ভালোবাসার রংধনু
৪০
_____________________
৭৭.
অন্তুকে সজোরে চড়টা মারার পরও আমার মন শান্ত হচ্ছিল না। ইচ্ছে করছিল আরও আঘাত করি ওকে। যে মুখ দিয়ে আমার নাম নিয়েছে, যে হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শ করেছে সে মুখ-হাত ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেই৷ কিন্তু লোকসমাগমে তা সম্ভব ছিল না। প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে যেত। বাধ্য হয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। পিছু ঘুরে চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করছিলাম। এমন সময় আবারও ওর কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
— আরো মারো আমাকে নীরু। মারো, গালি দাও। অন্যায় করেছি আমি তোমার সাথে। শাস্তি আমার প্রাপ্য;কিন্তু আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিও না। তোমার ঐ চোখজোড়ায় শুধু ভালোবাসা দেখে এসেছি আমি। ঘৃণা সইতে পারবো না৷
বলতে বলতে আবারও আমার কাছে আসতে চাইলো অন্তু। দু কদম সরে ওর নাগালের বাইরে চলে গেলাম আমি। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবো তার পূর্বে ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো কেউ ওকে। তাকিয়ে দেখলাম ইনতিসার। মাটিতে ফেলে কলার চেপে ধরে অনবরত মুখে ঘুষি মারতে মারতে চিৎকার করে বলতে লাগল,
— তোর সাহস কি করে হয় আমার বউকে ছোঁয়ার। স্কাউ/ন্ড্রেল। আজ তোকে মেরেই ফেলব আমি।
বেকায়দায় পড়ে অন্তু নড়াচড়া করতে পারছিল না। একেকটা ঘুষি পড়তেই নাকমুখ ফেটে র/ক্ত বেরুতে শুরু করেছিল। র/ক্ত দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। ইনতিসারের বন্ধুরাও ততক্ষণে ছুটে এসেছে ওকে আটকাতে। ও তো কারোর কথাই শুনছিল না। জোর করে টেনে হিঁচড়ে বহুকষ্টে সরাতে সক্ষম হলেও বারবার মারমুখী হয়ে ছুটে যাচ্ছিল।
ভরা মজলিসে এরকম অপ্রীতিকর ঘটনা কেউই এক্সপেক্ট করেনি। অকস্মাৎ এমন কিছু দেখে আশেপাশে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল। উপলব্ধি করলাম মানসম্মান বাঁচাতে চাইলে আমাদের এক্ষুণি প্রস্থান করা দরকার৷ কালক্ষেপণ না করে ইশি আপুকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে বললাম আমরা যাচ্ছি তারা যেন সবটা সামলে নেয়। সেও সম্মতি দিয়ে আমাদের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। ইনতিসারও আর রা করলো না৷ চুপচাপ এসে গাড়িতে বসলো৷ পুরো পথ আমাদের আর কোনো কথা হলো না। যেন একে অপরকে বলার মতো কোনো বাক্য সাজিয়ে উঠতে পারছি না৷
বাড়ি ফিরেও সে একটা শব্দ উচ্চারণ করলো না। গম্ভীর মুখে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ঘরে চলে গেল। ওর গমন পথে তাকিয়ে আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম৷ এতদিন পর এরকম একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে অন্তুর সাথে দেখা হবে কল্পনায়ও আনিনি আমি। বিষয়টা ডাইজেস্ট হতে সময় লাগছে। ইনতিসারের মনে কি চলছে জানি না তবে আমার মনে হলো কিছুটা সময় আমাদের একা থাকা উচিৎ। সকালের ঝগড়া তারপর এই রাতের ঘটনা সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা হয়ে আছে মাথার৷ কোনটা কীভাবে অ্যাকসেপ্ট করবে বুঝে উঠতে পারছে না। একটু সময় দেয়া হোক ওকে৷ নইলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হতে পারে৷
