ভালোবাসার রংধনু,১৫,১৬
sinin tasnim sara
১৫
______________
২৬.
ব্যাগের মধ্যে অনবরত ফোনটা বেজে চলেছে। ব্যাগটার ওপর হাত রেখে বসায় স্পষ্ট ভাইব্রেশন টের পাচ্ছি আমি। কে ফোন দিতে পারে ধারণা করার চেষ্টা করছি। আপা অবশ্যই, নাকি প্রীতম সাহেব? আচ্ছা এতক্ষণে সে নিশ্চয়ই বউ নিয়ে বাড়িতে উঠে গেছে!
আপা কি সেই নিউজ আমাকে জানাতে চায়? আমি জানি প্রীতম সাহেব তার বিয়ে সম্পর্কিত ঘটনায় আমার সম্পৃক্ততা কোনোভাবেই প্রকাশ করবে না কারোর সামনে। তবুও আপা বুঝে যাবে। ভীষণ চালাক সে;এবং দোষটা আমার সাথেসাথে ইনতিসারের ঘাড়েও চাপবে। ইনতিসার আর আমার মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে এটা বোধহয় শিওর হয়ে যাবে আপা। দুশ্চিন্তা লাগছে না আমার। আপা যে আমার ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছে ভাগ্যিস আগেই বলে দিয়েছিল;নইলে এখন কষ্টটা বেশি লাগতো। আমি আবার মানসিক চাপে থাকলে সব কাজে গোলমাল করে ফেলি। কত সেন্সিটিভ একটা সময় যাচ্ছে আমার! এডমিশান। মুখের কথা তো নয়।
— কি রে কোন ভাবনায় হারিয়ে গেলি?
জিনিয়া আমার হাতের ওপর অল্প করে চাপ দিলো। ওর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম আমি।
— হারাইনি। আচ্ছা এখন তো নিতুল নামক মেয়েটা চলে গেছে। আমিও চলে যাই?
মাথা নেড়ে গলা খাদে নামিয়ে বললাম। জিনিয়া একবার সবার দিকে তাকালো। সবাই খেতে ব্যস্ত। সেও আমার মতো খুব আস্তে আস্তে বলল,
— খাওয়াটা শেষ হলেই চলে যা?
— খেতে ইচ্ছে করছে না। খুব আনকমফোর্টেবল লাগছে।
— ওয়াশরুমে যাবি?
— না অন্য ব্যাপার।
— কি? আমাকে বল?
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলো জিনিয়া।
— হঠকারী সিদ্ধান্তে যে এতবড় একটা কাজ করে ফেললাম, এর ফলাফল কি হবে? আইডিয়া করতেও ভয় লাগছে।
জিনিয়া বুঝতে পারলো এই সিচুয়েশনটার কথা বলছি। এবার ও সরে নিজের জায়গায় বসলো। সবাই এতক্ষণ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের দেখছিল কিন্তু প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চায়নি। ঘটনা যা ঘটে গেল তা তো মোটেই স্বাভাবিক কিছু না৷
জিনিয়া দু মিনিট চুপচাপ স্বাভাবিকভাবে খাবার খেলো। তারপর বাকি খাবার রেখে আমার হাত টেনে ধরে উঠতে উঠতে বলল,
— আমরা একটু ওয়াশরুম থেকে আসি?
