ভালোবাসার রংধনু,১৯,২০

0
1018

ভালোবাসার রংধনু,১৯,২০
sinin tasnim sara
১৯
________________
৩২.
রাতটা কোনোরকমে কাটার পরই বেরিয়ে পড়লাম বাড়িটা থেকে। যাওয়ার মতো জায়গা তো নেই। তবুও শেষ ভরসা হিসেবে হাঁটতে হাঁটতে রওয়ানা
হলাম জিনিয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও ওর আশ্রয়ে থাকব না কিন্তু ও নিশ্চয়ই গার্লস হোস্টেল গুলোর খোঁজ দিতে পারবে আমাকে? এই শহরে থাকি কত বছর হলো! কিন্তু চিনিনা কিছুই।
ওকে একটা কল করতে পারলে ভালো হতো; কিন্তু আমার ফোনটা…
এখান থেকে জিনিয়ার বাড়ি অনেক দূর। হেঁটে যাওয়া সম্ভব না।
রিকশা ভাড়ার টাকা আমার কাছে নেই। তবুও বৃথা চেষ্টা হিসেবে ব্যাগটায় হাত ঢোকালাম। কাপড়গুলো একটু সরাতেই হাতে কাগজের মতো কিছু একটা আটকালো। কৌতূহলে মাথা নিচু করে দেখলাম চকচকে হাজার টাকার নোট।
ভারী অবাক লাগল। সেই চারবছর আগে ঐ বাড়িটায় ওঠার সময় এই ব্যাগে করে কাপড় এনেছিলাম। তারপর থেকে আলমারি বন্দী ছিল ব্যাগ। হাতও দেয়া হয়নি। সেই ব্যাগে আমারই কাপড়ের ভাঁজে হাজার টাকার নোট! এ টাকা তাহলে আমার নয়। এত টাকা একসাথে কখনো নেই-ই নি আমি।
প্রয়োজন হলে পাঁচশ টাকা নিয়েছি হয়তোবা, তাছাড়া আর নেইনি। এটা যেহেতু আমার টাকা নয় তাহলে টাকা এলো কীভাবে? কে রেখেছে টাকা?
ঠোঁট কামড়ে অন্য কাপড়গুলোও উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। অদ্ভুত বিষয় হলো কয়েকটা কাপড় সরানোর পরেই হাজার টাকার একটা বাণ্ডিল চোখে পড়ল। গুনে দেখি চৌদ্দ হাজার টাকা। একটা নোটের সাথে ছোট্ট কাগজও আটকানো। ওতে লেখা,
“টাকাগুলো ফেলে দেয়ার আগে নিজের গলায় এবং কানে একবার হাত দেবে। দিয়েছ?
হ্যাঁ, টাকাগুলো তোমার গলার চেইন;ওতে আটকানো ফুলের পাপড়ি শেপের লকেট এবং ইয়াররিং বিক্রির টাকা; অর্থাৎ তোমার টাকা।”
এ পর্যন্ত পড়েই আমি তড়িঘড়ি করে গলায়,কানে হাত দিলাম। ঠিক, দু’টোই খালি।
তারপর আবারও লেখাগুলোতে চোখ বোলালাম৷ আরও লিখেছে,
“টাকার ব্যবস্থা আমি করে দিয়েছি বলে ইগো দেখিয়ে ওগুলো ফেলো না। পস্তাবে। এটাকে বরং একটা ঋণ ভেবে নাও। যে মানুষটাকে পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি ঘৃণা করো, তার ওপর ঋণী থাকলে নাহয়। সময় আসলে চুকিয়ে দেবে”
ভ্রু কুঁচকে কাগজটা ছিঁড়ে কুঁচিকুঁচি করে ফেলে দিলাম আমি। নাটকের শেষই হয়না। কত্তবড় ধড়িবাজ! কখন বাড়ি ফিরে এসব নিয়েছে বুঝতেও পারিনি।
এই নমুনা ওর পিছু ছাড়ার! গতকাল রাতের ওর বলা কথাগুলো মনে করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। জানে ওর টাকা আমি মরে গেলেও ছোঁবো না। তাই মাথা খাটিয়ে আমারই জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। চোর কোথাকার।
ব্যাগের জিপার আটকে হাতে তুলে নিলাম ব্যাগটাকে। এখনও জানিনা এই টাকা খরচ করবো কি না! জিনিয়াদের বাসায় যাই আগে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।

হেঁটে হেঁটে কিছুটা পথ যাওয়ার পর হঠাৎ করে রাস্তা গুলিয়ে গেল আমার। সব গলি এক মনে হতে লাগল। রাস্তার ধারের সব বাড়ি জিনিয়াদের বাড়ি মনে হতে লাগল। দুঃখে, শোকে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি কতক্ষণ। কপাল ভালো জিনিয়ার বাড়ির ঠিকানা মনে ছিল। পথের ধারে এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম এই বাড়ি কোথায়? সে প্রথমে চিনতে পারল না। কিন্তু পাড়ার নাম বললে ভ্রু কোঁচকাল। বলল,
“আপনি তো ভুল পথে আইসা পড়ছেন। ঐ গলি তো অন্য রোডে”
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— হেঁটে যাওয়া সম্ভব কি?
