ভালোবাসার রাত Season_2,পর্ব(১৭)

0
2860

ভালোবাসার রাত Season_2,পর্ব(১৭)
রোকসানা রাহমান

তিয়ামতীর ডাকে রিদ ব্লেন্ডারের শব্দ বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকনা খুলে একটা গ্লাস নিয়ে তাতে তরল কিছু ঢাললো। তিয়ামতী কয়েক কদম এগিয়ে এসে বললো,,

“” তুমি কি করছো?””

রিদের ব্যস্ত গলার উত্তর,,

“”সরবত বানাচ্ছি।””
“” সরবত?””
“” হুম,তোর ফেলে দেওয়া ঔষধের সরবত!””

রিদের কথায় তিয়ামতী হতবাক। চোখদুটো রসগোল্লার মতো ভীতিরসে ডুব দিয়ে রয়েছে। চোখের দৃষ্টি পিছুঘুরে থাকা রিদের পিঠের উপর। হাতের নাড়াচাড়ার জন্য কাধ একবার এদিক ওদিক কাত হয়ে যাচ্ছে রিদের। সেই নড়ে উঠা পিঠটা ভেদ করে তিয়ামতী রিদের সব কার্যক্রম দেখতে পারছে এমনভাবেই দৃষ্টি স্থির।

রিদ নিজের কাজ সম্পন্ন করে ডানপাশটা দিয়ে ঘুরে দাড়িয়েছে। ঠোঁটে হাসির রেখা,চোখে দুষ্টু চাহনি। রিদ পা চালিয়ে তিয়ামতীর দিকে এগিয়ে আসছে। তিয়ামতীর স্থির দৃষ্টি এবার চঞ্চলতায় রুপ নিয়েছে। একবার রিদের দিকে তো আরেকবার রিদের হাতের মধ্যে বন্দী গ্লাসটার দিকে পড়ছে। তিয়ামতী কম্পিত গলায় বললো,,

“” লিদ ভাইয়া!””

তিয়ামতী তার পেটের ভেতর চাপা পড়ে থাকা শব্দভান্ডার থেকে আর একটা শব্দও বের করতে পারেনি। আঁখিদুটো নিমীলিত করে নিয়েছে। দুহাতে মুখটাও বন্ধ করে এক চাপা ভয়ে নাকটাও বন্ধ করে নেওয়ার চেষ্টায় আছে।

“” বিয়ে করা স্বামীকে ভাইয়া বলিস? তোর কি লজ্জা সরম কিছু নেই রে তিল?? দুদিন পর ছেলের বউ আসবে। শেষে দেখা যাবে সে শ্বশুড়আব্বা না ডেকে শ্বশুড়মামা ডাকা শুরু করে দিয়েছে।””
“” আপনি তো শ্বশুল হওয়াল আগে মামা হয়েই বসে আছেন। আমাল ডাকেল তোয়াক্কা কলবে কে?””

তিয়ামতী কথা শেষ করতেই রিদ ওর মুখে সরবতের গ্লাসটা চেপে ধরলো।

রিদের জোরের সাথে পেরে না উঠে তিয়ামতী ঢকঢক করে সরবত খাচ্ছে,আর রিদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

“” কি হয় না হয় সেটা পরের ব্যাপার। তুই যদি আমাকে আরেকবার ভাইয়া বলিস তো,আমি ও তোকে বোন বলে ডাকবো। তোর লজ্জা সরম না থাকলেও আমার আছে। আমি বানাবো বউ আর তুই বানিবি ভাই? কেমন খাপছাড়া সম্পর্ক মনে হচ্ছে না?? তার থেকে ভালো তুই আমাকে ভাই আর আমি তোকে বোন ডাকবো। আহা! ভাইবোনের সংসার! বেশ মিলমিশ লাগবে!