অন্ত সাহেব একবার জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কিছু তারপর কি ভেবে আর করলো না। কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
ব্যাগটা সাথে করেই নিয়ে এসেছিলাম আমি। সুযোগমতো ফোন বের করে ফেললাম। কে অনবরত কল দিচ্ছে দেখা প্রয়োজন। নোটিফিকেশন বারে দেখি এতটুকু সময়ের মধ্যে সাঁইত্রিশবার কল এসেছিল। কয়েকটা আপার থেকে আর বাকি সব ইনতিসারের নম্বর থেকে৷ ও এতবার কল করেছে আমাকে! একটু অবাকই লাগলো৷ একবার ভাবলাম কল ব্যাক করি তারপর মনে হলো থাক দরকার নেই, আজেবাজে কথা বলে মাথা নষ্ট করে দেবে। কথাবার্তা হলে বাসায় গিয়েই হোক। ফোন সাইল্যান্ট করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। জিনিয়া ওয়াশরুমের পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।
অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বলল,
— স্যরি রে তোকে জড়িয়ে ওরকম মজা করাটা আমার একদমই উচিৎ হয়নি।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছোট্ট জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকালাম।
— স্যরি তো আমার নিজেকে বলা উচিত হাজারবার। এত হোঁচট খেয়েছি তবুও আমার শিক্ষা হয়নি। ভাবনাচিন্তা করে কোনো ডিসিশন আজও নিতে পারিনা আমি। বিয়ে বিয়ে নামক মিথ্যে নাটকটার জন্য এখন যে রিগ্রেট ফীল হচ্ছে, ঠিক-ভুলের বুঝ যেটা এখন আসছে;ঘন্টা দুই আগে এলেও নতুন কোনো বিপদের আশংকা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারতাম।
— অন্ত ভাইয়া সেরকম ছেলেই নয় যে তোর বিপদ ঘটাবে।
— আমি কীভাবে জানবো সে কিরকম ছেলে! তোর ভাই তুই জানবি। আমি তো সেই শ্রেণির মানুষ যে নিজের কবর নিজেই খুঁড়ে বসে আছে। নইলে দু একদিন চোখাচোখি হয় যে ছেলের সাথে সে সামনে এসে হঠাৎ এক গল্প বলে আমার হেল্প চাইলো তাও আবার বিয়েশাদীর মতো সেন্সিটিভ বিষয় নিয়ে নাটক! আমি ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে তার কথায় সমর্থন জানালাম। মানুষ আমাকে পাগল ছাড়া আর কিচ্ছু বলবে না। আসলে ঐ মুহুর্তে কি যে হলো আমার! সব তালগোল পাকিয়ে ফেললাম। তোর সাথে বিষয়টা এমনভাবে সম্পর্কিত,এজন্যই বোধহয় আমার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছিল। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না তুই এরকম কোনো কাজ করেছিস।
অথবা এরকমও হতে পারে তোকে কল করার পর অন্ত সাহেবকে আমার মাইন্ড ট্রাস্টওয়ার্দি মনে করেছে তাই হুট করে ভয়ংকর সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম।
এতটুকু বলে একটু থামলাম।
— উফফ কি যে লজিকলেস কথাবার্তা বলছি! মনে হচ্ছে মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে আমার।
মাথা দু’হাতে চেপে ধরে আমিও দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। আমার এত অস্থিরতা দেখে জিনিয়া এগিয়ে এলো। কাঁধে হাত রেখে আমতাআমতা করে বলল,
— এত অস্থির হোস না দোস্ত। ভুল একটা হয়ে গেছে এখন কি আর সেটাকে পাল্টাতে পারবো কোনোভাবে! সত্যি বলতে আমি ভাবিওনি তুই ভাইয়ার এক কথায় রাজি হয়ে যাবি। ভাইয়া যখন প্রথম আমাকে এই প্রস্তাব দেয় তখনই বলেছিলাম তুই কখনোই এরকম কিছুতে রাজি হবি না। অন্য কোনো উপায় খুঁজতে হবে। কিন্তু সে উপায়টা কি আমরা বুঝতে পারছিলাম না।
ভাইয়া বলল সে চেষ্টা করে দেখুক একবার তুই মানিস কি না! নইলে এই প্ল্যান বাদ। আমি একপ্রকার শিওরই ছিলাম প্ল্যানটা বাদ যাবে। বাট তুই আমাকে সত্যিকার অর্থে অবাক করে দিয়েছিস।
জিনিয়ার কথাগুলো আমি চুপচাপ শুনলাম প্রথমে, কোনো রা করলাম না। তারপর একটু সময় নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম,
— আসলে তোকে দোষারোপ করেই বা লাভ কি! আমার ঠিক ভুল আমারই বোঝা উচিৎ। এতবড় গাধামির কাজ করলাম এখন এর ভোগান্তিটা আমার খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া উচিৎ। তোকে শুধু একটা রিকোয়েস্ট করবো ওসব ছবি টবি যত আছে ডিলেট করানোর ব্যবস্থা করিস।
— কোথায় যাচ্ছিস তুই?
— বাসায়। মেন্টালি একদমই স্টেবল না আমি। এখানে আর একমিনিট সময়ও ব্যায় করা সম্ভব না আমার পক্ষে।
— আমি তোকে পৌঁছে দি?
