ভালোবাসার রাত Season_2,পর্ব (১৮)

0
2560

ভালোবাসার রাত Season_2,পর্ব (১৮)
রোকসানা রাহমান

সন্ধ্যা নিজের লজ্জাদৃষ্টি রাতের দিকে ফেলতে পারছেনা। মাথাটা কিছুটা সামনে নামিয়ে মেঝেতে দৃষ্টিপাত! নিচুস্বরে রাতকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর কাধে বিছিয়ে থাকা শাড়ীর আঁচলে হাত পড়েছে রাতের। আমচকা টানে শাড়ীর আঁচল নিচে ফেলে দিলো!

সন্ধ্যা অবাক হওয়ার সময়টুকু না নিয়ে নিজের দুহাত বুকের উপর আড়াআড়ি পেতে বললো,,

“” রাত ভাইয়া! কি করলে এটা?””

সন্ধ্যার নিচুস্বরের প্রশ্ন আগলে রাখেনি রাতের কর্নদ্বয়,বাতাসে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। সন্ধ্যার বুজে আসাদৃষ্টিতে নিজের আনমনা দৃষ্টির ভাব বিনিময় করার মাঝেই নিচু হয়ে বসেছে। বা-হাতে সন্ধ্যার কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিলো। সন্ধ্যা থমকে থাকা বলপ্রয়োগে বললো,,

“” কি করছো?””

সন্ধ্যার টেনে আসা সুরের প্রশ্নে রাত চুপ। গভীর নয়ন তখন সন্ধ্যার পেটে। হলদে পেটটাতে নিজের ডান হাতের পাঁচআঙুল বিছিয়ে নিয়েছে। হাতে লেগে থাকা সবটা হলুদ মেখে যাচ্ছে। নদীর আঁকাবাকা পানির স্রোতের মতো রাতের হাতও বয়ে যাচ্ছে। ধীরগতিতে পেটের নাভীমূল ছেড়ে গলায় এসে থমকে গেলো।

সন্ধ্যার বন্ধ চোখের পাতা কাঁপছে,নাকের পাতার সাথে শুকনো হলদে ঠোঁটজোড়াও কাঁপছে। গাঢ় টানের ঘন শ্বাস নেওয়াই গলার বিউটি হাড়ের মধ্যবর্তী গভীর গর্ত সৃষ্টি হচ্ছে। এই গভীর গর্ত তো এই ভরা গর্ত। রাত বেশ কিছুক্ষণ গভীর গর্ত আর ভরা গর্ত উপভোগ করলো। রাতের বা-হাতে ভর ছেড়ে দিয়েই সন্ধ্যা অনেকটা ধনুকের ন্যায় পিছনে ঝুকে আছে। বুকের বিস্তৃতি ঢাকার জন্য ব্যবহৃত হাতের আড়াআড়ি বেড়াজাল খসে গিছে অনেক আগেই। দুপাশে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে।

সন্ধ্যাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরতেই ও দুহাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো রাতের শরীরটাকে। শক্তবাধনে বেধে নিয়ে হারিয়ে যাওয়ার প্রবল উত্তেজনা!

আমি চাইলেই এখন তোকে নিয়ে হারিয়ে যেতে পারি রাতের উষ্মামহলে। আমাকে বাধা দেওয়ার বিন্দুমাত্র শক্তিটুকুও তোর মধ্যে বেঁচে নেই। কিন্তু তা আমি চাইনা,কখনো চাইনি। যদি চাইতাম তাহলে অনেক আগেই অনেক কিছু হতে পারতো আমাদের মধ্যে। কিন্তু আমার তো ইচ্ছে ছিলো এক পবিত্র চাওয়ার,পবিত্র বন্ধনের। তার অপেক্ষায় আমি প্রহর গুনছিলাম। কিন্তু!