হাত মুখে কোনোরকম পানি দিয়ে ড্রয়িং রুমেই বসে রইলাম আমি। মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে করছিলাম এমন সময় ওপরের ঘর থেকে সজোরে কিছু পড়ার শব্দ ভেসে এলো। আঁতকে উঠলাম । ইনতিসার ওপরে আছে। ও কি আবারও ভাঙচুর শুরু করেছে? তড়িঘড়ি করে পা বাড়ালাম ওপরের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ভাঙচুরের শব্দ আরও বেড়ে গেল। সাথে শুরু হলো বিরাশি চিৎকার। কেন আমি ওকে আটকেছি এটা আমার অপরাধ হয়ে গেছে। ভাগ্যিস ইঊশা বাড়িতে নেই বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেছে। ছেলেটা থাকলে কি ভয়ই না পেত! আমিই তো ভয়ে আধমরা হয়ে যাচ্ছি। একটা মানুষের এত রাগ কীভাবে হতে পারে? তীব্র ভাঙচুরের শব্দ আর চিৎকারে মনে হচ্ছে প্রলয় নেমে এসেছে বাড়িতে। এভাবে চেঁচাতে চেঁচাতে ভোকাল কর্ড না খারাপ করে ফেলে! দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে ওকে আটকানোর জন্য এগোলাম আমি। তখনই চিনামাটির একটা ফুলদানি মাটিতে আছড়ে ফেলল ও। ফুলদানিটা একদম আমার পায়ের কাছে এসে কয়েক খণ্ড হয়ে গেল এবং ওর কিছু ভাঙা অংশ এসে পায়ে বিঁধে গেল। মৃদু আর্তনাদ করে আমি পা চেপে ধরে বসে পড়লাম। ও আমার আর্তনাদ শুনে চমকে তাকালো। ছুটে এসে হাত সরাতেই আমাদের দু’জনের চোখে পড়ল রক্ত৷ চিকন ধারা হয়ে বয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে গেল ওর। ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক সেকেন্ড ব্যায় না করে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। তারপর ছুটোছুটি করে ফার্স্ট এইড বক্স এনে ড্রেসিং করে দেয়া আরো কত কি! পুরোটা সময় আমি মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ওকে। এখন কেমন শান্ত হয়ে আছে। এই শান্ত ইনতিসার আর একটু আগের ভায়োলেন্ট ইনতিসারের মধ্যে যেন কোনো মিল নেই।
রাগ উঠে গেলে একদম অপরিচিত হয়ে যায় মানুষটা। অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আমি ভাবি এই জিনিসটা কখন না আমাদের ক্ষতি করে দেয়। ওকে শিখতে হবে রাগ কনট্রোল করা৷ যেকোনোভাবে হোক শিখতে হবে।
— কি? তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে?
ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো। আমি কোনো উত্তর করলাম না। নিশ্চুপ রইলাম। ও মুখ তুলে চাইলো আমার দিকে এবার।
— তুমি রেগে গেলে একদম অন্য মানুষ হয়ে যাও। এতটা রাগ কি ঠিক?
— কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাগেরও প্রয়োজন আছে।
— কিন্তু রেগে গিয়ে ভাঙচুর!
আমার কথা শুনে এবার ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল,
— ভাঙচুর ঠিক নয়। কিন্তু এতে আমার নিয়ন্ত্রণও নেই। রাগ শান্ত করার জন্য আমাকে এটা করতেই হয়।
— নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কি করা যায় না?
— ঠিকাছে করে দেখব৷
— আমিও তোমার রাগ শান্ত করার একটা উপায় জানি। দেখতে চাও?
ও ভ্রু কোঁচকালো। মুচকি হেসে আমি দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। মাথায় ফু দিতে দিতে বললাম,
— শোনো রেগে গেলে বারবার ‘আউজু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’ পড়বে। রাগ এমনিতেই কমে যাবে। অবশ্য রাগ কমানোর কিছু দুআ আমি জানি। শিখিয়ে দিব।
— তারচেয়ে বরং দুআ দরুদ পড়ে তুমি এভাবে আমার মাথায় ফু দিয়ে দিও। সেটা বোধহয় বেশি কার্যকরী হবে।
বলতে বলতে হেসে ফেলল ও।
— সবসময় দুষ্টুমি মনোভাব তাই না?
