ভালোবাসার রাত Season_2,পর্ব (২৫)
রোকসানা রাহমান
তিয়ামতী নিজের কথা শেষ করেই দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে নিলো। ইশ! এটা সে কি বলে ফেললো? লজ্জায় তিয়ামতীর বিছানার সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। তিয়ামতীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রিদান শব্দ করে হেসে উঠলো। এতে যেন তিয়ামতীর লজ্জা দ্বিগুন হারে বেড়ে গেছে। ইচ্ছে করছে রিদ ভাইয়াকে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। সত্যিই কি পালাবে? কিন্তু যদি ধরে ফেলে?? তিয়ামতী কিভাবে পালাবে সেই ছক সাজানোতে ব্যস্ত।
রিদান নিজের হাসির ইতি ঘটিয়েছে অনেক্ষণ। তিয়ামতীর ঠোঁটের কোনের তিলটাতে তার লোভাতুর দৃষ্টি। গভীর ছোয়ার লোভ জেগে উঠেছে অন্তরে। এক নিমিষেই এতো লোভ তার কি করে জাগলো?? রিদানের থমকে থাকা হাতটা হঠাৎই চঞ্চল হয়ে উঠলো। নিজের ঠোঁটে রিদানের হাতের ছোয়াই তিয়ামতীর মনে আঁকা পালানোর ফন্দিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। এক সুখকর অনুভূতির উপস্থিতি অনুভব করছে। অনুভবটা আরো দৃঢ় হলো রিদানের ঠোঁটের স্পর্শে।
বহুবছর আগে একটি রাত দুজনের মনে দাগ কেটে দিয়েছিলো। শুধু কি মনে? মনের সাথে শরীরেও যে দাগ কেটে দিয়েছিলো। সেই দাগ এতোটাই গভীরে চলে গিয়েছিলো যে আজ আবার সেই পুরোনো,পরিচিতি মানুষটার স্পর্শে ধপধপ করে জেগে উঠতে চাইছে। যা পাওয়ার ছিলো তা পাওয়া হয়নি,তাই বলে কি সে পাওয়ার ইচ্ছেটা নিভে যাবে?? অপূরণীয় ইচ্ছেরা কখনোই নিভে যায় না,মনের এক কোনে ঠিক ঘাপটি মেরে বসে থাকে। অপেক্ষায় থাকে এক নতুন শুভক্ষণের,নতুন করে জেগে উঠার উদ্যমের, নতুন করে পুর্ণতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার। আর সেই ইচ্ছে যদি হয় শরীরের তাহলে তো কথাই নেই। সেই ঘাপটি মেরে বসে থাকা ইচ্ছেটা হঠাৎ করেই জ্বলে উঠছে। পরিপুর্ণভাবে নিজেকে জ্বলিয়ে শেষ করে দিতে চাচ্ছে দুজনের শরীরে।
রিদানের ঠোঁটের আদরে তিয়ামতীর গলার বিস্তর টয়টুম্বর। ভালোবাসার মানুষটির গভীর ছোয়ায় যখন তিয়ামতী অনুভূতির উচ্চতর শিখরে পৌছুবে ঠিক তখনি তিয়ামতী অন্যকিছু অনুভব করলো। নিজের খোলা গলায় রিদের উষ্ণ ঠোঁটের মধ্যে আরেকটি উষ্মার ছোয়া। তরল উষ্মা। তিয়ামতী আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারলোনা। চট করে চোখ মেলে ফেলে। রিদের মাথার দুধার চেপে ধরলো। উচু করতেই তিয়ামতীর কলিজা কেঁপে উঠেছে। সাথে সাথে চোখ ভিজে উঠে গলার স্বরে কান্নার ঢল,,,
“” আপনাল চোখে পানি কেন,লিদ ভাইয়া?””
তিয়ামতীর চোখে চোখ রাখার সাহস পাচ্ছেনা রিদ। বাতাসের ন্যায় সরে আসে তিয়ামতীর কাছ থেকে। অন্যপাশে মুখ করে অপ্রস্তুতসুর,,
“” কোথায় পানি? কিসের পানি??””
