ভালোবাসার রাত Season_2,পর্ব (১৬)

0
2491

ভালোবাসার রাত Season_2,পর্ব (১৬)
রোকসানা রাহমান

পেছন থেকে সন্ধ্যার কন্ঠ পেয়ে রাত একদম ভেঙে পড়েছে। পেছনে ঘুরেই সন্ধ্যাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ফুপিয়ে উঠলো। রাতের চোখের নোনা পানি সন্ধ্যার কাধের শেষাংশে গিয়ে পড়ছে। যা গড়িয়ে যাচ্ছে ওর পিঠ বেয়ে। সন্ধ্যা চোখটা বন্ধ করে আবার ডেকে উঠলো,,

“” রাত ভাইয়া!””

সন্ধ্যার ডাকে সাড়া না দিয়ে ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে রাত।

সন্ধ্যা কন্ঠ টেনে বললো,,

“” আমি সায়ন ভাইয়াকে বিয়ে করবো। আর সেটা কালকেই!””

রাত শ্বাসরুদ্ধ চুপ। নিজের কেঁপে উঠা ফুপানিটাও থমকে রেখেছে। সন্ধ্যার পিঠে লেগে থাকা হাতের বাধনটা আলগা করছে ধীরগতিতে। সেভাবেই কিছু সেকেন্ড নিজের মধ্যে চলা সব গতিপরিধি নিশ্চল,নিস্তম্ভ,স্তম্ভিত করে রেখেছে। রাতের এমন অসার হয়ে যাওয়াটা যেন বুঝতে পেরেছে সন্ধ্যা। গলার মধ্যে কাটা বিধে থাকার যন্ত্রণা হচ্ছে তার৷ চোখের কোনে পানি চিকচিক করতে চাইছে। কিন্তু সে দিলে তো। নাকদিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাসে বুকটা ভেতর-বাহির উঠানামা করিয়ে দৃঢ়কন্ঠে বললো,,

“” বিয়েটা আমি কালকেই করতে চাই। সায়ন ভাইয়ার সাথে তুমি কথা বলবে নাকি আমি?””

রাত আর সন্ধ্যার স্পর্শে ডুবে থাকতে পারছেনা। চোখের পানিটা এতক্ষণে নিজের বাধে আটকে পড়েছে। নিয়ন্ত্রণে কি এসেছে? নাকি সন্ধ্যার চোখে চোখ পড়লেই আবার তুমুলযুদ্ধে বাধ ভেঙে ফেলবে?? ভাঙলে ভাঙবে তবুও সে এখন সন্ধ্যার চোখে চোখ রাখবে। মেয়েটা চাইছে কি??

সন্ধ্যার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে রাত। চোখে নোনা তরলে টলমল,এখনো বাধটা ভাঙেনি,পুর্ণ চাঁদের স্নিগ্ধ জোসনা পুরোটাই পড়ছে সন্ধ্যার মুখে। রাতের অটলদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার সামর্থ্য করে উঠতে পারছেনা সন্ধ্যা। নিজের চঞ্চলদৃষ্টি স্থির করতে বড্ডবেশি বাধ্যবাধকতায় ভুগছে।

“” আমার দিকে তাকা!””

রাতের ভারীকন্ঠস্বর সন্ধ্যার কানে নয়,বুকে শীতল ঝড় বয়িয়ে দিয়েছে। মানুষটাকে সে ছোট্টবেলা থেকে দেখে এসেছে,কখনো এমন করুণরুপী নয়। সবসময় হাঁসিমুখি,নাহয় চরম ছটফটানি। ছটফটানিটা তো তারজন্যই ছিলো। মাঝে মাঝে অভিমানির কৃশ ফিনফিনে ছায়াও সে চোখে ঠাউর করতে পেরেছিলো তবে সেটা নামমাত্রই। রাত কখনোই তা সন্ধ্যাকে বুঝতে দেয়নি। সেই মানুষটা আজ তার বুকে ঢলে পড়তে চাচ্ছে,চাপাকষ্টের নোনাপানি তার স্পর্শে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে অথচ সে?? সে কিনা নোনাপানির তিক্ততাকে প্রকট করে তুলেছে??

