ভালোবাসার রংধনু,২৫,২৬

0
1103

ভালোবাসার রংধনু,২৫,২৬

২৫
_____________
৪৪.
সুখ এবং দুঃখ দুটোই খুব অদ্ভুত জিনিস। সবার জীবনে এরা সমান ভাবে আসে না। কারো ভাগে হয় সুখটা বেশি পড়ে আর দুঃখটা কম, কারোর ভাগে আবার দুঃখের ডালা উপুড় করে ঢেলে দেয়া । তাই বলে যে সে কখনোই সুখের মুখ দেখে না এই ধারণাটা বোধহয় ভুল। এই যে আমি নিজেকে এতটা অভাগী মনে করি; যার জীবনের পরতে পরতে দুঃখ গাঁথা। আমার জীবনে কি কিঞ্চিৎ পরিমাণ সুখ নেই? কখনো ছিল না? ছিল, অবশ্যই ছিল। হয়তোবা আজ দুঃখকে বড় করে দেখছি বলে দুঃখ পিছু ছাড়ছে না। কিন্তু জীবনে বড় রকমের পরিবর্তন কখনো কি হতে পারে না? ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? হয়তোবা পৃথিবীর কোথাও, কোনো সীমান্তে এক পৃথিবী সুখ ভীষণ আগ্রহ নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কেবল আমার একটা পদক্ষেপের দেরি!

সেদিনের পর অন্তুর সাথে আমার সম্পর্কের সুরটা কেমন কেটে গেল। এবারে বোধহয় কাটলো আমার তরফ থেকেই। বিয়ের কথা বললেই ওর পালাই পালাই মনোভাব আমার ভালো লাগছিল না। আর কতদিন এভাবে থাকব আমরা! বিয়ের পর কি লেখাপড়া কন্টিনিউ করা সম্ভব নয়? সংসারে বাড়তি মানুষ নেই, কোনো ঝুট-ঝামেলাও নেই। এছাড়াও আমি লেখাপড়া করছি স্বনামধন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যোগ্যতা কি কোনো অংশে কম আমার? তাহলে ওর বারবার সিলি কিছু লজিক দেখিয়ে বিয়ের ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণ কি? ওর এসব আচরণে মনে হচ্ছিল সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার আগ্রহ কেবল আমার। আমি কি বলেছিলাম ওকে দ্বিতীয়বার ফিরতে? ফিরলোই যখন তাহলে এখন এরকম করবে কেন? খুব রাগ হলো আমার।
রাগ করে ওর ব্যাপারে কিছুটা অনাগ্রহ দেখাতে লাগলাম।
ওদিকে অনার্স ফাইনাল চলে এসেছিল। এমনিতেই সেমিস্টার ড্রপ দেয়ার একটা লজ্জা ছিল। জুনিয়রদের সাথে পড়ছি রেজাল্ট তো আমায় ভালো করতেই হতো। কোমর বেঁধে লেগে পড়েছিলাম পড়াশোনায়। সেজন্য সাধের চাকরিটাও ছেড়ে দিলাম।এখন শুধু আমি আর আমার পড়াশোনা৷ মধ্যিখানে আর কারো স্থান নেই। কিন্তু পড়তে গিয়ে খেয়াল করলাম অনেক ছোটোখাটো বিষয় আমি বুঝতে পারছি না। বুঝলাম মাঝেমধ্যে ক্লাসে ফাঁকি দেয়ার ফল এটা। এখন পড়াগুলো বুঝব কি করে? বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। বন্ধুদের থেকে হেল্প চাইলে দু একজন সাজেশন দিলো ক্লাসের হাই সিজিপিএ ধারী ফার্স্ট বয়ের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে। ওর কাছ থেকে কিছু নোটস হাতিয়ে নিতে পারলেই কেল্লা ফতে। আইডিয়া খারাপ না। আমার বেশ পছন্দই হলো, তবে ওই ফার্স্ট বয়ের সাথে বন্ধুত্ব পাতাব কি করে?
ওর সাথে কখনো চোখাচোখি হয়েছে বলেও তো মনে পড়ে না। এখন হঠাৎ করে অবতীর্ণ হয়ে ওর সামনে পেছনে ঘুরঘুর করলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে না? এমনিতেই সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমি ওর সিনিয়র হতাম। কে জানে বয়সেও বড় কি না! জুনিয়র ছেলের সামনে নোটের জন্য ঘুরঘুর করব বিষয়টা ভাবতেই তো লজ্জা লাগছে। কিন্তু প্রয়োজনও তো আমারই। দোটানায় ভুগতে ভুগতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল আমার। কিন্তু আমার দোটানায় তো সময় সঙ্গ দিলো না। পরীক্ষা এলে সময়ও দ্রুত যায়। একেকটা দিন যেভাবে পাখির ডানায় ভর করে যেতে লাগল, আমি ভয়ই পেলাম লজ্জা আঁকড়ে পড়ে থাকতে গিয়ে ফেইল না হয়ে যায়। শেষে নিজেকে একটা কড়া ধমক লাগিয়ে লজ্জাকে সাইড করে ফার্স্ট বয় ছেলেটা, কি যেন নাম? সাজিদ। সাজিদের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললাম। ছেলেটা অতটাও কম্পলিকেটেড নয়। দু একদিন লাইব্রেরিতে ওর পাশে গিয়ে বসতেই বুঝে গেল কি চাই আমার। পরে হাসিমুখে নোটস বের করে দিতে দিতে বলল,
— পড়াশোনায় হেল্প চাইতে লজ্জা কিসের? যে লজ্জায় নিজের ক্ষতি হয়, সে লজ্জা থাকার চাইতে না থাকাই ভালো নয় কি?
