ভালোবাসার রংধনু ৩৮

0
888

ভালোবাসার রংধনু
৩৮
_______________
৭৩.
দিন দুয়েক পর বাড়িওয়ালাদের তরফ থেকে নোটিশ এলো বাড়ি খালি করতে হবে। আমি ভয় পেলাম ইনতিসারের চাকরিটাও না চলে যায়! সৃষ্টি কর্তার অশেষ রহমত চাকরিতে কোনো এফেক্ট পড়লো না। আমরা অবশ্য আগে থেকেই জানতাম এরকম কিছু হবে। প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম সবকিছুর জন্য। এত কম সময়ে ঢাকা শহরের বুকে বাড়ি পাওয়া দুষ্কর। তাই ইশি আপুদের বাড়িতে ওঠার সিদ্ধান্ত হলো কয়েকদিনের জন্য৷ আমরা ওখানে উঠব শুনে ওনারা আহ্লাদে-খুশীতে আটখানা।
কিন্তু সমস্যা হলো আপুদের তিন কামরার ফ্ল্যাট৷ অসুস্থ শ্বশুর মশাই, আপা। ওনাদের কথা চিন্তা করে ইনতিসার তুহিন ভাইকে বলল বাড়িওয়ালাকে বলে চিলেকোঠার ঘরটা কয়েকদিনের জন্য ভাড়া নেয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। আমরা দু’জন ওখানেই থাকব। তুহিন ভাই তো কিছুতেই রাজি হবেন না৷ তার কথা নতুন বউ সমেত কখনোই এরকম চলনসই ব্যবস্থা করা যাবে না। প্রয়োজন হলে অ্যাডজাস্টমেন্ট উনি আর আপু করবেন৷ বিপরীতে ইনতিসার ওনাকে বুঝিয়ে বলল “আপু এখন একা নয়। এসব আতিথেয়তার আগে তার মধ্যে বেড়ে ওঠা নতুন সদস্যের কথা ভাবতে হবে। আর আমাদের তো ওখানে থাকতে সমস্যা নেই। তাহলে তুহিন ভাই এত ছোটো ফীল করছেন কেন?”
তুহিন ভাই তবুও গাঁইগুঁই করছিলেন। পরে ইনতিসারের সাথে আমিও যোগ দিলে আর না করতে পারলেন না। পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তীতে চিলেকোঠাটা আমরা ভাড়া নিলাম।পুরোনো বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কিছু ফার্নিচার খুব আগ্রহ নিয়ে দু’জন মিলে ওতে সাজালাম। ঘরের সাথে মানানসই পর্দা আর কয়েকটা গাছ ও জানালায় ঝুলিয়ে দিলো। আস্তে আস্তে চার হাতের ভালোবাসায় ছোট্টো সেই ঘরটাকে নিজেদের একটা পৃথিবী বানিয়ে ফেললাম আমরা;মায়ার পৃথিবী। যে পৃথিবীতে কোনো দুঃখ নেই, কোনো যাতনা নেই কেবল স্নিগ্ধ ভালোবাসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে আনাচে-কানাচে। ও অফিসে বেরিয়ে গেলে আমার বাকি দিনটা কাটে আপুদের বাসায়। আবার ও ফিরলে সবার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে আমায় সাথে নিয়ে চলে আসে আমাদের শান্তির নীড়ে। ওর আঁকার অভ্যেস৷ কখনো রাত বিরেতে সেই আঁকাআঁকির ভূত মাথায় চাপে৷ তারপর ঘুম বাদ দিয়ে জানালার ধারে বসে আঁকিবুঁকিতে লেগে পড়ে। তখন আমাকেও তার পাশে বসে থাকা চাই রাতভর।এই করে করে আমরা আমাদের নতুন সংসারের নিত্য নতুন গল্প বুনি। আমাদের গল্পের সঙ্গী হয় আকাশভরা ঝিকিমিকি তারা, সোনার ডিমের মতো চাঁদ। কখনোবা হয় শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টি। কখনো তাঁর আঁকতে ইচ্ছে করে না৷ ঝলমলে জ্যোৎস্না ধারায় গা ভাসাতে ভাসাতে আঙুলের ফাঁকে আঙুল ডুবিয়ে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের চিন্তায় লেগে পড়ে সে। কখনোবা সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো প্রেমের জোয়ার নামে আমাদের পৃথিবীতে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় অন্য জগতে ।