সন্ধ্যা এদিকওদিকে বিক্ষিপ্ত চাহনি নিয়ে বললো,,

“”আমি ছেলেমানুষি করছিনা রাত ভাইয়া। আঠারোবছরের যুবতী হয়ে কাকে বিয়ে করবো সে অধিকারটুকু আমার আছে। তোমারও তো তাই ইচ্ছে ছিলো। এখন আমারও সেই ইচ্ছে।””

সন্ধ্যা রাতের দিকে তাকালে ঠিক বুঝতো রাতের চোখে নোনাপানির বদলে অনল ঝড়ে পড়ছে। তবে সেই অনলের তেজটা খুবই ক্ষীণ। এই অনল তো তার তেজ পুরোটা রাতের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছে। রাত সন্ধ্যার মুখবিবর চেপে ধরেছে। সাথে সাথে সন্ধ্যা নিজের চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো। ডান হাত-বাহাত দু হাতেই পড়নের জামাটা খামচে আছে। রাত ওর বন্ধচোখের দিকে তাকিয়ে বললো,,

“” রুমে যা।””
“” তুমি যাবেনা?””

সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেনা রাত। কথা পেট ছেড়ে গলা বেয়ে আসছেনা। কন্ঠনালীটা কি তার অকেজো হয়ে পড়েছে?? হলেই তো ভালো। আজকাল খুব বেশিই বেড়ে উঠেছে তার কন্ঠনালী। নাহলে মায়ের সাথে সে কিভাবে চড়াগলায় চিৎকার করে উঠেছিলো?? যে ছেলে মায়ের সাথে এমন রূঢ়ভাবে কথা বলতে পারে তার কন্ঠনালী তাৎক্ষনিকভাবে ছিড়ে হাজার টুকরো হয়ে যাওয়া উচিত। তারটা কি এমনই হয়েছে?? নাহলে সে করে নিবে। কিন্তু কিভাবে??

“” আমার রুমে যেতে ভয় লাগছে। আমাকে একটু দিয়ে আসোনা!””
“” আসতে ভয় নেই যেতে ভয়??””

নিজের কন্ঠে নিজেই চম্কিত রাত। গলার স্বরটা এতোটা পাল্টে গিয়েছে কিভাবে??

“” রাত ভাইয়া,আমার ঘুম পাচ্ছে।””
“” তোকে ঘুমাতে মানা করেছে কে? যা গিয়ে শুয়ে পড়।””
“” বললাম যে ভয় লাগছে।””
“” তাহলে এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঘুমা!””

এমন শক্তকথা তো রাত তার সন্ধ্যাকে বলেনা। তাহলে কি এবার বুকটা খুব বেশি ক্ষত হয়ে গিয়েছে?? রেগে গিয়ে বলেছে নাকি অভিমানে??

বেশ কয়েক মিনিট পেরিয়ে গিয়েছে। রাত উল্টোঘুরে পিনপতন নিরবতায় মিশে যাচ্ছে,মাঝরাতের মৃদু বাতাসের ঝাপটা পড়ছে পুরো শরীরে। কেমন এক ঠান্ডা অনুভূতি। চাঁদের আলোয় রজনীর অন্ধকারের সাথে মিশে গিয়ে সাদাকালোর হাঁট বসিয়েছে। সে হাঁটে কি সে একাই ক্রেতা? তাহলে বিক্রেতা কে? নাকি সে নিজেই ক্রেতা ও বিক্রেতার দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু কেনাবেচা হচ্ছে কি? চাঁদের আলো,নাকি সাদাকালো কষ্ট!

