ভালোবাসার রংধনু
৯
__________
(১৬)
ভালোবাসা কখনোই জোর করে পাওয়ার মতো কোনো বস্তু নয়। এটা কেবলই একটা অনুভূতি। যা মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । মনের ওপর কখনো কারোর জোর খাটেনা। অনেক সময় নিজেরই জোর খাটেনা, সেখানে বাইরের মানুষ তো অন্য ব্যাপার।
এই সহজ সমীকরণটা ইনতিসার বুঝতে পারেনা কিংবা বুঝতে চায়না। অন্যসব পছন্দের বস্তুর মধ্যে সে আমাকেও ধরে নিয়েছিল চার বছর আগে। যাকে সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে নিজের বানানো চাই। এর ফলাফলই আজকের এই অভিশপ্ত সময়টা।
সবসময়ই তো আমি ওর থেকে পালানোর চেষ্টা করেছি। ও কি বলতে পারবে কখনো ওর কোনো ডাকে সাঁড়া দিয়েছিলাম আমি? সাঁড়া দেইনি কারণ ও আমার জন্য আকাশের চাঁদের মতন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে তাকে কল্পনায় আনতেও আমার আগ্রহ জাগেনি কখনো। যত ব্যাকুল হয়েই ও ডাকুক না কেন আমায়, কখনোই ওর ডাকটা কান পেতে শোনার জন্য আমার মন অস্থির করেনি। বরং বিরক্ত হয়েছি, রাগ লেগেছে, কখনোবা করুণা হয়েছে ওর জন্য। যাকে পাওয়ার ও জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে যে তাকে নিয়ে ভাবতেও চায়না এ কথা কি ও জানে? বুঝতে পারে?
ইনতিসার যেমন মানুষ, এত ডাকের পরেও ওপাশ থেকে সাঁড়া না পেলে তার দিকে আর ফিরে তাকানোরও আগ্রহ হওয়ার কথা নয় বরং তাকে মস্তিষ্ক থেকে ডিলেট করে দিয়ে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। একজন মানুষের জন্য কি কখনো জীবন থেমে থাকে? থাকেনা তো।
কিন্তু ইনতিসার সব নিয়মের উর্ধ্বে। তার প্রেমিক সত্ত্বা তার ব্যক্তিত্ত্বের অপর পিঠ। সে যেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার নিজেরই প্রতিদ্বন্দ্বী। তার কাছে জীবন থামিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নিজের হাতে। সে অন্ততপক্ষে নিজের জীবনটা থামিয়ে রেখেছে আমার কারণে।এখনও তার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে কেবল আমি। চার বছরের দূরত্ব এতটুকুও প্রভাব ফেলেনি তার ভালোবাসার ওপর।
তবে আগের প্রেমিক সত্ত্বার ইনতিসার আর এখনকার ইনতিসার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়েছে। আগের ইনতিসার পাগলাটে ছিল, এখনকার ইনতিসার ভীষণ অভিমানী। কিন্তু যার কাছে অভিমানের কোনো মূল্য নেই তার কাছে অভিমান দেখিয়ে লাভ আছে?
শক্ত করে চেপে রাখা আমার বাহুদ্বয় ধীরে ধীরে বাঁধনছাড়া হলো। ইনতিসার আঁজলা ভরে আমার মুখখানি নিয়ে খুব নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো,
— এই চার বছরে এক মুহুর্তের জন্যেও আমায় ভালোবাসনি নীরদ?
অশ্রুসজল আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। ওর চোখজোড়াও টুলটুল করছে পানিতে। কড়া স্বরে বললাম,
— না। ভালোবাসা দূর, আপনার মুখ দেখতেও ইচ্ছে করেনা আমার।
— আমার অপরাধটা কোথায় নীরদ? কেন শুরু থেকেই তোমার কাছে এতটা অপছন্দনীয় আমি? কেন তুমি সবসময় আমি বিমুখ থাকতে চাও?
