ভালোবাসার রাত Season_2,পর্ব (১২)

0
2890

ভালোবাসার রাত Season_2,পর্ব (১২)
রোকসানা রাহমান

সন্ধ্যা কথার ফাঁকে ফাঁকে নানা অঙ্গিভঙ্গি করছে। হাতটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে বিধায় মাঝে মাঝে পেটের দু ইঞ্চি খালি জায়গাটা তিন ইঞ্চিতে রুপান্তর হচ্ছে। রাতের মাথা গরম হয়ে সব টালমাটাল অবস্থা। রাগে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। ইচ্ছে হচ্ছে সন্ধ্যার গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিতে নাহয়,পেটে গরম ছ্যাকা লাগিয়ে দিতে। রাত আর পারছেনা সহ্য করতে এবার কি তবে ওর ভেতরের রাগটা বেড়িয়ে আসতে চাইছে?? সব বাধ ভেঙে গিয়ে রাতের ভয়ংকর রুপটা সন্ধ্যা দেখতে চলেছে??

রাতের চোখে অগ্নিনালা বয়ছে। হাতদুটো মুঠো করে নিজের রাগকে দমিয়ে রাখতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে কই? বরংচ রাগটা আরো বেশি তীব্র হয়ে আসছে।

“” রাত,তুই এখানে? আর আমি তোকে খুজতে খুজতে কাহিল!””

হঠাৎ অন্যকারো কন্ঠে রাত পেছনঘুরে তাকায়। সায়ন দাড়িয়ে আছে দরজার কাছটাতে। রাতের দিকে ঠিকমতো খেয়াল বাদ দিয়ে সন্ধ্যাকে ঘুরঘুর করে দেখছে সায়ন। বেশ কিছুক্ষন দেখে নিয়ে হালকা হেঁসে বললো,,

“” তুমি সন্ধ্যা না? সেই ছোট্টবেলা দেখেছিলাম। তুমি তো অনেক বড় হয়ে গিয়েছো। বাহ! বেশ সুন্দরীও হয়েছো।””

সন্ধ্যা লজ্জা মাখতে গিয়েও মাখলোনা। সায়নের কাছে এগিয়ে বললো,,

“” সায়ন ভাইয়া,তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে?? আমি তো ছোটবেলা তোমাকে কত পছন্দ করতাম। তাও কেন এলেনা? হঠাৎ তুমি আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া বন্ধ করলে কেন?””
“” রাত তো আমাকে..””

সায়ন কথা ছুড়তে গিয়ে চুপ হয়ে গেলো। রাতের দিকে চোখ পড়তেই তার সব হাঁসি ফুরুৎ। এটা সে কি করতে যাচ্ছিলো?? এই টাগড়া যুবক বয়সে সে মরতে চায়না,তাও রাতের হাতে তো নয়ই। তাহলে দেখা যাবে মরেও শান্তি পাবেনা। সায়ন ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,,

“” আরে,আমি তো আান্টির সাথে এখনো দেখা করিনি। যাই আন্টির সাথে দেখা করে আসি।””

রাতের ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি থেকে বাঁচতে চটপট পা চালিয়ে চলে গেলো সায়ন।

সন্ধ্যা সেদিকে তাকিয়েই বললো,,

“” রাত ভাইয়া,সায়ন ভাইয়া দেখতে এতো ভালো কেন?? উফ! আমার চোখ জুরিয়ে গিয়েছে! কি ভালো দেখতে। ছেলে মানুষ বুঝি দেখতে এতো ভালো হয়?””

রাতের অগ্নিদৃষ্টিকে কোনো পরোয়াই করছেনা সন্ধ্যা। নিজের মতো বকবক করে বের হতে যাবে অমনি রাত ওর হাতটা খামচে ধরলো। সন্ধ্যা রাতের হাতের উপর নিজের আরেকটা হাত রেখে বললো,,

“” এতো শক্ত করে ধরেছো কেন? আমার নরম হাতটা কি ভর্তা বানিয়ে দিবে?””

রাত আগুন ঝেড়ে কিছু বলতে যাবে অমনি সন্ধ্যার বান্ধুবী দিয়ার আগমন।

“” এই সন্ধ্যা, তোরা কি করছিস?””