— নাহ্। আমি তো তোমার কথার প্রেক্ষিতে আরো ভালো সাজেশন দিলাম।
অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল। ওর দুষ্টুমি আন্দাজ করতে পেরে পেটে চিমটি কেটে বললাম,
— এত অভিনব সাজেশন লাইফে কেউ দেয়নি। তুমি মানুষটা আসলেই খুব ক্রিয়েটিভ মাইন্ডের।
— তবে!
গৌরবের আভা ফুটতে দেখা গেল ওর মুখে। তা দেখে আমার আবারও হাসি পেয়ে গেল। ও আমার হাসি মাখা মুখখানার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। তারপর গালে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
— স্যরি পর হার্টিং ইউ সোনা।রিয়্যালি স্যরি৷
— নো আ’ম স্যরি ইনতিসার। সকালের জন্য, সন্ধ্যেরাতের ঘটনাটার জন্য।
— ঐ ব্যাপারটাতে তোমার কোনো ত্রুটি ছিল না। তবে ঐ ছোকরার হঠাৎ রূপ বদলের কারণ বুঝতে পারছি না আমি। কি চায় সে!
— তুমি ওকে চেনো তাই না?
— খুব ভালো করে।
বেশ শান্ত স্বরে বলল ইনতিসার। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে বললাম,
— কে জানে! এতদিন বাদে ওর মধ্যে অপরাধবোধ..
— অপরাধবোধ! নো নো। এভ্রিথিং ইজ নট দ্যাট ইজি। হি ইজ আ ব্লাডি গ্রাউন্ড ফিশ। সুবিধের লোক নয় ও। অপরাধবোধ বলে যে একটা শব্দ হয় এটা ওর ডিকশিনারিতেই নেই।
একটু থেমে আবারও বলল,
— ওর কাছে তো সবকিছু এক্সপেরিমেন্টাল৷ ভালো খারাপ সবকিছু। আমার ধারণা ওর মানসিক সমস্যা আছে। নইলে মানুষের লাইফকে ও এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে ধরে কীভাবে? আর ওর সবচেয়ে বড় পিগ তো তুমি।
— মানে!
— তোমার কি মনে হয় যেচে এসে ভালোবাসা, তারপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, আবার ফিরে আসা, আবারও ডাম্প করা এসব অ্যাবনরমাল নয়? ও আসলে হিউম্যান রিলেশন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে। তুমি কি জানো তোমাকে ডাম্প করার পর ও ওর এক ফ্রেন্ডকে বিয়ে করেছিল।
— নিতুল বলে কাউকে?
— হতে পারে। নাম জানা নেই আমার। কিন্তু ঐ মেয়ে ঠিকমতো ছ’মাসও সংসার করতে পারেনি ওর সাথে। অ্যাবিউজড হয়ে থানায় কেস-টেস করে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে। তারপর ও অনেকদিন জেলে ছিল। মাসখানেক হলো জামিনে ছাড়া পেয়েছে।
— তুমি এতকিছু জানলে কীভাবে?
অবাক হলাম আমি। ও মৃদু হেসে বলল,
— জানি তো অনেক আগে থেকেই। আসলে জানতে হয়েছিল কোনো এক প্রয়োজনে।
— প্রয়োজনটা কি আমি?
ও জবাব দিলো না। শান্তভাবে কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন এড়িয়ে বলল,
— আমি তো অবাক হয়ে যাই তুমি চার বছর ওর সাথে থেকেও ওর সাইকোলজিটা বুঝতে পারোনি। আমি শুধু একদিন দেখেছিলাম ওকে তোমার সাথে তাতেই নাড়িনক্ষত্র বের করে ফেলেছি।
— তুমি কি একদম শুরু থেকেই জানতে আমাদের সম্পর্কে?
— খোঁজ রেখেছিলাম শুধু। ওর ভেতরে যে এত প্যাঁচ তা তখন জানতে পারিনি। আসলে তখন তো আমার লাইফেও আনপ্রেডিক্টেবল অনেক কিছু হচ্ছিল। মূলত সুযোগ পাইনি ওর সম্পর্কে পুরোটা জানার৷
— জানলে কবে?
