।
— আপনি বইটা এভাবে আছড়ে ফেললেন কেন?
— ইচ্ছে হয়েছে ফেলেছি। সমস্যা?
— অবশ্যই সমস্যা। স্যরি বলুন বইকে, এক্ষুনি স্যরি বলুন।
বই হাতে নিয়ে এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আমি বিরক্তির সাথে বইটা ধাক্কে সরিয়ে দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললাম,
— যত্তসব ফাউল লোকজন।
এগুতে ছেলেটার কথা কানে ভেসে এলো। বলছে, “আজকালকার মেয়েদের মধ্যে ম্যানার্স জিনিসটা একদমই নেই। বইকে কেউ এভাবে অসম্মান করে?”
বদ্ধ উন্মাদ নাকি? প্রথমে দোষ করলো নিজে তারপর আমার ভ্রু কোঁচকানো নিয়ে কথা শোনালো, এখন আবার বই নিয়ে? আমাদের আশেপাশে এমন পাগল-ছাগলরা ঘুরে বেড়াচ্ছে কই আগে জানতাম না তো!
______________
(১৩)
ফুরফুরে মেজাজটা এক বদ্ধ উন্মাদের কারণে নষ্ট হয়ে গেছিল, অল্প কিছুক্ষণ হলো আবারও ঠিক হয়ে গেছে । জিনিয়া কল করেছিল একটু আগে। ওর বাসায় আজ কেউ নেই। কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ডের জন্য ডাকছে আমাকে। আমিও ভাবছিলাম ওর সাথে সময় কাটাবো। মনের কথাটা কেমন টেলিপ্যাথির মাধ্যমে পৌঁছে গেল ওর কানে। ঠিকানা মেসেজ করে দিয়েছে ও। এখান থেকে বেশি দূরে নয় বাড়িটা। হাঁটতে হাঁটতেই রওয়ানা হলাম। বেশিক্ষণ লাগলো না অবশ্য।
জিনিয়াদের বাড়িটা পুরো দশ তলা। রাস্তার পাশে বিরাট জায়গা জুড়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য মাথার ওপর থাকলে মাথা তুলে তাকিয়ে পুরো দশতলা দেখা যায়না। চোখ কোনোরকমে সপ্তম ফ্লোর অবধি এসে আটকে যায়। তবুও জোরজবরদস্তি করে পুরো দশ তলা দেখে নেবার চেষ্টা করলাম আমি কিন্তু সম্ভব হলোনা। দারোয়ান গেটের বাইরেই বসে ছিল আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে। বিনিময়ে আমি একটা পাল্টা হাসি দিলাম। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল মনে হয় লোকটা। আজ আমি খুব অদ্ভুত আচরণ করছি। অতিরিক্ত খুশিতেই। ব্যাপারটা দারুণ। মাঝেমধ্যে এমন অদ্ভুত হবারও প্রয়োজন আছে।
চাইলে এখন সরাসরি গেট দিয়ে ঢুকে যেতে পারি আমি, কিন্তু দারোয়ান মিছেমিছি সন্দেহ করুক এটা চাইলাম না। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে জিনিয়াকে কল করলাম। আমার কল পেয়ে ছুটে ব্যালকনিতে এলো জিনিয়া। ব্যালকনি থেকেই চিল্লিয়ে বলল,
— ওপরে চলে আয় দোস্ত।
আজিজ মামা ও আমার ফ্রেন্ড, ওকে ভেতরে আসতে দিন।
দারোয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল।
জিনিয়ার কথা শুনে দারোয়ানের আমার থেকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি সরলো। দাঁত বের করে হেসে বলল,
— ওহ্ আপনে ছোটো মায়ের বান্ধুবি? আগে বললেই হইতো। এতক্ষণ রোদের মধ্যে এমনেই দাঁড়ায় থাকলেন।
— সমস্যা নেই। মাঝেমধ্যে রোদের মধ্যেও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ভিটামিন ডি এর অভাব দূর হয় এতে।
— ওহ আচ্ছা ।
গেট খুলে দিতে দিতে আবারও হাসলো দারোয়ান।
লোকটার যে এমন হাসা রোগ আছে এতক্ষণ বোঝা যায়নি। অবশ্য না হাসলেই ভালো দেখায় লোকটাকে। হাসলে কেমন মাড়ি অবধি বের হয়। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু। কেউ একবার দেখলে দ্বিতীয়বার তাকাতে চাইবে না।
,
দশ তলা বিল্ডিং হওয়ায় জিনিয়াদের বাড়িতে একটা দারুণ লিফট আছে, সিঁড়ির পাশেই। লিফটে ওঠা হয়না অনেকদিন। ভাবলাম লিফট দিয়েই যাব কিন্তু কে যে উঠছে এতক্ষণ ধরে! লিফট ওপরে যেতেই আছে, যেতেই আছে আর নামছে না। আমিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না আর। এত হাঁটা পড়েছে যে পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। এখানে ঢুকতে ঢুকতে আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম পায়ের পেছন দিকটা ব্যথা করছে আর জ্বলছে। তখন যে ওভাবে পড়ে গেলাম কিছু লেগে কেটে গেছে বোধহয়!