সন্ধ্যা চোখ বাকিয়ে দিয়ার দিকে তাকালো। এবার তার চোখও রাগে লাল হয়ে আসছে। দিয়া রাতের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে বলছে,

“” তোকে খুব সুন্দর লাগছে। ইচ্ছে করছে একটা চুমু খায়।””

সন্ধ্যা নিজের হাত ছাড়িয়ে কঠোরভাবে বললো,,

“” এই লুচু মেয়ে,তুই এখানে কি করছিস? আমি তো তোকে ইনভাইট করিনি।””
“” বান্ধুবীর জন্মদিনে আসতে ইনভাইট লাগে নাকি?””

সন্ধ্যার গলা ছেড়ে পাল্টা প্রশ্ন,,

“” দাওয়াত ছাড়া খেতে চলে এসেছিস? মুখ দিয়ে খাবি নাকি চোখ দিয়ে?””
“” যেটা দিয়ে খেলে তৃপ্তি পাবো।””

দুজনের কথোপকথনে রাত হতবাক। এদের মাঝখানে তার কিছু বলা উচিৎ নাকি তাও বুঝতে পারছেনা। একবার সন্ধ্যার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার দিয়ার দিকে। রাত হঠাৎই দিয়ার হাতে ধরে টেনে সন্ধ্যার পাশে দাড় করিয়ে দিলো। এতে যেন দিয়া বেশ বিস্মিত। অবাকের দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে তার হাতে বাধা রাতের হাতে। রাত চাঞ্চলতার সাথে বললো,,

“” দেখ তো দিয়াকে সাদাকালো থ্রি-পিসটাই কত সুন্দর লাগছে।””

সন্ধ্যা অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে বললো,,

“” তাহলে ওকে খেয়ে ফেলো। তুমি কি দিয়ে খাবে বলো তো? আজ তো আমার জন্মদিন পার্টি নয়,ভক্ষণ পার্টি। যেখানে খাবার নয় অন্যকিছু খাওয়া হয়!””

রাত সন্ধ্যার কথা ঝেড়ে ফেলে অনুরোধী সুরে বললো,,

“”তুই ও ওর মতো একটা থ্রি-পিস পড়ে নে। এসব লেহেঙ্গাতে তোকে একদম মানাচ্ছেনা।””

দুজনের কথার মাঝখানে ফোড়ন কাটলো দিয়া। কিছুটা সন্ধ্যার দিকে ঝুকে এসে ফিসফিস করে বললো,,

“” তোর রাত ভাইয়ার কাছে, তোর চাওয়া পুরন হয়েছে কি? তাহলে আমিও একটু চাইতাম। উনাকে দেখলেইনা আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে,আমি ব্যাকুল হয়ে পাগল হয়ে যাই। আমার মনে হয় আমি তোর রাত ভাইয়ার প্রে…””

দিয়া কথা শেষ করার আগেই ওর পায়ের উপর নিজের পাটা রাখে সন্ধ্যা। নিজের হাইহীল দিয়ে পিষিয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে চালিয়ে ঝাঝড়া কন্ঠে বললো,,

“” যখন তখন তোর প্রেম জেগে উঠে না? তুই এখন আমার সামনে থেকে যাবি নাকি তোর জামা টেনে ছিড়ে ফেলবো। আসছে আমার সাদাকালো রানী!””

দিয়াকে অনেকটা জোর করে ঠেলে রুম থেকে বের করে দিয়েছে সন্ধ্যা। রাত কিছু বলতে যাবে তার আগেই সন্ধ্যা ওকে টেনে নিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো। রাতের ঠিক পাশে দাড়িয়ে আছে। পাশাপাশি,কাছাকাছি। রাতের ডান হাতটাতে সন্ধ্যা নিজের বা হাতটা দিয়ে জড়িয়ে আরেকটু কাছ ঘেষে দাড়িয়ে আয়নাতে চেয়ে আছে।

সন্ধ্যা কি করতে চাচ্ছে বা আয়নাতেই বা কি এতো দেখছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছে রাত। মাথায় চড়ে বসা রাগটা তখনো টগবগে। তবে আগের মতো নয়। অনেকটাই কমে এসেছে। সন্ধ্যার হাতের বাধনে তাকিয়ে কিছু একটা অনুভব করছে,ভালো লাগা নাকি ভালোবাসা? ঠিক তখনি সন্ধ্যা বলে উঠলো,,

“” রাত ভাইয়া,তোমার হাইট কত?””