— এইতো শেষের দিকে এসে।
— আমি তো ওকে একদমই বুঝতে পারিনি ইনতিসার। এত সাংঘাতিক ও! যখন সম্পর্ক ছিল পাগল ছিলাম ওর জন্য। আমার পাগলামির সুযোগ নিয়ে যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলতো? তাহলে আজ আমরা এভাবে একসাথে থাকতে পারতাম না বলো?
— ওর ঘাড়ে ক’টা মাথা তোমার দিকে হাত বাড়াবে। আমি ছিলাম না পাশে? সামনে ছিলাম না কিন্তু ছায়াসঙ্গী হয়ে ছিলাম তো। একটা উল্টোপাল্টা কিছু করে দিতো ওর ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দিতাম।
— বাব্বাহ। একেবারে এত?
ঠোঁট কামড়ে হাসলো ইনতিসার। আমার মাথার পেছনে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
— তোমার জন্য আমি সব করতে পারি নীরদ৷ সব।
ওর দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল। আমার ভেতরটাকে একদম নাড়িয়ে দিলো। ক্ষীণ গলায় বললাম,
— এখন আর রিস্ক নিতে যেও না ইনতিসার৷
— ও তোমার গায়ে হাত দিয়েছে। সাজা তো ওকে পেতেই হবে। বললাম না তুমি ওর সাইকোলজি বুঝতে পারোনি। আমি জানি আটঘাট বেঁধেই ও নেমেছে৷ সহজে আমাদের পিছু ছাড়বে না। তবে আমিও ইনতিসার ইলহাম। এসব পঁচা শামুককে কীভাবে থেতলে দিতে হয় খুব ভালো করেই আমার জানা।
— আমার ভয় করছে।
— ভয়ের কিছু নেই। আমি একাই এনাফ ওর জন্য। তোমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না৷ তোমার ভাবনা তো অন্য।
— অন্য!
— আমরা এখন সকালের অর্ধেকে ছেড়ে রাখা ডিসকাশনে ফিরে যাব।
— আমাকে মাফ কোরো গো সকালের জন্য।
ওর হাত ধরে অনুতপ্ত হয়ে বললাম আমি।
— তুমি আমাকে সত্যিকার অর্থেই কষ্ট দিয়েছ নীরদ। তুমি নিজেও জানো লোকের কথায় কখনো প্রভাবিত হই না আমি। আমি তো শুধু চাই তোমাকে তোমার স্বপ্নের সাথে আরেকবার পরিচয় করাতে। এভাবে ডানা ভাঙা পাখির মতো বন্দী জীবনের স্বপ্ন তো তুমি দেখনি নীরদ৷ তুমি তো সবসময় আকাশে পাখা মেলে উড়তে চাইতে। আজ কেন নিজের স্বপ্নটা ভুলে গেছ? কেন একটুতেই গিভ আপ করে ফেল বলবে?
— আমার আর কোনো স্বপ্ন নেই ইনতিসার। আকাশ আমার গণ্ডির বাইরে। ওতে ওড়ার সামর্থ্য আমার আর হবে না। ও আমার ধরাছোঁয়াতে নেই। আমি যতবারই ওকে ধরতে গেছি ততবারই বেশি করে উপলব্ধি করেছি ওর দুষ্প্রাপ্যতা। তাছাড়া সবার সব স্বপ্ন পূরণ হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। কতজনেরই তো স্বপ্ন পূরণ হয় না। জীবন তাই বলে থেমে আছে?
— আর যাদেরটা পূরণ হয়? এক্সেপশন ক্যাননট বি অ্যান এক্সামপল নীরদ।খারাপ সময় কি মানুষের জীবনে আসে না ? মানুষকে আরও কত কত সংগ্রাম করতে হয়। সংগ্রাম না থাকলে আবার জীবন হলো!যেটা তুমি খুব সহজেই পেয়ে যাবে সেটার মর্মার্থ কিন্তু তোমার কাছে খুব কম থাকবে। কখনো কখনো থাকবেই না। কিন্তু যেটা পেতে তোমাকে অনেকটা সইতে হবে, খুব সংগ্রাম করতে হবে সেটার মর্মার্থ তোমার কাছে সবচাইতে বেশি হবে। মরমে মরমে উপলব্ধি করতে পারবে ওর গুরুত্ব।
কঠিন কোনো যুদ্ধ শেষে জয়ের অ্যাচিভমেন্ট একটা ডিভাইন ফিলিংস নীরদ। এই ফিলিংসটা যে পায়নি সে জীবনের বিরাট কিছু মিস করে গেছে। তুমি মিস করো না। সুযোগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে তোমাকে। সাহস করে একটাবার ওর ডাকে সাঁড়া দাও। ওর পথে একবার পা বাড়িয়ে দেখ কত নতুন নতুন পথের খোঁজ এনে দেয় ও তোমাকে। আরে এক পথে চলতে চলতেই তো আরেক পথের সন্ধান মেলে তাই না?