বাতাসের মৃদু বাতাসটা এখন অনেকটাই মচমচে হয়ে উঠেছে। ছাদের পাশেই আমগাছের পাতাগুলোর মড়মড়ে শব্দে রাতের কেনাবেচা বন্ধ। সন্ধ্যা কি চলে গিয়েছে?? রাত পাশ ফিরেই ফিক করে হেঁসে উঠে,,

“” পাগলিটা দেখি সত্যি সত্যি দাড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।””

রাত আর সময় নষ্ট করলোনা। কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিলো। সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে। ছাদে তার যাতায়াত খুব কম। খোলা আকাশের সৌন্দর্য সে নিজের বারান্দা থেকেই উপভোগ করে। কিন্তু যখন মনে হয় বারান্দার স্বল্প আয়তায় বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারছেনা তখনি ছাদে আসা হয়। সবার অগোচরে। তবে সে না চাইতেও তার পিছু পিছু সন্ধ্যার আগমন ঘটবেই। এই একটা কাজে রাত আজো অনভিজ্ঞ। এতকিছু সন্ধ্যার অগোচরে ঘটিয়ে আসছে অথচ ছাদযাত্রাটা সে কিছুতেই পারেনা।

রাত সন্ধ্যার ঘুমশ্রী মুখটার দিকে চেয়ে নিচুস্বরে বললো,,

“” এবার অন্যবারের মতো আমাকে বিরক্ত করতে আসিসনি। তাহলে কেন এসেছিলি? হৃদয়ক্ষরণ করতে??””

সন্ধ্যাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়েছে রাত। ফ্যানের সুইচটা অন করে,ড্রিমলাইটটাও জ্বালিয়ে দিয়েছে। রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলেও মনটা সায় দিচ্ছেনা। আঁখিটা চাইছে সন্ধ্যার ঘুমশ্রী আরেকটুখানি আঁখিবরণ করতে। রাত চরণ ফেলে সন্ধ্যার কাছে এগিয়ে এসেছে। মেঝেতে হাটু ভর করে বসলো। আজ এতো পিপাসা পাচ্ছে কেন রে স্বপ্নবধু?? নিজের ডানহাতটা সন্ধ্যার ললাটস্থলে স্পর্শ করতেই ও নড়ে উঠেছে। রাতের হাতটা টেনে নিচ্ছে সন্ধ্যা। গালস্পর্শে মেখে নিয়ে আবার গভীরঘুমের নিশ্বাস ছাড়ছে। রাতের ভিজে উঠা চোখটাকে স্বাভাবিকে আনতে চোখটা বন্ধ করে নিয়েছে,সাথে সাথে কল্পনার কচুবাক্য,

“” আমি সায়ন ভাইয়াকে বিয়ে করবো। আর সেটা কালকেই।””

রাত চট করে চোখের পাতার ঝাপটা খুলে ফেললো। কোনো ভাবনান্তরে না ঢুকে নিজের হাতটা হেচকা টানে সরিয়ে নিয়েছে। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পুর্বেই পা বাকিয়ে হাঁটা ধরলো।

~~

কথায় কথায় ভালোবাসি শব্দটা যেমন গতিতে ঝড়ের মতো পাহাড়ের চূড়ে উঠে, ঠিক তেমনি আবার মাটিতেও চলে আসে। উঠার কাজটা চলে পুর্ণ বয়সে আর নামার কাজটা চলে ঠিক তেমন গতিতেই পুর্ণতার ভার মানে বুড়ো বয়সে। এই বয়সটাই ভালোবাসি,চুমু দেওয়া,শরীরের স্পর্শ,বিভিন্ন অবাস্তব কথাতে প্রেম জাগেনা। অভ্যাসে জাগে। এই যেমন এখন রিমা সিকান্দার সাহেবের চোখের চশমাটা খুলে দিয়ে শরীরে চাদরটা ঠিকভাবে মেলে দিবে,তারপর নিজেও বালিশের ছোট্ট জায়গা দখলে মাথাটা রাখবে। এটা তার রোজ রাতের অভ্যাস। এখানেই তার প্রেম জাগে। একদিনও যদি সে এটা মিস করে তবে মনে হয় তার রাতের ঘুম হারাম। অথচ কাঁচা বয়সে স্বামীর জলদি ঘুমের জন্য কত রাতই না ঝগড়া করে পার করেছে! আর এখন? এখন সে চশমা খুলে দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে।

রিমা সিকান্দার সাহেবের চশমায় স্পর্শ করতেই উনি নড়ে উঠলেন। বন্ধ চোখটাও খুলে গিয়েছে। তবে এতে রিমার দোষ নেই। দরজায় কড়া পড়ার দোষ। রিমা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তিনটা বেজে পঁচিশ। ঘড়ি ছেড়ে সিকান্দার সাহেবের দিকে তাকালেন। দুজনেই চোখাচোখিতে ইশারায় ভাবছেন,এতো রাতে কে??