রাতের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে ওর সামনাসামনি দাড়ালো সন্ধ্যা।

“” কোথায় হারিয়েছো? আমি যে বকর বকর করছি,তুমি শুনতে পাচ্ছোনা?””
“”শুনতে দিলি কই? শোনার আগেই তো সব শেষ।””

সন্ধ্যা কপাল কুঁচকে বললো,,

“” কি শেষ?””
“” কিছুনা।””

সন্ধ্যা বিরক্তভর্তি একটা নিশ্বাস ছাড়লো। রুমের একসাইডে থাকা একটা চেয়ার নিয়ে এসে রাতের সামনে রাখলো।

“” চেয়ার দিয়ে কি করবি?””

রাতের কথার কোনো উত্তর দিলো না সন্ধ্যা। চেয়ারে উঠে দাড়িয়ে হাতের ইশারায় রাতকে ওর কাছে ডাকলো।

“”এখন তো আমি তোমার থেকে লম্বা হয়ে গিয়েছি। তোমাকে কে বলেছে এতো লম্বা হতে? নিচে দাড়ালে তুমি লম্বা আর উপরে দাড়ালে আমি লম্বা। বেখাপ্পা হাইট নিয়ে তুমি কেন জন্মালে,রাত ভাইয়া?””
“” আমি বেখাপ্পা লম্বা?””
“” তা নাহলে কি? পুরো তালগাছ। আমি ৫ ফুট তিন হয়েও তোমার কাধ অবধি! তাহলে কি তুমি বোঝাতে চাচ্ছো আমি খাটো মেয়ে?””
“” আমি সেটা কখন বললাম?””
“” মাত্রইতো বললে।””
“” না আমি বেখাপ্পা আর না তুই খাটো। দুজনেই দুজনের দিক থেকে পারফেক্ট!””
“” মোটেও না। আমি তো তোমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারিনা। মাথা উচু করে আকাশ পানে চেয়ে কথা বলতে হয়। আমার ঘাড় ব্যথা হয়না বুঝি?””

রাতের ইচ্ছে হলো সন্ধ্যার মাথাটা বুকের সাথে ল্যাপ্টে নিয়ে বলতে,তোর ঘাড় ব্যথা করে আমার সাথে কথা বলতে হবেনা। আমার বুকে কান পেতে আমার হার্টবিটরা কি বলছে সেটা শুনলেই হবে। আমি তো তোর স্পর্শেই তোর সব না বলা কথাগুলো বুঝে নিবো!

“” আবার কি বিড়বিড় করছো? এইদিকে চুপ করে দাড়াও। চোখটা বন্ধ করো তো।””
“” কেন?””
“” এতো প্রশ্ন করো কেন? তোমার কি মনে হয়,আমি লুকিয়ে তোমাকে চুমু খাবো? আমাকে তোমার অমন মনে হয়? আমার চুমু খাওয়ার মানুষের অভাব নেই। তোমার মতো বেখাপ্পা লোককে আমি কেন চুমু খেতে যাবো?””

রাত আর কথা না বাড়িয়ে চোখটা বন্ধ করে নিলো। এই মেয়েটা একটুও ভালো করে কথা বলতে পারেনা। সবসময় হৃদয়ক্ষত কথা বলবে।

রাত চোখ বন্ধ করতেই সন্ধ্যা কাজল ল্যাপ্টে দিচ্ছে রাতের গালে,কপালে,নাকে,থুতনিতে এমন কি ঠোঁটেও! রাত হকচকিয়ে বললো,,

“” আরে আরে কি করছিস?””
“” একদম নড়নচড়ন নয়। চোখ খুললে খবর আছে। তোমাকে এখন আমি সাজাবো। তুমি এতো ফর্সা কেন? আমার থেকেও বেশি ফর্সা। ছেলেমানুষ এতো ফর্সা কেমনজানি অশোভন লাগে। এই জন্যইতো বুড়ো হতে চললে তাও তোমার কোনো গার্লফ্রেন্ড হয়নি।””

