ভালোবাসার রংধনু,২৯,৩০

0
892

ভালোবাসার রংধনু,২৯,৩০

২৯
__________________
৫৩.

— তুই দেখতি না আম্মা তোকে কতখানি আদর করতেন? উনি কিন্তু মনে মনে মেনে নিয়েছিলেন তোকে ছেলের বউ হিসেবে। আমাকে প্রায়ই পাশে বসিয়ে বোঝাতেন ইনতিসার পরিবর্তন হবে। নীরদের যোগ্য হয়ে ফিরে আসবে। আমি যেন ওকে মেনে নিই। আমি কখনো..
কথা বলার এ পর্যায়ে দরজায় তীব্র নকের শব্দে থেমে গেল আপা। ধরে রাখা আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল,
— ইঊশা এসেছে বোধহয় স্কুল থেকে। যা তো বাবু দরজাটা একটু খুলে দে।
— যাচ্ছি। কিন্তু এত জলদি স্কুল শেষ? মাত্র তো সাড়ে এগারোটা।
— ও তো মর্নিং শিফট। সাতটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত স্কুল।
— ওহ আচ্ছা।
বলে আমি দরজার দিকে পা বাড়ালাম।

দরজা খুলতেই দেখা গেল ইনতিসারের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইউশা। ছেলেটাকে কতদিন পর দেখছি আমি! ইশশ কি সুন্দর চাচার সাথে হাত নাড়িয়ে হেসে হেসে গল্প করছে। হয়েছেও একদম ইনতিসারের ফটোকপি। আগে বোঝা যেত না তেমন একটা। তবে এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে খুব ফুটে উঠছে বিষয়টা। একরকম চোখ, ভ্রুর গঠন আবার নাক। নাকের ওপর ইনতিসারের মতো তিলও হয়েছে। আরেকটু বড় হলে এ পুরোপুরি ইনতিসারের আদল পাবে মনে হচ্ছে। আসলে রক্ত কথা বলে।
দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখছিলাম আমি ইঊশাকে। অপেক্ষা করছিলাম কখন ওর চোখ পড়বে আমার দিকে। সেই চার বছর আগের মতো তাম্মি বলে ডেকে উঠবে; ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবে। কত যে মিস করেছি এই ডাকটা! ভেতরে ভেতরে যেন অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। কিন্তু যা আশা করেছিলাম তার কিছুই হলো না। আমাকে দেখামাত্র ইঊশার মুখের হাসি দপ করে নিভে গেল। নিমেষে গাম্ভীর্য্যতা ধারণ করে ফেলল ও চেহারায়। আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলবো তার পূর্বেই ইনতিসারের হাত থেকে ওর স্কুল ব্যাগটা টেনে নিয়ে ধপাধপ্ পা ফেলে ভেতরে চলে গেল।
আমি বোকার মতো ওর গমন পথে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ওর এমন আচরণের কারণ।
পাশ থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে ইনতিসার বলে উঠল,
— ওকে একটু সময় দিতে হবে। বহুদিনের জমে থাকা অভিমান।
আমি ইনতিসারের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আমার সাথে সবাই অভিমান করতে পারে কেবল আমিই কারো সাথে পারি না।
আপার কথাগুলো আর শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাছাড়া এখন ইঊশা এসেছে। ওর সামনে নিশ্চয়ই বলবেও না। তারচেয়ে বরং আমি একটুখানি বারান্দায় যাই ।
ঘরে গিয়ে দেখলাম আপা ইঊশার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত৷ ওকে আর ঘাটালাম না। নিঃশব্দে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘিয়ে রঙের গ্রীলগুলোয় বাহারী নকশা করা। আমাদের বাড়িতে এমন ছিল। বাবা যখন কাজে বেরিয়ে যেত আমি বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে একমনে তার যাওয়া দেখতাম। আবার যখন ফেরার সময় হতো তখনও ছুটে গিয়ে অপেক্ষা করতাম। বাবার সাথে কাটানো ছোটো ছোটো স্মৃতিগুলো ইদানীং খুব করে মনে পড়ে।
— হাই। গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে কি এত চিন্তা করো? তোমার কি অনেক দুঃখ?
আচমকা কোত্থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো । আমি ভ্রু কুঁচকে ইতিউতি তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করলাম কে কথা বলে।
— এই যে আমি এদিকে। তোমার ডান দিকে। এপাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।
ওপাশের মানুষটা আবার কথা বলে উঠল;সাথে তার রিনরিনে গলায় ঝংকার তোলা খিলখিল হাসি। ডানদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম মিষ্টি চেহারার এক অষ্টাদশী তরুণী। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি ওই আন্টির গেস্ট? ঐ যে যিনি হুইল চেয়ারে বসে থাকেন সবসময়।
আমার বুঝতে সমস্যা হয় না মেয়েটা আপার কথা বলছে। আমি ঈষৎ হেসে মাথা নেড়ে বলি,
— হু আমি ওনার বোন। আর তুমি?