তিল শোয়া থেকে উঠে পড়লো। শাড়ীর আঁচল বুকে জড়িয়ে রিদের কাছে এসে বললো,,
“” আমি আপনাল চোখে পানি দেখেছি। আপনি কাঁদছিলেন,কেন কাঁদছিলেন? কি হলো বলুননা।””
তিয়ামতীর কথার পিঠে রিদ কিছু বলছেনা। বলবে কি করে গলাতো তার বন্ধ হয়ে আসছে। তার চোখ নয়,গলা চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে এতোদিনের পুষে রাখা জমানো পানির দানা। চোখের পানিগুলো এতো বেশি স্পর্শকাতর কেন? আপন মানুষের ছোয়া পেতে না পেতেই ভেঙে পড়তে চাচ্ছে। তিয়ামতী কিছু ভেবে না পেয়ে শব্দকান্নাতে ভেঙে পড়ে বললো,,
“” বুঝেছি,আপনি আবাল আমাকে ছেলে চলে যাবেন। আবাল আমাকে একলা কলে….””
তিয়ামতীকে কথা শেষ করার সুযোগ দিলোনা রিদ। ওকে ঝাপটে ধরে হু হু করে কেঁটে উঠলো।
“” আর কোথাও যাবোনা রে বউ!””
**ভালোবাসার সুতোয় বুনা, শাড়ীর আঁচলে
বেধে নিস
লুকিয়ে রাখিস
তোর মনের গহীন অতলে!!**
তিয়ামতী রিদকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো,,
“”আমি কোথাও যেতে দিবোনা,কোথাও। আমাল বুকেল খাঁচায় বন্দী কলে লাখবো।””
“” তাই করিস। আমি নির্দ্বিধায় থাকবো। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে। তার বিনিময়ে একটু শাস্তি তো আমার পাওনা। সৃষ্টিকর্তা হয় তো সেই পাওনা চুকাতেই আবার আমায় তোর কাছে পাঠিয়েছে।””
তিয়ামতী রিদের মুখটা হাতের আঁজলে নিয়ে কান্নামিশ্রিত হাসি হাসলো। চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,,
“” আমি তো ভেবেছিলাম,আপনাল হাসিটাই বাচ্চাদেল মতো,কিন্তু এখন তো দেখছি আপনাল কান্নাও বাচ্চাদেল মতো। আপনি কি আমাল বাচ্চা বল?””
রিদ তিয়ামতীর দুষ্টু কথাতে চুপ করে রইলো। ওর দিকে সুক্ষ চাহনি একে ধীর কন্ঠে বললো,,
“” তুই অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস রে,তিল। অনেক বড়। আমার সেই ছোট্ট তিলটা আজ কত কি বুঝতে শিখেছে। যেখানে আমি একজন ছেলে হয়েও আমার একাকিত্বের বোঝা বয়তে না পেরে এক জঘন্য কাজে প্ররোচিত হয়ে পড়েছিলাম সেখানে তুই মাত্র আঠারোতে পা দেওয়া এক নব্য তরুণী হয়ে সবটা মেনে নিলি। শক্ত হাতে সবটা সহ্য করে বছরের পর বছর কাটালি। না আমার উপর কোনো অভিযোগ তুলেছিলি না ভাগ্যকর্তার উপর!
কিভাবে পারলি তুই? তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এতোদিনে অন্য কোনো পুরুষ….””
“” চুপ,কিসব আবিজাবি বলছেন? শক্ত হওয়াল সেলা উপহালটা তো আপনি আমাকে দিয়েছিলেন। নলম হয়ে যদি গলে যেতাম তাহলে শুধু আপনাকে না আমাল ভালোবাসাল উপহালটিকেও যে অপমান কলা হতো,লিদ ভাইয়া!””
