ভালোবাসার রংধনু,২১,২২
sinin tasnim sara
২১
_________
৩৫.
সেদিনের সেই সন্ধ্যার পর আমার জীবনে হঠাৎ পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগল। ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া আমিকে সামলে নেবার জন্য একজোড়া বলিষ্ঠ হাত পেয়ে গেলাম অপ্রত্যাশিতভাবে। যে হাতজোড়া রুক্ষ নির্জীব মরুভূমির মতো আমার জীবনটাকে মুঠো ভরা “ভালোবাসা” নামক সঞ্জীবনী দিয়ে সতেজ করে তুলল। আমি জানতাম না কীভাবে, কখন মানুষটার সাপোর্ট পেতে পেতে সম্পূর্ণ তাকে পাওয়ার লোভ পেয়ে বসল আমাকে! মিথ্যেমিথ্যি বিয়েটাকে সত্যি করার বাসনা জাগলো খুব করে। “ভালোবাসা” নামক বস্তুটার থেকে সবসময় পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছি আমি; অথচ ভাবতেও পারিনি এটাই কখনো আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ অবশ্য আগে করিনি আমি। অন্তুই করেছিল। সেও আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে। আমার সংগ্রামে স্বেচ্ছায় জুড়ে দিয়েছিল নিজেকে। তারপর হুট করেই আমাদের সম্পর্কটা খুব গাঢ় হলো । সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে নামল। দু তিন মিনিটের ফর্মাল কথাবার্তাও সময় গড়ানোর সাথে সাথে ইনফরমাল হয়ে গেল। কথা বলতে গেলে সময়-জ্ঞান থাকত না আমাদের। অকারণেই আমার হোস্টেলের সামনে দিয়ে ঘুরপাক খেত সে। আমি সামনে এলে বলতো,
— ট্রিট দিব তোমাকে চলো।
— ট্রিট! কিসের ট্রিট? কোন পারপাসে?
— আরে এত কষ্ট করে পড়াশোনা করছো একটা ট্রিট তো তোমার প্রাপ্য তাইনা? নাও আর কথা বাড়িও না জলদি তৈরি হয়ে এসো।
আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জোর করে রেডি করে নিয়ে সে চলতো অকারণ ট্রিট দিতে৷ নতুন প্রেমে পড়েছি তখন। প্রেমিকের সবকিছুতেই ভালোবাসা খুঁজে পাই৷ তার অংশ হিসেবে সাহেবের অকারণের ট্রিটও ভালো লাগত আমার। সেই তো হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার ধারের কোনো চায়ের দোকানে একগাদা কনডেন্স মিল্ক আর চিনি দেয়া কড়া লিকারের চা! চিনি বেশি খাওয়ার অভ্যেস না থাকলেও সেই চায়ের জন্য সব অভ্যেস ত্যাগ করতে লাগলাম আমি হাসিমুখে।
চা খাওয়া শেষ হলে এলেবেলে ধরনের গল্পে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করত সে আমাকে। আমি তো বেশি কথা জানিনা তাই গল্পের রেশ থাকত না বেশিক্ষণ। সে বুঝতো ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে আমার৷ এখন আটকাবে কীভাবে? একা একাই ভাবত। ততক্ষণে আমি গুছিয়ে নিয়েছি এখন উঠব, ঐ মুহুর্তে হঠাৎ জোর গলায় ডেকে উঠত আমাকে,
— উঠছ যে? আরে এখনই চলে যাবা? ব্যস্ততা না থাকলে কিছুটা সময় থেকে যাও না ।
ঢাকাশহর তো এখনও ঠিকঠাক চেনো না তুমি। শহর না চিনলে বড় হবা কি করে? আমি ভাবলাম চা খেয়ে তোমাকে নিয়ে একটু শহর চেনাতে বেরুব। থাক এখন ফেরার দরকার নেই। বরং চলো তোমাকে একটু শহর চিনিয়ে আসি ।
আমি ওর কথা শুনে মুখ লুকিয়ে হাসতাম। বুঝতাম ঠিকই, শহর চেনানো তো বাহানা মাত্র;আসলে সে আমার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে চায়। চাইতাম তো আমিও এমনকিছু৷ তবে চাওয়া-পাওয়াগুলো অগোচরে থাকতে দিয়েছি সবসময়৷ আমি চেয়েছিলাম সে এগোক। এবং আমার চাওয়া পূর্ণ হলো একদিন।
ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো । তার ইউনিভার্সিটির জুনিয়র হয়ে গেলাম আমি। আমার চান্স পাওয়ার খুশিতে সেদিন সে ক্যাম্পাস ঘোরাতে নিয়ে গেল আমাকে। অর্ধেক বেলা খুব আগ্রহ নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখানোর পর ঘুরতে ঘুরতে তার ডিপার্টমেন্টের সামনে যখন এলাম, ঐ মুহুর্তে আচমকা আমার হাত ধরে থামালো আমাকে। আমি ফিরে তাকালে দেখতে পেলাম পকেট থেকে টুকটুকে লাল গোলাপ বের করে হাঁটু গেড়ে বসছে সে। প্রেম নিবেদনের বিখ্যাত সেই পন্থা!