— উঁহু। রিকশা লাগব।
দোকানদারের কথা শুনে হতাশ হলাম। পরে বাধ্য হয়ে রিকশা করে যেতে হলো।
কিন্তু রিকশায় উঠে অন্য চিন্তা ঘিরে ধরল আমাকে । জিনিয়া যতই আমার বান্ধবী হোক না কেন! এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় ওদের বাসায় গেলে আমাকে ঠিক অ্যাকসেপ্ট করবে না। শহরের মানুষের মন খুব কঠিন। মায়াদয়ার স্থান নেই বললেই চলে। তাছাড়াও আমার জীবনের গল্পটা এতটা সহজ নয়। কে জানে কীভাবে নেবে ওরা আমাকে! আদৌ নেবে কি না সন্দেহ।
চিন্তাটা ধীরে ধীরে ভয়ের রূপ নিলো পথেই। এই ভয়ের কারণে দেখা গেল বাড়ির সামনে এসে আর ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছি না।
আজ দারোয়ানও নেই ভাগ্যিস। নইলে এতটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দিত না,সন্দেহ করতো৷
কতটা সময় মনের সাথে যুদ্ধ করে ভয় কাটিয়ে ভেতরে যখন পা রাখলাম তখন ভরদুপুর৷ যোহরের আজানে মুখরিত চারিদিক। আমি একরাশ শঙ্কা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আগেরদিনের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। অন্ত নামক মানুষটার সাথে প্রথম দেখা হলো এ বাড়িতে। সেও তো ঘুরঘুর করে যখন তখন। তবে এই মুহুর্তে তার সামনে আমি একদমই পড়তে চাইছি না। উঁহু, রিস্ক নেয়া যাবে না। দ্রুত ওপরে যেতে হবে৷ ব্যাগ শক্ত করে চেপে ধরে কোনোদিকে না তাকিয়ে একছুটে লিফটে উঠে গেলাম।
__________
৩৩.
জিনিয়াদের দরজার সামনে অনেকগুলো জুতো দেখে একটু ভড়কে গেলাম শুরুতে। আধখোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম ভেতরে কি চলছে! কিন্তু চোখে পড়ল না কিছুই। ভেতর থেকে অনেক মানুষের আওয়াজ আসছে। কোনো প্রোগ্রাম কি? আমি কি অসময়ে এসে ভুল করলাম?
একরাশ দুশ্চিন্তা গ্রাস করে ফেলল আমাকে। অস্বস্তিবোধ হতে লাগল। নক করবো নাকি ফিরে যাব বুঝে উঠতে পারছিলাম না;ঐ মুহুর্তে দরজা খুলে গেল হঠাৎ। সাথেসাথেই চমকে উঠে দু কদম পেছনে সরে গেলাম আমি।
— আরে আম্মাজান ডরাইছেন নাকি?
হাস্যোজ্জ্বল মুখে জিজ্ঞেস করল ওপাশের ব্যক্তি। ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি। আরেহ্ জিনিয়াদের বাড়ির দারোয়ানটা না?
— আপনেরও দাওয়াত আছিল বুঝি? যান ভেতরে যান৷ সাগাই (মেহমান) তো সব আইসা পড়ছে। আমি একটু বাজারে যাই। এই যে ম্যাডাম লিস্ট ধরায় দিলো। মেলা খরচ।
দাঁত বের করে হেসে লিস্ট দেখাল দারোয়ান। আমি কিছু না বুঝেই মাথা নাড়লাম।
— তাইলে যাই আম্মা। আপনে বেল টিপেন, ভিতরে যান।
— জ্বী।
আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে সালাম ঠুকে বেরিয়ে গেল দারোয়ান।
দারোয়ান চলে গেলে আমি চিন্তাভাবনা ছেড়ে কলিংবেলটা বাজালাম আলতো হাতে। বার দুই বাজাতেই দরজার ওপাশ থেকে জিনিয়ার গলা ভেসে এলো।
— কে?
