ভালোবাসার রংধনু ১৪

0
984

ভালোবাসার রংধনু
১৪
________

২৫.
হতভম্বতা কাটিয়ে কড়া স্বরে বললাম,
— এসব কোন ধরনের ফাইজলামি? মাঝরাস্তায় আটকেছেন এসব উল্টোপাল্টা কথা বলে হ্যারাস করার জন্য?
ছেলেটার মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করলো এবারে। তড়িঘড়ি করে বলল,
— আরেহ্ আরেহ্ আপনি ভুল বুঝছেন। আমাকে কথাটা তো সম্পূর্ণ করতে দিন?
— কিসের কথা সম্পূর্ণ! আপনার এসব…
— প্লিজ ম্যাডাম আমার কথাটা শুনুন আগে?
আমায় থামিয়ে দিয়ে অনুরোধের সুরে বলল ছেলেটা। সন্দিগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বোঝালাম, বলুন দেখি এরপর আর কি বলবার আছে!
একটু হলেও শান্ত হয়েছি বুঝতে পেরে ছেলেটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নরম ভাবে বলল,
— আসলে আমি একটা বিরাট প্রবলেমে ফেঁসে গেছি। যে প্রবলেমের অংশীদার না চাইতেও আপনি হয়ে গেছেন।
— আপনার প্রবলেমের অংশীদার আমি হয়ে গেছি?
ভ্রু কুঁচকে গেলো আমার।
— হ্যাঁ। বিষয়টা একটু অড। ধৈর্য ধরে পুরোটা শুনবেন কেমন?
— বলুন।
— রিকশাকে ধরে রাখবেন এতক্ষণ?
— এতক্ষণ মানে! এই না আপনি বললেন দু মিনিটে শেষ হবে কথা! মতলব তো আপনার সুবিধার লাগছে না। প্রথমে দু মিনিটের কথা বলে..
— আচ্ছা আচ্ছা স্যরি। রিকশা ছাড়তে হবেনা। এভাবেই বলছি আমি। চেঁচামেচি করবেন না প্লিজ।
— অপ্রাসঙ্গিক কথায় মেতেছেন কেন? ইম্পর্ট্যান্ট কথা যা আছে বললে বলে ফেলুন দ্রুত। আমার অত সময় নেই আপনার পেছনে ব্যয় করার মতো।
ছেলেটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে অযথা নিজের চুলে একবার হাত বোলালো তারপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলো,
— আসলে প্রবলেমটা হলো আমার এক ক্লাসমেট বেশ কয়েক বছর যাবৎ আমায় পছন্দ করে।

এ পর্যন্ত শুনেই নাকমুখ কোঁচকালাম আমি। চোখ ছোট ছোট করে তাচ্ছিল্যভরে তাকালাম ওর দিকে। যার অর্থ এসব থার্ডক্লাস কথায় মোটেই ইন্টারেস্টেড নই ।
আমার তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি বুঝতে পেরেও ও দমলো না৷ বলে যেতে থাকলো একটানা৷
— পছন্দের বিষয়টা বলেছেও। কিন্তু আমি তাকে শুরুতেই না করে দিই। ফ্রেন্ডের বাইরে অতিরিক্ত কোনো ভাবনা তাকে নিয়ে আমার তৈরি হয়নি।
তাকে পছন্দ করিনা এটা জানার পরেও সে হাত ধুয়ে আমার পেছনে পড়ে আছে। আমি কার সাথে মিশছি, কার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করছি, কখন কোথায় কোথায় যাই; এককথায় আমার ডেইলি গ্রাইন্ড তার মুখস্থ। সুক্ষ্মভাবে সে আমার ওপর নজরদারি করে এবং পরে এই বিষয় নিয়ে নানারকম ঝামেলা সৃষ্টি করে আমাকে প্যারা দেয়। নজরদারি কীভাবে করে প্রশ্ন উঠতে পারে আপনার মনে। সেক্ষেত্রে বলে রাখি সে আমাদেরই ফ্ল্যাটে সেকেন্ড ফ্লোরে রেন্টে থাকে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সে আমার ওপর নজরদারি করার জন্যই এখানে উঠেছে!