ওর কথার প্রেক্ষিতে মাথা নীচু করে ক্ষীণ হাসলাম আমি। এতবড় কাজ এত সহজে হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। নাকি কিছু কাজ সহজই? আমার ভাবনার পরিধিই জটিল৷ কে জানে!
____________
৪৫.
দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। নিজ পরিশ্রম আর সাজিদের হেল্পের বদৌলতে বেশ ভালো পরীক্ষা দিলাম। এবং পরীক্ষার পরপরই সাজিদের সাথে বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠলো। পৃথিবীতে কতকিছু জানার আছে, শেখার আছে ওর সাথে মিশতে মিশতে বুঝতে পারলাম। প্রফেসরের প্রিয় ছাত্র ছিল ও। বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রফেসর ওকে ডেকে পাঠাতেন। বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়ায় ও আমাকেও নিয়ে যেতে শুরু করলো ওসব কাজে। টুকটাক আমি যা পারতাম সাহায্য করার চেষ্টা করতাম৷ প্রফেসর ভীষণ জ্ঞানী মানুষ এবং মিষ্টভাষী। ওনার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগত আমার।
একসময় নিজের জীবন নিয়ে যে মধুর স্বপ্নগুলো দেখেছিলাম, এই মানুষগুলোর সাথে মেশার পর মনে হচ্ছিল সেই স্বপ্নগুলো ছুঁতে পারা তেমন একটা কঠিন নয়। শুধু চেষ্টা করতে হবে আমাকে।
আমি তো শুরু থেকেই ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম। নিজের জীবনের গল্পগুলো কখনো কারো সাথে শেয়ার করিনি একান্ত আপনজন ছাড়া। কিন্তু এতবছরে প্রথমবার এমন হলো সাজিদ আর প্রফেসর দুজনকেই আমার জীবনের সব ঘটনা খুলে বললাম। সাজিদ ইমোশনাল ছেলে। শুনতে শুনতে আবেগপ্রবণ হয়ে গেল। কিন্তু নিজেকে খুব সন্তর্পণে সামলেও নিলো। প্রফেসর আবার খুব শক্ত মনের মানুষ। আমার জীবনের গল্প শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— তুমি একদিন খুব বড় হবে মেয়ে। এতটা সহ্য করে এতদূর অবধি এসেছো। আর অল্পকিছুটা সহ্য করতে হবে। জীবন চলার পথটা এরকমই। মসৃণ পথের সন্ধান সকলেই পায় না। কাউকে খানিক কাঠখড় পোড়াতেও হয় সফলতা পেতে।চিন্তার কিছু নেই। সোনা পুড়লেই তো খাঁটি হয় নাকি? শোনো, কোনো প্রয়োজন হলে নির্দ্বিধায় আমাকে নক করবে। তুমি আমার কন্যা সমতূল্য। আমার সন্তানদের চেষ্টা করেও সুখের পথটা ধরিয়ে দিতে পারিনি আমি। হয়তোবা আমার চেষ্টাতেও কোনো ত্রুটি ছিল! কিন্তু তোমাকে আমি যতটা পারি সাহায্য করবো। তুমি কিছু করতে পারলে আমার অবশ্যই ভালো লাগবে।
শুনেছি প্রফেসরের দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে বড়। এককালে বেশ সুখ্যাতি ছিল। ভালো ছাত্র, ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে, রিচ ফ্যামিলি, দেখতে শুনতেও ভালো। কিন্তু কিছু হাই সোসাইটি ছেলেপেলেদের যা হয়! সঙ্গদোষ। সঙ্গদোষে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গেছে কোনো এক অতল গহ্বরে। এখনও নামডাক আছে তবে মাদকসেবি হিসেবে। বেশ কিছুদিন আগেই জেল খেটে এসেছে । এখন লাপাত্তা। আর মেয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে কম বয়সে বিয়ে করেছিল। বেশিদিন সংসার করতে পারেনি, খুব অকস্মাৎ তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়৷ এরপর শ্বশুরবাড়িতেও জায়গা হয়নি। কয়েকদিন বাবার বাড়িতে ছিল। তারপর বাইরের দেশে চলে গেছে। পড়াশোনাটা আবারও শুরু করেছে।
এখন প্রফেসর আর তাঁর ওয়াইফ থাকেন এখানে একে অপরের পরিপূরক হয়ে। কি অদ্ভুত! বাইরে থেকে মানুষের জীবন যেরকম পরিপাটি ধারণা করা হয় ভেতর থেকে তা কতখানি পরিপাটি কিংবা আদৌ পরিপাটি কি না! কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। মনুষ্য জীবন বড়ই রহস্যময়।
________
৪৬.
