ভালোবাসার রাত,পর্ব (৪)
রোকসানা
সেই ছোটবেলার একি কান্ড কি আজকেও ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে? তীল রিদের হাতের ব্লেডের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে,মাথাটাও ভার ভার হয়ে আসছে। তীল রিদের দিকে তাকাতেই চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে দেখতে পেলো। সবকিছু এমন অন্ধকার হয়ে আসছে কেন? বিদ্যুৎ চলে গেলো??? তীল আর কিছু ভাবতে পারলো না। কাপতে কাপতে রিদের বুকে ঢলে পড়লো
মাঝরাতেই তীল হালকা জাগনা পেলো। চোখ মেলতেই পুরো রুম অন্ধকার! চোখটা আবার বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো কি হয়েছিলো তার সাথে। হঠাৎই মাথায় হাত চলে গেলো। দুহাত দিয়ে হাতরিয়ে নিজের মাথায় চুলের স্পর্শ নিয়ে নিজের মনটাকে শান্ত করার কাজে লেগে পড়লো। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে লাইটটা জ্বালিয়ে নিলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে নিজের চুলগুলো দেখছে। চুল তো যেমন ছিলো তেমনি তাহলে কি আমি ঘুমের ঘোরে সব স্বপ্ন দেখছিলাম?? কিন্তু মন তো বলছে স্বপ্ন নয়। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ৩ টা বেজে ৩৬। মধ্যরাত হয়ে গেছে। যদি সেরকম কিছুই হয়ে থাকে রিদ ভাইয়া যেমন রাগী মানুষ আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা না। তীল নিচের ঠোটটা কামড়াতে কামড়াতে পুরো রুমে চোখ বুলালো। হঠাৎই বিছানার কাছটাতে লাইটের আলোতে কিছু ঝিলিক দিতে দেখতে পেলো। তীল একটু এগিয়ে ওটা উঠাতেই বুঝতে পারলো সে কোনো স্বপ্ন দেখেনি। তাহলে উনি কিছু করলেননা কেন?? আর আমি বিছানায় কিভাবে গেলাম? আমার গায়ে তো চাদরটাও টানা ছিলো! তীলের মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। বার বার ব্রেনে চাপ দিয়েও কি হয়েছিলো তা বের করতে পারলোনা। বিরক্ত নিয়ে বিছানায় পুনরায় শোয়ার ব্যবস্থা করতেই মনটা বলে উঠলো,তীল তোর রিদ ভাইয়া তো এখন গভীর ঘুমে,মন ভরে একটু দেখে নিবিনা? তুই কি তার ঘুমন্ত চেহারা দেখার সুযোগটাকে পায়ে মাড়িয়ে দিবি???
তীল রিদের দরজাটা শব্দহীনভাবেই খুলার চেষ্টা করলো। কিন্তু এই নির্জনতায় শব্দকে মেরে ফেলা অসম্ভব। তবুও যতটা পারলো নিঃশদেই রিদের রুমে ঢুকে পড়লো। এই জৈষ্ঠ্যমাসেও উনি এমন কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুৃাচ্ছেন কেন?? মুখটাও কেমন ঢেকে ঘুমাচ্ছেন! উনার কি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছেনা? শরীরটা কি ঘেমে নেয়ে উঠছেনা? নাকি উনার নিশ্বাসের প্রয়োজন নেই?? ঠান্ডা গরমের কোনো অনুভূতি নেই? তীলের ইচ্ছে হলো রিদের হয়ে সে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে দিক। ইশ! উনি হয় তো নিশ্বাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন তাই এখন নিশ্বাস ছাড়া কিভাবে থাকতে হয় সেই গবেষনায় ব্যস্ত!
তীলের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। জাগনা অবস্থায় তো আমাকে শাস্তি দিয়েই কুল পাননা একটু ঘুমের ঘোরে দেখতে চাইলাম সেটাও দিলেননা। আপনার শাস্তির ঝুড়ি কি কোনোদিন শেষ হবেনা? ওটা থেকে একমুঠো ভালোবাসা আমাকে দিবেননা? আমি যে আপনার ভালোবাসা না পেয়ে কাঙাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেননা??