আমি তবুও দ্বিধান্বিত বোধ করলাম। এবার ও করতলে আমার মুখ তুলে ধরলো।
— মনে আর কোনো দ্বিধা রেখো না নীরদ। আজ দ্বিধাকে জয় করো। ভয়, দ্বিধা এগুলোকে জয় করার জন্যই আমাদের জন্ম। যা তোমাকে টেনে নীচে নামায় তাকে আঁকড়ে ধরে থেকে কি লাভ? মনকে বোঝাও পিছিয়ে থাকার জন্য আমরা আসিনি। আমরা শুধু এগোতে জানি। মাথা উঁচু করে বাঁচতে জানি। তোমার জন্য পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছি আমি। কিন্তু তোমার দ্বিধা, তোমার ভয় এগুলোর সাথে যে শুধু তোমাকেই লড়তে হবে। কিছু ইন্টার্নাল অ্যাফেয়ার থাকে যা নিজেকে সলভ করতে হয়। সেটা মানুষকে স্ট্রং হতে সাহায্য করে।
আর বাকিসব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ারের জন্য তো আমি আছি। কি আছি না?
— হু।
— তাহলে কি এখন রাজি? পড়বে?
— হু।
হেসে উঠল ও এবার। ঠোঁটের ওপর আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,
— দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল। আমি কালই বিএসএল এ কথা বলে আসব। এলএলবি কোর্সে ভর্তি হবে তুমি।
— ল’ নিয়ে তো কোনো আইডিয়াই নেই আমার৷
— হয়ে যাবে। পড়তে পড়তে হয়ে যাবে।
— কোনো সহজ সাবজেক্ট দিতে পারলে না?
— রাস্তা কঠিন হলেই তো মজা।
দুষ্টু হেসে চোখ মারল ও। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
— হ্যাঁ মেরে দাও তুমি আমাকে।
— ছিঃহ্ তোমাকে আমি মারতে পারি! আমার দশটা নয় পাঁচটা নয় একটামাত্র বউ। আমার আট বছরের সাধনার ফল।
— ইশশ চুপ করো।
— নাহ্, আমার তো বলা উচিৎ পেলে পুষে বড় করা বউ। সেই ছোট্ট বয়স থেকে তোমাকে বড় করলাম।
— তুমি পেলে পুষে বড় করেছ?
চোখ রাঙালাম আমি। ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— করেছি না? দূর থেকে দোয়া করে করে। আমার দোয়ায় আজ তুমি এত বড় হয়েছ।
— বাহ্ খাওয়াদাওয়ার তো কোনো ভূমিকাই নেই তাহলে।
— একদম না। আমার দোয়া আর ভালোবাসা তোমার জীবনীশক্তি।
আমি স্যারেন্ডারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। এই মানুষটার সাথে কথায় পারা যাবে না।
তবে এতকিছুর মধ্যেও আমার মাথায় আবার নতুন দুশ্চিন্তার আবির্ভাব ঘটল। ইনতিসারের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে অন্তু সহজ মানুষ নয়। ওর এবারের প্রত্যাবর্তনের কারণ কি? আমাকে ঘুঁটি বানিয়ে আমাদের বিজনেসে ঢুকতে চেয়েছিল? আফটার অল বিজনেসটা দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর ইনতিসারের খ্যাতিও তো কম হয়নি। ওদিকে জেল খাটার কারণে ওরও বেশ লোকসান হয়েছে৷ নাহ্ বিষয়টা সহজে সমাধান করার মতো তো নয়। সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।
_______________________
৭৮.
