ভালোবাসার রংধনু ৪১

0
1157

ভালোবাসার রংধনু
৪১
___________
৭৯.
বলা বাহুল্য একই প্লেনে আমার সাথে ভার্সিটির কয়েকজন কাছের বন্ধু ফ্লাই করছিল যাদের সাথে অ্যাকোমোডেশনটাও একসাথেই করা হয়েছিল। দীর্ঘ আঠারো-ঊনিশ ঘণ্টার ঢাকা টু দুবাই- দুবাই টু নিউক্যাসল খণ্ড জার্নির পর পৌঁছে সবাই মিলে বন্ধুদের মধ্যে একজনের খালার বাসায় গিয়ে উঠলাম। উনিই মূলত এক পরিচিত জায়গায় আমাদের আবাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। জেট ল্যাগ কাটিয়ে পরদিন আমাদের রেন্টের সেই বাসায় ওঠার কথা। সুদীর্ঘ জার্নিতে আমি অভ্যস্ত নই। শারীরিক দিক দিয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম৷ তার সাথে মানসিক দুর্বলতা তো ছিলই। তাই দেখা গেল বাকি বন্ধুদের চাইতে আমাকেই বেশি অসুস্থ লাগছিল। খালাম্মা খুব আন্তরিক মানুষ৷ দু চারটা খাইয়ে সবার আগে আমাদের রেস্টের ব্যবস্থা করে দিলেন। ঘরে গিয়েই সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ফোন খুলে বাড়িতে জানাতে শুরু করলো। চুপচাপ তাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম আমি। অভিমান অতটা শক্ত ছিল না, তবুও আমার ইচ্ছে করলো না ফোন খুলে ইনতিসারকে একটা কল করি। অদ্ভুত রকমের একটা বিষণ্নতা আর ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে লাগল শরীর৷ অবসন্ন শরীরটাকে কোনোরকমে টেনে বিছানায় এলিয়ে দিতেই দুচোখ ভেঙে ঘুম নামল।
ঠিক কতক্ষণ পর ঘুম ভাঙলো জানা নেই। তবে চোখ খুলতেই অনুভূত হলো তলপেটটাতে অসম্ভব ব্যথা। মনে হচ্ছে কেউ অনবরত ছুরি চালাচ্ছে ওতে। সাথে উষ্ণ রক্তের বান। কিছুটা সময় লাগল আমার বুঝতে। তারপর ধড়ফড় করে উঠে বসলাম৷ সত্যি সত্যি রক্তের বান ডেকেছে। আমার কাপড়, বিছানা সব ভেসে যাচ্ছে কালসিটে রক্তে। আশ্চর্য এত রক্তের উৎস কোথায়?
আমার পাশে এক বান্ধবী শোয়া ছিল। তার ঘুমটাও বোধহয় আমার কারণেই ভেঙেছিল। ঘুম ঘুম চোখে ভ্রু কুঁচকে সে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
— কি হয়েছে? ওভাবে উঠে বসলি কেন?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় ওকে উত্তর দিলাম,
— রক্ত?
— হু? কি বলছিস বুঝি না।
— রক্ত।
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম ওকে। ও তাকাতেই নিজেও চমকে উঠে বসল। কি যেন আশংকায় ওর শরীর দুলে উঠল একবার। তারপর আমাকে কিছু না বলেই ফোন হাতে ছুটে বেরিয়ে গেল । আমি ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলাম ওর গমন। কিছু বুঝতে পারলাম না। ভয়ানকভাবে মাথা ঘুরতে শুরু করলো আমার। চোখ বন্ধ করে মাথা চেপে ধরে বসে রইলাম চুপচাপ। ও ফিরলো খালাম্মা আর আরো দু’জন বন্ধুকে নিয়ে। খালাম্মা নির্দেশ দিলেন আমায় চেঞ্জ করতে হেল্প করতে। বন্ধুরা সব ধরাধরি করে চেঞ্জ করে আবারও শুইয়ে দিলো বিছানায়। খালাম্মা খুব উদ্বিগ্ন মুখে আমায় পরীক্ষা করতে লাগলেন। তখুনি জানতে পারলাম উনি একজন ডাক্তার। দীর্ঘক্ষণ পরীক্ষা নিরিক্ষার পর মুখ অন্ধকার করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। ওনার চোখের তারায় শোক আর অস্বস্তি দুটোই ফুটে উঠতে দেখলাম আমি। মনে ভয় লুকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— আমার কি হয়েছে খালাম্মা?