— প্রয়োজন নেই। আমি একা যেতে পারবো। আর হ্যাঁ, প্লিজ ওনাদের বলে দিস আমি চলে গেছি। না বলে যাওয়াটা বেয়াদবি হয়ে যায় হয়তো। তবে আমার এই মুহুর্তে খুব বেয়াদবি করতে ইচ্ছে করছে। ওনাদের কারোর মুখও দেখতে ইচ্ছে করছে না।
— নীরদ আমার ভাই মানুষটা খারাপ না রে। বিশ্বাস কর তোর কোনো বিপদ হবেনা।
— বিশ্বাস করলাম।
একপলক জিনিয়ার কাতর মুখখানার দিকে তাকিয়ে প্রস্থান করলাম আমি।
_______________
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখি বেসমেন্ট পার্কিংয়ের কাছে একটা জটলা মতো বেঁধেছে।
বিষয়টা ইগনোর করে হয়তোবা চলে আসতাম কিন্তু দুলাভাইয়ের মতো কারোর গলা শুনতে পেয়ে পা দু’টো আমার আর এগোলো না। পিলপিল পায়ে এগিয়ে গেলাম জটলাটার কাছে। গিয়ে দেখি পার্কিংয়ের সামনে যে দারোয়ান বসে থাকে তাকে বেধড়ক মার মারছেন দুলাভাই সাথে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। অথরিটি জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের থামাতে কিন্তু পারছে না।
ঘটনাটা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লোকটাকে মারছে কেন দুলাভাই? পাশে থেকে কেউ যেন বিড়বিড় করে খুব তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
— এসব কোটিপতি বিগড়ে যাওয়া লোক মনে করে, টাকাপয়সা আছে পৃথিবীটাই এখন তার কেনা। লোকলজ্জার ভয় না করে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা করে বেড়াবে আর তাদের আটকাতে গেলে এভাবে অত্যাচার! ছিঃ দেশটা একেবারে রসাতলে গেছে।
চাপা রাগ নিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল ব্যক্তিটা। আমি একরাশ ভয় নিয়ে একবার দেখলাম লোকটার প্রস্থান। অশ্লীলতা করেছে দুলাভাই! এই অশ্লীলতা কি আমি যা ভাবছি তাই?
মনে মনে প্রার্থনা করলাম আমার ধারণা ভুল হোক;এতটাও নোংরা হয়ে যায়নি দুলাভাইয়ের মন মানসিকতা। একমনে প্রার্থনা করতে করতে চারিদিক ভালোভাবে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কোনো মেয়ে মানুষ আছে নাকি দুলাভাইয়ের সাথে!
বেশি একটা কষ্ট করতে হলোনা অবশ্য, আমার ভয়কে সত্যি করে বেশ আধুনিক পোশাক পরিহিতা এক রমনী টিস্যু চেপে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো কোত্থেকে। দুলাভাইকে দু’হাতে জাপ্টে ধরে টেনে সরিয়ে নিলো দারোয়ানের থেকে। গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খুব আদুরে স্বরে শান্ত করলো দুলাভাইকে। দুলাভাইও যেন তড়িৎ শুনলো তার কথা। দুলাভাই একটু শান্ত হলে সে উপস্থিত সকলের দিকে তীর্যক চোখে তাকিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
— কি? সার্কাস শেষ তো। নাউ গেস্ট লস্ট।
রীতিমতো ধমক খেয়ে সবাই সুরসুর করে বেরিয়ে যেতে লাগলো। একজনকে দেখলাম আহত দারোয়ানকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। সবাই স্থানত্যাগ করলেও আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম নির্বাক ওদের দিকে তাকিয়ে। একজন এখনও যায়নি বুঝতে পেরে মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো। আমার চোখে চোখ রেখে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় হয়তোবা জিজ্ঞেস করলো,
— কি? সবাই গেল তুমি বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে কেন?
আমি উত্তরে কিছু বলতেও পারলাম না, একচুল নড়তেও পারলাম না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম দুলাভাইয়ের দিকে। এই মানুষটা এত জঘন্য! আমার আপাকে না ভালোবেসে বিয়ে করেছিল! তবে ধোঁকা দিলো কেন? আচ্ছা মানুষের ভালোবাসা পাল্টায় কেন? এর পেছনে কারণটা কি! আমার আপা যে এই ধোঁকাবাজটাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এ জানেনা? আজ যেভাবে আপার ভালোবাসাকে এ অপমান করছে, একদিন এর শতগুণ অপমান ফিরে আসবে এর কাছে। এই অমানুষের শাস্তি হবেই একদিন!
