ভালোবাসার রংধনু,৩৫,৩৬

0
797

ভালোবাসার রংধনু,৩৫,৩৬
Sinin Tasnim Sara
৩৫
________________
৬৭.
অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে কয়েকদিন যাবৎ ইনতিসার বাসায় বসা৷ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। ছুটি নিলেও তার কাজ কম কোথায়? রোজ অফিস থেকে এ আসছে, ও আসছে। বাইরের মানুষের পদচারণায় মুখরিত বাড়ি। এর মাঝে দু’দিন একজন লইয়্যারকে আসতে দেখেছি। আপার কাছে শুনলাম সে নাকি সম্পত্তি গুলো ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু নিলাম হয়ে যাওয়া সম্পত্তি কি আর ফিরে পাওয়া সম্ভব? এখন নতুন করে শুরু করতে হবে সব। তবে সব সম্পত্তি হাত ছাড়া হলেও একটা এখনও হয়নি। ইনতিসারের দাদু ওকে যে বাড়িটা দিয়েছিলেন;ঐ বাড়িটা৷ ওটা নাকি ফিরে পাওয়া সম্ভব। ব্যাংকে নির্দিষ্ট একটা অ্যামাউন্ট পরিশোধ করতে হবে তার জন্য৷ ইনতিসার চেষ্টা করছে সেই টাকা জোগাড় করার৷ তবে কাজটা বেশ সময়সাপেক্ষ। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার৷ ইনতিসার কখন থেকে রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। কোন ফাঁকে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো, আমি তখন এসব ভাবনায় মশগুল খেয়াল করিনি ওকে। নিজের উপস্থিতি জানান দিতে আচমকা আমার বিনুনি টেনে ধরলো ও। চমকে উঠে পাশ ফিরে দেখি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম,
— কি?
ও বিনুনি হাতে পেঁচিয়ে আমায় নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
— এতক্ষণ ধরে ডাকছি শোনো না। মন কই?
আমি ওকে দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললাম,
— মন কাজের মধ্যে। দেখি চুল ছাড়ুন। উফফ ব্যথা পাই।
— না ছাড়বো না। কথা কি হয়েছিল? আবার আপনি সম্বোধন কেন?
— আপনি সম্বোধন কেন মানে? আপনি ছাড়া কখনো অন্যকিছু সম্বোধন করেছি?
— বাঃ সেদিন রাতে আমার বুকে পড়ে বড় “তুমি” বলে ডাকলে। বললে “চুপ করো, চুপ করো”
সব ভুলে গেলে না?
— দেখুন ওটা স্লিপ অব টাং। সজ্ঞানে কখনোই আমি আপনাকে আপনি ছাড়া তুমি ডাকব না।
— তার মানে সেদিন সজ্ঞানে নয় অজ্ঞানে ডেকেছ?
— উফফ কি সজ্ঞান-অজ্ঞান নিয়ে পড়লেন!
খানিক বিরক্ত হলাম আমি। বিনিময়ে সে রাশভারি গলায় বলল,
— তবে তোমাকে সবসময় অজ্ঞান করে রাখতে হবে। যেন আমাকে “তুমি” সম্বোধনে ডাকো।
— ইনতিসার!
ওকে ঠেলে সরিয়ে হেসে ফেললাম আমি।
ও চুল থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বিড়বিড় করে বলল,
— এভাবে আমার নাম ধরে ডাকবে না। বুকের ভেতর ঝড় ওঠে।
আমি স্পষ্ট শুনলাম ওর কথা কিন্তু না শোনার ভাণ করে কাজে মন দিলাম।
কয়েক সেকেন্ড পর নিজেকে স্বাভাবিক করে ইনতিসার তাড়া দেখিয়ে বলল,
— সকালের নাশতা কি আজ দুপুরে পাওয়া যাবে নাকি? সময়জ্ঞান এত কম হলে হয়!
— আ’ম শিওর এখনও ন’টাই বাজেনি। আজ আটটায় এসেছি আমি কিচেনে। রুটি বেলে সেঁকে নিতে ৪৫ মিনিট লাগে আমার। অ্যান্ড সি আমার কাজ শেষের দিকে৷
— খুব সময় মেপে কাজ করা হয় মনে হয়!
খোঁচা মেরে বলল ও। বুঝলাম আজ ঝগড়া করার জন্য মুখ চুলকচ্ছে । কিন্তু আমার ঝগড়া করার কোনো মুড নেই। তাই পাল্টা জবাব না দিয়ে চুপচাপ রুটি সেঁকায় মন দিলাম। ওদিকে
সুবিধা করতে না পেরে ক্ষেপে গেল সে। কাউন্টারের ওপর একটা মেলা মাইনের কাপ পড়ে ছিল হাতে নিয়ে সজোরে আছড়ে ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো,
— মহারানী ভিক্টোরিয়া হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। একশো কথায় একটার জবাব দেয়। এরপর এসো আমার সাথে কথা বলতে আমিও জবাব দিব না।
এতটুকু বলে গটগট করে বেরিয়ে গেল সে। বেরোতে বেরোতে কি মনে করে ফিরে এসে অদ্ভুতভাবে আমার মুখের ওপর ফু দিয়ে আবারও চলে গেল।
আমি হতভম্ব হয়ে তার গমন পথে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। আমি মহারানী ভিক্টোরিয়া না হলেও সে তো ঠিকই ডালিম কুমার৷ তো ডালিম কুমারের যত রাগ-পাগলামো আমার সাথেই কেন?