প্রতুত্তরে মিনিটখানেক পর উনি যে কথাটা বললেন তা বোধহয় আমার এ ছোট্টো জীবনে শোনা সবচেয়ে ভয়ংকর একটা কথা।
দুঃখী গলায় শান্তভাবে বললেন,
— স্যরি নীরদ।ইটস আ মিসক্যারেজ।
কথাটা আমার জন্য আনএক্সপেক্টেড ছিল। আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি এমন কিছু ওনার মুখ থেকে উচ্চারিত হতে পারে। “স্যরি ইটস আ মিসক্যারেজ” ছোট্ট একটা বাক্য অথচ এই ছোট্ট বাক্যটা ঐ মুহুর্তে আমায় কতখানি বিস্মিত এবং ব্যথিত করলো তা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। স্বাভাবিকভাবেই হাতটা পেটে চলে গেল। একটা নিষ্পাপ প্রাণ, যার সম্পর্কে এই পৃথিবীর কেউই অবগত ছিলাম না। সে তার জানান দিলো এভাবে, নিঃশেষের মাধ্যমে? আমারই অংশ, একটু একটু করে আমার ভেতর বেড়ে উঠছিল যা আমি জানলাম না, বুঝতেও পারিনি। জানলাম কখন;যখন সে আমায় ছেড়ে চলে গেল? সত্যি কি সৃষ্টিকর্তার এতখানি নিষ্ঠুরতা মানায়?
সেদিন আমার আর কান্না পেলো না। বুকের ভেতর তোলপাড় চলতে থাকলেও বাইরে তার কিছুই প্রকাশ পেলো না। সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিলো। গ্রহণও করলাম সে সান্ত্বনা। এরপর চুপচাপ উঠে গিয়ে ফোন খুলে ইনতিসারকে ফোন করলাম। ওকে জানালাম স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হলো আমাকে৷ কতখানি হারাতে হলো। ফোনের ওপাশে ও নিস্তব্ধ রইলো। ওর ঘনঘন শ্বাস প্রশ্বাস জানান দিচ্ছিলো যাকে দেখা হলো না, একটুখানি ছোঁয়া হলো না;এমনকি যার মৃ/ত্যুও চোখে দেখা হলো না তার কথা মনে করে এখন ওর দুচোখ ছাপিয়ে জল নামছে। আমি সময় দিলাম ওকে সামলে নেয়ার। সামলাতে পারলো কি না জানি না। পাল্টা প্রশ্ন করলো,
— সে বোধহয় রাজকন্যা ছিল তাই না নীরদ? বাবার অভিমানী রাজকন্যা। এতই অভিমানী যে একটুখানি চোখের দেখারও সুযোগ দিলো না।
কথা বলার এক পর্যায়ে ওর কণ্ঠ ভেঙে আসতে চাইলো। আমি ফোনটা রেখে দিলাম। আমার চোখ দিয়েও কি দু ফোঁটা জল ঝরেছিল সেদিন? কি জানি!
