ভালোবাসার রংধনু ৩৭
_____________
৭১.
বেলা বাড়তেই আমরা হাসপাতালে গেলাম প্রিমাকে দেখতে। ওর অবস্থা তখন কিছুটা ভালো। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল বেডে। আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম সুরে ডাকলাম ওকে। ও চোখ খুলল কয়েক সেকেন্ডের জন্য৷ আমাকে দেখে সাথেসাথে বন্ধ করে নিয়ে শীতল গলায় বলল,
— কেন এসেছ নীরদ? কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দিতে?
আমি দুদিকে মাথা নেড়ে ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম,
— ক্ষমা চাইতে এসেছি প্রিমা৷
পাশ থেকে ওর মা রাগত স্বরে বলে উঠলেন,
— মিনিমাম লজ্জা থাকলে আমাদের সামনে আর পড়তে না। আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে এখন ক্ষমা চাওয়ার নাটক করতে এসেছ?
— আহ্ মা চুপ করো তো।
বিরক্ত হয়ে বলল প্রিমা। ইনতিসারের ডাক্তারের সাথে কথা বলছিল এতক্ষণ। কথা শেষে আসতেই সেও আন্টির রোষানলে পড়ে গেল। আমাদের দুজনকে কতগুলো কড়া কথা শোনাতে নিয়েছিলেন তিনি কিন্তু প্রিমার রাগারাগিতে থেমে গেলেন। পরে ইনতিসার বারবার রিকোয়েস্ট করে কথা বলার জন্য ওনাকে বাইরে নিয়ে গেল৷ যাওয়ার সময় আমায় চোখের ইশারায় বোঝালো আমি যেন প্রিমার সাথে কথা বলি। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।
ওরা বেরিয়ে গেলে আমার আগে প্রিমাই বলে উঠল,
— আমাকে নিয়ে এই গেইমটা না খেললেও পারতে৷ আমি তোমাকে একজন ভালো বন্ধু ভেবেছিলাম৷ তুমি অস্বীকার করতে পারবে ওনার কমিটমেন্ট সম্পর্কে তুমি জানতে না? একই ছাদের নীচে থাকো অথচ এতটুকু কথা জানো না এই মিথ্যেটা এটলিস্ট বলতে এসো না।
আমি বড় করে শ্বাস নিয়ে প্রিমার হাত টেনে নিলাম আবারও। বললাম,
— আমি আসলে চাইনি আমার সাথে জড়িয়ে ওর..
কথা পুরোটা শোনার আগেই প্রিমা চমকে তাকালো।
— তার মানে ওই মেয়েটা তুমি?
আমি ঈষৎ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালাম। প্রিমা হেসে উঠল এবার।
— তারমানে তুমি যেচে পড়ে তোমাদের মধ্যে আমাকে থার্ড পার্টি করে ঢুকিয়েছিলে?
— আমার কথা শোনো প্রিমা। বোঝার চেষ্টা করো..
ও হাত তুলে আমাকে আবারও থামিয়ে দিলো।
— যা বোঝার আমি বুঝে গেছি নীরদ। নতুন করে কিছু শুনতে বা বুঝতে চাইছি না। আমি জানি না কোন উদ্দেশ্যে তুমি এটা করলে! তোমার কি ক্ষতিটা করেছিলাম যার জন্য তুমি এতবড় শাস্তি আমাকে দিলে। তবে শুধু এতটুকু বলব আমার কাছে ক্ষমা চাইবে না। ক্ষমা আমি তোমাকে করতে পারবো না। হৃদয় ভেঙেছে আমার। প্রথম প্রেম, তাও আবার ভুল জায়গায়! লজ্জায়ই মরে যেতে ইচ্ছে করছে ৷ অবশ্য মরতে চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। যাহোক জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না৷ বেঁচে যেহেতু ফিরে এসেছি তাহলে এখন থেকে বাঁচার মতো করেই বাঁচব বাকিটা জীবন৷ তোমরা আমাকে বিরাট এক শিক্ষা দিলে। এর জন্য থ্যাঙ্কিউ। এবার তুমি আসতে পারো৷
— প্রিমা..