অদ্ভুতভাবে সেদিন রাতের প্রোগ্রামের পর থেকে অন্তুর আর টিকিটিরও দেখা পাওয়া গেল না। একদিন বেশ আগ্রহ নিয়ে ইনতিসারকে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি ব্যাপার অন্তুর আর কোনো খোঁজ নেই। ও যদি আমাদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যেই এসে থাকে তাহলে এখনও চুপচাপ বসে আছে কেন?
ও কেবল একটা ফিচেল হাসি হেসে বলল,
— সেই পথ যে আমি নিজ হাতে ওর জন্য বন্ধ করে দিয়েছি ডার্লিং। এমন টাইট দিয়েছি না!
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
— কি করেছ তুমি ওর সাথে? খুব খারাপ কিছু? কেউ জেনে গেলে!
— বেআইনি কিছু নয়। ছোট্টো করে একটা শাস্তি দিয়েছি। একটুখানি মার পড়েছে, বলতে পারো গণধোলাই। পুরোটা আমার ইশারায় হয়েছে এমনটাও নয়। ওরই এক বিজনেস পার্টনারের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল। ভদ্রলোক আমার কাছে সাহায্য চাইলেন। আমি কিছু লোকের খোঁজ দিলাম। ওদেরকে যা ডিরেকশন দেয়ার ঐ ভদ্রলোকই দিয়েছেন। পাগল-ছাগলটিরও বেশি একটা ক্ষতি হয়নি। শুধু একটা পা ডিসট্রয় হয়ে গিয়েছে। শুনেছি এখন প্রাণ বাঁচাতে দেশ আর বিদেশ করতে করতে কেটে যাচ্ছে ওর।
— ও প্রতিশোধ নিলে?
— এত মার খেয়ে আবার প্রতিশোধ! আচ্ছা নিতে আসলে তখন দেখা যাবে। আমি একদমই ওর খোঁজখবর রাখব না তা তো নয়। শত্রুদের সবসময় খোঁজ রাখতে হয়৷ আমিও রাখব। ওর ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহ নিয়ে রাখব। হয়েছে?
এরপর আমার বলার মতো আর কিছু ছিল না। মনের দুশ্চিন্তাটাও পুরোপুরি দূর হলো না। সুপ্তাবস্থায় এক কোণে পড়ে রইলো।
বিএসএল এ ভর্তি হওয়ার পর সময়টা চোখের পলকে কাটতে লাগল।
এলএলবি কোর্সের শেষে ওনাদের রেকমেন্ডেশনে বার-অ্যাট ল’ করার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ এলো। আমি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম। পুরো এক বছর ইনতিসার আর ইঊশার থেকে দূরে থাকতে হবে। কীভাবে পারব! কিন্তু পারতে তো আমাকে হতোই। এতদূর এসে পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ ছিল না। নিজেকে বেশ গুছিয়েই নিচ্ছিলাম। ক্যাডেটে যাওয়ার পর থেকে ছেলেটার সাথে দেখাও হয় মাসে একবার করে। ভাগ্য এমন ওর সাথে যেদিন দেখা হবে সেদিনই রাতের ফ্লাইট পড়ল আমার৷ খারাপই লাগল। ও জানে না তখনও। রিয়্যাকশন কেমন আসবে ভেবেই একটা অস্বস্তি হচ্ছিল আমার৷ আমার সব সাকসেসে ও খুশি হয়েছে জেনেও কেন যে অস্বস্তিটা হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না৷ ইনতিসার বারবার বলছিল,
— তোমার কি মনে হয় ও মানতে পারবে না৷ তোমাকে আটকে দেবে?
আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে প্রতুত্তরে বললাম,
— জানি না। শুধু বুঝতে পারছি একটা অস্বস্তি দানা বাঁধছে।
— বেশি ভেবো না তো।
ভেবো না বললেও কি ভাবনা থেকে নিজেকে বিরত রাখা যায়? দুশ্চিন্তা হলো আমার বেশ, তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জোর চেষ্টা চালালাম। ছেলের সাথে দেখা হলো, কথা হলো, বেশ খানিকটা সময় কাটানোও হলো। বেঁধে দেয়া সময় শেষ হতে আর কিছুক্ষণ বাকি ঠিক সেই মুহুর্তে ইনতিসার ওকে বলে উঠল ,
— মায়ের তরফ থেকে একটা খুশির সংবাদ আছে শুনতে চাস?