জ্বলুনি বাড়ছে ক্রমশ। নাহ্ আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছেনা। লিফটের আশা ছেড়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করলাম। ফেরবার সময় নাহয় লিফটে ওঠা যাবে।
জিনিয়াদের সিঁড়িগুলো বেশ উঁচু উঁচু। দ্বিতীয় ফ্লোর অবধি উঠতেই হাঁপিয়ে গেলাম একেবারে। পায়ের ব্যথাটা হঠাৎ বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে কি যে ছোটাছুটি করছে ভেতরে! নাহ্ একটুখানি না বসলে আর হবেনা। শেষ সিঁড়িটায় বসার জন্য মাত্র নিচু হয়েছি ঐ মুহুর্তে কে যেন এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। চকিতে আমি মুখ তুলে চাইলাম। পকেটে হাত পুরে একটা ছেলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছে আমার দিকে। অবাক করা বিষয় হলো ওর ডানপাশের ভ্রুটায় শুধু ভাঁজ পড়েছে, বাঁ পাশের ভ্রু স্থির। কেমন শৈল্পিক ব্যাপার। অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম আমি। ছেলেটার মুখেও কোনো কথা নেই, আমার মুখেও নেই। এভাবেই আমরা কতক্ষণ থাকলাম জানা নেই। তবে নিস্তব্ধতা ভাঙলো ছেলেটাই। হঠাৎ একদম হঠাৎ করেই তার মুখ দিয়ে জীবনানন্দ দাশের “নীলিমা” কবিতার চার লাইন সেতারের সুরের মতো বেরিয়ে এলো,
“তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙেছো মায়াবী!
জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী;”
আমি বিস্মিত হয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পায়ে টান লেগে দাঁড়ানো আর সম্ভব হলোনা বরং পা স্লিপ কেটে উল্টোদিকে পড়ে যেতে নিলাম। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল তড়িৎ। এই উঁচু সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলে নির্ঘাত কোমর ভাঙবে। ভেবেই চোখ অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেল আমার। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মাথায় একটা হ্যাঁচকা টান লাগলো। উল্টোদিকে না পড়ে পড়লাম সামনের দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শৈল্পিকভাবে ভ্রু কোঁচকানো ছেলেটার বুকে। হ্যাঁ ও-ই আমাকে আছাড় খাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে।
আছাড় খাইনি ভেবে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ার পর যখন উপলব্ধি করলাম আমি একটা ছেলের বুকে তখন সাথেসাথেই দু’হাতে ঠেলে তাকে সরিয়ে দিলাম। ছেলেটা দু কদম পেছনে গিয়ে একটু থেমে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনার কোথাও লাগেনি তো?
— ন..নাহ্।
দ্রুত হাতে চুল ঠিক করতে করতে বললাম আমি।
— ওহ্ আচ্ছা । কোথায় যাচ্ছিলেন যান। সাবধানে যান কেমন?
কথাটা বলে আমাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত বেগে নেমে যেতে শুরু করলো ছেলেটা। সাথে পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল দিয়ে বলল,
— কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ে গেছে রে।
আমি অবাক হয়ে প্রস্থান দেখছিলাম ছেলেটার। সর্বশেষ সিঁড়িটায় গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো ও। তারপর আমার দিকে ফিরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
— থ্যাঙ্কিউ সো মাচ্। আপনার জন্যই মনে পড়েছে কবিতার লাইনগুলো। আসি কেমন? সাবধানে যাবেন কিন্তু।
এরপর আমাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে ছেলেটা তরতর করে হেঁটে চলে গেল।
আমি ওখানে দাঁড়িয়ে বোকার মতো মাথা নাড়লাম। আমার কারণে কবিতার লাইন মনে পড়েছে? এ তো দেখছি আরেক অদ্ভুত ছেলে।
আচ্ছা আজ আমার সাথে এত অদ্ভুত ছেলেদের দেখা হচ্ছে কেন?
চলবে,
sinin tasnim sara