বিস্ময়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতেও ভুলে গেলাম আমি। যেন বাক্যহারা হয়ে গেছি কয়েক মুহুর্তের জন্য । বিস্ময় ভাংলো তার কথাতেই।
— ইয়ে নীর, প্রপোজ কীভাবে করতে হয় তা তো আমার জানা নেই । আজ তোমার সাথে দেখা করার আগে বন্ধুরা আমাকে বারবার করে মুখস্থ করিয়েছে কাউকে প্রপোজ করতে হলে কীভাবে বসতে হয়, কীভাবে ফুল ধরতে হয়, কী কী বলতে হয়! কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি সব ভুলে বসে আছি। গুছিয়ে তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে পারছি না। আমি বরং আমার ভাষায় বলি কেমন?
আমি বোকার মতো মাথা নেড়ে সায় দেই। সে উঠে দাঁড়িয়ে নার্ভাসভাবে হেসে বলে,
— ভালোবাসা, বিয়ে-শাদি, সম্পর্ক এসবের বিপক্ষে থেকেছি আমি সবসময়। এক মানুষের সাথে দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়া আমার কাছে খুব দুঃসাধ্য মনে হয় । আমি ভাবতেও পারিনা আজ কারোর জন্য আমার যে অনুভূতি, দু’দিন পরেও সে অনুভূতি একইরকম থাকবে। অন্য সবকিছুর মতো অনুভূতিও ক্ষয়িষ্ণু, এটাই ভাবতাম আমি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে কীভাবে যেন আমার ভাবনার গতিপথটা পাল্টে গেছে নীর৷ সম্পর্ক নিয়ে ভিন্ন ভাবনা আর ভাবতে ইচ্ছে করেনা আমার। কেন যেন মনে হচ্ছে আমার থিওরি আমার কাছেই উল্টো হয়ে গেছে। অনুভূতি ক্ষয়িষ্ণু কি না জানিনা তবে তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আমি একমুহূর্ত তুমি হীনা নিজেকে ভাবতে পারছি না। প্রতিদিন নানা বাহানায় তোমার কাছে ছুটে আসি কেন জানো? একদিন তোমাকে না দেখলেই মনে হয় আমাদের মাঝে দূরত্ব যেন কতখানি! কত বছর যেন তোমার সাথে আমার দেখা হয়না। তোমাকে ছাড়া আমি কতটা শূন্য তুমি আইডিয়াও করতে পারবে না নীর। আমি জানি না আমার জন্য তোমার মনে কোনো অনুভূতি জেগেছে কি না! কিন্তু তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতিগুলো আর লুকিয়ে রাখতে পারছিলাম না কিছুতেই। আজ হয়তো আমার দুঃসাহসিক পদক্ষেপটা আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক পাল্টে দেবে। ঠিক কোনদিকে মোড় নেবে সম্পর্ক বুঝতে পারছি না৷ তবে…
— তবে?
— তবে তুমি “না” করলে আমি বোধহয় মরে যাব নীর। স্রেফ মরে যাব৷
শুনতে হাস্যকর লাগছে, তাই না? “তোমাকে ছাড়া বাঁচব না” বাক্যটা আমার কাছেও আগে হাস্যকরই লাগত ৷ কিন্তু যেদিন থেকে বুঝলাম তুমি আমার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে গেছ সেদিনের পর থেকে আর লাগে না। পিচ্চি মেয়ে কি আছে তোমার মাঝে বলতে পারো? আমাকে এভাবে পাগল করলে কবে?
দু’কদম এগিয়ে এসে আমার দু-বাহু আঁকড়ে ধরে শুধালো সে। তার অস্থির চাহনি আমাকেও স্পর্শ করে ফেলল তড়িৎ। তার চোখে চোখ রেখে আমারও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো,
— আপনি বলুন তো, আপনার মাঝে কি এমন আছে? প্রেম বিদ্বেষী আমার মনে আপনার জন্য হঠাৎ উথাল-পাথাল প্রেমের জোয়ার বইতে শুরু করলো কেন?