ইঊশাকে এক্সাইটেড লাগল। তবুও মুখ ফুলিয়ে বলল,
— এসেছ অনেকক্ষণ অথচ খুশির সংবাদ জানাচ্ছ সবার শেষে?
— কিছু খুশির সংবাদ তো লাস্ট মোমেন্টে জানাতে হয়। আমি শিওর মায়ের এতবড় অ্যাচিভমেন্ট শুনে তোর গর্ব হবে।
— আচ্ছা! তবে বলোই না। মা তুমি বলবে নাকি বাবা?
আমার দিকে তাকিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করলো ইঊশা। ইনতিসার ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
— আমিই বলছি। শোন তোর মা বার-অ্যাট ল’ করার সুযোগ পেয়েছে ইংল্যান্ডে। নদার্মব্রিয়া ল’ স্কুল। আজ রাতেই তার ফ্লাইট৷
খবরটা শোনার আগে ইঊশার মুখে যে এক্সাইটমেন্ট লেপ্টে ছিল, শোনার পর আর তা রইলো না। বরং হাসি উবে গিয়ে একরাশ গাম্ভীর্য ভর করে নিলো। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। একটু আগের অস্বস্তিটা তবে অমূলক নয়৷ বিপরীতে ওকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ইনতিসার আবারও প্রশ্ন করলো,
— তুই খুশি হোসনি?
— না।
কাট কাট স্বরে জবাব এলো ওর তরফ থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ও বলল,
— মা কোত্থাও যাবে না। আমি যেতে দেব না। এরকম কথা তো ছিল না মা। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা তো ছিল না।
— ইঊশা। ও ছেড়ে যাচ্ছে কোথায়! কেমন কথা বলছিস?
— ঠিক বলছি। শোনো মা তুমি যদি একদিনের জন্যেও আমাকে ছেলে হিসেবে মেনে থাকো তাহলে আমার কথা শুনবে। ইংল্যান্ডে যাবে না তুমি।
কেন নিষেধ করছে, কারণ কি কিচ্ছু না বলে আমাদের অবাক করে দিয়ে এরপর দ্রুত পায়ে উঠে চলে গেল ইঊশা। কতবার ওকে পেছন থেকে ডাকা হলো কিন্তু জবাব দিলো না;না ফিরে তাকালো।
ছেলের তরফ থেকে নিষেধ এলে আমার সংকল্পও টলে উঠল। ইনতিসার বুঝতে পারল আমার অবস্থা। ভরসা দিয়ে বলল,” তুমি নিশ্চিন্তে যাও আমি সামলে নেব ওকে।”
আমরা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত চুপচাপ গেলাম। কিন্তু ইমিগ্রেশনের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে আমার মনে হলো নাহ্ যাওয়াটা বোধহয় আমার আসলেই উচিৎ হবে না। আজ আমি গেলেই ইঊশার থেকে দূরে চলে যাব। এই দূরত্ব সম্পর্কগুলোর ওপর তেমন ভালো প্রভাব ফেলবে না৷ সাথেসাথেই ইনতিসারকে বলে দিলাম আমি যেতে চাই না। ও অবাক হলো। হাত চেপে ধরে অনুনয় করে বলল,
— লাস্ট মোমেন্টে এমন কথা বলো না। বললাম তো ইঊশাকে সামলে নেব আমি৷ বোঝাব ওকে। ও বুদ্ধিমান ছেলে ঠিক বুঝবে।
— বুঝবে না ইনতিসার। বরং আজ গেলে ওর সাথে চিরকালের তরে সম্পর্ক ছিন্ন হতে পারে।
— হবে না। তুমি ওর চিন্তাটা বুঝতে পারছো না। ও একবার ওর মাকে হারিয়েছে এজন্য একটা ভয় ওর মনে দানা বেঁধেছে। তোমাকে হারানোর ভয়। কিন্তু এই ভয়টা তো বৃথা। আমাদের মোটেই উচিৎ হবে না ভয়টা ওর মনে বাড়তে দেয়া।