এরপর বেশ কয়েকদিন পরের ঘটনা। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে একদিন বাইরে বেরুলাম। কাজ শেষে ফিরব, হঠাৎ সাজিদের সাথে দেখা। আমায় দেখে তো সাজিদ ছাড়বেই না, লাঞ্চ করাবে। আমিও দ্বিমত পোষণের কারণ খুঁজে পেলাম না। মাঝে অনেকদিন ওর সাথে কথা হয়নি। এই উছিলায় নাহয় হবে! পাশেই ওর আত্মীয়ের রেস্তোরাঁ ছিল। পরিচিত এবং খাবারের মান ভালো হওয়ায় ওখানেই বসার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। তবে ওখানে বসার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্তও কি জানতাম এতদিন পর এই অসময়ে খুব অপ্রত্যাশিতভাবে অপ্রত্যাশিত কাউকে দেখতে পারব! আপনারা ভাবছেন আমার জীবনে অপ্রত্যাশিত কেউটা আবার কে? আছে আছে আমার জীবনেও কিছু অপ্রত্যাশিত মানুষ আছে। অন্যদের কথা বাদ থাকুক, বরং যার সাথে দেখা হলো তার কথা বলি। ফেলে আসা অতীত, ইনতিসার। হ্যাঁ বছর পেরিয়ে হঠাৎ করে আজ ইনতিসারকে দেখতে পেলাম আমি। আমার ঠিক সামনে দুটো টেবিল পরেই বসেছিল। প্রথমে দেখায় চিনতে পারছিলাম না। কেন যেন বেশ পরিবর্তন এসে গেছে ওর চেহারায়। গায়ের রঙ নষ্ট হয়ে গেছে, চেহারা ভেঙে গেছে; আবার মুখভর্তি দাড়িও হয়েছে। সবসময় হেয়ার জেল দিয়ে সেট করে রাখা চুলগুলো অবিন্যস্তভাবে খানিক বেড়েছে। সেগুলো আবার অপরিপক্ব হাতে ছোটোখাটো পনিটেইল করে রাখা। চোখে ধাঁ ধাঁ লাগছিল আমার। দু টেবিল সামনের অপরিচিত চেহারার ছেলেটা যে ইনতিসার, বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ও তো এরকম ছিল না? ওকে দেখে খুব অস্বাভাবিক লাগছে। চোখদুটো কি ভীষণ বিষণ্ণ! চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। আচ্ছা সেই রাতটার পর ও পাল্টে গেছে নাকি এর মধ্যে নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে যেটা সম্পর্কে আমি অবগত নই? এরকম শ-খানিক প্রশ্ন একত্রে সূঁচ বিদ্ধ করে চলেছিল আমার মস্তিষ্কে। কিছুতেই সেই প্রশ্নগুলো থেকে পালাতে পারছিলাম না আমি। এতদিন বাদে ইনতিসারের মুখোমুখি হওয়া হয়তোবা অনুচিত। কিন্তু আমি যে আটকাতে পারছি না নিজেকে। আমার কি উঠে যাওয়া উচিৎ ওর সামনে? জিজ্ঞেস করা উচিৎ ওর কি হয়েছে?

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

১৮+ সতর্কতা
ভালোবাসার রংধনু
২৬
______________

৪৬.
মনের দোলাচলে ভুগতে ভুগতে কখন আমি ইনতিসারের দিকে পা বাড়িয়ে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। ইনতিসার হয়তোবা আর এক কদম দূরে এরই মধ্যে হঠাৎ আমায় হ্যাচকা টানে কেউ বিপরীত দিকে ফিরিয়ে নিলো। আমি অবাক এবং আহত হয়ে তাকিয়ে দেখলাম অন্তু। সেও এখানেই? বিস্ময় জাগলো আমার মধ্যে। ওদিকে সে ভ্রু কুঁচকে শুধলো,
— কখন থেকে ডাকছি শুনতে পারছো না?
ডাকছিল নাকি? কই আমি তো শুনতে পাইনি। ওর প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছে হলো না আমার। ইনতিসার আছে কি না মুখ ফিরিয়ে তা দেখাই যেন মুখ্য আমার কাছে। কিন্তু একি, ও তো নেই। বিচলিত হয়ে আশপাশটায় ভালো করে চোখ বুলালাম আমি। ও আসলেই নেই কোথাও। কিছুক্ষণ পূর্বেও যে ওকে দেখলাম? তবে কি আমার ভ্রম ছিল! আমার যে কত প্রশ্ন জমেছিল মনে। এখন এগুলোর উত্তর পাব কোথায়?
— কি হলো কথা বলছো না কেন? আর কি খুঁজছো এমন অস্থির হয়ে?
আমার হাতের ওপর অন্তুর হাতের চাপটা খানিক বাড়ল। ব্যথায় চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো আমার। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,
— কিছু না। তুমি এখানে কি করছো?
— আমারো তো একই প্রশ্ন। তুমি এই সময়ে এখানে কেন?
— কাজ ছিল তাই এসেছি।
ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলাম আমি। উত্তরটা যে ওর মনপুত হলো না এর প্রমাণ দিতে আবারও ও খামচে ধরলো আমার কনুইয়ের কাছটা। কণ্ঠ যথাসম্ভব নীচু করে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল,
— একটা ছেলের সাথে বসে ছিলে দেখলাম। হু ইজ হি?