আমি হালকা কেশে জবাব দিলাম।
— আব..জিনিয়া আমি নীরদ।
সাথেসাথে দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল জিনিয়া।
— হোয়াট আ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ! তুই এই অসময়ে আমার বাসায়? আয় আয় ভেতরে আয়। খুব ভালো সময়ে এসেছিস। মা দেখলে অনেক খুশি হবে। দাঁড়া মা’কে ডাকি৷
জিনিয়া খুশিমনে আন্টিকে ডাকতে গেল। কিন্তু আমি এখনই তা চাইলাম না। ওকে আটকাতে ওর হাত চেপে ধরে টেনে নিলাম বাইরে। অস্থিরভাবে বললাম,
— আন্টিকে পরে ডাকিস। আগে আমার কথা শোন।
— আরে শুনব তো। ভেতরে চল। ভেতরে গিয়ে বলবি।
— উঁহু এখানেই বলতে হবে।
— কি হয়েছে তোর?
একটু ঘাবড়ালো জিনিয়া৷ আমি বড় করে শ্বাস ফেলে বললাম,
— আসলে সমস্যায় পড়ে তোর এখানে আসা দোস্ত। আমাকে প্লিজ হেল্প কর।
— কি সমস্যা? খুলে বল আমাকে।
আমার হাতে আলতো করে চাপ দিলো জিনিয়া।
— বলব। আচ্ছা আঙ্কেল কি বাসায়?
— উঁহু। বাবা তো গ্রামের বাড়ি গেছে গত রাতে। কেন বাবাকে দরকার?
— না না। আসলে…
আসলে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছি। ইনফ্যাক্ট তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে।
— কিহ্?
বিস্ফোরিত চোখে তাকাল জিনিয়া। আমি হ্যাঁ-বোধক মাথা নেড়ে গতকালকের সব ঘটনা বিস্তারিত বললাম ওকে।
আমার কথা শুনে ও নড়াচড়া করতেও ভুলে গেল কয়েক মুহুর্তের জন্য। তারপর ওর দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরতে শুরু করল। আমার কাঁধে হাত রেখে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
“ঐ অমানুষগুলোর মধ্যে কীভাবে ছিলি তুই বোন? তোর আপনজনও তো দেখি তোর শত্রু”
ওর কান্না দেখে আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম৷ মনের ভেতর চেপে রাখা কথাগুলো কাউকে বলতে পেরে শান্তি লাগছে।
— ইয়ে জিনিয়া, এখন তো আমার থাকার মতো কোনো জায়গা নেই। তুই কি কোনো মেস বা গার্লস হোস্টেলের খোঁজ দিতে পারবি? খুব ভালো হতো আমার জন্য৷
— কিসের মেস, টেস! কোত্থাও যাওয়া হবে না তোর। আমাদের বাসায় থাকবি তুই।
চোখের পানি মুছে আমার ব্যাগটা হাতে নিলো ও।
— আরে না না। আমি থাকব না এখানে। আঙ্কেল-আন্টি কি ভাববেন!
— কিচ্ছু ভাববে না কেউ। তুই চল ভেতরে চল।
আমায় আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত টেনে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল জিনিয়া।
ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়িংরুম ভরা মানুষজন দেখে আর কথা বলার সুযোগ পেলাম না আমি। বাধ্য হয়ে চুপচাপ জিনিয়াকে অনুসরণ করতে হলো।
আন্টি রান্নাঘরে ব্যস্ত। দেখা হলো না আমার সাথে।
জিনিয়া নিজ থেকে ওর আত্মীয় স্বজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। তাঁদের সাথে টুকটাক কথা বলে অবশেষে ওর রুমে বসলাম।
আমায় রুমে বসিয়ে দরজা আটকে আরও এক পশলা কাঁদতে বসল জিনিয়া। আমি একরাশ বিস্ময় নিয়ে ওর কান্না দেখতে লাগলাম। এই মেয়ে তো দেখছি পাগল কিসিমের। নইলে বন্ধুর দুঃখে এভাবে দুঃখবিলাস করবে কেন?