কাতর হয়ে শুধলো ও। উত্তর দিলাম না আমি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ইনতিসার পুনরায় গালে হাত রেখে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো আমায়৷
— উত্তর দাও নীরদ। চুপ করে থেকো না। কেন আমায় ভালোবাসনা তুমি? কেন সবসময় আমার থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাও? কেন আমার ভালোবাসাকে মিথ্যে মনে হয় তোমার? এদিকে তোমায় ভালোবেসে যে প্রতিনিয়ত দহন জ্বালায় জ্বলছি চোখে পড়েনা তোমার?
ওর প্রশ্ন শুনে অজান্তেই আমার মনটা বলে উঠলো,
— পড়ে। কিন্তু বুঝতে দিইনা। ইচ্ছে করেই অবুঝ সেজে থেকেছি সবসময়। কারণ প্রেমিক ইনতিসারকে বরাবরই ভয় পাই আমি। চাইনি সে আমার জীবনের আরেকটা দূর্ভাগ্যের নাম হোক।
ভালোবাসবার পূর্বে ইনতিসার কখনো আমার মতো চিন্তা করেনি। সে শুধু মন দিয়ে ভালোবেসেই গেছে,তাই হয়তো আমাদের মধ্যেকার ব্যবধানগুলো কখনো তার চোখে পড়েনি। একটা সময় এমন এসেছিল সে সকলের সামনে জাহির করে দিচ্ছিল তার ভালোবাসার কথা। সময় বাড়ার সাথেসাথে সাহস বেড়ে যাচ্ছিল তার ভীষনভাবে। দিনের আলোয়, বাড়িতে মানুষ ভরা এমন অবস্থাতেই হুটহাট আমার ঘরে ঢুকে যেত বিনা নোটিশে। অধিকাংশ সময়ই তো আমি বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতাম, দেখা যেত সে এসে বই কেড়ে নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে আমার সামনে মেঝেতে জামু ফেলে বসছে। বলছে,
— গ্লুমি ওয়েদার একটু চুল টেনে দাও তো। মাথা ব্যথায় মরে যাচ্ছি আমি উফফ।
অথবা আমি ঘুমিয়ে থাকলে জোর করে ঘুম থেকে টেনে তুলে এক ধমক দিয়ে বলছে,
— এত ঘুম কিসের হ্যাঁ? সারাদিন খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কোনো কাজ নেই তোমার! এদিকে খিদেয় যে মরে যাচ্ছি আমি, জীবনে খোঁজ নিয়েছো আমার? নাওনি তো। যাও এখন সোনায় বাঁধানো হাতদুটো দিয়ে একটু খাবারদাবার রান্না করে নিয়ে আসো। দশ মিনিট সময় দিলাম। না আনলে কিন্তু কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেবো বললাম।
আমি কখনোই ওর এসব পাগলাটে কাজকর্মকে গুরুত্ব দিতাম না। বিরক্তিকর একটা এক্সপ্রেশন দিয়ে ওকে ইগনোর করে চলে আসতাম। বিনিময়ে সেও থেমে থাকতো না। একটা না একটা ক্ষতি করতোই আমার। বড় রকমের না হলেও ছোটখাটো করতো। ওর এসব অদ্ভুত আচরণের পেছনের কারণটা আমি তখনই ধরতে পারলাম। সন্দেহ হতো, ওর মনে হয়তোবা কোনো অনুভূতির জন্ম নিয়েছে আমায় ঘিরে। নইলে মার মার কাট কাট সম্পর্কের পরেও ও বারেবারে নানা বাহানায় আমার আশেপাশে থাকতে চাইবে কেন? ওর মনে আমার জন্য অনুভূতি আছে এটা ভাবতে গেলেও আমার ভয় লাগতো। যতই হোক আমি এবাড়িতে আশ্রয়ে ছিলাম। আশ্রয়ে যারা থাকে তাদের নিয়ে কখনোই কেউ ভালো ধারণা পোষণ করেনা। সেখানে এবাড়িরই ছোট ছেলের সাথে যদি কোনোপ্রকার সম্পর্কে জড়িয়ে যেতাম তাহলে কি দূর্দশাই না হতো আমার! তাছাড়াও আপা এ বাড়ির বউ। আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে না যাওয়া সত্ত্বেও কেবল প্রেমের সম্পর্কের থেকে সে এ বাড়ির বউ হতে পেরেছে। এখন আমিও যদি ইনতিসারের ডাকে সাঁড়া দিয়ে ফেলি তাহলে লোকে এটাই ভাববে বড়লোক পরিবার দেখে এক বোন আরেক বোনকে লেলিয়ে দিয়েছে। আমার পরিবার নিয়ে, মৃত মা-বাবাকে নিয়ে নোংরা কথা উঠতো। আমাদের লোভী বলে জানতো সকলে। আর আমি এসেছি থেকেই বুঝতাম এ বাড়ির হাতে গোনা দু একজন ছাড়া আর কেউ আমায় পছন্দ করতো না, মেনে নিতে পারেনি। যে পরিবারের প্রায় সবাই ই আমি বিমুখ সে পরিবারের কারোর সাথে সম্পর্ক গড়ার কথা ভাবতাম কি করে?
অবশ্য সবসময় যে সন্দেহ হতো সেরকমটাও নয়। একবার ভাবতাম আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। ইনতিসারের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য বেশ, আমাদের মন-মানসিকতা এবং চালচলনও ভিন্ন। ভেবে নিলাম ওর আমার প্রতি যদি কোনো ভালোলাগা জন্মেও যায় তা অবশ্যই সৌন্দর্যের মোহ। এ মোহ ক্ষণস্থায়ী। চোখের পলকে কেটে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা এমন ছিল না। বরং ইনতিসারের পাগলামির চূড়ান্ত রূপ শেষ অবধি সে আমায় দেখিয়েই ছাড়ালো। চিরকালের জন্য নিজের সাথে বাঁধবার অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে এলো এক বিকেলে।
এসএসসি পরীক্ষার সময় চলছে। আর একমাস বাদেই পরীক্ষা। লেখায়পড়ায় কোনোরকম গ্যাপ আছে কিনা যাচাইয়ের জন্য পুনরায় এক প্রস্তুতি কোচিং-এ ভর্তি হয়েছিলাম। দুপুরের শিফটে ছিল সে কোচিং। আপা নিয়ে যাওয়া আসা করত। আমিই বলেছিলাম ওকে ইনতিসারের অত্যাচার থেকে বাঁচতে। আপারও মনে হয় কোনোভাবে সন্দেহ হয়েছিল ইনতিসারকে। তাই সেও না করল না।
কিন্তু একদিন দুলাভাইয়ের কোন বন্ধুর বাড়িতে এক দাওয়াত অ্যাটেন্ড করতে হতো তাকে। দোটানায় পড়ে গেল, আমার কোচিং-এ যাবে নাকি দাওয়াতে? আমি ওর দোটানা দেখে স্ব-উদ্যোগে বললাম, আজকের দিনটা আমি একা যাই,তুমি চিন্তামুক্ত দাওয়াতে চলে যাও কোনোই সমস্যা নেই। আমার কথায় আপা ভরসা পেয়ে পরে দুলাভাইয়ের সাথে চলে গেল। একা একাই সেদিন কোচিং করে বাড়ি ফিরলাম। ইনতিসার আগেরদিন বাড়িতে ছিল না। সেদিন বিকেলেই কোত্থেকে উদয় হলো। খোঁজ নিয়ে দেখলো আপা বাড়িতে নেই। এমন সুযোগ হাতছাড়া করবে কেন? কারো তোয়াক্কা না করে সোজা আমার ঘরে চলে এলো। আমি তখন মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছি। ওকে দেখে স্বভাবতই ভয় পেয়ে গেলাম। অসময়ে একটা ছেলেমানুষ ঘরে এলে যেমন বিপদাপদের ভয় হয় ঠিক তেমন ভয়। ভয় পাবার আরও একটা কারণ হলো, ও কেমন অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল পুরো ঘরজুড়ে। বারবার নিজের মাথার চুলগুলো টানছিল আর বিড়বিড় করছিল। ওকে এমন এলোমেলো দেখে ভয়ানক কোনো বিপদের আশংকা করছিলাম আমি। সুযোগ যেন নিতে না পারে এজন্য ভয় পেয়েছি বিষয়টা বুঝতে দিলাম না। বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করলাম,
— আপনি এই অসময়ে এখানে কেন?