রিদের তাচ্ছিল্যকথনকে পাত্তা না দিয়েই তিয়ামতীও বলে উঠলো,,

“” ছোটবেলা থেকে বলে আসছি,হুট কলে কিভাবে চেন্জ কলবো?? একটা অভ্যাস থেকে আলেকটা অভ্যাসে তো লাফিয়ে যাওয়া যায়না। সময়েলও একটা ব্যাপাল আছে।””
“” আর কত সময় নিবি হ্যা? ছুরি থেকে বুড়ি হয়ে গিয়েছিস, কাঁচা চুলে পাকার রঙ লাগিয়েছিস তাও তোর সময় হয়নি??””
“” না হয়নি,এতোটা বছল ভাইয়া হিসেবেই তো ছিলেন,ভাইয়া থেকে স্বামী হতে না হতেই দুল দুল কলে তালিয়ে দিলেন,আপনি আমাল স্বামী সেটা ফিল কলাল সময়টুকুও পায়নি,তাহলে ভাইয়াটা কাটবো কিভাবে??””

তিয়ামতীর যুক্তিতে রিদ বিভ্রান্ত। কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে প্রসঙ্গ পাল্টালো,,

“” আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন?? ওর কথা কি একটু শুনতে পারিস না? কাল সকালে নিজে থেকে ওকে গিয়ে বলবি,তুই চিকিৎসা করাবি। আর সেটা ইউকেতেই।””
“” না। আমি ওখানে যাবোনা।””
“”কেন?””
“” যেখানে আপনি আছেন,সেখানে আপনাকে ছালা আমি নিশ্বাস নিতে পালবোনা। দম আটকে মলে যাবো।””

তিয়ামতীর উত্তরে রিদ কিছু বললো না৷ কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে আবার বললো,,

“” তাহলে অন্য কোথাও থেকে কর। বাংলাদেশের বাহিরে এখন অনেক উন্নত দেশ রয়েছে,যেখানে এইডসের বেশ ভালো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে।””

তিয়ামতীর চটপট উত্তর,,

“” যেখানে আপনার কোনো স্পর্শ নেই,যেখানকার অক্সিজেনে আপনার কোনো গন্ধ নেই সেখানকাল নিশ্বাসও আমি নিতে পালবোনা। দম আটকে মলে যাবো।””

রিদ এবার কিছুটা বিরক্ত নিয়ে বললো,,

“” ওকে,তোর এখানে ওখানে যেহেতু এতো সমস্যা তাহলে নিজের দেশের চিকিৎসাটা তো ঠিকমতো নিবি। সেটা কেন নিচ্ছিসনা? ঔষধ কেন খাচ্ছিসনা? বাংলাদেশে হয়তো অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রের মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসা পাবিনা তবুও ডঃসীমা তোকে যেভাবে আগলে রেখে স্পেশালিভাবে ট্রিট করছে,শুধু ডক্টরি নয় উনিতো আবেগ দিয়েও তোকে যথেষ্ট বুঝিয়েছে তবুও কেন তুই এমন বাচ্চাদের মতো করছিস??

তিয়ামতী এবার রিদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। ফুপিয়ে উঠে বললো,,

“” আমাল আপনাকে ছালা আল বাঁচতে ইচ্ছে কলেনা লিদ ভাইয়া,আপনাকে ছালা একএকটা সেকেন্ড আমাল কাছে যুগ যুগ মনে হয়। এতো বেঁচে থেকে কি হবে? আমি মলে যেতে চাই,আপনাল কাছে যেতে চাই। আপনাল স্পল্সে ডুবে থাকতে চাই,একাকিত্ব আমাকে মেলে ফেলছে,নিশীলাতেল কালো অন্ধকাল আমাকে খেয়ে ফেলতে চায়,আমাল যে খুব ভয় লাগে লিদ ভাইয়া,ভয়ে থলথল কলে যখন কেঁপে উঠি তখন আপনাল বুকটাকে আমি খুব মিস কলি!””

