ভালোবাসার রংধনু,৩৩,৩৪

0
956

ভালোবাসার রংধনু,৩৩,৩৪
Sinin Tasnim Sara
৩৩
________________
৬২.
হসপিটাল থেকে ফেরার পর থেকে আপা সবসময় অসুস্থ থাকতো। কয়েকদিন আগের চেহারার উজ্জ্বলতাটাও অবশিষ্ট রইলো না । জীর্ণ শীর্ণ, দুর্বল একটা শরীর নিয়ে সবসময় বিছানায় লেপ্টে থাকে। আমি সামনে গেলে তো ঠিকই হেসে হেসে কথা বলতো কিন্তু আড়ালে গেলে ওর ফোঁপানোর আওয়াজ শুনতাম। খুব কষ্ট হতো আমার। এই কষ্ট ভুলে থাকার জন্য সারাদিন নিজেকে নানামুখী কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতাম। ছোট্ট সংসারের পুরো দায়িত্ব ইনতিসার নামক ছেলেটা একা বহন করছে। ওর হাড়ভাঙা পরিশ্রম দেখার পর কোথাও না কোথাও সহানুভূতির জায়গা তৈরি হয়েছিল আমার। আবার বলা যেতে পারে কখনও সহানুভূতি ছাপিয়ে অপরাধবোধ নামক একটা সুক্ষ্ম অনুভূতি মাঝেমধ্যে মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠতো। আমি যদি ওদের জীবনে না আসতাম তাহলে বোধহয় বেচারাকে এসব ভোগ করতে হতো না। না স্বজন হারাতো আর না পরিবারটা এভাবে ভেঙে যেত।
ওর না বলা সত্ত্বেও একটু একটু করে সংসারের বোঝাটা খানিক আমার কাঁধেও তুলে নিতে শুরু করলাম আমি । ও দেখলো, বুঝলো সবই৷ কিন্তু কিছু বলল না৷ বললে বোধহয় আমিও অপজিশনে পড়ে যেতাম।
আমাদের এই বিষাদময় ছোট্ট সংসারে আমি সবচাইতে বেশি মিস করতে লাগলাম ইঊশাকে। সকাল-বিকেল সারাবেলা;কাজে, অবসরে সবসময় আমার চার বছর আগের মিষ্টি ইঊশার মুখখানা মনে পড়তো। যে তার মায়াবী স্বরে তাম্মি তাম্মি ডেকে আমার কানদুটো ঝালাপালা করে দিতো। কখনও ছোট্টো হাতখানা দিয়ে আমার তর্জনী চেপে গুটি গুটি পায়ে ঘুরে বেড়াতো সারা বাড়ি। আমি উপলব্ধি করতে লাগলাম আমাকে ঘিরে ওর সকল ভুল ধারণা মেটানোর দায়িত্ব ছিল কেবল আমার। হ্যাঁ আমারই। কিন্তু সঠিক সময়ে এ উপলব্ধি না হবার কারণে আমি এটা করতে পারিনি।
আপার শারীরিক অবনতির কারণে ইশি আপু ইঊশাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। মাকে সবসময় অসুস্থ অবস্থায় দেখে ওর ওপর মেন্টাল প্রেশার পড়তে পারে এই ভেবেই ওকে নিয়ে যাওয়া। অবশ্য এই সিদ্ধান্ত সিংহভাগ আপারই ছিল। ও চাইছিল না ইঊশা ওকে এই অবস্থায় দেখুক। দূরে পাঠিয়ে মানসিকভাবে শক্ত করতে চাইছিল। আপার এমন সিদ্ধান্তে ইনতিসার মোটেও খুশি ছিল না। ও একদমই চায়নি শেষ কটাদিন বাচ্চাটা মা ছাড়া থাকুক। ইনতিসার নিজে মাউইমার মৃ/ত্যুর সময় পাশে থাকতে পারেনি। এই আক্ষেপ ওর সারাজীবনের। ও চায়নি ইঊশাও বড় হয়ে এমন আক্ষেপ করুক। কিন্তু আপা নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত দিব্যি দিয়ে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিলো। সপ্তাহে একদিন শুধু ইঊশা আসতো। বৃহস্পতিবার স্কুল শেষে। সেদিন রাতটা থেকে আবার শুক্রবার চলে যেত দুপুরবেলা। ও এলে আমি আর দূরে দূরে থাকি না। জোর করে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করি, ওর পছন্দের খাবার রান্না করে যত্ন নিয়ে খাওয়াই। কখনো পাশে বসিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি যেগুলো হচ্ছে জীবনে এগুলোর ওপর কারো হাত নেই। এগুলো সব সৃষ্টিকর্তার পরীক্ষা। ও কখনও বোঝার চেষ্টা করে, কখনও করে না৷ তবে আগে যে আমাকে একদমই পছন্দ করতো না, এই বিষয়টার পরিবর্তন ঘটেছে৷ আমার ধারণা কেবল আমার একার প্রচেষ্টায় নয় ইনতিসার, ইশি আপু উভয়েরই ভূমিকা আছে এতে৷

ইঊশার স্কুলে পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষাগুলোতে ও ওর মায়ের কাছেই থাকতে চাইছে। কিন্তু আপা কঠোরভাবে বলে দিয়েছে এখানে এলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আসা যাবে না৷ আপার কথা শুনে মন খারাপ করেছিল বাচ্চাটা। অভিমান করে আড়ালে বসে একা একা কাঁদছিল। ওর কান্নাটা আমি সহ্য করতে পারলাম না৷ আপার রাগটা যে কেন এত বেড়েছে! দিনে দিনে কঠোর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সবসময় ওর কঠোরতা মেনে নিলে হবে না। মন খারাপ নিয়ে কীভাবে পড়া কমপ্লিট করবে বাচ্চাটা?