— আমি? আমি তো এই বাড়ির মেয়ে। এটা আমার আব্বুর বাড়ি।
— ওহ্ তুমি বাড়িওয়ালার মেয়ে।
— হ্যাঁ তো। আচ্ছা তোমার নাম কি?
আমি সংক্ষেপে জবাব দিই,
— নীরদ।
— নীরদ। তারমানে মেঘ। খুব সুন্দর নাম। আমার নাম শুনবে?
— বলো।
— আমি প্রিমা। পুরো নাম প্রিমা পারিজাত । সুন্দর না নামটা?
— খুব মিষ্টি। একদম তোমার মতো।
হালকা হেসে বলি আমি। ওপাশে প্রিমা নামক মেয়েটাও লাজুক হাসে। বলে,
— থ্যাংক ইউ। কিন্তু তুমি আমার চাইতে বেশি মিষ্টি ৷ বিশ্বাস করো আমি তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আগে কখনো দেখিনি। আন্টি সবসময় তোমার গল্প করে। বলে তার একটা বোন আছে খুব সুন্দর দেখতে, পরীর মতো। আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম তোমায় দেখার জন্য।
— এখন তোমার এক্সাইটমেন্ট ফুলফীল হয়েছে?
— তা আর বলতে! আন্টির প্রশংসা কখনো কখনো আমার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হতো। কিন্তু এখন দেখছি না। আন্টি ঠিক বলে। তুমি ভীষণ প্রিটি; নাহ্ প্রিটিয়েস্ট। একদম জলজ্যান্ত আফ্রোদিতি।
উচ্ছ্বাস মাখানো কণ্ঠে বলে প্রিমা। আমি অবাক হই। এর আগে এমন অকপটে কথা বলা মেয়ে আমি বোধহয় একটাও দেখিনি। মেয়েটা তো ভারী অদ্ভুত!
সে আবারও প্রশ্ন করে,
— আচ্ছা নীরদ তুমি কিসে পড়ো?
— আমি পড়ি না প্রিমা।
— ওহ্ পড়াশোনা শেষ তোমার? হায় আল্লাহ তুমি তো আমার অনেক সিনিয়র। এই একদম স্যরি, আমি না বুঝে তোমায় তুমি বলে ফেলেছি আবার নাম ধরেও ডেকে ফেলেছি।
— কোনো সমস্যা নেই। নিঃসংকোচে ডাকতে পারো। বাই দ্য ওয়ে তুমি কিসে পড়ো?
— আমি মাত্র ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম।
— আজ কলেজে যাওনি?
— না। আজ আমার টিউশন টিচার আসবেন তো তাই যাওয়া হয়নি। আচ্ছা শোনো না তোমার ফোন নম্বরটা আমাকে দেবে? তোমার সাথে ফোনে কথা বলব। তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে।

প্রিমার কথা শুনে আমি ভাবনায় পড়ে যাই। ফোন তো আমার কাছে নেই। গতকাল রাতেই ফেলে দিয়েছি।
— কি হলো দাও?
সে তাড়া দেয়। আমি মিথ্যেমিথ্যি বলি,
— আমার ফোনটা তো নষ্ট হয়ে গেছে। আপাতত ফোন ছাড়া আছি। তুমি বরং প্রতিদিন বিকেল বেলা বারান্দায় এসো। কথা হবে। কেমন?
— আচ্ছা ঠিকাছে সমস্যা নেই। এখন তবে আমি যাই? আমার স্যার আসার সময় হয়েছে।
এতটুকু বলে হাত নেড়ে সে চলে যায়৷ বিদায় বলারও সময় দেয় না। আমি আপন মনে হেসে উঠি। মেয়েটা তো ভীষণ চটপটে!
প্রিমা চলে যাওয়ার পর আমি আরও কিছুক্ষণ বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করি। চুপচাপ আকাশ দেখি; কখনো গ্রীলের ফাঁক গলিয়ে আসা রোদের ফোঁটাগুলোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করি৷ আমার মাথায় গান ঘোরাফেরা করে,
“শূন্যতায় ঢেকে গেছে
শহরের বাকি ইতিহাস,
ফিরবো না তুমি আর আমি,
ফিরবো না হয়ত আবার।
তবু চাইছি তোমাকেই
তুলে নিতে অঞ্জলিতে
রোদের ফোঁটা”

কি অদ্ভুত!