রিদ তিয়ামতীকে নিজের বুক থেকে আলগা করলো। ওর চিবুক চেপে ধরে আছে,ওর চোখে সরল চাহনি নিয়ে ধীর গলায় বললো,,

“” তাহলে পড়ে আছিস কেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে?? চলে আয় আমার কাছে!””

তিয়ামতী সাথে সাথে ছিটকে সরে গেলো। কাঠগলায় বললো,,

“” পালবোনা। আমি চলে গেলে যে আমাল ছেলেটা একা হয়ে যাবে। খুব একা! যাকে পৃথিবীতে আনাল জন্য আপনাল সাথে যুদ্ধ কলে মিলিত হয়েছিলাম আজ তাকে ফেলে দিয়ে আমি কি কলে আপনাল কাছে যাবো? এতোটা স্বাল্থপল আমি হতে পালবোনা,লিদ ভাইয়া!””

তিয়ামতীর গালটা আবার চেপে ধরে আছে রিদ। তবে আগেরবারের মতো এবার নরম ছোয়ায় নয়,শক্ত ছোয়ায়। চোখে ফুটে উঠেছে আগুনের ঝলকানি,হাতের চাপটা আরেকটু গাঢ় করে কঠিন গলায় বললো,,

“” এতোই যখন ভালোবাসা,এতোই যখন মায়া,এতোই যখন দরদ তাহলে সে ছেলের গালে দাগ বসালি কি করে? বল কেন মেরেছিস ওকে? তুই জানিস না এতে শুধু ও না ওর বাবাও কষ্ট পাবে? তবুও কেন মেরেছিস?? তোর এই চড়টা ওর গালের দাগটা এতোটাই গভীর করেছে যে ওর হৃদয়ও ক্ষত হয়েছে।””
“” বেশ কলেছি,ও আপনাকে নিয়ে এমন বলবে কেন? বাবাকে ভালোবাসা আল ছেলেকে ভালোবাসা কি এক হলো? দুটো ভিন্ন লকম ভালোবাসাকে সে এক কাঠগলায় দালালো কেন?””

তিয়ামতীর উত্তরে রিদ আরো বেশি গর্জে উঠেছে। রাগে মুখটা কেঁপেকেঁপে উঠছে। তিয়ামতীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। পাশেই অবস্থান করা ফ্রিজের দিকে নজর পড়েছে তার।

তিয়ামতী রিদের ধাক্কা সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে হালকা ধাক্কা খেয়েছে। নিজেকে সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই ওর হাতদুটো টেনে নিলো রিদ। তিয়ামতী কিছু বুঝার আগেই বরফের টুকরো দিয়ে দুহাতভর্তি করে দিয়েছে। রিদের দিকে প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে ও।

“” একটু অপেক্ষা কর সব বুঝে যাবি।””

সময় যখন সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিটে চলছে তখনি তিয়ামতীর হাতের অবস্থা কাহিল। বরফ গলা পানি নিচে পড়লেও বরফ শেষ হচ্ছেনা বরংচ বরফের পাহাড়টা বেড়েই যাচ্ছে। এদিকে অতিরিক্ত ঠান্ডা বহনে তিয়ামতীর হাত অবশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। হাতের শীতল ঠান্ডাটা রক্তের সাথে মিশে গিয়ে পুরো শরীরে বয়ে যাচ্ছে।

অতি গরমে হাতে ফোস্কা পড়ে জানতো সে কিন্তু অতি ঠান্ডাতেও যে পড়ে সেটা সে এখন টের পাচ্ছে। চোখ বেয়ে নোনাপানির স্রোত চলছে তিয়ামতীর। অসহায় চাহনি নিয়ে রিদের দিকে তাকাতেই দেখে সেখানটা অন্ধকার জায়গা করে নিয়েছে। কালো অন্ধকারেও সে আবছা ভেসে উঠা তার রিদ ভাইয়াকে চারপাশে কোথাও পাচ্ছেনা। ব্যাকুল হয়ে চারপাশটা চোখ বুলিয়ে খুজছে। রান্নাঘর ছেড়ে পুরোবাড়ি তল্লাসী নিলো। কোথায়ও তার ছায়া না পেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,,,

“” লিদ ভাইয়া!””