জিনিয়ার দুঃখবিলাস দেখতে দেখতে উপলব্ধি করলাম ভীষণ ক্ষুধায় পেট জ্বালা করতে শুরু করেছে । গতরাত থেকে না খাওয়া, তারওপর এত ধকল গেল!
ক্ষুধার কথা জিনিয়াকে বলতে খুব লজ্জা লাগছিল; কিন্তু নিজের দূর্বল শরীরের সাথে লড়াই করা সম্ভব হলো না। লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম,
— জিনিয়া কিছু খাবার হবে? খুব ক্ষুধা পেয়েছে আমার।
জিনিয়া এক মুহুর্ত কান্না থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বেশিক্ষণ ওর চোখে চোখ রাখতে পারলাম না,লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম। কিন্তু তারপরেই দেখলাম ওর ফোঁপানো কান্না তীক্ষ্ণ শব্দযুক্ত কান্নার রূপ নিয়েছে।
অদ্ভুত!আমার দুঃখে আমার চাইতেও বেশি ও কেন কাঁদছে? কেউ শুনলে কি ভাববে!
নাহ্ এখন তো দেখছি পাগল কিসিমের না, আদ্যোপান্ত পাগলই এই মেয়ে।

চলমান,
sinin tasnim sara

ভালোবাসার রংধনু
২০
_____________
৩৪.
জিনিয়াদের আত্মীয়-স্বজন চলে গেল বিকেলের দিকে। তারা যে আমাকে একদমই পছন্দ করেনি, তাদের ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা গেছে। আমার এসবে কিছু যায় আসার কথা না; আসছেও না । আমি যত দ্রুত সম্ভব নিজের একটা ব্যবস্থা করার কথা ভাবছিলাম।
এর মধ্যে একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ বছর এডমিশন পরীক্ষা আমি দেবো না। সম্ভব নয় এভাবে। পড়াশোনা বিষয়টাই মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে আমার। তাছাড়াও সাথে বই নেই,সময় তো নেই-ই। আমি তো আর গল্প-উপন্যাসের নায়িকা নই যে পরীক্ষার হলে বসল, আর চোখের পলকে চান্স হয়ে গেল।
আমার ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে আসার বিষয়টা দেখতে পেয়েই আন্টির মুখ অন্ধকার হয়ে গেছে। এখান থেকে যে কোনো সাহায্য পাব না বুঝতে পারছি। নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে। এত অপদার্থ কেন আমি? সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখার ফল পাচ্ছি তো এখন!
পাশের রুম থেকে চাপা কিছু শব্দ ভেসে আসছে। তর্ক করছে জিনিয়া আন্টির সঙ্গে। আমি জানি আমাকে নিয়েই। একটা বাইরের মেয়ের জন্য বাড়িতে অশান্তি হবে বিষয়টা খারাপ দেখায়। দীর্ঘশ্বাস চেপে উঠে দাঁড়ালাম। এখানে থাকাটা আর উচিৎ হবে না। মাগরিব ঘুচে গেছে। বেরোলে এখুনি বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ। ব্যাগ থেকে সুতির একটা ওড়না বের করে মাথায় পেঁচিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লাম। খারাপ লাগছে। জিনিয়ার সাথে বোধহয় আর কখনোই দেখা হবে না। আমাকে কোনো হেল্প করতে পারলো না বলে গিল্টি ফীল করবে।
— নীরদ না?
দোতলার সিঁড়ির শেষ মাথায় পা রাখতেই পেছন থেকে ডাক পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম অন্ত সাহেব। খানিক হাসবার চেষ্টা করলাম।
— জ্বী।
— ফ্রেন্ডের বাসায় থাকতে এসেছিলেন বুঝি?
নেমে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করলেন উনি। আমি আবারও হাসলাম।
— সেরকমই কিছু।
— সপ্তাহখানেক পরেই তো আপনাদের এক্সাম। এই সময় বাইরে ঘোরাটা কি ঠিক?
— না ঠিক নয়। কিন্তু আমি ঘুরছি। কারণ আমি পরীক্ষা দেবো না।
— পরীক্ষা দেবেন না! কেন? প্রিপারেশন ভালো না?
— উঁহু।
— ভেবেচিন্তে ডিসিশান নিয়েছেন?