দীর্ঘদিনের বিরহের পর এই প্রেমের সময়গুলোকে খুব উপভোগ করি আমরা। দিন যায়, মাস যায় প্রেমের তীব্রতা বাড়ে। এক মুহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করতে চায় না আমাকে। কে জানে মানুষটা এত পাগলামো কেন করে! তার এসব পাগলামো দেখে আড়ালে সবাই হাসাহাসি করে। আপা আমাকে দেখলেই ঠাট্টা করে ডাকে, বর সোহাগী। ইশি আপু আবার ইনতিসারের আচরণ দেখলে রেগে যায়৷ ধমক দিয়ে বলে, এমন বউ পাগল কবে থেকে হয়েছিস হ্যাঁ? একটুখানি বসতেও দিস না বউকে আমাদের পাশে। এক সেকেন্ডের জন্যেও কি চোখের আড়াল করা যাবে না।আমরা তোর বউকে গুম করে দেব? অসভ্য৷
ইনতিসারের ফারাক পড়ে না এসব খোঁচায়। দিব্বি ঘর ভরা মানুষের সামনে সে আমার হাত জড়িয়ে ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
— দশটা নয় পাঁচটা নয় একটা মাত্র বউ আমার। চোখের আড়াল করবো কেন? কত কাঠখড় পুড়িয়ে বউ এনেছি জানিস?
ওর এসব পাগলামো দেখলে ভীষণ লজ্জা পায় আমার। মাঝেমধ্যে প্রীতম সাহেবের বলা একটা কথা মনে পড়ে, “ইনতিসার কখনো কারো ওপর স্থির হবে আমরা ভাবতেও পারিনি”
আমিও অবাক হই। বেপরোয়া ছেলেটা কখনো কাউকে এমন জীবন-মরণ ভালোবেসে ফেলবে, কখনো ভালোবাসতে বাসতে নিজের মাথায় বউ পাগল তকমা লাগিয়ে নেবে স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। এটাও কল্পনা করিনি যার জন্য এতকিছু সেই মানুষটা আবার আমি হবো। আসলে ভাগ্য আমাদের কখন কোন অদ্ভুত মোড়ে নিয়ে যায় বলাই যায় না।
_____
দেখতে দেখতে সংসার জীবনের পাঁচ মাস পার করে গেলাম আমরা। ইদানীং আর সময় করে বসা হচ্ছে না একসাথে। আপার শরীরের অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। দিন-রাত একবুক আতঙ্ক নিয়ে বসে থাকি ওর পাশে। এক মুহুর্ত একা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। ওর ব্যথা, যন্ত্রণা সব সামনে থেকে দেখি। ভয়ে কলিজা কেঁপে ওঠে আমার৷ যখন দেখি ব্যথায় কাঁদতে কাঁদতে নিজের মৃত্যু কামনা করছে তখন কি যে অসহায় লাগে আমার নিজেকে! মাঝেমধ্যে একটু সুস্থবোধ করলে বায়না ধরে এটাসেটা খাওয়ার। আমি ছুটে গিয়ে রান্না করে নিয়ে আসি। কিন্তু খাবারটা মুখে দিতে পারে না। দু একবার খেলে বমির সাথে বেরিয়ে যায়৷ চোখের সামনে নিজের বোনকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখা কতখানি কষ্টের বোঝাতে পারি না কাউকে। প্রায়ই মনে হয় এসব দেখতে দেখতে বোধহয় মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি । এখন এক সেকেন্ডের জন্য আপাকে মাথা থেকে সরাতে পারি না। সামনে না থাকলেও মনে হয় ওর জীর্ণ শরীরটা দেখছি। আমার ঠিক সামনে শুয়ে ও কাতরাচ্ছে। ওর যন্ত্রণাভরা চিৎকারগুলো আমার কানে সূঁচালো আঘাত হানছে। কান চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদি আমি। ইনতিসার আমায় কাঁদতে দেখলে বোধহয় ভয় পায়। শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। কান্না থেমে গেলে কাতর স্বরে বলে, ডাক্তারের কাছে যাবে নীরদ? সাইকিয়াট্রিস্ট?