অন্ধকার রুমে আলো জ্বলে উঠেছে। তিয়ামতী চোখ মেলতেই সামনে রাতকে দেখতে পেলো। এমন মাঝরাতে স্বপ্ন দেখে প্রায় তার বুক শুকিয়ে আসে। আজও হয়েছে। শুকনো বুকটা কাতর হয়ে গলাকে জানান দিচ্ছে তার পিপাসা পেয়েছে। গলায় হাত পড়তেই রাত পানিভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিলো মায়ের দিকে।

তিয়ামতী নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে গ্লাসটা ফেরত দিতে দিতে বললো,,

“” তুই এতোরাতে এখানে?””

মায়ের প্রশ্নের উত্তরে রাত কিছু বললোনা। মাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে কম্বলটা চাপিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে।

“” তোর মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন রে,বাপ?””

মায়ের এমন মমতাময় প্রশ্নকে এড়িয়ে যেতে পারছেনা রাত। মাঝপথেই দাড়িয়ে রইলো। বাহিরে যাওয়া দরজা আর মায়ের ঠিক মাঝ বরাবর স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। একমন চাইছে অভিমান নিয়ে ছুটে বাইরে চলে যেতে তো আরেকমন চাইছে সকল অভিমান ভুলে গিয়ে মায়ের বাহুবন্ধনে আটকে যেতে। বুকের ভেতর চলা হঠাৎ ঝড়েরবেগটা দমাতে হলে এই মুহুর্তে তার মায়ের বাহুবন্ধনটাই যথেষ্ট।

“” কিরে,এভাবে পাহাড়ের ন্যায় থমকে গেলি কেন? রাগ করেছিস?””

রাতের চোখ ভিজে উঠছে,কিন্তু কেন? মায়ের উপর অভিমানের জন্য নাকি সন্ধ্যার উপর সুপ্ত অভিমানের জন্য?? একি সাথে দুটো অভিমানের পাহাড় সে একা কি করে বইবে?? মানুষ দুটোই যে তার শরীরের অভ্যন্তরে বসবাস করা এক কলিজার এপারওপার!

রাত আর স্থির থাকতে পারছেনা। চোখের নোনাস্রোতের চলনগতি থামাতে হলে তার পায়ের চলনগতির প্রয়োজন। চোখটা বন্ধ করে দরজার দিকেই অগ্রসর হলো সে।

~~

ভোরের কাঁচারোদের গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে সন্ধ্যার। হিমেল বাতাসটাকে তাড়িয়ে একটা ভাপসা গরম জায়গা করে নিচ্ছে ওর শরীরে। সারারাতে ব্যস্তগতিতে চলতে থাকা চলমান ফ্যানটা শীতল বাতাস দিতে ব্যর্থ হচ্ছে,তার ফলস্বরূপই যেন সন্ধ্যার কপালপার্শ্বতে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা জমে উঠেছে। সন্ধ্যা গায়ে জড়ানো পাতলা কালো কাঁথাটা সরিয়ে দিয়ে আবার ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিলো,ঠিক তখনি কানে বাজছে নানারকম শব্দ। ছোটবাচ্চার কান্না,দু/তিনজনের হাসির শব্দ আবার নানা কথার ধ্বনি। সন্ধ্যা চট করে উঠে বসলো। বিরক্ত নিয়ে কানখাড়া করে আছে,এ বাড়িতে হচ্ছেটা কি??

এমন মিশ্রশব্দ সন্ধ্যার মেজাজে বিরক্ত চেপে বসেছে। বিছানা ছেড়ে বাইরে পা পড়তে ওর কপাল ভ্রূযুগলসহ কুঁচকে উঠলো।

“” রাত ভাইয়া,উঠো বলছি!””

