ভালোবাসার রাত,পর্ব (১৮)
রোকসানা রাহমান
তিলকে অবাক করে দিয়ে রিদ ওর বুকের উপর শুয়ে খুব গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। অস্পষ্টট সুরে বললো,
“” ভালোবাসি তোকে,খুব বেশি ভালোবাসি রে বউ!””
রিদের চোখের পানি বেয়ে বেয়ে তিলের বুকে পড়ছে। তিলকে ফাঁকি দিয়ে চোখের পানি মুছার চেষ্টা করছে রিদ। কিন্তু যে চোখই নিজের পানিকে আটকাতে পারেনি, লুকাতে পারেনি তা রিদ কিভাবে তিলের কাছ থেকে লুকোবে? তাও এতোটা কাছ থেকে?? রিদের অতি নগন্য কষ্টের কান্নার সাথে ফুপানির শব্দ এবং রিদের চোখের পানি যা রিদের চোখের কোন বেয়ে তিলের জামা ভেদ করে শরীরে ছুয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ এমন উষ্ণ পানির ছেয়ায় তিলের মনে খটকা লাগে৷ তিল রিদের মাথাটা চেপে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফেলে।
এ সে কি দেখছে? রিদ ভাইয়ার চোখে পানি? চোখ ভিজে লালবর্ন ধারন করে আছে। কেন কাঁদছেন উনি?? আমার কেন মনে হচ্ছে উনি আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছেন?? উনি তো এমন নরম মনের মানুষ নই? কি এমন হলো যে এতোটা পাল্টে গেলো। যে চোখের চাহনি আমাকে ভয়ে নাড়িয়ে দিতো সেই চোখ আজ কেন আমার চোখে চোখ রাখতে পারেনা???
রিদের চোখের পানি দেখেই তিলের চোখ ভিজে গেলো। কান্নাজরিত কন্ঠে বললো,
“” আপনি কাঁদছেন কেন?? কি হয়েছে আপনাল?””
রিদ তিলের হাত থেকে নিজের মুখমন্ডলটা সরিয়ে নিলো। সোজা হয়ে দাড়িয়ে চোখের পানি আড়াল করে বললো,
“” কোথায় কাঁদছি? তুই কি দিনে দিনে কানাও হয়ে গেছিস?? ছোট মাছ খাসনা কত দিন ধরে বলতো?””
“” আপনি কথা গুলাচ্ছেন কেন? আমি দেখলাম আপনাল চোখে পানি,বলুননা কি হয়েছে? আল আজকাল আপনি কেমন জানি হয়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখতেই পালেননা এমন। আবাল হুট কলে এসে অনেকগুলো ভালোবেসে ফেলেন। যেন এক মুহুলতেই সবটা ভালোবাসা দিয়ে দিবেন!””
রিদ তিলের মাথায় একটা চাটি মেরে দিলো৷ ঠোটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“” কালকেই তো এক্সাম শেষ। পাস করবি নাকি ফেল? ঠিক ঠিক করে বল,আমি কিন্তু লাড্ডু পাওয়া মেয়ের বর হতে পারবোনা। ইউকে থেকে পড়াশুনা কমপ্লিট করেছি তো এমনি এমনি না। কত কষ্ট করে পড়তে হয়েছে জানিস? এখন যদি আমাকে লাড্ডু পাওয়া মেয়েকে বিয়ে করতে হয় তাহলে আমার ইয়া মোটা মোটা ইংলিশ বইগুলো তো আমাকে দেখে হাসবে!””
তিল রিদের কথা নিজের কানেই নিচ্ছেনা। সে খুব বুঝতে পারছে এগুলোর পেছনে অন্য কিছু আছে। কিন্তু সেটা কি?? তিল রিদকে হালকা করে জড়িয়ে ধরলো।
“” ছাড়,ছাড় ছাড় আমাকে। তুই আমাকে ঘুষ দিয়ে বিয়ে করতে চাচ্ছিস?? ছি! ছি! ছি!!! তিল!!! তুই তো দেখছি ব্যাংকের সব টাকা লুটে নিয়ে নিজের পেটে পুরবি। এখনি ঘুষ দেওয়া শিখে গেছিস??””