রাতের মনে চলা ভাবনার রাজ্যে বাধা দিতেই সন্ধ্যা ওকে আরো জোরে চেপে ধরলো। এক নতুন অনুভূতির ছোয়া পাওয়ার জন্য ছটফটি নিশ্বাস তার। নিশ্বাসের স্পষ্ট শব্দ রাতের কানে বাজছে।

রাত দুহাতে সন্ধ্যার মাথার দুধারে চুলের উপর চেপে ধরলো। মুখটা বুক থেকে ছাড়িয়ে একটু বাকা করা। আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম,আমার ভালোবাসার স্পর্শ তোকে কতটা ঘায়েল করতে পারে। তুইতো পুরোপুরি নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিস স্বপ্নবধু,এর দুটো কারণ হতে পারে। এক. আমার ভালোবাসার স্পর্শ তোর খুব গভীরে গিয়ে ছুয়েছে আর দুই. আমিই প্রথম পুরুষ যে তোকে এভাবে ছুয়েছে!

“” তোর যে শ্বাসকষ্ট আছে,এটাতো আগে চোখে পড়েনি!””

রাতের তীক্ষ্ণ কন্ঠে সন্ধ্যা চট করে চোখ মেলে। তার সাথে কি হয়েছে,কি হতে চলেছে,কিই বা হচ্ছে তাই বুঝার চেষ্টা করছে। সন্ধ্যার ফ্যালফ্যাল চাহনি দেখে রাত কিছটাু বিদ্রুপসুরে বললো,,

“” তুই ও কি শ্বাসকষ্টরোগি? এভাবে টেনে টেনে নিশ্বাস নিচ্ছিলি যে?? চারপাশেতো অক্সিজেনের অভাব নেই,তাও তোর এতো কম পড়লো? সবারটা তুই একাই টেনে নিচ্ছিস!””

রাতের কথা সন্ধ্যার মাথায় ঢুকছেনা। মনে হচ্ছে সে মাত্রঘুম থেকে উঠেছে,এক ভয়ংকর স্বপ্নতে ডুবে ছিলো।

“” দেখি শাড়ীটা একটু উপরে তোল তো। তোর পায়ে এখনো হলুদ লাগানো বাকি। শেষেতো আমাকেই দোষ দিয়ে বলবি,রাত ভাইয়া তুমি এতো কিপটে কেন? একটুখানি হলুদ মাখলে,ধোয়ার আগেই শেষ। তোর এইসব কুটনীতিবাদ কথাতে আমি নেই। নে নে শাড়ীটা উপরে তোল!””

রাতের তাড়া দেওয়া কন্ঠে সন্ধ্যার উগ্র চাহনি। মেঝেতে চোখ পড়তেই শাড়ীর আঁচলে আটকে গেলো। আঁচল কাধে না থেকে মাটিতে কি করছে? দ্রুত ভাবনাতে সবটা ঝকঝকা আয়নার মতো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। সাথে সাথে লজ্জার আবরণে জড়িয়ে পড়ছে। রাতের দিকে তাকানোর শক্তিটাও সে হারিয়ে ফেলেছে। ইশ! কি লজ্জা! রাত ভাইয়া আমার সব সরম দেখে ফেলেছে নাকি?? আমিও কি মুভির হিরোইনদের মতো শ্বাসকষ্টে ভুগছিলাম?? সন্ধ্যা এই মরণ লজ্জা থেকে বাঁচার উপায় খুজছে। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে পেছনঘুরে দৌড় দিতেই রাতের হাতে বাধা পড়লো।

“” হলুদপর্ব শেষ না করেই পালাচ্ছিস?””

সন্ধ্যার গলায় কথা আটকে আছে। ভেতরেও ঢুকছেনা বাইরেও আসছেনা। এ কেমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো সে?? না পারছে চুপ করে থাকতে না পারছে কিছু বলতে! সন্ধ্যা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। রাত ওর হাতটা ছেড়ে দিলো। কাছে এগিয়ে এসে আঁচল কুড়িয়ে কাধে রাখতে রাখতে বলছে,,

“” শক্ত হতে শেখ,নিজেকে নিজের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখ । তোর সবটাতে শুধু তোর স্বামীর অধিকার। মনে রাখিস,তোর হাতের নখস্পর্শটাও যেন তোর স্বামীর ছোয়াই হয়। একমাত্র তার ছোয়াতেই লজ্জায় লাল হবি অন্যকারো ছোয়াতে নয়। অন্যদের জন্য লজ্জায় লাল নয়,রাগে লাল হবি। আর সেই অন্যদের মাঝে আমিও পড়ি!””
“” সায়নরা কাল কখন আসবে?””