____________________
৫৪.
দুপুরের খাওয়ার সময় টেবিলে আবারও আমি আর আপা ছাড়া কেউ নেই। ইঊশাও না। আপাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— শুধু আমরা দু’জন খাব? আর কেউ খাবে না?
— বাড়িতে তো এখন তুই আর আমিই আছি। ইনতিসার তখুনি বেরিয়ে গেছে কাজে। ওর ফিরতে রাত হবে। আর তোর ভাগ্নে বাড়িওয়ালার ছেলে মুরসালিনের সাথে খেলতে গেছে। এখন খাবে না।
— ইশি আপুকে দেখেছিলাম কাল।
— ও তো আজকে সকালেই চলে গেছে ওর শ্বশুরবাড়ি। ইশিও গতকালকেই এসেছিল আমাদের দেখতে। কালই চলে যেত কিন্তু সন্ধ্যার দিকে উকিল এলো বাড়িতে। আমি একা কীভাবে কথা বলি? ইনতিসারও ছিল না। তাই ওকে থেকে যেতে বললাম।
— ওহ্।
এরপর আর কিছু বললাম না আমি। ক্ষনিক চুপ থেকে আপাই বলে উঠল,
— জানিস আমাদের এ অবস্থা কারা করেছে?
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইলাম ওর দিকে। আপা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলল,
— এহতেশাম আর ওর বাবা। এহতেশাম পুরোটাই ওর বাবার মতো। বুঝলি নীরদ সম্পত্তির লোভ খুব বড় লোভ। এই লোভে মানুষ আপনজনকে আঘাত করতেও দু’বার ভাবে না।
ইনতিসারকে বাইরে পাঠানোর পর ঐ লোকটা যেন পিশাচে পরিণত হলো। তোকে আর আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করতে লাগল। তার প্রথম কাজ ছিল এহতেশামকে নিজের দিকে করা। সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে খুব সহজেই সে কাজ হয়ে গেল। এরপর এহতেশামই হয়ে উঠল ওর ডানহাত। আমি এতদিন একজনের সাথে লড়ছিলাম কিন্তু ওদিকের পাল্লা ভারী হওয়ায় আমার অসুবিধে হয়ে গেল। কোনদিকটা সামলাব বুঝে উঠতে পারছিলাম না । ওদিকে ওরা ওদের সমস্ত পরিকল্পনা একে একে বাস্তবায়ন করতে লাগল। ধোঁকার আশ্রয়ে তোর নামে যত টাকা ছিল সব দখলে নিয়ে নিলো। পদে পদে তোর জন্য মৃ/ত্যু ফাঁদ তৈরি করতে শুরু করলো। শুধু তাই? ওরা দু’জন এত নিকৃষ্ট হয়ে গেছিল যে নিজেদের রক্ত, নিজেদের বাড়ির ছেলে ইঊশাকেও টার্গেট করেছিল। ওর মাধ্যমে আমাকে কষ্ট দেবে। ওরা জানতো তুই আর ইঊশাই আমার একমাত্র দুর্বলতা। আমি না, পারছিলাম না নীরদ। এতটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই একসময় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম তোকে দূরে পাঠানোর জন্য। কিন্তু যখন উপলব্ধি করলাম তোকে তো আমি একা পথ চলতে শেখাইনি, তখন আমার নিজেকে অসহায় লাগতে শুরু করলো। অবলম্বন খুঁজতে লাগলাম আমি। আমার মনে হলো তোকে ভালো কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দূরে পাঠালেই একমাত্র এদের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। তাই প্রীতম বলে ছেলেটার সম্বন্ধ যখন এলো তোর জন্য, তখন কিছু না ভেবেই সুযোগটা লুফে নিলাম।
— তুমি তাহলে আমাকে মিথ্যেমিথ্যি আশ্বাস দিয়েছিলে যে বিয়ে করাবে না।
আমি হালকা হেসে জানতে চাইলাম। জবাবে
আপাও হাসলো।
— অনেকটা সেরকমই। ঐ সময় আমার মাথা কাজ করছিল না। ইনতিসার ফিরে এসেছিল তোর জীবনে। ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছিলাম আমি। এহতেশাম প্রতিনিয়ত আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতো। আমি নিজেকে হাসিমুখে উৎসর্গ করতে পারতাম কিন্তু তোর আর ইঊশার কিছু হোক মানতে পারতাম না।
— কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তোমার পরিকল্পনা সফল হলো না আপা।
— হ্যাঁ। তুই নিজ হাতে আমার পরিকল্পনাটা নষ্ট করে দিলি। প্রীতমকে ওর প্রেমিকার সাথে মিলিয়ে দিলি।
— তুমি সবটা জানতে?