আমি চট করে ওর চোখের দিকে তাকালাম। এ মুহুর্তে কি ও আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে? ওর অভিব্যক্তি তো তাই ই বলছে। ভাবতেই মুখ তেতো হয়ে গেল আমার। কঠিন স্বরে বললাম,
— অফকোর্স হি ইজ মাই ফ্রেন্ড।
— কই আগে তো পরিচয় করাওনি আমার সাথে।
— এটা পাবলিক প্লেস অন্তু। প্লিজ এখানে এসব নয়।
আমার কথা শুনে ও হাতটা ছেড়ে দিলো। তবে কাটকাট গলায় বলল,
— কি করছি আমি? কিছুই করছি না। শুধু জানতে চাইছি ও কবে তোমার ফ্রেন্ড হলো।
— ঠিকাছে জানতে চাইছো, জানবে। চলো ওর সাথে কথা বলেই নাহয় জেনে নাও। তবে আই বেগ অফ ইউ কোনো সিনক্রিয়েট নয়।
— ওকে ফাইন। করলাম না সিনক্রিয়েট।
প্যান্টের পকেটে হাত পুরে কাঁধ উঁচু করে বলল ও। নিশ্চিত হয়ে আমিও ওকে নিয়ে গেলাম সাজিদের সাথে পরিচয় করাতে।
সাজিদ অবশ্য ওকে আগে থেকেই চেনে। আমার পরিচিত কারোর থেকেই লুকোই না আমি সম্পর্কের কথা। বরং সবাইকে একধাপ বেশি করে বলি অন্তু আমার ফিয়ন্সে। খুব জলদিই বিয়ে করছি আমরা। বিয়ে করি আর না করি বলে বেড়িয়েছি ঠিক। বিষয়টা হয়তোবা হাস্যকর। হোক, হাস্যকর কাজকর্মও করতে হয় মাঝেমধ্যে।

অন্তু সাজিদের সাথে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলো। ওদের গল্পের ধরন দেখলে মনেই হবে না একটু আগে এই সাজিদকে নিয়েই ও নাক সিঁটকোচ্ছিলো। অবশ্য ওরা কি কথা বলছে আমি বুঝতে পারছি না। এসবে আমার মন নেই। মন পড়ে আছে কিছুক্ষণ পূর্বের ভাঙাচোরা ইনতিসারের দিকে । কি হয়েছে ওর? এখানে এসেছিল কেন? গেলই বা কখন? ও কি আমায় দেখতে পেয়েছে?
ইশশ কতগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু উত্তর একটাও জানা নেই।
— কি নীরু? থেকে থেকে কোথায় হারিয়ে যাও বলো তো?
অন্তুর ধাক্কায় আবারও বাস্তবে ফিরলাম আমি। মাথা নেড়ে বললাম,
— উঁহু কোথাও নয়। সাজিদ কোথায় গেল? ওকে দেখছি না।
— ওর ফোন এলো একটা। কথা বলতে গেল বোধহয় ওদিকটায়।
— ওহ্।
এতটুকু বলে কফির কাপ নাড়াচাড়া করতে লাগলাম আমি। কফি কখন দিয়ে গেছে খেয়ালও করিনি।
— নীরুউ; নীরদ আমার ওপর এখনও রাগ?
আমার আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে কোমল কণ্ঠে শুধলো অন্তু। আমি কফির কাপের দিকেই তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে। কিছুটা সময় নিয়ে ছোট্ট করে উত্তর দিলাম,
— নাহ্।
— কতদিন হয়ে গেল আমার কল পিক করছো না তুমি। মেসেজের উত্তর দিচ্ছো না৷ দেখাও করছো না। কতদিন গেলাম তোমার বাসায়। কখনো তুমি বাসায় থাকো না, কখনো ইন্টারকমে কল গেলেও রিসিভ করো না৷ কেন এমন করছো?
— কি করছি আমি অন্তু? তুমি যা চাও তাই শুধু দেবার চেষ্টা করছি।
— আমি যা চাই?