_____________
৬৮.
ইঊশা এখন তার ফুপির বাড়িতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে নিয়ম করে এ বাড়িতেও আসে। আপাকে আজ ডাক্তার দেখাতে নিতে হবে এজন্য গতকাল ইঊশাকে নিয়ে আসা হয়েছে। তার আবার খাওয়াদাওয়ায় অনেক বাছবিচার। সে রুটি খায় না পরোটা খায় তাও আবার মাখন দিয়ে। সাথে ডিম নয় মিষ্টি কিছু রাখা চাই। ইনতিসারের কড়া নির্দেশ ইঊশা যা খেতে চাইবে তাই হবে বাড়িতে। খাওয়ার কষ্ট যেন ও না পায়। আমিও ওর কথা মতোই কাজ করি। কিন্তু আজ সম্ভব হয়নি। না জানে আবার রেগে যায় কি না! ও ইঊশার ব্যাপারে একটু বেশিই সেন্সিটিভ৷
খাবারগুলো নিয়ে মাত্র টেবিলের ওপর রেখেছি অমনি ইঊশা চেয়ার থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আদুরে স্বরে বলল,
— মিসড ইউ ছোটমা।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। পাহাড় সমান বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
— কি বলে ডাকলে তুমি আমাকে?
ও মুখ তুলে চাইলো। মিষ্টি হেসে বলল,
— কেন ছোটমা। তুমি তো আমার ছোটমা হও। হও না?
— তোমাকে কে শিখিয়েছে এই সম্বোধন?
বিস্ময়ভাব বজায় রেখেই বললাম আমি।
ও কনফিউজড হয়ে সরে গেল। ভ্রু কুঁচকে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
— কেন ইনতিসার বাবা। বাবা বলেছে তোমার আর ওঁর বিয়ে হবে কদিন পর। তখন তো ছোটমা বলে ডাকতেই হবে৷ এখন থেকে যেন প্র্যাকটিস করে নিই৷
— কিহ্ ইনতিসার বলেছে এই কথা? আর তুমি ওকে বাবা ডাকছো কবে থেকে?
— তুমি আসার আগে তো বাবা বলেই ডাকতাম৷ মাঝখানে চাচ্চু বলেছি এখন আবার বাবা বলছি। বাবাই আমাকে বাবা বলে ডাকতে বলেছে।

স্বাভাবিক গলায় বলল ইঊশা। তন্মধ্যে ইনতিসার এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে। ওকে দেখে ইঊশা উঠে গিয়ে হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
— ইনতিসার বাবা তুমি বলোনি তোমাকে বাবা আর খালামনিকে ছোটমা বলে ডাকতে? বলো?
ইনতিসার শুকনো বিষম খেয়ে আমার দিকে আঁড় চোখে তাকালো। তারপর মুখ ফিরিয়ে রাশভারী গলায় বলে উঠল,
–খালা তো মায়েরই রূপ আর চাচ্চু বাবার৷ তো চাচাকে বাবা আর খালাকে মা ডাকতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা তো নেই। তবে কারো যদি এই সম্বোধন পছন্দ হয় নেবে,না হলে নেবে না সরাসরি বলে দেবে।
আমি ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। কোমরে হাত রেখে বললাম,
— সম্বোধনে আমার সমস্যা নেই। সমস্যা হলো আপনি নাকি বলেছেন আমার আর আপনার কিছুদিন পর বিয়ে? এত বড় ডাহা মিথ্যেটা আপনি এতটুকু বাচ্চাকে বলতে পারলেন?
— বিয়ে! কাকে বললাম আমি বিয়ের কথা?
ভীষণ অবাক হয়ে তাকালো ও।
— আপনিই তো বলেছেন বিয়ের কথা ইঊশা কে।
— আমার মাথা খারাপ ওর সামনে আমি এসব কথা বলে বেড়াবো? আর ইউ ম্যাড!
কিরে ইঊশা আমি তোকে বলেছি এরকম আজেবাজে কথা?
ইউশা বিভ্রান্ত হয়ে মাথা নাড়লো,
— বললে না ওইদিন?