— তখন জানতাম না। পরে জেনেছি। তো
আমার সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর নতুন কিছুই আর ভাবতে পারছিলাম না। সে সময়ে ইনতিসার এলো। কোত্থেকে ও সবটা জেনে গেছে। আমায় এসে জিজ্ঞেস করলো এসব সত্যি কি না। আমিও আর আটকাতে পারলাম না নিজেকে। অসহায়ের মতো সবটা বলে দিলাম। এরপর ও কোনো স্টেপ নেবে, তার আগেই তো এলো সেই ভয়াল রাতটা।
আমি খুব শান্ত স্বরে জানতে চাইলাম,
— আপা সেদিন রাতের ঘটনাটা ইচ্ছাকৃত ছিল তাই না? দুলাভাই আর তোর শ্বশুরের সাজানো ছিল?
আপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর চেহারায় আস্তে আস্তে রাগ-ক্ষোভ ফুটে উঠছে। গম্ভীর গলায় বলল,
— হ্যাঁ। কিন্তু নির্বোধ আমি এসব আগে বুঝতে পারিনি।
— তুমি কি আমায় সেদিন ভুল বুঝেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলে?
আপা আৎকে উঠল।
— কখনোই না। তোকে ভুল বোঝার কোনো প্রশ্নই আসে না নীরদ। সে রাতে তোকে অমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল আমি যদি তোকে এই মুহুর্তে বাড়ি থেকে বের না করতে পারি তাহলে তোর আরও সর্বনাশ হয়ে যাবে৷ কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না, কেউ না৷
— আর ইনতিসার পরে আমায় খুঁজে পেলো কি করে? তুমি পাঠিয়েছিলে ওকে?
— তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পরপরই ইনতিসার ফিরেছিল কোত্থেকে যেন। বাড়ির ওরকম অবস্থা দেখে ওকে কিছু বলতে হয়নি। সবটাই বুঝে গেছিল।
আমি ছোট্ট করে শ্বাস ফেললাম। সে রাতে আমার মনের ওপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গেছিল কখনো জানতে পারবে আপা? তার কাছে আর কোনো উপায়ই ছিল না আমাকে বাঁচানোর!
খাবার আর গলা দিতে নামতে চাইলো না আমার। মানসপটে দুঃসহ সেই রাতের প্রতিচ্ছবি ভাসতে লাগল। দুলাভাইয়ের নোংরা স্পর্শ, আপার বের করে দেয়া। অসহায় নীরদের পথে পথে ঘুরে বেড়ানো। উফফ কি ভয়ানক!
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

ভালোবাসার রংধনু
৩০
____________________
৫৫.
সপ্তাহখানেক এমনি করেই কেটে গেল। এর মধ্যে জানতে পেরেছি মাউইমা আর এই পৃথিবীতে নেই। সেই চার বছর আগে আমি বাড়ি ছাড়ার মাসখানেক পর উনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। ওনার মৃ/ত্যুর পর থেকেই সাজানো গোছানো সংসার একে একে ভাঙতে শুরু করে। ইনতিসারের বড় ভাই আলাদা হয়ে যান। এখন উনি সস্ত্রীক বিদেশে সেটেল্ড। ওদিকে ইনতিসারের বাবার হঠাৎ করে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যায় একটা। চারবছর থেকে উনি কোমায়। হসপিটালে থাকা অবস্থায় জানা যায় ভদ্রলোক লোনের সাগরে ডুবে ছিলেন। যা পরিশোধ করতে বাড়ি- গাড়ি, বিজনেস সব খোয়াতে হয়। সম্পত্তি খোয়ানোর পর হসপিটালের বিল পরিশোধ করা যখন ইনতিসারের একার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না, তখন তার সকল দায়িত্ব ইশি আপু কাঁধে তুলে নেয়। বাবার দায়িত্ব নিতে গিয়ে ইশি আপুকেও শ্বশুর শাশুড়ির থেকে সংসার আলাদা করতে হয়। ওরা এখন কল্যানপুরে আলাদা বাসা নিয়ে থাকছে।
ইশি আপু অবশ্য চেয়েছিল ইনতিসাররাও যেন ওদের সাথে গিয়েই থাকে। কিন্তু ইনতিসার রাজি হয়নি। কেন রাজি হয়নি সেটা আপাও জানে না।