কিন্তু ইচ্ছেকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলাম না। নিয়ন্ত্রণহীন আমার মন ভাবনার ঝাঁপি বন্ধ করে গুছিয়ে রাখা উত্তরটা শুনিয়ে দিতে বলল৷ আমিও মনের কথা শুনে বলে ফেললাম,
— হ্যাঁ শুনতে হলে যে প্রশ্ন করতে হয়,
“উইল ইউ বি মাইন?”
আপনি প্রশ্ন করছেন না, তাহলে উত্তরটা আমি দেই কি করে?
আমার কথা শুনে সেও খানিক চমকাল। চোখ বড় বড় করে বলল,
— তার মানে? নীর, তুমি? তুমিও আমায়…
তার কথা শেষ হবার পূর্বে আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসলাম৷
তারপর বলা নেই কওয়া নেই, অন্তুর বন্ধুরা দল বেঁধে হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে এলো কোত্থেকে। আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদের কি সে উল্লাস! সেই মুহুর্তে ওদের দেখে আমার লজ্জা তো আকাশচুম্বী। নিজেকে লুকোতে আমি আছড়ে পড়লাম অন্তুর বুকে। সেও আলতো হেসে চেপে ধরে রইলো আমায় বুকের মাঝে। কতটা সময় এভাবে অতিবাহিত হবার পর কানের কাছে খুব কোমল আওয়াজ পাই,
— নীর উইল ইউ বি মাইন?
লজ্জা তখনও কাটেনি আমার। ঠোঁট কামড়ে ধরে আরেকটু লুকই তার বুকে। লজ্জায় কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল আমার। কোনোরকমে বিড়বিড় করে বলি,
— জানিনা। যান।
সে হাসে, প্রাণখোলা হাসি;সাথে আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আকাঙ্ক্ষিত শব্দগুলো উচ্চারণ করে, “ভালোবাসি তোমাকে নীর, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি”
মানুষটার মুখে ভালোবাসার কথা শুনে সুখ সুখ লাগে আমার। আবেশে চোখ বন্ধ করে তার বুকে লেপ্টে থাকি৷ আমার মনে হয় মানুষটা সৃষ্টিকর্তারই পাঠানো উপহার৷ তার হাত ধরে দুঃখ ঠেলে সুখের জগতে পা রাখতে চলেছি আমি। সে আমার জীবনের একমাত্র সৌভাগ্য।
________________
৩৬.
আমার দেখা অন্যতম পারফেক্ট একজন মানুষ ছিল অন্তু। সে সবসময় আমার পাশে ঢালের মতো থেকেছে। কখনও প্রেমিকের মতো প্রচন্ড ভালোবেসেছে, কখনও অভিভাবকের মতো আমার সব দায়িত্ব পালন করেছে। আমি না চাইতেও ফাইন্যান্সিয়ালি হেল্প করার চেষ্টা করেছে সবসময়। দু’বছরের সম্পর্কে আমাদের মনোমালিন্য হয়েছিল শুধু একবার। ওর অকারণ ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্টের বিষয়টা নিয়েই। বিষয়টা আমার পছন্দ ছিল না৷ সে নিজেও স্টুডেন্ট। আমার পেছনে অযথা টাকা খরচ করার মানে হয়? যেখানে আমি এনাফ ইনকাম করছি। অন্ততপক্ষে নিজের চলার মতো ইনকাম তো করছিই। তাছাড়াও চারজন মেয়ে মিলে একটা ফ্ল্যাটে থাকি। শেয়ারে ভাড়াও বেশি নয়। তাহলে তার কেন হেল্প করতে হবে আমাকে? এ নিয়ে একটু রাগারাগি হয়। ভেবেছিলাম রাগারাগিতে মনটন খারাপ করবে , বিষয়টা স্টপ হয়ে যাবে। কিন্তু কোথায়? পাত্তাই দেয়নি সে। পরের মাসের বাসা ভাড়া দিতে গিয়ে যখন দেখলাম অনেক আগেই ভাড়া পরিশোধ করা শেষ তখন বুঝতে পারলাম বারণ শোনার মানুষ এ না। নিজের যা ভালো মনে হয় তাই করে যাবে। তবুও খোঁচাখুঁচির চেষ্টা করলে মুখের ওপরেই অস্বীকার করে, সে নাকি আমার বলার পরেই টাকাপয়সা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে৷ আমি অযথাই ঝগড়ার চেষ্টা করছি।
মুখের ওপর এমন ডাহা মিথ্যে শুনে পরে হাল ছেড়ে দিয়ে একা একাই চুপ করে যেতে হয় আমায়। কিন্তু তার সমস্ত হেল্পগুলোকে ঋণ ভেবে তা পরিশোধের চিন্তায় নিজের ইনকামের টাকা থেকে কিছুটা জমাতে শুরু করলাম। সবটাই ওর অলক্ষ্যে। জানতে পারলে আর আস্ত রাখত?