— চুপ ব্যাটা মিথ্যে কথা শিখেছিস এই বয়স থেকে। ইশির বাড়িতে গিয়ে এরকম হয়েছে না? ইশিটা তো শ্রেষ্ঠ মিথ্যেবাদী। প্রত্যেকটা কথায় ওর মিথ্যে জড়ানো। তোকেও এখন ধরে ধরে মিথ্যে শেখাচ্ছে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলতে লাগল ইনতিসার। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না কথা কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছে! নিশ্চয়ই ভদ্রলোক কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছে। অপরাধ করে কথা ঘোরানো! দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলবো আমি ঐ মুহুর্তে সে আমার দিকে আঙুল তুলে বলল,
— শোনো গাধা নীরদ। তোমার মতো গাধা সবাইকে ভেবো না। যে যা বলছে তাই বিশ্বাস করে নেবে নাকি? আর আমার কিসের দায় পড়েছে বানিয়ে বানিয়ে তোমাকে বিয়ে করব এমন কথা বলার। সন্ন্যাস ধর্ম পালন করছো তুমি করো। আমার তো এমন সন্ন্যাসী বউ চাই না। আমার জন্য অন্যকেউ অপেক্ষা করে আছে। সে তোমার মতো এমন খটখটে না। প্রেমে টইটুম্বুর। তার হৃদয়ে অসীম প্রেম। সে তো আমি বলতে পাগল। আর আমার অমন আমি পাগল বউটাকে চাই। বিয়ে হলে আমার একমাত্র ওর সাথেই হবে অন্যকারোর সাথে না। বুঝলে?
মুখ ফিরিয়ে খেতে বসে গেল সে। ইঊশাকেও ধমকে খাওয়াতে লাগল।
আমি চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর জন্য অন্যকেউ অপেক্ষা করে আছে? কে সে?
বানিয়ে বলল নাকি কথায় কথায় সত্যি বেরিয়ে পড়েছে!
তড়িৎ উল্টোপাল্টা কিছু প্রশ্ন আনাগোনা করতে শুরু করলো মনে। বুকের ভেতর বোধহয় ভাঙচুরও শুরু হলো সাথে। এসব ভাঙচুরের থেকে মুক্তি পেতেই কিছু না বলে আপার ঘরের দিকে চলে গেলাম আমি। আপা বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিল৷ আমায় দেখে মিষ্টি করে হাসলো৷ আমি গুটিগুটি পায়ে গিয়ে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম৷
আপা সস্নেহে আমার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় শুধলো,
— কি হয়েছে নীরদ? শরীর খারাপ?
আমি মাথা নেড়ে আপার কোমর জড়িয়ে ধরলাম৷ ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম,
— দিকভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি আপা। লড়াই করতে করতে ইদানীং ক্লান্ত লাগে খুব।
— কখনো কখনো মনের কথাও শুনতে হয় নীরদ। সবসময় ওকে শক্ত আঁটুনিতে আটকাতে চাইলে হয় না৷ মনের মধ্যে একটু একটু করে জমতে থাকা অনুভূতিগুলো কখনো বাঁধনমুক্ত হতে চায়। সেই মুক্তি টুকু ওদের প্রাপ্য।
— আমার মনটাই যেন দুই সত্তা হয়ে গেছে আপা।
বলতে বলতে আরেকটু আঁকড়ে ধরলাম আমি আপাকে।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আপা উদাস কণ্ঠে বলল,
— আর যাই কর সময়কে অবহেলা করিস না নীরদ। আজও একজন তোর পথ চেয়ে বসে আছে। সে চাইছে তোর একটা পদক্ষেপ। তুই শুধু একধাপ এগিয়ে তার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা আঁকড়ে ধরবি। তারপর দেখিস তোর হয়ে সে পুরো পৃথিবীর সাথে লড়ে যাবে। আর যেন দেরি করিস না৷ ভেতরে চলতে থাকা অন্তর্দন্দকে প্রস্থানের পথ তোর নিজেরই দেখাতে হবে। বুঝলি?
আপার কথা শুনতে শুনতে অবচেতন মনটা একা একাই বলে উঠল,
“সময় গিয়ে আজ তার দিকে হাত বাড়াতে বলছো আপা। ইতোমধ্যে অনেক তিক্ত স্মৃতি যে জমা হয়ে গেছে। এই অনুমতিটা আগে দিলে জীবনের গতিপথ হয়তোবা এমন কঙ্কর মিশ্রিত হতো না”

সকালটা একরকম কাটার পর বেলা বাড়লে আপাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম আমরা৷ ওখানেই বিকেল পার৷ সন্ধ্যেতে আমাদের বাসায় নামিয়ে ইনতিসার গেল আপার জন্য ঔষধ আনতে। আমি জোর করে ইঊশাকেও পাঠিয়ে দিলাম ওর সাথ৷ বাইরে গেলে মনটা ভালো হবে৷
ওদের বিদায় দিয়ে আমি ফিরছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঠিক সেদিনের মতো প্রিমার সাথে দেখা হয়ে গেল। আজ আমাদেরই ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল প্রিমা। ওকে দেখে আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। চটজলদি নিজেকে স্বাভাবিক করে সহাস্যে জিজ্ঞেস করলাম,
— তুমি? এতদিন পর?