সেদিন যখন আপনার সাথে আমার ধাক্কা লাগলো, কথা হলো সেটা সে দেখে ফেলেছিল। তারপর এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ঝামেলার সৃষ্টি করলো৷ তার বদ্ধমূল ধারণা আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে এবং সেই সম্পর্কের কারণেই আমি তাকে অ্যাকসেপ্ট করছি না। তার ধারণা, বিষয়টার সত্যতা যাচাই করতে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি অস্বীকার করতাম তাই আমার কাজিন আপনার ফ্রেন্ড জিনিয়াকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। জিনিয়া জানতো না ওর থেকে আমি পালাই পালাই করে বেড়াই। শুধু জানে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে। তাই ওকে আরও জেলাস করাতে মজার ছলে ও মিথ্যেমিথ্যি বলে দিল, হ্যাঁ আপনার সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে। জিনিয়ার ফ্রেন্ড এই হিসেবে চেনাপরিচয় থেকে আমাদের সম্পর্ক হয়েছে। জিনিয়া তো আর বুঝতে পারেনি ওর এই মজা আমার জীবনে কতবড় সাজা হয়ে যাবে!
এখন ঐ মেয়েটা মানে আমার ফ্রেন্ডটা বলেছে সে চায় আমাদের বিয়ে হয়ে যাক।
একটু থামলো ছেলেটা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— মানে আপনার আর আমার। আমি যে অন্যকারো এটা নাকি প্রথমে মানতে তার কষ্ট হয়েছিল কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখেছে ভালোবাসা যার সাথে ভালো থাকে তাকে তার সাথেই থাকতে দেয়া উচিৎ। এখন সে চায় আমাদের সম্পর্কটা সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পাক। সামাজিক কোনো স্বীকৃতি পেতে না দেখা অবধি নাকি তার শান্তি হবেনা। জেলাসি থেকে সে বারবার আপনার-আমার ক্ষতি করতে চাইবে।
— কিহ্! কিসব আষাঢ়ে গল্প শোনাচ্ছেন আপনি আমাকে হ্যাঁ? আর জিনিয়া মিছেমিছি একজনকে এতবড় মিথ্যে বলেছে আমার নামে?
— হাইপার হবেন না ম্যাডাম। বিষয়টা পুরোটাই না বুঝে হয়ে গেছে। জিনিয়াও তো জানতো না ঐ মেয়ে অতবড় সাইকো।
— হাইপার হবোনা মানে! কতদিনের ফ্রেন্ড ও আমার। আমার পেছনে আমি সম্পর্কিত এতবড় কান্ড ঘটিয়ে ফেললো একবার জানালো না পর্যন্ত! আর আপনার ঐ ফ্রেন্ডই বা কতবড় গর্দভ যে মাত্র একবার অ্যাক্সিডেন্টাল ধাক্কা দেখে ভুলভাল ভাবনা পোষণ করে ফেলে!
— ও আপনার ভাবনার চাইতেও গর্দভ। আমি তো ওকে মাঝেমধ্যে বুঝে উঠতেও পারিনা। ওর জন্য আমার কোনো মেয়ের সাথে ভালো ফ্রেন্ডশিপ নেই। কাউকে ফ্রেন্ডলি কথা বলতে দেখলেই আমার পাশাপাশি ঐ মেয়েটাকেও প্যারা দিতে শুরু করে। আজেবাজে কথা শুনিয়ে দেয়। থাক ঐ প্রসঙ্গে না যাই।
আসলে ওর সন্দেহ গাঢ় হবার পেছনে জিনিয়ার চাইল্ডিশ কাজটা দায়ী। এছাড়াও আপনার সাথে আমার ঐদিনের অ্যাক্সিডেন্টটার পর থেকে টানা কয়েকদিন জিনিয়াকে কোচিং-এ আনা নেয়া করেছি চাচ্চু বাসায় না থাকার কারণে। আমার কোচিং-এ যাওয়ার বিষয়টাকে ঐ সাইকো মেয়ে ভেবে নিয়েছে আপনার কারণেই আমি যাই।
— মানে এমনিতেই বিষয়টা ঘাঁটা ছিল আপনি আরও ঘেঁটে দিয়েছেন!
তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে কপাল চেপে ধরে বললাম আমি। ছেলেটা খুব দুঃখী গলায় বলল,
— আসলে বিপদ যখন আসে তখন চারিদিক দিয়েই আসে।
— তো এখন আমাকে কি করতে হবে? ঐ সাইকো মেয়ের জন্য আপনাকে বিয়ে করতে হবে!
— না না। বিয়ে করতে হবেনা। বিয়ে থেকেই তো পালাতে চাইছি আমি।
শেষের কথাটা বিড়বিড় করে বললো ছেলেটা। যদিওবা আমার কানে এসেছে তথাপি না শোনার ভান করলাম।
— কি বললেন?
— নাহ্ কিছুনা। বলছিলাম যে সত্যি সত্যি বিয়ে করতে হবেনা আপনাকে, জাস্ট বিয়ের নাটক করবেন। শুধু দশ মিনিটের জন্য আমার বউ হতে হবে। প্লিজ।
— এটা করে আমার লাভ?
— দেখুন আমি কিন্তু আপনাকেও এই প্রবলেম থেকে বের করার চেষ্টা করছি। মেয়েটা কতটা বাড়াবাড়ি করতে পারে আইডিয়া নেই আপনার। ও আমাদের সম্পর্কের বিষয়টা আমার বাসায় জানানোর পরিকল্পনা করছে। একবার যদি আমার আব্বার কানে যায় যে তার ছেলে রিলেশনশিপে আছে, তাহলে আমার একটা স্বপ্নও পূরণ হওয়ার নয়৷ আমি তো ফাঁসবোই সাথে আপনিও ফাঁসবেন।
বিয়েশাদিতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। লাইফ নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা অন্য৷ আমি আর দু’বছর পরেই অ্যাবরডে চলে যাবো। ওখানেই সেটেল্ড হবো। আব্বা আবার এটা চায়না। যেন না যেতে পারি এজন্য সে আমাকে নানা উপায়ে বাঁধার চেষ্টা করবে। এখন থেকেই হন্যে হয়ে সে উপায় খুঁজে ফিরছে, যদিওবা পায়নি;তবে এখন যদি আপনার আমার মিছেমিছি সম্পর্কের কথাটা বাইরে চলে আসে সেটা হবে আগুনে ঘি ঢালার মতো। আমি কোনোভাবেই আপনার-আমার সত্যি সত্যি বিয়েটা আটকাতে পারবো না। তাই বলছি আজ শুধুমাত্র দশ মিনিটের জন্য আমার বউ হন। আপনিও বেঁচে যান আমিও বেঁচে যাই।
— আপনি যে কথাগুলো সত্যি বলছেন আমাকে কোনো ট্র্যাপে ফেলার জন্য না এ কথা বিশ্বাস করবো কীভাবে?
চোখ সরু করে বললাম আমি।
— জিনিয়াকে কল করুন এক্ষুনি আমার কথার সত্যতা যাচাই হয়ে যাবে।
— আমি কল করবো না। আপনি করুন এবং ভিডিও কল। আমার সামনে।
— ওকে ফাইন।
পকেট থেকে ফোন বের করে আমার সামনে দাঁড়িয়েই ছেলেটা জিনিয়াকে ভিডিও কল করলো। কল রিসিভ হলে ওকে কথা বলতে না দিয়ে আমি ফোনটা টেনে নিলাম। ফোনের এপাশে আমায় দেখে কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফেললো জিনিয়া। অস্বাভাবিক মাত্রায় ঘামছে ও। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অপরাধ একটা অবশ্যই করেছে। আমি কেবল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— এইমাত্র যা শুনলাম তা কি সত্যি জিনিয়া?