তীল দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে উল্টো ঘুরে হাটা ধরতেই রিদ বলে উঠলো,
“” পা টা টিপে দেতো। তোর চুল মুঠো করে ধরতে গিয়ে আমার সব শক্তি খরচ হয়ে গেছে। আর পাটাও ব্যথা করছে।””
রিদের কন্ঠ শুনে তীল ঝপ করে আবার পিছনে ঘুরে দাড়ালো। কিন্তু উনিতো সেই আগের মতোই মুখ ঢেকে শুয়ে আছে তাহলে কথা বলছে কে? আমি কি ভুল শুনলাম?
তীলের ভাবনার মাঝে হামি পেয়ে গেলো। মুখটা হা করতেই রিদ আবার বলে উঠলো,
“” এতো বড় করে কেউ হামি দেয়? মনে তো হচ্ছে তুই আস্ত গরুর মাথা খাওয়ার জন্য হা করছিস এখনো হামি দেওয়াও শিখলিনা? আর এখনো ওখানেই দাড়িয়ে আছিস কেন? বললাম না পা টিপে দিতে?””
তীল মুখটা কালো করে রিদের পায়ের কাছে এগিয়ে যেতেই রিদ কম্বলের তলা থেকে একটা পা বের করে দিলো।
উজ্জ্বল শ্যামলা পায়ের মধ্যে ছোট ছোট কালো পশমগুলোকে তীলের কাছে পাতাহীন গাছের ছোট ছোট ঝোপ মনে হলো। যে ঝোপের মধ্যে কোনো পোকা মাকর নেই। কিন্তু কেন নেই? দু একটা পোকামাকড় থাকলেই বোধহয় আরো সুন্দর লাগতো!
রিদের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তীলের পুনরায় হামি পেলো।
“” তুই একরাতে কয়বার ঘুৃমাবি বলতো? মাত্রই তো ঘুম থেকে উঠে এলি তাও এতো হামি আসছে কেন? আমার তো মনে হচ্ছে তোর জন্য ২৪ ঘন্টায় ১ দিন ২ রাত হওয়া দরকার ছিলো!””
তীল হাতদুটো নিজের জামায় হালকা করে মুছে নিয়ে রিদের পায়ে হাত দিতেই মনে হলো গরম পানির ছেকা খেয়েছে। হাত পুরে যাওয়ার ভয়ে হাতটা সরিয়ে নিতেই রিদ বলে উঠলো,
“” কিরে,তুই কি চাস না আমি ঘুমাই?””
“” আপনাল পা এতো গলম কেন?””
“” আমার পা গরম না ঠান্ডা সেটা তোকে ব্যখ্যা করে বুঝাতে হবে?? তোকে সামান্য পা টিপে দিতে বললাম বলে এখন আমার খাতা কলম নিয়ে লিখালিখি করতে হবে?””
রিদ যে আবার রেগে যাচ্ছে বুঝতে বাকি রইলোনা তীলের। ওতো চায়না তার রিদ ভাইয়া তার উপর রাগ করুক তাই চুপচাপ পা টিপায় মন দিলো।
“” আমার পায়ের নিচের চাদরটা তোল,দেখ নিচে একটা কাগজ ভাজ করা আছে। ওটা খুলে পড়তো!””
রিদের কথা মতো তীল কাগজটা বের করে মেলে ধরলো চোখের সামনে।
“” কি হলো পড়ছিস না কেন?””