“” রাত,তোমার কি মাথায় সমস্যা হয়েছে? আই মিন মাথায় কোনো আঘাত পেয়েছিলে?””

সিকান্দার সাহেবের কথায় রাতের কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। মুখের ভাবে বুঝা যাচ্ছে,সে জানতো এমনি হবে। এতে বেশ নিরাশ হলেন সিকান্দার সাহেব। পাশ থেকে রিমা এসে রাতকে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। স্নেহের হাতস্পর্শে বললেন,,,

“” তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন,বাবা? কিছু হলে আমাদের খুলে বল। জানিসনা,সন্ধ্যার মতো তোর কষ্টেও আমার বুক পুড়ে?””

রাতের স্থির দৃষ্টি মেঝেতে। নতজানু অবস্থায় নিচু স্বরে বললো,,

“” ফুপা,সবসময় তো আমার ইচ্ছেতেই সন্ধ্যার পথচলা,এবার নাহয়…””

সিকান্দার সাহেব হুংকার করে উঠলেন,,,

“” তাই বলে নিজের বিয়ে নিজেই ঠিক করে ফেলবে? বেশি বেড়ে গিয়েছে মেয়েটা। গালে দুটো সটাং সটাং পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে। আর সেটা তোমার হাত থেকে হলেই বেশি মানাত। দাড়াও ওর মাথা থেকে বাড়াবাড়ির ভুতটা এখনি নামিয়ে আসছি।””

সিকান্দার সাহেব রাতের কোনো ইশারা তোয়াক্কা না করেই হাঁটা ধরলেন। দরজার ধারে পৌছুতেই রাতের অনুরোধের সুর,,,

“” ফুপা প্লিজ! একটু শান্ত হোন।””

সিকান্দার সাহেব থামলেন,তবে ক্ষান্ত হলেননা। বুকে চলছে তখনো রাগের খুলকি। রাত বিছানা ছেড়ে ফুপার কাছে এসে বললো,,

“” সায়ন বর্তমানে সরকারীর দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন কর্মকর্তা। বেতন বেশ ভালো। প্রথম শ্রেণীতে যাওয়ার তোরজোর চলছে। হয়তো খুব শিঘ্রই চলেও যাবে। দেখতে শুনতেও বেশ ভালো। সেটা তোমরাও জানো। আর সবথেকে বড় কথা সায়ন সন্ধ্যাকে খুব পছন্দ করে আর সন্ধ্যা…””
“” তোকে ভালোবাসে।””

সিকান্দার সাহের রাতকে সবসময় তুমি সম্বোধন করলেও অতিরিক্ত রেগে গেলে তুইতে চলে যান। এটা রাতের জানা। তাই সে খুব ভালো করেই উনার রাগের গভীরতা মেপে নিয়েছে। নিজের কথাটা ওভাবে ছিনিয়ে নেওয়াতে রাগের খারাপ লাগেনি কিন্তু শেষাংশ ছিলো খুবই ক্ষতপুর্ণ। রাতও চোখের পলকের মতো উত্তর দিলো,,

“” ও আমাকে কখনোই বলেনি। তোমাদেরকেও বলেনি। তোমরা আমার দিকটা ভেবেই এমন ভেবে নিয়েছো।””
“” সায়নকে ভালোবাসে এটা নিশ্চয় বলেছে?””