রিদ আশ্বাসীসুরে বললো,,
“” আমার জন্য তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিস। নিজের ইচ্ছেতেও তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি,আর নয়। এবার তোকে আমি ভালোবাসা দিতে চাই। ভালোবাসার শেষ ফোঁটাটাও তোর কপালে আঁকতে চাই।””
রিদ তিয়ামতীর দুহাত নিজের হাতের আবদ্ধে নিয়ে বললো,,
“” এই তোকে আমি প্রমিস করছি,আমার জন্য তোর চোখের অমূল্য সম্পদের একফোটাও গাল বেয়ে….””
রিদের কথা শেষ করতে না দিয়েই তিয়ামতী ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। আবদ্ধের বাধন থেকে নিজের হাত ছুটিয়ে নিলো। রিদের হাত নিজের শরীরের দুদিক দিকে জড়িয়ে দিলো।
~~
তিয়ামতীর শরীরে কম্বল জড়িয়ে দিলো রিদ। ওর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ মেখে দিয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো।
জোর কদম ফেলে রাতের রুমের দিকে এগুচ্ছে। বন্ধ দরজার বাইরে দাড়িয়ে সে। সিটকিনি বাইরে থেকে লাগানো। কোথায় আছে সে?? রিদান ভাবনায় ডুবে পা বাকিয়ে চলে যেতে গিয়েও থমকে গেলো। কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে কি? আন্দাজের তীর কতটা সুক্ষ তা জানার ইচ্ছেতেই বন্ধ দরজা খুলে ফেললো। যা ভেবেছিলো তাই।
বিছানার শেষপ্রান্তের এককোনে আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে সন্ধ্যা। গলে যাওয়া মোমের ন্যায় চোখের পানি দাগ কেটে আছে সন্ধ্যার চোখের নিচে। রিদান ঠোঁটদুটো প্রসারিত করে মনে মনে আউড়াল,ছেলেটা আমার সত্যিই কি পাগল হয়ে গিয়েছে?
রিদান সন্ধ্যার মাথার নিচে বালিশ রাখলো। সন্ধ্যার শরীরে পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে ফিরতি পথে পা বাড়াচ্ছে।
~~
নীশিরাতের শেষ প্রহর। সাদা মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুড়ি খেলা চলছে। ছাদের ঠিক মাঝখানে রাত শুয়ে আছে। বালিশ হিসেবে নিজের দুহাতের মুঠোকে ব্যবহার করেছে। চোখের সরলদৃষ্টি চাঁদমেঘের লুকোচুড়িতে। সেও কি এই চাঁদের মতো?? যেই সুখের আলো শরীরে মাখতে যায় তখনি কষ্টগুলো মেঘের ন্যায় তাকে ঢেকে ফেলে। মাঝে মাঝে মেঘের কাছে পরাজিত হয়ে চাঁদ যেমন অভিমান করে হারিয়ে যায় আজ সেও তো এমন হারিয়ে যাওয়ার পথে। তার আকাশেও যে এখন বৃষ্টির ঢল নেমেছে। রাত প্রাণহীন নিশ্বাস ছেড়ে চোখটা বন্ধ করলো।
রিদান সিড়ি বেয়ে ছাদে এসেছে অনেক্ষণ। ছেলের পাশে দাড়িয়ে ছিলো। নিজের রুমের বিছানাটা কি ছোট হয়ে গেলো যে ছাদটাকেই বিছানা বানিয়ে নিয়েছে???
রিদান নিঃশব্দে ছেলের পাশে শুয়ে পড়লো। রাতের মাথার নিচ থেকে ওর একটা হাত টেনে বের করলো। হাতবালিশটা ভাগ করে নিয়ে আরাম করে চোখ বন্ধ করে নিলো,নিজের দুহাত নিজের বুকের উপর বিছানো। রিদানের এমন কর্মকান্ডে রাতের অবস্থার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শুধু একবার পলক ফেলে পাশের লোকটিকে দেখে নিলো। রিদান বন্ধচোখেই বললো,,
“” বড় হয়ে গিয়েছিস তোকে তো আর আমার বুকে শোয়ার আমন্ত্রণ করতে পারবোনা। তাই তোর হাতটাই বালিশ বানিয়ে নিলাম। ওজনটা কি বেশি? আমার শরীরের নয়,তোর জমাট বাধা রাগের। রাগ নাকি অনুরাগ??
