ভালোবাসার রংধনু শেষ পর্ব

0
1940

ভালোবাসার রংধনু
শেষ পর্ব
__________

৮১.
মার্চের মাঝামাঝি কোনো এক সময়৷ নিউক্যাসলে বসন্তের আগমন ঘটেছে। ঝরাপাতার শোক শেষে প্রকৃতি এক নবরূপ ধারণ করেছে। পথের ধারে শুকনো মড়মড়ে ডালগুলো ভরে উঠেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতার কুঁড়িতে। কোনো কোনো গাছে পাতা গজানোর আগেই ফুল ফুটে একাকার। বসন্তের অগ্রদূত নামে পরিচিত চেরি ব্লসমও মাথা চাড়া দিয়ে তার আগমন জানান দিচ্ছে। যেদিকেই চোখ যায় গাছে গাছে স্নিগ্ধ গোলাপি অথবা সাদা চেরির শোভা৷ যেন গাছের ডালে মেঘের পাগড়ি৷ মৃদু বাতাস দোলা দিলেই কি সুন্দর করে ওরা ঝরে পড়ে। মনে হয় ফুল নয় একগুচ্ছ তারা খসছে। আমি যে বাসাটায় থাকি তার সামনে একটা প্রকাণ্ড সাদা চেরি গাছ আছে। মাঝেমধ্যে চুপচাপ ঐ গাছটার নীচে গিয়ে বসে থাকি। কি অমোঘ টানে ও বারবার আমায় কাছে টানে । ছুঁতে পারবো না জেনেও অযথা ফুটে থাকা চেরিগুলোর দিকে হাত বাড়াই। কখনো সখনো বাতাস দোলা দিয়ে গেলে দু একটা পাপড়ি এসে হাতে পড়ে। অতটুকুতেই আনন্দ হয়।
আজ আমার পরীক্ষা শেষ হলো। পরদিন ফ্লাইট। অন্যান্য দিনের মতো বাইরে থেকে ফিরে চেরি গাছটার নীচে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তখন মাত্র সন্ধ্যে নেমেছে। একদৃষ্টিতে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে স্বভাবসুলভ হাতটা বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। প্রকৃতিতে মৃদু হাওয়া উঠল। সাথেসাথে বৃন্ত থেকে একঝাঁক ফুল খসে পড়ল হাতে। কখনো এমন ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল পড়ে না। আজ পড়ল। তবে সাদরে বিদায় জানালো ও আমাকে। ফুলগুলো হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে মুচকি হেসে ভেতরে চলে গেলাম। রাতটা কাটল ভীষণ এক্সাইটমেন্টে। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল ল্যান্ড করেই ইনতিসারের মুখটা দেখব। যদিওবা ভাবনাটা পুরোটাই অমূলক;কারণ ও জানে না আমি ফিরছি। তবুও মনটা তীব্রভাবে বলছিল, নাহ্ ও থাকবে;অবশ্যই থাকবে।
একা একা যাব শুনে বন্ধুরা খুব মন খারাপ করল। ওরাও ফিরতো কয়েকদিন পরেই। কিন্তু আমার যে তর সইছিল না। ওদেরও তো পার্টনার আছে, ওরা বোঝে। তাই শত মন খারাপ সত্ত্বেও এয়ারপোর্টে সি অফ করতে ঠিকই এলো। সবার সাথে বিদায় পর্ব শেষে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে ফাইনালি আমি রওয়ানা হলাম দেশের উদ্দেশ্যে। আবারও সেই ঊনিশ ঘণ্টার খণ্ড জার্নি। জার্নিতে এবার সমস্যা নেই। আমার শুধু যেকোনোভাবে মানুষটাকে দেখা চাই।
সমস্যা নেই মন জানে কিন্তু শরীর কি আর পারমিট করে? ঠিকই ও ক্লান্ত হয়ে পড়ল।ইমিগ্রেশন শেষে লাগেজ কালেক্ট করে ক্লান্ত পায়ে একটু একটু করে এগোচ্ছিলাম বাইরের দিকে। এয়ারপোর্টের বাইরেটা মানুষে গমগম করছিল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তুহিন ভাইকে খুঁজছিলাম আমি। ওনার আমাকে রিসিভ করতে আসার কথা। ইতিউতি তাকিয়ে ওনাকে খুঁজতে খুঁজতে আচমকা একটা জায়গায় চোখ স্থির হয়ে গেল। আমার থেকে অল্পহাত দূরে হাত ভাঁজ করে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো চিরচেনা এক মুখ। চোখ ছলছল করে উঠল আমার। এ ভাবনাটাও তবে ঠিক ছিল! এসেই তার মুখটা দেখলাম। ওদিকে তার ধারালো দৃষ্টি আমাতে নিবন্ধ। ঠোঁটের কোণে হাসির লেশ মাত্র নেই। তীর্যক দৃষ্টিটা যেন ব্যঙ্গাত্বক সুরে বলছে, “সইলো না তো। অবশেষে ফিরতেই হলো।”
সত্যি সইলো না আর। শরীরের ক্লান্তি মনে স্থানান্তর করল। এরপর বিন্দুমাত্র নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করে সকল লাজলজ্জা ভুলে এই ভরা লোকসমাগমে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে শক্ত করে। কে কি ভাবছে ভাবুক ওটা দেখার বিষয় না। এতদিন বাদে আমার মানুষটাকে আমি পেয়েছি। পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা তার সামনে না এনে দেয়া পর্যন্ত শান্তি নেই আমার।
ইনতিসার বোধহয় অবাক হয়েছে। কিছুক্ষণ প্রতিক্রিয়াহীন দাঁড়িয়ে রইল৷ এরপর নিজেকে ধাতস্থ করে পাল্টা আমায় জড়িয়ে ধরে মুচকি হাসল৷ আলতো হাতে মাথা চেপে ধরে ক্ষীণ গলায় বলল,
— সেই তবে এলে।
— এলাম। আমার তো তুমি ছাড়া যাওয়ার আর জায়গা নেই।
মুখ তুলে ওর দিকে তাকালাম। ও আবারও বুকে টেনে নিলো। এবার ওর কণ্ঠে অভিমানী সুর।
— আমার তো তোমার সাথে কথা বলাই উচিৎ নয়। এক বছর যোগাযোগ বন্ধ রেখে যে কষ্টটা দিয়েছ তার শাস্তি পাওয়া উচিৎ তোমার।
— দাও, দিয়ে দাও শাস্তি। এক্ষুণি এইমুহুর্তে। তোমার সব শাস্তি ভালোবাসা বলে গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত আমি।
ওর পিঠের কাছটায় শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললাম আমি। ও ভারী অবাক হলো।
— বিরহ তোমায় পাগল করে দিলো নাকি? তোমার মুখে এমন কথা তো বিরল।
ও কি খোঁচা মারল আমাকে? মারলে মেরেছে। ওসব কানে তুলতে চাইলাম না।
— শুধু পাগল নয়। বদ্ধ উন্মাদ। আর একটাদিন ওই ভীনদেশে কাটালে আমি বোধহয় পাগলামির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে রাস্তায়ই নেমে পড়তাম। একটা বিখ্যাত লাইন আছে না? আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন। এবার সত্যি সত্যি তোমার বিরহে বিলীন হতে বসেছিলাম গো।
— ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে আরও বেশি ইমোশনাল কথাবার্তা বলছো তাই না? কঠোর হতে গিয়েও হতে পারছি না আমি। ফাজিল মেয়ে৷
প্রতুত্তরে আমি ঠোঁট কামড়ে হাসলাম। ও শান্ত স্বরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও বলে উঠল,
— বিরহ তো তুমিই চাইলে সেদিন।
আমি ওর চোখের তারায় গভীর অনুযোগ দেখতে পেলাম। ও আমার সাথে স্বাভাবিক হয়েও ঠিক স্বাভাবিক নয়৷
— কিছু সময় কি বিরহও দরকার পড়ে না?