আপার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এবার আমি ইঊশাকে রেখে দিলাম। আপা শুনে তো কি রাগ! ভীষণ বকাঝকা করলো আমাকে। আমি চুপচাপ বকা হজম করে ইঊশাকে আমার ঘরে নিয়ে এলাম। তারপর থেকে ও আমার সাথেই থাকছে৷ একসাথে থাকতে থাকতে ওর মনের বরফটা গলছে আস্তে আস্তে৷ কোনো সম্বোধনে না ডাকলেও ইদানীং সরাসরি কথা বলে আমার সাথে। আমি বুঝতে পারছি আপা ইচ্ছে করেই বোধহয় কিছুটা দূরে সরাচ্ছে ওকে। যেন সহজেই ও আমার কাছাকাছি আসতে পারে।

ইনতিসারের কাজের প্রেশার ইদানীং খুব বেড়েছে। দিনের পর দিন কেটে যায় বাড়ি ফেরে না। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আমি ফোন করি বারংবার। কিন্তু ওপাশ থেকে একটা কথাই ভেসে আসে “আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না”
কেন যে ওকে ফোনে কখনও পাওয়া যায় না! পরে তানজিম ভাইকে কল করে খোঁজ নিয়ে আসতে বলি। ফিরতি কলে তানজিম ভাই কৌতুকের সাথে হেসে বলে “আমাদের ইনতিসার কখনও এত কাজ পাগল হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি”
শুনে আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি৷ আসলেই সময় মানুষকে কতখানি বদলে দেয়৷ ভাবতে বসলে কখনোই আমি আজকের এই ইনতিসারের সাথে আমার চেনা আগের ইনতিসারকে মেলাতে পারি না৷ আমার মনে পড়ে না পুরনো ইনতিসারকে কখনো মুখ ফুটে টাকার কথা বলতে হয়েছে কি না । চাওয়ার আগে তার সমস্ত চাহিদা পূরণ হয়ে যেত ম্যাজিকের মতো। দুহাতে কখনো এত টাকা সে উড়িয়েছে নিজেও বোধহয় হিসেব রাখেনি। অথচ আজ পাই টু পাই হিসেব করে খরচ করতে হয়। মাসের শুরুতে বেতন নিয়ে এসে লিস্ট করে সংসারে কি কি খরচ লাগবে। বাড়িভাড়া, বাজার-সদাই, আপার ঔষধপত্র, নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, ইঊশার যাবতীয় খরচ সবকিছু সামলে ওর নিজের জন্য কিছু বেঁচে যায় কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ। অবশ্য বেঁচে যাওয়ার কথা না। কখনো মাসের পনেরো তারিখের পর সংসার চালানোই কঠিন হয়ে যায়। অতিরিক্ত টাকা থাকা সেখানে অসম্ভব। ইদানীং ড্রিংকসও করে না বোধহয়। মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরতে দেখি না আর।
অবসরে বসে বসে ভাবনা আসে ইনতিসারের আক্ষেপ হয় না? রাগ হয় না আমাদের প্রতি? ও চাইলেই তো এসব দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো৷ ওর বড় ভাইয়ের মতো নিজের জীবন সাজাতে চলে যেতে পারতো বিদেশে। কিন্তু গেল না কেন? কেন স্বেচ্ছায় একটা দুর্দশার জীবন বেছে নিয়েছে? এই যে তিনরুমের ফ্ল্যাটটা! এই পুরো ফ্ল্যাটটাই হলো ওর ঐ বাড়ির একটা ঘরের সমান। বিলাসপূর্ণ সেই ঘর ছাড়া আজ এতটুকু ঘরে কীভাবে থাকে? কীভাবে কোনো অভিযোগ না করে শুধু শাকসবজি দিয়ে ভাত খেতে পারে?
ভাবতে বসলে এসব প্রশ্নের উত্তর কখনোই খুঁজে পাই না আমি। উত্তরগুলো তো সব ইনতিসারেরই জানা।
_________________
৬৩.
এ মাসটায় টানাটানি একটু বেশিই হচ্ছে যেন। আপাকে কয়েক থেরাপি দিতে গিয়ে প্রচুর টাকা বেরিয়ে গেল হাত থেকে। এদিকে গতকাল থেকে ইঊশা খুব জেদাজেদি শুরু করেছে পিজ্জা খাওয়ার জন্য। পরীক্ষা শেষে ওর কোনো এক বন্ধুকে দেখেছে বাবার সাথে পিজ্জাবার্গে যেতে৷ এখন বন্ধুকে দেখে ওরও শখ জেগেছে পিজ্জা খাবে। ফাস্টফুড ওর ভীষণ পছন্দ। আমি জানি ইনতিসারের হাতে টাকাপয়সা নেই। কোনোরকমে সপ্তাহখানেক চলার মতো কিছু আছে বোধহয় হাতে। এমন মুহুর্তে ইঊশার আবদার শুনে বিপাকে পড়ে গেল মানুষটা। সকালবেলা খাবার টেবিলে ইঊশা যখন আবদার করছিল শুনেই চোখমুখ শুকিয়ে এসেছিল ওর৷ একটাই ভাস্তে। নিষেধও করতে পারছিল না, কিছু বলতেও পারছিল না। আমার খুব ইচ্ছে করছিল যেখান থেকে পারি ওর হাতে টাকা এনে দেই। কিন্তু আমিই বা কীভাবে দেবো? নিজেই তো বেকার।
ইঊশার জিদ দেখে আপাও খুব রাগ করল। অযথা বাচ্চাটার গায়ে হাত তুলল। তখন ব্রেকফাস্টটা মাত্র মুখে তুলেছে ইনতিসার। ইঊশাকে মারতে দেখে মুখের খাবারটাও চিবুতে পারল না। চোখমুখ শক্ত করে খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে গেল। শত ডাকেও ওকে ফেরাতে পারলাম না৷ তারপর সারাদিন উদ্বেগে কাটলো আমার। যেমন রেগে বেরুলো, কার না কার ওপর রাগটা ঝেড়ে ফেলে। রাগের ওপর তো ওর কন্ট্রোল নেই।
সারাদিনে তেমন কোনো সংবাদ এলো না আর৷ ড্রিংকস ছাড়ার পর থেকে জলদি জলদিই বাসায় ফিরতো। কিন্তু আজ কেন যেন খবর নেই৷