ও এলো একসপ্তাহ পর। আমায় জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। এই প্রথম আমি ওকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখলাম। যে সবসময় আমাকে সামলে এসেছে তাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে খারাপ লাগল বৈকি। কিন্তু খারাপ লাগাটা ঢাকা পড়ে গেল তীব্র অভিমানে। আমার সাব-কনশাস মাইন্ড ধরেই নিয়েছিল যা কিছু হয়েছে তার জন্য শতভাগ দায়ী এই একটা মানুষ। সেদিন এয়ারপোর্টে অতখানি নিষ্ঠুর যদি না হতো তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। ভেতরের কথা ভেতরেই চেপে রাখলাম আমি। অভিযোগগুলো প্রকাশ করার ইচ্ছে লেশমাত্র ছিল না। ও বুঝলো সবটা। আমাকে সামলে নিতে এখানেই রয়ে গেল। খালাম্মার সহায়তায় অন্য একটা বাসার ব্যবস্থা হলো। না চাইতেও উঠে গেলাম ওখানে। তারপর দিনগুলো খুব যাচ্ছেতাই ভাবে কাটতে লাগল। খুব নির্বিকার হয়ে গেলাম আমি, আর ও হলো কাতর। আমাকে স্বাভাবিক করার রোখ চেপে বসেছিল ওর মাথায়। কখনো অনুনয়-বিনয়, কখনো আদর-যত্ন কতশত উপায় অবলম্বন করতে চাইল। কিন্তু আমি স্বাভাবিক হতে পারলাম না। দিনকে দিন বরং আমাদের ভেতরের অস্বাভাবিকতা বেড়ে চলল। আস্তে আস্তে একজন আরেকজনের থেকে পালানোর প্রবণতা তৈরি হচ্ছিল। বাইরে কিছুই প্রকাশ করতাম না আমরা৷ উপলব্ধি করতাম বাইরে সব ঠিকঠাক চলছে অথচ ভেতরে ফাঁপা। এমন করে কি সম্পর্ক চলতে পারে? একটা ব্রেক খুব করে দরকার ছিল আমাদের, একটুখানি দূরত্ব। চিন্তাটা একসাথেই মাথায় এসেছিল বোধহয়। তাইতো একদিন কিছু না বলে হঠাৎ ও দেশে ফিরে গেল। সকালবেলা উঠে একটা চিরকুট পেলাম,
“যার চলে যাওয়ার পেছনে তুমি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আমাকে দায়ী করছো সে আমারও অংশ ছিল নীরদ। কষ্টটা যতখানি তোমার, ততখানি আমারও। অথচ একা আমাকে দোষারোপ করে প্রতিনিয়ত দূরে সরে যাচ্ছ তুমি। এই এতখানি অবহেলা আসলেই আমার প্রাপ্য?”
চিরকুটটা দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। ভুল-ত্রুটি কার কতখানি তা বিচার করার ক্ষমতা আমি হারিয়েছে কবে!একা ওকে দোষারোপ করেই বা আমার লাভ কি ছিল? আমি কি ফিরে পেতাম আমার সন্তানকে? পেতাম না৷ আমি যা চাইছিলাম তা হলো সময়। ঐ যে ও একদিন বলেছিল কিছু ইন্টার্নাল অ্যাফেয়ার থাকে যা নিজেকেই সামলাতে হয়৷ সেই সামলানোটা আমি একা একাই করতে চাইছিলাম। তবে নিজের কষ্টে বুঁদ থাকতে গিয়ে একটা বিষয় অনুধাবন করতে ভুল হয়ে গিয়েছিল তা হলো এই একই কষ্টের ভাগিদার ও নিজেও। মনের ভাবটা প্রকাশ করেই গিয়েছিল মানুষটা, কিন্তু আমি উপলব্ধি করেও উপলব্ধি করতে পারিনি। এরপর আর কি! আবারও বিরহ।