আমি আপাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে প্যারালাইজড হলো কীভাবে। জবাব দেয়নি। হয়তোবা এখন সঠিক সময় মনে করছে না। যখন করবে তখন আপনা থেকেই বলে দেবে।

ইঊশা এখন পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলে না। আমায় দেখলেই উশখুশ করে;নয়তো গম্ভীর হয়ে যায়। আমাকে ও কেন পছন্দ করছে না বুঝতে পারছি না। কারণ খোঁজার চেষ্টা করছি। তবে এখন ওর সামনে তেমন যাই না। ওকেও কিছুটা সময় দেয়া উচিৎ।
আমাকে দেখে যেন অস্বস্তিবোধ না করে সেজন্য রুমও আলাদা করে নিয়েছি। তিন রুমের ফ্ল্যাট তো। আপা এক রুমে, ইনতিসার এক রুমে এভাবে থাকতো। একটা রুম ফাঁকাই পড়ে ছিল। আমি ঐ রুমটায় উঠেছি৷ তেমন কিছুই ছিল না রুমটায়, শুধু একটা বেড ছাড়া। আমার ওতেই চলে যেত যদিওবা৷ কিন্তু ইনতিসারের ওতে হচ্ছিল না। আমি শিফট করার দিন দুয়েক পর একদিন দুপুরবেলা এক পিকআপ বোঝাই করে ফার্নিচার নিয়ে হাজির। ঘর সাজাতে যা লাগে তার সবই ওখানে ছিল। লোক ধরে হৈ চৈ করে সেসব যখন আমার ঘরে তুলল আমি অবাক হয়ে গেলাম।জানতে চাইলাম, এসব আমার ঘরে কেন?
উত্তরে সে খুব শান্ত স্বরে বলল,
— আমি তো আর ফকির না। গেস্টকে ফার্নিচার বিহীন একটা ঘরে রেখে দিব৷
আমি আরও কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার গাম্ভীর্যতা আমায় বলতে দেয়নি। মনে মনে আক্ষেপ করেছি। এমনিতেই টানাটানির সংসার। এখন আবার আমার জন্য অযথাই এতগুলো টাকা খরচ করে ফেলল। আমি আর কতদিনই বা আছি এখানে?
আমার এমন ভাবনা থাকলেও ইনতিসার নামক ভদ্রলোকের কি ভাবনা ছিল আমি জানি না। তার অযথা টাকা খরচ ফার্নিচারে শেষ হলো না। এরপর সে কারণে অকারণে আরও টাকা ওড়াতে করতে শুরু করলো। যেমন ,একদিনের ঘটনা বলি।
সেদিন শুক্রবার । সবাই বাসায়। খুব স্বাভাবিকভাবে ছুটির দিন হওয়ায় ইঊশাও বাসায়৷ ওর দিকটা চিন্তা করে আমি একদমই সেদিন ঘর থেকে বেরুচ্ছিলাম না।
কিন্তু বিকেলের দিকে কোত্থেকে প্রিমা নামক মেয়েটা হঠাৎ আমাদের বাসায় এলো। এসেই হম্বিতম্বি, আমায় নিয়ে ছাদে যাবে। কতদিন থেকে গল্প করা হয় না আমার সাথে। আজ পেয়েছে কিছুতেই ছাড়বে না। ওকে পেয়ে আপাও বাহানা পেয়ে গেল। আমি ঘরকুনো হয়ে থাকি কেন, কেন ঘুরেফিরে বেড়াই না কত অভিযোগ তার! দুজন দুদিক থেকে চেপে ধরায় শেষে আমারও করার কিছু রইলো না। গেলাম প্রিমাকে খানিক সময় দিতে৷ মনে মনে বিরক্তই ছিলাম অবশ্য। আমার আসলে লোকারণ্য, আলো এসব কিছুই পছন্দ ছিল না। জীবনযুদ্ধে হারতে হারতে নিজেকে সবকিছুর থেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম এক এক করে। কিন্তু আমি যতই চাইছিলাম নিজেকে সবকিছুর থেকে সরিয়ে নিতে, সবকিছু ততই গভীরভাবে জড়িয়ে যাচ্ছিল আমার সাথে। আমি চেয়েও তাদের আলাদা করতে পারছিলাম না।

সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ভাবছিলাম না করতে যখন পারলামই না তাহলে মিনিট পাঁচেক হাঁটাহাঁটি করে যেকোনো বাহানায় নীচে নেমে যাবক্ষণ। সেও খুশি, আমিও খুশি।
আপনমনে এমন পরিকল্পনা করে তো গেলাম ওপরে। কিন্তু ছাদের দরজায় পা দিয়ে একবার ছাদে চোখ বোলাতেই সে পরিকল্পনা যে কোথায় সুর সুর করে পালিয়ে গেল নিজেও বুঝতে পারলাম না।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে একবার ছাদের দিকে আরেকবার প্রিমার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আল্লাহ্ এত সুন্দর ছাদ তোমাদের?”
