ভালোবাসার রংধনু,২৩,২৪

0
898

ভালোবাসার রংধনু,২৩,২৪

২৩
___________
৩৯.
দেখা-সাক্ষাৎটা কোনো রেস্তোরাঁ কিংবা ক্যাফেতে করতে চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু অন্তু বেছে নিলো নিরিবিলি একটা জায়গা। শহরের ভেতরেই কিন্তু আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে অনেক দূর। কেন যেন জায়গাটা নিয়ে আমি কম্ফোর্টেবল ফীল করছিলাম না। এজন্য শুরুতেই না করে দিলাম৷ সম্পর্ক আগের মতন থাকলে এ নিয়ে সে রাগারাগি করতো অবশ্যই। কিন্তু যেহেতু আগের মতন আর কিছুই নেই, তাই ঠিক বুঝতে পারল রাগারাগি আর কাজে দেবে না এখানে। এরপর শুরু হলো অসহায়ের মতো রিকোয়েস্ট করা। ওর প্যারাগ্রাফের মতো মেসেজ গুলো খুব প্যারাদায়ক লাগত আমার কাছে। আমি খুব সহজ ভাবে বলে দিলাম, দেখা করতে হলে আমার পছন্দ করা জায়গাতেই করতে হবে। রাজি হলে আমি দেখা করব, নইলে দরকার নেই। আমার দৃঢ়তা কীভাবে যেন ওর একগুঁয়েমিভাব কাটিয়ে দিলো। তারপর একদিন হুট করে সময়-জায়গা বেছে নিয়ে দেখা করতে গেলাম ওর সাথে। দেখা করার পর একটা অদ্ভুত বিষয় উপলব্ধি করলাম, মানুষটা সামনে আসামাত্র আমার কাঠিন্য ভাব ভেতর থেকে শিথিল হতে শুরু করেছে । তার প্রতি ভালোবাসাটা যে এখন পর্যন্ত অক্ষত আছে এবং মনের কোনো না কোনো অংশে সুপ্তআকাঙ্ক্ষা আছে সবটা ঠিক করে নেয়ার, এটা ভেবেই আমার ঘাম ছুটতে লাগল। আমি ভয় পেতে লাগলাম নিজের দুর্বল সত্তার কথা ভেবে। পুরোটা শক্ত হতে আমি শিখিনি, সেল্ফ রেসপেক্ট এর বুলি আওড়ে যাওয়া আমার মধ্যে এখন পর্যন্ত সেল্ফ রেসপেক্ট জন্মায়নি। এই উপলব্ধিটা যে কতখানি লজ্জায় ফেলছিল আমাকে! বোঝাতে পারব না। নিজেকে চোর চোর মনে হচ্ছিল একবার করে। এরপর মানুষটা যখন ছলছল চোখে পায়ের কাছে বসে ক্ষমা চাইতে লাগল, তখন ঠিক তখনই আমার বেহায়া মন লাগামছাড়া হয়ে গেল। ইচ্ছে করছিল সবকিছু ভুলে এক ছুটে তার বুকে গিয়ে লুকিয়ে পড়ি। কিন্তু সাথেই সুক্ষ্ম এক দ্বিধার স্তর আমায় ঢিলে বাঁধনে বেঁধে রেখেছিল। না এগোতে পারছিলাম আর না পেছাতে। মনে হচ্ছিল এক্ষুণি দম আটকে মারা যাব আমি। নিজের দুর্বলতা লুকতে মানুষটার সামনে থেকে সরে যাওয়াটা খুব দরকার হয়ে পড়ছিল। একদণ্ড না ভেবে দৌড়ে পালাতেও চাইছিলাম আমি। কিন্তু দু পা এগোলে সে যখন ছুটে এসে লোকারণ্যের মাঝে দুঃসাহসিকভাবে আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ভেতরের দুর্বলতাও সবলতার মিথ্যে খোলস ভেঙে বেরিয়ে এলো। নিজের পাগলাটে প্রেমিকা সত্তার কাছে পরাজিত হয়ে নত মুখে তাকে কোনোরকমে বললাম,
— ছাড়ো লোকে দেখছে।
সে দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ভীষণ জেদি কণ্ঠে বলল,
— ছাড়ব না। ততক্ষণ অবধি ছাড়ব না যতক্ষণ অবধি না আমার পুরনো নীর ফিরছে আমার কাছে।
আমি ওকে জোর করে সরানোর চেষ্টা করলাম নিজের থেকে। সেও যেন পণ করেছে ছাড়বে না আমায়। কিছুক্ষণ জোরাজুরি করে ব্যর্থ হলে ক্লান্ত স্বরে বললাম,
— আমায় অপমান করতে এত ভালো লাগে? এই যে এতগুলো মানুষ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দেখছে, মান সম্মান থাকছে আমার?