— ওহ হ্যাঁ, তোমরা আর এই বাড়িতে থেকো না নীরদ৷ তোমাদের একসাথে দেখলে আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে বড় রকমের ক্ষতি করে ফেলতে পারি। যত দ্রুত সম্ভব চলে যেও এখান থেকে৷ চলে যেও৷
এতটুকু বলে মুখ ফিরিয়ে নিলো প্রিমা। আমি বুঝতে পারলাম এই সমস্যা আর সমাধান করা সম্ভব নয়। ক্ষমা চাইতে, ওকে বোঝাতে এসেছিলাম আমি। কিন্তু মেয়েটা তা চায় না। এই মেয়েটার সাথে করা অন্যায়ের বোঝা হয়তোবা আমাকে আজীবন বইতে হবে। তবে আমি মনভরে দোয়া করি ওর জন্য৷ আজ যে কষ্টটা ও পেলো এই কষ্টটাকে মুছে দিতে এক পৃথিবী ভালোবাসা নিয়ে কেউ আসুক ওর জীবনে। ওর মন আকাশও কখনো ভরে উঠুক ভালোবাসার বর্ণিল রংধনুতে৷
একবুক হতাশা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম করিডরের শেষ মাথায় ইনতিসার আর প্রিমার মা আন্টির মধ্যে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। অবশ্য বাকবিতণ্ডা বললে ভুল হবে। আন্টি সম্ভবত ইনতিসারকে আবারও কড়া কিছু কথা শোনাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগল। মনে হলো এই কড়া কথাগুলো আসলে আমার প্রাপ্য। আসলে আমার এখন গিয়ে মাফ চাওয়া উচিৎ ওনার কাছে। ইতস্তত করে এগিয়ে গেলাম আমি ওদিকে। কাছাকাছি যেতেই একটা কথা কানে ভেসে এলো,
— তোমাদের খারাপ সময়ে যখন কাছের আত্মীয়রাও দূরে সরে গেল তখন কিন্তু এই আমি তোমার মায়ের সাথে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের খাতিরে তোমাদের সাহায্য করেছি । মাথা গোঁজবার ঠাঁই করে দিয়েছি, তোমার খালুর রেকমেন্ডেশনে একটা ভাল কোম্পানিতে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছি৷ আর আজ আমার উপকারের এই প্রতিদান দিচ্ছ তুমি? আমার মেয়েটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে৷ আচ্ছা তুমি বলো তো ওর মধ্যে কিসের কমতি? কেন তুমি ওকে আপন করতে পারো না?
ইনতিসার মাথা নীচু করে বলল,
— খালাম্মা আমি মানছি আমাদের খারাপ সময়ে আপনারা শেল্টার দিয়ে, চাকরির খোঁজ দিয়ে বিরাট বড় উপকার করেছেন। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তার জন্য। কিন্তু প্রিমার এই স্টেপের জন্য আপনি সরাসরি আমাকে কিংবা আমার পরিবারকে ব্লেম করতে পারেন না। মানছি মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আপনার মন মানসিকতা ঠিক নেই। আমিও অপ্রত্যাশিত ঘটনাটার জন্য মাফ চাইতেই এসেছিলাম আপনার কাছে। কিন্তু আপনি এ কেমন আবদার করছেন? কমতির কথা তো আসছে না খালাম্মা৷ আপনি আমার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করুন। ওর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান চিন্তা করুন। কম করে হলেও দশ-এগারো বছরের ছোটো হবে ও আমার থেকে। সবসময় আমি ওকে বোনের চোখে দেখেছি খালাম্মা। বোনের মতো স্নেহ করেছি। আমার স্নেহকে ও কখন অন্য চোখে দেখেছে বুঝতেই পারিনি৷ ওকে ঘিরে যে কখনো এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে আমি কল্পনাও করিনি৷ ও যে হঠাৎ আমাকে…
কথা সম্পূর্ণ করলো না ইনতিসার। আন্টি অস্থির হয়ে বললেন,
— তোমাদের বয়সের তফাৎ নিয়ে তো আমাদের কোনো আপত্তি নেই ইনতিসার৷ তোমার পারিবারিক সমস্যা নিয়েও নেই। আমার মেয়ে ভালোবাসে তোমাকে। ভালোবেসে তো কুঁড়ে ঘরেও থাকা যায়। আমি জানি তুমি দায়িত্ববান ছেলে। তোমার হাতে মেয়ে দিয়ে আমি আর তোমার খালুও নিশ্চিন্ত হতে পারবো। একটাই মেয়ে আমাদের। বড় আদরের। ছোটোবেলা থেকে ওর কোনো চাহিদা অপূর্ণ রাখিনি। ও মুখ ফুটে যা-ই চেয়েছে তা-ই দেয়ার চেষ্টা করেছি আমরা।