— নিয়েছি।
— ঝামেলা পোহাতে হতে পারে কিন্তু।
— যে ঝামেলায় আছি তা-ই আগে কাটিয়ে উঠি।
মনে মনে কথাটা আওড়ে চুপচাপ হাসিমুখে তাকিয়ে রইলাম আমি ওনার দিকে।
উনি নেমে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শীতল দৃষ্টিতে হাতে ধরে থাকা ব্যাগ দুটোর দিকে তাকালেন;তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
— গতকালকের জন্য থ্যাংক্স। আপনি একটা অপরিচিত ছেলের এতবড় উপকার করলেন তার জন্য মন থেকে থ্যাংক্স।
জবাবে আমি কিছু বললাম না। উনি খানিক চুপ থেকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন ঠিক তখুনি দোতলার একটা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল। খানিক পর মাঝবয়সী দু’জন মহিলা বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। আমরা দু’জনেই তাকালাম সেদিকে। মহিলা দু’জন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তাঁদের একজন সহাস্যে অন্ত সাহেবের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
— আরে অন্ত তুমি এখানে? ভালো আছো?
অন্ত সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে তাঁদের সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় সারলেন। ওনারা আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল,
— ওকে তো ঠিক চিনলাম না।
— ও আমার গেস্ট। মায়ের পক্ষের গেস্ট। দাওয়াত ছিল। চলে যাচ্ছে।
খুব দ্রুত বললেন উনি। ভদ্রমহিলারা ভ্রু কোঁচকাল একটু। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— আগে কখনও দেখিনি তো। যাকগে নাইস টু মিট ইউ৷
আমি সংক্ষেপে জবাব দিলাম,
— নাইস টু মিট ইউ ঠু।
— তাহলে অন্ত আসি। পরে দেখা হবে।
হাত নেড়ে চলে গেল ওরা। ওরা চলে যাওয়ার পর অন্ত সাহেব আবারও আমার দিকে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন,
— আমি সচরাচর এই সময়ে বাসায় থাকি না। আজ কেন আছি জানেন নীরদ?
— আইডিয়া করতে পারছি।
— কি বলুন তো?
— জিনিয়া আপনাকেও আমার ব্যাপারে বলেছে।
— আপনার আইডিয়া সঠিক। এবং এও বলেছে আমি যেন আপনাকে হেল্প করি।
— কিন্তু আমার যে আপনার হেল্প চাই না অনিক সাহেব।
— স্যরি ম্যাডাম। আপনি না চাইলেও যে আজ আমায় আপনার হেল্প করতেই হবে।
মৃদু হেসে অন্ত সাহেব আমার ব্যাগের দিকে হাত বাড়ালেন। আমি চট করে ব্যাগ সরিয়ে নিয়ে বললাম,
— একবার কিছু না বুঝেই আপনার ওপর ভরসা করেছিলাম অন্ত সাহেব। কিন্তু তারপর আমার খুব গিল্টি ফীল হয়েছে। এখন আবার নতুন করে গিল্টনেসে ভুগতে আমি চাইনা।
আমার কথা শুনে অন্ত সাহেব মাথা নীচু করে হাসলেন।
— নিজ প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে গিল্ট ফীল করানোর মতো কাজও করতে হয়। ইটস গুড।
— আমার আপনাকে প্রয়োজন নেই অন্ত সাহেব।
— আপনার জেদ অনেক বেশি নীরদ। এটা কিন্তু মানুষের জন্য খুব হার্মফুল। আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। একটা ভুল সময়ে যখন আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতি হয়নি, আজও হবে না।
— ভবিষ্যতে যে হবে না তার কি গ্যারান্টি?
— ভবিষ্যতের কথা তো আমরা বলতে পারি না নীরদ। আমরা বাঁচি বর্তমানে। বর্তমানে বেঁচে বর্তমানকে নিয়ে ভাবাটাই বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?
এ পর্যায়ে কঠিন কিছু বলতে চাইলাম আমি কিন্তু তার পূর্বে উনি আমার হাত থেকে ব্যাগটা টেনে নিলেন।
— আমি ঋণী হয়ে থাকতে পছন্দ করিনা। একটা প্রবলেমে হেল্প করে আপনি আমায় ঋণী করে দিয়েছেন। এই ঋণ যে আমায় পরিশোধ করতেই হতো ম্যাডাম।
প্লিজ আসুন আমার সাথে।
অনুরোধের সুরে বলল অন্ত সাহেব। আমি আর না করতে পারলাম না৷ বাধ্য হয়ে গেলাম তার পিছু পিছু।
দেখাই যাক না ভাগ্য আমার জন্য আর কি কি লিখে রেখেছে।
_________________
৩৫.