“” কি হয়েছে,বলুননা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনাল চোখে পানি আমি কখনোই সহ্য কলতে পালবোনা। আমি কি কিছু কলেছি? তাহলে আমাকে শাস্তি দিন! তাতেও আমি হ্যাপি,কিন্তু আপনাল চোখে পানি দেখে আমাল বুকটা জ্বলে পুলে যাচ্ছে,লিদ ভাইয়া।””
রিদের ঠোটের কৃত্রিম হাসিটা নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। তিলকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে নিলো। নিজের হাতের তালু দিয়ে তিলের গালদুটো চেপে ধরে বললো,
“” ভালোবাসিস আমাকে?””
“” হুম!””
“” কতটা?””
তিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিদ ওকে ছেড়ে দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বললো,
“” তোর ঐ ছাই ভালোবাসা আমার লাগবেনা। কই এতোদিন তো বলিসনি ভালোবাসিস তাহলে আজকে কেন বলবি? শুনবোনা আমি তোর ভালোবাসার কথা!””
তিল রিদের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“” আপনি তো জানতে চাননি!””
“” জানতে চাইবোনা বলে তুই বলবিনা? এখন তোর কাছে আমাকে ভালোবাসা জানার জন্য হাত পাততে হবে? ভিক্ষে চেয়ে বলতে হবে,তিল সাহেবা,তিল সাহেবা,দুটো ভালোবাসার কথা বলে আমাকে ধন্য করুন???””
“” আপনি এভাবে বলছেন কেন? আমিতো….””
“” কাল পরীক্ষা শেষ হবে কখন?””
“” ৪ টায়।কেন?””
“” কাল একটু তাড়াতাড়ি আসিস তো!””
রিদ চলে যেতে নিলে তিল পেছন থেকে প্রশ্ন করে,,,
“” কেন? কাল কি আছে?””
“” আমার মাথা আছে। এসে খেয়ে ফেলিস। বিরক্তকর!””
রিদের কথায় তিল মন খারাপ করে মুখটা নামিয়ে নিতেই রিদ ডেকে উঠে,
“” বউ,একটু এদিকে আসুন তো। আপনার বর আপনাকে একটা চুমু খাবে।””
তিল মাথা উচু করে দেখে রিদ ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। যে হাসির ছোয়া তিলের ঠোটেও লাগলো তবে সাথে কিছুটা লজ্জা মিশ্রিত। এমন করে কেউ চুমু খেতে চাই? ইশ! কি লজ্জা!
“” আমি কি চুমু না খেয়েই চলে যাবো?””
তিল ছুটে গিয়ে রিদের সামনে দাড়ায়।
“” তোর তো দেখি লজ্জা শরম নাইরে তিল,চুমু নেওয়ার জন্য দৌড়ে চলে এলি? এমন ছুচি তুই?””
“” ধুল! লাগবেনা,আপনাল চুমু!””
তিল অভিমান করে চলে যেতে নিলেই রিদ ওর হাতটা চেপে ধরে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে দাড় করালো।
“” এতো অভিমান শিখেছিস কেন? আমাকে পাগল করে পাগলাগারদে পাঠানোর জন্য? তুই জানিস, তুই যখন অভিমান করিস তখন তোর গালদুটো ফুলে লাল টমেটো হয়ে যায়? আমার তো আবার টমেটো অনেক পছন্দ, আমি যদি খেয়ে ফেলি? তখন গাল ছাড়া তোকে কত বিচ্ছিরি লাগবে ভাবতে পারছিস?””
“” লাগুক,তাও আপনি শান্তি পান। আপনাল শান্তি দেখেই আমি আমার মন জুলাবো।””
রিদ তিলের ঠোট আংগুল দিয়ে চেপে ধরে বললো,
“” আজকাল আগুন ধরানোর কথা বলাও শিখে গেছিস দেখি!কোথা থেকে শিখছিস এগুলো?””