বিপরীতে আমি কিছু বলি না। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়ে কি হবে৷ সে তো আমাকে ঠিক করতে পারবে না৷ আমাকে ঠিক করতে পারবে একমাত্র আপার সুস্থতা। আচ্ছা আমার আপার সাথেই কেন এমন হলো? পৃথিবীতে আরো কত কত অসুখ, ট্রিটমেন্ট নিলেই ঠিক হয়ে যায়। আপারটা কেন হলো না? আপাকেই কেউ কেন সুস্থ করতে পারল না?
সব্বাইকে এই প্রশ্নটা করি। কিন্তু উত্তর কারোর কাছেই পাই না৷

আপা খানিক পর পরই আমাকে ডেকে পাঠায়। হাত ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “বড়পা, মেজোপাকে বলেছিলি আমার শরীরের অবস্থা? ওরা আমাকে দেখতে আসে না কেন রে? বোনের প্রতি কোনো টান নেই ওদের৷ আমি কি এতই খারাপ?”
আপার কথা শুনলে আমার যন্ত্রণা বেড়ে যায়৷ বড়পা, মেজোপাকে অনেক আগেই খবর দিয়েছিলাম আমি। তাদের কোনো ফারাক পড়েনি এসবে। একজন তো বাইরে থাকে সেই দোহাই দিয়ে কেটে পড়েছে । আরেকজন বিরক্ত হয়ে বলেছে,
“ভরা সংসার যখন ছিল, সুখের কমতি ছিল না তখন তো মেজো বোনকে মনে পড়েনি। আজ অসুস্থ হয়ে এত মনে পড়ছে কেন? আমি কিছু বুঝি না ভেবেছিস। সবই প্রয়োজন। টাকার প্রয়োজন। শোন, বলে দে সেজোকে, সে নিজে একদিন আমাদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। তারপর থেকে আমরা ভুলে গেছি আমাদের কোনো ছোটো বোন আছে৷ ও বাঁচুক আর মরুক আমাদের কিছু যায় আসে না । বারবার ফোন করে বিরক্ত করতে যেন না দেখি”
মেজোপার কথা শুনে আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম সেদিন। বিশ্বাস করতে পারিনি স্বার্থে কেউ কখনো এতটা অন্ধ হতে পারে যে সহোদরার প্রতিও তার কিঞ্চিৎ মায়া অবশিষ্ট থাকে না৷ এই এরা নাকি আমাদের বড় বোন। একই মায়ের পেট থেকে সবার জন্ম তবুও মনটা সবার ভিন্ন কেন? আপাকে তো আর সত্যিটা বলতে পারি না। বানিয়ে বানিয়ে বলি,
— আসবে জলদি আসবে তারা।
আপার চোখ খুশিতে চকচক করে।
— সত্যি আসবে বলছিস?
— আসবে তো। আমি নিজে কথা বলেছি।
আপা ভরসা পায়। হাসে। হাসতে হাসতে আবার কেঁদে ওঠে। বলে,
— জানিস আম্মার মুখটা এখন আর মনে পড়ে না আমার। কিন্তু আব্বার মুখটা মনে পড়ে। মাঝেমধ্যে আমি স্বপ্ন দেখি আব্বা আম্মা একসাথে বসে আছেন একটা বাগানে। ফুলের বাগানে৷ গল্প করছেন, হাসছেন। ওনাদের খুব সুখী মনে হয় স্বপ্নে। বহুদিন পর আবার এক হতে পেরে খুব খুশী বোধহয় ওনারা৷ ওনাদের একসাথে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে যায় রে নীরদ৷ আমার মনে হয় যদি ছোটো হয়ে যেতে পারতাম আবার। আম্মার কোলে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকতাম, ঠিক ছোটোবেলার মতো৷ জানিস তো আম্মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। ছোটোবেলায়…

এতটুকু বলে থেমে যায় আপা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আমি ওকে ডাকি,
— আপা তারপর বলো?
আপা নির্জীব পড়ে থাকে। তারপর আচমকা আমার গালে হাত রেখে অসংলগ্ন ভাবে বলে,
— আম্মার চেহারা আবছা মনে পড়ছে নীরদ। একদম তোর মতো। তুই আম্মার ফটোকপি হয়েছিস। আম্মার মতো চোখ ঝলসানো রূপ, মাথাভরা চুল। তুই আম্মার মতো সহজ-সরলও। তোর গায়ে আম্মার মতো গন্ধ আছে। এই যে তোর আম্মার সাথে এত মিল তাই হয়তো অন্য দুই বোনের মতো আমি তোকে অবহেলা করতে পারিনি। তোকে যত্ন করেছি মানে আম্মার যত্ন করেছি তাই না? তাহলে আমার মৃত্যুর পর আমি আবার আম্মার কাছে ফিরে যেতে পারবো, না নীরদ? আচ্ছা মৃত্যুর পর সন্তানেরা কি তাদের মা-বাবার সাথে দেখা করতে পারে?