সন্ধ্যার আকস্মিক প্রশ্নে রাত থমকে গেলো। না রাত নয়,তার আশেপাশের সব প্রাণগুলো থমকে গিয়েছে,শুধু জড়বস্তুগুলো জীবন্ত। যারা তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। রাত থমকে যাওয়াসুরেই বললো,,,

“” জুমু’আর নামাজের পর রওনা দিবে।””
“” ওহ!””

সন্ধ্যা ছোট্ট শব্দটা প্রয়োগ করে পা চালালো সিড়ির দিকে। তার আর হলুদপর্ব শেষ করা হলোনা।

থমকে যাওয়াটা রাত ঠিক বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। মিনিটখানি পার হতেই সে অস্থির হয়ে উঠে,বুকের ভেতরের চাপা ব্যর্থতার আর্তনাদটা প্রবল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এই অসহ্য যন্ত্রণা ভেতরে আটকে রাখতে ব্যর্থ সে। দু-হাত দুদিকে ছড়িয়ে দুনিয়া কাঁপানো চিৎকারে ফেটে পড়ে। তার গলা ছাড়া চিৎকারে কি পৃথিবী কেঁপে ভুমিকম্প হয়ে গেলো? সেই কম্পন কি সন্ধ্যাকে নাড়িয়ে দেয়নি?? শুনতে পায়নি সে রাতের ব্যর্থতার আর্তনাদ???

সখী বুঝলিনা তুই,,,,
বুকের ভেতর গেঁথে দিলি যাতনার সুই,,,,

~~

আজকাল সায়ন চোখের পাতা বন্ধ করতে ভয় পায়। কেমন এক ভয়-ভীতি কাজ করে তার মনের ভেতর। চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছে রাত ওর গলা টিপে ধরেছে,নাহয় নাকে বালিশ চেপে ধরে আছে। সব ভয়-ভাতি পার করে যখন ঘুমিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনি সে ভয়ংকর স্বপ্নে ধরফরিয়ে উঠছে। স্বপ্নেও সে রাতের গন্ধ পায়। এখনো পাচ্ছে। রাতের গন্ধ মানেই তীব্র ভয়ংকর কিছু ঘটা। গন্ধে গভীর ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে সায়নের। চোখ বন্ধ করে কানখাড়া করতেই খচখচ শব্দ। সায়ন আর চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে পারছেনা। এদিকে ভয়ে চোখটা মেলতেও পারছেনা। ভয়ে শিউরে উঠছে,চোখ মেললেই যদি পেটে ছুরি চালিয়ে দেয়??

সায়নের মাথায় চলা হাজারও চিন্তাভাবনার রেশ কাটিয়ে হালকা করে চোখ মেলে পাশ ফিরলো।

“” অতিরিক্ত টেনশনে তুই করিস?””

রাতের প্রশ্নে সায়ন পুরো চোখ মেলে থ হয়ে রয়েছে। মুখটা থ হলেও ঘাড়টা হয়নি। রাতের অস্থিরতায় চলতে থাকা পা দুটো রুমের এপাশওপাশ ছুটে বেড়াচ্ছে। সে সাথে সায়নের ঘাড়টাও একবার এপাশ তো আরেকবার অপাশ ঘুরছে। রাত নিজের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আরো দু/এক রাউন্ড পায়চারী পর্ব শেষ করে এসে পুনরায় বললো,,

“” অতিরিক্ত টেনশনে তুই কি করিস?””
“” সিগরেট খাই!””

সায়নের দিক থেকে উত্তর পাওয়ার সাথে সাথে রাত ওর উপর হামলে পড়ে,সায়ন আকুলকন্ঠে লাগাতার বলে যাচ্ছে,,

“” ভাই,আমি এখনি মরতে চাইনা,ছেড়ে দে। আমি ভুলেও তোর বাড়িমুখো হবোনা।””
“” সিগরেট কোথায় রেখেছিস?””