দুলাভাইয়ের প্রতি রাগটা দাঁত পিষে নিয়ন্ত্রণ করলাম আমি। যেতে উদ্যত হবো সেই মুহুর্তে দুলাভাইয়ের দৃষ্টি পড়লো আমার ওপর। ঘাবড়ে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো সে। কিছু বলবে,আমি আর সুযোগ দিলাম না কেবল শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাঁটা ধরলাম।
,
ফুটপাত দিয়ে বেখেয়ালে হাঁটছি অনেকক্ষণ, কোনো গন্তব্য নেই। থাকবে কীভাবে! ওই বাড়িটাতে আর পা দিতে ইচ্ছে করছে না। কীভাবে মুখোমুখি হবো আপার? ওর অসহায়ত্ব খুব করে উপলব্ধি করি এখন। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়৷ ও আমার জন্য এতকিছু করলো অথচ আমি, কিচ্ছু করতে পারলাম না ওর জন্য। আমি জানি আমার জন্যই ওই অমানুষটার সাথে সংসার করে যেতে হচ্ছে আপাকে। মাথার ওপরের ছাদটা যেন সরে না যায় এজন্য এত কষ্ট করছে। আমাদের অসহায়ত্ব দেখে অমানুষটারও বোধহয় পৈশাচিক আনন্দ হয়। সেজন্যই তো নির্লজ্জতা এভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
আমারও যে ধৈর্যের ধনুক টান টান হয়ে ছেঁড়ার দশা! কবে মুক্তি পাবো এই জাহান্নাম থেকে?
এসব উল্টোপাল্টা ভাবনায় ডুবে রাস্তা পার হচ্ছিলাম কোত্থেকে একটা জাম রঙা গাড়ি এসে ব্রেক করলো সামনে। ঘাবড়ে দু কদম পেছনে সরে গেলাম আমি। মুখ দিয়ে নোংরা গালি বেরুতে চাইলো তড়িৎ, এমন সময়ে মৃদু শব্দে খুলে গেল কার ডোরটা। ওপাশ থেকে খুব পরিচিত গম্ভীর গলা ভেসে এলো,
— সময় নষ্ট না করে গাড়িতে উঠে বসো নীরদ।
আমি বিস্ময় নিয়ে মাথা নীচু করে দেখলাম, চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে ইনতিসার। বলতে চাইলাম,
— আপনি এখানে কীভাবে?
বলা হলো না। মুখ ঘুরিয়ে তাকালো সে আমার দিকে। তার দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল আলজিভ পর্যন্ত কথা এসে আটকে গেল আমার। উচ্চবাচ্য না করে উঠে বসলাম গাড়িতে। গাড়িতে ওঠবার কয়েক সেকেন্ড পরে একদম হঠাৎ চোখের পর্দায় ঘন্টা দু-তিনেক আগের একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো। এরকমই একটা জামরঙা গাড়ি আমি দেখেছিলাম অন্ত সাহেবের সাথে কথা বলার সময় রাস্তায়। এই গাড়ি আর ঐ গাড়ি প্রায় এক।
তবে কি তখনকার গাড়িটা এটাই? আর গাড়ির ভেতরের মানুষটা ইনতিসার!
চলবে,
sinin tasnim sara
ভালোবাসার রংধনু
১৬
____________________
২৭.
ইনতিসারদের বাড়ি থেকে অল্প দূরে বিরাট জায়গা জুড়ে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। সারাদিন খুটখাট শব্দ চলতেই থাকে এখানে, কিন্তু আজ বেলা না গড়াতেই সব চুপচাপ। গন্তব্যহীন রাস্তার পাশে উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর সামনে গাড়িটা মূর্তিমান দাঁড়িয়ে। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনো মানুষের ছায়া নেই। কেবল আমরা দু’জন দাঁড়িয়ে আছি পরস্পরের থেকে দশ কদম আগে আর পরে। ইনতিসার তার ফোনটা হাতের মুঠোয় খুব শক্ত করে চেপে ধরে পায়চারী করছে। রাগ কমানোর বৃথা চেষ্টা! তিল পরিমাণও যে কমছে না তা বোঝা যাচ্ছে খানিক পর পর রাস্তায় পড়ে থাকা ছোট ছোট কংক্রিট গুলোতে ওর তালগাছ সমান পায়ের ফাঁকা লাথি পড়তে দেখে। একটাও নিজ জায়গা থেকে সরছে না তবে ও অধৈর্য হয়ে পড়ছে ওগুলোকে জায়গাচ্যুত করবার জন্য। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি ওর কর্মকাণ্ড। মনে হচ্ছে কংক্রিট নয় ও আমাকে এভাবে লাথি দিয়ে দূরে কোথাও পাঠাতে চাচ্ছে। পারছে না শুধু ভালোবাসে তাই। বিষয়টা খুব বিরক্তিকর। অযাচিতভাবে আমার জীবনে ইনতিসারের দখল দেয়াটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এই একটা সমস্যাই বোধহয় আমার মাথায় দীর্ঘদিন ধরে বোঝা হয়ে আছে যেটা থেকে মুক্তি মিলছে না। ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গাড়িটার দিকে তাকালাম। হুডের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে মনে পড়ল অল্প কিছুক্ষণ আগের কথা। ওর এই আচনক রাগের কারণ বলছি, তার আগে বলি তখন রাস্তায় জাম রঙা যে গাড়িটা দেখেছিলাম সেই গাড়িই হলো এই গাড়ি। অর্থাৎ ইনতিসার অন্ত’র সাথে আমায় দেখে নিয়েছে শুরুতেই। গাড়িতে ওঠার পর ওর থমথমে মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম কিছু একটা হয়েছে।আমার ভাবনা সত্যি হলো শেষ পর্যন্ত। বাড়ির রাস্তা ধরলেও ও যখন বাড়ি ক্রস করে এদিকটায় আসছিল তখন একটু নড়েচড়ে বসলাম। না রেগে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলাম,
— বাড়ির গলি তো ক্রস করে গেল। কোথায় যাচ্ছি আমরা?