রাত সাড়ে বারোটা, একটা -দেড়টা। আমি জেগে বসে রইলাম একরাশ উদ্বিগ্নতা নিয়ে। জানি না কেন কয়েকমাস যাবৎ ও না ফেরা অবধি আমার ঘুম আসে না। কেমন একটা অশান্তি অশান্তি ভাব থাকে বুক জুড়ে৷ ও যেন বুঝতে না পারে এজন্য ঘর অন্ধকার করে বসে থাকি। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ বিছানায় হেলান দিয়ে চুপচাপ দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছি। ঘড়ির কাঁটা যখন দুটোয় তখন সদর দরজায় লক খোলার শব্দ হলো। পরিচিত পায়ের শব্দে বুঝতে পারলাম ও এসেছে। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে শুয়ে পড়ব ঐ মুহুর্তে আমার ঘরের দরজায় নক হলো৷ হালকা কেশে ইনতিসার গম্ভীর স্বরে ডাকল,
— নীরদ বাইরে এসো তো। ইঊশা পিজ্জা খেতে চেয়েছিল নিয়ে এসেছি। ওকে খাইয়ে দাও।
ওর ডাকে কিছু একটা ছিল। চমকে উঠলাম আমি ৷প্রথম কয়েক সেকেন্ড মুখে কথা যোগাচ্ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললাম,
— ইঊশা তো ঘুমে।
— জাগাও ওকে। জাগিয়ে খাওয়াও। যে খাবারের জন্য মার খেয়েছে সে খাবার না খেয়ে ঘুমোতে দিব না ওকে।
আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে গটগট করে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল ও। বুঝলাম আপা যে ইঊশার গায়ে হাত তুলেছিল বিষয়টা মোটেই পছন্দ করেনি ইনতিসার।
কিন্তু ঘুমন্ত বাচ্চাকে ডেকে খাবার খাওয়াব কি করে? দ্বিধায় পড়ে গেলাম আমি। হয় না হয় করে এক পা দু পা করে আপার ঘরের দিকে গেলাম। ইঈশা ঘুমে কাদা। কোনোভাবেই ওকে জাগানো সম্ভব না। থাক সকালবেলাই নাহয় খাবে৷ এসব ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে আসছিলাম। কিছুটা পথ চলে আসতেই আপা খুব মৃদু স্বরে ডেকে উঠল পেছন থেকে। আমি জবাব দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
— তুমি এখনও ঘুমোওনি?
আপা মাথা নাড়ল। ইশারায় কাছে ডেকে বলল,
— আমার পাশে একটুখানি বস।
আমি পাশে গিয়ে বসলে দু’হাতের মুঠোয় আমার হাত টেনে নিয়ে বলল,
— বহুদিন থেকে তোকে একটা কথা বলব ভাবছিলাম।
— হ্যাঁ বলো না।
— নীরদ আমি আমার জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে গেছি। মানুষ মৃ/ত্যুর আগে বুঝতে পারে তার মৃ/ত্যু আসন্ন। আমিও বেশ বুঝতে পারছি তোদের মাঝে বেশিদিন আর নেই আমি।
— এসব কেন বলছ আপা?
— এটাই সত্যি । আমার জীবনের শেষ কটাদিন আমি স্বস্তি নিয়ে বাঁচতে চাই নীরদ। আর আমার এই স্বস্তিটা তোর মাঝেই।
— আমার মাঝে?
— হু তোর মাঝে। তুই ই একমাত্র পারিস আমার স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে।
— কি করতে হবে আমাকে আপা বলো? আমি সব করতে পারব তোমার জন্য৷
আমার কথা শুনে আপা নীরব হয়ে গেল। খানিকটা সময় নীরব থেকে বলে উঠল,
— তুই ইনতিসারকে বিয়ে কর নীরদ৷ মৃত্যুর আগে তোকে একটা বিশ্বস্ত হাতে দিয়ে যেতে পারলে আমার জীবন থেকে আর কোনো চাওয়া থাকবে না৷
— আপা!
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মৃদু চিৎকার করেই উঠলাম আমি। আপা শক্ত করে আমার হাতটা চেপে ধরলো৷ অনুনয়ের সুরে বলল,
— প্লিজ নীরদ আমার কথা শোন। বিয়ে কর তুই ইনতিসারকে। তোকে নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তা। আমার পর কি করবি তুই? কোথায় যাবি? আমার ইঊশাকেই বা দেখে রাখবি কীভাবে? খড়কুটোর মতো ভাসমান একটা অনিশ্চিত জীবন আমি কীভাবে দিয়ে যাব তোকে? তারচেয়ে তুই সংসারী হ। তোকে কোথাও থিতু হতে দেখলে আমি স্বস্তির সাথে ম/র/তে পারব।
— না আপা এ হয় না। কিছুতেই হয় না৷
হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
— কেন হয় না নীরদ? কিসের কমতি? ইনতিসার কোন অংশে কম বলতে পারিস? নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, সংসারী হয়েছে। তোকে ভালোও বাসে৷
— আপা আমাদের অতীত তুমি জানো না? সে রাতের ঘটনা তুমি জানো না? এই চার বছরে কি কি হয়ে গেছে তুমি জানো না? তারপর কীভাবে বলছ আমার ওপর ওর ভালোবাসা এখনও অক্ষত আছে। কীভাবে ভাবছ আমরা দুজন একসাথে…
এ হয় না আপা। কোনো ভাবেই হয় না৷
উত্তেজনার সাথে এতটুকু বলে একছুটে চলে এলাম আমি আমার ঘরে। পেছন থেকে আপা খুব করে ডাকল, কিন্তু শুনলাম না। ও কীভাবে এমন ভয়ানক কিছু ভাবতে পারছে? আমার আর ইনতিসারের পথ সেই কবেই আলাদা হয়ে গেছে। আলাদা সে পথটা এখন কোনোভাবেই জোড়া লাগানো সম্ভব না। কোনোভাবেই না।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

ভালোবাসার রংধনু
৩৪
______________
৬৪.