— পড়ে বৈকি। নইলে যে মেয়ে আমাকে সহ্যই করতে পারছিল না। দেখলেই বিরক্ত হচ্ছিল, সরে যেতে চাইছিল আমার থেকে৷ এক বিরহ জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে আজ সে এতখানি পাগল হয়ে উঠল যে লোকলজ্জার নিমেষ মাত্র ভয় না করে এই এত এত লোক সমাগমে একদম ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। ম্যাজিক?
ইনতিসারের কথা শুনে ঠোঁটে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল আমার । চোখ নামিয়ে বললাম,
— আর লজ্জা দিও না।
— দিলাম না। তবে বোঝাপড়াটা কিন্তু হবেই হবে। এবারে যন্ত্রণার পরিমাণ একটু বেশি। কিছুটা শোধ আমি নিয়েই ছাড়ব।
— আচ্ছা তবে তাই হবে।
— মনে রেখো। পরে পালালে চলবে না।
— পালাব না কথা দিচ্ছি।
ও আবারও হেসে উঠল।
আমি মুহ্যমান হয়ে সে হাসির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কতদিন তাকে হাসতে দেখি না।মানুষটার হাসিতে এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি। বার-বার শুধু তাকিয়ে দেখতেই ইচ্ছে করে।
_______________________
৮২.
বাসায় ফেরার পর মাসখানেক কেটে গেছে কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা পূর্বের ন্যায় মসৃণ হতে পারেনি। এয়ারপোর্টেই বুঝতে পেরেছিলাম চোখের সামনে সব স্বাভাবিক লাগলেও বাস্তবিক তা স্বাভাবিক নয়। মিসক্যারেজের পরের দিনগুলিতে যখন ইনতিসার গেল নিউ ক্যাসলে গেল, তখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। প্রয়োজন ছাড়া কথা হতো না আমাদের। সাত সকালে বেরোতাম আমি। সারাদিন ভার্সিটিতে পড়ে থেকে ফিরতাম সন্ধ্যের দিকে। দেখা কিংবা কথা যা হওয়ার ডিনার টেবিলে। কোনোদিন এমনও গেছে এক ঘরে থেকেও একটা বাক্য বিনিময় হয়নি। ও মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থেকেছে আর আমি ব্যস্ততা বোঝাতে পড়াশোনায় ডুবে থেকেছি। একই ছাদের নীচে থেকেও যোজন-যোজন দূরত্ব কতখানি পীড়াদায়ক তখন না বুঝলেও এখন মরমে মরমে বুঝতে পাচ্ছি। মাসখানেকেই হাঁপিয়ে উঠেছি। মনে হচ্ছে কেন ও আমাদের সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না? আর কত!
নাকি ও চায়ই না স্বাভাবিক হতে? জানে মুখোমুখি হলেই এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তাই বুদ্ধি করে বোনের বাসায় রেখে গেছে। অজুহাত এই, আরো একজন অতিথি এসেছে বাড়িতে। দ্বিতীয় বাচ্চার সময় আপুর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত তার দুর্বলতা কাটেনি। শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াও প্রেগন্যান্সি পরবর্তী মানসিক একটা প্রেশারের বিষয়ও আছে। ভাইয়া কাজের জন্য তেমন সময় দিতে পারেন না৷ একদিক দিয়ে আমি থেকে তার ভালোই হয়েছে। সঙ্গী পেয়েছে। এছাড়া বাচ্চা দুটো মামণিকে পেয়ে খুবই খুশী। তাহযীব আগে থেকেই আমার ভক্ত। ফোন করলেই তার আধো আধো স্বরে রাজ্যের গল্প শুরু হয়ে যেত। খুব এনজয় করতাম আমি ওর বাচ্চামি গল্পগুলোকে। ওর সাথে কথা বললেই একটা অন্যরকম শান্তি লাগতো। আসলে আমি বোধহয় ওর মাঝে আমার হারানো সন্তানকে খুঁজে ফিরতাম৷ ছোটোজন ছেলে বাবু। বোনের সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখা হয়েছে তাবশীর। ডাকনাম তাজিম। তাজিমও এই ক’দিনে বেশ চিনে গেছে আমায়। দেখলেই কোলে আসার জন্য ছটফট করে। এরপর কোলে নিলেই ঘুম। বাচ্চাটার ঘুমন্ত মুখটায় যেন রাজ্যের মায়া। মনোযোগ দিয়ে দেখি আমি। দেখতে দেখতে কখন চোখে জল চলে আসে। ভেতরের এসব অব্যক্ত কথা, অবর্ণনীয় ব্যথা কার সাথে ভাগ করে নেব?