ভোরের আযান শুনে সবেই বিছানায় কাত হয়েছিলো রাত। সারাটারাত চোখের দুপাতা একপাতাতে আনতে পারেনি সে।

সন্ধ্যার এমন শক্তডাকে ঘুমকাতুরে কন্ঠে বললো,,

“” একটু ঘুমুতে দেনা। খুব ক্লান্ত লাগছে।””

সন্ধ্যা আর ডাকার প্রয়োজন মনে করলোনা। সোজা ওর পেটের দুদিকে দুপা ভর দিয়ে রাতের দিকে ঝুকে দাড়িয়েছে। বিছানার সাথে অসার হয়ে পড়ে থাকা হাতদুটো ধরে সন্ধ্যা টেনে রাতকে বসিয়ে দিলো। গরম মেজাজে বললো,,

“” একরাতের মধ্যে শুনশান বাড়ীটাকে পার্ক বানিয়ে ফেলেছো,ক্লান্ত তো হওয়ারই কথা। কে বলেছে এগুলো করতে?””

সন্ধ্যার বচনভঙ্গিটা গোগ্রাসে গিলছে রাত। আধবোজা চোখ দিয়ে অপলকে চেয়ে আছে।

“” কিছু বলবে নাকি তোমাকে পানিতে চুবাবো?””
“” রাগলে তোকে বউবউ লাগে!””

রাতের ভারীকন্ঠে সন্ধ্যার রাগ সব পানি। মনে হচ্ছে রাতের মাথায় ঢালতে চাওয়া সবটা পানি নিজের মধ্যে পড়েছে।

“” এতো রাগার কি আছে? এ বাড়ির মেয়ের বিয়ে একটু খাওয়া-দাওয়া হবেনা?? হাতের কাছে যাদের পেয়েছি তাদেরকে ধরে এনেছি। তোর তো অন্যের বউ সাজার খুব তাড়া!””

সন্ধ্যা ভ্রূ উচিয়ে তাকাতেই রাত বিড়বিড় করে বললো,,

“” ঐতো সায়নের বউ হওয়ার তাড়া তাই তো বললাম।””

সন্ধ্যা বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে বললো,,

“” আমার এসব আদিখ্যেতা চাইনা। তুমি কাজী ডাকো,আমি কবুল বলে বাপের বাড়ি ছাড়বো।””

রাত সন্ধ্যার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বললো,,

“”তোর এতো তাড়া কিসের রে? আমি কি তোর চাওয়া অপুর্ণ রাখছি? তুই যা চাচ্ছিস তাই তো হচ্ছে,শুধু একটু গুছিয়ে দিচ্ছি! একটু সবুর করনা রে,আজকে হলুদের ছোয়া লাগা কাল নাহয় কবুল বলিস!””
“” এতো সাজের দরকার নাই। আমি আজকেই….””
“” প্লিজ! শেষবেলায় আমার ইচ্ছেটা রাখ!””

সন্ধ্যা কিছু বলতে চেয়েও বললোনা। চোখ পাকিয়ে বেড়িয়ে এলো। সন্ধ্যার চলতিপথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রাত,অন্তর্মনের অন্তর্কন্ঠে চাপা অভিমানের সুর,,,

চাইছি তোকে, খুব করে,,,,,,
বেসে যাব ভালো,চুপ করে,,,,,,

~~

দলে দলে মেহমান এসে হাজির হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে। চারপাশে হলুদের মেলা। বাচ্চা থেকে শুরু করে মাঝবয়সীর মায়েরাও হলুদসাজে সজ্জিত করে নিয়েছে নিজেকে। চারপাশে কাঁচা হলুদ আর বাঁটা মেহেদীর গন্ধ মইমই করছে।

রাত সন্ধ্যার হলুদসন্ধ্যা সাজাতে ব্যস্ত। পেছন থেকে তিয়ামতীর ভারীকন্ঠ,,,

“” কি হচ্ছে এসব? রাত তুই কি এবার সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেলি?””