সিকান্দার সাহেবের তাচ্ছিল্য প্রশ্নে রাত নিরব।

“” কি হলো বলেনি?””
“” বিয়ে করবে বলেছে।””
“” বাহ! খুব ভালো। ও বললো আর তুই বিয়ে দিবি বলে প্রতিজ্ঞাও করে ফেললি। আমাদেরকেও মানাতে চলে এসেছিস। অথচ কিছুদিন আগেও তুই ওর ছেলেমানুষিতে বিরক্ত হতি। তাহলে আজ কেন এতো সিরিয়াস দেখাচ্ছিস?””
“” কারণ এবার ওর চাওয়াতে কিছু ছিলো ফুপা। এটা ওর হুটহাট ভাবনা থেকে আসেনি। আমি ওর মুখ দেখেই বুঝেছি ও এই ব্যাপারে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে তবেই এই সিদ্ধান্তে এসেছে। ফুপা এটা ওর বাচ্চামী নয়!””
“” রাত আমি এই বিয়েতে সম্মতি দিবোনা।””
“” কেন দিবেনা?””
“” তুমি কি আমার কাছে কৈফত চাচ্ছো?””
“” না,ফুপা। অপরাধ নিচ্ছেন কেন? আমি কারণটা জানতে চাচ্ছি!””
“” আমি দিতে বাধ্য নই।””

ফুপার এমন কঠিন আচরণে বেশ অবাক হচ্ছে রাত। এই মানুষটার সরলতা সবসময় রাতকে ভাবিয়েছিলো। কিন্তু আজ এমন কঠিনরুপ বড্ড বেমানান ঠেকছে তার কাছে। রিমা সিকান্দার সাহেবের দিকে কিছু বলবে ভেবে এগুতেই উনি বলে উঠলেন,,

“” আমার মেয়ে,আমার ইচ্ছে। এখানে অন্যকারো হস্তক্ষেপ আমি মেনে নিবোনা।””

রাত চুপচাপ বেরিয়ে আসতে গিয়েও আবার থমকে গেলো। কিছুটা জোর নিয়েই বললো,,

“” আপনার মেয়ে বলেই আপনার কাছে অনুমোতি চেয়েছিলাম। বিয়ে তো হবেই। হোক সেটা বাড়ি অথবা কাজী অফিসে! আমিও দেখি কে আটকাতে আসে।””

রাত দ্রুতপদে চলে যেতেই রিমা শব্দ করে হেঁসে উঠলো। এতে সিকান্দার সাহেব বেশ বিরক্ত নিয়েই বললেন,

“” সেদিনের জন্ম নেওয়া পুচকি ছেলে আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি শাসিয়ে গেলো আর তুমি হাঁসছো?””

সিকান্দার সাহেব যেন দারুন একটা জোকস বললেন এমন ভাবসাবেই রিমা হাঁসিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা।

“” সমস্যা কি তোমার?””
“” আমার ভাইয়ের সামনে গেলে তো তোমার হাঁটু কাঁপতো। আর তার ছেলের সামনে তোমার অদৃশ্য কাপুনি দেখেইতো হাঁসি পেল।””
“” আমি কাঁপলাম?””
“” এখনো তো কাঁপছো। এইযে নাকটা কেমন নড়েচড়ে উঠছে দেখ। বিশ্বাস নাহলে তুমি আয়নায় গিয়ে দেখতে পারো।””

সিকান্দার সাহেব সত্যি সত্যি আয়নার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে নাক খুটিয়ে দেখছে। রিমা আরেকদফা হেঁসে নিয়ে বললো,,

“”রাতের সাথে ভাব দেখাতে যেয়োনা। ওর কাজে তো বাধা দিতে পারবেনা শুধু শুধু উচু নাকটা নিচু হবে।””
“” সন্ধ্যাকে অন্য ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিবে আর আমি চুপ করে বসে থাকবো?””

রিমা রহস্যময়ী হাঁসি দিয়ে বললো,,

“” ভুলে যেওনা, রিদ ভাইয়ার ছেলে ও। দেখবে সন্ধ্যা চোখবুঝবে একজনকে দেখে,আর চোখ খুলে দেখবে আরেকজনকে!””