পাখির ডানায় ভর করে চলে গেল আরও কয়েক মাস। আমাদের জীবন ধারণে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসেনি এর মাঝে৷ তবে ইঊশার সাথে আমার সম্পর্কের একটুখানি উন্নতি ঘটেছে; উন্নতি ঘটেছে ইনতিসারের সাথেও। বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই গড়ে উঠেছে আমাদের মাঝে। আপার মাথায় যে আমার বিয়ের ভূত চেপেছিল তা এখনও শক্তভাবে চেপে বসে আছে। রোজকার ডাল-ভাত খাওয়ার মতো আমাকে বিয়ের জন্য কনভিন্স করাও আপার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। আমি শিওর ইনতিসারের কানেও গেছে এই কথা। তবুও আমরা সবরকম কানকথাকে পেছনে ফেলে একটা হেলদি বন্ড তৈরি করেছি নিজেদের মাঝে। সামনাসামনি হলে অস্বস্তি হয় না এমন নয়। তবে অস্বস্তিগুলোকে চট করে লুকিয়ে ফেলি হাসি মজার আড়ালে। মাঝেমধ্যে চা আড্ডায় নিজেদের জীবন নিয়ে গল্প করি। নিত্যকার টুকিটাকি গল্পের মাঝে কোনোসময় রাজনীতি, সমাজতন্ত্র, মার্ক্সবাদ কত কি ঢুকে যায়!
এভাবে দুঃখের মধ্যেও সুখ খুঁজে নিতে শুরুই করেছিলাম মাত্র, তন্মধ্যে হুট করে বাঁধ সাধলো আমারই দ্বিতীয় সত্ত্বা৷ ভেতরের সত্ত্বা। সহজ শব্দে যাকে আপনারা “হৃদয়” বলে ডাকেন৷ আমি জানি না কেন হুট করে আমার মন ইদানীং অন্যরকম এক সুর ধরেছে।বন্ধ পড়ে থাকা পুরোনো কোনো বিবশ অনুভূতির দরজায় জোর কড়া নাড়ার চেষ্টা করছে৷ আমি অবশ হাতে তাকে সামলানোর চেষ্টা করেও সফল হচ্ছি না। অনুভূতির অভিধানটাকে গোপন কুঠুরিতে আটকাতে পারছি না। বুঝে উঠতে পারছি না কি হচ্ছে আমার সাথে, কেন হচ্ছে। আমি কি কোনোভাবে ইনতিসারের ওপর ফল করছি? উঁহু এটা তো হতে দেয়া যাবে না ৷ কিছুতেই না৷ এরকম ভুল আমার দ্বারা দ্বিতীয়বার হওয়া সম্ভব না৷ ইনতিসার বা আমি কেউ কখনো সুখী হবো না পরস্পরের সাথে। কারণ আমি এখন ইনতিসারকে নিয়ে যা ফীল করছি তা ভালোবাসা নয়৷ হতে পারে না। এটা নিতান্তই দায়বদ্ধতা নয়তোবা অনুশোচনা। বছর চারেক আগে অন্তুর প্রতি ঠিক এমন একটা অনুভূতিকেই ভালোবাসা ভেবে ভুল কছিলাম আমি। কিন্তু এখন উপলব্ধি হয় ওর ওপর অনুভূতির নব্বই শতাংশ ছিল একপ্রকার দায়বদ্ধতা। ঋণী ছিলাম ওর কাছে। অসহায় একটা সময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার। নিঃস্ব আমার সে সময়ে খুব করে প্রয়োজন ছিল কাউকে৷ একপ্রকার ইনসিকিউরিটি থেকে ওকে আঁকড়ে ধরার বাসনা জাগল। সারাজীবন ভালোবাসা না পাওয়ার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত থেকেছি আমি। একটা মানুষকে গোটা সমাজের সামনে দাবী করে “এই মানুষটা আমার আপনজন” বলার অধিকার কখনো আমার হয়নি। বোধহয় এজন্যই অন্তুর আগমন সাদরে গ্রহণ করেছিল আমার হৃদয়। সমস্তটা দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল ওকে।
আজ আবারও ইনতিসারের প্রতি যদি সেরকম অনুভূতিই জাগে তাহলে এটা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে আমার। দায়বদ্ধতার সম্পর্কগুলো ক্ষণস্থায়ী হয়৷ আমি ঘরপোড়া গরু। সিঁদুর মেঘ দেখলেই ভয় লাগে। দ্বিতীয়বার কোনরূপ দায়বদ্ধতায় জড়াতে চাই না আর। নিজের জীবনটা তো নষ্ট করেইছি। এখন ইনতিসারের জীবন আমার কারণে নষ্ট হোক এটা আমি চাই না ৷ কিছুতেই না৷
কয়েকদিন যাবৎ তাই ইনতিসারের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছি। ওদিকে ওরও ব্যস্ততা বেড়েছে আবার৷ অফিসে কর্মচারী ছাঁটাই হচ্ছে। চাকরি নিয়ে একটা ভয়ের মধ্যে আছে। কাজের লোড নিচ্ছে খুব৷ বেরিয়ে যাচ্ছে কাল ফজরে, ফিরছে রাতে। সেই সুযোগে আমিও অনুভূতি নামক বেহায়া জিনিসটাকে বাঁধার চেষ্টা করছি খুব করে৷ আগে ওর জন্য যা জেগে বসে থাকতাম এখন তা থাকছি না। রাতের দশটা বাজলেই দরজায় খিল দিয়ে দেই। দিনের বেলায়ও কোনোভাবে সামনে পড়ি না৷ খুব করে ওর নজর বাঁচিয়ে চলি। কোনো দরকারে কল টল দিলেও আপা অথবা মাফিনের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিই, তাদের দিয়ে কথা বলাই৷ বিধ্বংসী অনুভূতিটা থেকে যেকোনোভাবে নিস্তার লাভই এখন আমার মুখ্য উদ্দেশ্য।
অফিসের দিনগুলোতে নাহয় বাঁচা যায় কিছু করে কিন্তু ছুটির দিন? ও তো বাড়িতেই থাকে। কাজের লোক ছাড়িয়ে দেয়ায় সমস্ত কাজের ভার আমার ওপরেই। এখন ঘরদোর সামলাতে গেলে নজর বাঁচিয়ে চলা কীভাবে সম্ভব?