তীল কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে পড়লো,
“” প্রিয়,ঝলমলে কালাকেশী।””
“” কালা কেশী পড়ছিস নাকি মালাকেশি কিছুইতো বুঝতে পারছিনা। কাকা কাকি কি তোকে শাকসবজি খাওয়ায় না? তোর চেয়ে তো কাকরাও ভালো করে কা কা করতে পারে।এখন কি তোর কথা শুনার জন্য তোর মুখের সামনে মাইক ধরতে হবে? আমাকে তোর মাইকম্যান মনে হয়? তোর মাইক ম্যান হওয়ার জন্যই তো ইউকে তে বসে মোটা মোটা ইংলিশ বই পড়েছি তাইনা,তীল? আমার কানের কাছে এসে পড়।””
তীল রিদের পায়ের দিক থেকে এসে মুখের কাছটাতে আসতেই রিদ বলে উঠলো,
“” ওভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন? পড়ে তো কাল আব্বুকে বলবি আমার জন্য দাড়িয়ে থাকতে থাকতে তোর কোমড় ব্যথা হয়ে গেছে,পিঠের মেরুদন্ড বাকা হয়ে গেছে। নালিশ দেওয়ার জন্য তো তুই দু পা তুলে দাড়িয়ে থাকিস।””
রিদ নিজের কথা শেষ করতে করতে তীলকে টান দিয়ে নিজের বালিশের পাশে বসিয়ে দিলো।
মুখের থেকে কম্বলটা সরিয়ে বললো,
“”নে এবার পড়।””
“” প্রিয় ঝলমলে কালাকেশী!
তুমি কেমন আছো? আমি কিন্তু ভালো নেই তোমার পেটে হাত দেওয়ায় তুমি যে চিৎকার দিয়েছিলে সেটা আমার কান ফুটো করে বের হয়ে গিয়েছে। ফলে আমি এখন তোমার সেই চিৎকার ছাড়া আমার এই কান আর কিছু শুনবেনা বলে ওয়াদাবদ্দ হয়েছে।
তোমার সাথে আমার পরপর দুবার দেখা হয়েছে কিন্তু একবারও তোমার নাম জানা হয়নি। রিদের কাছ থেকে শুনলাম তোমার নাম নাকি তীল। তোমার নাম শুনে আমি বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম। আরেকটু গবেষনা করতেই বুঝতে পারলাম তোমার শরীরে লেগে থাকা অসংখ্য চিন্হের প্রতীক হিসেবেই তোমাকে সবাই তীল বলে ডাকে। তোমার ভালো নাম তিয়ামতী। আমার এই দুটো নামই ভালো লেগেছে। তবে কেন জানি তোমার নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করেনা। কেন করেনা তাতো জানিনা। তুমি প্লিজ আমাকে জানিয়ে দিও।””
“” এতো মন দিয়ে পড়ছিস যেন এই প্রথম লাভলেটার পেলি। লাভলেটার বললে ভুল হবে যেন রাষ্ট্প্রতির হাত থেকে শুভেচ্ছাবার্তা পেলি। কাগজটা উল্টিয়ে নিচের দিকে কয়েকটা লাইন আছে ঐটা পড়।””
রিদের কথামতো তীল অসংখ্য ক্ষুর ক্ষুদ্র লাইনকে অবহেলা করে পেজটা উল্টিয়ে নিচের প্যারা পড়তে লাগলো,
“” আমি কালই আমার বাবা মাকে নিয়ে তোমার বাবা,মায়ের সাথে দেখা করিয়ে সব পাকাপাকি করবো। তোমার মত থাকলে কালই কবুল বলে কাবিন করে ফেলবো। তোমার ঐ ঠোটের কোনের তিলটা ছুতে না পেরে আমার হাতটা অবশ হয়ে গেছে। আর সাথে সাথে আমার রিদায়টাও। এভাবে আর একদিন কাটালে আমার রিদকম্পন অফ হয়ে যাবে! আর আমি কম্পহীন রিদয় নিয়ে মারা যাবো।
তুমি কি আমার দ্বিতীয় জীবনটা দান করবে?
ইতি তোমার সিজজজজজ..””
তীল নামটা পড়ার আগেই রিদ কম্বলটাসহ তীলকে বিছানার সাথে চেপে ধরলো।
“” তোর ঠোটের দাগটা দেখি মিলিয়ে গেছে। দাগ ভেনিশ করার মলম লাগিয়েছিলি নাকি???””