আমার প্রশ্ন শুনেই ও ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো । তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ছেলেটা যা যা বলেছিল এই কথাগুলোই রিপিট করে গেল। সাথে ফ্রী উপদেশ দিলো এই প্রবলেম থেকে মুক্তি পেতে যেন ছেলেটার কথা মেনে নিই। ও যে আমার পেছনে এতবড় ব্লান্ডার করে রেখেছে ব্যাপারটা ভীষণ রাগিয়ে দিলো আমাকে। আর একটা অতিরিক্ত কথা না বলে কল কেটে ছেলেটার হাতে দিয়ে দিলাম।
হতাশার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছি আমি। মানে সব ঝামেলা আমার ঘাড়েই পড়তে হবে!
এই ছেলেটা যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে বিয়ে ঘটিত ঝামেলাটা আমাকেও ভোগাবে। একবার এতে ফেঁসে গেলে সহজে নিস্তার নেই। ওর বাবা যেমন ওকে আটকাতে কিছু না ভেবেই বিয়ে করিয়ে দেবে তেমনই আমার আপাও ভাবনা চিন্তায় যাবেনা। এমনিতেই প্রীতম সাহেবের বিষয়টা নিয়ে ওদিকে কি রিঅ্যাকশন হবে, জানা নেই আমার।
আবার যেন বিয়ে ঘটিত কোনো ঝামেলা ঘাড়ে না চাপে তার জন্য কি এখন ছেলেটার কথায় রাজি হয়ে যাওয়া উচিৎ?
ভাবনায় পড়ে গেলাম আমি। এর মাঝে রিকশাওয়ালা তাড়া দিয়ে বলল, আরও দেরি করালে সে লেইট ফী নেবে। এভাবে রিকশায় বসে সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। রিকশা ছেড়ে দিয়ে ছেলেটার সাথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ।
আমাকে ভাবনার অতল থেকে অবশ্য টেনে আনলো ছেলেটাই। বাইকের ওপর একটা কালো রঙের ব্যাগ ছিল সেটা থেকে কিসের একটা কাগজ নিয়ে এসে আমার সামনে ধরলো। বলল,
— চিন্তার কোনো কারণ নেই। কোনো ঝামেলা হবেনা। আমি নকল রেজিস্ট্রি পেপার বানিয়ে এনেছি বিয়ের। এই দেখুন।
রেজিস্ট্রি পেপার হাতে নিয়ে দেখি হুবহু কিছুক্ষণ আগে কাজি অফিসে দেখা প্রিতমের রেজিস্ট্রি পেপারটার মতন৷
হাতে নিয়ে লেখাগুলো পড়তে পড়তে সন্দিগ্ধ গলায় বললাম,
— এটা যে নকল তার প্রমাণ কি?
— জানতাম এর প্রমাণ চাইবেন। কাজি অফিসের অপজিটে কম্পিউটারের দোকান থেকে বানিয়ে নিয়েছি এটা। চলুন ওখানে গিয়েই জিজ্ঞেস করবেন। আমি রিস্ক নিতে চাইলাম না। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ছেলেটার সাথে গেলাম দোকানটায়। নাহ্ আসলেই সে মিথ্যে বলেনি। দোকানদার কাগজ দেখেই বলল, একটু আগে এটা বানিয়ে দিয়েছে আমার সাথের জনকে।
দোকানদারের কথার পর আর ছেলেটাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ আছে? আমি চুপচাপ তাকে ফিরিয়ে দিলাম নকল রেজিস্ট্রি পেপারটা।
পেপার হাতে কাজি অফিসের সামনে যেতে যেতে সে বলল,
— এখন তো বিশ্বাস হয়েছে? এবার বলুন আমার সাথে নাটকটা কন্টিনিউ করবেন?
আমি দ্বিধান্বিত হয়ে বললাম,
— হবো। কিন্তু হীতে বিপরীত হলে? যদি এতে ঝামেলা বাড়ে!
— বাড়ার চান্স নেই। আর নেগেটিভ ভাববেন না প্লিজ। সবসময় পজিটিভ ভাবার চেষ্টা করুন।
— এখন কি করতে হবে?
— কিছুই না। আমি এখন আমার কয়েকটা ফ্রেন্ডকে কল করে ডাকব। ওরা এলে আমরা সবাই মিলে আমার এক ফ্রেন্ডের মামার রেস্টুরেন্টে যাবো। রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পর ঐ মেয়েকে ডাকা হবে এবং বাকি নাটক তারপর থেকেই কন্টিনিউ করা হবে।
— তার মানে আপনি এমন একটা সিচুয়েশন ক্রিয়েট করতে চাচ্ছেন যেন মনে হয় বিয়ে হয়ে গেছে, এখন বিয়ের ট্রিট দিতে নিয়ে এসেছেন সবাইকে। মেয়েটাকে সাডেন ফোন করে জানাবেন!
— হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন।
— সন্দেহ করবে না মেয়েটা?
— সন্দেহের অবকাশ তো নেই। মিথ্যে বিয়েকে সত্যি প্রমাণ করতে যা যা প্রয়োজন সব আছে আমাদের কাছে। শুধু কয়েকটা ছবি তোলা নেই। সেটাও হয়ে যাবে রেস্টুরেন্টে গেলে। ডোন্ট ওয়ারি।
আসলে সবই ম্যানেজ করা আছে শুধু আপনাকে রাজি করানোটা বাকি ছিল।
অল্প হেসে বলল ছেলেটা। আমি ওর দিকে তাকালাম একবার। সব রেডি করেই এসেছে আমার সামনে! কিন্তু আমি এই টাইমে কাজি অফিসের আশেপাশে ছিলাম ও জানলো কি করে? ভাবলাম জিজ্ঞেস করি কিন্তু তার আগেই ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেল; আর জিজ্ঞেস করা হলোনা।
আধ ঘণ্টার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম ওভাবে রোদের মধ্যে কাজি অফিসের সামনে।
এর মাঝে ছেলেটার সাথে পরিচিত হয়ে নেয়াটা সমীচীন মনে হলো। নাম তার অন্ত। মাশরুখ ইসরার অন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যামেস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করছে। আমাদের টু ইয়ার সিনিয়র মাত্র। এজন্যই এত কমবয়সী লাগে! কথার মাঝে তার বন্ধুরা চলে এলো। বিশাল গ্রুপ। ছয় জন ছেলে আর চারজন মেয়ে। মুহুর্তের মধ্যেই জায়গাটা মুখরিত হয়ে গেল যেন! সবাই এসে আমার সাথে পরিচিত হলো জনে জনে। অন্ত সাহেবকে হেল্প করতে রাজি হয়েছি জন্য একপশলা ধন্যবাদও জানালো। তারপর সবাই মিলে রওয়ানা হলাম রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। পথে অন্ত সাহেবের ফ্রেন্ডরা শিখিয়ে পড়িয়ে দিলো ঐ মেয়েটার সামনে কীভাবে অ্যাক্টিং করতে হবে।
ওদের এত সিরিয়াস ভাবভঙ্গি দেখে আমি ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হতে থাকলাম।
আমাকে আবার শান্ত করলো অন্তর চার বান্ধবী। খুব ফ্রেন্ডলি ব্যবহার। কে যেন এক ফাঁকে বলল,
গ্রুপ ফটো, আমার আর অন্ত সাহেবের আলাদা আলাদা ফটো তুলে রাখতে। কোনো ভাবেই যেন মেয়ে সন্দেহ করতে না পারে। আমার একদম ইচ্ছে ছিলোনা ওসব ফটো টটো তোলার। তবুও তুলতে হলো বাধ্য হয়ে। ফটো তোলা শেষে অন্ত সাহেব ফোন লাগালো ঐ মেয়েটাকে। ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে বেরুলো বোধহয় মেয়েটা, বেশি সময়ই লাগলো না তার আসায়। বড়জোর দশ থেকে পনেরো মিনিট এর মাঝেই উপস্থিত। আমরা মিডেলের দু’টো টেবিল জুড়ে বসেছিলাম। যেখানে থেকে বাইরেটা স্পষ্ট দেখা যায়। মেয়েটাকে যখন বাইরে রিকশা থেকে নামতে দেখা গেল তখনই সবাই হাসি ঠাট্রা থামিয়ে কি সিরিয়াস! আমি তো নার্ভাসনেসে ফেটে পড়ছি।
রেস্টুরেন্টের কাঁচের দরজা ঠেলে খুব গম্ভীর মুখে ঢুকলো সে। গটগট করে হেঁটে আমাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো আমার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে। খুব অস্বস্তি হলো আমার। ও যেন চোখ দিয়ে স্ক্যান করছে আমাকে।
দৃষ্টি না সরিয়ে অন্ত সাহেবের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো,
— সাডেন বিয়ে?