আপার প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারি না আমি। চট করে ওর মুখ চেপে ধরে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলি,
— মরার কথা বলবে না আপা। তুমি চলে গেলে আমি একা হয়ে যাব না? কে আছে আমার তুমি ছাড়া।
আপা মুচকি হেসে আমাকে বুকে টেনে নেয়। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
— কেন ইনতিসার আছে। ও তোকে সারাটা জীবন বুকে আগলে রাখবে দেখিস। খুব অদ্ভুতভাবে ওর মধ্যে আমাদের আব্বার ছায়া আছে। জানিস তো আব্বা আম্মাকে এরকম ভালোবাসতেন।
বলতে বলতে আপা তৃপ্তির হাসি হাসে৷ আমি আপাকে আরেকটু আঁকড়ে ধরি। বিড়বিড় করে বলি,
— আমার তোমাকেও লাগবে।
— মানুষ কি সবসময় সবাইকে পাশে পায় রে? একজন আসে আরেকজন চলে যায়৷ যোজন-বিয়োজনেই তো জীবন। তোর আমার সঙ্গ বোধহয় এতটুকুই ছিল ৷
কথা বলার এক পর্যায়ে আপা উদাস হয়ে যায়৷
— আমার জীবনে তেমন কোনো অপ্রাপ্তি নেই। শুধু ভালোবাসার মানুষটাকে ধরে রাখতে পারিনি। এখন ইঊশার বাবাকেও মনে পড়ে খুব৷ মানুষটা যে কেন শেষের দিকে ওরকম হয়ে গেল। সে যদি না পাল্টাতো তাহলে আমাদের জীবনটা আজ অন্যরকম হতো তাই না নীরদ?
— হ্যাঁ তাই। অনেক কথা হয়েছে। এখন ঘুমোও তো তুমি। ইশশ ঘুম বাদ দিয়ে তোমার এত গল্প!
নিজেকে সামলে নিতে আপাকে থামানোর চেষ্টা করি আমি। আপা আলতো হেসে চোখ বন্ধ করে। ওকে ঠিকমতো শুইয়ে দিয়ে বেরোনোর সময় আমি শুনতে পাই বিড়বিড় করে বলছে,
— তুই একদিন লাল শাড়ি পরিস তো নীরদ। বিয়ে করলি কামিজ পরে। লাল শাড়িতে তোকে কত মানায়! একদিন টুকটুকে বউ সেজে আমার সামনে আসবি তো৷ চোখ জুড়িয়ে দেখবো তোকে। আমার পুতুল বোনটা পুতুল বউ সাজবে। চোখ জুড়িয়ে যাবে আমার, চোখ জুড়িয়ে যাবে।

আমার মাথায় আপার কথা গেঁথে যায়। ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবি আমার তো লাল শাড়ি নেই। তাহলে কীভাবে পরবো? নাহ্ দ্রুতই ব্যবস্থা করতে হবে। আমার আপা দেখতে চেয়েছে আমায় লাল শাড়িতে। তার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখব না আমি।
ঘরে ফিরতেই দেখি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে ইনতিসার। মেঝেতে বসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে। দীর্ঘশ্বাস চেপে দরজা আটকে ওর পাশে গিয়ে বসি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই এলিয়ে পড়ে আমার কাঁধে। ঘুম ঘুম গলায় জিজ্ঞেস করে,
— ভাবি ঘুমিয়েছে?
— হু। তুমি মেঝেতে কেন? বিছানায় উঠে শো।
— শোবো।
— এখনই চলো।
টেনে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিই ওকে। ও সাথে আমাকেও টেনে নেয় বুকে। ফিসফিসিয়ে বলে,
— এত দেরি করো আজকাল। জানো না তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসতে চায় না?
