ভালোবাসার রাত,পর্ব (১৭)
রোকসানা রাহমান
রিদকে ছাড়া তিলের পড়ায় মন বসেনা,ঘুম আসেনা,খাওয়ার স্বাাদ আসেনা। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যখন রিদকে নিজের পাশে পাইনা তখন হুহু করে কেঁদে উঠে। আপনি আমাকে মারেন,কাটেন,বকেন যা খুশি তাই করেন তবুও এভাবে দুরে ঠেলে রাখবেননা প্লিজ,আমি যে আপনার বিরহ নিতে পারছিনা। আপনার মতো আমারও বুকে চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। এ কেমন ব্যথা রিদ ভাইয়া? আবার কোন খেলায় আপনি আমাকে নামিয়েছেন?? কোন নেশায় আমাকে ডুবিয়েছেন? আমি যে ডুবে মরে যাচ্ছে,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেন এমন করছেন???
কালকে পরীক্ষা অথচ তিলের মনে হচ্ছে সে কিছুই পারেনা। যত পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে তত মনে হচ্ছে এগুলো তার পড়া হয়নি। তার মধ্যে রিদ ভাইয়াটারও কোনো খেয়াল নাই। কি হয় এসে একটু পড়ালে উনি সামনে বসলেই তো আমার সব পড়া হয়ে যাবে। ট্রেন যেমন রেললাইনের উপর দিয়ে গড়গড় করে ছুটে চলে যায় সেও তো রিদ ভাইয়ার সামনে গড়গড় করে সব পড়া বলতে পারবে!
তিল মনের দুঃখে বই,খাতা,কলম নিয়ে বাইরাবাইরি করতে থাকে। হঠাৎই নিজের ফোন বেজে উঠলো, অচেনা নাম্বার,এতো রাতে তাকে কে কল দিবে?? অনেকটা বিরক্ত নিয়েই তিল কলটা রিসিভ করে কানে ধরলো,
“” তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে,আমার রুমে একটু আসবি?””
“” লিদ ভাইয়া!””
রিদের কন্ঠ পেয়ে তিল চোখটা বুঝে ফেলে। খুশিতে ফোন কান থেকে নামাতেও ভুলে গেছে। এতোদিন পর উনার কন্ঠ শুনে মনে হলো উনার কন্ঠ শোনার জন্য কত দিনের তৃষ্ণা ছিলো তা এখন বুঝতে পারছে।
আপনি ডেকেছেন আর আমি আসবোনা এটা হয়?? তিল তখনি বই খাতা সব ফেলে উঠে পড়ে। ছুটে যেতে গিয়ে থেমে যায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজের চুলটা একটু আচড়িয়ে নিলো। আজ কত দিন বাদে রিদ ভাইয়া তার তিলকে দেখতে চাচ্ছে একটু ফিটফাট নাহলে চলে???
রিদের দরজার সামনে যেতেই তিলের পা থমকে গেলো। বুকের ভেতরে কিছু একটা চলাচলের শব্দ পাচ্ছে। খুব বেশি নার্ভাস লাগছে। হাতদুটো মুঠো করে নিজের জামাটা কুচকিয়ে ধরে জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে নিলো। হঠাৎ এমন নার্ভাস লাগার কারন খুজে পাচ্ছেনা। দরজায় হাত রাখতেও কেমন একটা লাগছে। তাহলে ভেতরে গিয়ে রিদ ভাইয়ার সামনা সামনি হবো কি করে??? কেন এমন অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে? অনেকদিন বাদে দেখা হচ্ছে বলে? নাকি অনেকদিন বাদে কাছে যাচ্ছি বলে???
“” কি হলো,বাইরে দাড়িয়ে আছিস কেন? তোকে কি পালকি দিয়ে বয়ে আনতে হবে??””
রিদের কথায় তিল হালকা কেঁপে উঠে,শেষ একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে দরজাটা ঠেলে দেয়।
পুরো রুমটা অন্ধকারে ঢাকা। এতো অন্ধকার কেন? বিদ্যুৎ কি চলে গেছে?? আমার রুমে তো ঠিকই ছিলো তাহলে এখানে কি হলো??? তিল পা বাড়িয়ে ভেতরে এগুতেই রিদ বললো,
“” ভয় পাচ্ছিস?? দাড়া!””