সন্ধ্যা রাতের মুখের সাজটা শেষ করে হাতে পায়েও কাজল মেখে দিলো। ঠিকঠাকমতো মিশিয়ে পুরো শ্যামবর্ন বানিয়ে আহ্লাদী স্বরে বললো,,

“” ইশ! তোমাকে কি সুন্দর লাগছে গো রাত ভাইয়া। আমার একটা বোন থাকলে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম।””

রাত বাঁকাচোখে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছে,আমি তোকে বিয়ে করার জন্য ২৪ বছর ধরে পুড়ছি,আর তুই নাই বোনের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য আফসোসে মরছিস। একেই বলে কপাল! তবে এই পোড়া কপাল নিয়েই তোকে আমি পুড়াবো,ভালোবাসার দহনে তোকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিবো আমি,আমি তো সেই সময়ের অপেক্ষায় আছি!

সন্ধ্যা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ক্ষীণস্বরে চিল্লিয়ে বললো,,

“” আল্লাহ! আটটা বেজে গিয়েছে?? শিপন,অমিত,দিহাম,আরমান সবাইতো চলে এসেছে। আমাকে নিশ্চয় খোঁজছে। আমি কেক কাটবো কখন? তোমার জন্য আমার লেট হয়ে গেলো।””

সন্ধ্যা ছুটাছুটি করে চুলটা আচড়িয়ে নিলো,লেহেঙ্গার ওড়নাটা গলায় ফেলে,গালের এপাশওপাশ কিছু একটা মাখলো,ঠোঁটের লিপস্টিকটা আরেকটু গাঢ় করলো,কপালের টিকলিটাও এদিক ওদিক সরিয়ে সোজা করলো। রাত চুপচাপ সন্ধ্যার কার্যকলাপ দেখছে,মুখে একটা রা শব্দও নেই। সন্ধ্যার টেনে আনা চেয়ারটাতেই গম্ভীর আসনে বসে ওকে দেখে যাচ্ছে।

সন্ধ্যা নিজেকে পরিপাটি করে রাতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দৌড় দিবে ঠিক তখনি ওর কনুই চেপে ধরলো রাত। শান্তস্বভাবেই বললো,,

“” লেহেঙ্গাটা চেন্জ করে নে।””

সন্ধ্যার চটপট উত্তর।

“”অসম্ভব,আমার সবসাজ ঘেটে যাবে। ছাড়ো,আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।””

রাত বসা থেকে উঠে দাড়ালো। সন্ধ্যাকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে বললো,,

“” তুই এটা পড়ে বাইরে যেতে পারবিনা।””
“” যাবো।””
“” না,যাবিনা।””
“” ১০০ বার যাবো। তোমার কি?””
“” সন্ধ্যা কথা বাড়াস না। বলছিতো এটা পড়ে বেরোনো যাবেনা।””
“” যাবে যাবে যাবে। আমি যাবো যাবো যাবো। তোমার কথা শুনবোনা।””

সন্ধ্যার জেদের পাহাড়টা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এক টানে সব ছিড়ে ফেলতে,গুড়িয়ে দিতে সন্ধ্যার জেদের পাহাড়।

সন্ধ্যা নিজের একরোখা কথা থেকে যে পিছপা হবেনা সেটা ওর চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সেই চোখটার দিকে কড়া চোখে তাকাতে পারছেনা রাত। তবুও জোর করে তাকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বললো,,

“” আমি বলছি তুই যাবিনা,আর এটাইতেই তুই অনুবর্তী হবি!””

সন্ধ্যার একরোখা জবাব,,

“” হবোনা। কি করবে? আমাকে বকবে? মারবে? নাকি..””

সন্ধ্যার কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর হাত ছেড়ে দিয়েছে রাত। ওর দিকে একবার তাকানোর প্রয়োজন মনে করলোনা। মাত্রাতিরিক্ত রাগে তার কপালের উভয়পাশের শিরারা বেড়িয়ে আসার উপক্রম। কানে শুধু সন্ধ্যার কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে,কি করতে পারি সেটা তোকে জানাতে চায়না বলেই আজ তোর এতো অধপতন!