তিল লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে নিলে রিদ ওর কপালে চুমু খেতে গেলো। কিন্তু আবারও কিছু একটা ভেবে কপাল ছেড়ে গালে চুমু খেয়ে বললো,
“” দোয়া করি,ভালোবাসারা যেন তোকে মাতিয়ে রাখে।””
রিদ চট করে তিলকে ছেড়ে হাটা ধরে। নিশ্বাসটা আবার গলার মাঝখানটাই এসে আটকে আছে। পুরোটা কেন আটকায়না? তাহলেতো একটু শান্তি পেতাম। জীবনের পুর্নতাকেই অপুর্নতায় খেয়ে ফেলছে!
তিল রিদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। এক গাধা অভিমান আর কষ্ট এসে ভিড় করছে তার মনে। কিন্তু কেন? রিদ ভাইয়া এটা কি বলে গেলেন? যা শুনেই আমার মন খারাপ হয়ে গেলো?
তিল মন খারাপের জ্বালায় সারারাত ছটফটিয়ে কাটিয়ে দিলো।
রিদ ভাইয়া কেন তাড়াতাড়ি যেতে বললো? কি হবে তাড়াতাড়ি গিয়ে?? আগে তো কখনো এমন বলেনি তাহলে কাল রাত কোন বললো?? টেনশনে তিলের খাতায় কাটাকাটির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে লেখাও যেন ফুরাচ্ছেনা। তিল ৩ ঘন্টার পরীক্ষা ২ ঘন্টায় শেষ করে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। কিছু ভালো লাগছেনা তার। মনটা কেমন খচখচ করছে। ভালোমন্দ কিসব চিন্তা আসছে মাথায়। তার মধ্যেই রাস্তায় মানুষের গুনগুন থেকে বুঝা যাচ্ছে এক্সিডেন্ট করেছে কেউ। পুরো শরীর নাকি রক্তে মাখামাখি! হাঠাৎই চোখের সামনে তিলের সেই স্বপ্ন ভেসে উঠলো,যেখানে রিদের শরীরও রক্ত মেখে ছিলো। উফ! কিছু ভালো লাগছেনা,গরম লাগছে,খুব গরম লাগছে,এতো গরম কেন? শরীরটাও কেমন জ্বলে যাচ্ছে। আজকেই এতোকিছু হতে হচ্ছে????
বাসায় এসেই তিল সোজা রিদের রুমে ঢুকে গেলো। পুরো রুম ফাঁকা। কোথায় গেলো উনি? আমাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে নিজেই নাই? তিল বিরক্ত নিয়ে রিদের রুমের ওয়াশরুমটাই ঢুকে ফ্রেশ হয়ে আসলো। তিলের মনে হলো,উনার ওয়াশরুমটাও কেমন মন খারাপ করে আছে,পানিটাও কি গরম,ঠিক উনার শরীরের মতো। উনার শরীরের তাপমাত্রা কি সবসময়ই ১০০ এর উপরে থাকে??
তিল রিদের বিছানায় বসল। এখনো উনি এলেননা,গেলেনটা কোথায়? তিল বেড়িয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাড়ালো। পা ঘুড়িয়ে পায়ে পায়ে ড্রেসিং টেবিলটার সামনে গিয়ে দাড়াতেই তিলের চোখ আটকে গেলো আয়নাতে। কালো কালি দিয়ে কিছু একটা লিখা। তিল ঠোট নাড়িয়ে পড়তে থাকলো,,,
***ভালো থাকিস রে বউ! তুই আমার কাছে কখনো কিছু চাসনি অথচ আজ যখন তোর এই
বদমেজাজী,রাগী,স্বার্থপর ভাইয়াটাকে বর হিসেবে চাইলি তখন তাও আমি তোকে দিতে পারিনি। মাফ করে দিস।
ভেবেছিলাম তোকে বউ সাজে দেখে তারপর চলে আসবো কিন্তু নিজেকে দিয়ে আর অভিনয় করাতে পারছিলাম না রে। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তোকে বউ সাজে দেখবো বলে ১৭ টা বছর ওয়েট করে ছিলাম অথচ দেখ তোকে আমি সামান্য শাড়িতে জড়ানোই দেখতে পারলামনা। ভাগ্য আমার সাথে এভাবে বেঈমানী করবে জানতামনা। মনকে শান্তনা দিচ্ছি এটা ভেবেই যে আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। হয়তো আমি তোর জন্য বেস্ট ছিলাম না!