আমার চোখে জল দেখলেই আপু রেগে যায়৷ ইনতিসারকে কল করে রাগারাগি করে৷ সেও বুঝতে পারে আমাদের মধ্যে কিছু একটা ঠিক নেই। সম্পর্কের একটা সুর কেটে গেছে। যা প্রতিনিয়ত আমাদের উভয়কেই ভোগাচ্ছে, প্রচুর ভোগাচ্ছে।
নিজ চোখে দুজনের ভোগান্তি দেখেই কি না! সে একদিন সিদ্ধান্ত নিলো আমাদের সম্পর্কের কেটে যাওয়া সুরটা পুনরায় জুড়ে দেবে। তার ছোট্ট সে প্রচেষ্টায় সেদিন সামনে এলো অনেক অজানা কথা, আমার ছোটো ছোটো অজস্র ভুল। যা আমাদের সম্পর্কটার মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে ছিল। এবং অজ্ঞাত কাঁটাটার আঘাতে জর্জরিত হতে হতে আমরা নিঃশেষের দিকে পা বাড়াতে পারতাম।
_________
একদিন সকালবেলার ঘটনা৷ নিত্যদিনের মতো ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমরা দু’জন বসে গল্প করছি। গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে আপু হঠাৎ বলে উঠল,
— তোমরা আবারও আলাদা থাকছো কেন। পুরোনো কথা ভুলে গেলে হয় না? ওটা তো একটা দুর্ঘটনা ছিল। দুর্ঘটনাটাকে ধরে রাখলে জীবনে এগোতে পারবে? দুঃখ ভুলে মুভ অন করা শিখতে হবে না? কিছুক্ষেত্রে নিজের ভালোর জন্য খারাপ ঘটনাগুলোকে ভুলতে শিখতে হয়।
— ভুলে তো গেছিই আমি। আমার মনে আর ওসব নিয়ে কোনো রাগ কিংবা বিদ্বেষ নেই। আর না আমি আলাদা থাকতে চাই। বরং সে ই তো আমায় এখন চায় না।
দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম আমি। আমার কথা শুনে আপু একটু হাসলো। তারপর আচমকা রেগে উঠে বলল,
— তুমি বউ না ওর? চায় না বললেই হলো! জিদ নেই তোমার মধ্যে? তুমি জোর করে নিজের অধিকার আদায় করে নেবে। ও পালাতে চাইবে কলার টেনে ধরে ওকে আটকাবে। প্রয়োজন হলে ঘরে বন্দী করে রাখবে।
— জোর করবো আমি!
— তো করবে না? কিছুক্ষেত্রে জোরেরও প্রয়োজন আছে। তাছাড়া বলা যায় না ও হয়তোবা তোমার জিদ্দি রূপটা দেখতে চাইছে। চাইছে তুমি এবার জোর করে ওকে আটকাও।
— মানে!
এবার আপু বিরক্ত হলো।
— আসলেই তুমি বোকা নীরদ। খুব বোকা। এই যে সাহসিকা হয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে এলে, একা একা থাকলে, পড়লে। এত অ্যাচিভমেন্ট তোমার নামের সাথে যুক্ত হলো কিন্তু ভেতর থেকে তুমি সেই বোকাসোকাই রয়ে গেলে। তুমি অন্তর্মুখী মানলাম। কিন্তু সব জায়গায় তোমার এক আচরণ মানায়? তোমার হৃদয়ের উথালপাথাল ঝড়ো হাওয়া একবারও আমার ভাইকে দেখাতে ইচ্ছে হয় না? ওকে ভালোবেসে ওর বিরহে মরমে মরমে মরছো তুমি। আমি দেখছি, তোমার ভাইয়া দেখছে। সবাই দেখছে। ইভেন যার দেখার কথা সেও দেখছে। শুধু চাইছে তোমার বিরহবেদনা, তোমার পাগলাটে ভালোবাসার ঝুলি তার সামনে খুলে বসো। তাকে জোর করে পাশে বসিয়ে তোমার সমস্ত অভিযোগ শোনাও। তোমার ভাগের ভালোবাসাটা আদায় করে নাও। শুধুমাত্র তোমার একটা আহ্বানের জন্য ও কি পরিমাণ অপেক্ষা করে আছে জানো? আমরাই তো বুঝতে পারি অথচ তুমি বুঝতে পারো না।
— আপু!
চোখ ছলছল করে উঠল আমার।
— কাঁদবে না নীরদ৷ আরও শোনা বাকি। ভেবেছিলাম আড়ালের কথা কখনো তোমাকে জানতে দিব না। কিন্তু পরিস্থিতি আমায় বাধ্য করছে বলতে। শোনো, তুমি যে আসবে এটা আমার ভাই আগে থেকেই জানতো। তোমার সাথে যেদিন কথা হয় সেদিন কিন্তু ও বাবুকে দেখতে এসেছিল। ইভেন কথা বলার সময় ও আমাদের সাথেই বসে ছিল। তুমি ফোন করেছ শুনেই ফোনটা লাউডস্পিকারে দিতে বলল। আমি প্রথমে অস্বীকৃতি জানালাম। কিন্তু তুমি কল দিয়েছ শুনে ওর চোখে যে খুশীর ঝলকটা দেখা যাচ্ছিল ওই খুশীর ঝলকটা নিভে যাক চাচ্ছিলামও না। শেষে দিলাম ফোন লাউডস্পিকারে৷ তোমার কন্ঠ শোনার পর থেকেই ও বারবার ইমোশনাল হয়ে পড়ছিল জানো! আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ করছিলাম আমার এত স্ট্রং ভাই যাকে কি না ভয়ানক খারাপ সময়ে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখিনি তুমি আসবে শোনার পর থেকে তার চোখের কার্নিশে জলের আনাগোনা শুরু হয়েছিল। বিব্রতকর বিষয়টা নিয়ে লজ্জায় যেন পড়তে না হয় এজন্য ভেজা চোখদুটো আড়াল করতে কতবার যে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল তার ইয়ত্তা নেই।
তুমি চেয়েছিলে ওকে সারপ্রাইজ দিতে। আমি বারবার নিষেধ করেছি, খবরদার এয়ারপোর্টে যাবি না। তোর বউ যেমন প্ল্যান করেছে ওভাবেই হবে। ও সারপ্রাইজ যখন দিতে চাচ্ছে, দিক। ওয়াদাও করিয়েছিলাম। ও চুপচাপ বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কিন্তু সময় এলে আল্টিমেটলি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে আর পারল না। ওয়াদা ভঙ্গ করেই ফেলল। সেদিন ওর বাসায়ই থাকার কথা। অথচ তোমার ল্যান্ড করার পূর্ব মুহুর্তে জরুরি কাজ দেখিয়ে অফিস যাওয়ার মিথ্যে বাহানা করে ঠিকঠিক এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। তোমার ভাইয়া তো হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে বলেই ফেলল, ইনতিসার কি পরিমাণ বউ পাগল হয়ে গেছে দেখেছ?