আমাদের সম্পর্কটা খুব ভালো যাচ্ছিল। পাওনার চাইতে বেশিকিছু পেতে পেতে আমি সম্পূর্ণটা ওর ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছিলাম। ওর সান্নিধ্য আমায় পুরোদমে অতীত ভুলিয়ে দিয়েছিল। হ্যাঁ, একদম ভুলিয়ে দিয়েছিল। এক মুহুর্তের জন্যেও আমার মনে পড়ত না আমার ফেলে আসা জীবনের কথা। আপা, ইনতিসারের কথা। ওরা পুরোদমে মন এবং মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে গেছে। ওদের পরিবর্তে তখন সবটা জুড়ে কেবল একজনের বসবাস । আমার প্রথম প্রেম। আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন।
দিনকে দিন ওর প্রতি আমার ভালোবাসা সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে লাগল। ও জানতো আমি কি পরিমাণ ভালোবাসি ওকে, ঠিক কতটা পাগল আমি ওর জন্য৷ ওর তরফ থেকেও ভালোবাসার কমতি ছিল না।
কিন্তু কথায় আছে, সুখের জন্য ভালোবাসলেও এর দুঃখকে এড়ানো যায় না। আমাদের সম্পর্কেও দুঃখের সময় ঘনিয়ে আসছিল দ্রুত। আমার জীবনে অপ্রত্যাশিত ঘটনার সংখ্যাই বেশি। সুখ যেমন একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে এসেছিল, দুঃখও তেমন অপ্রত্যাশিত ভাবেই এলো৷
চলবে,
sinin tasnim sara
ভালোবাসার রংধনু
২২
________
৩৭.
আমাদের সম্পর্কের শুরুটা যেমন মিষ্টতা দিয়ে হয়েছিল, সময় গড়ানোর সাথে সাথে এই মিষ্টতা কোথায় যেন হারিয়ে যেতে শুরু করল। চোখের সামনে ধীরে ধীরে মানুষটার পরিবর্তন আমাকে খুব পীড়া দিতো । একদিন যে মানুষটা আমাকে খোলা আকাশে মুক্ত পাখি হবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সে-ই হঠাৎ আমার পায়ে শেকল পরিয়ে জোর করে খাঁচায় বন্দী করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। তার ভালোবাসাই হয়ে গেল আমার কাছে শক্ত লৌহ শেকলের মতো । নাকি এটাকে ফাঁসির দড়ি বলব? যে দড়িতে স্বেচ্ছায় গর্দান দিয়েছিলাম আমি।
বুঝতে পারছেন না তো? আচ্ছা একটু ভেঙে বলছি।
সম্পর্কের শুরু থেকে আমায় ঘিরে অন্তুর একটা সমস্যাই ছিল, আমার কেন একটা বন্ধুমহল নেই? সে খুব টেনসড থাকত এটা ভেবে, যেভাবে তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি! সে যখন থাকবে না, বাইরে চলে যাবে তখন আমি একা একা কীভাবে থাকব? কার ভরসায় রেখে যাবে আমাকে? জিনিয়াও তো নেই। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। থাকে হাজবেন্ডের সাথে মুম্বাই। এতবড় শহরটায় সাপোর্ট ছাড়া আমি ঠিকঠাক চলতে পারব তো! আমার সার্ভাইভাল নিয়ে ওর মনে একটা শঙ্কা কাজ করতো সবসময়। দুশ্চিন্তায় নীরব হয়ে বসে থাকত প্রায়ই। অনবরত সিগারেট ফুঁকতো আর কিছুক্ষণ পরপর আমার দিকে করুণ চোখে তাকাতো। ওর এত দুশ্চিন্তা দেখে আমি হাসতাম।
বলতাম, ” এতই যখন দুশ্চিন্তা আমায় নিয়ে তাহলে বাইরে যাচ্ছ কেন? নিজ দেশেও তো উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া যায়। ভালো স্টুডেন্টদের কি অপরচুনিটি কম?”