রিদানের প্রশ্নধ্বনিতে রাতের মনোযোগ ক্ষুন্ন। পাশ ফিরে তাকাবে কি তাকাবেনা তাই ভাবছে। বাধা অনুভব করছে,অদৃশ্য বাধা! কিন্তু কেন?? তাহলে কি এই মানুষটার জন্যও তার মনে চাপা অভিমান রয়েছে??
ছেলের দিক থেকে কোনো উত্তর পেলোনা রিদান। এতে যেন উৎসাহই পেলো। নিজের কথার চড়কি অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললো,,
“” তুই কি আসলেই আমার বউয়ের উপর বিরক্ত নাকি নিজের বউয়ের উপর?””
রাত না চাইতেও তার চোখ বিধলো রিদানের মুখে। দুজনের চোখে চোখাচোখি। একজনের চোখে দুষ্টু আভাস,আরেকজনের চোখে বিস্ময়ের!
রিদান এবার ছেলের দিকে কাত হলো। ডানহাতটা মেঝেতে ভর দিয়ে গাল ঠেকিয়ে বললো,,
“” চিঠি লেখার সময় তোর চোখে পানি এসেছিলো। মনে ভাবনা এসেছিলো,কপালে বিরক্তের ভাজ পড়েছিলো,এমনকি নাক থেকে ব্যর্থতার শ্বাস পড়েছিলো। আমি কি ঠিক বলছি?””
রিদানের কথায় রাত হকচকিত। যে মানুষটার সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিলোনা। চোখের দেখা,মনের দেখা, কিছুই নেই। সে কিভাবে জানলো তার অদৃশ্য অনুভূতির কথা? তাহলে কি একেই বলে রক্তের বন্দন?? বাহিরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও মনোসংযোগে অটল!
“” চিঠিতে বারবার আমার বউয়ের কথা উল্লেখ করলেও তুমি পুরো চিঠিতে অদৃশ্যভাবে নিজের বউয়ের কথা ভেবেছো। এতো দ্রুতই হাল ছেড়ে দিলে?””
রাতের মনে ঝড় বয়ছে,সত্যিই কি তাই? মনের অজান্তেই কি সে নিজের ব্যর্থতার অদৃশ্য ছবিটাই এই মানুষটার কাছে পাঠিয়েছিলো?? কিন্তু কেন? কোন আশায়? না জানা এই মানুষটার কাছেই কেন তাকে ব্যর্থতায় বুনো জাল পাঠাতে হয়েছে?? এতো ভরসা কি করে জেগে উঠেছিলো?? জন্মদাতা বলে??
রিদান আগের ন্যায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো। রাতের হাতের কব্জি এবং কনুইয়ের মাঝ বরাবর মাথা রেখেছে। চোখের পাতা দুটো এক করে ভারী গলায় বললো,,
“” ছোটবেলায় সুষম খাবারের নাম নিশ্চয় পড়েছো?? আমিও পড়েছি। বিজ্ঞান বইয়ে। ঠিক কোন ক্লাসে পড়েছিলাম মনে পড়ছেনা। তোমার কি মনে আছে??””