— কিন্তু মেয়েকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অন্যের সামনে অন্যায় আবদার করলে তো হবে না খালাম্মা৷ আপনার মেয়ের জীবন আপনাদের নিয়ন্ত্রিত হলেও অন্য কারো জীবন আপনাদের নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। আমি ইনতিসার সব রকমের বাঁধন থেকে মুক্ত৷ আমি কারোর নিয়ন্ত্রণে চলতে পছন্দ করি না এটা আপনি অনেক আগে থেকেই জানেন।
এবার আন্টি খানিক রেগে গেলেন৷ রাগের চোটে তড়িৎ কিছু বলতে পারলেন না৷ তবে ওনার মুখভঙ্গি ভয়ানক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ ক্রোধের দৃষ্টিতে ইনতিসারের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলেন৷ চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নিয়ে বললেন,
— আমাদের বিষয়সম্পত্তি কিছু অংশে কম নয় ইনতিসার। সবটা প্রিমার নামেই করা৷ মেয়ে আমার বোকাসোকা। সম্পত্তির ভার বইতে পারবে না৷ বিয়ের পর সব সম্পত্তি তোমার নামেই ট্রান্সফার হবে। আর আগেও বলেছি তোমাকে আমরা দায়িত্বশীল ছেলে বলেই জানি। তুমি খুব ভালোভাবেই সবটা সামলে নিতে পারবে। আর অমত করো না বাবা।
সম্পত্তির প্রলোভনে ইনতিসারকে আটকানোর শেষ প্রচেষ্টা করলেন উনি। ইনতিসার কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ওনার দিকে। মিনিটখানেক পর ছোটো করে শ্বাস ফেলে আলতো হেসে উঠল। বলল,
— আমাকে আপনি সম্পদের প্রলোভনে আটকাতে চাইছেন খালাম্মা? অতীতে আমার জীবনধারণ কেমন ছিল জানার কথা৷ সম্পদের লোভই যদি আমার থাকত তাহলে আমিও আজ বড় ভাইয়ের মতো অন্য কোথাও সেটেল্ড হয়ে যেতাম। যাকগে কথায় কথা বাড়ে৷ এসব বিষয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে আমার নেই। আমি সহজ ভাষায় বলে দিচ্ছি। মাফ করবেন,আমার পক্ষে প্রিমাকে অ্যাকসেপ্ট করা সম্ভব নয়৷ কারণটা হয়তোবা আপনি জানেন। আপনি আমার মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন। মা সব কথাই আপনার সাথে শেয়ার করতো আমি জানি।
ইনতিসারের এই কথাগুলোর প্রেক্ষিতে আন্টি আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,
— এই মেয়েটা সেই কারণ তাই না?
তারপর গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে আচমকা আমার বাহু চেপে ধরে বললেন,
— তুমি সব নষ্টের গোড়া। কেন ফিরে এসেছ আবার এদের জীবনে? তোমার কারণে একসময় আমার বান্ধবির সংসারে অশান্তি হয়েছে৷ আজ আবার আমার মেয়েটা..
তুমি কোন দিক দিয়ে যোগ্য ইনতিসারের?
বলতে বলতে রাগের বশবর্তী হয়ে হাত ওঠাতে গেলেন আমার ওপর। সেই মুহুর্তে ইনতিসার ওনার হাত ধরে আটকে দিলো। আমায় নিজের দিকে টেনে নিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
— অনেক হয়েছে খালাম্মা আর নয়। আপনি আমার মায়ের বয়সী ভেবে অনেক অন্যায় কথার প্রতুত্তর আমি করিনি। কিন্তু আর চুপ থাকতে পারছি না। আমার লাইফের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার কেবল আমার। আমি কাকে আমার লাইফের সাথে জড়াতে চাইবো, কাকে চাইবো না এটাও আমার সিদ্ধান্ত। আপনার কোনো অধিকার নেই আমার চোখের সামনে আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার কিংবা ওর যোগ্যতা বিচার করার৷
— স্ত্রী!