ও শুধু অপেক্ষা করছিল কখন আমি কথা শুরু করি! তারপরই কষ্ট করে আটকে রাখা ওর রাগের
পারদ ভাঙলো আমার ওপর। গাড়ির স্পিড বেড়ে গেল আচমকা। চোখের পলক ক’বার পড়েছে, দেখি আমরা এই রোডে ।
গলা চড়িয়ে বললাম,
— সমস্যা কি?
সাথেসাথেই কষে এক ব্রেক চাপলো ও। পকেট থেকে ফোন বের করে ছুঁড়ে দিলো আমার দিকে। ফোনটা এসে পড়লো আমার কোলের ওপর। ভ্রু কুঁচকে ফোন হাতে নিয়ে দেখি একটা ছবি বার করা। ছবিতে আমি আর অন্ত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি কাজি অফিসের সামনে।
ছবিটা দেখার পর আমার ভেতর থেকে কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিশ্চয়ই ভুল বুঝেছে এই ছেলে! যাক ভালোই হয়েছে, এবার তবে ছাড়া পাবো এর হাত থেকে।
ছবি দেখার পরেও আমায় স্বাভাবিক দেখে ইনতিসারের রাগ বেড়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে সে প্রশ্ন করলো,
— এই ছেলেটা কে? ওর সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক?
প্রথমবারে আমি কোনো জবাব দিলাম না। আমায় মৌন দেখে ও শক্ত করে আমার বাহু চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ফের একই প্রশ্ন করলো।
ওর বজ্রমুষ্ঠিতে মনে হলো আমি হাতটা আর অনুভব করতে পারছি না, এত জোরে চেপে ধরেছিল! একটা ঢোকের সাথে ব্যথা হজম করে বললাম,
— ছবিটা দেখলেই তো স্পষ্ট বুঝে যাওয়ার কথা ছেলেটার সাথে আমার কিসের সম্পর্ক! আপনি বুঝতে পারছেন না?
— না বুঝতে পারছি না। তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই আমি।
— আমার মুখ থেকে শুনলে সেটা কি মেনে নেয়ার মতো হবে?
ও এবারে আরেকটু নিকটে টেনে নিলো আমায়। খুব কাতর হয়ে বলল,
— আমার ভালোবাসাকে বারবার এত অসম্মান কেন করো নীরদ?
ওকে এক ফোঁটাও রাগতে না দেখে খানিক অবাক হলাম আমি। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
— এক ভালোবাসার গান আর কত গাইবেন? একটা মেয়ে আপনাকে পছন্দ করেনা, কন্টিনিউয়াসলি রিজেক্ট করে যায় তবুও তার পেছনে এভাবে সময় নষ্ট করছেন। ইনতিসার আপনি কি জানেন আপনার এসব আচরণ কতটা মেন্টাল প্রেশার দেয় আমাকে? আর কীভাবে বোঝালে বুঝবেন আপনার থেকে মুক্তি চাই আমার?
হতাশ ভাবে বললাম আমি। আমার কথা শুনে খানিক চুপ করে রইলো ইনতিসার। তারপর অন্যরকমভাবে হেসে বলল,
— তাই বোধহয় নিজে থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে নিয়েছ?