সবেগে প্রিমা মাথা নেড়ে ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরলো। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম ও যেন একটুখানি কাঁপছে। ওর হাতের তালু ঘেমে একাকার৷ আমি কোনো প্রশ্ন করবো তার আগেই ও গলা খাদে নামিয়ে যথাসম্ভব ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— নীরদ আজ আমি একটা কনফেশনের জন্য এসেছি৷ আমার এই কনফেশনটা শুধু তোমার সামনেই৷ তুমি জানতে চেয়েছিলে না ইনতিসার ভাইয়ের প্রতি আমার কোনো অনুভূতি আছে কি না? হ্যাঁ আছে। অ্যাকচুয়ালি আই অ্যাম ইন লাভ উইথ হিম৷ আর সব মেয়ের মতোই আমিও তাকে প্রথম দেখায় পছন্দ করে ফেলি। শুরুতে নরমাল ক্রাশ ভেবেছিলাম কিন্তু সময় যাওয়ার সাথে সাথে উপলব্ধি করছি এটা শুধুমাত্র পছন্দ নয়। এর চাইতে বেশি কিছু।
বলতে বলতে আমায় জড়িয়ে ধরলো প্রিমা। ওর শরীরের কাঁপুনি যে বেড়ে গেছে স্পষ্ট টের পেলাম আমি। ও যেন আমাকে নিয়েই কাঁপছে।
এদিকে আমার বাকশক্তিও কোথায় হারিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কেউ শক্ত করে আমার গলাটা চেপে ধরে কথা বলা থামিয়ে দিয়েছে।
মিনিটখানেক আমার গলা জড়িয়ে থেকে প্রিমাই বলে উঠল,
— আমি জানি না এই সিক্রেটটা কেন আজ তোমার সামনে এক্সপোজ করে দিলাম। কিন্তু এখন আমার ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে কাঁটার মতো কিছু একটা বহুদিন থেকে গলার কাছে বিঁধে ছিল। আজ এতদিন পর তা সরে গেল। একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা থেকে আমার মুক্তি মিলল।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলাম। মনের শঙ্কা লুকিয়ে শুধলাম,
— এত যে ভালোবাস কখনো জানিয়েছ তাকে?
লজ্জায় রক্তিম হয়ে মাথা নীচু করে ফেলল প্রিমা। দু’পাশে মাথা নেড়ে বোঝালো জানায়নি।
— তো জানাতে হবে না?
— কীভাবে জানাব? যদি রেগে যায়? বাড়ি ছেড়ে চলে যায়! ভয় করে আমার।
— ভালোবাসলে ভয় কিসের পাগল? ভালোবাসা তো ভয়কে জয় করতে শেখায়৷
— আমি তো জানি না ভালোবাসা কীভাবে প্রকাশ করতে হয়। তুমি আমাকে হেল্প করবে নীরদ?
কাতর হয়ে বলল প্রিমা।
আমার ভেতরের প্রণয়িনী সত্তা চিৎকার করে বলে উঠতে চাইলো,
— না হেল্প করবো না। পাগল মেয়ে তুমি যাকে ভালোবেসে কাছে পেতে চাইছো সে বহু বছর আগে থেকেই আমার। সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে তাকে কেবল আমার জন্য লিখে দেয়া হয়েছে। তার জন্ম হয়েছে কেবল নীরদের আকাশে ভালোবাসার রংধনু এঁকে দেয়ার জন্য। অন্য কারোর আকাশে নয়। সে কেবল আমার;এই নীরদের একার।
কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও মনের কথা মনেই রয়ে গেল;বাইরে প্রকাশ পেল না। প্রিমার কাঁধে ভরসার হাত রেখে আমি বললাম,
— করবো অবশ্যই করবো।
— সত্যি?
আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রিমা আবারও জড়িয়ে ধরলো আমাকে।
আর আমি? আরও একবার আপন লড়াইয়ে নিজেকে হেরে যেতে দেখলাম।
চলবে,

Sinin Tasnim Sara

ভালোবাসার রংধনু
৩৬
_____________
৬৯.