চমকে ওর দিকে তাকালেন আন্টি। সাথে আমিও। ইনতিসার কাঠিন্য বজায় রেখে বলল,
— হ্যাঁ স্ত্রী।
— কবে বিয়ে হলো তোমাদের? আর বিয়ে যে হয়েছে তার প্রমাণ কি?
— আপনার কীরকম প্রমাণ লাগবে? কাগজ দেখা প্রয়োজন? স্যরি আমি এই মুহুর্তে ওটা ক্যারি করছি না। আপনি বাসায় চলুন তারপর নাহয় দেখাবো।
— তুমি মিথ্যে বলছো ইনতিসার৷
— মিথ্যে নাকি সত্য তার প্রমাণ তো আপনাকে দেখাতে চেয়েছিই। এরপর বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার।
এ্যাই চলো।
বলে আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো ইনতিসার৷
হসপিটালের ভেতর থেকে বাইরে আসা অবধি আমি পুরোটা সময় ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সময় মানুষকে কতখানি বদলে দেয়! এই একটা মানুষকে আমি কখনো ভীষণ অপছন্দ করেছি। তার উশৃংখল আচরণ, তার ডোন্ট কেয়ার ভাব একসময় কতখানি অপছন্দ ছিল আমার। কাছে এলেই কতকিছু বলে অপমান করেছি। তখন এই মানুষটাকে ভালোবাসার কোনো কারণই খুঁজে পেতাম না। অথচ আজ তাকে ভালো না বাসার কারণ খুঁজে পাই না। এই যে ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় কি শক্ত করে চেপে ধরে আছে! এই হাতটা আজ কেবল ভরসা আর সাহস দিতে জানে। আগে এত গুছিয়ে কথা বলতে পারতো না মানুষটা। নিজের ভেতরের কথাগুলো এলোমেলো ভাবে বলতে গিয়ে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করে ফেলতো। আজ সে বেশ গুছিয়ে কথা বলে। তবে আগে যেমন না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতো আজও তেমন না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়৷ যা তার চাই, তা চাই-ই। ঐতো আপোষে নয়তো ছিনিয়ে।
— ঘটনা কি? আজ তোমার দৃষ্টিতে প্রেমের তীব্রতা একটু বেশি। কঠিন নীরদ কি একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে?
ইনতিসারের কথায় আমার ধ্যান ভাঙলো। ওর চোখে উপচে পড়া দুষ্টুমি৷ লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি। লজ্জা থেকে বাঁচতে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
— জিহ্বার আগায় বাজে কথা ঘুরে বেড়ায় সবসময়।
— বাজে কথা! আমার ভালোবাসা বাজে কথা? নীরদ তুমি আমার ভালোবাসারে মিনিটে মিনিটে অপমান কইরা যে অপরাধগুলা করছো৷ সব লিখে রাখছি আমি । কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা হবে কিন্তু তোমার।
— উমহ্ আসছে।
ভেংচি কাটলাম আমি।
— হেই ডোন্ট আন্ডারস্টিমেট মি।
হেঁচকা টানে বুকে ফেলে বলল ইনতিসার৷ আশেপাশে তাকিয়ে ত্রস্তে সরে সরে যেতে যেতে আমি চোখ রাঙালাম ওকে।
— মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? রাস্তায় কত লোক দেখেছেন? টানাটানি করছেন লোকে কি বলবে দেখলে?
— লোকের কথায় এই ইনতিসার চলে না। ইনতিসার তার আপন মর্জির মালিক।
চোখ টিপ দিয়ে রিকশা ডাকলো ইনতিসার। উঠে বসতে বসতে আমি বললাম,
— আন্টির সামনে কি বললেন ওটা? আমি আপনার স্ত্রী হলাম কবে?
— হওনি, হবে।
খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল সে।
— সবকিছু এত সহজ ইনতিসার?