প্রতুত্তরে সে কিছু বলত না। চট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেত। আমি বুঝতাম কোনোভাবেই সে নিজ স্বপ্নের সাথে আপোষ করতে রাজি না। অ্যাম্বিশাস তাকে দেখেও আমার খুব প্রাউড ফীল হতো। এভাবে চলতে চলতে একসময় তার চাপাচাপিতে আমারও খুব ইচ্ছে হলো কিছু বন্ধু বানাই৷ কিন্তু বন্ধু কি হাতের মোয়া? চাইলেই পাওয়া যায়৷
নাহ্, শুরু শুরুতে আমি কোনোভাবেই কাউকে বন্ধু বানাতে পারছিলাম না। সবার নিজস্ব গ্রুপ আছে।
প্রায়ই ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে বসে থাকতে দেখতাম তাদের। কি সুন্দর আড্ডা দিত, পড়াশোনা করতো। ওসব দেখলেও চোখ জুড়োয়। মনটা আমার লোভী হয়ে উঠত কোনো গ্রুপে জয়েন হওয়ার জন্য। ঘোরের মধ্যে এক পা বাড়িয়েও ফেলতাম বোধহয়, তারপর আচমকা সম্বিত ফিরে আসত। কুণ্ঠাবোধে পিছু মুড়ে দীর্ঘশ্বাসের সাথে প্রস্থান করতে হতো। হুটহাট একটা মেয়ে গিয়ে কীভাবে কারোর গ্রুপে ঢুকব ভাবতেও অদ্ভুত লাগত আমার। এই অদ্ভুত লাগাটা প্রতিদিন না কমে বরং বাড়ছিলই। পরে নিজের দ্বিধা-দ্বন্দের সাথে জিততে না পেরে বন্ধু বানানোর চিন্তাই বাদ দিয়ে দিলাম । অন্তু আছে, সে হলেই চলবে। এই মনোভাব নিয়ে আমি দ্রুতই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে না থাকলে কি হবে, ভাবার সময় নেই আমার।যখনকার বিষয় তখন দেখা যাবে।
তো এভাবেই দ্রুত পরিবর্তনশীল একটা সময় কেটে গেল আমাদের। ক’দিন বাদেই অন্তু খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল পড়াশোনায়। তার ব্যস্ততা খুব করে প্রভাবিত করে ফেলল আমাদের সম্পর্ক কে।
আগের মতন কোনো কিছুই আর থাকল না৷ দু’জনের মধ্যস্থতায় আমরা দেখা-সাক্ষাৎ, কথা বলা সব কমিয়ে আনলাম। আমার একটুখানি কষ্টই হতো এভাবে, কিন্তু মানিয়ে নিতাম। সারাদিনের বিচ্ছিন্ন কনভারসেশন আমি সময়ে-অসময়ে বের করে করে দেখতাম। এভাবে দেখা যেত, কবে কি কথা হয়েছে সব মুখস্থ হয়ে যেত আমার। আগে আমি পড়কুট ছিলাম। কিন্তু অন্ধপ্রেম আমার লেখাপড়ার প্রতি সব আগ্রহও কমিয়ে দিলো। ফলস্বরূপ পরীক্ষাগুলোতে একদমই ভালো রেজাল্ট করতে পারছিলাম না। অন্তু বকাঝকা করত দেখা হলে। তখন প্রমিস করতাম ভালো করে পড়ব, কিন্তু পড়তে বসলে মনে হতো বইয়ের ভেতর সে ঢুকে বসে আছে। তার খেয়ালে ডুবে থাকতে থাকতে কোন দিক দিয়ে সময় চলে যেত টেরই পেতাম না। কিন্তু আমার এই খামখেয়ালিপনা পরবর্তীতে যে আমাকে কতটা ভোগাতে পারে তা তো আর তখন চিন্তা করিনি। বিপদে না পড়া অবধি চিন্তা করতেও ইচ্ছে হয়নি অবশ্য।
জীবনে তখন নতুন কষ্ট এসে হানা দিয়েছে। লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপের কষ্ট। অন্তু বিদেশে যাওয়ার আগে আগে একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। শেষ মুহুর্তে দেখা-সাক্ষাৎ একদমই হয়নি আমাদের। একদিন দেখা করার কথা অবশ্য ছিল, আমি সেদিন বেশ প্রিপারেশন নিয়ে গেছিলাম তার সাথে দেখা করার জন্য৷ কিন্তু শেষ মুহুর্তে সে আসতে পারেনি। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর যখন জানতে পেরেছিলাম সে আসবে না, তখনকার কষ্টটা কাউকে বোঝানোর মতো নয়। হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়া কষ্ট। খুব যত্ন করে রান্না করে নিয়ে গেছিলাম মানুষটার জন্য। সব ফেলে দিয়ে আসতে হয়েছে। সেই যে অদ্ভুত দিনটা! সে দিনটা থেকে আমার আত্নসম্মানে আঘাত লাগা শুরু। মানুষটা চলে যাওয়ার পর একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করলাম, সে খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির। অনেকটা স্বার্থপরও। তার মাথায় যখন যেটা ঢুকে যায় তখন সেটার পেছনে সে এতখানি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আশপাশটা আর তাকাতে চায় না।