আমায় অবাক হতে দেখে প্রিমা মিটিমিটি হাসতে লাগল। দু পা এগিয়ে গিয়ে দুহাত প্রসারিত করে সহাস্যে বলে উঠল,
— স্নিগ্ধ আফ্রোদিতিকে এক টুকরো স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাঝে স্বাগতম।
ওর কথা শুনতে শুনতে আমি অপার মুগ্ধতায় গুটি গুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলাম। চারিদিকে তাকাতে তাকাতে মনে হলো এত সুন্দর ছাদ আমি আগে কখনো দেখিনি। কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা পুরো ছাদ জুড়ে বাহারি সব ফুলগাছ। কতগুলো এক সাইডে মাটির টবে লাগানো। কতগুলো আবার লতানো গাছ, শৈল্পিকভাবে রেলিং পেঁচিয়ে উঠে গেছে। ছাদের পশ্চিম দিকে একখানা দোলনা বসানো। আমি শুধু কল্পনা করছিলাম গোধূলী লগ্নে, সূর্য যখন ঢলে পড়ে আকাশের বুকে, অস্তমিত সে সূর্যকে দেখতে কতই না সুন্দর লাগে এখান থেকে!
আমার দুচোখের ঘোর কাটছিলই না। একা একাই ফুটে থাকা ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলাম আমি। একসময় ইংরেজি পরীক্ষাগুলোতে মাই হবি ইজ গার্ডেনিং মুখস্থের মতো লিখে এসেছি। কখনো কল্পনায়ও আসেনি নিজের গার্ডেন এর কথা। গাছপালা সম্পর্কে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। শখ পূরণ করার ইচ্ছেও জন্মাতো মনে, কিন্তু দমিয়ে রাখতাম নিজেকে। কারণ সুযোগও ছিল না, সামর্থ্যও ছিল না। বছর দুয়েক আগে একবার সামর্থ্য হলো। রুমমেটকে সাথে নিয়ে গাছ কিনেও আনলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালা গেটে দেখেই আটকে দিলেন। কড়াশব্দে বললেন গাছপালা ওনার বাড়িতে অ্যালাউড না। টাইলসে টবের দাগ বসে যাবে, কাদা লেগে যাবে আরও কত কি সমস্যা! বুকে পাথর চাপা রেখে শখের গাছগুলো সেদিন ফেলে দিয়ে আসতে হয়েছিল। আহা ভাবলেও বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে।
— মিস.আফ্রোদিতি কোন খেয়ালে হারালে। এদিকে তাকাও।
পাশ থেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ডেকে উঠল প্রিমা। আমি মুখ ফিরিয়ে দেখলাম ওর হাতে একটা পাখির খাঁচা ধরে রাখা। চোখ বড় বড় করে বললাম,
— এই তোমাদের পাখিও আছে?
— হ্যাঁ আছে তো। দুটো পাখি। আমার দুই কন্যা পান্তুয়া আর চমচম। মামণিরা সে হ্যালো টু খাম্মি।
পাখি দুটোকে উদ্দেশ্য করে বলল প্রিমা।
আমি হেসে ফেললাম ওর পাগলামী দেখে৷ খাঁচাটা হাতে নিয়ে দেখলাম আকাশী আর টিয়া রঙের দুটো শেল প্যারাকিট।পাখির খাঁচায় আবার ঝুনঝুন করে বাজা একটা ঘণ্টা বেঁধে দেয়া। বাতাসের দোল খেয়ে যখনই ঘণ্টা বেজে ওঠে পাখি দুটো খাঁচায় মিহি সুরে ডাকতে ডাকতে ওড়াউড়ি করে। দেখতে এত দারুণ লাগে উফফ!
প্রিমার সাথে এক টুকরো প্রকৃতিতে হারিয়ে আমি যেন কিছুসময়ের জন্য দিন দুনিয়া ভুলে রইলাম। আমাদের দুজনেরই চৈতন্য ফিরলো মাগরিবের আজান শুনে। এরপর না চাইতেও ফিরে যেতে হলো ঘরে।
ঘরে ফিরতেই আপা হাসিমুখে জানতে চাইলো কেমন উপভোগ করলাম আমি ছাদের সৌন্দর্য? স্নিগ্ধতায় মাখামাখি আমার মনটাও নরম হয়ে ছিল। ওর প্রশ্নে নিজেকে আটকাতেই পারলাম না আর। কতখানি মুগ্ধ হয়েছি, তারপর আমার একসময়ের এমন স্বপ্নসহ আরও কতশত গোপন কথা আবেগতাড়িত হয়েই প্রকাশ করে ফেললাম ওর সামনে।
ও আমার কথা শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হাত চেপে ধরে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে বলল,
— তুই কতদিন পর এভাবে কথা বলছিস জানিস? আমার বোন যে এত কথা বলতে জানে আমি কখনো ভাবিওনি। এই যে তুই সবসময় নিজেকে ঘরে বন্দী করে রাখিস এটা কি ঠিক? আজ একটুখানি বেড়িয়ে এলি কত ভালো লাগল। হাসি যেন তোর মুখ থেকে সরছেই না। তোর মুখে হাসি যে কত সুন্দর লাগে তুই ভাবতেও পারবি না নীরদ।নিজেকে আর গুটিয়ে রাখিস না। মন খুলে হাস। নতুন করে বাঁচতে শেখ।
_________________
৫৬.