— সহজ মনে করলে সহজ। সবটাই মনের ওপর ডিপেন্ডেবল।
আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল ও৷
আমি তৎক্ষনাৎ কিছু বললাম না৷ ইনতিসারই আবার বলে উঠল,
— অনুভূতিগুলোকে শব্দের রূপ দিতে শেখো নীরদ৷ জ্ঞাত সত্যটাকে একটাবার শুধু প্রকাশ করে দেখো। শুধু একটাবার বলো তুমিও আমাকে চাও আমার মতোই তীব্রভাবে; একটাবার বলো ভালোবাসা নামক প্রিয় অসুখটা আমার মতো করে তোমাকেও ছুঁয়ে ফেলেছে। লেট মি হিয়ার দোজ ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ডস ফর ওয়ান্স।
কাতর চোখে চাইলো আমার পানে ইনতিসার৷ ওর চোখে চোখ রাখতেই আমার হৃদয়ে অন্যরকম এক ঢেউ উঠল। যার সম্পর্কে আমি আগে অবগত ছিলাম না। মিনিটখানেক পূর্বেও প্রকৃতিতে প্রখর তাপদাহ। কিন্তু ওর চোখে তাকাতেই মনে হলো দক্ষিণ কোণে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আকাশে কি মেঘ জমেছে কোনো? প্রেমবৃষ্টি নামক যে একটা রূপক শব্দ আছে। আমরা তার সাথে বাস্তবে পরিচিত হবো না?
ইনতিসারের ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল আমার। আমার ভেতরের অবস্থাটা কোনোভাবে বুঝতে পারলো বোধহয় ও। কিছু একটা চিন্তা করে হঠাৎ আমার ওড়নার একপ্রস্থ টেনে চিকন করে ছিঁড়ে নিয়ে কিছু একটা করলো। অবাক হয়ে দেখলাম পেঁচিয়ে আংটির শেপ বানাচ্ছে। বানানো হয়ে গেলে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— উইল ইউ ম্যারি মি নীরদ?
আকাশে মেঘ জমেছে কি না জানা নেই তবে আমার চোখে যে মেঘগুলো জমে ছিল তা গলে অচিরেই অশ্রু হয়ে ঝরতে শুরু করলো। হাত বাড়িয়ে মাথা ওপর নীচ করে কাঁপা স্বরে আমি বললাম,
— ইয়েস। আই উইল।
এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। আমার অনামিকায় ওর মাত্র বানানো আংটিটা পরিয়ে দিতে দিতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল,
— এখন কি আমার চিৎকার করে বলা উচিৎ “পাইলাম, অবশেষে আমি তাহাকে পাইলাম”?
এবং আমাকে একটা কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলন্তা রিকশায় উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত প্রসারিত করে সত্যি সত্যি চিৎকার করে বলে উঠল,
“ইয়েস! ফাইনালি সি’ইজ গন্না বি মাইন। হে পৃথিবী শুনে রাখো আজ থেকে নীরদ শুধুমাত্র ইনতিসারের। শুধুমাত্র ইনতিসারের”
ওকে দাঁড়াতে দেখে আতংকে আমি ওর হাত টেনে ধরলাম। সাথে এও উপলব্ধি করলাম পাগলটার পাগলামির কারণে রিকশাওয়ালা মামা তো বটে, পুরো রাস্তার মানুষ আমাদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়েছে৷ লজ্জায় ওকে টেনে বসিয়ে পুনরায় চোখ রাঙিয়ে বললাম,
— কি হচ্ছেটা কি?
ও হাসতে হাসতে আমার গালে হাত দিলো। আর্তির সুরে বলল,
— এবার ঐ ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ডটা। প্লিজ?
আমি ওর পাগলাটে আচরণে হেসে ফেললাম। কথা বলতে গেলে লজ্জা জেঁকে ধরলো৷ যথাসম্ভব ফিসফিসিয়ে বললাম,
— ভালোবাসি।
ও তড়িৎ রিকশার হুড তুলে দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিলো। বলল,
— আর একবার?
— ভালোবাসি, ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি ইনতিসার। ভীষণ।
ও তীব্র আবেগে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম ও চোখ ছলছল করছে। চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করতে ও আমার গালে আলতো করে ঠোঁট চেপে ধরলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠল,
— তাহলে হসপিটালে বলা মিথ্যেটাকে আজ সত্য করে দিই?