— হ্যাঁ তাই। এই যে ছবিতে ছেলেটাকে দেখছেন, ওর সাথে ঘণ্টা দুই আগে বিধিসম্মতভাবে বিয়ে করেছি আমি । হাজবেন্ড হয় ও আমার। আমার জীবনের একমাত্র ভালোবাসার মানুষ।
কথাগুলো এত দৃঢ় স্বরে বললাম যে ইনতিসার বিভ্রান্ত হয়ে গেল কিছু সময়ের জন্য। তারপর আমার বাহু ছেড়ে দিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীর এবং স্পষ্ট স্বরে বলল,
— বিশ্বাস করতে পারলাম না নীরদ। তুমি যতই চিল্লিয়ে অস্বীকার করতে চাও বাট তোমার লাইফে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কক্ষনও নেই৷ আসতে পারেনা। এই বিয়ের গল্প পুরোটা মিথ্যে। তুমি মিথ্যে বলছ আমায়।
আমাকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল ও। তারপরেই এমন উদভ্রান্তের মতো আচরণ।
ত্রিমাত্রিক এসব চাপ এবার আমায় পাগল করে দেবে মনে হচ্ছে। খুব আজেবাজে খেয়াল মাথায় আসছে। আচ্ছা আমি যদি নিজের সাথে কিছু করে ফেলি তাহলে কি আপা খুব কষ্ট পাবে? নাকি চিরতরের জন্য আমার হারিয়ে যাওয়াটাই সকল সমস্যার সমাধান হবে?
হাতমুড়ে চোখ বন্ধ করে গাড়িটার সাথে মিশে দাঁড়ালাম। খুব ক্লান্ত লাগছে। এত বোঝা আর বইতে পারছি না।
আরও কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর শেষ পর্যন্ত ইনতিসার আমার দিকে ফিরলো। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বড় বড় কদম ফেলে সামনে এসে দাঁড়ালো।
— আমি একটা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি নীরদ। আমরা এক্ষুনি এই মুহুর্তে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করবো।
ইনতিসারের মুখে এ কথা শুনে আমি বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে গেলাম। ছেলেটার মাথার ভেতর কি মস্তিষ্ক জিনিসটা নেই? আমি যে বললাম আমার বিয়ে হয়ে গেছে ও বুঝতে পারেনি বিষয়টা? বিস্ময়ের সাথেই বললাম,
— আপনি কি পাগল? কথা বোঝেন না? বিবাহিত মেয়েকে আবারও বিয়ে করবেন!
এবারে হাসলো ও। আমার হাত আলতো করে চেপে ধরে বলল,
— বারবার মিথ্যে বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে পরিস্থিতি ঘোলা করতে চাইলেই আমি সে সুযোগ তোমায় দেবো কেন? এই পৃথিবীতে আমার চাইতে তোমায় কে ভালো চেনে নীরদ? আমার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এতই ডেস্পারেট হয়ে গেছ যে মিথ্যেমিথ্যি বিয়ের গল্প ফাঁদতে শুরু করেছ। বিষয়টা কষ্টের হলেও হাস্যকর।
— সিক কথাবার্তা।
রোষের সাথে হাত ছাড়িয়ে নিলাম আমি। সব প্ল্যান ফেইলড হতে দেখে মেজাজ চটে গেল আমার। ভেতরের সব রাগ উগড়ে না দিলে আর শান্তি পাবোনা। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— আপনার মতো মস্তিষ্ক বিহীন পাগল ছেলে আমি আমার লাইফে দ্বিতীয়টা দেখিনি। সাথে এতবড় লম্পট। শেষ পর্যন্ত আপনি আপনার আসল চরিত্র দেখিয়েই দিলেন। একটা ম্যারেড মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া.. ছিঃ!
সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ আপনারা কেবল লোকচক্ষুর সামনেই;আড়ালে এমন চরিত্রহীন-লম্পট।
— এ্যাই নীরদ!
হুংকার দিয়ে উঠল ও। ক্রোধে চোখদুটো টকটকে লাল বর্ণের হয়ে গেছে, কপালের শিরা ফুলে কি ভয়ানক মুখভঙ্গি! সুযোগ পেয়ে গেলাম আমি। এই ক্রোধকেই কাজে লাগাতে হবে।
ওর চাইতে দ্বিগুণ চিৎকার করে বললাম,
— চেঁচাবেন না একদম। অনেক সহ্য করেছি আপনার অত্যাচার। কিছু বলিনা, ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে থাকি বলে পেয়ে বসেছেন আমাকে?
শুনে রাখুন আর চুপ করে থাকবে না এই নীরদ। আজ এই মুহুর্ত থেকে যদি আপনি আমার পিছু না ছাড়েন তবে আমি আপনার নামে হ্যারাসমেন্টের কেইস করে দেব। কারোর সম্মান দেখতে যাব না আর। যদি আইনের পথে হেঁটে এই মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তি মেলে তাহলে হলো নইলে শেষ উপায় হিসেবে..
— হিসেবে?