ওর কথার পৃষ্ঠে আমি নিশ্চুপ থাকি। ভাবনার খেয়ালে ডুবে একসময় বলি,
— মানুষের জীবনটা খুব অনিশ্চিত ইনতিসার। প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় আমার মনে হয় পরদিন সকালবেলা যদি আর উঠতে না পারি? তোমাকে আবারও দেখতে না পারি৷ খুব অকস্মাৎ যদি হারিয়ে যাই তোমার জীবন থেকে তুমি কি…
আমার কথাটা সম্পূর্ণ করতে দেয় না ইনতিসার। ঠোঁটের ওপর তর্জনী চেপে ধরে দৃঢ় গলায় বলে,
— অনেক সাধনার পর আমি তোমাকে পেয়েছি। এত জলদি হারাতে দেব ভেবেছ? তুমি যেখানেই হারাও না কেন মনে রাখবে একদিন আমাদের আবারও দেখা হবে। দেখা হতেই হবে। তোমাকে খুঁজতে পুরো পৃথিবী তোলপাড় করে দেব আমি।
সৃষ্টিকর্তাও জানেন এই ইনতিসারের প্রাণ নীরদ। তিনি এখন যেমন আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন, আমার বিশ্বাস বারবার এমনি করে মিলিয়ে দেবেন।
আমার আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না। ইনতিসারের বুকে মুখ লুকিয়ে একমনে প্রার্থনা করি, তাই যেন হয়। এই মানুষটার থেকে আর কোনো অবস্থাতেই হারাতে চাই না আমি৷ কোনো অবস্থাতেই না।

_______________
৭৪.
এরপর সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা। শ্রাবণের শেষ সময়। প্রকৃতির নিয়মে রোজ একপশলা করে বৃষ্টি নামে। আপার বৃষ্টি খুব পছন্দ। বৃষ্টি নামলেই বিছানার পাশে জানালাটা খুলে দিতে বলে। গ্রীলের ফাঁক গলিয়ে যে বৃষ্টির ছাঁট আসে কাঁপা কাঁপা হাতে ওগুলো ছোঁয়ার চেষ্টা করে। আমি বাঁধা দেই না। এতটুকু আনন্দ ভোগ করার অধিকার ওর আছে। রোজকার মতো সেদিনও এমন বৃষ্টি নেমেছিল। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সকাল বেলাতেই আমি ওর কাছে চলে এসেছিলাম৷ অন্যান্যরাও বৃষ্টির জন্য সেদিন বাড়িতে বসা। আপা সেদিন একটু বেশিই চুপচাপ। বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। রোজ কথার ফুলঝুরি খুলে বসে৷ অথচ সেদিন ওর মুখে কথাই নেই তেমন৷ আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলাম ওকে। বোঝার চেষ্টা করছিলাম ওর মনোভাব। মনে হচ্ছিল অন্যান্যদিনের তুলনায় একটু সুস্থবোধ করছে। কিন্তু কে জানতো ওর ঐ সুস্থতার স্থায়ীত্ব খুব অল্প;খুব।
আনমনে বৃষ্টি দেখতে দেখতে একসময় খুব দুর্বল স্বরে আপা আমার নাম ধরে ডাকল,
— নীরদ।
আমি ওর পাশেই বসা। আরেকটু এগিয়ে গেলাম৷
— বলো আপা?
— মাফিন বাবুকে ডাকবি? আর ইনতিসারকেও৷
— এক্ষুণি ডাকছি আপা।
তৎক্ষণাৎ ফোনটা নিয়ে ইনতিসারকে কল করে দিলাম আমি। ফোন পাওয়া মাত্র ইঊশা সমেত নেমে এলো ও নিচে।
ইঊশাকে দেখেই আপা মুচকি হেসে দু’হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে কোমল স্বরে বলল,
— বাবা আজকে তোকে কিছু কথা বলব। মন দিয়ে শুনবি। হয়তো অনেক কথাই আজ বুঝতে পারবি না। কিন্তু সময় হলে আস্তে আস্তে সবটা বুঝে যাবি। অতদিন তো আমার হাতে সময় নেই বাধ্য হয়ে তাই আজই কথাগুলো বলতে হচ্ছে। মাফ করিস তার জন্য।