কথাটা যেন কাজে দিলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরে দাঁড়াল সে আমার থেকে। আমি আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেলাম। সেদিন বাসায় ফিরে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। কোনো কাজে মন বসছিল না। মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু একটা মানুষের খেয়াল, অন্তু অন্তু অন্তু। চোখ বুঁজলে দিনের বেলাকার ঘটনাটা বারংবার দেখছিলাম। এসব কথা না আমি কারোর সাথে শেয়ার করতে পারছিলাম, আর না নিজের ভেতর চেপে রাখতে পারছিলাম। কি যে এক অন্তর্দ্বন্দ্ব! একরকম ছটফট করতে করতে রাত কাবার হয়ে গেল৷ পরদিন সাত সকালে ছিল আমার ক্লাস। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে কিঞ্চিৎ অসুস্থতা শরীরে নিয়ে সে ক্লাস অ্যাটেন্ড করতে হলো। ক্লাস শেষে কোনো বিরতি নেই। নতুন জবে ঢুকেছি। একটা রেস্তোরাঁয় ওয়েট্রেস হিসেবে৷ নতুন জবে চাইলেই কি ছুটি নেয়া যায়?
কাজটা বিশাল কঠিন। এত এত নিয়ম মানতে হয়! মনে হয় সেটাও একটা পরীক্ষা ক্ষেত্র। তবুও শরীরের ক্লান্তি, মনের ক্লান্তি সব সাইডে রেখে জোর করে কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। কোত্থেকে অন্তুর আগমন। সে এসেই ম্যানেজারের কাছে আমার ফ্যামিলি মেম্বার সেজে আমার জন্য ছুটি চাইতে লাগল। এমনিতেই ব্যস্ততা ঘিরে ধরেছিল আমাকে, তার ওপর ওর অনধিকার চর্চা! বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে উঠল আমার। মনে হলো কষে একটা চড় লাগাই। কিন্তু লোকারণ্যের মাঝে সিনক্রিয়েট করা অনুচিত। তাছাড়াও এটা আমার কাজের ক্ষেত্র৷ কোনোরকমে নিজের রাগ সামলে ওকে বললাম, ছুটি নিতে হবে না। আমার কাজ বিকেলের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে৷ সে যেন পারলে একটু অপেক্ষা করে। এক কথাতেই রাজি হলো সে। কিন্তু অপেক্ষা করবে রেস্তোরাঁতেই। চুপচাপ এক কর্নারে বসে অযথা এটাসেটা অর্ডার দিতে শুরু করল। ওর এসব বাড়াবাড়ি আমায় শান্ত থাকতেই দিচ্ছিল না। রাগে একবার মনে হচ্ছিল দেয়ালে ঠুকে ঠুকে নিজেই নিজের মাথা ফাটাই। কিন্তু ধৈর্য হারা হলে তো চলবে না। পুরোটা সময় খুব কৌশলে ওকে ইগনোর করে গেলাম৷
_____________
৪০.
কাজ শেষ হলো মাগরিবের আজানের একটু আগে। তারপর সোজা বাঁদর টার হাত ধরে বাইরে। রেস্তোরাঁর ত্রিসীমানা থেকে ওকে বের করার পর আমার মনটা একটু শান্ত হলো। ফুটপাত দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলেছি পাশাপাশি। কিছুটা পথ যাওয়ার পর কোমল স্বরে সে বলল,
— নিজেকে এতখানি কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয়?