যাওয়ার আগে বলেছিল, দূরত্ব যাই হোক না কেন যোগাযোগে সমস্যা হবে না। সব আগের মতোই থাকবে। কিন্তু এটা ছিল একটা চরম মিথ্যে কথা। তার যাওয়ার দু’মাস পার হয়ে গেলেও ফোন তুলে একটা কথা সে আমার সাথে বলেনি। রাতের পর রাত কেটে গেছে ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করেছি আমি। মেসেজের পর মেসেজ দিয়ে গেছি। সে কালেভদ্রে একটা উত্তর দিয়েছে, তাছাড়া নয়। অভিমানে গুমরে গুমরে কেঁদেছি। কিন্তু অভিমান জমিয়ে রাখিনি। সে আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন। তার সবকিছু মেনে নিতে রাজি আমি, কিন্তু কোনো মূল্যে হারাতে রাজি নই। খুব ব্যক্তিত্বহীন হয়ে গেছিলাম সে সময়টায়। ইনতিসারের সামনে হরহামেশা আমার যে কঠিন রূপটা দৃশ্যমান ছিল তার ছিঁটেফোঁটা অন্তুর সামনে ছিল না। আমার ফ্ল্যাটমেট আপুরা আমাকে নির্বোধ, পাগল বলেও কটাক্ষ করেছে। সরল এবং স্বল্পভাষী হওয়ায় পছন্দের ছিলাম তাদের। কিন্তু আমার পরগাছা হয়ে যাওয়ার বিষয়টা তারা কিছুতেই মানতে পারেনি। অনেক সময় অনেককিছু বলে বোঝাতে চেয়েছে,
“আমি একটা ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি। অতিসত্বর সম্পর্কটা থেকে আমার বেরিয়ে আসা উচিৎ৷”
কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি তাদের কথা;উল্টো তাদেরই আমার শত্রু মনে হয়েছে। আমার মানুষকে আমার চাইতে ভালো আর কেউ চিনবে? নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে তাই যোগাযোগ করতে পারছে না। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন কালচার। সমস্যা হতেই পারে। একটুখানি যোগাযোগ করছে না জন্য এরা এত কথা বলবে আমাকে? অন্যের রিলেশনশিপ নিয়ে কমেন্ট করা কেমন অভ্যাস? ছিঃহ্। ধীরে ধীরে আমার বিরক্তি তৈরি হচ্ছিল তাদের ওপর। তারপর তাদের এড়িয়ে যেতে শুরু করলাম। আমি এবং আমার আগ্রহভরা অপেক্ষা তখন একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেলাম। খুব কঠিন একটা সময় কাটতে লাগল আমার। কি অদ্ভুত অদ্ভুত খেয়াল আসত মাথায়। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার খেয়ালটাই আসত সবার আগে। মনে হতো আমি খুব অপদার্থ। কাউকে ভালোবেসে বেঁধে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। এভাবে একপর্যায়ে মানসিক রোগীই বোধহয় হয়ে যেতাম, যদি হুট করে আবারও অন্তুর আগমন না ঘটত ৷
কোনো এক ফ্যাকাসে রোদ-বিকেলে সুদূর লন্ডন থেকে এলো তার ফোনকল। এতদিন বাদে কল পেয়ে আমার সে কি কান্না! আমায় কাঁদতে দেখে তারও আক্ষেপের শেষ নেই। ঝামেলায় ফেঁসে গেছিল বেচারা। দেশের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, আমার সাথেও তাই যোগাযোগ করতে পারেনি। অনেক কান্নাকাটি, মান-অভিমান, প্রমিস দেয়া-নেয়া দিয়ে সে যাত্রায় ঝামেলা মিটলো আমাদের। কিছুদিন ঠিকঠাক থাকল সব, তারপর কি হলো, আবারও খোঁজ নেই! আমি তো দুশ্চিন্তায় পাগল। ফের মাস কাবার করে এসে সে বলল, এরকমটা হতেই থাকবে এখন থেকে। দূরত্ব, যোগাযোগহীনতাটা যেন আমি মানিয়ে নিই। অকপটে বলে দিলো সে। কিন্তু আমি মানতে পারলাম না। সারাদিনের মধ্যে একটা ঘণ্টা আমাকে দেয়ার মতো সময় তার নেই? এত কিসের ব্যস্ততা তার? আমি তো আমার সব কাজ আটকে রেখে তার অপেক্ষাতেই বসে থাকি৷ সে একটু ম্যানেজ করতে পারে না? রাগ হয় আমার। সইতে না পেরে চিৎকার চেঁচামেচি করি। সেও থেমে থাকে না। অনেক কঠিন কঠিন কথা বলে আমাকে। কটাক্ষ করে বলে,
“ধীরে ধীরে মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ছো তুমি। এভাবে কি মনে হয় রিলেশন ওয়ার্ক আউট করবে? আমি কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছি দেখ, আর তুমি কোথায় পড়ে আছো?”