আমি জানি মা হিসেবে আমি তোকে তেমন কিছু কখনো দিতে পারিনি। আমার সারাটা জীবন শুধু লড়াই করেই কেটে গেছে। তোর জীবনে সেরকম কোনো ভূমিকা আমি রাখতে পারিনি। এখন আর সে সময়ও অবশিষ্ট নেই৷ তোর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখে যেতে পারব না এই কষ্টটা আমায় সবসময় তাড়া করে বেড়িয়েছে। আর আজ সেই কষ্টটা নিয়েই আমায় চলে যেতে হচ্ছে। আমি তোকে সুস্থ একটা বর্তমান না দিতে পারলেও ভালো ভবিষ্যৎ দিয়ে যেতে চাই। আমার মৃত্যুর পর তুই কখনোই আমাকে নিয়ে কষ্ট পাবি না, আমার জন্য কাঁদবি না৷ এই যে আমার পাশে বসা এই দু’জনকে দেখছিস? আমার পর এদের দু’জনকে নিজের মা-বাবা বলে জানবি।
আপার কথা শুনে অজানা ভয়ে আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমি আটকাতে চাইলাম ওকে এসব কথা বলার থেকে। কিন্তু ইনতিসার ইশারায় থামিয়ে দিলো আমাকে।
ওদিকে ইউশা মায়ের কথা শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেছে। আপা ওর চোখ মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে আবারও বলল,
— শক্ত হ বাবা। আমার কথা মন দিয়ে শোন৷ জীবনে তোকে অনেক বড় হতে হবে। এক জীবনে আমার ব্যর্থতা অনেক। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা আমি আমার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারিনি। কিন্তু তুই তোর স্বপ্ন ঠিক পূরণ করবি। আমার দোয়া থাকবে তোর সাথে। নিজ চোখে তোকে সফল হতে দেখে যেতে পারলাম না ঠিক, কিন্তু মনে রাখবি তোর সফলতার মধ্য দিয়ে তুই আমাকে খুঁজে পাবি।
তারপর আমাদের দিকে ইশারা করে বলল,
— এই মানুষ দুটোকে মন থেকে মেনে নিস বাবা। এই পৃথিবীতে এরাই আছে একমাত্র যারা সবসময় তোর পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
এই পর্যায়ে ইনতিসার আপার পাশে গিয়ে বসলো। ইঊশাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আপাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— ভাবি এসব কথা বলার তো আরও সময় আছে। কোথাও যাচ্ছ না তুমি বুঝতে পেরেছ? তুমি নিজে আগে শক্ত হও।
আর ইঊশা তুই একদম কাঁদবি না। মা অসুস্থ তাই এসব বলছে।
ইনতিসারের কথার পৃষ্ঠে আপা মৃদু হাসলো। ছলছল চোখে বলল,
— মানুষ মৃত্যুর কথা বুঝতে পারে ইনতিসার। অনেক তো হলো ভাই। আর কত নেবে শরীরটা? এরও তো মুক্তি চাই বলো৷ আজ এ খুব করে চাইছে সমস্ত যন্ত্রণার থেকে মুক্তি পেতে। ভেতরটাও আর পারছে না। অনেক সংগ্রাম করেছি তো। এবার আমার ছুটি চাই। লম্বা ছুটি।
— আপা তুমি চুপ করো তো।
হাত জোড় করে বললাম আমি। আপা শুনলো না আমার কথা। একমনে বলে যেতে থাকলো,
— ইঊশা আর নীরদ দুটোই আমার সন্তান ইনতিসার৷ তুমি ইঊশাকে যতখানি দেখে রাখবে আমার নীরদকেও দেখে রাখবে। খুব বোকা ঐ মেয়েটা। একটু পাগলাটে। আমি জানি তোমার চেয়ে ভালো ওকে কেউ সামলাতে পারবে না। আমি আমানত হিসেবে দিয়ে যাচ্ছি এদের দু’জনকে। দেখে রেখো। কোনো ভুল করে থাকলে ক্ষমা করে দিও ভাই। নীরদ তুইও।
আপা আমার দিকে তার দুর্বল হাতটা বাড়িয়ে দিলো। দুর্ভাগ্য আমি হাতটা ধরার আগেই সেটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল নিচে।
তারপরের স্মৃতিটা আমার কাছে বেশ ধোঁয়াটে। আমি দেখলাম ইনতিসারের হাত এগিয়ে গিয়ে আপার আধখোলা চোখ বন্ধ করে দিলো। আপার বোজা চোখের দুপাশ বেয়ে চিকন অশ্রু ধারা গড়াতে গড়াতে নরম বালিশে মিশে গেল। তারপর আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। কানে কেবল প্রতিধ্বনিত হলো ইনতিসারের তীক্ষ্ণ আওয়াজ, “নীরদ”

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here