এই যে আজ সকালবেলা ব্রেকফাস্ট রেডি করার সময় কিচেনে ওর সাথে দেখা হলো। দেখেও না দেখার ভান করে কাজ করছিলাম। সে এসেই হম্বিতম্বি। চা করে দিতে হবে, মাথাব্যথা। আমি খুব শান্ত স্বরে বললাম ” আপনি গিয়ে বসুন। আমি করে দিচ্ছি”
কিন্তু নাহ্ সে আশ্বস্ত হলো না। চায়ের পাতিল টাতিল নামিয়ে ঠুসঠাস শব্দ করে, চামচ, চা-চিনির পট আছড়ে এক প্রকার টর্নেডো সৃষ্টি করে একা একা চা বানিয়ে নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় শ্যেন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এখন আমাকে চা করে দাও না যে? সবসময় দরজা লক করে বসে থাকো। ফোন দিলেও ইঊশা নয়তো ভাবিকে ধরিয়ে দাও ঘটনা কি?
আমি জানতাম এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে কণ্ঠের শীতলতা বজায় রেখেই জবাব দিলাম,
— সময় পাই না। কাজের চাপ খুব।
প্রতুত্তরে ইনতিসার চুপ করে রইলো। চোরা চোখে ওর কুঁচকানো ভ্রু দেখে বুঝতে পারলাম বিশ্বাস করেনি আমার কথা। না করুক, আমার কি? ওর থেকে মনোযোগ সরিয়ে রুটি গোল করায় মন দিলাম আমি। ও কতক্ষণ মূর্তিমান দাঁড়িয়ে থেকে হাতে ধরে থাকা চায়ের কাপ সবেগে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে রাগত গলায় বলল,
— আমার সাথে ভাব দেখাতে আসবে না নীরদ৷ তোমার ভাবের তোয়াক্কা করে না এই ইনতিসার৷ বুঝতে পেরেছ? পৃথিবীর সব কাজ একা তোমারই। ঠিকাছে করো কাজই করো।
এরপর গটগট করে হেঁটে চলে গেল।
আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে ওর গমন পথে তাকিয়ে রইলাম৷ জিনিসপত্র ছোঁড়াছুড়ি কি এই ছেলের প্রধান শখ? এভাবে রাগ দেখাতে গিয়ে সংসারের কতটা ক্ষতি করে দেয় ও জানে? ভাঙা কাপটার দিকে চোখ পড়তেই আফসোস হলো আমার। আহারে! কত সুন্দর ছিল কাপটা।
এরপর সারাদিনে যতবার সামনা সামনি হলো প্রতিবার চোখ রাঙিয়ে চোখমুখ শক্ত করে তাকালো আমার দিকে৷ আমি দেখেও না দেখার ভান করে কাটিয়ে দিলাম৷
___________
দুপুরবেলা জুম্মা নামাজে চাচা-ভাস্তে প্রতিবারের মতো এক রঙা পাঞ্জাবি পরে আতর মেখে জায়নামাজ হাতে বেরিয়ে গেল। ওদের বিদায় দিয়ে আসার সময় সিঁড়িঘরের কাছে বহুদিন পর প্রিমার সাথে দেখা হলো আমার। ওকে দেখামাত্র চট করে সেদিনের ছাদের ঘটনা মনে পড়ে গেল। যদিওবা ঐ ঘটনার সাথে ওর সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে৷ তবুও ওরকম বাজে কিছুর পর ওদের পুরো পরিবারের থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি। তবে সেটা ওদের বুঝতে না দিয়ে। তাই ওকে দেখে ভদ্রতাসূচক একটা হাসি দিলাম কেবল। কিন্তু ও হাসিতে সন্তুষ্ট হলো না৷ লাফিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে অনুনয়ের সুরে বলল,
— নীরদ তোমার সাথে আমার খুব ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে।
ওর এমন আচরণে আমি ভড়কে গেলাম৷আবার আর্ত স্বর উপেক্ষাও করতে পারলাম না। অগত্যা নিয়ে গেলাম ভেতরে।
ও এসেই মাফ চাইতে লাগল আমার কাছে। ওর মায়ের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পেরেছে কোনোভাবে। খুব স্যরি ফীল করছে এখন৷ ওর মা নাকি এরকমই সেন্সিটিভ৷ সত্যি বলতে আমি মন থেকে ঐ স্মৃতি কখনোই মুছে ফেলতে পারব না। কিন্তু এক বাসায় থাকি, বিদ্বেষ করে লাভ কি?