~~

সন্ধ্যার জন্মদিনের কেকটা ছুড়ে ফেলে দিলো,খাবার আসনগুলো আছাড় মেরে গুড়িয়ে দিচ্ছে,চারপাশের জ্বলমলে আলোর রশ্নিগুলো টেনে ছিড়ে ফেলে বাইরে বেড়িয়ে পড়লো রাত। পেছনে শতশত চেনা অচেনা মানুষের চিৎকারের ভয়ানক কন্ঠস্বরগুলো শুনার সময়টুকু যেন নেই। দ্রুতপদে ব্যস্ত রাস্তার কিনার ধরে হাঁটা শুরু করেছে,কাঁপছে সে,পুরো শরীরে কম্পনের খেলা চলছে!

~~

ঘড়ির কাটা যখন ১২ টা পার করলো তখন রাত বাসায় পা ফেলেছে। কয়েক ঘন্টার তফাতে বাড়ির বৈচিত্র পুরো বিপরীত। কোনোদিকে চোখ না ঘুরিয়ে সোজা নিজের রুমের দিকে পা চালাচ্ছে রাত। বারান্দায় দাড়িয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার জন্য চোখটা বন্ধ করতেই পেছনে কারো উপস্থিত টের পেলো।

সন্ধ্যার বাবা সিকান্দার সাহেবকে দেখে মাথাটা নিচু করে ফেলেছে রাত।

“” কেন করেছো এটা জানতে চাইবোনা। আমি কখনোই তোমার কাছে কোনো কাজের জবাব চায়নি। আমি সবসময় ভেবে এসেছি,তুমি যথেষ্ট বুদ্ধীন্দ্রিয় একজন ছেলে। ছোটবেলা থেকেই তোমাকে আমি খুব পছন্দ করে এসেছি। এখনো করি। তবে আজ তোমার ফুপা হিসেবে একটা কথা বলতে এসেছি,যার উপর রাগ তার উপরেই ঝেড়ে ফেলা উচিত,যাতে সে দ্বিতীয়বার তোমার রাগের দর্শন পাওয়ার আগে একবার হলেও চিন্তিত হয়। তুমি আজ একজনের জন্য অনেকগুলো মানুষের মন ভেঙে দিয়েছো। এটা কি ঠিক হয়েছে? একজনের জন্য আরেকজন কেন ক্ষতিগ্রস্থ হবে?””
“” সরি ফুপা!””
“” আশা করি আমার উপদেশটা তোমার কাজে লাগবে!””

সিকান্দার সাহেব বেড়িয়ে যেতেই রাতের মা তিয়ামতী এসেছেন।

“” আম্মু,তুমি এখনো জেগে?””
“” আমি এখনি রিমার সাথে কথা বলবো,কালকেই তোদের বিয়ে!””
“” বিয়ে? কার বিয়ে?””
“” তোর আর সন্ধ্যার!””

তিয়ামতীর কথা শুনে ক্ষনিকের জন্য রাতের চিন্তাশক্তিরা আলাদা হয়ে গিয়েছে। মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল ভঙ্গিমায় তাকানো ছাড়া আর কোনো কথা বের হচ্ছেনা ওর মুখ থেকে। হয়তো তিয়ামতীর এমন অপ্রত্যাশিত কথার ধাক্কাটা সে সামলিয়ে উঠতে পারেনি। রাতের নিরবতা দেখে তিয়ামতী নিজের কথা চালিয়ে বললো,,

“” আমি আর তোদের এমন রাগ-অভিমান দেখতে পারছিনা। সন্ধ্যার কথা বাদই দিলাম,তুই তো দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠছিস। আর তাছাড়াও..””
“” তাছাড়া?””

তিয়ামতী পেরে উঠা কথাটা লুকিয়েই বললো,,

“” তাছাড়া আর কি? বিয়ে হয়ে গেলে বদ্ধরুমে রাগ-অভিমান আটকে নিবি। আর সন্ধ্যাটাও তো বড় হয়েছে,ওর ছেলেমানুষিও কমবে।””

রাত তিয়ামতীকে নিজের বিছানায় বসালো। নিজেও পাশে বসে মায়ের দুটো হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে বললো,,

“” ভয় পাচ্ছো,আম্মু?””