মায়ের কন্ঠ কর্নপাত করছেনা রাত। নিজের কাজে গভীর মনোঃনিবেশ সে।

“” তুই চাচ্ছিসটা কি আমাকে একটু বলবি? তোর কর্মকান্ডে তো আমি নিজেও পাগল হয়ে যাচ্ছি।””

রাত এবার মায়ের দিকে ঘুরে তাকালো। কিন্তু কিছু না বলেই সামনে হাঁটা ধরেছে। তিয়ামতীও নিজের ছেলের পিছ ধরেছে। পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কথার ধোয়া ছাড়ছে,,,

“” কথা বলবি নাতো? না বললি,তাতে আমার কি?;তোর কি মনে হয় আমি তোর সাথে কথা বলার জন্য ব্যাকুল? আমি কথার গাছ?””

রাত পথের বাক ঘুরলো তিয়ামতীও ঘুরেছে। রাস্তার পাশে লাইটিং ঠিক আছে নাকি তা পরীক্ষা করছে,,

“” একটু রেগে গিয়ে চড় মেরেছি বলে আমাকে শাস্তি দিচ্ছিস তো, দে। আমি তো তোদের বাপ-ছেলের শাস্তি নেওয়ার জন্যই পৃথিবীতে এসেছিলাম। একজন স্বপ্নে এসে রাগ দেখাচ্ছে তো আরেকজন এখানে।””

রাত মায়ের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো। সাথে সাথে তিয়ামতী নিজের দু-হাত ওর দিকে মেলে ধরে বললো,,

“” তোকে মেরেছি বলে তোর বাপ এসে আমার হাতে ফোস্কা ফেলে দিয়ে গিয়েছে। বাপ-ছেলে দুটোই স্বার্থপর,নিজের যা ইচ্ছে তাই করবে। আমার দিকটা ভাবার কোনো সময়ই নেই।এই পৃথিবীতে আমার ব্যথা দেখার কেউ নেই।””

রাত হাতের দিকে নিবিড়ভাবে চেয়ে আছে। সাদা ফকফকা তালুতে আড়াআড়ি ঘনরেখা ছাড়া সে কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা। তিয়ামতী রাতের অবস্থা বুঝতে পেরে নিজের হাতদুটো সরিয়ে ন্যাকা কন্ঠের সুর তুললো,,

“”দেখতে পারছিস নাতো? পারবিও না। তোদের তো আমার ব্যথা দেখার সময়, চোখ নেই। বেশ করেছি আমি ঔষধ খাইনি,আর খাবোওনা। তোদের বাপ-ছেলের পাগলামীতে আমি অতিষ্ট। এবার গভীরঘুমে চোখ বুঝে বিদায় নিবো। তাতে যদি তোরা শান্তি পাস!””

তিয়ামতী নিজের কথা শেষ করে সোজা নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরেছে। রাত মায়ের উল্টোরাগ ভাঙাবেনা। উনার না মুখকে হাঁ বানাতে হলে এতোটুকু ধৈর্য্য তাকে ধরতেই হবে!

~~

সন্ধ্যার হলুদসাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। চারপাশের আলোর রশ্মি কমে এসেছে,মানুষের হইহট্টগোল কমে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। সারাসন্ধ্যা হাসি-তামাসা,নাচগান শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে কেউ কেউ বাড়ি ফিরেছে কেউ কেউ এ বাড়িতে জায়গা দখলে শুয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা হলুদ ধুয়ে গোসল ছেড়ে পাতলা সুতি শাড়ী পড়ে মায়ের রুম থেকে বেরোলো। পুরোবাড়িতে আনাচ কানাচেও সে রাতকে খুজে পায়নি। সেই যে সকালবেলা তার রুমে কথা হয়েছিলো তারপর আর তার দেখা পায়নি সন্ধ্যা৷ মানুষটা গেলো কই?? নিজেই এতো কিছুর আয়োজন করলো,আবার নিজেই নিজেকে সবকিছু থেকে আড়াল করে রেখেছে। তাহলে কি প্রয়োজন ছিলো এগুলোর?? একটু হলুদ ছোয়াতেও তো আসলোনা! আমি যে তার হলুদের স্পর্শ নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম তা কি সে বুঝেনি??