সাথে আক্ষেপ করেও বলে, “এরকম ইমম্যাচিওর একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানোই আমার ভুল হয়েছে।”
তার কঠিন কঠিন সব কথা, তার আক্ষেপ আমায় অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে দিচ্ছিল। এত দ্রুতই আমার ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলল সে? ভীষণ কান্নায় কন্ঠরোধ হয়ে আসছিল আমার। তার কথার পৃষ্ঠে আর একটা কথাও বলতে পারিনি। চুপচাপ ফোন রেখে দিয়েছি।
_______
৩৮.
সেবার অভিমান জেঁকে ধরেছিল আমায়। সে যেমনটা করে চায় তেমনটা হয়েই দেখাবো আমি। পুনরায় পড়াশোনায় ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পড়া জমিয়ে রাখতে রাখতে এমন অবস্থা হয়েছিল, পুরোনো পড়া কমপ্লিট করব নাকি নতুনগুলো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তারমধ্যে ফাইনাল পরীক্ষার ডেইট পড়ে গেল। অবস্থা আমার আরও খারাপ। পরীক্ষা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দিলেও ফেইল করব জানি। কিন্তু ফ্ল্যাটমেট আপুরা রেগে ধমকে পরীক্ষা দেয়ালো। আমিও সুন্দরভাবে ফেইল করে মান-ইজ্জত খেয়ে বসে রইলাম। এবার যেন আমার ডিপ্রেশনের চূড়ান্ত পর্যায় চলছে। আর কিছু না হোক আমার মতো মেয়েরা সম্মানটা দিয়েই বাঁচে। পুরো ক্লাসে আমি একা ডাব্বা মেরে শেষ পুঁজি সম্মানটাও খোয়ালাম। এবারের চাপ আমার মস্তিষ্ক নিতে পারল না। সারা জীবন যে কঠিন বিষয়টা শুধু ভেবেই গেছি তা এবার বাস্তবে রূপ দিয়ে দিলাম। সুই/সাইড অ্যাটেম্প করলাম আমি। আমাদের কিচেন নাইফ টা দিয়ে সময় নিয়ে নিয়ে পোঁচ দিলাম হাতে। আর্টারি কেটে ভয়ানক অবস্থা, র/ক্তে যখন মাখামাখি পুরো আমি, ফ্লোর; ঠিক তখন কোত্থেকে পাশের রুমের আপুর আগমন। আমায় এমন র/ক্তাক্ত অবস্থায় দেখে তার কি যে ভয়ানক চিৎকার! শেষবার ঝাপসা চোখে তাকে দেখার পর আমি চেতনা হারালাম।
জানিনা ঠিক কতটা সময় পর আমার চেতনা ফিরে এলো! কিন্তু চোখ বন্ধ অবস্থায় হাতের যন্ত্রণা ছাড়াও অন্যরকম একটা অনুভূতিতে কাবু হয়ে রইলাম আমি। ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি তাড়া করতে লাগল আমায়৷ মাথায় কারো স্নেহের স্পর্শ আর মিহি শব্দে কান্নার আওয়াজ আপার কথা মনে করাল আমায়। ঔষধের ওভার ডোজে চট করে চোখ মেলতে পারছিলাম না, কিন্তু কেবিনে উপস্থিত ব্যক্তিগুলোকে দেখার জন্যেও অস্থির অস্থির লাগছিল। ঈষৎ নড়াচড়া করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিলাম আমি। অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল,
— আপা এসেছ? ইনতিসার? ইনতিসার? তুমিও কি আছো? ইনতিসার….
আমার মৃদু স্বর কেউ বুঝতে পারছিল কি না! কিন্তু মাথার ওপর থেকে স্নেহের স্পর্শ সরে গেল। বেডের পাশে কারোর উপস্থিতিও যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল। আরও অস্থির হয়ে শেষমেশ চোখ মেলে তাকালাম আমি। কিন্তু কোথায় আপা,আর কোথায় ইনতিসার! হসপিটালের জীর্ণ বেডে আমি একা শুয়ে আছি। আমি ছাড়া আর কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই কেবিনটাতে।
কে জানে কেন! কাঙ্ক্ষিত মানুষ দুটোকে না দেখতে পেয়ে সাথে সাথেই আমার কান্না পেয়ে গেল। কোনো কিছু না ভেবে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। আমার কান্নার শব্দে সরব হয়ে উঠল আশপাশ। নার্স তারপর আপুরা সবাই ছুটে এলো কেবিনে। সবাই একটা প্রশ্নই করছিল আমাকে, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি? খারাপ লাগছে? আমি জবাব দিতে পারছিলাম না। কি জবাব দিতাম? কে বুঝতো আমার ভেঙে পড়ার কারণগুলো? অন্যের দুঃখ বোঝার মতো ব্যক্তি পৃথিবীতে আর অবশিষ্ট আছে?