— নিজেকে শেষ করে দিতে হাত কাঁপবে না আমার।
ইনতিসার হাতে পায়ে চমকে উঠল একথা শোনার সাথেসাথে। টুকটুকে লাল চোখে ওর হালকা পানির আভাস। পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। শক্ত চোয়ালের ওর মুখের ভাষা বোঝা বড্ড কঠিন৷ আমি তবুও নিষ্পলক বোঝার চেষ্টা করছি ওর অভিব্যক্তি। ওর চমক কেন যেন দ্রুত কাটলো। ঠোঁটে ফুটে উঠল ক্রুর হাসি। আমি বিভ্রান্ত বোধ করলাম সে হাসিতে।
ইনতিসার এবার শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে গাড়িতে হেলান দিয়ে বাঁ হাত পকেটে পুরে হাতড়ে হাতড়ে সিগারেট আর লাইটার বের করলো। খুব আয়েশের সাথে তা জ্বালিয়ে বুড়ো আঙুলে নিজের ভ্রু চুলকোলো একবার। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ঠোঁট গোল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
— তাহলে আমরা সমাপ্তির দারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি তাই তো? ওকে তোমার আমার থেকে মুক্তি চাই না নীরদ? দেব তোমায় মুক্তি;তবে একটা কথা জেনে রাখবে,তুমি আজকে আমার ভেতরে যে ক্রোধাগ্নি জ্বালানোর চেষ্টা করছো এর আঁচ পরে তোমার গায়েই লাগবে পুরোটা। তখন সে অপরাধবোধের দহন সইতে পারবে তো?
ওর ইঙ্গিত কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারলাম বোধহয়। অস্থির ভাবে বললাম,
— খবরদার আপনি আমাদের মাঝে অন্তকে টানবেন না। ওর কিছু হলে ছেড়ে দেব না আমি আপনাকে। ওয়ার্ন করছি।
ইনতিসারের ঠোঁটে এখনও ভয়ানক হাসিটা লেপ্টে রয়েছে।
— স্যরি হানি৷ তোমার ওয়ার্নিংয়ে ইনতিসার ভয় পেলো না। ইনতিসার ভয় পেতে শেখেই নি কখনও।
— অন্তর এসবে দোষ নেই ইনতিসার।
রাগে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করলো আমার। ইনতিসার এক পলক ক্রন্দনরত আমাকে দেখে আবারও ধীরকন্ঠে বলল,
— তুমি বারবার ওই ছেলেটার কথা তুলছ কেন? ওকে নিয়েই এত ভয় কেন? আমি কি একবারও বলেছি ওর ক্ষতি করবো?
— আমি জানি আপনি প্রতিশোধ ওর ওপর দিয়েই তোলার চেষ্টা করবেন। আমি..আমি কিন্তু ওয়ার্ন করছি আপনাকে!
ইনতিসার তোয়াক্কা করলো না আমার কথা। খুব অবহেলায় হাতের সিগারেটটা ফেলে গাড়ির ডোর খুলতে খুলতে বলল,
— চলো তোমায় পৌঁছে দিই।
— আমার কথা এখনও শেষ হয়নি ইনতিসার।
— শেষ হয়নি? তুমি মুক্তি চাইলে আমিও দেব বললাম। এখন আবার নতুন করে কি চাও?
— এত সহজে যে আমায় মুক্তি দেবেন না তা আমি ভালো করেই জানি । আপনি অবশ্যই ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন আমার, আর সেখানে অন্তকেও জড়াবেন। তবে শুনে রাখুন সেরকম কিছু করার যদি চেষ্টা করেও থাকেন তার ফলাফল কি হতে পারে আগেই বলে দিয়েছি আমি। ফলাফলের চিন্তা করে তারপর কাজ করবেন।
গাড়ির সিটে ফেলে রাখা ব্যাগ টেনে বের করে নিয়ে হাঁটা ধরলাম আমি। পেছন থেকে শোনা গেল ইনতিসারের মৃদু হাসি তবে ফিরে তাকালাম না আর।
জিনিয়াকে একবার কল করতে হবে। ওর ভাইকে যেন সাবধানে থাকতে বলে। কে জানে কখন কি করে বসে সাইকোটা!
__________
২৮.
দূর্বল শরীর নিয়ে হেঁটে আসতে আসতে যখন বাড়িতে পৌঁছুলাম তখন মাগরিবের আজান পড়ছে। বাড়ির বাইরে আমার জন্য অপেক্ষমান ছিল আপা। আমি যেতেই হাত ধরে টানতে টানতে সোজা ঘরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। তারপর দরজায় খিল দিয়ে ধমকের সুরে বলল,
— কোথায় ছিলি সারাদিন? এতবার কল করেছি কোনো খবর নেই তোর। কতবড় কাণ্ড হয়ে গেছে এদিকে। প্রিতম নাকি বিয়ে করে বউ ঘরে তুলেছে।
বিকেলেই ওর মা কল করেছিল। বেচারি কি কান্নাকাটি করছে! হাজারবার স্যরি বলল আমাকে। আমিও অবাক হয়ে গেছি। প্রেমিকা থাকলে বিয়েতে রাজি হলো কেন ছেলেটা?