এই বলে একটু থামল আপু। তারপর আমার হাতের ওপর হাত রেখে আবারও বলল,
— তাহলে তুমিই ভাবো, যে তুমি আসবে শুনে ওর এত অস্থিরতা! কয়েকটা মিনিটের দেরিও তার সইলো না। সব বাঁধা পেছনে ফেলে ছুটে গেল তোমার কাছে। সে ই তোমার থেকে আলাদা থাকতে চায়? হ্যাঁ হয়তোবা তোমার সামনে যাওয়ার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। নিজেকে গুটিয়েছে যেন তুমি ওর সামনে অবাধে নিজেকে মেলতে পারো।
নীরদ তুমি স্ট্রং পুরো পৃথিবীর সামনে কিন্তু তোমার মধ্যেও তো কিছু দুর্বলতা আছে। ইনতিসার চায় সেগুলো তুমি ওকে জানাও৷ তোমার যন্ত্রণাগুলো সব খোলামেলা বলে ফেলো ওর সামনে। কিন্তু তুমি তো ওর সাথেও কঠিন হয়ে আছো। আপন মানুষের কাছে এত কাঠিন্যও বোধহয় মানায় না তাইনা?
— তবে সে আমাকে এখানে রেখে গেল কেন আপু?
— ওটাও এখন ফুলটাইম গাধা বনে গেছে। কি ভেবে রেখে গেছে ও ই ভালো জানে। তবে এতটুকু বলতে পারি ও এক্সপেক্ট করেনি ওর এক কথায় তুমিও আমাদের এখানে চলে আসতে রাজি হবে।
— আমি ভেবেছিলাম সেও আসছে।
— তোমাদের আসলে একটা ইন্টার‍্যাকশনের খুব প্রয়োজন বুঝলে নীরদ৷ আয়োজন করে দুটিতে বসে কথা বলতে হবে। দূরে দূরে থেকে হচ্ছে না। একজন এক্সপেক্ট করছো অপরজন তোমাকে বুঝুক, অপরজন এক্সপেক্ট করছে তুমি তাকে বোঝো। এভাবে মান-অভিমানের পাল্লা ভারী হচ্ছে কেবল।
তবে শত অভিমান থাকুক এটা স্বীকার করতেই হবে যে গাধাটা তোমাকে একটাদিন না দেখে থাকতে পারে না। এই যে খাওয়ার বাহানায়, তাহযীব-তাজিমকে দেখার বাহানায় ও রোজ এবাড়ি চলে আসে; আমি ঠিক বুঝতে পারি ওর চোখজুড়ে তৃষ্ণা আসলে তোমায় দেখার।
— তা সত্ত্বেও সে আমায় ফিরতে বলে না।
— এটাই তো প্রবলেম হয়ে গেছে তোমাদের৷ ও এক্সপেক্ট করে তুমি ওর সাথে ফিরতে চাইবে। এদিকে তুমি এক্সপেক্ট করো ও তোমায় ওর সাথে ফিরতে বলবে। তোমাদের এক্সপেক্টেশন সব মনেই রয়ে যাচ্ছে। বাইরে আর বেরুতে পারছে না।
— গাড়ি বলে দেবেন আপু? আমি এক্ষুণি ফিরতে চাই বাসায়৷
চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম আমি। সাথেসাথেই আপু হাত টেনে আবারও বসিয়ে দিলো।
— আরে দাঁড়াও। সব কাজে তাড়াহুড়ো। যাবে তো অবশ্যই। কিন্তু ওর সাথে। ও তোমায় রেখে গিয়েছিল এখন ও ই তোমায় নিয়ে যাবে। তাছাড়া আজ তাহযীবের বার্থডে। সেলিব্রেশনের সময় ওর মামণি থাকবে না তাই কি হয়? ইনতিসার তো আসবেই আজ৷ প্রস্তুতি নাও ওর মুখোমুখি হওয়ার।
_______________
৮২.
ঘরোয়াভাবেই তাহযীবের বার্থডে সেলিব্রেশন করা হলো সন্ধ্যের দিকে। ডিনারও হলো জলদি৷ ডিনার শেষে ইনতিসার চলে যেতে চাইছিল। কিন্তু পারল না। তাহযীব জিদ করল মামার সাথে বাইরে যাবে, লং ড্রাইভে। একমাত্র আদরের ভাগ্নী৷ তার আবদার পূরণ সবার আগে। অগত্যা তাকে থেকে যেতে হলো। ও থেকে যাওয়ায় তাহযীবের চাইতে আমিই বেশি খুশী হলাম। এইতো সুযোগ। এবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেই হবে। শুধুমাত্র ওর জন্য ভেতরটাতে আমার কতখানি অস্থিরতা জমা হয়ে আছে ও কি জানে?
রাত একটু বাড়লে, রাস্তাঘাট যখন সুনসান তখন লং ড্রাইভে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো৷ সুযোগ বুঝে আপু আমাকেও পাঠিয়ে দিলো ওদের সাথে৷ হাইওয়ে ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে গাড়ি চলছিল আমাদের। বৈশাখ শেষের দিকে। আবহাওয়া বোঝা বড় দায়৷ এই রোদ তো এই বৃষ্টি। সারাদিন ভ্যাপসা একটা গরম শেষে বিকেলের দিকে উড়ো মেঘের বৃষ্টি হলো। এখন আবার আকাশে মস্ত চাঁদ৷ সোনালি রঙা। কি সুন্দর নরম সোনা রঙা আলো ছড়াচ্ছে। এতক্ষণ তাহযীব পুটুর পুটুর গল্প করছিল। এখন আমার কোলে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। সারা সন্ধ্যে এত ছোটাছুটি করেছে! ক্লান্তি আর সহ্য হয়নি। অথচ লং ড্রাইভে আসার কত শখ! লং ড্রাইভ এখন ঘুমিয়ে। ঘুমিয়েছে ও অনেকক্ষণ। তবুও ইনতিসার এখান থেকে ওখানে যাচ্ছে। এক মুহুর্তের জন্য কোথাও দাঁড়াচ্ছে না কিংবা বাড়ির পথ ধরছে না। সঙ্গ উপভোগ করছে। আপুর বলা কথাগুলো আমার কানে বাজছে। তার চোখজুড়ে আমায় দেখার তৃষ্ণা। এই যে ড্রাইভ করতে করতে খানিক পরপর আঁড়চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। বিষয়টা আমিও উপভোগ করছি। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠছে আমার। কত কত ভুল ধারণা মনে পুষে রেখেছিলাম। আজ সব ভুল ধারণাগুলো ভেঙে যাওয়ার পর এত সুখ লাগছে!