তীল রিদের দিকে তাকাতে তাকাতে আবার সেই পুরোনো স্মৃতিতে চলে গেলো।
সেইদিন কাকিমার ঘরে ঘটে যাওয়া ঘটনায় পুরোবাড়ির মানুষের মাথা নাড়িয়ে দিয়েছিলো রিদ।
“” ভাইজান রিদ ছোট মানুষ,ভুল মানুষের পাল্লায় পড়ে হয়তো এমন করে ফেলেছে। কতই বা বয়স? ১৬ বছরের ছেলে এসবের কি বুঝে বলো? ওকে বুঝিয়ে বললে ও সব বুঝতে পারবে!””
“”রহমত,সব অন্যায় ছেড়ে দেওয়া যায় না। আজ হয়তো তীল ছোট। তাই রিদ ওর সাথে কি করতে চেয়েছে ও বুঝতে পারেনি। কিন্তু যখন ও বুঝবে? ওর সামনে আমি কি করে যাবো? আর তাছাড়া রিদ আমার ছেলে। ওকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমার জানা আছে।””
“”তাই বলে এইটুকু ছেলেকে বিদেেশ পাঠিয়ে দিবে? ভাইজান এতো বড় শাস্তি তুমি ওকে দিওনা। আমি নাহয় তীল আর ওর মাকে নিয়ে অন্য কোথাও…””
রহমত আলীর কথায় নিজেরই বড় ভাই গর্জে ওঠে।
“” এ বাড়িতে কে থাকবে কে থাকবেনা সেটা ঠিক করার দায়িত্ব বাবা আমাকে দিয়ে গেছেন। তুই যদি বাবার আদেশের অবাধ্য হতে চাস তাহলে যা চলে যা। বাবার ভিটেতে থাকার কোনো যোগ্যতাই নেই,তোর!””
“” ভাইজান,আমি রিদের ভা….””
“” যে নিজের কাকার মেয়ে তাও একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে খারাপ নজরে তাকাতে পারে তার এর চেয়েও ভয়ানক শাস্তি পাওয়ার দরকার ছিলো!””
তীল নিজেদের দরজার আড়াল থেকে রিদের চলে যাওয়া দেখছিলো। রিদ কাধে ব্যাগ নিয়ে বাবার হাত ধরেই তীলের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। ভয়ে তীল দরজার আড়ালে চলে গেলো। কিন্তু হঠাৎই তুফানের গতিতে নিজের বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে তীলের কাছে দৌড়ে এসে ওর ঠোট কামড়ে ধরে।
“” তোর কি মনে হয়েছিলো আমার নামে নালিশ করেছিলি তাই তোকে কামড়ে দিয়েছিলাম?””
রিদের প্রশ্নে তীল অতীত থেকে ছুটে বের হয়ে রিদের দিকে তাকালো।
রিদ নিজের ডান হাতের বৃদ্ধা আংগুলটি দিয়ে তিলের ঠোটের বা পাশেই ঘেসে থাকা লাল তিলটাই ছুতে ছুতে বললো,
“” এইটা যাতে আমি ছাড়া কেউ দেখতে না পারে,কেউ ছুতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু…””
রিদের শীতলচোখদুটো আবার অগ্নিনালার মতো জেগে উঠলো,
তীল ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো,
“” আপনাকে খুব ভয়ংকল লাগছে লিদ ভাইয়া। আমি লুমে যাবো।””
“” কেন,আমার রুমে থাকতে তোর বুঝি কষ্ট হচ্ছে??””
“” লিদ ভাইয়া প্লিজজজজজ….””
তীলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রিদ ওর ঠোট কামড়ে ধরলো। ব্যথায় তীল ছটফট করতে লাগলো। তাতে রিদের প্রতিক্রিয়া আরো বেকে বসলো। তীলকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে,ওর ঠোট থেকে বের হওয়া রক্ত চুষে নিচ্ছে রিদ!
চলবে