একটু থামলো আপা। তারপর কি মনে করে সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— আচ্ছা তুই কি কিছু জানতিস এ ব্যাপারে?
আমি শুনলাম ওর সব কথা কিন্তু সাড়া দিলাম না।ওসবে মন নেই আমার। কোত্থেকে এত কান্নারা এসে ভীড় জমাতে শুরু করলো যে!
সামলাতে পারলাম না নিজেকে৷ আপাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলাম।
আপা আমায় কাঁদতে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। মাথায় হাত রেখে শুধলো,
— আরে নীরদ, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন এভাবে?
আপার বুকে মাথা রেখেই আমি বললাম,
— আপা আমাকে ভুল বুঝো না। একটা কথা বলতে চাই।
— হ্যাঁ বল? এসবের সাথে কি তোর কোনো সম্পৃক্ততা..
— এসব বিষয়ে নয় আপা।
অধৈর্য হয়ে বললাম আমি।
— তাহলে?
— আসলে আপা, আমি বলতে চাইছিলাম..
তুমি কিন্তু আমায় ভুল বুঝবে না বলো?
কাতর দৃষ্টিতে চাইলাম আপার দিকে।
আপা সস্নেহে আমার গালে হাত রাখলো।
— আচ্ছা ভুল বুঝবো না। বল তুই।
— আপা, আমার যাবতীয় খরচের জন্য তোমার অ্যাকাউন্টে যে টাকাটা রাখা আছে, পুরো অ্যামাউন্টটা কি আমার সেভিংস অ্যাকাউন্টটায় ট্রান্সফার করতে পারবে?
— হঠাৎ একথা কেন নীরদ?
অবাক হলো আপা।
— আমি আর এই বাসায় থাকতে পারছি না আপা।বিশ্বাস করো, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে এখানে। ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়া পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে পারবো না আমি। অন্য কোথাও শিফট করা খুব দরকার আমার জন্য।
— কি হয়েছে বোন? খুলে বল তো আমাকে। তোর কি ইনতিসারের সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে?
চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আমার গালে-মুখে হাত বুলোতে লাগল আপা। আপার অবিশ্বাস এখনও অবিচল। কান্না বেড়ে গেল আমার। হাতজোড় করে বললাম,
— যার সাথে সম্পর্কই নেই তার সাথে ঝামেলার কথা আসছে কোত্থেকে আপা? তুমি অন্তত আমাকে অবিশ্বাস করা বন্ধ করো। আমি আর নিতে পারছি না।
— আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হ তুই। পানি খাবি?
— না আপা। আমি যা বলছি তা একটু শোনো। আজই আমি এই বাড়িটা ছাড়তে চাই। তোমার কাছে কোনো ক্যাশ থাকলে প্লিজ দাও আমাকে।
— এখন এই ভর সন্ধ্যেবেলা কোথায় যাবি তুই? মাথা ঠান্ডা রেখে কোনো ডিসিশান নিতে হয়।
— আমি মাথা ঠান্ডা রেখেই ডিসিশান নিয়েছি আপা। আমি তোমার পায়ে পড়ছি প্লিজ আমাকে সাহায্য করো।
আপার পায়ে ধরতে গেলে ও ছিটকে সরে গেল একটু।
— ছিঃ ছিঃ নীরদ কি করছিস তুই? আচ্ছা ঠিকাছে তুই যা বলবি তাই হবে। একটু বস আমি দেখছি টাকাপয়সার বিষয়টা।
আপা খুব চিন্তিত মুখে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
আমি ওভাবেই বসে কিছুসময় কাঁদলাম তারপর চোখ মুছে ধীরগতিতে উঠে দাঁড়ালাম। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে পড়তে চাইছে। বরফ শীতল পানিতে ঘণ্টা কয়েক ডুবে থাকতে পারলে ভালো লাগতো।
নাহ্ এসব আমলে নেয়া যাবেনা। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে এখন। আজ যেকোনো উপায়ে বাসাটা থেকে বেরুতে হবে আমার। রাত্রিবেলা কোনো মেসের ব্যবস্থা করতে পারবো কি না কে জানে! সেসবেরও খোঁজ নিতে হবে। অনেক কাজ বাকি।
চলবে,
sinin tasnim sara