আলতো হেসে বললাম,
— ইটস ওকে প্রিমা। আমি ওসব মনে রাখিনি। নিজের প্রিয় জিনিসে কেউ হাত দিলে রাগ হবে স্বাভাবিক। আন্টিরও হয়তো হয়েছিল। সমস্যা নেই।
প্রিমা উঠে এসে আমার হাত চেপে ধরলো।
— তুমি ক্ষমা করেছো তো আমাকে?
— আরে ক্ষমা কোত্থেকে আসছে পাগল। বললাম না এসব মনে রাখিনি। তুমিও ভুলে যাও তো৷
— আমার খুব খারাপ লেগেছে নীরদ৷ আমি ঐ সময় তোমার সাথে থাকলে বোধহয় মা ওরকম করতে পারত না।
— হয়েছে চুপ। এখন এসব কথা বাদ দাও তো৷ চা খাবে? আমি খুব সুন্দর চা বানাতে পারি।
— সত্যি? তুমি চা ও বানাতে পারো?
— শুধু চা! আমি তো রান্নাও জানি। দাঁড়াও কাল পায়েস করেছিলাম। টেস্ট করে বলো কেমন লাগে৷
— হু হু দাও দাও। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না আফ্রোদিতি রূপবতী হওয়ার সাথে সাথে এত এত গুণে গুণবতীও৷
হাসতে হাসতে বলল প্রিমা। জবাবে আমিও মৃদু হেসে চলে গেলাম ওর জন্য খাবার আনতে৷ খাবার দিয়ে চা বানাচ্ছি আর টুকটাক গল্প করছি । দূরে সুবিধা করতে না পেরে একসময় প্রিমাই উঠে চলে এলো কিচেনে। পুরো কিচেনে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
— আচ্ছা তোমাদের বাড়ির ভদ্রলোক সবসময় মুখ গোমড়া করে রাখে কেন? দু বছর থেকে থাকছে। হাসতে দেখিনি একবারও। ও কি বাসাতেও ওরকম?
— কার কথা বলছো?
কৌতূহলী চোখে তাকালাম আমি।
— কার আবার! আন্টির দেবর আর আমাদের পাড়ার একমাত্র লেডি কিলার মিস্টার ইনতিসার ইলহাম।
— লেডি কিলার! পাড়ার মেয়েরা সব ওর ওপর ক্রাশড নাকি?
হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
— সে আর বলতে! পাড়া কি;আমার ফ্রেন্ডসরাই তো ও বলতে পাগল। মাঝেমধ্যে আসে না আমাদের বাসায়? শুধু ওকে দেখার জন্যই আসে জানো৷ আর মৌটুসী তো পুরো অবসেসড ওর জন্য৷ প্রপোজও করে ফেলেছিল৷ আনফরচুনেটলি পাত্তা পায়নি। বেচারি। তবে আমার খুব রাগ হয় মৌটুসীর ওপর। বেয়া/দব মেয়ে। ওর জন্য আমাদের পড়ানো বাদ দিয়ে দিলো ইনতিসার৷
— ও তোমাদের পড়াতো নাকি?
কাপে চা ঢালতে ঢালতে আবারও প্রশ্ন করলাম আমি। প্রিমা মাথা নাড়লো।
— হু নতুন যখন বাসাটায় এলো তখন। জব পাওয়ার আগে। ভীষণ ভালো পড়ায় জানো?
— তো কোন সাবজেক্ট পড়াতো সে?
— ফিজিক্স৷ কি সহজ করে বোঝাতো। আহা!
বলতে বলতে চোখ জল জল করে উঠলো প্রিমার৷ আমি মনোযোগ দিয়ে ওর গতিবিধি লক্ষ করছি। সন্দেহের বশে এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— বাকিদের কথা তো শুনলাম এবার তুমি তোমার খবর বলো। লেডি কি/লা/র আর সবার মতো তোমার মন কাড়তে পারেনি?
— ধ্যাত কি যে বলো না!
হাসতে হাসতে মুখ ফিরিয়ে নিলো প্রিমা।
পায়েসে চামচ নাড়াতে নাড়াতে বেখেয়ালি মনে শুধলো,
— ইনতিসার ভাইয়ের কি পায়েস পছন্দ নীরদ?
আমি প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হলাম। আমার সন্দেহ কি তবে ঠিক? পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে উত্তর দিলাম,
— তা তো বলতে পারব না৷ খায় তো। পছন্দ কি না জানি না।
— আমাকে পায়েস রান্না শেখাবে?
চকিতে আমার দিকে ফিরে তাকালো ও।
— তুমি বাচ্চা মেয়ে রান্না শিখবে?
— হু। এই পায়েসটা খুব মজা হয়েছে। প্লিজ আমাকে শিখিয়ে দাও।
— আচ্ছা শেখাবো।
— আজই শেখাও আজ তো অফ ডে। আমি ফ্রী৷
— আজই শিখবে? কিন্তু আমার যে কতগুলো কাজ আছে।
বিব্রতভাবে বললাম আমি৷
প্রিমার মন খারাপ হয়ে গেল। মাথা নীচু করে আপনমনে বিড়বিড় করে বলল “কিন্তু তার বার্থডে যে এ সপ্তাহেই”
আমি কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিলাম ওর। তাই এতটুকু কথা অনায়াসেই কানে এলে আমার। কার বার্থডের কথা বলছে ও? ইনতিসারের কি!
চোখ বন্ধ করে আমি মনে করার চেষ্টা করলাম ইনতিসারের বার্থ ডেইটটা। দুঃখজনকভাবে মনে পড়লো না। নিজের ওপরেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
প্রিমার দিকে তাকিয়ে অবচেতনে জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
— তোমার কি ইনতিসারকে পছন্দ প্রিমা?