রাতের দিক থেকে নিরব শব্দধ্বনিতে রিদান বেশ গুছিয়ে নিয়ে আবার বললো,,
“” খাদ্যের প্রধান ছয়টি উপাদানের নির্দিষ্ট পরিমানের উপস্থিতি যা ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজন মেটায় তাকে সুষমখাদ্য বলে। ভালোবাসাটাও অনেকটা সুষম খাদ্যের মতো। রাগ,অভিমান,ঝগড়া,অবহেলা,শাসন ও যত্ন এই সবগুলো মিলেমিশে একটি মিশ্র অনুভূতি। যাকে আমরা ভালোবাসা বলে নাম দিয়েছি। ভালোবাসা শব্দটিকে যথার্থ মর্যাদা দিতে হলে তোকে এই মিশ্র অনুভূতিগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যখন যেটার প্রয়োজন তখন তোকে সেই নির্দিষ্ট পরিমানটাকেই ব্যবহার করতে হবে। যদি তুই নির্দিষ্ট এর বাহিরে চলে যাস তাহলেই ভালোবাসার অপমান হবে। আর সে অপমানটা সহ্য করতে না পেরে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা থেকে প্রস্থান করবে। সুষম খাদ্যের উপাদানগুলোর পরিমান যেমন মানুষ ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়। তেমনি ভালোবাসার মিশ্র অনুভূতিগুলোও ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হয়। উদাহরন হিসেবে আমার বউ মানে তোর মা’কে দিয়েই বুঝায়, ও ছোটবেলা থেকেই আমার রাগ দেখে অভ্যস্ত এখন যদি হুট করে ওর সাথে নরম ব্যবহার শুরু করি, ও আমাকে সন্দেহ করবে,শুধু সন্দেহ বললে ভুল হবে ওর মনে সরাসরি ভয় বাসা বাধবে। তেমনি সন্ধ্যা তোর নরম ব্যবহারে অভ্যস্ত এখন যদি তুই ওর সাথে এমন কঠিন ব্যবহার করিস তাহলে কি ওর তোকে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক? না বরং এটাই স্বাভাবিক।
সমস্যা সন্ধ্যার মধ্যে না,তোমার মধ্যে। কি সমস্যা জানো? সন্ধ্যা কিন্তু চাইছে তোমার সেই ভয়ংকর রুপটা ভুলে যেতে কিন্তু তুমি দিচ্ছোনা। তুমি এতোটাই অধৈর্য্য হয়ে পড়েছো যে বারবার ওর সম্মুখীন হচ্ছো তাও অদ্ভুত ব্যবহার নিয়ে। একটু আগে তুমি যেটা করেছো সেটা ঠিক করোনি। আমি যতটুকু বুঝতে পারছি ও ভুলেও তোমার সামনে আসবেনা।””
রিদান চোখ মেললো। রাতের চোখের প্রশ্নটা পড়ে নিয়ে বললো,,
“” আমি কোনো আগন্তুক নই। তোমার আম্মুর স্বামী। তার চিঠিতে আমি সবাইকেই দেখতে পেয়েছি।””
রাত শোয়া থেকে উঠে পড়লো। বাবার জন্য একফোটা বাক্যওব্যয় করেনি। সোজা হাঁটা ধরতেই রিদান গলার স্বর উচু করে বললো,,
“” তুমি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি পারবোনা। তুমি আমার বউয়ের দুইমাত্র ভালোবাসা।””
রাত থমকে দাড়ালো। রিদান কয়েক কদম এগিয়ে এসে বললো,,
“” তুই যা স্বীকার করছিস না,তা ভাঙানোর প্রয়োজন মনে করছিনা। তবে হ্যা,তুই আমাকে বাবা বলে না ডাকলেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি কি তোকে বাবা বলে ডাকতে পারি? এতো বছর পর বাড়ি এলাম। জন্মদাতার বিয়োগ ঘটায় তাকে তো ডাকতে পারছিনা। মনের ভেতর শূন্যতা অনুভব করছি।””
রাত তখনো দাড়িয়ে। পেছনে-সামনে কোনোদিকেই পা মেলছেনা। রিদান আরেক কদম এগিয়ে এসে মুখটা সামনে বাড়িয়ে বললো,,
“” বাবা,আমি কি তোমাকে একটু ছুতে পারি?””
বাবার এমন আদুরী আবদারে রাত আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলোনা। বুকের ভেতর জমে থাকা সকল অভিমান পিষিয়ে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।
“” সরি বাবা।””
রিদান ছেলের পিঠে আদুরী কিল দিয়ে বললো,,
“” ইটস ওকে,বাবা!””