আমি ওর চোখে চোখ রেখে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালাম। এবারে ও চোখের পানিটা আটকাতে পারলো না৷ আমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে ফিরলো যেন আমি ওর চোখের পানি না দেখতে পারি৷ আমিও ওর হাত জড়িয়ে ধরে বাহুতে মুখ গুঁজে রইলাম।
সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ও পকেট থেকে সেলফোন বের করে কাউকে একটা কল করলো৷
তারপর সেদিন বিকেলে তিন কালেমার জোরে আমার নামটা সারাজীবনের জন্য ওর নামের সাথে জুড়ে গেল। নাবিহা ওয়াসিমাত নীরদ থেকে আমি পলকেই মিসেস ইনতিসার ইলহাম হয়ে গেলাম৷
_______________________
৭২.
রাত্রিবেলা ইশি আপু তার মায়ের বিয়ের শাড়ি, কিছু গয়না দিয়ে আমায় সাজিয়ে দিয়ে গেল।
ইনতিসারের আসা পর্যন্ত চেনা ঘর, চেনা বিছানাটাকে নতুনত্বের স্বাদ নিয়ে ঘুরে দেখতে লাগলাম আমি। ঘুরতে ঘুরতে বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট ডেস্ক টেবিলটার আধ খোলা ড্রয়ারে চোখ চলে গেল। আগ্রহী হয়ে ড্রয়ারে উঁকি দিতেই উডেন কভারের স্কেচবুক নজরে পড়ল একটা৷ নিশ্চয়ই এটা ইনতিসারের? ঐতো কভারের ওপর খোদাই করে ওর নামটা লেখা৷ ওটার সৌন্দর্য দেখেই নাকি অতি আগ্রহে হাতে টেনে নিলাম স্কেচবুকটা৷ ওটা হাতে নেয়ার পর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ রইলো না আমার । উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে প্রথম পৃষ্ঠা খুলে ফেললাম। খুলতেই নজরে পড়লো পুরনো অতি পরিচিত এক দৃশ্য। হু, বছর কয়েক আগে প্রথমবার যখন ইনতিসারকে দেখলাম আমি, সে রাতের দৃশ্যটা। একটা আহত ছেলেকে বন্ধুরা ধরাধরি করে গাড়ি থেকে নামাচ্ছে অন্যদিকে কাঁচের জানালা ভেদ করে উৎসুক চোখে তাকে দেখছে একটা মেয়ে। আমাদের প্রথম দেখার মুহুর্তটা! কি সুন্দর করেই না এঁকেছে মানুষটা। একদম জীবন্ত লাগছে। ভীষণ আবেগে হাত বুলিয়ে দিলাম আমি ছবিটায়। এরপর একের পর এক পৃষ্ঠা ওল্টাতে আমাদের একসাথে তৈরি হওয়া প্রত্যেকটা মুহুর্তের ছবি দেখতে পেলাম ওখানে। আমাদের ঝগড়া, আমাদের ভালো-খারাপ সব মুহুর্তই খুব যত্নে বন্দী করে রেখেছে সে এখানে। দেখতে দেখতে সর্বশেষ ছবিটায় এসে আরেকবার চোখ আটকে গেল আমার৷ যেদিন রাতে ব্যালকনিতে প্রথমবার ওকে জড়িয়ে ধরলাম ! সেই মুহুর্তটাও এঁকেছে। স্কেচটার পাশে আবার ছোট্ট করে “ভিজুয়ালাইজেশন”কোট করে আরো একটা স্কেচ করা। যেখানে আমি স্মিত হাস্যে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। ও করতলে আমার মুখখানা তুলে ধরে অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে আছে। পাশে দু’লাইন লেখা
“শোনো কাজল চোখের মেয়ে, আমি তোমার হবো ঠিক, তুমি ভীষণ অকূল পাথার, আমি একরোখা নাবিক”
লেখাটায় হাত বোলাতে বোলাতে আমার চোখ ছলছল করে উঠল৷ এমন সময় পাশ থেকে ইনতিসারের গলা ভেসে এলো,
— এটা তো রীতিমতো চুরি হয়ে গেল মিসেস৷
ওর কণ্ঠ শুনেই কি না কে জানে! জমাটবাঁধা জলগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না আমি। টুপটুপ করে ওরা ঝরে পড়তে শুরু করলো
চোখ থেকে। স্কেচবুকটা তুলে ধরে তার দিকে তাকিয়ে ভাঙা স্বরে বললাম,
— লেখাটা তো সত্যি করলে। ভিজুয়ালাইজেশনটা এবার বাস্তব করা যায় না?