— তুমি চাও আমি তোমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখি। তাই তো রাখছি। বিয়ে করতে চাও না জানি। চাও না সমস্যা নেই৷ এভাবেই থাকি অন্ততকাল। নিজেকে প্রিপেয়ার করছি। তোমারও এখন প্রিপেয়ার্ড হওয়া উচিৎ।
— নীরদ তুমি একটা বিষয় নিয়ে কেন পড়ে আছো? আমি কি একবারও বলেছি বিয়ে করবো না? বিয়ে করবো, অবশ্যই করবো। বাবা মারা গেল মাত্র কয়েকদিন হয়। আমার কাঁধে রাজ্যের দায়িত্ব। যা পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি আমি। জানো তো পৃথিবীতে আর সবকিছু থেকে পালানো গেলেও দায়িত্ব থেকে পালানো যায় না৷ দায়িত্ব থেকে পালায় কাপুরুষরা৷ আমি তো কাপুরষ নই।
খানিক চুপ করে থেকে ও আবারো বলল,
— শোনো নীরদ। অল আই ওয়ান্ট ফ্রম ইউ ইজ, টাইম। আমাকে একটুখানি সময় দাও জাস্ট। এসব আমি তোমার জন্যই করছি। অনলি ফর ইউ। আই ওয়ান্ট টু গীভ ইউ দ্য বেস্ট লাইফ, দ্য বেস্ট ফিউচার। তুমি শুধু আমার পাশে থেকে আমায় সাপোর্ট করো।
অন্তু খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে৷ ওর গোছানো কথা মানুষকে নিমেষে কুপোকাত করতে সক্ষম। যে যুক্তিগুলো ও দেখায় ওগুলোর বিপরীতে একটা টু শব্দ করারও জো আছে? নেই।
আমিও তেমন কিছু পেলাম না৷ মনে অনেককিছু ঘুরপাক খাচ্ছিলো তবে গুছিয়ে বলতে পারছিলাম না৷ অগত্যা কনভিন্স হয়ে গেলাম৷
সাজিদের কি যেন জরুরি কাজ পড়ে গেল। ও কোনোরকমে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ওর যাওয়ার পর আমরা আর কিছুক্ষণ থাকলাম ওখানে। আসরের আযান পড়লে অন্তু আমায় বাসায় নামিয়ে দিলো। চলে যাওয়ার সময় মিষ্টি হেসে বলতে ভুলল না, “বন্ধুদের সাথে বেশি ঘোরাফেরা নয় কেমন। এটা আমার পছন্দ নয়”
প্রতুত্তরে আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বুঝলাম ও জেলাস। জেলাসির কি আছে? একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের বাইরে আর কোনো সম্পর্ক হতে পারে না? অদ্ভুত!
_________________
৪৭.
অন্তুর জেলাসির বিষয়টাকে কিন্তু আমি খুব লাইটলি নিয়েছিলাম। আমি ভাবতেও পারিনি সম্পর্কের এতদিন পর এসে টিনএজদের মতো খুব নর্মাল বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হবে। আমার প্রত্যেকটা পদক্ষেপে ওর এই বাঁধা-সেই বাঁধা আমাদের সম্পর্কটাকে টক্সিক লেভেলে নিয়ে যেতে শুরু করেছিল৷ এমনকি একসময় ও আমার লোকেশনও ট্রেস করতে শুরু করলো। ওকে না বলে এক পা বাইরে দেয়ার উপায় নেই। আমার নিজেকে মনে হচ্ছিল আ ব্রোকেন উইংড বার্ড। একটা ডানা ভাঙা পাখি৷ যাকে ওড়ার বৃথা স্বপ্ন দেখিয়ে নিজ হাতে ডানা ভেঙে দেয়া হয়েছে।
ওর পোজেসিভনেস দিনকে দিন বাড়ছিল বৈ কমছিল না। অযথা সন্দেহ করতো। একসময় পোজেসিভনেস এতটা বেড়ে গেল প্রফেসরকে নিয়েও সন্দেহ করতে শুরু করলো । এমন আচরণ করতো একেক সময়! যা দেখলে ওকে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হতো না আমার।
আমি আসলে বুঝে উঠতে পারছিলাম না হঠাৎ করে ওর এমন পরিবর্তনের কারণ কি।খুব করে খোঁজারও চেষ্টা করছিলাম সেই কারণটা কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
তবে একদিন নিজে থেকে কারণটা এসে ধরা দিলো আমার কাছে। একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম অন্তুর সাথে। সেখানে বহুদিন পর দেখা হলো নিতুলের সাথে। নিতুল ঐ মেয়েটা যে একসময় অন্তুর জন্য পাগল ছিল। যার কারণে অন্তুর সাথে আমার নাটকীয় পরিচয়টা।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম নিতুলের সাথে অন্তুর খুব ভালো ফ্রেন্ডশিপ। ওদের কথাবার্তার ধরন, হাসি-তামাশা দেখে মনে হচ্ছিল দুটিতে একদম বেস্ট ফ্রেন্ড, কিংবা তার থেকেও বেশি কিছু। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল এই নিতুল মেয়েটা যেমন আমাদের সম্পর্ক শুরুর কারণ ছিল তেমনই বোধহয় সম্পর্ক শেষেরও কারণ হবে। আমাদের সম্পর্কটাকে ভাঙার পেছনে সমস্ত কলকাঠি ও-ই নাড়বে। এবং আই ওয়াজ অ্যাবসোলিউটি রাইট। কলকাঠি নাড়তে তো শুরু করেই দিয়েছিল। সিংহভাগ কাজ করেছে আগেই আমাকে নিয়ে অন্তুর মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়ে। শেষ যে চালটা বাকি ছিল তা এক্সিকিউট করে দিলো পার্টিতে। শুরুতে খুব নাটকীয় ভাবে আমায় সফট ড্রিংকস এর সাথে নেশাদ্রব্য মিশিয়ে খাইয়ে দিলো আমার অগোচরেই। জীবনে প্রথমবার নেশাদ্রব্য গ্রহণ, আমি ঠিক সহ্য করতে পারলাম না। অস্বস্তি হচ্ছিল এবং এক পর্যায়ে গলগল করে বমি। সকলের সামনে এভাবে বমি করায় খুব এম্ব্যারাসড ফীল করলো অন্তু। সাইডে এনে চোখ কটমট করে বলল,
— এটা কোনো কাজ করলে? শরীর খারাপ হয় এমন জিনিস খেতে হবে কেন তোমার? কতগুলো মানুষের সামনে তুমি আমায় অপমান করলে আইডিয়া করতে পারো?