রাতের অশান্ত কন্ঠে সায়ন নিজের ভুল ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিলো। রাততো ওকে মারতে নয়,ওর প্যান্টের পকেট হাতড়াচ্ছিলো সিগরেটের জন্য। সায়ন সহজ গলায় বললো,,

“” আমি সিগরেট বাসায় খাইনা,তুই জানিসনা?””
“” তুই খাসনা সেটা তোর সমস্যা। আমি খাবো। এক্ষুনি ব্যবস্থা কর নাহলে তোর পেছনে আগুন জ্বালিয়ে তোকেই খাওয়া শুরু করবো!””

জ্বলন্ত সিগরেট দুঠোঁটের মাঝে ধরে আছে রাত। ভেতরে ধোয়া টেনে নিতেই শরীর কাঁপিয়ে খকখক করে উঠলো। মুখের সিগরেট নিচে পড়ে গিয়েছে। সায়ন দৌড়ে এসে বললো,,

“” যেটা তোর কর্ম নয়,সেটা না করলেই কি নয়?””
“” তুই কি আমাকে উপদেশ দিচ্ছিস?””
“” উহু! এমনি বললাম।””
“” তুই আমার সন্ধ্যাকে ছুবি? এটা আমি কি করে সহ্য করবো বলতো?””
“” আচ্ছা ছুবোনা।””

সায়নের দ্রুত উত্তরে রাত ওর গলা টিপে ধরে বললো,,

“” কেন ছুবিনা? ও তোর বউ হবে,তুই ওর বর হবি,তাহলে কেন ছুবিনা?””
“” তুই বাঁচতে দিলে ছুবো!””

রাত গলা ছেড়ে আবার অসহায় গলায় বললো,,

“” আমি ওকে না দেখে কিভাবে বাঁচবো?””
“”তোর যখন দেখতে ইচ্ছে হবে তখনি আমাদের বাসায় চলে আসিস,আমার কোনো আপত্তি নেই!””

রাত অগ্নিনিক্ষেপ করতেই সায়ন আধোভাঙা গলায় বললো,,

“” না মানে,আমার বাসা আর তোর বাসা তো একি জায়গায়,১০ মিনিটের দূরত্ব! তাই মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছে।””

রাত পলক ফেলে সায়নের দিকে চেয়ে থাকে। বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চাই দীর্ঘশ্বাস! দীর্ঘশ্বাসটা আর আটকে রাখতে পারলোনা,মুক্তবাতাসে ছেড়ে দিয়ে বললো,,

“” সন্ধ্যার স্বামী হিসেবে ওকে ভালোবাসার পুর্ণঅধিকার তুই পাবি,এতে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। তবে হ্যা ব্যথা তো এক জায়গায় আছে সেটা হলো ওর চোখের পানিতে। ওকে কষ্ট দেওয়ার চিমটিখানি অধিকারও তোর নেই,আমি তোকে দিবোনা। আর আমি না দিলে সেটা তুই নিতে পারবিনা এটাও নিশ্চয় তোর জানা আছে?””
“” হুম!””

~~

রাতের দেওয়া বেনারশীটাই পড়েছে সন্ধ্যা। ভালো লাগছে নাকি খারাপ লাগছে বুঝে উঠতে পারছেনা। তবে এক অদ্ভুত মন খারাপে ছেয়ে আছে তার পুরো শরীর। নাকে নোলক,কানে দুল,গলায় গয়না,সিথীতে টিকলি,হাতে ঝনঝন ভারী চুড়ি সাথে ভারী মেকাপ,কোনোকিছুই বাদ নেই। তবুও বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা খালি আছে যার কারণে তাকে বউবউ লাগছেনা৷ মনের এই খুতখুতুনি নিয়ে বারবার আয়নায় নিজেকে পরখ করছে সন্ধ্যা।

“” তোকে তো একদম পুতুলবউ লাগছে রে সন্ধ্যা!””