~~
বাচ্চারা যেমন হাঁটা-খেলা শেষে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়েজনীয় আধো বুলিতে গল্প জুরে বসে ঠিক তেমনি একটা বয়সসীমা পার হওয়ার পর মানুষ বুড়ো বয়সে জানা-অজানা শব্দ দিয়ে গল্প জুরে দেয়। সেইসব গল্প শোনার প্রচন্ড ধৈর্য্যের প্রয়োজন যা সকলে করে উঠতে পারেনা। জীবনের এমন স্বল্প সময়ে কেই বা চাইবে বুড়ো বাবা-মা,দাদা-দাদী,নানীর গল্প শুনে সময় ব্যয় করতে? তাই সকলেই তাদের এড়িয়ে চলে। সকলেরই কত তাড়া। কিন্তু রিদানের নেই। সে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছে মায়ের বুলিতে। গভীর মনোযোগী। একসময় মায়ের কথার ঝুরি ফুরিয়ে এলেই মাকে কোলে তুলে বললো,,
“” এইবার ছেলের কোলে করে এঘর-ওঘর ঘুরবে। আবার যদি শুনেছি ঘরে বসে,শুয়ে কাটাচ্ছো তাহলে কিন্তু তোমাকে খোলা আকাশের নিচে ফেলে আসবো। কেউ তোমাকে দেখতেও যাবেনা।””
রিদান মাকে নিজের পাশের চেয়ারটাতে বসিয়ে দিলো। সামনে নাস্তার প্লেট সাজিয়ে দিচ্ছে। মা আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে বললেন,,
“” তোর মুখটা দেখার জন্যই এখনো পৃথিবীর আলো,বাতাসে পড়ে আছি। এখন খোলা আকাশ কেন,মাটির নিচে ফেলে এলেও আমার কোনো আপত্তি নেই!””
একে একে সকলেই নাস্তার টেবিলে হাজির। সবগুলো ভরা চেয়ারের মাঝে একটি শূন্য চেয়ার বড্ড বেমানান লাগছে। রিদান শূন্য চেয়ারের মাঝে নিজের ছেলের মনের ভেতরের শূন্যতাও যেন অনুভব করতে পারছে। সকলকে খাবার শুরু করতে বলে সে পা বাড়ালো ছেলের বউয়ের রুমের দিকে।
~~
সন্ধ্যার ঘুম ভেঙেছে অনেক আগে। মায়ের ডাকাডাকি শেষে মামির ডাকাডাকিতে ঘুমানো অসহ্যকর। তাই বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হলো। ঠান্ডা পানির ছোয়াতে ঘুমটা চলে গেলেও আলসেমি ভাবটা তখনো সীমিত। জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরে আলো প্রবেশের পথ খোলায় যখন ব্যস্ত তখনি কারো পায়ের আওয়াজ পেলো। দৌড়ে নিজের গুছানো কাঁথাটা মেলে শুয়ে পড়লো। পুরোমুখ ঢাকা।
কয়েক মিনিট পেরিয়ে যেতেও যখন রাতের কন্ঠ পেলোনা সন্ধ্যা চুপচুপ করে কাঁথাটা সরালো। তার বেডের সামনে চেয়ারে কেউ বসে আছে। রাতের মতো দেখতে হলেও রাত নয়। সন্ধ্যা এক ঝটকায় উঠে বসলো। সামনের মানুষটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,,
“” তুমিই তাহলে সেই মামা, যে আমার মামিকে এতো কষ্ট দিয়েছে,অত্যাচার করেছে?””
সন্ধ্যার প্রশ্নে রিদান কিছুটা নড়ে উঠলো। প্রথম আলাপেই এতোটা সহজ করে দিবে তা ভাবেনি রিদান। তবে খুব একটা অবাকও হয়নি। তিয়ামতীর চিঠির অনেকাংশ জুরেই থাকতো এই মেয়ের চঞ্চলতা!
রিদান স্বল্পশব্দে হেঁসে উঠে চেয়ার ছাড়লো। সন্ধ্যার পাশে বসে বললো,,
“” তুমিই সেই মেয়ে,যে আমার ছেলেকেটাকে জ্বালাতে জ্বলাতে পাগল বানিয়ে দিয়েছে?””