এরপরের কয়েকটা দিন মানসপট থেকে অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত ছাদটাকে আর সরাতে পারলাম না। অমোঘ টানে প্রতি বিকেলে ছুটে যেতে লাগলাম গাছগুলোর কাছে, পাখি দুটোর কাছে। অল্প সময়ে ওরা খুব আপন হয়ে গেল আমার কাছে। স্ব উদ্যোগে বোধহয় ওগুলোর পরিচর্যাও করতে শুরু করেছিলাম। এটাই ছিল আমার ভুল। প্রিমা ডানপিটে, মিশুক মেয়ে হলেও ওর মা সেরকম ছিলেন না। ভদ্রমহিলা বেশ গম্ভীর এবং আত্মকেন্দ্রীক। খুব স্বাভাবিকভাবেই ওনার সাজানো গোছানো বাগানে আমার হস্তক্ষেপ উনি মোটেই পছন্দ করলেন না। পছন্দ না করারই কথা। নিজের জিনিসে অন্যের হস্তক্ষেপ বিষয়টা আসলেও খারাপ। উনি হয়তো ভেবেছিলেন আমার দ্বারা যদি ওনার জিনিসপত্রের কোনো ক্ষতি হয়! এজন্য একদিন কড়া ভাষায় সতর্ক করে দিলেন ছাদে যেন ঘনঘন না আসি আমি। আর গাছগুলোতেও যেন হাত না দেই।
ওনার আচরণটা খুব স্বাভাবিক ছিল আমি জানতাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেনে নিতে পারলাম না।ওনার প্রস্থানের পরপরই অপমানে চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো। নিজেকে ভর্ৎসনা করলাম নিজের পাগলাটে খেয়ালের জন্য। সুযোগ পাওয়া মাত্রই যে আমার পাখা গজিয়ে যায় আর একটা না একটা ভুল করে ফেলি তার জন্য নিজেকে সতর্ক করে দিলাম। আর এমন করা যাবে না। কক্ষনও না। আবেগে ভেসে আর কিচ্ছু নয়৷
ছাদে দাঁড়িয়ে নিজেকে সতর্ক করার পরেও বাড়ি ফিরে আমার মন মানতে চাইলো না। সেই আবেগতাড়িত হয়েই কিশোরীদের মতো বালিশে মুখ গুঁজে গুনগুন করে কাঁদতে কাঁদতে রাত পার করে দিলাম।
পরদিন সকালবেলা দরজায় তীব্র ঠকঠক শব্দে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে আমি হতবাক। জন-পাঁচেক মানুষ দুহাত বোঝাই করা ফুলের টব নিয়ে সোজা আমার ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। পেছনে আপা আমায় ডাকতে ডাকতে বলছে,
— দেখ তো নীরদ ইনতিসারটার কি কাজ! আজ ইঊশাকে স্কুলে দিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ রিকশা ভরে এসব ফুলের টব নিয়ে এসেছে। জিজ্ঞেস করলে বলছে ইঊশা বাগান করতে চেয়েছে তাই ওকে ফুলগাছ কিনে দিয়েছে।
— তাহলে এরা তো ভুল জায়গায় রেখে যাচ্ছে আপা। তোমার ঘরে গিয়ে রাখতে বলো গাছগুলো। মাফিন দেখলে ভীষণ রাগ করবে।
— কোনো ভুল জায়গা, ভুল ঘর নয়। ঠিক জায়গাতেই রাখছে ওরা। আমি ওদের এই ঘরের ব্যালকনিতে নিয়ে রাখতে বলেছি ।
পেছন থেকে শান্ত স্বরে বলল ইনতিসার। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম তার হাতেও চারটা ফুলের টব।
এগিয়ে আসতে আসতে সে আরও বলল,
— ভাবির এই অবস্থায় সে যত্ন নিতে পারবে গাছের? তুমি তো অলস বসে থাকো সারাদিন ঘরে। তুমি করবে গাছের পরিচর্যা। তাছাড়া এই ঘরের ব্যালকনি বড়, আলো-বাতাস ভালো আসে। সব দিক দিয়ে তোমার ব্যালকনিই পারফেক্ট বাগানের জন্য বুঝতে পেরেছ?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— মাফিন তো দেখলেই রেগে যাবে। ও তো আমায় পছন্দই করছে না এখন।
— তোমার কাজ না ওর সমস্যাটা শোনা? সবসময় সবকিছুর থেকে পালাতে চাও কেন? কে তোমাকে আসলেই পছন্দ করে, কে করে না ঠিকঠাকভাবে জানার চেষ্টা করেছো কখনো?