দিয়ার কন্ঠ পেয়ে সন্ধ্যার মেজাজ চরকগাছ।

“” তুই এখানে?””
“” বারে,তোর বিয়ে আর আমি আসবোনা? তুই বলতে ভুলে গেলে কি হবে? তোর রাত ভাইয়ার তো ঠিক মনে আছে। উনি তো আমাকে কল দিলেন।””
“” রাত ভাইয়া তোকে কল দিয়েছে?””
“” হুম।””

আমি বাড়ি ছাড়া আগেই এসব নষ্টামি শুরু হয়ে গেছে? আমার বান্ধুবীর নাম্বার আমার কাছে নেই অথচ তার কাছে ঠিক আছে?? ছি!

সন্ধ্যা কল্পনায় নাক সিটকাতেই রাতের আগমন,,

“” দিয়া,তুমি কি আমাকে একটু হ্যাল্প করতে পারবে?””

রাতের এমন আবেদনী সুরে সন্ধ্যার গা জ্বলে যাওয়ার অবস্থা। ইচ্ছে করছে গলায় কাঁটাচামচ ঢুকিয়ে দিতে।দিয়ার আহ্লাদী সুর,,

“” কি হ্যাল্প বলুন!””
“” আমার রুমে যেতে হবে।””
“” হ্যা,এক্ষুনি যাচ্ছি!””

দিয়া দ্রুতপদ ফেলতেই উপুত হয়ে পড়ে গেলো। সন্ধ্যা মুচকি হেঁসে উঠে ওকে টেনে তুলতে তুলতে বললো,,

“” রাত ভাইয়া,ও তো হাঁটতেই শিখেনি,কি করতে হবে আমাকে বলো।””
“” তুই কনে সেজে আমার রুমে যাবি? আমার পান্জাবী ইস্ত্রী করবি? মানুষ কি বলবে? দিয়াই পারবে। দিয়া এসোতো।””

~~

বরযাত্রী এসেছে প্রায় একঘন্টা হতে চলেছে। এখনো বিয়ের কার্যকলাপ শুরু হয়নি। সন্ধ্যার বসে থাকতে থাকতে কোমড় ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। ভারী মেকাপ তার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রুমভর্তি মেয়েরা তাকে ঘেরাও করে রেখেছে। হাসি-ঠাট্টাতে ওর কান ঝালাপালা। সন্ধ্যা মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে,বিয়ে মানে কষ্ট কষ্ট আর কষ্ট!

মাগরিবের আযানের পর কাজী সন্ধ্যার কাছে এলো। সাথে রাতও এসেছে। কালো পান্জাবীতে সন্ধ্যার কোমড় ব্যথা গায়েব। গরমও লাগছেনা,পৃথিবীর সবটা অক্সিজেন নিয়েই কি হাজির হয়েছে?? মনটা এতো ভালো লাগছে কেন??

কাজী সাহেব তার সকল বয়ান পেশ করে সন্ধ্যাকে কবুল বলতে বললেন। সন্ধ্যার সেদিকে কোনো হুশ নেই,তার চোখ তখনো রাতের দিকেই আটকে আছে।

রাতও চুপচাপ দাড়িয়ে আছে,হাতদুটো বুকে বাধা,চোখে তীক্ষ্ণদৃষ্টি এমন একটা ভাব যে দেখি তুই আমার সামনে কিভাবে কবুল বলিস!

পাশ থেকে দিয়ার ধাক্কাতে সন্ধ্যার ভ্রম কাটে। আশেপাশের অবস্থা বুঝে উঠে। কাজী সাহেব পুনরায় কবুলের আর্জি তুললেন। সন্ধ্যা একবার রাতের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার কাজীর দিকে। চোখে বন্যা বয়বে বয়বে ভাব। সন্ধ্যা চারপাশে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলো। পানি পিপাসা পাচ্ছে। একটু কি পানি চাইবে? যদি সবাই হেঁসে ফেলে??

“”পানি খাবি?””

রাতের সহজ গলার প্রশ্নে সন্ধ্যা মাথা নিচু করে বললো,,

“” হুম!””