— এক্স্যাক্টলি। ভয় দূর করার জন্য আমার ওর কাছে থাকা চাই, পাশে থাকা চাই।
— তুমি ভুল ধারণা মনে পুষছো নীরদ। এমনিতেও ওর সাথে তোমার প্রতিদিন দেখা হওয়ার সুযোগ নেই৷ মাসে মাসে দেখা হয় তাও কেবল একবার৷ এই একবারটা সশরীরে উপস্থিত না থেকে ভার্চুয়ালি থাকলেও ক্ষতি নেই। আমি তো থাকবোই ওখানে। বোঝাতে পারব ওকে সবটা। অভিমান কতদিন থাকবে? একদিন, দুদিন? একসপ্তাহ? একটা না একটা সময় তো ওকে বুঝতেই হবে এই কোর্সটা কতখানি ইম্পর্ট্যান্ট তোমার জন্য। ক্ষণস্থায়ী অভিমানের কথা চিন্তা করে এতবড় অপরচুনিটি লেট গো করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
— তুমিই বুঝতে পারছো না ইনতিসার৷ এসব আমার কাছে কিছুই না। আমার প্রায়োরিটি লিস্টে স্বপ্নের চাইতেও সম্পর্ক আগে। মানুষ পাশাপাশি থেকেও কত দূরত্বের সৃষ্টি হয় সেখানে ভার্চুয়ালি সম্পর্ক বিল্ডআপ! উঁহু সম্ভব নয়। নাহ্ আমার ঠিক লাগছে না বিষয়টা। আমি যাব না,কিছুতেই যাব না।
— তুমি যাবে নীরদ। স্বপ্ন আর সম্পর্ক গুলিয়ে ফেলার মতো কোনো বিষয় নয়। একটাকে রেখে আরেকটাকে মহৎ করবারও কোনো বিষয় নয়৷ ইটস অল আবাউট ব্যালেন্স। জীবনে প্রতিটি পর্যায়ে ব্যালেন্স করে চলতে হয়।
— জিদ করো না। আমি যাব না।
— তবে তোমায় যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। আমি অথবা ইঊশা।
— ইনতিসার!
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম আমি। ওর দৃষ্টি শান্ত, মুখাবয়বে দৃঢ়তা৷ এত কঠিন ও সচরাচর হয় না।
— কথাটা একটু বেশিই বালকসুলভ হয়ে গেল না ইনতিসার?
— বালকসুলভ মনে হলে আমার কিছু করার নেই। আমি আমার জায়গায় অটল। বালকসুলভ আমার কথাটা হলে তোমার আচরণও কম নয়৷
— এত কঠিন হয়ো না ইনতিসার।
— তোমার সামনে দুটো অপশন খোলা আছে। নাউ চয়েজ ইজ ইওরস৷
কথাটা বলে অন্যদিকে চলে গেল ইনতিসার। আমি ওখানে বসেই মাথা চেপে ধরে আকাশ-পাতাল চিন্তায় ডুবে গেলাম। এ যেন এক অগ্নিপরীক্ষা। এরকম সিদ্ধান্তহীনতায় বহুদিন পড়িনি।
ওদিকে একটু একটু করে সময় অতিবাহিত হতে লাগল। ইমিগ্রেশনের শেষ সময়। শেষবারের মতো আশা নিয়ে ইনতিসারের দিকে তাকালাম আমি। কিন্তু ওর কাঠিন্য কিছুতেই গলল না। স্থির-শীতল ওর চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে খুব অভিমান হলো আমার। বিনাবাক্য ব্যয়ে উঠে ওর হাত থেকে কাগজপত্র নিয়ে লাগেজ সমেত ইমিগ্রেশনে চলে গেলাম।
পেছন থেকে খুব ক্ষীণ গলায় ও বলল,
— সাবধানে যেও, সাবধানে ফিরো। অপেক্ষায় থাকব।
আমি জবাব দিলাম না, ফিরেও তাকালাম না৷ পুরো এক বছরের জন্য চোখের আড়াল। বিদায়টা আর ঠিকঠাক মতো হলো না আমাদের।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara