ভালোবাসার রাত,পর্ব (১৩)
রোকসানা রাহমান
তিলকে অবাক করে দিয়ে রিদ বিছানায় উঠে গেলো। তিলের পড়োহিত জামায় হাত দিতেই তিল চিৎকার করে উঠলো,,
“” আমি চেন্জ কলছি,প্লিজ জামা ছিলবেননা””
“” গুড,তোর তো দেখি দিনে দিনে বুদ্ধী বাড়ছে। কিন্তু বুদ্ধীর উৎপত্তি এতো লেট করে করছিস কেন? সারের দাম কি বেড়েছে? চিন্তা করিস না আমি নাহয় সার কেনার টাকাটা তোকে দিয়ে দিবো,তুই এককালীন কিস্তিতে আমাকে পরিশোধ করিস। তবে হ্যা,চক্রবৃদ্ধি হারে কিন্তু সুদও দিতে হবে,বুঝেছিস?””
“” চক্লবৃদ্ধীতে কেন?””
“” সেটা তোকে পরে বলবো। এখন ঝটপট জামাটা পাল্টে নে।””
তিল নিজের বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই রিদ বলে উঠলো,
“” তুই যদি ওয়াশরুমে গিয়েই জামা পাল্টাবি,তাহলে আমি এতো কষ্ট করে দরজায় সিটকিনি লাগালাম কেন? সিটকিনি লাগাতে আমার কতটা এনার্জি লেগেছে জানিস?””
“” তাহলে কোথায় চেন্জ কলবো?””
রিদ নিজের হাতটাকে সামনের দিকে তাক করে বললো,
“” এই যে এই জায়গায়,ঠিক আমার সামনে দাড়িয়ে চেন্জ করবি। দাড়া আমি আগে ঠিকঠাক পজিশনে বসে নেই।””
“” কি! আপনাল সামনে?””
“” চোখদুটো এমন রসগোল্লার মতো করেছিস কেন? তুই জানিস না আই হেট রসগোল্লা? রসমালাইয়ের মতো করতে পারিস কজ আই লাভ রসমালাই!””
রিদের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে তিলের মনে হলো উনার সামনে কয়েক কেজি রসমালাই রাখা আছে। আর সে এখনি দুহাত মেখে টপাটপ মুখে পুড়বে।
“” কি,হলো শুরু কর!””
তিল জামাটা রিদের দিকে নিক্ষেপ করে গালটা শক্ত করে বললো,
“” আমি পালবোনা।””
“” কেন,পারবিনা? এটা তো এতো কষ্টের কাজ না,তিল। সামান্য জামা চেন্জ করাতেও তোর এতো আলসেমি? আগে জানলে তো তোকে গরম পানিতে গোসল না করিয়ে ঠান্ডা পানিতে গোসল করাতাম।””
“” উফ! বলছি তো পালবোনা। আপনি এখান থেকে যান।””
রিদ বিছানা থেকে নেমে এসে তিলের সোজাসুজি দাড়িয়ে বললো,
“” এটা তো কষ্টের কাজ না,তিল। এতো বেশি আলসেমি তোকে মানায় না। এই দেখ আমি তোকে দেখাচ্ছি। এই যে এভাবে জামাটা নিচ দিকে শক্ত করে ধরবি,এক হাত পেছনের পার্ট আরেক হাত সামনের পার্ট ধরবি,তারপর আসতে আসতে উপরে তুলে, গলা দিয়ে বের করে ফেলবি,ব্যাস হয়ে গেলো!””
রিদ নিজের গেন্জিটা পুনরায় আগের মতো করতে করতে তিলকে বললো,
“” আচ্ছা,তুই নিচ থেকে ধরে উপরে তুলে চেন্জ করিস,নাকি আগে হাতা থেকে হাত বের করিস??””
রিদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তিল জামাটা নিয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। বাইরে থেকে রিদের মুচকি হাসিটা তিল দেখতে পেলোনা। আমি তো এটাই চাই, তুই আমার কথার অবাধ্য হোস। কিছু কিছু ভালোবাসায় অবাধ্যটাতো খুব বেশি গভীর ভালোবাসার জানান দিয়ে যায়!
“” বাহ! লাল কালার জামাই তো তোকে বেশ মানিয়েছে।””
তিলকে আয়নার সামনে নিয়ে দাড় করালো রিদ। আর কানে ফিসফিস করে বললো,
“” মনে আছে,ছোটবেলায় তোর লাল জামাটা ছিড়ে ফেলেছিলাম বলে তুই কিভাবে ভ্যা ভ্যা করে কাদছিলি?? কেন কাদছিলি বল তো? জামা ছিড়ে ফেলেছিলাম বলে? আজ থেকে তুই কবুল বলার আগ পযন্ত শুধু লাল কালার জামাই পড়বি। এটা তোর শাস্তি। কারন ঐদিন তোর কান্নার জন্যই তো আমি তোকে শাড়িটা পড়াতে পারিনি। যা ওয়াড্রবটা খুলে দেখ!””
তিলকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই রিদ দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো।
তিল ওয়াড্রবটা খুলে তো অবাক,এখানে তার পুরোনো কোনো জামাকে দেখতো পারছেনা। শুধু লাল আর লালের খেলা জমে আছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীর সবটা লাল রং এখানে এসে বাসা বেধেছে। নতুন জামা দেখে মনটা খুশিতে নেচেও উঠলেও পরক্ষণেই বিরক্ত নেমে আসে চেহারায়। প্রতিদিন এক কালার জামা পড়লে কেমন দেখাবে?? বিচ্ছিরি লাল পোকার মতো নিশ্চয় যাদের জামার প্রয়োজন হয়না।
তিলকে বেশ সুন্দর করেই সাজানো হয়েছে। পুরো ক্রেডিটটাই ঘটা করে নিজের আয়ত্ত করে নিচ্ছে রিমা। আর পাশ থেকে সিকান্দারও বার বার শার্টের কলারটা ঠিক করার বাহানায় বার বার বুঝাচ্ছে রিমা যে তার বউ। আর বউয়ের ক্রেডিট মানেতো তারই ক্রেডিট তাইনা???
রিদকে লাল পান্জাবীতে মনে হচ্ছে,যুদ্ধে জয়ী হওয়া কোনো দেশের রাজপুত্র আর জয়ী হবার সুবাদেই সেখানকার রাজা তার কন্যাকে কন্যাদান করছেন। তিলের চোখ যেন আজ রিদের দিকে সরছেইনা। তার লাল কুৃমারটা এতো সুন্দর কেন???
তিলের ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটান বড় আব্বু। পাশ থেকে তিলের হাতটা ধরে টানতে টানতে নিজের রুমে নিয়ে আসে। নিজের বিছানার পাশে বসিয়ে পায়চারী করছেন। তিল এতক্ষন চুপ থাকলেও এবার বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
“” কি হয়েছে বড় আব্বু? তুমি এরকম ঘামছো কেন? এনিথিং রং?””
“” আমি জানি তোর এই বিয়ে তে মত নাই। রিদানের অত্যাচারের ভয়েই করছিস তো? কিন্তু তুই কি এটা বুঝতে পারছিসনা ওকে বিয়ে করা মানে ওর সাথে সারাটা জীবন কাটানো। তাহলে তুই কোন অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য এরকম করছিস?? তোকে কি বলবো? আমি নিজেই বাবা হয়ে ছেলের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছিনা। এতো বছর পর ছেলেকে কাছে পেয়ে আমার শক্ত মন নরম হয়ে গেছে এতোই নরম হয়েছে যে..””
বড় আব্বু নিজের কথা শেষ না করেই পুনরায় পায়চারী করতে করতে বললো,
“” তিল,তোকে আমি সম্পুর্ন হেল্প করতে রাজী আছি। তুই কি পালিয়ে যেতে চাস? তাহলে আমি নিজে তোকে…””
তিল মুচকি হেসে বড় আব্বুর দিকে এগিয়ে গেলো। উনার পায়ে সালাম করে বললো,
“” বড় আব্বু,আমি তোমাকে আব্বু ডাকার আগে যে বড় বলে সম্বোধন করিনা? এই বড় শব্দটা মুছে ফেলতে চাই আর সেটা তোমার ছেলেকে বিয়ে করে।””
“” মা,তুই বুঝতে..””
“” আমি কিছু বুঝতেও চাইনা,শুধু এটা বুঝি তোমার ছেলের অত্যাচারগুলোকে যেন কখনো মিস করতে না হয় সেই কাজটাই করছি,আর সেটা তোমার ছেলের ভয়ে নয়,ভালোবেসে!””
আমির আলী সাহেব খুবই বিস্মিত হলেন। আমার ছেলেটার সাথে কি তাহলে মেয়েটাও পাগল হয়ে গেলো???
তাসমিয়া বেগম বারবার চোখের পানি মুছে ভিজিয়ে ফেলেছেন নিজের শাড়ীর আঁচল। আজ দুটো ভালোবাসার পুর্নতা পাচ্ছে। কেউ জানুক আর না জানুক সেতো জানতো তিল রিদের জন্য কত চোখের পানি ফেলেছে??? আর রিদ? সে তো ছোট্টবেলায় তিলের কপালে সেকেন্ডে সেকেন্ডে কালো টিপ দিতো যাতে তিলের দিকে কারো নজর না পড়ে। টিপটা হালকা হয়ে এলেই সাথে সাথে গাঢ় করে দিতো। বলাতো যায়না হালকা করে থাকা কাজলের টিপ যদি বদ নজরের সাথে লড়াই করতে না পারে??? তাসমিয়া বেগমের ইচ্ছে হলো আজকেও তিনি তিল আর রিদের কপালে নজর কাটা দিয়ে দিতে। যাতে তাদের উপর কেউ নজর লাগাতে না পারে।
রিদ আর তিলের এনগেজম্যান্ট সম্পন্ন হলো খুবি ঘরোয়াভাবে। হঠাৎ করে রিদের চাওয়াকে পুরন করতে যে কয়জনকে পেয়েছেন সেকয়জনকে বাসায় এমে হাজির করেছেন আমির আলী।
“” রিদ,বিয়েটা তিলের পরীক্ষার পরে ঠিক করলে হয়না,বাবা?””
“” না,হয়না। পরীক্ষার এখনো দুমাস বাকি,আব্বু। আমি এভাবে একা একা থাকতে পারবোনা। আই নিড তিল ইন মাই রুম!
ছেলের এমন লজ্জাহীন কথায় নিজেরই মুখ ঢেকে ফেলার অবস্থা হয়েছে আমির আলী সাহেবের। এভাবে বাবার সামনে কোনো ছেলে যে এমন কথা বলতে পারে সেটা রিদানকে না দেখলে হয়তো জানতে পারতোনা। এই মুহুর্তে এখানে থেকে ছেলের লজ্জাহীন কথা না শুনার থেকে ভালো বিয়ের কাজে লেগে পড়ার। আর কটা দিনই বা আছে? ১৫ মার্চ বিয়ে মানে হাতে আর ১৭ দিন বাকি। আমাদের বংশের একমাত্র ছেলে বলে কথা বিয়েটা তো যেন তেনভাবে দেওয়া যাবেনা।
তিল বিছানা গুছানোর সময় সিকান্দার সাহেব এসে হাজির। হাতে একটা হলুদ পান্জাবী।
“” তিল,আপামনি, আপনি কি আমাকে একটু বিষ দিবেন? আমি খেয়ে মরে যায়??””
“” আত্মহত্যা করবেন? কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয় দুলাভাই,আমার কাছে কোনো বিষ নাই।””
বিষ নাই শুনে সিকান্দার সাহেবের মাথায় বাড়ি পড়লো। এমনি ভাব নিয়ে তিলের মাত্রই ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করা বিছানায় ধপ করে বসে পড়লেন। ডান হাতটা কপালে ঠেকানো।
“” কি হয়েছে,দুলাভাই? আমাকে কি বলা যাবে?””
তিলের এই কথাটারই জন্য মনে হয় সিকান্দার সাহেব ওয়েট করছিলেন। চট করে বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে গেলেন। হাতের পান্জাবীটা তিলের দিকে বাড়িয়ে বললো,
“” দেখুন,রিমা বলছে আপনাদের গায়ে হলুদে নাকি আমাকে এই পান্জাবী পড়তে হবে।””
তিল পান্জাবীটার দিকে চোখ বুলিয়ে বললো,
“” সুন্দরীতো। আপনাকে বেশ মানাবে,দুলাভাই। কিন্তু এটার জন্য আপনাকে বিষ খেতে হবে কেন সেটা এখনো বুঝতে পারছিনা।””
সিকান্দার পান্জাবীটা ভালো করে মেলে বুকের দিকটা বাড়িয়ে বললো,
“” দেখুন হলুদ পান্জাবীতে কালো কালারের গাঁদা ফুলের ছাপ। আপনিই বলুন গাঁদা ফুল কি কালো কালার হয়? আর তাও কি হলুদ পান্জাবীতে? আপনার গায়ে হলুদে আমার কি কোনো প্রেস্টিজ থাকবে?””
তিল পান্জাবীটা ভালো করে দেখলো,সত্যিই হলুদ কালার পান্জাবীতে কালো গাদা ফুলের ছাপ রয়েছে। নিচে আবার ক্যাপশন হিসেবে ইউস করা আছে আমার কালো গাঁদা। তবে দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। কিন্তু সিকান্দার সাহেবের অসহায় কথা আর অসহায় মুখ দেখে বেশ মায়া হলো তিলের। রিমাটাও কি তাহলে রিদ ভাইয়ার মতোই হলো???
“” তুমি,আবার তিলের কাছে নালিশ করতে চলে এসেছো? দাড়াও শুধু পান্জাবীতে কেন তিলের গায়ে হলুদে তোমাকেও গাঁদা ফুল দিয়েই সাজাবো।””
তিল বিছানায় শুয়েই শরীরটা মেলে দিলো প্রশান্ত শান্তিতে। মনের ভেতর কেমন জানি প্রাপ্তি প্রাপ্তির শান্তি অনুভব হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে আর কিছুদিন পর তার রিদ ভাইয়া তার বর হবে।
তিল ঘুমের ঘোরেই বুঝতে পারলো তার মুখে গরম বাতাসের ছোয়া লাগছে। কিন্তু সেটা বার বার ছেড়ে ছেড়ে লাগছে,এমনটাতো কেউ ফু দিলে লাগে। তিল চোখ মেলতেই রিদের মুখটা ভেসে উঠে,ঠোটটা এখনো চুক্কা করে আছে,যেন এখন চোখটা না মেললেই আবার ফু দিতো।
“” আপনি? এভাবে ফু দিচ্ছেন কেন?””
তিলের কথার উত্তর না দিয়েই ওর চোখটা বেধে ফেললো রিদ। তাও ওরি লাল ওড়না দিয়ে।
“” আলে, কি কলছেন? আমাল দম বন্ধ হয়ে আসছে।””
“” চোখ বাদলে দম বন্ধ হয়? আমি কি তোর গলা চেপে ধরে আছি?””
বলতে বলতে তিলকে কোলে তুলে নিলো রিদ। পায়ে পায়ে কদম ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।
“” আমাকে কোলে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? আমি কি আবাল কিছু ভুল কলছি? আপনি কি ছাদে উঠছেন? আমাকে ছাদ থেকে ফেলবেননা প্লিজ,লিদ ভাইয়া! এতো উপল থেকে পললে আমাল ভয় লাগবে।””
“” এই জন্যই তো চোখ বেধে নিয়েছি। কতটা উপর থেকে পড়বি,তুই দেখতেও পারবিনা।””
চলবে