আমি কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। শরীরটা আমার এত খারাপ হয়ে গেছিল বমিতে ! দুর্বল হয়ে ওর গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ। ওদিকে নিতুল তার নাটক চালিয়ে যেতে অন্তুর বকা থেকেও আমায় বাঁচাতে এলো। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে অন্তুকে শাসনের সুরে বলল,
— তুমি যে কি করো না! অসুস্থতা কি দেখে আসে? করেছে নাহয় বমি। তো কি হয়েছে? এখন ওকে বকাঝকা করার সময়? কোথায় ফ্রেশ হতে পাঠাবে তা না….
দেখি নীরদ এসো তো। তোমায় ফ্রেশ করে নিয়ে আসি। তারপর অন্তুর থেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে ও ই আমায় ওয়াশরুম অবধি নিয়ে গেল৷ আমি যখন ফ্রেশ হচ্ছি তখন হঠাৎ ও গায়েব। আমি অবশ্য ওর দিকে বেশি খেয়াল করতে পারছিলাম না। গা গোলানো ভাবটা কিছুতেই কমছিল না আমার৷ নীচু হয়ে বেসিনের টেপে মাথা ভেজাচ্ছিলাম ঠিক এমন সময় হঠাৎ করে আমায় পেছন থেকে একজোড়া শক্ত হাত জাপ্টে ধরলো। চমকে উঠে পেছন ফিরেই দেখতে পেলাম যার পার্টিতে আজ এসেছি, অন্তুর বন্ধু, সেই লোকটা। ছটফটিয়ে তৎক্ষনাৎ সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে লোকটা তার নোংরা হাতদুটো দিয়ে আমার বুকের কাছটায় চেপে ধরে খুব অশ্লীল শব্দ করে বলে উঠল,
— সেক্সি! কতক্ষণ থেকে তোমাকে দেখে যাচ্ছি আইডিয়া আছে? তুমি তো আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছ। অন্তু এত সেক্সি একটা মেয়ের সাথে ডেট করে কই আগে বলেনি তো। শালা ****
পিঠে মুখ ঘষতে ঘষতে বিড়বিড় করে গালি দিয়ে উঠল লোকটা । আমি ভয়ে কথা বলতে পারছিলাম না। বছর চারেক আগের সেই ভয়াল রাতটার কথা মনে পড়ছিল, যে রাতে দুলাভাই আমাকে…
খুব কষ্টে নিতুলের নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু নাহ্ ও তো এই তল্লাটেই নেই। বুঝলাম এই লোকটাকে আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে নিতুলই। ছিঃ একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এতবড় ক্ষতি কেউ কীভাবে করতে পারে?
আমার শক্তি শেষ হয়ে আসছিল ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে। মনকে বোঝাচ্ছিলাম আজ চুপচাপ থাকলে আমি নিজেকে বাঁচাতে পারব না। কেউ আসবে না এদিকে। যা করার আমাকেই করতে হবে। হাত-পা সব দিয়ে যতটা পারা যায় আঘাত করার চেষ্টা করছিলাম লোকটাকে;সাথে এমন কিছু খুঁজছিলাম যা দিয়ে ওকে রক্তাক্ত করা যায়৷ আমার মাথায় শুধু একটা বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছিল যে করেই হোক এর হাত থেকে বাঁচতে হবে এবং সেটা একে শাস্তি দিয়েই। দুর্ভাগ্য বসত বেসিনের সামনের ট্রে টায় এমন কিছুই রাখা ছিল না যা দিয়ে একে আঘাত করা যায় শুধুমাত্র একটা ব্লেড ছাড়া। বাঁচার অস্ত্র পেয়ে গেছি বুঝতে পেরে আমি আর এক মুহুর্ত দেরি না করে লুফে নিলাম ব্লেডটা। তারপর এলোমেলোভাবে ওর কোথায় কোথায় আঘাত করেছি জানি না। বদমাশটা যখন চিৎকার করে আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো ঠিক তখনই আমিও যেন গলায় জোর পেলাম। কালক্ষেপণ না করে জোর চিৎকারে অন্তুকে ডাকতে ডাকতে ব্লেডটা দিয়ে আরো আঘাত করলাম ওর মুখে, গলায়। ওকে ক্ষতবিক্ষত করতে গিয়ে আমার নিজের হাত কেটে গেল। কিন্তু এসব দেখার সময় নেই।
ওয়াশরুম বাড়ির ভেতর দিকে থাকলেও আমার অনবরত চিৎকার মিউজিকের শব্দ ছাপিয়ে ঠিক অন্তুর কান অবধি গেল। শুধু অন্তু নয় ওখানে উপস্থিত সবার কানেই। এবং নিমেষে সবাই ছুটে উপস্থিত হলো ওয়াশরুমের সামনে।
আমি তখন ব্লেডের আঁচড় থামিয়ে দিয়েছি। ফ্লোর ভরা রক্ত দেখে আমার মাথা ঘোরাচ্ছিল। আমি কি খুন করে ফেলেছি? ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আমি ঝাপসা চোখে অন্তুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। ও ছুটে এসে জাপ্টে ধরতেই আমার সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। জানিনা তারপর কি হয়েছিল।

চেতনা ফিরলে নিজেকে একটা অপরিচিত কামরায় আবিষ্কার করলাম। ক্ষীণ আলোয় পাশে বসে থাকা অন্তুকে চিনতে অসুবিধা হলো না। কপালে হাত দিয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে ও। আমি বোধহয় কোনো ব্লান্ডার করে ফেলেছি। কে জানে লোকটা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। মরে গেলে ওকে খুনের দায়ে কি আমায় জেলে যেতে হবে? ভীতু কম্পিত হাতে আমি অন্তুকে আলতো স্পর্শ করলাম। চেতনা ফিরেছে বুঝতে পেরে ও বেড সাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— এখন কেমন লাগছে?