আচমকা ওর কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না আমি। পাশ ফিরে ভ্রু কুঁচকে চাইলাম। ও আলতো ভাবে আমার কপালে আসা বেবি হেয়ারগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে বলল,
— অমানবিক পরিশ্রম করো তুমি রেস্টুরেন্ট টায়। এত কাজ কেউ কাউকে দিয়ে করায়? তার ওপর ম্যানেজারটা ভালো না। কেউ স্টাফের সাথে এত রুড বিহ্যাব করে? স্ক্রা/উন্ডেল!
বলতে বলতে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল ওর। আমি ঝটকা মেরে ওর হাতটা সরিয়ে দিলাম।
— অনেক সহ্য করছি তোমার নাটক। প্লিজ বন্ধ করো তো এসব। এতদিন বাদে কোত্থেকে উদয় হয়ে এসব মিছেমিছি নাটক করার কারণ তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না৷ উদ্দেশ্য কি তোমার?
আমার কথায় আহত দৃষ্টিতে তাকাল ও।
— আমি নাটক করছি? তোমার আসলেই তাই মনে হয় নীর?
— হ্যাঁ মনে হয়, মনে হয়। নাটক না তো কি? সত্যি করে বলো তো, আমার থেকে চাও কি তুমি? অনেক তো হলো। অনেক অপমান, অবহেলা সহ্য করলাম তো আমি। এখন আর কি করতে বলছো? ওহ্ হো, একটা জিনিস বোধহয় বাকি আছে। তোমার মনোরঞ্জনটা এখনও করা হয়নি। তুমি কি সেজন্য …
— নীরদ!
ধমকে উঠল অন্তু। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল ওর। আমার কাঁধ চেপে ধরে ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,
— আমি তোমার কাছে এতখানি ছোটো হয়ে গেছি নীর? আমার ভালোবাসা এতখানি নীচে নেমে গেছে তোমার কাছে? তোমার মনে হয় তোমার অন্তু খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে তোমার কাছে আসতে পারে?
— আমার নও তুমি অন্তু । নও তুমি আমার। আর আমিও তোমার নই।
— তুমি মানো আর না মানো নীরদ, তুমি আমারই । কেবল আমার।
বলতে বলতে খুব কাছে চলে এলো ও আমার। আমি বেশিক্ষণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। চট করে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। অলক্ষ্যে দু ফোঁটা অশ্রুও বিসর্জন গেল বোধহয়!
অন্তু আলতো করে আমার গালে হাত রাখল।
— আমাকে ভুল বুঝো না নীরদ। এতটাও নীচে নেমে যায়নি তোমার অন্তু। বিশ্বাস করো কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি আমি। আমি তো, আমি তো আমার অভিমানী প্রেয়সীকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি । সম্পর্কটাকে একটা নতুন নাম দিতে এসেছি । তুমি আমাকে স্বীকার করবে না নীর? ক্ষমা করবে না তুমি আমায়?
আমি বললাম,
— এত সহজ? এত সহজেই ভুলে যাব আমি সবকিছু? আমার এতদিনের কান্না, আত্মসম্মান বিসর্জন। সব ভুলে যাব এক নিমেষে?
আমি বুঝতে পারলাম না। রাগলাম নাকি আমার কণ্ঠে দিয়ে অভিমান ঝরে পড়েছিল?