এ সুখ কাউকে বোঝানোর মতে নয়৷

কিছুক্ষণ একভাবে থাকার পর মনে হলো মানুষটার সাথে একটু দুষ্টুমি করা যাক। কখনো তো করা হয়নি। দেখা যাক আজ কি হয়! যেই ভাবা সেই কাজ। গলা খাঁকারি দিয়ে ওর দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আচমকা আমি বলে উঠলাম,
— ওভাবে আঁড়চোখে না তাকিয়ে সরাসরি আমার দিকে ফিরে তাকালেও তো পারো। কেউ নিষেধ করবে না। আই অ্যাম অল ইওরস।
আমার কথা শুনে ও সাথে সাথে ব্রেক কষলো৷ ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
— কাকে বলছো আমাকে?
— গাড়িতে তুমি ছাড়া আমাকে দেখার মানুষ আর কেউ আছে?
— আমি দেখছিলাম তোমাকে আঁড়চোখে? কখন! কে বলল!
একদম অবুঝের মতো বলে উঠল সে।
— কাউকে বলতে হবে কেন? আমার কি চোখ নেই।
— তোমার ঐ সমস্যাওয়ালা চোখে সবসময় ভুল-ভাল দেখো তুমি। আমার কিসের দায় তোমায় আঁড়চোখে দেখব!
— তোমার দায় তো সবচেয়ে বেশি। আমায় একদিন না দেখলে পাগল পাগল হয়ে যাও তুমি। খবর আছে আমার কাছে।
— হাস্যকর! কে যে এসব ভুয়া খবর ছড়িয়ে বেড়ায় তোমার কাছে৷
বিরক্ত হবার ভাণ করে মুখ ফিরিয়ে নিলো ও। আমি মৃদু হাসলাম। তাহযীবকে একহাতে ধরে আর একটুখানি সরে গিয়ে ইনতিসারের কাঁধে থুতনি রাখলাম। নরম গলায় বললাম,
— আচ্ছা ঠিকাছে আঁড়চোখে তাকাচ্ছিলে না। এবার তবে সরাসরি তাকাও তো। আমার দায়ে তাকাও। আমি কত সুন্দর করে সেজেছি দেখবে না তুমি?
ও কঠিন হওয়ার চেষ্টা করল কতক্ষণ। তাকাবে না তাকাবে না করে মুখ ফিরিয়ে থেকেও একসময় না পেরে তাকাল। সেই মুহুর্তে দু’জনার দৃষ্টি দু’জনাতে নিবদ্ধ হয়ে গেল। কিছু বলতে চাইল বোধহয় ;দুর্ভাগ্যবশত ব্যর্থ হলো। ঠোঁট দু’খানা ঈষৎ কেঁপে উঠতে দেখলাম আমি। এত কাছে থেকে মানুষটাকে বহুদিন দেখা হয় না। কিচ্ছু পাল্টায়নি মানুষটার মধ্যে, কিচ্ছু না। সেই দীপ্তিময় চাবুকের মতো মুখখানা, সরল চোখজোড়া, টিকলো নাক, মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এক দৃষ্টিতে পরোখ করতে করতে নাকের গাঢ় বাদামি তিলটায় চোখ আটকাচ্ছিল আমার বারবার। ঘোর লাগছিল দৃষ্টিতে। ভয়ানক ঘোর৷ ঠোঁট ছোঁয়াতে ইচ্ছে করছিল তিলটায়। কিন্তু অতটা পৌঁছুনো সম্ভব নয় এ মুহুর্তে। কোলে একজন শুয়ে আছে। তার ব্যথা লাগতে পারে। ইনতিসারও ক্ষেপে যেতে পারে। হীতে বিপরীত হবে তখন। সবটা বিবেচনা করে সাথেসাথেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলাম আমি। চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
— দূরে সরিয়ে রেখে খুব ভালো আছো? আমি তো ভালো নেই। একটুও ভালো নেই।
ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। উদাস কণ্ঠে বলল,
— দূরত্ব তো তুমিই চেয়েছিলে।
— এখন আর চাইছি না। আমাকে ফিরিয়ে নাও ইনতিসার। প্লিজ। আর পারছি না তোমাকে ছাড়া।
— কই! আমি তো দেখছি দিব্যি আমাকে ছাড়া ভালো আছো তুমি। ইশিকে নিয়ে, বাচ্চাদের নিয়ে ভালোই আনন্দে মেতে আছো। আমাকে ছাড়া যদি না-ই চলতো তোমার তাহলে সেদিন রাজি হতে না এখানে আসার জন্য। রেখে যাওয়ার মুহুর্তেও আটকাতে।
— আমি বুঝতে পারিনি তুমি আমায় একা রেখে যাচ্ছ। ভেবেছিলাম তুমিও..
— এটাই সমস্যা। তুমি বুঝতে পারো না নীরদ। চোখের সামনে থাকা কতকিছু আলগোছে এড়িয়ে যাও ।
ওর কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ছে। আমি আজ খুব ধৈর্য নিয়ে বসেছি।
— মাফ করো প্লিজ। এখন থেকে বোঝার চেষ্টা করবো আমি তোমাকে। একটা শেষ সুযোগ তো আমি ডিজার্ভ করি তাই না?