এক ধাক্কায় সাড়ে ন’ মাসের বিরহ৷ কোর্সের সাথে সাথে আমাদের বিরহের সময়টা কাটছিল। এর মাঝে দেখাসাক্ষাৎ আর হলো না। ইঊশা ফোন করে দেখতে চাইতো খুব। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এত এত খারাপ ঘটনাগুলোর মধ্যে এটাই একটা ভালো ঘটনা ঘটেছিল যে পারতপক্ষে ইঊশা মায়ের প্রতি তার অভিমান দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারেনি। শুনেছিলাম ইনতিসার এখানে আসার আগে ইঊশাকে খবর পাঠিয়েছিল আমার অসুস্থতার। হয়তোবা সেই খবরটাই ওর হৃদয়কে খুব করে স্পর্শ করেছিল। মায়ের ওপর রাগ ধরে রাখতে পারেনি ছেলেটা। ওর কথা ভেবে যেতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু পরক্ষণেই হারিয়ে ফেলা সন্তানের কথা মনে পড়লে সে ইচ্ছেটা মাটি হয়ে যেত৷ সুযোগ পেয়েছিলাম দেশে যাওয়ার কিন্তু কাজে লাগাতে ইচ্ছে করল না।
নিজেকে খুব ব্যস্ত করে তুলেছিলাম। বোধহয় জাগতিক সব কষ্টগুলো থেকে মুক্তি লাভের আশায়। তবুও শত ব্যস্ততার মাঝে কোনো এক উদাস বিকেলে হৃদয় উথালপাথাল করা অজ্ঞাত এক নীল স্রোতের আগমন ঘটতো।
এই স্রোতে ভেসে যেতে যেতে আমার মনে পড়তো নিউক্যাসলে পা দেয়ার পরের ভয়ানক রাতটাকে, পাগলপারা হয়ে মানুষটার কান্নার দিনগুলোকে, আমাদের সম্পর্কের শীতলতাটাকে। আমি খুঁজতাম খুব করে খুঁজতাম হারিয়ে যাওয়া আমার বিচারবুদ্ধিগুলোকে। লিখে যাওয়া তার চিরকুটের কথাগুলো মনে পড়ত। সে কি আসলেই দোষী নয়? নাকি দোষী! আমার কষ্ট আর তার কষ্ট কি এক? আসলেই এক! স্মৃতি হাতড়াতে গেলে অস্থির লাগতে শুরু করতো আমার। সেই অস্থিরতাকে কমাতে একছুটে চলে যেতাম টাইন নদীর তীরে। আচ্ছা মানুষের ভেতরে বয়ে চলা স্রোত কখনো বাইরের স্রোতের সাথে গিয়ে মিশতে পারে? কে জানে! অজানাকে জানার চেষ্টা কখনো করিনি। নদীর তীরে নিস্তব্ধতায় নিরালা বসে মন শান্ত হলে আবারও তার সাথে কাটানো সমস্ত সুখের স্মৃতি রোমন্থন করতাম। কখনো আনমনে ফোন চলে যেত সূদুর বাংলাদেশে; মানুষটার কাছে।কথা হতো না আমাদের। অভিমান কি তারও একবিন্দু কম? কথা না হলেও কেবল দুপাশ থেকে দু’জন দু’জনার দীর্ঘশ্বাস গুনতাম। সেকেন্ডের কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে মিনিটে পরিণত হতো, মিনিট আবার ঘণ্টায়। ফোন রেখে দেয়ার পূর্ব মুহুর্তে আমি শুনতে পেতাম ভীষণ আবেগে ফিসফিস করে বলা তার একটা কথা,
“অভিমানে তো অনেকটা কাটল নীরদ। আর কত? হাঁপিয়ে উঠছি। জানি তুমিও। জলদি কি ফিরে আসতে পারো না? আর কতখানি বিরহ চাও?”
প্রতুত্তরে কিছু বলবার তাড়না ছিল না আমার। নাকি ছিল, নিজে থেকেই অগ্রাহ্য করেছিলাম!
___________
৮০.