আমার প্রশ্ন শুনে ও চকিতে তাকালো, তারপর কালবিলম্ব না করে এক ছুটে চলে এলো আমার কাছে। হাতদুটো টেনে ধরে বলল,
— শোনো নীরদ তোমাকে একটা সিরিয়াস কথা বলবো এখন। মন দিয়ে শুনবা ঠিকাছে?
আমি ওর অসংলগ্ন গলা শুনে ভড়কে গিয়ে আলতোভাবে মাথা নাড়লাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলে ও দিলোনা। ঘনঘন শ্বাস ছেড়ে খুব দ্রুততার সাথে বলতে লাগলো,
— আমি মনে হয় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি নীরদ। তুমিই আমার সিরিয়াস প্রেম। তোমাকে দেখার পর থেকে কেমন অশান্তি শুরু হয়েছে মনের ভেতর। এক মুহুর্ত স্থির থাকতে পারিনা।সবসময় তোমাকে চোখের সামনে বসায় রেখে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে ইচ্ছে হয়। তুমি মাফিনের সাথে কথা বলার সময় যখন অল্প করে হাসো তখন আমার কি ইচ্ছে করে জানো? তোমাকে শক্ত করে জড়ায় ধরে চুমু খাই। তোমার ফোলা ফোলা গাল আমার খুব ভালো লাগে নীরদ। দেখলে মনে হয় এক টুকরো সাদা মেঘ। আমায় ডেকে ডেকে বলে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে।
তুমি আমার আশেপাশে থাকলেই আমি টের পেয়ে যাই জানো? তোমার গায়ের গন্ধ আমার খুব ভাল্লাগে, কেমন নেশা ধরে যায়।
তোমাকে দেখার পর থেকে আমার আর কাউকেই ভালো লাগেনা নীরদ৷ তুমি আমাকে পাগল করে দিচ্ছ৷ আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনা তোমার জন্য। চোখ বন্ধ করলে তোমার চেহারা ভাসে চোখের পর্দায়। দেখো আমার চোখদুটো ভালো করে দেখো, না ঘুমাতে ঘুমাতে ইনসমনিয়ার পেশেন্ট হয়ে গেছি। কত ডার্ক সার্কেল চোখের নিচে দেখো?
বলতে বলতেই ও ঝুঁকে পড়লো আমার ওপর। আমি মাথা সরিয়ে নিলে আবারও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
— আমি জানি আমার কথা খুব এলোমেলো লাগছে তোমার কাছে। আমি যে একদমই গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা নীরদ। আচ্ছা কনক্লুশনে আসি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমাকে বিয়ে না করলে টুপ করে মরে যাব আমি। দেখছো না কত খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি! তুমি আমাকে বিয়ে করবে নীরদ? সব ব্যবস্থা করে এসেছি আমি। আমরা এক্ষুণি কাজি অফিসে যাবো। কিচ্ছু করতে হবেনা তোমায়, শুধু একটা রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিবা। বাকি সব কাজ আমার। আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার বউ হয়ে গেলেই সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। প্লিজ চলো নীরদ? প্লিজ। বন্ধুদের কাজি অফিসে বসিয়ে রেখে এসেছি আমি। তোমাকে চেইঞ্জ করতে হবেনা। শুধু একটা ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে নাও। বলতে বলতেই র্যাকের ওপর থেকে একটা লাল রঙের ওড়না এনে আমার মাথায় পেঁচিয়ে দিলো ও। তারপর হাত টেনে ধরলো শক্ত করে।
— চলো নীরদ। বেশিক্ষণ লাগবে না। শুধু একটা সাইন।
সেদিনকার ওর অদ্ভুতুড়ে আচরণ আমার শরীর হিম করে দিচ্ছিল। ভয়ে থরথর কাঁপছিলাম আমি। কি সর্বনাশের কথা! বিয়ে করবে আমাকে? সব ব্যবস্থাও করে এসেছে? ইশশ কেউ জানতে পারলে কি ঝামেলার মধ্যেই না পড়তে হবে!
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমি কান্নামাখা গলায় বললাম,
— প্লিজ আমার হাত ছাড়ুন। আর এক্ষুণি চলে যান এ ঘর থেকে। এসব কথা কেউ জানতে পারলে বিপদে পড়তে হবে আমাকে।
এক মুহুর্ত বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ও। নরম সুরে ভরসা দেবার মতো করে বলল,
— কাঁদছো কেন নীরদ? কেঁদো না। আর এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি আছি তো! আমার ওপর একটু ভরসা করো। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না তোমার। শুধু বিয়েটা হতে দাও প্লিজ।
— নাহ্ আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।
জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম আমি। সে দু কদম এগিয়ে এসে ফের হাত টেনে ধরলো আমার। কাতর স্বরে বলল,
— আমাকে ভুল বুঝোনা নীরদ। বাজে কোনো উদ্দেশ্যে বিয়ে করতে চাইছি না বিশ্বাস করো। ভালোবাসি তোমায়, ভীষণ ভালোবাসি। এজন্য হারানোর ভয় পাই। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে আর কেউ তোমায় আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। তুমি না চাইলে কখনো ছুঁয়েও দেখবো না তোমাকে, একটুও কাছে আসার চেষ্টা করবো না। তবুও রাজি হয়ে যাও?
— নাহ্ এভাবে হয়না। এরকম বিয়ের কোনো ভিত্তি নেই, সমাজস্বীকৃত নয় এসব। তাছাড়াও আমি কখনো আপনাকে ঐ দৃষ্টিতে দেখিনি।
— দেখনি এখন দেখবে। একবার তোমায় ভালোবাসার সুযোগ দাও। যত্নে আগলে রাখবো দেখো।
— উফফ আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? এরকম করে হয়না। এসব মুখের কথার মতো এত সহজ নয়।
— একটাবার ভরসা করে দেখো নীরদ। একটাবার!
— প্লিজ চলে যান আপনি আমার ঘর থেকে। মাথা ঠিক নেই আপনার।
— মাথা আমার ঠিকই আছে। তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো আমার অবস্থাটা।
— কিচ্ছু বোঝার নেই এখানে। আর এত জোর করছেন কেন? বলছি না বিয়ে করতে চাইনা আপনাকে!
বিরক্তির সাথে বলি আমি। সে দু’হাতে আমার কাঁধ চেপে ধরে।
— কেন চাওনা? পছন্দ করো না আমাকে?
— না করিনা। আর কখনো করবো ও না, আপনি একটা বাজে ছেলে।
রাগটা সামলাতে না পেরে ঝাঁঝালো স্বরে বলি। এবারে সেও রেগে যায়। রাগের বশবর্তী হয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় আমায়। তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
— বাজে ছেলে! আমি বাজে ছেলে? কতটুকু জানো তুমি আমার সম্পর্কে? আজ পর্যন্ত কি কি বাজে অভ্যেস দেখেছ তুমি আমার মধ্যে বলো?
— বড়লোক বাবার বখে যাওয়া জিদ্দি, একরোখা বদমাশ ছেলে আপনি। এটাই বাজে ছেলেদের সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য।
— আমি জিদ্দি, একরোখা, বদমাশ? জিদ দেখিয়েছি তোমাকে এখনো? দেখাবো জিদ কাকে বলে? তুলে নিয়ে কাজি অফিসে ফেলবো?
হনহন করে হেঁটে এসে রক্তচক্ষু নিয়ে বলে সে।
আমি এবার কেঁদেই ফেলি। কাঁদতে কাঁদতে বলি,
— সিনক্রিয়েট করবেন না। চিৎকার করতে বাধ্য হবো আমি।
— চিৎকার করবে? করো দেখি। কাজ তো আরও সহজ হয়ে যাবে। চিৎকার করে লোক জড়ো করবে তুমি। সকলের সামনে আমি বলবো আমাদের প্রেমের সম্পর্ক আছে। ঝগড়া হয়েছে তাই কাঁদছো। যে বিয়ে লুকিয়ে করতে চেয়েছিলাম সেটা এখন সকলের সামনে হবে। কারোর মত থাকুক আর না থাকুক।
ওর কথা শুনে নিজেকে অসহায় লাগতে শুরু করে আমার। যে পন্থাই অবলম্বন করতে যাচ্ছি তাই বিপরীতে যাচ্ছে। এভাবে ওর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। মনে প্রাণে প্রার্থনা করতে শুরু করি কেউ একজন আসুক। আপা কিংবা অন্যকেউ। এই পাগল ছেলেটার হাত থেকে বাঁচাক আমাকে।
প্রার্থনা খুব জলদিই কবুল হয়ে যায় কীভাবে যেন! অকস্মাৎ ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে আপা ঢোকে ভেতরে। ইনতিসার আর আমাকে এভাবে দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়। তারপর ধীরগলায় জিজ্ঞেস করে,
— ইনতিসার তুমি এ অসময়ে নীরদের ঘরে কি করছো?
আপার প্রশ্নের পর ইনতিসার আমার থেকে একটু সরে দাঁড়ায়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। চোখমুখের এক্সপ্রেশন চেইঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবে ও জবাব দেয়,
— বিয়েতে রাজি করাতে এসেছি।
কণ্ঠে স্বাভাবিকতা থাকলেও চোখেমুখে ওর অন্যরকম কঠোরতা। এর সঠিক কারণ বুঝতে পারিনা আমি।
ওদিকে ওর উত্তরে হতভম্ভ হয়ে যায় আপা। চোখের পলক না ফেলে একবার ওর দিকে, একবার আমার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়মাখা গলায় প্রশ্ন করে,
— কার বিয়ে? কিসের বিয়ে?
— আমাদের বিয়ে, আমার আর নীরদের। আমি নীরদকে ভালোবাসি ভাবি।
পূর্বের ন্যায় সাবলীল স্বীকারোক্তি। কিন্তু এই সাবলীল স্বীকারোক্তি যে আমার ওপর ঝড় বয়ে আনতে পারে এটা একবারও চিন্তা করেনা ও।
আমিও ঐ মুহুর্তে ভাবতে পারিনি ও এমন দুঃসাহসিক কোনো কাজ করতে পারে। আপার সামনে দাঁড়িয়ে রিঅ্যাকশন কি হবে তা কল্পনা করে দম বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করে আমার।
আপা খানিক সময় নেয় বিষয়টা বুঝতে। ঘরের মধ্যে তখন পিন পতন নীরবতা। আমি শব্দ বিহীন কাঁদছি। আপাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবো সেজন্য মনে মনে কথা সাজাচ্ছি। ঠিক সেই মুহুর্তে আপা আমার হাতটা টেনে নিয়ে তার সামনে দাঁড় করালো। এবং কিছু বুঝে ওঠার পূর্বে সর্বশক্তি দিয়ে এক থাপ্পড় কষালো আমার গালে। অকস্মাৎ মারে ব্যালেন্স হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম আমি। আপাই টেনে তুলল আবার। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— শেষ পর্যন্ত আমার ভয়টাকেই সত্যি করে দিলি? আমারই আশ্রয়ে থেকে এতবড় ক্ষতি করে দিলি আমার? এসব করার জন্যই এসেছিস এখানে?
আমি অনুনয়ের সুরে বললাম,
— আপা বিশ্বাস করো তুমি যেমন ভাবছো তেমন কিছুই নয়। ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
— চুপ কর নির্লজ্জ। ধরা পড়ে এখন মুখের ওপর মিথ্যে বলছিস? সম্পর্ক নেই তাহলে ও তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে আসবে কীভাবে?
উত্তরে আমি কিছু বলবো তার পূর্বে ইনতিসার এগিয়ে এলো। আপার থেকে আমায় ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
— ভাবি তুমিও জানো নীরদের কোনো দোষ নেই এখানে। আমাদের সমস্ত কথোপকথন যে এতক্ষণ বাইরে থেকে শুনছিলে এটা আমি জানি। শুধুমাত্র আমাকে শাস্তি দেবার জন্য ওকে এভাবে মারার প্রয়োজন নেই। যা বলার সরাসরি আমাকে বলো।
চমকাবার পালা ছিল আমার। আপা বাইরে থেকে শুনছিল আমাদের কথা? তাহলে এতক্ষণ ঘরে এলো না কেন? আচমকা বিষয়টা নিয়ে রাগ হলো আমার। অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও মার খেয়েছি, ব্যাপারটা হজম করতে পারলাম না আমি। এবং আমার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো ইনতিসারের ওপর। হ্যাঁ ওর জন্যই এতসব ঘটছে । দোষ না করেও দোষী হয়ে যাচ্ছি আমি।
এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিই ওর থেকে। চোখের পানি মুছে বলি,
— সব হয়েছে আপনার জন্য। ভালোবাসা ভালোবাসা ভালোবাসা। ক্যাসেটের মতো বাজিয়ে যাচ্ছেন তখন থেকে। বলেছি না একবার পছন্দ করিনা আপনাকে, ভালোবাসতে পারবো না। বিয়ে করতে চাইনা। বুঝতে পারছেন না আমার কথা?
— নীরদ আমার কথাটা শোনো..
— আপনি আমার কথা শুনুন। ভালোবাসবার মতো কোনো কোয়ালিটি নেই আপনার মধ্যে। অতিরিক্ত রাগ, জেদে ভরা আর দুহাতে টাকা ওড়ানো ছাড়া আর কি কোয়ালিটি আছে আপনার? আমাকে শোনান না মেয়েরা মৌমাছির মতো আশেপাশে ঘোরে আপনার? কারণ আপনার লেভেলই ওরকম। টাকা পয়সার ভারে ওপরে উঠলেও বাস্তবিকপক্ষে আপনি একটা নিচু সস্তা টাইপ ছেলে। আপনাদের মতো সস্তা ছেলেরা আমার দু চোখের বিষ। ঘৃণা করি আমি আপনাদের, ভীষণ ঘৃণা করি।
— চিৎকার চেঁচামেচি কোরো না নীরদ। শান্ত হও।
— শান্ত হবো। কি শান্ত হবো? জীবনটাকে জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছেন আমার। সেই প্রথম দিন থেকে। আপনার এত মানসিক অত্যাচার আর নিতে পারছি না আমি।
দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে মেঝেতে বসে পড়ি আমি। আমায় এমন অবস্থায় দেখে আপা দৌড়ে আসে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
— শান্ত হ নীরদ শান্ত হ।
— শান্ত হবো? এই ছেলেটা যতক্ষণ আমার সামনে থাকবে কিছুতেই শান্ত হতে পারবো না আমি। শোনো আপা অনেক হয়েছে এবাড়িতে থাকা। তুমি যে ভয় পাও বাইরে একা একটা মেয়ে থাকলে কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে? আসলে আমার সবচাইতে বড় ক্ষতি হবে এবাড়িতে থাকলে। এই ছেলেটার জন্য। আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকতে চাইনা। তুমি এক্ষুণি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। চলো।
চোখের পানি মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াই আমি।
এবারে ইনতিসার কথা বলে।
— হাইপার হয়না নীরদ। রাগের মাথায় কোনো ডিসিশন নেবে না।
— আপনার লজ্জা করেনা এসব বলতে? এত কথা শোনবার পরেও নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কীভাবে?
আরও দুটো কথা শোনাতে নেই কিন্তু আপা আটকে দেয় আমাকে। হাত টেনে ধরে বলে,
— চুপ কর নীরদ। চুপ কর। আর বলিস না কিছু। অনেক বলে ফেলেছিস ইতমধ্যে। এখন চুপ কর।
আর ইনতিসার প্লিজ তুমি এখন চলে যাও ভাই। আব্বার ফেরার সময় হয়েছে। ভুল করেও যদি উনি এসব জানতে পারেন তাহলে বিরাট বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। আমি রিকোয়েস্ট করছি তোমাকে। প্লিজ যাও।
আপার রিকোয়েস্টে এবার কাজ হয়। এক মুহুর্ত ব্যয় না করে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ইনতিসার। আর আমি রাগে, দুঃখে একাকার হয়ে আপার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদি। সব সময় সব সমস্যার উৎস আমিই কেন হই?
চলবে,
sinin tasnim sara