প্রিমা রোজ একবার করে বাড়ি আসছে আমাদের সাথে সময় কাটাতে। যদিওবা আমাদের সাথে সময় কাটানো ওর মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, ও আসলে ইনতিসারের সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টায় এবাড়ি আসছে আমি বেশ বুঝতে পারি। আমার কাছে আবার ইনতিসারের পছন্দ-অপছন্দের কথা জিজ্ঞেস করে। আমি সোজা কথায় বলে দিই ওর সম্পর্কে জানি না৷ আসলে আমার খুব ঈর্ষা হয়। ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাই আমি। একবার করে মনে হয় প্রিমাকেও উসকেছি আমি। এখন যে সাফারিংটা হচ্ছে তার দায়ভার আমার৷ আরেকবার করে মনে হয় প্রিমাই ঠিক ইনতিসারের জন্যে। ওকে, এই সংসারকে ভালোবেসে আগলে রাখার মতো মেয়ে প্রিমা৷ ইনতিসার যেমনটা চায় ওরকম হতে পারবে মেয়েটা। বর পাগল।
আমার আর ইনতিসারের মিলন হওয়ার নয়। একটা সময় যখন ও আমাকে চেয়েছে তখন আমার মন ওকে চায়নি। মাঝখানে আমার জীবনে অন্যকেউ এসেছিল। আমাদের অতীতের স্মৃতিগুলোও সুখকর নয় । আমরা যদি এক হয়েও যাই তাহলে তিক্ত স্মৃতিগুলো হয়তো আরও বেশি তাড়া করে বেড়াবে আমাদের। মাউইমার চলে যাওয়া, ওদের আজকের পরিণতি সব তো আমার জন্যই। না আমি ওদের জীবনে আসতাম, না আমায় ও ভালোবাসত;আর না আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। কখনো এসব মনে করে ও যদি আমায় ঘৃণা করতে শুরু করে তখন আমি সইতে পারবো না। এরচেয়ে ভালো মুভ অন করুক ও। আমি কেবল ওকে সুখী দেখতে চাই। দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্ম আমার। আমার সাথে যেই জড়ায় তার জীবনেই দুর্ভাগ্য নেমে আসে। অনেকটা সয়েছে ইনতিসার। আর নয়।
— কি ভাবছিস বল তো বসে বসে? দু’বার ডাকলাম শুনলি না।
আপার মৃদু ধাক্কায় খেয়ালের সুতো কাটলো আমার৷ মাথা নেড়ে বললাম,
— হু। ও কিছু না।
— কিছু না কি? ইদানিং মন কই থাকে তোর? যখনই দেখি উদাস হয়ে কিছু ভাবিস। কি ভাবিস আমাকেও একটু বল।
— কিচ্ছু ভাবি না আপা। মিছেমিছি চিন্তা করছো তুমি।
— তোকে কিন্তু আমার সুবিধের লাগছে না এখন৷ বাড়িওয়ালার মেয়েটা প্রতিদিন আমাদের বাড়ি আসে কেন? ওর মতলব কি?
— মতলব আবার কেমন শুব্দ! ও এমনিতেই আসে আমাদের সাথে গল্প করতে।
— আমি বিছানায় পড়ে থাকি বলে কি আমার চোখ,কানও বন্ধ ভাবিস? ও ইনতিসারের জন্য এ বাড়িতে আসে তাই না?
প্রতুত্তরে আমি চুপচাপ আপার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আপা আমার হাত ধরে ঝাকালো আবার।
— কি রে বল?
একটু দম নিয়ে আমি বললাম,
— হ্যাঁ।
— আর ওকে এতখানি সাহস তুই দিয়েছিস?
কঠোর চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো আপা। আমি মাথা নীচু করে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলাম।
এতেই আপা ভীষণ রেগে সপাটে চড় মেরে বসলো আমার গালে। বাহু চেপে ধরে রাগে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— নিজের কপাল নিজেই কেন বারবার পোড়াস? যে সুখ যেচে পড়ে আসতে চাইছে তোর কাছে তাকে বারবার ঠেলে দিচ্ছিস কেন পায়ে?
— আপা শান্ত হও। তোমার শরীর ভালো নেই। এভাবে চেঁচামেচি করবে না।
এগিয়ে গিয়ে আপাকে শান্ত করতে চাইলাম আমি। কিন্তু ও ঝটকা মেরে আমার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
— খবরদার ছুঁবি না তুই আমাকে। এত স্বার্থপর হয়েছিস তুই? তোর কাছে কারো কথার মূল্য নেই? না শয্যাশায়ী বোনের, না আর কারোর! তোর কাছে তোর ইগোটাই বড়?