ছোটোবেলা থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামে পার্টিসিপেইট করতে পছন্দ করতো ইঊশা। কখনো জিতে ফিরতো কখনো জিততো না। যতখানি জিততো না মনোবল ওর ততখানি বেড়ে যেত। দ্বিগুণ পরিশ্রম করে পরের বার ট্রফি নিজের নামে লেখাতো। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করতাম জয়ের ভয়ানক রকমের একটা নেশা ওর মধ্যে। আমরা তো কখনো ওকে প্রেশারাইজ করিনি কোনোকিছুর জন্য। ও একা ডিবেটিং করেছে, বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে নাম লিখিয়েছে। এভাবে টিচারদের চোখেও পড়ে গেছিল। একবার হলো কি ও যখন জুনিয়র স্কুলে ওর একজন টিচার সাজেস্ট করলেন গণিত অলিম্পিয়াডে নাম লেখাতে। ও টিচারের কথা রাখতে এমনি এমনি নাম লিখিয়ে এলো। এখন নাম লেখালো প্রিপারেশন তো নিতে হবে। জোর প্রিপারেশনও নিলো। দেশের বড় বড় স্কুলের সব ব্রিলিয়ান্ট ব্রিলিয়ান্ট বাচ্চাদের সাথে প্রতিযোগিতা হলো ওর এবং খুব অদ্ভুতভাবে ও সেবারের প্রতিযোগিতায় জিতে গেল। একবার জিতে গিয়ে ওর মনে ভীষণ সাহস এলো এবং গণিত অলিম্পিয়াডের ওপর এলো ভীষণ প্রীতি। ওটাকে ধ্যান-জ্ঞান করে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগল একদিন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ও বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করবে। আমি কায়মনে একটাই প্রার্থনা করতাম আমার ছেলের মনের আশাটা পূর্ণ হোক। ওর সকল মনের আশা পূর্ণ হোক। সৃষ্টিকর্তার মর্জিও বোধহয় এমনকিছু ছিল। লাকিলি ম্যাথ অলিম্পিয়াডের এবারের আসরে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করার একটা সুযোগ এলো। ও সহ বাংলাদেশী আরও পাঁচজন বাচ্চার ডাক পড়ল। হায়ার সেকেন্ডারি লেভেলে। অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হবে নরওয়ের অসলোতে। ওখানে যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে আমাকে কল করলো,
— মা তোমাকে আসতেই হবে।
আমার তখন মক ট্রায়াল চলছে। জটিল একটা কেইস নিয়ে কাজ। ছেলের ফোন পেয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। এই ক’মাসে ওর একটা আবদারও পূরণ করতে পারিনি আমি, একটাও না৷ এখন ছেলের জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় তাতেও আমি পাশে থাকতে পারব না। মন খারাপ গলায় বললাম,
— আমার তো ট্রায়াল চলছে বাবা। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ও রাগল।
— আমার একটা অ্যাচিভমেন্টেও তোমায় পাশে পাব না মা? খুব কষ্ট হয় আমার।
— কষ্ট তো আমারও হয় বাবা। কষ্ট পুঁজি করে রাখি। এইযে এত ত্যাগ, সংগ্রাম এগুলোর কি কোনো ফল আসবে না? অবশ্যই আসবে৷ সেটারই অপেক্ষা করি।
— কোনোভাবেই কি আসা সম্ভব নয় মা?
— আমি তোমাকে লাইভে দেখব ইঊশা।
জোর কান্না চেপে ভাঙা স্বরে বললাম আমি। ফোনের ওপাশে ও নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ তারপর টুট টুট শব্দ জানান দিলো কল ডিসকানেক্ট হয়ে গেছে।
এতগুলো মাস পর সেদিন প্রথম আমার চোখে জল এলো। আকাশ-বাতাস এক করে আমি কাঁদলাম৷
ছেলে অভিমানে দু’দিন কথা বলল না৷ আমি বারবার তাকে কল করলাম, রিসিভ করল না। বিষণ্নতায় কাটল পরের দু’দিন। তারপর যেদিন নরওয়ে যাবে সেদিন তার রাগ পড়ে গেল। টেক অফের আগে আমাকে কল করল। ভেজা গলায় বলল,
— ভিডিও কলে আসো মা তোমাকে দেখি।
ছেলের আবদার ফেলা যায়? আমি লাইব্রেরিতে ছিলাম। ছুটতে ছুটতে বেরুলাম। ভিডিও কলে দেখি ছেলের মুখ শুকনো। সে ভয় পাচ্ছে।
— মা যদি ঠিকঠাক ইকুয়েশন না পারি?