রাত পানির উদ্দেশ্যে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ভেতর থেকে চেঁচামেচির শব্দ। বিয়ের কনে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।

সন্ধ্যার মা রিমা কাঁদতে কাঁদতে সন্ধ্যার মুখ ভিজিয়ে ফেলেছেন তবুও তার জ্ঞান ফেরার কোনো লক্ষণ নেই। এদিকে পুরোবাড়িতে হা-হুতাশ চলছে,বিয়ের কনে কবুল বলার আগেই অজ্ঞান!

সিকান্দার সাহেব মেয়ের এমন গাঢ় অজ্ঞানে অস্থির। ফোনের পর ফোন লাগাচ্ছেন এ্যাম্বুলেন্সের জন্য। অপেক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিবেন তখনি রাতের বাধা।

“” আপনারা সবাই যার যার রুমে যান। বাইরের গরম পরিবেশ ঠান্ডা করুন। ওকে আমি দেখছি।””

সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিলো রাত। গাড়ীর পেছন সিটে শুয়িয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। ইঞ্জিনটা সচল করতে করতে বললো,,,

“” আমি কাউকে কল না দেওয়া পর্যন্ত আমাকে কেউ কল দিবেনা।””

~~

সময় যত গড়াচ্ছে গাড়ীর স্পিড তত বেড়েই বলেছে। চারপাশের কোলাহল কমে গিয়ে নিস্তব্ধতা বাসা বাধছে,ঘন অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারপাশ। শুয়ে থাকতে থাকতে সন্ধ্যার শরীর কাহিল। জেনেশুনে কারণ ছাড়া এভাবে কতক্ষণ শুয়ে থাকা যায়? গাড়ীতো থামছেইনা। চলন্ত ট্রেনও তো সময় ছেড়ে থেমে আবার চালু হয় কিন্তু এটা কেন হচ্ছেনা? রাত ভাইয়া কি গাড়ী থামাতে পারছেনা? ব্রেক ফেইল করলো নাকি??

সন্ধ্যা শোয়া থেকে উঠে রাতের পেছন থেকে উপুত হয়ে বললো,,

“” আমাকে কি পাঁচার করে দিবে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?””

সন্ধ্যার কন্ঠ পেয়েই রাত আচমকা ব্রেক কষে। সন্ধ্যা তাল সামলাতে না পেরে পিছনে সিটের সাথে ধাক্কা খেলো।

“” ওহ! মাগো মাথাটা বুঝি ফেটেই গেলো।””

রাত সন্ধ্যার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাড়ালো। সন্ধ্যাও নেমেছে। মাথা ঢলতে ঢলতে বললো,,

“” আমাকে হসপিটালে না নিয়ে এটা কোথায় আনলে?””

রাস্তার দুধারে সারিসারি গাছ। চারপাশটা নিরবের হাঁট,সেই হাঁটে জোনাকিপোকারা একটু পরপর উকি দিচ্ছে। মিনিট বাদে বাদে দু একটা গাড়ী ছুটে যাচ্ছে। সন্ধ্যারা এসেছে কোথায় সেটাই বুঝতে পারছেনা। যতদুর চোখ যাচ্ছে আঁকাবাঁকা রাস্তা মিশে যাচ্ছে অন্ধাকারের হা’তে।

“” রাত ভাইয়া,আমরা কোথায় এসেছি? বাংলাদেশে আছিতো?””

সন্ধ্যার কথার কোনো পাত্তা না দিয়ে রাত রাস্তার কিনার ধরে হাঁটা শুরু করলো।

“” আরে,কোথায় যাচ্ছো?””

সন্ধ্যার কোনো কথার উত্তরই দিচ্ছেনা রাত। দেওয়ার কোনো অঙ্গভঙ্গিও নেই। সে আপনমনে হেঁটেই চলেছে। বরং পায়ের গতি বেড়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা দৌড়ে এসে রাতের পথ আটকে দাড়িয়ে হাঁপাচ্ছে।

“” তুমি দেখতে পারছোনা,হাঁটতে পারছিনা? উফ! আবার মুখেও কুলু পেতেছো। সমস্যা কি?””

রাত সন্ধ্যাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই সন্ধ্যা একদমে বললো,,

“” আমি তোমাকে ভালোবাসি,তোমাকে বিয়ে করবো,কবুল কবুল কবুল!””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here