— বিয়ের প্ল্যান তো আগে থেকেই ছিল। জানালাম সাডেন।
— বিয়ের আগে জানালে না? আমিও আসতাম।
— মনেই ছিলোনা তোমার কথা। যখন মনে পড়লো সাথেসাথেই ডেকে ফেললাম।
কষ্ট করে একটা শুকনো হাসি দিয়ে মেয়েটা চেয়ার টেনে বসলো।
— তো নাম কি তোমার?
প্রশ্নটা আমাকে করেছে বুঝতে অসুবিধা হলোনা আমার। শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললাম,
— নীরদ।
— অন্তর বোন জিনিয়ার ফ্রেন্ড তুমি তাইনা?
সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম আমি।
উপস্থিত সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মেয়েটা বলল,
— জিনিয়া কোথায়?
আমি বুঝে উঠতে পারলাম না কি বলবো। আমাকে চুপ করতে দেখে অন্ত সাহেব পাশ থেকে বলে উঠলো,
— আছে। ও একটু ওয়াশরুমে গেছে।
অন্তর উত্তর শুনে আমি প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম তার দিকে। জিনিয়ার কথাটা যে মিথ্যে বলছে পরে এই ব্যাপারটা সামলাবে কি করে?
আমার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি বুঝতে পেরে অন্ত খুব সরল চোখে আমার দিকে তাকালো। অল্প কিছুক্ষণ পর দেখলাম কোত্থেকে জিনিয়া এসে হাজির। অবাক হয়ে গেলাম আমি। ওকে তো কল করতে শুনিনি। ও কখন এলো? এতক্ষণ কোথায় ছিল?
প্রশ্নগুলো মনে চেপে রেখে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম। যত প্রশ্ন তার উত্তর এখান থেকে বেরিয়ে নাহয় শুনে নেবো।
জিনিয়া আসার পর আমার বাকি পরিচয় বানিয়ে টানিয়ে মেয়েটার সামনে ও ই উপস্থাপন করলো। কথার ফাঁকে জানতে পারলাম মেয়েটার নাম নিতুল। এত সুন্দর একটা নাম! এত সুন্দর তার চেহারা দেখলে একদমই মনে হয়না মেয়েটা একটা সাইকো। অবশ্য চালাকও কম নয়। খুব সুক্ষ্মভাবে গল্পের তালে একবার রেজিস্ট্রি পেপার দেখছে, একবার ছবিগুলো! অন্ত সাহেব বিয়ের নাটকটাকে আরও সত্য হিসেবে প্রেজেন্ট করতে হঠাৎ আমার কাঁধ জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে সহাস্যে নিতুলকে জিজ্ঞেস করলো,
— বলো তো নিতুল আমাদের একসাথে কেমন লাগছে?
নিতুল আবারও শুকনো হাসলো। ছোট্ট করে বলল,
— খুব ভালো।
তারপর ভাবুক চোখে তাকিয়ে হাসিটা বজায় রেখেই জিজ্ঞেস করলো,
— নতুন বউকে লাল শাড়ি পরাওনি কেন? লাল শাড়ি ছাড়া বউকে কি আসল বউ মনে হয়?