একটুও কাঁদবিনা,মন খারাপ করবিনা তাহলে আমি দুরে গিয়েও শান্তি পাবোনা। তোর না বলা ভালোবাসার দোহাই দিয়ে গেলাম,আমি ছাড়া তোর জীবনটাকে নতুন করে রাঙিয়ে নিস!
ইতি
তোর পালিয়ে যাওয়া লিদ ভাইয়া***
রিদ ভাইয়াকে ছাড়া আজ ১ টা বছর চলে গেছে তিলের জীবন থেকে। যার মধ্যে ৮ বার মিলিয়ে প্রায় ৪ মাসের মত হসপিটালেই কাটিয়ে দিয়েছে সে। হাসি আর কান্নার মধ্যে তফাত কি সেটাও ভুলে গেছে তিল। রিদের অন্ধকার ঘরটাকেই নিজের ঘর বানিয়ে নিয়েছে,এখন সেও প্রচন্ড গরমে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমুতে শিখে গেছে,কেন শিখবেনা? একমাত্র এটাই আছে যার মধ্যে সে তার রিদ ভাইয়ার গন্ধ পায়,মন ভরে নিশ্বাস নিতে পারে,যে নিশ্বাসে শুধু রিদ আছে। জড়িয়ে ধরলে মনে হয় এটাই তার রিদ ভাইয়া। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলছে,বউ আরেকটু শক্ত করে ধরোনা!
প্রতিদিনের মতো আজো সে আয়নার সামনে দাড়িয়ে রিদের লিখে যাওয়া সেই আয়নাচিঠি পড়ে যাচ্ছে আর গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় তিল ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়ে।
যে ঝড়ের গতিতে হুট করে এসে সবার মনকে খুশিতে ভরে দিয়েছিলো রিদ ঠিক সেভাবেই হুট করে পালিয়ে গিয়ে পুরো বাড়ির মানুষকে মন খারাপের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। সবার যেন এখন এটাই মৌলিক কাজ। এর মধ্যে রিমা অনেকবার এসেছে কিন্তু তাতে লাভের কিছু হয়নি সে নিজেও মন খারাপ রোগে ভুগতে ভুগতে আবার চলে গিয়েছে। বাড়িটাই জনমানবহীনতায় ভুগছে।
ছেলেকে খুজতে খুজতে আমির আলী আর রহমত আলী হাপিয়ে উঠেছেন,তবুও যদি জানতে পারতেন কোথায় আছে কেমন আছে। সেটাও হয়নি!
আজ রিদের জন্মদিন। এই দিনেও মানুষটার রুমটা এমন বাসি থাকবে?? তিল নিজের হাতে রিদের রুমটা গুছাচ্ছে,আজকে ফুল দিয়ে সে তার রিদ ভাইয়ার রুমটা সাজাবে,কিন্তু কি ফুল দিয়ে সাজানো যায়?? উনার কোন ফুল পছন্দ? আমি এটাও জানিনা? এই জন্যই উনি চলে গিয়েছেন। আপনি ঠিকি বলেছেন রিদ ভাইয়া আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন। তবে আপনি একটা কথা ভুল বলেছেন আপনি আমার জন্য বেস্ট ছিলেন,আমিই আপনার জন্য বেস্ট ছিলামনা!
তিল চোখের পানি মুছতে মুছতে রিদের ওয়াড্রভটা খুলে জামাকাপড় গুছাতে লাগলো। হঠাৎই কিছু কাগজ চোখে পড়ে। হাত দিয়ে সেগুলো বের করে চোখের সামনে ধরতেই বুঝতে পারলো মেডিকেলের কাগজ। পেসেন্টের জায়গায় রিদের নাম লিখা।
চলবে