আমি সে প্রশ্নের জবাব দিলাম না। উল্টো ভয়ে তটস্থ হয়ে জানতে চাইলাম,
— লোকটা কি মরে গেছে অন্তু?
আমার প্রশ্ন শুনে ও ছোটো করে শ্বাস ফেলল। মাথা নেড়ে বলল,
— মরেনি। খারাপ ভাবে জখম হয়েছে। এখন হসপিটালে। কে জানে কি হবে?
— আমাকে কি পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে?
— তোমার পেছনে অলরেডি পুলিশ ঘুরছে নীরদ৷ ওরা কেইস করে দিয়েছে তোমার ওপর।
— কিহ্।
আঁতকে উঠে বসলাম আমি।
— ভয় পেও না। আমি আছি। সব ঠিক করে দেবো। তবে কয়েকটা দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে তোমায়।
— গা ঢাকা দিয়ে! আচ্ছা আমরা এখন কোথায় আছি?
— ঢাকাতেই। একটা ফার্ম হাউজে। এটা আমার চাচার। বহু আগে বানানো। কেউ জানে না এর সম্পর্কে।
— ওরা কি তোমার ওপরেও কেস করে দিয়েছে?
— হু। তবে আমি বেরোতে পারব এটা থেকে সমস্যা নেই।
— তুমি আমার ওপর রেগে?
আমি আর্দ্র গলায় জানতে চাইলাম। অন্তু সে প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কেবল বলল,
— ও কি তোমাকে মোলেস্টের ট্রাই করেছিল?
— হুঁ। নিজেকে বাঁচাতে আমি হাতের কাছে যা পেয়েছি তাই দিয়েই….
বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম আমি। অন্তু কাছে সরে এসে সযত্নে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল
— কেঁদো না। একদম ঠিক কাজ করেছো তুমি। ওই শাস্তি তো ওর কম হয়ে গেছে। ওর শাস্তির ব্যবস্থা আমি করবো দাঁড়াও।
— আমার সাথেই কেন এসব হয় বলতে পারো?
— থাক রিগ্রেট ফীল করো না। পরীক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষের জীবন।
— তবু সব কঠিন পরীক্ষাগুলো আমার জন্যই?
আমি কাতর দৃষ্টিতে চাইলাম ওর দিকে। ও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমায় বুকে জড়িয়ে নিলো।
— ভেঙে পড়বে না নীরদ। আমি আছি।
_______________
৪৮.
“আমি আছি” বলাটা বোধহয় খুব সহজ। কিন্তু সত্যি সত্যি পাশে থাকা খুব কঠিন৷ এবং এই কঠিন কাজটা সবার দ্বারা হয় না। অবিশ্বাস্যভাবে আমার একমাত্র প্রেমিক পুরুষের দ্বারাও হলো না। সে তো পুরোদমে বিজনেসম্যান বনে গেছে। বিজনেসের সামনে সবকিছু কুরবান৷ কোথায় তার প্রতিজ্ঞা আর কোথায় তার ভালোবাসা!
এসব কেন বলছি? কারণ আছে। আজ সাড়ে চার মাস হয় আমি গা ঢাকা দিয়ে বসে আছি একা, নিরিবিলি এই ফার্ম হাউজে। সেই যে রেখে গেল৷ তারপর আর তার দেখা কই? এই সাড়ে চার মাসে কোনো একদিন হয়তোবা এসেছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম নিয়মিত আসতে পারবে কি না! সে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল মামলা থেকে মাত্র বেরিয়েছে। কোনোভাবেই আর কারোর সন্দেহের তালিকায় আসা যাবে না। সে সকলের সামনে ঘোষণা করে দিয়েছে নীরদ নামের কারোর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
কথাটা খুব স্বাভাবিকভাবে বলতে পেরেছিল সে। কিন্তু আমি কেন যেন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। আমার সাথে সম্পর্ক নেই। এত অবলীলায় বলল কথাটা? সে না ঐ লোকটার শাস্তির ব্যবস্থা করবে! তবে এসব কেন?