ও অবাক হলো না৷ যেন জানতো এমন কিছু হবে। মাথা নীচু করে মৃদু হেসে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো আমার কাছে। আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে করতলে আমার মুখখানা তুলে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
” কাজল চোখের মেয়ে আমি তোমার হলাম ঠিক। যতই অকূল পাথার হও, মানলে তো, আমিও একরোখা নাবিক”?
আমি ঠোঁট কামড়ে আসন্ন কান্নাটাকে আটকাতে চাইলাম। উঁহু পারলাম না। আমার কান্নার দমক আটকাতে ইনতিসার আরেকটু ঝুঁকে এলো আমার দিকে। পালোকস্পর্শোর মতো ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে আমার মাথাটা ওর বুকে চেপে ধরে মৃদু হেসে বলল,
— বিয়ের রাতে বউকে নাকি গিফট করতে হয়? আমি অধম যে মাসের শেষে হাত খালি অবস্থায় বিয়ে করলাম এখন এই খালি হাতে আমার “কিচ্ছু লাগবে না” বলা বউটাকে কি গিফট করি?
আমি ঠিকই বলতে চাইলাম “কিচ্ছু লাগবে না”। কিন্তু আমার বলার আগেই ও ঠোঁটে তর্জনী চেপে ধরে অন্য হাত দিয়ে পকেট থেকে কিছু একটা বের করে সামনে মেলে ধরলো। তাকিয়ে দেখি আমার জন্মদিনে বাবার দেয়া সেই চেইনটা যেটা ও একদিন নিয়েছিল। ওতে আবার নতুন একটা লকেট ঝুলছে। সহাস্যে চেইনটা গলায় পরিয়ে দিতে দিতে ইনতিসার বলল,
— স্যরি আগের লকেটটা ভেঙে নতুন করে করিয়ে নিয়েছি। মা ডিজাইন পছন্দ করে দিলো। এখন যে ফুলের পাপড়ি শেপ লকেটটা দেখছো এতে কিন্তু আমার নাম লুকনো আছে৷ মায়ের হাতে দিয়েছিলাম সে কখন এটা করে নিয়েছে জানি না৷
আমি বিড়বিড় করে বললাম,
— ভালো হয়েছে এখন তুমি সবসময় আমার কাছে।
ইনতিসার শুনতে পেয়েছে আমি জানি কিন্তু বুঝতে দিলো না। চেইন পরিয়ে কাঁধে আলতো করে চুমু খেয়ে নাক স্লাইড করতে করতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে বলল,
— ইউ হ্যাভ ইনটক্সিকেটিং স্মেল। উমম লাভড ইট৷
আমার ওর কথার দিকে খেয়াল নেই। আমি ভাবছি বিয়ের রাতে যদি বউকে গিফট দিতে হয় তাহলে তো বরকেও দেয়ার নিয়ম। এখন আমি তাকে কি উপহার দিই?
অসহায়ভাবে তাকালাম। সে বোধহয় বুঝতে পারলো আমার অবস্থা।
ঈষৎ ঝুঁকে আবিষ্ট গলায় বলল,
— লেট মি হ্যাভ ইউ। ইট উইল বি দ্য বেস্টেস্ট গিফট এভার ফর মি৷
তারপর করতলে আমার মুখ তুলে নিয়ে আবারও ফিসফিসিয়ে উঠল,
— জাস্ট লেট মি শো ইউ ওয়ান্স; হাউ ইন্টেন্সলি আই ওয়ান্ট ইউ। প্লিজ।
ওর চোখের আর্তি আমার মনটাকে নিমেষে ব্যাকুল করে তুলল৷ কিছু না বলে ওর বুকে মুখ গুঁজে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমি। প্রাপ্তিতে আলতো হাসলো ও।
বিড়বিড় করে বলল,
“এ আমাদের নতুন শুরু নীরদ। আমাদের নতুন শুরু”
চলবে,
Sinin Tasnim Sara