ও আবারও মুখ ফিরিয়ে নিলো। এ প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে শান্ত স্বরে বলল,
— সোজা হয়ে বসো নীরদ। আমরা এখন ফিরব৷ অনেক লেইট হয়ে যাচ্ছে।
দ্বিরুক্তি করলাম না আমি। এক কথায় বাধ্য মেয়ের মতো সোজা হয়ে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সময় শুধু ওর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বললাম,
— শতবার ফিরিয়ে দিলেও হাল ছাড়ব না ইনতিসার। আমিও কম জিদ্দি নই । তোমাকে আমার কাছে ধরা দিতেই হবে। এক পৃথিবী ভালোবাসা নিয়ে তোমার দোরগোড়ায় পা রাখব এবার। দেখি কীভাবে ফিরিয়ে দাও।
জবাবে ও কিছু বলল না। কঠিন মুখে ড্রাইভ করে গেল। আমার চোখে আবারও জল আসতে চাইছিল। চট করে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম আমি। ইনতিসারকে এ অশ্রু দেখানো যাবে না। শক্ত থাকতে হবে ওর সামনে, শক্ত!
ব্যাকসিটে মাথা কাত করে হেলান দিয়ে রাজ্যের ভাবনায় ডুবে গেল নীরদ। ও যদি একটাবার ফিরে তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো ইনতিসারের ঠোঁটের কোণে লেপ্টে আছে এক বিস্ময়কর মুচকি হাসির আভাস৷ মানুষ বহু প্রতীক্ষার পর কোনোকিছু পেয়ে গেলে ঠোঁটের কোণে যে অবর্ণনীয় সুখের হাসিটা লেপ্টে থাকে, ইনতিসারের মুখেও এই মুহুর্তে সেই হাসি৷ অন্তর্মুখী মেয়েটা আস্তে আস্তে তার সামনে নিজেকে মেলে দিতে শুরু করেছে ভেবেই ইনতিসারের সুখ হচ্ছে, ভীষণ সুখ।

বাসায় ফিরে তাহযীবকে শুইয়ে দিয়ে চলে আসতে নিতেই ইশি আপু খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরল। গলা খাদে নামিয়ে বলল,
— বদমাশটার সাথে কথা হলো কিছু? কি বলে ও?
আমি তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম৷ এরপর গাড়িতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই একে একে বলে দিলাম। শুনতে শুনতে আপু হেসে উঠল। বলল,
— হ্যাঁ একদম হাল ছাড়বে না। আজই ওর ঘরে ঢুকে যাবে। তারপর জোঁকের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরবে ওকে। দূরে সরাতে চাইলে কামড়েও দেবে।
আপুর কথা শুনে আমি তার মুখে হাত চাপা দিলাম। লজ্জায় কান গরম হয়ে উঠছিল আমার। সে মুখ থেকে হাত সরিয়ে আরও জোরে হেসে ফেলল।
— এত লজ্জা পেলে হবে? রাত পুরোটা পড়ে আছে এখনও। আরও কত লজ্জা বাকি৷
— ইশশ আপু চুপ করুন প্লিজ।
— আচ্ছা আচ্ছা চুপ করলাম। এখন এই কাপড়গুলো ছাড়ো তো। সেদিন শপিং এ গিয়ে তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছি। ওটা পরবে। প্রিয় মানুষের সামনে একটু প্রেজেন্টেবল হয়ে যেতে হবে না?
— শাড়ি! ওই জিনিস তো বহুদিন পরা হয় না।
অসহায়ের মতো বললাম আমি।
— পরা হয় না। আজ পরবে। শাড়ি হলো একটা স্পেশাল পোশাক । ও তৈরি হয়েছে লাইফের স্পেশাল মোমেন্ট গুলোকে আরও স্পেশাল করে দিতে। ওর হাতে অনেক ক্ষমতা। বুঝলে?

আপুর জোরাজুরিতে খানিক ভয় ভয় লাগলেও শাড়িটা পরার পর সব ভয় একছুটে পালিয়ে গেল। আয়নায় ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে নিজেই নিজেকে নিয়ে খুশী হয়ে গেলাম। চিকন সোনালি পাড়ের জাম রঙা শাড়ি। ভীষণ মানিয়েছে আমাকে। কাপড়টা কি ঠিক ধরতে না পারলেও গায়ে দিয়ে খুব আরাম আরাম লাগাছে ৷ চুলে খোঁপা বেঁধে দিতে দিতে আপু বলল,
— ভেবেছিলাম মায়ের দেয়া গয়নাগুলো পরাব তোমাকে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার দরকার নেই। গলার ঐ চেইনটাই বেশ মানাচ্ছে। এখন শুধু চুড়ি পরালেই পারফেক্ট।
— আমার লজ্জা করছে আপু।
— আরেহ্ বললাম না লজ্জা আজকের জন্য ছুটিতে। বাঁদরকে সোজা করতে যাচ্ছ। লজ্জা পেলে চলবে!
আপু এমনভাবে বলল! হাসি পেয়ে গেল আমার৷
এরপর বাকিটা সাজিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে চোখ মেরে বলল,
— দেখি এবার নিমরাজি বাঁদরটা কীভাবে তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। চোখ তুলে একবার তাকালেই তো কুপোকাত।
___________
মনে মনে সাহস সঞ্চয় করতে করতে এগোলেও ঘরের দরজার সামনে এসেই আমার সব সাহস হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মোটামুটি ঠান্ডা আবহাওয়াতেও কুলকুল করে ঘামতে শুরু করলাম আমি। ও যদি ধমক-টমক দেয় তাহলে সয়ে নেব নাকি পাল্টা ধমক দেব? এসব ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম আমি। ও সোফায় বসে ল্যাপটপে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছিল। শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল৷ তাকাতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল ওর। ওর কোঁচকানো ভ্রু দেখে আমিও পাল্টা ভ্রু কোঁচকালাম। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে পিছু ঘুরে দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিলাম। এবার ওপাশ থেকে রাগত স্বরে ভেসে এলো,
— দরজা আটকাচ্ছ কেন?
আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে আয়েশ করে ওর পাশে বসতে বসতে সুর টেনে বললাম,
— তোমাকে বন্দী করছি। তুমি আর আমি বদ্ধ ঘরে একসাথে…
— স্টপ স্টপ। আকাশ কুসুম কল্পনা করা বন্ধ করো। আমি ইনতিসার বদ্ধ ঘরে থাকব তাও আবার তোমার সাথে? হুহ্
রাগে মুখ লাল করে ল্যাপটপ হাতে উঠে যেতে লাগল ও। আমি তড়িঘড়ি করে ওর হাত টেনে বসিয়ে দিলাম। এরপর ল্যাপটপ সরিয়ে সোজাসুজি ওর কোলে উঠে বসে বললাম,
— এক পা বাড়িয়ে দেখো শুধু।
আমার কর্মকাণ্ডে খুব বিরক্ত হলো যেন। চোখেমুখে বিরক্তিভাব ফুটিয়ে বলল,
— কি চাই নীরদ?
— তোমাকে। আমার তোমাকে চাই। আজ, এক্ষুণি চাই।
গলা জড়িয়ে ধরে মোহাচ্ছন্ন হয়ে বললাম আমি। ওর মুখাবয়বে বিরক্তির ছাপ আরও বাড়ল।
মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল ও।
— বিদেশ থেকে ফিরে তোমার লাজ-লজ্জা সব হাওয়া হয়ে গেছে দেখছি।
— কিছু কিছু সময় ওসব লাজ-লজ্জাকে হাওয়া করতেই হয়।
সাথেসাথেই জবাব দিলাম আমি। সুবিধে করতে না পেরে এবার চুপ করে গেল । আমিও মুখ টিপে হেসে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ কিছুক্ষণ উসখুস করতে করতে ও আবারও বলে উঠল,
— রাত বিরেতে আবার নতুন করে শাড়ি পাল্টেছো কেন? ইদানীং দেখছি খুব শাড়ি প্রেমী হয়েছ ঘটনা কি?
— ঘটনা তুমি জানো না? বোঝো না।
ফটাফট উত্তর। এবারেও সুবিধে করতে না পেরে রেগে গেল ও। গম্ভীর মুখে বলল,
— খবরদার নীরদ আর শাড়ি পরবে না।
— কেন তুমি কন্ট্রোললেস হয়ে যাও?
ওর গালে হাত বোলাতে বোলাতে ফিসফিসিয়ে শুধলাম আমি। আমার কথা শুনে সাথে সাথেই এপাশ ফিরে চোখ রাঙানি দিলো ও। বিপরীতে আমিও ওর কলার চেপে ধরে চোখ রাঙালাম৷ চেষ্টা করেও আর নিজের হাসি আর চেপে রাখতে পারল না ইনতিসার। ঠোঁটের কোণে চিলতে করে ফুটে উঠলই।
— অ্যাই অ্যাই তুমি হাসছো?
অবাক হবার ভাণ করে শুধলাম আমি। চট করে হাসি বন্ধ করে এবার ভ্রু কুঁচকে আমার হাত ছোটানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
— কি হচ্ছেটা কি। এখন আবার জোরজবরদস্তি করবে?
— হ্যাঁ করব। বলেছি না তোমাকে আমার চাই। ইগনোর করছো কেন আমাকে?
— পাগলামো করো না নীরদ৷ আমার অনেক কাজ৷ এসব পরে হবে।
— উঁহু পরে নয়। এখুনি, এই মুহুর্তে।
তারপর ওকে হতভম্ব করে শাড়ির আঁচল নামিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা বন্ধ করে আমার কোমরে হাত রেখে ও চিন্তিত স্বরে বলল,
— দেখি তোমার চোখ দেখাও তো। অসংলগ্ন লাগছে কি না৷ কিছু খেয়ে টেয়ে এসেছ নীরদ? দেখি দৃষ্টি ঘোলাটে লাগছে কিনা।
স্পষ্ট খোঁচা বুঝেও না বোঝার ভাণ করে আমি বাধ্য মেয়ের মতো ওর চোখে চোখ রাখলাম। গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
— দেখো, ভালো করে দেখো তোমার প্রেমের কবলে পড়ে দিকভ্রান্ত হয়ে গেছি আমি। কি ভয়ানক সর্বনাশ হয়ে গেছে গো আমার। এই সর্বনাশ একমাত্র তুমিই ঠেকাতে পারো।
প্রতুত্তরে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর শুকনো ঢোক গিলল ও। ফিসফিস করে বলল,
— দিস ইজ নট ফেয়ার নীরদ। চিটিং করলে তুমি। তোমার সর্বনাশ ঠেকাতে গিয়ে এই মুহুর্তে সাড়ে সর্বনাশটা আমার হয়ে গেল।
ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলাম আমি। ওর খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলোতে নাক ডুবিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
— সর্বনাশের দেখেছো কি! এবার দেখবে সর্বনাশ কাকে বলে, কত প্রকার আর কি কি।
— লাইট টা নিভিয়ে..
বিড়বিড় করে কথা বলতে চাইল ও। আমি চট করে ওর মুখটা চেপে ধরলাম। বিরক্ত স্বরে বললাম,
— এত ডিস্টার্ব করবে না তো ইনতিসার।
মুখ থেকে হাত সরিয়ে ও হেসে উঠল। আমার গালে হাত রেখে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবিষ্ট স্বরে বলল,
— আমার আফ্রোদিতি। আমি যে তোমায় কতখানি ভালোবাসি তা কি তুমি জানো?