এক ঝটকায় বুকে জড়িয়ে নিলো ও আমাকে। ভাঙা স্বরে বলল,
— অপরাধ করে ফেলেছি আমি। বিরাট বড় অপরাধ। কি যে হয়ে গেছিল আমার! আমি না, পারছিলাম না সবটা ম্যানেজ করতে। তোমায় একলা রেখে গিয়ে এত অপরাধবোধ হতো! পড়াশোনাও ভালো লাগত না। এত কষ্ট করে সবটা গুছিয়ে নেয়ার পর অকারণে যখন তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল তখন আর সহ্য করতে পারছিলাম না। নিজ হাতে সাজানো গোছানো সবকিছু কীভাবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমি ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাচ্ছিলাম৷ এজন্য তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারছিলাম না। আমি জানি আমার মৌনতা তোমাকে অস্থির করে তুলছিল। তুমি আরও বেশি করে আমায় চাইতে লাগলে, আর তখনই, তখনই আমার…
কথাটা সম্পূর্ণ করল না অন্তু।
আমি মৃদু স্বরে আওড়ালাম,
— সম্পর্কটাকে বোঝা লাগছিল। বাড়তি ঝামেলা মনে হচ্ছিল। তোমার সাজানো গোছানো জীবনটাকে এলোমেলো করে দেয়ার একমাত্র কারণ মনে হচ্ছিল। তাই তুমি পালাতে চাইছিলে আমার থেকে, এই সম্পর্কটা থেকে।
— না নীরদ না। পালাতে আমি চাইছিলাম না। তোমার থেকে পালিয়ে কোথায় যেতাম আমি? আমার শুধু একটু সময়ের প্রয়োজন ছিল। একটু সময়৷
আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল ও। আচ্ছা ও কি কাঁদছে? আমার কাঁধের কাছে জামাটা ভেজা লাগছে কেন?
দুর্বল হাতে ঠেলে সরাতে চাইলাম আমি ওকে৷ দেখতে চাইলাম ওর অশ্রুসজল কাতর মুখখানা। আশ্চর্য কয়েকদিন আগেও তো ওর অস্থিরতা পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছিল আমাকে। তবে আজ যন্ত্রণা দিচ্ছে কেন?
আমি কি দুর্বল হয়ে পড়ছি?
আমায় নিশ্চুপ থাকতে দেখে অন্তু আমার নাম ধরে ডাকল একবার। কিন্তু সাড়া দিলাম না আমি। দিতে ইচ্ছে করল না৷ ও কি মনে করল, না করল। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ আমায় ছেড়ে দিয়ে
হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ল। ছলছল চোখে হাত জোড় করে বলল,
— থাকতে পারছি না আমি তোমাকে ছাড়া। এক জীবনে তুমি আমার পাশে থাকবে না ভাবলেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি আমাকে যে শাস্তিই দাও আমি মাথা পেতে নেবো নীর। শুধু আমার হাতটা ছেড়ো না। প্লিজ! বিশ্বাস করো, নীরদকে ছাড়া তার অন্তু শেষ হয়ে যাবে। স্রেফ শেষ হয়ে যাবে।
বলতে বলতে ওর চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করল। ওর কাতর কণ্ঠস্বর আমাকেও ছুঁয়ে ফেলল খুব করে৷ আমিও আর পারলাম না গুটিয়ে থাকতে৷
ঠিক-ভুল বিচার করার সমস্ত ক্ষমতা হারিয়ে ওর মুখোমুখি বসলাম হাঁটু গেড়ে। ওর হাত দুখানা দুহাতে জড়িয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললাম,
— কঠিন শাস্তি দেব আমি তোমাকে অন্তু সাহেব, কঠিন শাস্তি দেব। আমাকে যতখানি যন্ত্রণা দিয়েছো তার শতগুণ যন্ত্রণা তোমায় দেব। বলে দিলাম।
অন্তু চট করে টেনে আমায় বুকে জড়িয়ে নিলো। চাদিতে চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— সব মঞ্জুর। শাস্তি দাও, তবু ছেড়ে যেও না।

চলবে,
sinin tasnim sara

ভালোবাসার রংধনু
২৪
_______________
৪১.