সেদিন ধরতে না পারলেও এখন পারলাম। আজ সে ঐ লোকটার সাথে বিরাট বড় একটা ডিল সাইন করেছে। ওরা এখন বিজনেস পার্টনার৷ আজ বিকেলেই ফোনে বিজনেস রিলেটেড একটা নিউজ পোর্টাল থেকে জানতে পারলাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে তাকে ফোন করে সত্যতা জানতে চাইলে সে খুব বিরক্তির সাথে বলল,
— একটা সিলি ঘটনাকে মনে রেখে নিজের ক্ষতি করে লাভ আছে? যদি ডিল সাইন না করতাম তাহলে তো মামলাই তুলে নিতো না। আবেগি চিন্তাভাবনা বাদ দাও। বি প্রাক্টিক্যাল।
— তুমি বলেছিলে ওকে শাস্তি দেবে।
— কোন ব্যাপারে শাস্তি নীরদ। ও সে/ক্সুয়ালি অ্যাবি/উজের চেষ্টা করেছিল। এরচেয়ে বেশি কিছু তো আর করেনি। এছাড়াও যা অপরাধ করেছিল তার শাস্তি তুমি নিজ হাতের ওকে দিয়েছ। একটুর জন্য ম/রতে ম/রতে বেঁচেছে। এরপর আর কি শাস্তি হতে পারে?
আমি হতবাক হয়ে ছিলাম বেশকিছুক্ষণ। দুর্বল কণ্ঠে শেষবার জিজ্ঞেস করলাম,
— তোমার কাছে বিজনেসটাই সব অন্তু?
— অবশ্যই। বিজনেস ছাড়া আমার জীবনে আছেই বা কি? তোমার জন্য তো জীবনের সব স্বপ্ন পেছনে ফেলে এসেছি। এখন একটা কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করছি তাতেও তোমার সমস্যা? তুমি কেমন পার্টনার বলতে পারো? কখনোই আমায় ভালো কাজে সাপোর্ট করো না। আমি আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়েও তোমায় পাশে পাইনি।
এরপর ওপাশ থেকে ফোন কেটে দেয়া হয়েছে। ওর সাথে কথা বলার পর থেকে আমার পৃথিবী থমকে আছে। ওর কথাগুলো শতশতবার প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কানে বাজছে। কিসব বলল ও আমাকে? অ্যাবি/উজের চেষ্টা করেছে, কিন্তু খারাপ কিছু করেনি। ও কি চাইছিল আমি রে/পড হই? আমি রে/পড হলে তবেই ও শাস্তির কথা ভাবতো?
এই যে মাত্র কিছুক্ষণ আগে কথা বলল, এই মানুষটা আমার অন্তু? আসলেই সে আমার? ফোন নম্বর, কণ্ঠ, কথা বলার ধরন সব তো এক। তাহলে মানুষটাকে আজ এত অপরিচিত লাগছে কেন?
তার তো এরকম হওয়ার কথা ছিল না।
সারাটাদিন আমি সোফার ওপর বসে এসব কথা ভাবতে থাকলাম। ভাবনার কূল কিনারা না মিললে
চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিদ্ধান্ত নিলাম আর এখানে এক মুহুর্ত নয়। কারো জীবনে গলগ্রহের মতো বাড়তি ঝামেলা হয়ে থাকা অনুচিত, একেবারেই অনুচিত। কারো থেকে আমার আর কোনো প্রত্যাশা নেই। নিজের জীবন থেকে তো নেই-ই। সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়। সবকিছুর থেকে ইতি টানার উপযুক্ত সময় এসেছে । সবার আগে ইতি টানতে হবে সম্পর্কটা থেকে। তার তরফ থেকে অবশ্য টানা হয়ে গেছে। আমিও আজ এই মুহুর্তে আমার তরফ থেকে ইতিটা টেনে দিলাম।তার দেয়া সমস্তকিছু ওভাবে রেখেই শূন্য হাতে বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে।
রাস্তায় নেমে বুঝলাম গভীর রাত৷ চারিদিকে গূঢ় অন্ধকার; ঠিক আমার জীবনের মতো। রাস্তায় আমি ছাড়া কোনো জনমানসের দেখা নেই। কেবল দু একটা দূরপাল্লার গাড়ি শাঁ শাঁ করে যাচ্ছে। পথের ধারে দাঁড়িয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো এইযে পথ দিয়ে দূরপাল্লার গাড়িগুলো চলছে আমি যদি অবচেতনে কোনো গাড়ির নীচে পড়ে যাই তাহলে তো বোধহয় সেকেন্ডের মাথায় আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। কেউ জানবে আমার হারিয়ে যাওয়ার খবর? আচ্ছা আমি যখন হারিয়ে যাবো চিরতরে, তখন আমায় মনে করার মতো কেউ থাকবে কি পৃথিবীতে? উঁহু থাকবে না বোধহয়। এই সাড়ে সাত কোটি মানুষের পৃথিবীতে আমার জন্য অপেক্ষা করবার কেউ নেই। কেউ না…..
ভাবতে ভাবতে আসলেই যে বিশ্বরোডের দিকে পা বাড়িয়েছি তা ঘুনাক্ষরেও কিন্তু বুঝতে পারিনি আমি। যখন চেতনা ফিরল তখন একটা দ্রুতগামী বাস ধেয়ে আসছে আমার দিকে দৈত্যের মতো। তবে কি আমায় এই দৈত্যটাই আজ গ্রাস করে নেবে? চিরতরে বিলীন করে দেবে আমার অস্তিত্ব মোহমায়ায় জড়ানো এই পৃথিবী থেকে?

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here