~~

দাদুর বালিশের নিচ থেকে নিঃশব্দে আলমারীর চাবিটা নিয়েছে রাত। আলমারীর ভেতরের ড্রয়ারটা খুলতেই চোখটা ঝলমলিয়ে উঠেছে। ড্রয়ারভর্তি এলোমেলো টাকা জমা পড়ে আছে,১ টাকার কয়েন থেকে শুরু করে হাজার টাকার নোটও আছে এতে। ড্রয়ারটা খুলে নিয়ে মেঝেতে বসে পড়েছে রাত। দাদুর দিকে তাকালো,লাইট জ্বালাবে ভেবেও ইচ্ছা বাদ। নিজের ফোনের লাইটটা জ্বালিয়ে নিয়েছে। বেশ আরাম করে বসে এলোমেলো টাকাগুলোকে সাজিয়ে নিচ্ছে পরপর। অন্যের টাকা নয় এগুলো,রাতের টাকা!হ্যা রাতের টাকা। দাদুর কাছে সে জমিয়েছিলো।

ছোটবেলা একবার এক বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলো রাতের পুরো ফ্যামিলি। বরাবরের মতো সন্ধ্যা রাতের হাতধরেই বিয়ের সাজ উপভোগ করছিলো,হঠাৎ সন্ধ্যা বলে উঠলো,,

“” রাত ভাইয়া,ঐ সাপ কাপড়টা আমারও চাই।””

রাত বিস্ময় নিয়ে বললো,,,

“” সাপ কাপড় কি?”

সন্ধ্যাও রাতের বিস্ময় কাটাতে বিয়ের কনের দিকে আঙুল ইশারায় বললো,,

“” ঐ যে ঐ আন্টিটাকে লাল সাপের মতো পেচিয়ে রেখেছে যে, ঐ কাপড়টা!””

রাত একগাল হেঁসে বলেছিলো,,

“” এটাকে বেনারশী বলে।””
“” যা খুশি তাই বলুক। সাপের মতো পেচিয়ে থাকে বলে সাপ কাপড়। তুমি এখন আমাকে কিনে দিবে নাকি বলো।””
“” আমার কাছে তো এখন টাকা নেই। বাড়ি যাই তারপর আম্মুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনে দিবো।””

রাতের মন খারাপকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে সন্ধ্যা ঠোঁট উল্টিয়ে কান্না করে দিলো। অভিমানভর্তি মুখে বললো,,,

“” আমি চাইলে তোমার কাছে থাকেনা। লাগবে না আমার কিছু। থাকিনা তোমার সাথে,যাও।””

সন্ধ্যার রাগ ভাঙাতে আম্মুকে নিয়ে শাড়ী কিনেওছিলো রাত। কিন্তু সন্ধ্যা অভিমান দেখিয়ে সেটা আর নেয়নি। সেদিনের পর থেকে রাত সবসময় পকেটভর্তি টাকা রেখেছে কিন্তু কখনো প্রয়োজন পড়েনি।

রাত টাকাগুলো চোখের সামনে ধরে মনে মনে বললো,বিয়ে যেভাবেই হোক। তোকে তোর সাপ কাপড়ে পেচিয়েই কনে সাজাবো!

~~

রাতকে থাপ্পড় মারার পর থেকে তিয়ামতী এক অস্থিরতায় ভুগছে,সাথে চাপা কষ্টে বুক ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে। চোখে অন্ধকার নেমে আসার মতো। রাত শেষ হতে চললো অথচ অস্থিরতা কাটিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে পারছেনা সে। এ কেমন যন্ত্রণা?

তিয়ামতী বুকের হাসফাস কমাতে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নিলো। চোখে ঘুমের আধার নেমে আসতেই চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যেতেই তীক্ষ্ণ ভুরররররর ভুররররর শব্দ কানে বাজছে। এমন তীব্র সব্দে তিয়ামতী বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। শব্দানুসারে পা চালিয়ে রান্নাঘরে এগুচ্ছে। অন্ধকারে কারো ছায়া দেখে তার চমকানো উচিত,কিন্তু সে ভয়ে চিৎকার না করে স্বাভাবিক গলায় বললো,,

“” লিদ ভাইয়া?””

তিয়ামতীর ডাকে রিদ ব্লেন্ডারের শব্দ বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকনা খুলে একটা গ্লাস নিয়ে তাতে তরল কিছু ঢাললো। তিয়ামতী কয়েক কদম এগিয়ে এসে বললো,,

“” তুমি কি করছো?””

রিদের ব্যস্ত গলার উত্তর,,

“”সরবত বানাচ্ছি।””
“” সরবত?””
“” হুম,তোর ফেলে দেওয়া ঔষধের সরবত!””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here