কথা বলতে বলতে ইনতিসার অন্য লাইনে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আমি চুপ মেরে গেলাম। আপাও আর কিছু না বলে হুইলচেয়ার টেনে বেরিয়ে গেল বাইরে। আপা চলে গেলে ইনতিসার তার হাতে ধরে রাখা টবগুলো আমার হাতে দিয়ে আমায় টেনে বারান্দায় নিয়ে গেল। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— খবরদার যদি আর ছাদে যেতে দেখেছি। এই যে গাছ এনে দিলাম যত খুশি বাগান করো। পারলে গাছকে কোলে নিয়ে সকাল বিকেল চুমু খাও তবুও মানুষের ছাদে আর পা দেবে না। কি আমার দু টাকার গাছ রে তার জন্য মানুষের কাছে অপমানিত হয়ে এসে রাতভর চোখ দিয়ে গঙ্গা যমুনা বইতে দিতে হবে। গাধার গাধা। রামগাধা।
ভীষণ রাগে সদ্য আনা একটা টব লাত্থি দিয়ে উল্টে ফেলে হনহন করে হেঁটে বাইরে চলে গেল ও। যেতে যেতে আবারও কর্কশ স্বরে বলে গেল,
— সন্ধ্যায় আরও গাছ আসবে। ওগুলো যেন রিসিভ করা হয়৷
আমি টব হাতে বোকার মতো মাথা নাড়লাম। গাছের জন্য ছাদে গিয়ে যে আমি অপমানিত হয়েছি এ খবর সে কীভাবে জানল? অদ্ভুত!
_____
সেদিন সারাটাদিন কাটলো আমার ফুলের গাছগুলো গুছিয়ে। বারান্দা বাগানের উপযোগী সব ফুল সে তুলে নিয়ে এসেছে। জুঁই, অর্কিড, গোলাপ, পর্তুলিকা, কামিনী, টগর, দোলনচাঁপা কি নেই?
তার কথা মতো আবার সন্ধ্যার দিকে এলো পাতাবাহার, মানিপ্ল্যান্ট, ফিলাডেনড্রন, প্যাথোস, পিস লিলি, স্নেক প্ল্যান্ট, মনস্টেরা, ক্যাকটাস এমনকি ছোট্ট একটা বনসাইও। পছন্দের সব গাছ দেখে আমি চট করে গতকালের বাড়িওয়ালির অপমানের কথা ভুলে গেলাম। গাছের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে উপলব্ধি করলাম আমার এই গাছগুলোতে কেউ হাত দিলে আমিও বোধহয় রাগারাগি করতাম তাদের সাথে। যেহেতু আমি এই ইমোশনটা বুঝি তাই গতকালকের ঘটনা মনে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে চোখ বন্ধ করে বাড়িওয়ালি ভদ্রমহিলাকে ক্ষমা করে দিলাম।
তারপর একটা দীর্ঘ সময় কাটলাম বারান্দায় বসে৷ সাজিয়ে রাখা ছোট ছোট গাছ গুলো হ্যালোজেন বাতিতে এত আদুরে লাগতে শুরু করল। সত্যি সত্যি ইচ্ছে করছিল হাতে নিয়ে একে একে সবকটিতে চুমু খাই।
গাছগুলোর ওপর নজর বোলালেই ইনতিসারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে পানি চলে আসছিল। ওকে একটা থ্যাংক্স না দেয়া পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি লাগছিল না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কখন ও ফিরবে, কখন ওর প্রাপ্য থ্যাংক্সটা ওকে দিতে পারব।
এতদিন বাদে এই প্রথম কেউ আমার ইচ্ছের মর্যাদা দিয়েছে, আমার খুশির মর্যাদা দিয়েছে। তার কৃতজ্ঞতা তো প্রকাশ করতেই হবে। এরকম কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কোনো কুণ্ঠাবোধ নেই । একদম নেই।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here