— পারবে বাবা অবশ্যই পারবে। ম্যাথের প্রতি তো তোমার অন্যরকম টান। যে জিনিসটার ওপর সবচেয়ে বেশি টান সে জিনিসটা কি সহজেই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইবে? জানো তো কোনো কিছুর ওপর অনুরাগ বেশি থাকলে সেটা আমাদের মন আর মস্তিষ্ককে একসাথে মিলিয়ে দেয়। দুটিকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে সাহায্য করে। ম্যাথের প্রতি অনুরাগ তোমার মনে আর ইকুয়েশন হবে ব্রেইন দিয়ে। ভয়টা তো নগন্য জিনিস। ওকে সিরিয়াসলি নেয়ার মতো কিছু নেই। দেখবে যখন তুমি ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়েছ তখন তোমার মনটা তাকেই প্রাধান্য দেবে যার রিফ্লেকশন তোমার ব্রেইনে। আর তোমার ব্রেইনে কার রিফ্লেকশন এটা তুমিও জানো, আমিও জানি।
— আমাকে সাহস দাও মা। অনেক অনেক দোয়া করো। তুমি ঠিকঠিক আমায় লাইভে দেখবে তো?
— দেখব বাবা অবশ্যই দেখব৷ তোমার এতবড় একটা অ্যাচিভমেন্ট, এতবড় জায়গায় পা রাখছো দু-চোখ ভরে দেখতে হবে না আমার?
হাসি ফুটে ওঠে ইঊশার মুখে। দু চোখ ভরে সে হাসি দেখি আমি। ছেলেটার হাসিটা ডুপ্লিকেট ইনতিসারের মতো। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা বিষণ্ন মুখে। রাজ্যের সব ক্লান্তি তার চোখজোড়ায়।শুষ্ক ঠোঁটে অল্পবিস্তর হাসি;মেকি হাসি। এভাবেই মেকি হাসি হাসতে শিখে গেছি আমরা দুজন গত কয়েক মাসে। তাকে আজ বহুদিন পর ভিডিও কলে দেখলাম৷ স্ক্রিনে চোখ মেলে সে আমার দিকে তাকাল না। সুক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা ছেয়ে গেল হৃদয়ে। তাকাল না কেন? আমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় না তার? আমার কাছে আসতে ইচ্ছে হয় না? এত পরিবর্তন! কেন?