আপার কথাগুলো সূঁচালো ফলার মতো ভেতরে ঢুকে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করলো৷ আমি হাজার চেষ্টা করেও কেন যেন নিজেকে সামলাতে পারলাম না।
উঠে দাঁড়িয়ে রাগের বশেই বলে ফেললাম,
— স্বার্থপরের মতো কে আচরণ করছে আপা আমি নাকি তুমি? যখন সময় ছিল তখন তো আমার জন্য এভাবে লড়াই করোনি। যখন সময় ছিল তখন তো আমায় বলোনি ইনতিসারের ডাকে সাঁড়া দে। তখন নিজের সবটা দিয়ে আমাকে আটকেছ। ঐ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ প্রত্যেকটা সেকেন্ড উঠতে বসতে আমায় মনে করিয়ে দিয়েছে আমি ওই বাড়ির আশ্রিতা। তুমি নিজেও একটা সুযোগ ছাড়নি আমায় সেটা উপলব্ধি করানোর। আপা একদিন তুমিই কিন্তু আমার হৃদয়ে ইনতিসারের প্রতি ভালোবাসার বীজটা অঙ্কুরিত হবার আগে বিনষ্ট করে দিয়েছিলে। তারপর অনেকটা সময় গড়িয়ে গেল। আজও কি অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছে? তখনও আমি একটা হেল্পলেস মেয়ে ছিলাম যার মাথা গোঁজবার ঠাঁই ছিল না এবং আজও আমি একটা ব্লাডি হেল্পলেস মেয়ে যার মাথা গোঁজবার কোনো ঠাঁই নেই। তখন যে ভয়ে তুমি আমায় ইনতিসারের দিকে এগোতে দাওনি আজ সে ভয় কোথায় চলে গেল? সেদিনের আর আজকের পরিস্থিতির মধ্যে ভিন্নতা কোথায়? সেদিন যেমন ইনতিসারের ডাকে সাঁড়া দিলে লোকে আমায় লোভী, দুশ্চরিত্রা মেয়ে বলতো;আজও বলবে। সেদিনেরটা অনুচিত হলে আজকেরটা অনুচিত নয় কেন?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি আবারও বললাম,
— চারটা বছর কিন্তু কম সময় নয় আপা। ভাগ্যের পরিহাসে আজকে ইনতিসারদের যে অবস্থা তার জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী আমি। তুমি গ্যারান্টি দিতে পারো ভবিষ্যতে সংসার জীবনে ওর কখনো রিগ্রেট হবে না আমাকে বিয়ে করে। আমার প্রতি কখনো ঘৃণা জন্মাবে না ওর। ভীষণ ভালোবাসার পর যদি ঘৃণার আঁচ ঢুকে যায় সম্পর্কের ভেতর সে সম্পর্কটা আর টেকে না আপা। আমার ভাগ্যে সুখ জিনিসটা লেখা নেই। তাহলে বৃথা এ জীবনে আরেকজনকে জড়ানো কেন? ইনতিসারেরও প্রয়োজন মুভ অন করা৷ ওর তো সুখী হওয়ার অধিকার আছে।
বলতে বলতে আমি আবারও বসে পড়লাম আপার পাশে। আপা চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁদছেও না৷ কতটা সময় তাকিয়ে থেকে আমার হাতটা টেনে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়। ক্ষীণ গলায় বলল,
— নিজেকে অপরাধী ভাবিস কেন বাবু? তোর কোনোই অপরাধ নেই এখানে। ইনতিসারদের এরকম অবস্থার জন্য তুই মোটেই দায়ী নোস। অপরাধ যদি কেউ করে থাকে তাহলে সেটা আমি করেছি। আমার প্রথম অপরাধ তোকে তখন থেকেই ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে না শেখানো৷ দ্বিতীয় অপরাধ তুই বারবার ঐ বাড়িটা থেকে চলে যেতে চাইতি সেসময়গুলোতে তোর কথা না শুনে জোর করে আটকে রাখা আর তৃতীয় অপরাধ আব্বার লিখে দেয়া সম্পত্তিগুলো বিক্রি করে সব টাকা এহতেশামের হাতে তুলে দেয়া। সেদিন যদি আমি একটু সাহসের পরিচয় দেখাতাম তাহলে বোধহয় এতসব হতো না। আসলে একটা সময় মানুষকে কিছুটা ছাড়ও দিতে হয়। পৃথিবীটাকে জানতে, বুঝতে দিতে হয়। নইলে পারিপার্শ্বিকতার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। তোকে বেঁধে রাখতে রাখতে বোধহয় নিজ হাতে তোকে পঙ্গুত্ব দিয়েছিলাম তাই আজ এ অবস্থা!
কথা বলার এক পর্যায়ে চোখ উপচে পানি পড়তে শুরু করলো আপার। ওর চোখের পানি দেখে আমার মনে অপরাধবোধ জাগলো। এতগুলো কড়া কথা শোনানো উচিৎ হয়নি আমার। এতদিন সামলাতে পেরেছি নিজেকে কিন্তু আজ কি হলো? এভাবে বেসামাল হয়ে গেলাম।
আপা আবারও বলল,
— আমার যে তোকে নিয়ে এখনও ভয় হয়। পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিলি। আমার হাতেও তো বেশিদিন সময় নেই। আমি চলে যাওয়ার পর তোর কি হবে? তোকে থিতু হতে দেখলে…
কথা সম্পূর্ণ করলো না আপা।
আমার নিজেকে আরও ছোটো লাগতে লাগল। মাথা নীচু করে অনুতপ্ত হয়ে বললাম,
— আমাকে মাফ করে দাও আপা। রাগের মাথায় ভুলভাল বকে ফেলেছি। কেন সে সামলাতে পারলাম না রাগটা! অপরাধী তো আমিও। যখন ফাইনালি কিছু করে দেখানোর সময় এলো তখনও তো পারলাম না। মিথ্যে আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে আজ এই অবস্থা হলো।
— নাহ্ না তুই নিজেকে দোষারোপ করবি না। আমি আর জোর করবো না তোকে। তবে কিছু তো সিদ্ধান্ত নে জীবন নিয়ে। আমার পর কোথায় যাবি?