তিয়ামতী নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চট করে দাড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ ইততস্ত করে বললো,,

“” ভয়? এখানে ভয় আসলো কি করে? আমি তো তোদের সংসার গুছিয়ে দিতে চাইছি। তোরা দুজনই ছেলেমানুষ,একজন আরেকজনের সাথে সারাক্ষন লড়াই করে যাচ্ছিস,যেটা তোরা নিজেরাও উপলব্ধি করতে পারছিসনা। বিয়ের নামে নাহয় সেই লড়াইটা প্রকাশ পাক।””

রাত তিয়ামতীর সামনে এসে দাড়ালো,ঠোঁটদুটো প্রসারিত করে ভরসা দিয়ে বললো,,

“” তুমি ভয় পেয়োনা আম্মু, যে কারণে বাবা তোমার থেকে দুরে সেই একি কারণে সন্ধ্যা আমার থেকে দুরে থাকতে পারবেনা। আমি থাকতে দিবোনা। কি হবে না হবে আমি জানিনা,তবে হ্যা এইটুকু জানি,আমার শেষ নিশ্বাসটা নেওয়ার জন্যও সন্ধ্যাকে আমার পাশে চায়,আমি তো শুধু ওর মুখে ভালোবাসিটা শুনতে চাচ্ছি। এই একটা শব্দ শোনার জন্যই আমি এখনো অপেক্ষা করে যাচ্ছি। ওকে বলতে হবে,নিজ থেকে,নিজ ইচ্ছায়। আমার ইচ্ছেতে নয়। আর যেদিন যে সময়ে এ চার অক্ষরের শব্দটা বলে উঠবে ঠিক সেদিনই ওকে তিন অক্ষরের শব্দ কবুল বলতে হবে। ভালোবাসি ওর ইচ্ছেতে বললেও কবুলটা আমার ইচ্ছেতেই হবে!””

রাতের বাক্যব্যয়ে তিয়ামতী বাকরুদ্ধ হয়ে রইলো। না সে বাবার ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছে আর না সে ছেলের ভালোবাসা। তবে এইটুকু ঠিক বুঝেছে,দুজনের ভেতরে চলে সবসময় অভুরন্ত ভালোবাসার তোলপাড়। তা যেকোনো সময় যেকোনো দিক ভাসিয়ে নিতে পারে বিধ্বস্তভাবে। একজন তো এতোই ভালোবাসে যে নিজের থেকে ভালোবাসার মানুষটিকেই তাড়িয়ে দিয়েছে,আর আরেকজন এতোই ভালোবাসে যে,২৪ ঘন্টা তার কাছে ঘুরঘুর করে, ভালোবাসার পাওয়ার জন্য ছটফট করে অথচ ভালোবাসিটা বলেনা।

~~
তিয়ামতীকে ওর রুমে শুয়িয়ে দিয়ে কম্বলটা পেরে দিলো রাত। লাইটটা নিভিয়ে বেড়িয়ে আসবে তখনি তিয়ামতীর প্রশ্ন,,

“” তুই কেন বলছিস না যে তুই ওকে ভালোবাসিস? এমন ও তো হতে পারে সন্ধ্যা চাইছে ভালোবাসি কথাটা তুই আগে বল!””

রাত দরজার কাছেই দাড়িয়ে বললো,,

“” কিভাবে বলবো? সুযোগটা দিচ্ছে কই? যখনি মনে হয় এবার হয়তো ও বড় হয়েছে ঠিক তখনি এমন এমন কান্ড করবে যে হয় আমি রেগে যাই আর নাহয় আমি ভেবে বসি ও এখনো বাচ্চা রয়ে গেছে। আর আমি তো ওর উপর রাগ দেখাতে চায়না। ওর প্রতি সবটা অনুভূতি ভালোবাসার হবে,রাগের নয়। আবার ভয় ও হয়,যদি ভাবে ওর বাচ্চামীর সুযোগ নিচ্ছি??””
“” তোর কাছে ও সারাজীবনই বাচ্চা থাকবে কেননা তোর ছায়াতেই তো ও একটু একটু করে বড় হচ্ছে। তবে ওর ভেতরে তোর প্রতি ভালোবাসাটা জন্মেছে বহু আগে। যেটা তুই টের পাসনি।””
“” মানে?””
“” আর কিছু বলা যাবেনা। পাগলিটা এমনি আমাকে মুখপাতলা উপাধি দিয়ে দিয়েছে।””