রিদ নিজের ফোনটার টর্চটা জ্বালিয়ে তিলের দিকে আলো ফেলে বললো,
“” তোর হাতের ডানদিকে ছোট টেবিলটায় দেখ মোম আর ম্যাচ আছে। মোমটা জ্বালিয়ে নে। তাহলে আর ভয় পাবিনা।””
রিদের কথা মতো তিল মোমটা জ্বালিয়ে রিদের কাছাকাছি এসে দাড়ায়। আজো উনি কম্বলটা মুড়ি দিয়েই শুয়ে আছে। রুমের ফ্যানটা অফ! এই গরমে উনি এভাবে থাকেন কিভাবে? উনার সব অদ্ভুত কাজের মধ্যে এটা বেশি অদ্ভুত যা তিলকে বারে বারে ভাবায়!
“” তুই কি মোম হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকার চাকরি নিয়েছিস? ওখানে রেখে আমার মাথার কাছে এসে বস।””
রিদের প্রত্যেকটা কথায় তিলের কাছে কেমন যেন ঠান্ডা বরফের ছোয়া লাগছে। এতো রাগী লোকটার ঝাঝালো কন্ঠ হঠাৎ এমন নিয়িয়ে গেলো কিভাবে? কথার ধরন না পাল্টালেও সেই আগের মতো ঝাঝটা আর নেই। কি হয়েছে উনার? উনি কি ভেতরে ভেতরে কোনো জিনিস নিয়ে খুব বাজে ভাবে ভুগছেন???
তিল রিদের মাথার কাছে বসতেই রিদ নিজের মাথাটা তিলের কোলে তুলে দিলো।
“” মাথাটা খুব ধরেছে,একটু চুলটা টেনে দেতো।””
তিল চুলে হাত দিতেই ওর হাতটা চেপে ধরে রিদ। হাতটা নিজের গালে ছুয়িয়ে নিয়ে বললো,
“” কেমন আছিস রে?””
রিদের অতি সাধারন প্রশ্নটাও যেন তিলের বুকের ভেতর ঝড় তুলে দিলো। কেমন আছে এটার উত্তর কি দিবে?? ভালো আছে? কিন্তু ও কি আসলেই ভালো আছে??
“” কিছু বলছিস না যে? রাগ করেছিস আমার সাথে??””
তিল এবার আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলোনা। ঠুকরে ঠুকরে কেদে উঠে, অভিমানে কন্ঠে বললো,,
“” আপনি খুব পঁচা খুব।””
রিদের মাথাটা সড়িয়ে তিল অভিমান করে উঠে চলে যেতে নিলে তিলের হাতটা চেপে ধরে নিজের বুকে।
“” সরিরে। এই দেখ কানে ধরেছি। এবার তো ক্ষমা করে দে। দেখতো তোর লিদ ভাইয়াকে কানে ধরে কেমন হনুমানের মতো লাগছে??””
তিল রিদের হাতটা কান থেকে সরিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
“” আমাল লিদ ভাইয়াকে যেমন খুশি তেমন দেখাক আপনাল কি? খবলদাল যদি আলেকবাল আমাল লিদ ভাইয়াকে হনুৃমান বলছেন তো””
“” তো কি করবি শুনি তুতলি রানী!””
“” আপনি এমন অন্ধকালে শুয়ে লয়েছেন কেন? আপনাল কি হয়েছে? আমাল খুব ভয় লাগছে।””
তিলের কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা রিদ। তিলের হাতটা বুক থেকে সরিয়ে চোখের সামনে আনলো। অনামিকা আঙুলটা দেখে হালকা শুকনো হাসি নিয়ে বললো,
“” ডায়মন্ডের সাথে স্বর্নের এমন হলদে কালারটা মানাচ্ছেনা। দেখি খুলে দেতো আমায়।””
রিদ আংটিতে হাত দিতেই তিল ঝটকা দিয়ে হাতটা টেনে সরিয়ে নিলো।
“” আপনি আমার বাবুকে আলাদা কলছেন কেন?'”
“” তোর বাবু মানে? আংটিকে তুই বাবু বানিয়ে দিলি? বেশি পড়ার চাপে তোর মাথাটা কি গেলো?””
তিল হাতের আংটিটা ঠিক করতে করতে লাজুক হয়ে বললো,
“” আপনিই তো বাবুল গন্ধ নিয়ে পলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন বাবাল কাছ থেকে যেন সন্তানকে না সলায় তাহলে এখন সলাচ্ছেন কেন? বাবাল থেকে আলাদা কলছেন দেখলে কি ও কেঁদে উঠবেনা?””