আছে। অবশ্যই আছে। আমিই তো পেয়ে গেলাম একজনকে, যে আমি না বলাতেই আমার ভেঙে পড়ার সব কারণগুলো বুঝে গেল। আর কেউ না ফ্ল্যাটমেট আপুদের মধ্যেই একজন। যে সেদিন রাতে আমায় সুই/সাইড অ্যাটেম্পট নিতে দেখেছিল। হসপিটাল থেকে বাসায় ফেরার পর থেকেই সে আমায় খুব করে সাপোর্ট করতে শুরু করল। সারাটাক্ষণ আমার সাথে সাথে থাকা শুরু করল । আমায় জীবনের মানে বোঝাতো, মুভ অন কীভাবে করতে হবে বাতলে দিতো। আমি অবাক হয়ে দেখতাম সে একপাক্ষিক চেষ্টা করছে আমায় খারাপ সময়গুলো ভোলানোর। আমি প্রথমে ওকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু সময় যেতে যেতে কীভাবে আপনা থেকেই ও আমার বিশ্বাসের জায়গাটা দখল করে নিলো, বুঝতেই পারলাম না। ও ঠিক আমায় নতুন করে বাঁচতে শেখাল। ওর সাপোর্টের মাধ্যমে আমি আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেলাম। পড়াশোনা শুরু হলো আমার। কুণ্ঠাবোধ সব এক ঝটকায় সরিয়ে ফেলে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে লাগলাম সবার দিকে এবং সফলও হলাম৷ দেখতে দেখতে আমার হাসিখুশি জীবন ফিরে আসতে লাগল আমার কাছে। সম্পূর্ণটা নয় কিন্তু আংশিক। অন্তুর আর আমার সম্পর্ক বরফের মতন শীতল হয়ে পড়ে রইলো। না আমরা সম্পর্ক ভাঙলাম আর না আগের মতন গলার জোর ছিল বলার, যে আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা। আমি ঠিক জানতাম না আমাদের সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে ছিল। আমার দিক থেকে চাওয়া-পাওয়াহীন সম্পর্ক আর ওর দিক থেকে? জানিনা।
আমার নিস্তব্ধতা ও কিছুটা দিন স্বাভাবিকভাবেই নিলো। কিন্তু বছর গড়ালেও আমার আচরণে যখন পরিবর্তন এলো না। যখন ও দেখলো আমি আর ওকে আগের মতো চাইছি না, তখন হুট করে ওর টনক নড়লো। ওপেন রিলেশনশিপ থেকে পুনরায় ধরাবাঁধা সম্পর্কে আমায় ফিরিয়ে আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল ও। কতভাবেই না ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগল আমাকে। ক্ষমা চেয়ে, রাগারাগি করে, বন্ধুদের দ্বারা বলিয়ে, অন্যকাউকে পেয়ে গেছি এমন জঘন্য অপবাদসহ আরো নানারকম নাটক করে। কিন্তু আমি ওর কোনো নাটকেই ভুলছিলাম না। ভেতর থেকে কোনো আগ্রহ পেতাম না ওর প্রতি। ভালো আমি ওকে ঠিকই বাসতাম। আগের মতোই।শুধু ছাড় দেয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম।
একটা খুব অদ্ভুত বিষয় হলো আমাকে হারিয়ে ওর তড়পানোর বিষয়টা আমাকে পৈশাচিক আনন্দ দিতে লাগল। আমি অন্যরকম সুখ অনুভব করতাম ওর কষ্ট দেখে। আমার ভেতর এমন নিষ্ঠুর সত্তা কবে জেগেছিল তা আমি নিজেও জানতাম না। কিন্তু চাইছিলাম এই সত্তা চলে যাক আমার ভেতর থেকে। আমি তো এরকম নই।
নিজের এই নিষ্ঠুর সত্তাটার সাথে খুব করে লড়ছিলাম আমি। এর মধ্যে খবর এলো অন্তু দেশে ফিরেছে। সে দেখা করতে চায় আমার সাথে। আমি কেন যেন না করলাম না। আমার মনে হলো সম্পর্কটা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে। এজন্য আমাদের মুখোমুখি হওয়াটা খুব খুব জরুরি।
চলবে,
sinin tasnim sara