ইনতিসারের কথা শুনে এবার লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি৷ ওর কাঁধে মুখ লুকোতে লুকোতে বললাম,
— আর তোমার ভালোবাসা যে আমার জীবনী-শক্তি তা কি তুমি জানো? এভাবেই সবসময় ভালোবেসে যাবে আমাকে কথা দাও।
পরম ভালোবাসায় বুকে জড়িয়ে নিতে নিতে ও বলল,
” আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এমনি করেই তোমায় ভালোবেসে যাব নীরদ৷ কথা দিলাম”

এরপর প্রিয়তমার ডাকে সাঁড়া না দিয়ে আর পারল না ইনতিসার৷ নীরদ তার কথামতো পৃথিবী ভরা ভালোবাসা নিয়েই দাঁড়াল ওর দোরগোড়ায়। এতখানি ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবার শক্তি ওর মধ্যে ছিল না। থাকবে কি করে? ও তো সেই কবে থেকে এই ভালোবাসাটুকুর প্রতীক্ষায়।
অবশেষে দুজনেরই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল।
রঙ্গিন ভালোবাসার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠল ওরা সহচর হয়ে। আস্তে আস্তে ইনতিসার হয়ে উঠল তার বিষণ্ণ সুন্দর নীরদের ধূসর আকাশের বুকে এক ফালি রংধনু;নীরদের একার ভালোবাসার রংধনু।

অতিরিক্তঃ
সময় বহমান নদীর মতো গতিশীল। দেশে থাকার কয়েকটা দিন ভীষণ সুখে কেটেছে আমার সন্দেহ নেই। তবে এখন ফেরার পালা। ঘণ্টা কয়েক পরেই ফ্লাইট। আমি আবারও ফিরছি ইংল্যান্ডে। কয়েকটা ল’ ফার্মে অ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম।ওখান থেকে ইন্টারভিউ এর ডাক পড়েছে। এত কষ্ট করে পড়াশোনা কমপ্লিট হলো এখন বাসায় বসে থাকলে চলবে! ইনতিসার নিজে বসে থেকে বড় বড় ল’ ফার্মগুলোতে অ্যাপ্লিকেশন করে দিয়েছে। আবারও দূরে যেতে হবে ভেবে একটুখানি খারাপ লাগছিল আমার কিন্তু পরবর্তীতে মেনে নিয়েছি। মেনে নেয়া, মানিয়ে নেয়াই তো জীবন৷ আর চিরকালের তরে তো দূরে যাচ্ছি না। ইঊশার এইচএসসি হয়ে গেলে ইনতিসার আর ইঊশাও চলে আসবে ইংল্যান্ডে। প্রসেসিং চলছে। এবারের মতো আমি নাহয় একাই গেলাম।
জানালার ধারে হেলান দিয়ে বসে ব্যক্তিগত ডায়েরিটাতে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা লিখে রাখছিলাম। এমন সময় ইনতিসারের গলা ভেসে এলো,
— কি ব্যাপার একা একা হাসছো যে? আমাকে বলো আমিও একটু হাসি।
ওর কথা শুনে ডায়েরি বন্ধ করে বিছানা থেকে নেমে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। লাগেজ গোছানো বাদ দিয়ে ও ফিরে তাকাল। কালক্ষেপণ না করে মুচকি হেসে ওকে টুপ করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম এরপর। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে আদুরে স্বরে ও জিজ্ঞেস করল,
— কিছু বলবে?
আমি প্রথমে জবাব দিলাম না। বেশ কিছুটা সময় ওর বুকে মুখ গুঁজে ওর গায়ের মিষ্টি গন্ধে ডুবে রইলাম। ও আবারো ডাকল।
— নীরদ?
ওর এবারের ডাক শুনে না চাইতেও আমার ভ্রু কুঁচকে এলো৷ আমি চট করে মুখ তুলে চাইলাম। বেজার মুখে বললাম,
— সেদিন বলেছি না আর নীরদ বলে ডাকবে না?
— তাহলে কি বলে ডাকব শুনি?
ওর চোখে উপচে পড়া দুষ্টুমি। তা দেখে আমি চোখ নামিয়ে লাজুক স্বরে বললাম,
— প্রথমদিকে যা বলে ডাকতে।
আমার জবাবে ও বিস্তর হাসল। গালে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
— তুমি এত আহ্লাদী কেন আমার গ্লুমি ওয়েদার?
এমন প্রশ্নে আমারও হাসি পেয়ে গেল৷ আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম,
— আহ্লাদী জন্যই তো ভালোবেসেছিলে।
আমার উত্তরে ইনতিসারের হাসি গাঢ় হলো। আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে দেখতে লাগলাম মানুষটার হাসি। এত সুন্দর হাসি কোনো ছেলেমানুষের হয় কখনো? সৃষ্টিকর্তা মানুষটার হাসিতে এত মায়া দিয়েছেন কেন? এই মায়ার সাগরে যে আমার ভরাডুবি হয় শতবার। আমায় একধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচালো ইনতিসার। ঈষৎ ঝুঁকে ঠোঁট কামড়ে পুনরায় ফিসফিসিয়ে শুধল,
— কি দেখো অমন করে হু?
আমি স্পষ্ট দেখলাম ওর চোখের দুষ্টুমিটা ফিরে এসেছে। আমার কেন যেন সুখ সুখ লাগছে ওর বাহুতে জড়িয়ে। গাঢ় হেসে আমার নাকটা ওর গালে ঠেকালাম। গালে আফটার শেভিংয়ের মাতাল করা সুঘ্রাণ। আজ বুঝি আমার মাতাল হওয়ার দিন? পালকস্পর্শোর মতো নরম চুমু এঁকে ওর মতোই ফিসফিসিয়ে বললাম,
— থ্যাংক ইউ ফর বিয়িং দেয়ার হোয়েন আই নিডেড ইউ মোস্ট। থ্যাংক ইউ ফর এভ্রিথিং ইনতিসার। আই লাভ ইউ।
জবাবে আমায় আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ইনতিসার কিন্তু মুখে কিছু বলল না। আমি ওর বুকে মৃদু কিল মেরে বললাম,
— তুমিও বলো৷ লাভিউ ঠু বলো।
— লাভিউ ঠু আমার বোকা-সোকা গ্লুমি ওয়েদার বউ।
— আজ একটা আবদার করলে রাখবে ইনতিসার?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম আমি।
— কি আবদার?
— একটা গান শোনাবে?
মুচকি হাসল ও। কোমল হাতে আমার অবাধ্য চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে মৃদু সুরে গুনগুনিয়ে উঠল,

“এ কি অপরূপ সুন্দর
তার স্বপ্নের বর্ষা রাতে,
আমি ভিজে ভিজে মরি
মিছে মগ্ন প্রভাতে

দেখি ভিষণ অন্ধকার মাঝে
আলো ছায়ায় তার নূপুর বাজে,
আমি যে ভেবে ভেবে শিহরিত..

আমি সূর্যের আলো হয়ে
তোমার চলার পথে,
ছায়া হয়ে তোমায় দেখি
এতটা ভালবাসি..”

আমি অপার মুগ্ধতায় ভাসতে ভাসতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর চোখে উপচে পড়া সুখ। অনেক সাধনার পর এই সুখ আমাদের হাতে ধরা দিয়েছে। এক জীবনে এতখানি সুখের গল্প আমাদের ভাগে লেখা ছিল কেউ কি কখনো কল্পনা করেছিলাম?
সমাপ্ত
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here