তিল নিজের কথা শেষ করে রিদের দিকে তাকাতেই বুঝলো উনি তার দিকেই চেয়ে আছে। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে, যে চাহনিতে কোনো কামুকতা নেই,কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই,কোনো চাওয়া নেই,রয়েছে শুধু মুগ্ধতা আর প্রাপ্তি।
রিদের এমন চাহনিতে তিলের লজ্জা যেন আরো প্রখর হলো। ঠোটে হালকা হাসি ফুটে উঠেছে।
“” তুই কেন বড় হলি তিল?””
“” আপনাকে বিয়ে কলাল জন্য!””
রিদ তিলের কাছ থেকে সরে এসে নিজের বালিশটাতে শুয়ে বললো,
“” অনেক রাত হয়েছে, রুমে যা। কাল তো আবার পরীক্ষা। ঠিক মতো সব পড়েছিস তো?””
তিল মনে মনে বললো আপনাকে ছাড়া কি আমার পড়ায় মন বসে রিদ ভাইয়া?
“” হুম।””
“” গুড,রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু খুব বকবো।””
“” হবেনা। আপনি পলিয়েছেন তো।””
রিদ আবার কিছু বলতে যাবে কিন্তু নিজের গলাটা ভার হয়ে গেছে বুঝতে পেরে কিছু বললোনা।
তিল তখনো রিদের মাথার কাছেই বসে আছে। আমার আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে রিদ ভাইয়া। একটু জড়িয়ে নিবেননা? আপনি হঠাৎ এতো শান্ত হয়ে গেছেন কেন? আপনার এই শান্ত টা যে আমার ভেতরে অশান্তের সৃষ্টি করছে।
“” এখনো বসে আছিস যে?””
তিল মন খারাপ করে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে রিদ ডেকে উঠে,
“” বউ!””
ইশ! বউ ডাকের মধ্যেও বুঝি এতো ভালোবাসা থাকে?? ইচ্ছে করছে সময়টাকে এখানেই বেধে রাখি!
“” এদিকে এসো।””
আজ যেন লজ্জারা সব পন করেছে তিলকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা।
তিল মাটির দিকে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে আবার রিদের কাছে এগিয়ে যেতেই রিদ উঠে বসে পড়ে।
তিলের গালে নিজের ডান হাতটা ছুয়িয়ে কপালে চুমু খেতে গিয়েও থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে কপাল থেকে ঠোটগুলো সরিয়ে তিলের বা গালে চুমু একে দিলো। ঠোটের কোনের তিলটা নিজের বা হাতের বৃদ্ধা আংগুল দিয়ে হালকা করে হাত বুলিয়ে বললো,
“” বেস্ট অফ লাক!””
তিল চলে যেতেই রিদ হুহু করে কেঁদে উঠে। যেখানটাই আমি নেই সেখানটাই ছুয়ে কি হবে????
রিদ ভাইয়ার কাছ থেকে এতো এতো আদর পেয়েও কি পরীক্ষা খারাপ হতে পারে? কখনোই না। তিল লুজের পর লুস পেজ নিয়ে লিখেই যাচ্ছে। কলমের কালি শেষ তো কি হয়েছে? আরেকটা নতুন কলম দিয়ে লিখা শুরু করে।
“” এখনি ঘুমাবি?””
কালকেই তার শেষ পরীক্ষা,তারপর গায়ে হলুদ অবশেষে বিয়ে। খুশিতে আজ তিলের পড়াই হচ্ছিলোনা। তবুও রিদ ভাইয়াকে সে রাগাবেনা বলে অনেক কষ্টে এতক্ষন পড়ায় মুখ গুজে রেখেছিলো। কিন্তু এভাবে কতক্ষন? তাই বই গুছিয়ে সবেই বিছানায় উঠে কাথাটা মেলছিলো। আর তখনি রিদ ভাইয়ার আগমন।
রিদের দিকে তাকিয়ে তিলের বুকটা কেঁপে উঠলো। উনাকে এতো অগোছালো লাগছে কেন? চোখের নিচটা এতো ফুলে গেছে,মনে হচ্ছে কালচে দাগ ও পড়েছে। মাথার চুলগুলোতেও অনেকদিন চিরনি চালানো হয়নি,গালে খোচা খোচা দাড়িগুলো এখন আর খোচা নেই অনেকটাই বড় হয়ে গেছে।
তিলকে অবাক করে দিয়ে রিদ ওর বুকের উপর শুয়ে খুব গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। অস্পষ্টট সুরে বললো,
“” ভালোবাসি তোকে,খুব বেশি ভালোবাসি রে বউ!””
চলবে