দীর্ঘ সময় খোঁজাখুঁজির পর বহুকষ্টে একটা গার্লস হোস্টেলে সিট ম্যানেজ করা সম্ভব হলো। অন্ত সাহেব নিজে তো খুঁজছিলেনই তার পাশাপাশি তার বন্ধুদেরও বলেছিলেন। কয়েকটা ঘণ্টা মানুষটার সাথে কাটানোর পর কেন যেন মনে হলো অন্ত নামক মানুষটা বোধহয় খারাপ না। সত্যিকার অর্থেই সে আমার উপকার করতে চাইছিল। সিট ফাইনাল করে যখন কয়েক মাসের সিট রেঞ্জটাও সে নিজ দায়িত্বে এডভান্স করে দিলো তখন আমার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। আমি নিতে চাইছিলাম না একদমই। আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করে সে হোস্টেল সুপারের হাতে ফিস বুঝিয়ে দিয়ে বলল,
— ধার হিসেবে নিন। চুকিয়ে দেবেন।
আমি বিষণ্ণভাবে উত্তর দিলাম,
— কতজনের ওপর আর ঋণী থাকব।
— সেকি! আরও কেউ ধার দিয়েছিল নাকি?
মজার ছলে বললেন উনি। আমি কিছু না বলে তার দিকে তাকালাম। উনি হাসি ধরে রেখে শুধলেন,
— টিউশন করাতে কোনো আপত্তি আছে নীরদ?
— উঁহু। পেলে তো ভালো হয়। আপনি খুঁজে দিতে পারবেন?
— চেষ্টা করে দেখি৷ ব্যাকগ্রাউন্ড সাইন্স তো?
— হ্যাঁ।
— আচ্ছা হয়ে যাবে।
— সত্যি হবে? এই শহরে তো বাসা পাওয়ার মতো টিউশন পাওয়াও দুর্লভ।
— ভালো দের জন্য সবখানেই অপশন থাকে। কেবল খুঁজে নিতে হয়।
— আমি কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব!
— ধন্যবাদের কোনো প্রয়োজন নেই। চা খাওয়ান নাহয় একদিন।
— আপনি কবে ফ্রী বলুন? এখন খাবেন? অনেক তো ঘোরা হলো।
— নাহ্ এখন যে পারছি না। কাজ আছে একটু। অলরেডি লেইট আমি।
— তাহলে?
— জানিয়ে দেবো । যোগাযোগ তো হবে এখন থেকে৷
— আমার কাছে কোনো ফোন নেই।
— হোস্টেলে অভিভাবকদের সাথে কথা বলার জন্য টেলিফোন আছে। ওখানেই নাহয় কল করব?
— আচ্ছা ঠিকাছে।
— তাহলে আজ বিদায় নেই? আপনি যান নিজের রুমে যান। গুছিয়ে নিন সব, কেমন?
হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম আমি।
— বি স্ট্রং।
মৃদু হেসে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন উনি। আমি তখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে। কয়েক কদম হাঁটার পর কি মনে করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম।
— আচ্ছা নীরদ ডোন্ট মাইন্ড আপনার নামটা একটু কঠিন। আমি কি আপনাকে নীর অথবা নীরু বলে ডাকতে পারি?
ওনার প্রশ্নে আমি নিজেই ভাবনায় পড়ে গেলাম। একটু অস্বস্তি লাগলেও তা লুকিয়ে বললাম,
— জ্বী পারেন।
— আচ্ছা তাহলে নীর বলেই ডাকব। তো নীর আপনি মাইন্ড না করলে আরেকটা কথা বলব।
— অবশ্যই বলুন।
— মলিনতা আপনাকে মানায় না। প্লিজ একটু হাসবেন। হাসি এমন একটা জিনিস যা কঠিন কাজকেও সহজ করে দেয়৷ আর আপনার হাসি সুন্দর।
এরপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পিছু ঘুরে চলে গেলেন অন্ত সাহেব।
আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তার প্রস্থান দেখলাম। মলিনতা মানায় না? আমার তো মনে হয় হাসি আমাকে মানায় না৷ মনখারাপের বার্তা নিয়েই আমার জন্ম।
চলবে,
sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here