কপালে নানা চিন্তার ভাজ নিয়েই সিড়িতে পা রেখেছে সন্ধ্যা। বাড়িতেই আছে,ভেতরে নেই মানে ছাদে আছে। ভেজা চুলে মোড়ানো সাদা টাওয়ালটা খুলে নিয়েছে সন্ধ্যা। দু/একটা বারি মেরে সিড়ির ধারে টাওয়ালটা রেখে দিলো। শাড়ীর কুচিতে বারবার পা আটকে যাচ্ছে তার। বিরক্তভর্তি নিশ্বাস ছেড়ে দুহাতে শাড়ী উচু করে দ্রুত উপরে উঠে যাচ্ছে।

ছাদের একপাশে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা চেচিয়ে উঠলো,,

“” রাত ভাইয়া? তুমি কোনপাশে? এতো অন্ধকার কেন? আজ দেখি আকাশে তারার বদলে মেঘেরা মেলা বসিয়েছে!””

সন্ধ্যা নিজের কথা শেষ করতেই ধপাস শব্দে দরজা লাগার শব্দ। কিছুটা ছিটকে উঠে সন্ধ্যা। ভয় ভয় নিয়ে চারপাশে আরেকবার চোখ বুলালো। রাতের কোনো দেখা না পেয়ে চোখ বন্ধ করে সিড়ির দিকে দৌড় দিতেই ফুলের টবের সাথে পা লেগে গিয়েছে। হুমড়ি খেয়ে একদম রাতের উপর পড়েছে। সন্ধ্যা বন্ধ চোখ মেলে আশ্বাসের সুরে বললো,,

“” আল্লাহ! তুমি? আমিতো ভাবলাম কোনো ভূতের উপর পড়েছি! কোথায় ছিলে তুমি?””

সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তরে রাত কিছু বলছেনা। পুরো দৃষ্টি সন্ধ্যার মুখে। ভেজা চুলগুলো এক ধার দিয়ে ওর গাল,নাক,ঠোঁট এমনকি গলায়ও ল্যাপ্টে আছে। রাত আনমনে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছে,সন্ধ্যার হাত তখনো রাতের টি-শার্টের বুকের দিকটা খামচে ধরে আছে।

সন্ধ্যার গোলাপী আভায় ফুটে থাকা মুখটাতে রাত নিজের হলদে মাখা হাতটা দিয়ে হলদে আভায় মাখিয়ে দিলো। ওর হাতদুটো নিজের বুক থেকে ছাড়িয়ে পিছু ঘুরিয়ে নিয়েছে। পেছনে পড়ে থাকা চুলগুলো সামনে ফেলে দিয়ে ঘাড়েও হলুদ মেখে দিচ্ছে। সন্ধ্যা নিজেকে ঘুটিয়ে নিয়ে সরে যেতে চাইলে ওকে আবার নিজের দিকে ঘুরালো রাত।

সন্ধ্যা নিজের লজ্জাদৃষ্টি রাতের দিকে ফেলতে পারছেনা। মাথাটা কিছুটা সামনে নামিয়ে মেঝেতে দৃষ্টিপাত! নিচুস্বরে রাতকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর কাধে বিছিয়ে থাকা শাড়ীর আঁচলে হাত পড়েছে রাতের। আমচকা টানে শাড়ীর আঁচল নিচে ফেলে দিলো!

সন্ধ্যা অবাক হওয়ার সময়টুকু না নিয়ে নিজের দুহাত বুকের উপর আড়াআড়ি পেতে বললো,,

“” রাত ভাইয়া! কি করলে এটা?””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here