প্রশ্নটা করে পরক্ষণে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম৷ আশ্চর্য আমি কি পাগল হয়ে গেছি? কিসব জিজ্ঞাসা করছি ওকে;কেন করছি? ভীষণ বিব্রত লাগল। প্রিমাও চমকে তাকিয়েছে আমার দিকে।
ওর অবাক দৃষ্টি আমায় আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। তবে আমি অবাক হলাম এই দেখে অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও আমার মন কোনোভাবে চাইছে প্রিমা না বলুক। বলুক ইনতিসারকে নিয়ে ওর ভেতর সেরকম অনুভূতি নেই। এবং নেগেটিভ একটা আন্সার শোনার জন্য আমার ভেতরে অদ্ভুত তাড়না অনুভব করতে লাগলাম আমি।
কিন্তু আমার চাওয়াকে অপূর্ণ রেখে প্রিমা কোনো উত্তর দেওয়ার পূর্বেই কর্কশ শব্দে কলিংবেল বেজে উঠল। সে শব্দেই ধ্যান ভাঙলো আমাদের দুজনের। আমি আলতো হেসে বললাম,
— ওরা এসেছে বোধহয়। তুমি বসো আমি আসছি।
— না চলো আমিও যাই তোমার সাথে। চলে যাব মা নাহলে বকবে।
মাথা নেড়ে সায় দিলাম আমি। পরে প্রিমাও আমার পেছন পেছন উঠে এলো৷ আমরা তখনও আন্দাজ করিনি দরজার ওপাশে কি চমক অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
______________
৬৫.
দরজা খোলামাত্র দেখতে পেলাম ইনতিসার একা নয় ওর সাথে কতগুলো ছেলেপেলে আর সকলে ইনতিসারকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইনতিসারের হাতে, পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। পাশে ইঊশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইনতিসারকে এমন আহত অবস্থায় দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি।শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। কিছু জিজ্ঞেস করবো তার পূর্বে আমার পেছন থেকে ছুটে এলো প্রিমা। ঘাবড়ানো গলায় শুধলো,
— কি হয়েছে ওনার?
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সাথের একটা ছেলে বলল,
— নামাজ পড়ে আসার পথে ভাই অ্যা/ক্সিডেন্ট করছে।
পাশ থেকে আরেকজন বলল,
— শালা বদমাশ ড্রাইভার নেশা করে গাড়ি চালাচ্ছিল মনে হয়। ফাঁকা রাস্তা অযথা এসে লাগায় দিছে।
ইনতিসার ওদের হাত নাড়িয়ে থামিয়ে দিলো। বলল,
— জোরে চেঁচামেচি করিস না ভাবি শুনতে পেলে মুসিবত হয়ে যাবে।
বলা বাহুল্য আপা তখন ঘুমাচ্ছিল। ইনতিসারের কথামতো ছেলেগুলো আর কিছু বলল না।
ধরাধরি করে ওকে ওর ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ছেলেগুলোর সাথে যোগ দিলো প্রিমা। ইনতিসারকে ঘরে নিয়ে যাওয়া, পানি খাওয়ানোসহ যাবতীয় সব কাজ ও এমনভাবে ছোটাছুটি করে করতে লাগল যেন ইনতিসারের ওপর ওর অদৃশ্য একটা অধিকার রয়েছে। ডাইনিং স্পেসে দাঁড়ালে ইনতিসারের ঘরের ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যায়। প্রিমার কনসার্ন, ইনতিসারের পাশে বসে থাকা, ওর কোনোকিছু প্রয়োজন হচ্ছে নাকি এসব জানতে চাওয়া সবটা, সবটা আমি এখানে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। খুব অদ্ভুতভাবে ঘরের ভেতরের দৃশ্যটা আমায় পোড়াতে লাগল৷ ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে একাকার হয়ে আমার ইচ্ছে করলো টেনে প্রিমাকে সরিয়ে আমি গিয়ে ওর স্থানে দাঁড়িয়ে যাই। ও এখন যা যা করছে তা করার অধিকার কেবল আমার। ইনতিসারের জন্য কনসার্ন হওয়া, ওর খেয়াল রাখা এসব আমার কাজ;প্রিমার নয়। এবং কিশোরী মেয়েদের মতো ঈর্ষান্বীত আমার এই মুহুর্ত থেকে প্রিমা সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ হয়ে গেল।
ওদের ভাবনায় মশগুল আমার ধ্যান ভাঙলো ইঊশার ফোঁপানোর শব্দে। বাচ্চাটা কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ লাল করে ফেলেছে ছেলেটা। ছোট্ট শ্বাস ফেলে আমি ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলাম। ওর নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললাম,
— তোমার চাচ্চু তো ঠিক আছে বাবা। কাঁদছো কেন?
আমার কথা শুনে ওর কান্না বেড়ে গেল। আমার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। চাচ্চুর কিছু হয়ে গেলে!
— কিচ্ছু হবে না তোমার চাচ্চুর। ট্রিটমেন্ট করিয়েছে না? জলদি সুস্থ হয়ে যাবে দেখো।
— সত্যি হবে?
— অবশ্যই। দেখি তুমি কান্না বন্ধ করো তো এখন। তোমার আম্মু শুনতে পেলে ভয় পেয়ে যাবে। আম্মু অসুস্থ না? তুমি কি চাও সে এসব নিয়ে চিন্তা করুক?
— উঁহু চাই না।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল ইঊশা।
— এইতো ভালো ছেলে। যাও এখন কাপড়চোপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আসছি। কেমন?
মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে চলে গেল ইঊশা। ও চলে গেলে স্বাভাবিকভাবে আমার নজর পুনরায় চলে গেল ইনতিসারের ঘরের দিকে। ইনতিসারও এদিকেই তাকিয়ে ছিল। আমার তাকানোয় চোখাচোখি হয়ে গেল। ওর চোখে চোখ রাখতেই আমার ভেতরে কোত্থেকে একরাশ অভিমান এসে জড়ো হলো। সেকেন্ডও অতিবাহিত না করে মুখ ফিরিয়ে উঠে চলে গেলাম আমি।
_____________
৬৬.
প্রকৃতির নিয়মে দিন গড়িয়ে রাত হয়েছে অনেকক্ষণ। বারান্দার গ্রীল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ভাবছি আজ দিনের বেলার কথা। কেন করলাম আমি এসব? নিজের কাছেই তো এখন ছোটো হয়ে যাচ্ছি। আমি তো চাই ই ইনতিসারের জীবনে অন্যকেউ আসুক। সুখী হোক ইনতিসার। সেই অন্যকেউটা নাহয় প্রিমাই হলো। তাহলে এখন ঈর্ষা জাগছে কেন? কেন আমার মনটা আমার বিরুদ্ধে যাচ্ছে? কেন আমি বিবশ অনুভূতিটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। কেন?
ভীষণ রাগে কান্না পেলো আমার। কোনোভাবে কান্নাটাকে দমাতে না পেরে মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম।
— কাঁদছো কেন নীরদ?
অকস্মাৎ ইনতিসারের গলা ভেসে এলো পাশ থেকে। চমকে ফিরে তাকালাম আমি। ওর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে পড়ে তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম,
— কই কাঁদছি না তো।
— মিথ্যে বলে লাভ আছে? আমি দেখলাম তোমায় কাঁদতে।
— ও কিছু না। এমনিই।
স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম আমি। ইনতিসারের দৃষ্টি কঠোর হলো।
— দুপুরের পর থেকে ঘরবন্দী হয়ে বসো আছো কেন? খাওয়াদাওয়াও করোনি।
— ক্ষুধা নেই।
— নীরদ আমি তোমায় বুঝতে পারছি না। ইদানীং এত অদ্ভুত আচরণ করছো কেন বলবে? কি হয়েছে তোমার?
— কি হবে? কিচ্ছু হয়নি।
— অনেক সময় অনেক কিছু চাইলেও লুকোনো যায় না নীরদ। তুমি ভাবছো আমি কিচ্ছু জানি না? বুঝতে পারি না?
— কিসব বলছেন আপনি ভুলভাল।
মেকি হাসবার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু সফল হলাম না। বেহায়া চোখজোড়া আবারও ভিজে উঠছে। উঁহু, ইনতিসারের সামনে ভেঙে পড়া যাবে না। কিছুতেই না।
ও আমার বাহু চেপে ধরে কাছে টেনে নিলো। ধীর গলায় বলল,
— আমার দিকে তাকাও নীরদ। একবার আমার চোখে চোখ রাখো। সবসময় কেন সবকিছু থেকে পালাতে চাও? পালিয়ে আর কত!
নাহ্ আমি আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। বিবশ সেই অনুভূতিটার কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে ফিরে তাকালাম ওর দিকে। চোখে চোখ রাখতেই দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করলো আমার৷ দু ফোঁটা উষ্ণ জল গড়িয়েও পড়লো কপোল বেয়ে। ও হাত বাড়িয়ে দিলো আমার পানে। কপোলে আঙুল স্পর্শ করেছে মাত্র সাথেসাথে আমি সমস্ত সংকোচ ঠেলে সরিয়ে ছুটে গিয়ে ওর বুকে আছড়ে পড়লাম। গভীর সাগরের তীরে উত্তাল ঢেউগুলো যেমন বেসামাল হয়ে আছরে পড়ে ঠিক তেমন করে৷ সহজ সমর্পণে ও বোধহয় বিস্মিত হলো৷ ক্ষনিক নিশ্চল থেকে আমার মাথাটা পরম স্নেহে বুকে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে শুধলো,
— ভালোবাসো?
আমি ওর পিঠের কাছটায় কাপড় শক্ত করে চেপে ধরে মাথা নেড়ে অস্পষ্টভাবে বললাম,
— একদম না, একদম না৷
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর৷ আমাকে আগলে রেখেই উদাসী হয়ে বলল,
— আমার তো তবে মহাদেব বাবুর মতো বলা উচিৎ
” একবার ভালোবেসে দেখো, একবার কাছে ডেকে দেখো
আবার আগের মতো কীভাবে ফুটাই এক লক্ষ একটি গোলাপ”
আমি চোখ খিঁচে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। অস্পষ্ট গলায় বিড়বিড় করে বললাম “চুপ করো। চুপ করো প্লিজ”
ইনতিসার হেসে উঠল। কানের কাছে মুখ নিয়ে পূর্বের ন্যায় ফিসফিসিয়ে শুধলো,
— সর্পিণী, কি আছে তোমার মাঝে বলতে পারো? তোমার থেকে পাওয়া প্রত্যাখ্যান নামক বিষাক্ত দংশনে লক্ষ কোটিবার আহত হয়েও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাকে থামাতে পারি না কেন? কেন তোমাকে এড়িয়ে যেতে পারি না কোনোভাবে? একটুখানি এড়াতে গেলে আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়ি। একটুখানি ভুলতে গেলে কেন আরো বেশি করে ভালোবেসে ফেলি?

ইনতিসারের প্রশ্নের জবাবে আমি নীরব রইলাম। মানুষটা কি জানে তার মুখে ভালোবাসার কথা ধারালো ফলা হয়ে আমার ভেতরের শক্ত বাঁধুনিটাকে কাটতে শুরু করেছে। কীভাবে আমি আটকাবো নিজেকে দ্বিতীয়বার এই ভালোবাসা নামক গরল পান থেকে? কীভাবে?

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here