রাত তিয়ামতীর কাছে এলো। ওর মাথার কাছে বসে অস্থির হয়ে বললো,,

“” কি বলবেনা আম্মু?””
“” কিছুনা!””
“” আম্মু!””

রাতের মলিন মুখটা দেখে তিয়ামতীর মায়া হলো। রাতের নাক টেনে বললো,,

“” তুই যখন এমন মুখ করিস তখন তোকে আমার কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে ইচ্ছে করে। তুই যে কেন বড় হলি!””
“” আম্মু,বলোনা!””

তিয়ামতী মুচকি হেঁসে বললো,,

“” তোর সন্ধ্যা তোকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। কবে জানিস? যখন ওর বয়স ছয়!””
“” কেড়ে নিয়েছে? কি বলছো?””

তিয়ামতী রাতের পড়নের কালো-শার্টটাতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,,

“” এটা কে ইস্ত্রি করে রেখেছিলো? সন্ধ্যা। তুই ঘুম থেকে উঠলে সবসময় ব্রাশে পেস্ট লাগানো পাস,কে লাগিয়ে রাখে? আমি? উহু! তোর সন্ধ্যা রাখে। তোর রুমের প্রত্যেকটা জিনিস সন্ধ্যার হাতে গুছিয়ে রাখা,সকালে তোর স্পেশাল নাস্তাটাও ও বানায়। এমনকি আমাদের সব ময়লাকাপড় রিনা ধুলেও তোরটা কিন্তু ধুতে দেয়না,তাহলে কে ধোয়?””

রাত ঘোরের মধ্যেই উত্তর দিলো,,

“” সন্ধ্যা!””
“” হুম। এই যে ওর সাথে রেগে এটাওটা ভেঙে হাত-পা কাটিস,এগুলোতে ঔষুধ লাগায় কে? বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধালে তোর কপালে জল-পট্টি দেয় কে? তোর কি মনে হয় এগুলো আমি করি? সুযোগ পেলে তো! আমি শুরু করার আগে সন্ধ্যা শেষ করে ফেলে। আর এগুলো ও এখন থেকে নয় সেই ছোট্টবেলা থেকে করে আসছে, তোর ব্যাপারে যে এতোটা সিরিয়াস সে মেয়ে কিনা বাচ্চা? তুই যখন ওকে নিয়ে নালিশ করতে আসিস তখন তো আমি ভেবেই পায়না কোনটা বিশ্বাস করবো,যা আমি চোখে দেখছি নাকি যা তুই বলছিস!””

রাত বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। বিস্ময়ের মাঝে অবিশ্বাসটাও ক্ষীণ হয়ে উকি দিচ্ছে। কিন্তু মা হয়ে ছেলের কাছে কেন মিথ্যে বানিয়ে বলবে?? আর এগুলো যদি সত্যিই হয় তাহলে তার চোখে পড়েনি কেন? এতোটা বছর ধরে একি কাজ চলে আসছে লাগাতার ধরে এটা সে কি করে মিস করতে পারে?

রাতের মনে জেগে উঠা প্রশ্নের উত্তর দিলো তিয়ামতী,,

“” তুই যেমন তোর রাগটাকে লুকিয়ে রেখেছিস,ঠিক তেমনি সন্ধ্যাও তার ভালোবাসাটাকে লুকিয়ে রেখেছে। কেন রেখেছে তা আমি জানিনা।””

রাত চট করে উঠে দাড়ালো। মায়ের রুম থেকে বের হতে হতে বললো,,

“” আম্মু,আমার আর ভালোবাসি শোনা লাগবেনা। আমার এখন কবুল চায়। তুমি বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দাও!””

রাতের চলে যাওয়ার পানে তিয়ামতী হা করে তাকিয়ে রইলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here