কেনর উত্তর নীরদের কাছে ছিল। বোকা নীরদ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারতো ঠিক এমন কিছু অভিমানী প্রশ্ন ইনতিসারের মনেও জমা হয়ে আছে। একটা দূর্ঘটনা, যেটাতে তাদের দু’জনের কারোরই হাত নেই, সে দূর্ঘটনাকে ধরে রেখে তারা একজন আরেকজনের থেকে যোজন-যোজন দূরে সরে গিয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে তাদের মান-অভিমান অমূলক। তারা কি জানে? অতিরিক্ত কোনোকিছুই একটা সম্পর্কের জন্য ভালো নয়। না ঘৃণা, না ভালোবাসা আর না অভিমান।
_______
নরওয়েতে পৌঁছুনোর দিন তিনেক পর থেকেই শুরু হয়ে গেল অলিম্পিয়াডের মূল কার্যক্রম। উদ্বোধনী পর্ব থেকে শুরু করে একদম শেষ পর্যন্ত একটানা সাতদিন আমি পড়াশোনা থেকে একটু একটু করে ব্রেক নিয়ে ছেলেকে সময় দিলাম।
আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম টেক অফের আগেও যে ছেলে নার্ভাস হয়ে কাঁদছিল সে একেকটা পর্ব কি ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সাথে উতরে যাচ্ছে। এবং তার ঐ আত্মবিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত তাকে জিতিয়ে দিলো। দেশের হয়ে সে রৌপ্য পদক জিতলো। শত শত মানুষের সামনে দিয়ে গিয়ে যখন ও স্টেইজে উঠল, ওর গলায় মেডেল পরানো হলো সেই মুহুর্তটা আমাদের তিনজনের জন্যই খুব আবেগপূর্ণ। দীর্ঘ কয়েকমাস পর সেদিন ইনতিসারের সাথে আমার ভিডিও কলে সরাসরি কথা হলো। ফোনের দুপাশে দু’জন আনন্দে কাঁদছি। ও নিজের কান্না আটকাতে দাঁতে ঠোঁট কামড়াচ্ছিল বারবার। আমি অনিমেষ দৃষ্টিতে দেখছিলাম ওর আবেগে টইটুম্বুর মুখখানি। আমাদের আবেগঘন মুহুর্তটাতে একদম হঠাৎ করেই ও চোখ মুছে পূর্ণ দৃষ্টিতে স্ক্রিনে তাকাল। মনে হলো আমার চোখে চোখ রেখেছে। নিষ্পলক কয়েক মুহুর্ত কাটানোর পর খুব কোমল গলায় বলে উঠল,
— ঠিক এই মুহুর্তটাতে তোমায় ভীষণ মিস করছি নীরদ। আমাদের ছেলের এতবড় একটা দিনে তুমি পাশে থাকলে মন্দ হতো না।
এতদিন বাদে ওর মুখে আমার নাম শুনে থমকে গেলাম আমি, থমকে গেল আমার আশেপাশের সবকিছু। অনুভূত হলো তার একটা ডাক, মাত্র কয়েকটা বাক্য এত শক্তিশালী! হৃদয়ে জমাট বাঁধা কঠিন বরফের স্তরটাকে এক লহমায় ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। আর কাঠিন্যের নীচে চাপা পড়ে থাকা আবেগটুকু এতদিন পর ছাড়া পেয়ে একদম হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো। তরল গলায় বলে ফেললাম,
— আর অল্পক্ষণ ইনতিসার।আর কিছুটা সময়। দ্রুতই ফিরবো আমি তোমাদের কাছে। খুব দ্রুত।

মনের কথা মুখ দিয়ে উচ্চারিত হওয়ার পর বুঝতে পারলাম মানুষটার জন্য আমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা এক ধ্রুব সত্যি। এই সত্যিকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সাথে এও বুঝলাম এই মুহুর্তে আমার সমস্ত ইন্দ্রীয় ভয়ানকভাবে তার তৃষ্ণায় তৃষিত। এরপর, মান-অভিমানের খেলা আর টেনে নেয়া সম্ভবপর হলো না। লেটার মার্ক পেয়ে ওতে হার হলো আমার৷ আস্তেধীরে গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম৷ আর পারছিলাম না তাকে ছাড়া। সত্যিই পারছিলাম না৷
ন’মাস দ্রুত কেটে গেলেও পরের তিনটে মাস কাটতে যেন কচ্ছপের গতি লাগল। কে জানে ব্যাকুল ছিলাম বলে তর সইছিল না নাকি!
কোর্স ইতোমধ্যে শেষ, শুধু ফাইনাল এক্সামটাই বাকি। এক্সাম শেষ করেই আমি ফিরে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু আমি যে ফিরব তা ইনতিসারকে জানালাম না শুধু ইঊশা আর তার ফুপিকে জানালাম৷ মানুষটা নাহয় এবার সারপ্রাইজড হোক একটুখানি।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here