এরপর কয়েকমাস আমরা নিজেদের মধ্যে গুছিয়ে নিলাম সবটা।
সেও আর ফিরল না বিদেশে। লেখাপড়া অর্ধেকে রেখে দেশে কিছু করার পরিকল্পনা করল। আমি দু একবার বললাম তাকে এমন সিদ্ধান্ত না নিতে। সবটা তো শর্টআউট হয়েই গেছে। এখন কেন নিজ স্বপ্ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে? বিপরীতে সে কেবল এতটুকু বলল,
— “আমি দীর্ঘ সময় একটা কাজে আগ্রহ ধরে রাখতে পারি না নীরদ। এখন যখন লেখাপড়া থেকে আগ্রহ চলে গেছে, তখন যত যাই হোক সে আগ্রহ আর ফিরবে না। তুমি আর এ নিয়ে ঝামেলা করো না”
এই কথার প্রেক্ষিতে আর কিইবা বলার থাকে মানুষের? স্বাভাবিকভাবে আমিও আর কথা খুঁজে পেলাম না বলবার মতো।
তবে একবার করে মনে হতো আমি বোধহয় স্বার্থপরের মতো আচরণ করছি। এটা তো ওর ভুল ডিসিশন। আমার বোধহয় আরও জোরাজোরি করা উচিৎ ছিল। কিন্তু কেন যে ভেতরে অদ্ভুত শীতলতা! যেন ওর এই সিদ্ধান্তে মনে তৃপ্তি এসেছে। এই তৃপ্ততা থেকেই বোধহয়…
এসব ভেবেও আবার অপরাধবোধ হতো। কেমন পার্টনার আমি? উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ফেলে সে এমন কোথাও স্থান করে নিতে চাইছে যেটা তার জন্য তৈরি হয়নি৷ এতসব জানা সত্ত্বেও আমি নীরব কি করে? তবে, স্বার্থান্বেষী তো কিছুটা হয়েছিলাম বটে৷ এসব অপরাধবোধ কতশত যুক্তিতে আটকাবার চেষ্টা করেছি তার ইয়ত্তা আছে?

অন্তুর বাবার পাথরের ব্যবসা। এসব ব্যবসায় প্রফিট অনেক। ও ইন্ট্যালিজেন্ট ছেলে। ব্যবসায় হাত লাগাতেই যেন লাভের পালে জোর হাওয়া লাগল। দেখতে দেখতে কয়েকমাসে ব্যবসার অবস্থা আরও উন্নত হলো। পাথরের ব্যবসার পাশাপাশি সে আরও নতুন নতুন কাজে হাত দেয়ার কথা ভাবছিল। ছেলেটা খাটতো প্রচুর। কত কত দিন কেটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিটিং করে, ট্রাভেল করে;খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আর রাতের ঘুম তো নেই ই। আমার মনে হলো ও কোনোকিছুর ওপর থেকে দ্রুত আগ্রহ হারিয়ে ফেললেও যখন কোনো কাজে হাত দেয় সেটার চূড়ান্ত পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামে না। ওর এই ব্যস্ততম দিনগুলোতে আমাদের যোগাযোগ হতো একটা নির্দিষ্ট দিনে। প্রতি শুক্রবার। সেদিন সারাটাদিন ও আমার নামে লিখে দিতো। সপ্তাহে ছয়দিন যে কথাটা হতো না সেটা ঐ একদিনে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতাম আমরা। ওদিকে আমার পড়াশোনা, কাজ সবটা সমান তালে এগুচ্ছিল। মোটামুটি খুশিই ছিলাম আমরা এভাবে। কিন্তু লং টার্মের খুশি আমাদের সইবে কেন? আমাদের জীবনে বিরাট একটা পরিবর্তনের সূচনা করতে আচমকা অন্তুর বাবার ডেথ হয়ে গেল। পৃথিবীতে বাবাই ছিল ওর একমাত্র অভিভাবক। যখন মাথা থেকে সেই বাবার ছায়া সরে গেল তখন থেকে ও ভাঙতে শুরু করলো৷ ছন্নছাড়া জীবন শুরু হলো ওর। দিনের পর দিন কেটে যায় অন্ধকার ঘরে নিজেকে বন্দী করে রাখে । তার অফিস বন্ধ, সব কাজ বন্ধ, জ্ঞাতিজনের সাথে যোগাযোগও বন্ধ । সবকিছু থেকে কেমন গুটিয়ে নিলো নিজেকে। আমি ওর এমন অবস্থা দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। এই ভয়ের তাড়নায় সিদ্ধান্ত নিলাম ওর বাড়িতে গিয়ে উঠতে হবে। দূরে থেকে হচ্ছে না। ওকে সামলাতে হলে ওর কাছাকাছি থাকতে হবে। সমাজ আমাদের এক ছাদের নীচে বসবাস হয়তোবা বাঁকা চোখে দেখবে কিন্তু আমার কাছেও কি আর কোনো পথ খোলা আছে? অবশ্য বিয়ে করলে এই বাঁকা দৃষ্টিতে হয়তোবা সইতে হতো না। কিন্তু ঐ মুহুর্তে বিয়েশাদির বিষয়টা কেন যেন মাথায় খেলেনি।
_________________
৪২.
একা একা সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন হুট করে তো ওর বাসায় চলে গেলাম, কিন্তু গিয়ে দেখি আমার আগেই ওর চাচা-চাচী, চাচাতো ভাই-বোন চলে এসেছে সেখানে। বলা চলে বাড়ি ভর্তি মানুষ৷ তাদের দেখে আমি একদম ভয় পেয়ে গেলাম। এরা কেউই জানে না আমাদের সম্পর্কের কথা। যদি জেনে যায় তাহলে ভয়ানক অবস্থা হবে। আবার এখানে জিনিয়ার মাও আছেন। উনি তো সেদিনের পর থেকে আমায় পছন্দই করেন না। এতবড় বিপদের মুখোমুখি হয়ে আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব! পরে লুকিয়ে দারোয়ানের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বলা বাহুল্য ব্যবসার খাতিরে অন্তুরা ততদিনে আলাদা বাড়ি নিয়ে নিয়েছিল। এখানে প্রায় সকলে আমায় চিনতো। ভাড়াটিয়া, হেল্পিং হ্যান্ড থেকে শুরু করে সবাই। তাই একা একা চলে আসার সাহসটা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি কি জানতাম? ইতোমধ্যে এখানে সব ঘেঁটে ঘ হয়ে আছে!
ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল আমার ভেতরটা। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে দারোয়ানকে বললাম, সে যেন লুকিয়ে অন্তুকে ডেকে নিয়ে আসে। কেউ বুঝতে না পারে এমনভাবে। আমার কথা শুনে প্রথমে অবাকই হয়েছিল লোকটা, তবে কেন যেন কোনো প্রশ্ন করেনি। চুপচাপ মাথা নেড়ে চলে গেছে।
________
৪৩.
নার্ভাসনেসে আমি অনবরত পায়চারি করছি, ঠিক তখন এলো অন্তু। ওর চোখেমুখে বিস্ময়৷ আমায় দেখেই বলল,
— তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আসবে যে আমাকে তো কলও করোনি। আর তোমার সাথে এই লাগেজ?
আঙ্গুল দিয়ে আমার লাগেজটার দিকে ইশারা করলো৷ ওকে দেখে যেন আমার প্রাণ ফিরে এসেছে ৷ আমি ছুটে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরে এক নাগাড়ে সবটা খুলে বললাম। আমার দুঃসাহস দেখে ওর চোখ ছানাবড়া। গলা খাদে নামিয়ে হতভম্ব হয়ে বলল,
— বুদ্ধিসুদ্ধি এত কম হলে হয় নীরু? এই যে তুমি ইমোশনাল হয়ে আমায় সাপোর্ট দিতে চলে এলে একবারও ভাবলে না আমাদের সম্পর্কটা সমাজ স্বীকৃত নয়। আমি ছেলে, লোকে আমায় কিছুই বলতো না। কিন্তু তোমায় ছেড়ে কথা বলতো কেউ?
ওর কথার প্রতুত্তরে আমি বোকার মতো মাথা নেড়ে বললাম,
— ওসব বিষয়ে আমি ভাবিইনি। আমার কাছে শুধু তুমি ইম্পর্ট্যান্ট।
ও এবার রেগে গেল।
— আমি ইম্পর্ট্যান্ট তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে চলো?
আমার হাত চেপে ধরে ভেতরে পা বাড়াতে চাইল ও। আমি টেনে আটকালাম ওকে। মাথা নীচু করে বললাম,
— কিন্তু তোমার পরিবারের লোক চলে আসবে এটা তো ভাবিনি।
— সমাজের মধ্যে তো পরিবারের লোকেরাও পড়ে নীরু। সমাজ নিয়ে চিন্তা করোনি তাহলে ওদের নিয়ে চিন্তা করছো কেন? চলো ভেতরে চলো।
— ভেতরে নিয়ে আমায় কি বলে পরিচয় দেবে?
— আমি কেন পরিচয় দিতে যাব? তুমি এসেছো, তুমি নিজেই তোমার পরিচয় দেবে।
দাঁতে দাঁত চেপে বলল ও। এর বিপরীতে কি বলব চট করে বুঝে উঠতে পারলাম না আমি। মাথা নীচু করে নীরব রইলাম। ওদিকে সেও চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে। বেশ কিছুটা সময় নীরবতায় কাটার পর আমি মৃদু স্বরেই বলে উঠলাম,
— তোমায় নিয়ে টেনশন হয় আমার। ভালোবাসি তোমায়। তোমার ভালো-মন্দ চিন্তা করার অধিকারও আমার নেই?
— তাই বলে তুমি ঠিক-ভুল বিচার করবে না?
— ঠিকাছে আমি ভুল করেছি। এখন আমার ভুলটাকে তুমিই ঠিক করে দাও। তুমি তো জানোই এই ভুলটাকে কীভাবে ঠিক করতে হয়৷
— ওহ্ প্লিজ নীরু। ফর গড সেক এর মধ্যে বিয়ের কথা অ্যাটলিস্ট টানবে না।
বিরক্তির সাথে বলল ও। কথাটায় আমি খুব আঘাত পেলাম।
— কেন তুমি বিয়ে করতে চাও না আমায়?
— আমি কি একবারও বলেছি চাই না? অবশ্যই চাই। কিন্তু এটা বিয়ে করার উপযুক্ত সময় নয়৷ তোমার লেখাপড়া শেষ করতে হবে না? চাকরি পেতে হবে না? নীরু তুমি বারবার কেন তোমার স্বপ্নগুলো ভুলে যাও?
আমি চাইলে উত্তর করতে পারতাম ওর কথার। ওর জন্য আমি পৃথিবীর সবকিছু ভুলতে পারি, সবকিছু।
কিন্তু এই মুহুর্তে আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। আমায় নীরব থাকতে দেখে ও নরম হলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— রাগ করলে? র‍্যুড হলাম বলে।
— আমি কিন্তু তোমার কথা ভেবেই এসেছিলাম অন্তু।
ও মৃদু হেসে আমার মুখখানা করতলে নিয়ে বলল,
— এখনও টিনেজারদের মতো রাগ করো নীরু। আমিও তো তোমার ভালোর জন্যই বলছি।
— বুঝতে পেরেছি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখ ফিরিয়ে বললাম আমি। ও আমার হাত টেনে ধরলো আবার।
— এই যে রাগ আরো বেড়ে যাচ্ছে তোমার। কি যে করি না তোমায় নিয়ে !
— কিচ্ছু করতে হবে না। সরো চলে যাব আমি।
— সরবো। আগে বলো কি করলে রাগটা কমবে তোমার?
— রাগই যখন করিনি তখন রাগ কমানোর প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?
— এটা তোমার মনের কথা নয়৷
— আমার মনের কথা আসলেই তুমি বোঝো?
মৃদু হেসে ওর চোখের দিকে তাকালাম আমি। খানিকটা সময় সেও আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল,
— চলো তোমায় রেখে আসি।
আমি আর উচ্চবাচ্য করলাম না৷ চুপচাপ লাগেজ নিয়ে হাঁটা ধরলাম। ও রিকশা করে আমায় পৌঁছে দিয়ে গেল বাসায়। পুরো রাস্তা আর বাক্য বিনিময় হলো না আমাদের মাঝে। কেবল নামার পর ও এতটুকু বলল,
— এই যে তুমি মনে করো আমি তোমার মনের কথা বুঝি না। বিষয়টা কিন্তু ঠিক নয় নীরু। আমি সব বুঝি। কিন্তু ভালো চাই তোমার। ভালোবাসাকে আপন করে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। কোন পাগল তার সেই সৌভাগ্যকে স্বেচ্ছায় ঠেলে সরিয়ে রাখবে?
আমি জানি তুমি আমারই হবে। তাই খুব আগ্রহভরে অপেক্ষা করছি। তোমার জন্য আমি সারাটা জীবন অপেক্ষা করতে পারব নীরু। সারাটা জীবন। তুমি শুধু তোমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে একবার পৌঁছে যাও৷
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here