এই প্রশ্নের উত্তরটা আমার কাছেও নেই। ওর পর কোথায় যাব? ইঊশার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলাম সেটাইবা কীভাবে নেব। এতসব ভাবতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায় আমার। তখন ইনতিসারের নাম মনে পড়ে। কিন্তু ও কি আমার সাথে সুখী হতে পারবে? লোভীদের মতো অসহায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছি না তো আমি?
কোনোকিছু করেই ভাবনার তল খুঁজে পাই না । এভাবে কেটে যায় আরও কিছুটা সময়। এর মাঝে প্রিমার আচরণে ইনতিসার আঁচ করে কিছু একটা৷ একদিন অফিস থেকে ফিরে আমার ঘরে আসে। ভ্রু কুঁচকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— প্রিমা মেয়েটা একটু বেশিই ফ্রী হয়ে গেছে তোমার সাথে মনে হচ্ছে। সারাদিন দেখছি এ বাড়িতেই পড়ে থাকে। ঘটনা কি?
ওর সূঁচালো দৃষ্টি আমার ওপর পড়ার পর নিজেকে চোর চোর মনে হতে লাগে আমার। আমি সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারি না৷ অন্যদিকে তাকিয়ে বলি,
— ঘটনা আবার কি? আমি সারাদিন একা একা থাকি তাই ও আসে।
— তাই কি?
— তাছাড়া আর কি? আজব৷
— তোমার চোখের ভাষা আর মুখের ভাষা তো এক লাগছে না আমার। মাতব্বরি করে কিছু করার চেষ্টা করছো মনে হয়।
— কিসের মাতব্বরি! কিসব আবোলতাবোল বলছেন বলুন তো?
— শোনো নীরদ। নিজেকে যত চালাক ভাবো ততটা চালাক কিন্তু তুমি নও। সাবধানে হ্যাঁ। আমার সাথে এসব নয়। নিজেকে পরিবর্তন করেছি বলে ভেবো না আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারব না। তুমি আমার সাথে যেরকম যেরকম আচরণ করবে আমার থেকে ফিডব্যাকও সেরকমই পাবে৷ উল্টোপাল্টা কিছু করার আগে মাথায় রাখবে এই ইনতিসার একবার যা চেয়েছে তা যেকোনোভাবে হোক আদায় করে ছেড়েছে৷ আমি আপোষে তোমাকে চাইছি, তুমি ছিনিয়ে নিতে বাধ্য করবে না। অনেক হয়েছে লুকোচুরি। আজ সরাসরি বলে দিলাম। আমি ইনতিসার কেবল একজনকে আপন করার পণ করেছি সে হলো নীরদ। এবং আমি যা পণ করি তা সম্পূর্ণ করেই ছাড়ি। মানুষের জীবন নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা নয়। ঠাট্টা-তামাশায় অনেকটা সময় কাটলো৷ আমাদের মধ্যে অন্যকাউকে জড়ানোর চেষ্টা করবে না। ভালোবাসি বলে সব অপরাধ মাফ এমনটা কিন্তু নয়। ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম তোমাকে।
আমাকে একটা কথার সুযোগ না দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল ইনতিসার৷ আমার কানে ইনতিসারের বলে যাওয়া কথাগুলো বাজতে লাগল৷ ভালোবাসার কনফেশন অনেক আগে থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু তা এতটা তীব্রভাবে আমার মনটাকে কখনো ছুঁয়ে যায়নি যতটা আজ ছুঁলো। এর কারণ কি আমিও মানুষটাকে ভালোবাসি বলে? একটুখানি মিঠেল ফাগুন হাওয়া যেন বয়ে গেল আমার সারা শরীর জুড়ে। ঠিক ঐ মুহুর্তে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলাম। সমস্ত দ্বিধা দূর করে ভেতরের প্রণয়িনী সত্তাকে জিতিয়ে দিলাম। আমি সাঁড়া দেব ইনতিসারের ডাকে। ওকে ভালোবাসতে গিয়ে যদি খারাপ কোনো তকমা লেগেও যায় তাহলেও আমার সমস্যা নেই। আমার কেবল ওকে পেলেই চলবে। ব্যাস৷
______
৭০.