এই প্রশ্নটা উপস্থিত সকলের কাছেই আনএক্সপেক্টেড ছিল। আমরা কেউ ভাবতেও পারিনি সে এরকম কোনো পয়েন্ট ধরতে পারে! চট করে কেউই কোনো উত্তর সাজাতে পারলো না। তবে জিনিয়া খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্তর দিলো,
— আপু বিয়েটা তো পরিবারকে জানিয়ে করা হচ্ছেনা যে লাল শাড়ি, লাল চুড়ি, মাথায় ওড়না পরে বউয়ের বেশে আসবে। এটা হলো সাডেন একটা বিয়ে। প্রিপারেশন নেয়ার সুযোগই হয়নি।
— তো সাডেন বিয়ের কারণ?
— কারণ নিশ্চয়ই আছে। এখন সব কারণ তো সবসময় সবাইকে বলা যায়না।
জিনিয়ার বাঁকা বাঁকা কথায় নিতুলের মুখ কালো হয়ে গেল। কোনোরকমে বলল,
— হু সেটাই।
— আমার ফ্রেন্ডকে যদিওবা সব ড্রেসেই পারফেক্ট লাগে তবুও তুমি যদি চাও ওকে লালে দেখতে, তাহলে নাহয় দেখলে।
মুচকি হেসে নিজের ব্যাগ থেকে একটা লাল ওড়না বের করে আমার মাথায় জড়িয়ে দিলো জিনিয়া একদম বউদের মতো করে। ওড়নাটা জড়িয়ে দেয়া মাত্র কোত্থেকে একরাশ লজ্জা এসে ভর করলো আমাকে। আশেপাশে মানুষ নিশ্চয়ই তাকিয়ে দেখছে আমাদের, কিন্তু কিছু বুঝতে পারছে না! ইশশ এই বিয়ের নাটক করতে এসে দেখছি আরেক ঝামেলায় পড়লাম। লাইফে মিথ্যে বিয়ের অভিনয়েরও এক্সপেরিয়েন্স হয়ে গেল। পুরো সার্কাস হয়ে গেছি আমি।
জিনিয়ার এই কাজের পর অন্ত ওর সাথে তাল মিলিয়ে বেহায়ার মতো বলল,
— এই যে হয়ে গেল আমার বউ লালে লালবতী।
আসলে কি বলো তো আমার বউ এত বেশিই সুন্দর যে ইচ্ছে করে ওকে লাল পরাইনি। যদি ছেলেপেলেরা নজর দেয়!
অন্তর কথায় আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। মনে হলো মাটি ফাঁক হোক আমি ঢুকে যাই। বারবার বউ বউ করছে কেন ছেলেটা? “বউ” শব্দটা শুনলে আমার কেন যেন খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে।
একটা মিথ্যেমিথ্যি বিয়ের নাটক করতে গিয়ে এরকম অনুভূতি হওয়া একদমই অনুচিত। সব দোষ আসলে এই ভাই-বোনের। এরা এমনসব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে যে লজ্জায় লজ্জায় আমার অবস্থা বেগতিক।
মনে হচ্ছে ওড়না টোড়না ফেলে দিয়ে নিতুলকে বলি, আমার কাঁধ জড়িয়ে থাকা এই অসভ্য ছেলেটা মোটেই আমার বর নয় নিতুল। তোমার একটা গাধামির জন্য এর সাথে বিয়ের নাটক করতে হচ্ছে আমাকে। এই নাটক করতে গিয়ে যে কি পরিমাণ অবস্থা খারাপ হচ্ছে আমার, তুমি আইডিয়াও করতে পারবে না৷ কেন মিছেমিছি ভুল বুঝতে গেলে বলো তো? এখন যদি তোমাকে এর শাস্তি দিতে চাই, কেমন হবে?
চলবে,
sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here