মানুষের পরিকল্পনা তো অনেকরকমই হয়ে থাকে। কিন্তু সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে দেখা যায় কত সমস্যার সাথে লড়তে হচ্ছে। আমি যখনই নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে যাই তখনি আমার অতীতে করে আসা কোনো ভুল মাশুল গোনাতে ফিরে আসে। ইনতিসারের ওয়ার্নিংয়ের আগেই যে আমি আমাদের মধ্যে প্রিমাকে ঢুকিয়ে ফেলেছি এটা তো নিজেও উপলব্ধি করতে পারছিলাম। তবে এটা উপলব্ধি করিনি একটা বাচ্চা মেয়েকে এসবের মধ্যে ঢোকালে ওর ওপর একটা খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। উপলব্ধি হলো একদম শেষে গিয়ে। প্রিমা তো জানাতেও চায়নি ইনতিসারকে ওর মনের কথা। কিন্তু আমি যখন ওকে ভরসা দিলাম তখন সেও প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল সব রকমের৷ এবং সময় সুযোগ করে একদিন তার মনের ঝাঁপিটা খুলে বসলো ইনতিসারের সামনে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ইনতিসার তাকে প্রত্যাখ্যান করলো৷ প্রিমা অভিমানী মেয়ে। প্রথমবার ভালোবেসে হৃদয় ভাঙার কষ্টটা সে সইতে পারলো না। আমার কাছেও এলো না তার কষ্টের কথা বলতে। কেন আসবে? তার এতবড় কষ্টের পেছনে বরাবর আমারও হাত রয়েছে। আমি ভয় পেলাম মেয়েটা উল্টোপাল্টা কিছু করে না ফেলে৷ যেতে চাইলাম ওর কাছে। কিন্তু ইনতিসার আমাকে আটকে ফেললো৷ বলল ওকে একটু সময় দাও নিজেকে স্বাভাবিক করার।
আমি সময় দিতে চাইলেও ও আমাদের সময় দিলো না ক্ষমা চাইবার।
একদিন রাত দেড়টা কি দুটো কান্নাকাটি আর চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। কান্নার উৎস আমাদেরই সদর দরজা বুঝতে পেরে আঁতকে উঠলাম আমি। বেরুতে বেরুতে দেখি ইনতিসার গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। বেশিকিছু বুঝতে পারলাম না তবে কান্নাকাটি যে করছে তাকে দেখতে পেলাম। প্রিমার মা। ওনাকে দেখেই ভয়ে জমে গেলাম এক জায়গায়। ইনতিসারকে কিছু বলা মাত্রই ও ছুটে গেল ওনার পিছুপিছু। আমি মূর্তির মতো ওখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অজানা আশংকায় আমার বুক শুধু কাঁপতে লাগল। সেই মুহুর্তে আর কিছু জানা হলো না। চুপচাপ ইনতিসারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ইনতিসার ফিরলো ফজরের আজানের একটু পর। ক্লান্ত অবসন্ন ওকে দেখে ছুটে গেলাম আমি। ভয়ার্ত গলায় জানতে চাইলাম,
— কি হয়েছে?
ও শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
— কি আর হবে! সুই/সাইড অ্যাটেম্প্ট করেছে প্রিমা৷ বারবার বলেছিলাম তোমাকে আমাদের মধ্যে কাউকে ঢুকিও না৷ দেখলে তো কি হলো? বারবার যে কেন নিজের বিপদ নিজে টেনে নাও বুঝি না৷
চমকে দু পা পিছিয়ে গেলাম আমি। কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলাম,
— বেঁচে আছে তো?
আমায় কাঁপতে দেখে ইনতিসার এগিয়ে এলো। দু হাতে আমায় আগলে নিয়ে বলল,
— আছে। ওর মায়ের এক পাতা প্রেশারের ঔষধ খেয়ে ফেলেছিল। ভাগ্যিস বেশি দেরি হয়ে যায়নি। হসপিটালে নেওয়ার পর ওয়াশ করে দিয়েছে। এখন ঘুমের মেডিসিন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হচ্ছে।
— ও আমাকে কখনো মাফ করতে পারবে না তাই না?
কাতর চোখে চাইলাম আমি ইনতিসারের পানে৷ ও আমার গালে হাত বুলিয়ে বলল,
— ও তো তোমার ব্যাপারে জানেই না।
ও যখন আমায় প্রপোজ করলো তখন খুব ভালো ভাবেই বুঝিয়ে বলেছিলাম ওর আর আমার বয়সের ব্যবধান, ফ্যামিলির অবস্থা এসবের জন্য সম্ভব নয়। তাছাড়াও আমি অন্য কারো সাথে কমিটেড৷ মানুষটা যে তুমি সেটা অবশ্য বলিনি। ওর বুঝতে পারার কথাও নয়। মেয়েটা যে এরকম একটা স্টেপ নিয়ে নেবে আমি ভাবতেও পারিনি। তবে তোমার ওকে সাপোর্ট করা উচিৎ হয়নি। তুমিও একাংশে অপরাধী।
— এখন তাহলে আমি কি করবো ইনতিসার?
— কি করবে তা তো এখন বলা যাচ্ছে না। সকাল হোক। দেখা যাক জল কতদূর গড়ায়। তারপরেই সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
আমি ইনতিসারকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম। যেন লুকিয়ে পড়ছি ওর বুকে। অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
— খুব ভয় করছে আমার।
ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
— ডোন্ট ওয়ারি। আ’ম হিয়ার ফর ইউ। আমি সব সামলে নেব সোনা। ডোন্ট ওয়ারি।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here