মামার এমন প্রশ্নে ভাগনি চমকিত। গলার সুরে নেমে এসেছে ইতস্ততা। আমতা আমতা টেনে বললো,,
“” আমি কেন জ্বালাতে যাবো? তোমার ছেলেই তো আমাকে জ্বালাচ্ছে।””
রিদান সন্ধ্যার মাথায় হাত রাখলো। নরমসুরে বললো,,
“” সম্পর্কে তুই আমার অনেককিছু হোস। সবছেড়ে তোকে আমি মা বলেই সম্বোধন করলে তোর কোনো আপত্তি আছে?””
সন্ধ্যা মাথানিচু করে বামে-ডানে দুলালো।
“” বেশি কিছু বলবোনা। এক লাইনে বলছি। আমি জানি আমার মা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। সে ঠিক বুঝে নিবে।””
সন্ধ্যা ডান দিকে মাথা কাত করে আচ্ছা বুঝালে রিদ বললো,,
“”তুই যেমন রাতের উপস্থিতে নিজেকে ভয়ের মধ্যে সিটিয়ে নিচ্ছিস। রাত ও তেমন তোর অনুপস্থিতে নিজেকে আমাদের সবার কাছ থেকে দুরে সরিয়ে নিচ্ছে। এর ফলাফল কিন্তু ভয়ানক হতে পারে। এমন ও হতে পারে ও নিজেই নিজের শরীরের সাথে ভয়ানক কিছু করে ফেলেছে।””
রিদান নিজের স্বল্পবাক্য শেষ করে উঠে পড়লো। ঠোঁটে তার আগমনী বিজয়ী হাসি। কিছু মানুষ আছে,যে নিজের ক্ষতিটা খুব সহজে পুষিয়ে নিতে পারলেও প্রিয় মানুষটার নগন্য আঘাতটাও সহ্য করতে পারেনা। এই মুহুর্তে রিদান সন্ধ্যাকে সেই কিছু মানুষগুলোর দলেই ফেললো।
~~
প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে রাত সন্ধ্যার দরজার সামনে হাঁটাচলে করে নিজের রুমে ফিরেছে। কেন জানি ছোট্ট একটা নক করার সাহসটাও জাগিয়ে তুলতে পারেনি। নিজের চেয়ার-টেবিলের সামনে থম মেরে রইলো। এই জায়গায় বসে কত অদ্ভুত অদ্ভুত আবদারে রাতের ঘুম নষ্ট করেছে তার হিসেব নেই। অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গিয়েছে দুজনের আর খাতাকলম নিয়ে বসা হয়না।
রাত একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই পাশের চেয়ারটা সরে যাওয়ার শব্দ। রাত মাথা উচু করে তাকলো। সন্ধ্যা বসে আছে। সত্যিই কি সন্ধ্যা নাকি মনের ভ্রম??
সন্ধ্যা বুকভর্তি সাহস ভরে বললো,,
“” সরি বলো।””
সন্ধ্যার দিক থেকে এমন প্রশ্ন ছুড়ে আশায় রাত বাকরুদ্ধ। নির্বাক চোখে চেয়ে আছে সন্ধ্যার দিকে।
“” কি হলো সরি বলো।””
“” কেন?””
“” তুমি আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছো তাই।””
“” আমি কি এমনি এমনি করেছি?””
সন্ধ্যা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো।
“” আবার ঝগড়া করছো তো? তোমার আব্বুর কাছে নালিশ করবো।””
“” কর।””
“” আমি কিন্তু আবার চলে যাবো।””
“” যা।””
সন্ধ্যা বিরক্ত হয়ে পা চালালো। তবে বাইরে নয়। রাতের বিছানায় শুয়ে পড়ে বললো,,
“” আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমিয়ে নেই। সকালে যাবো।””
রাত সন্ধ্যার কাছে এসে বললো,,
“” তুই আমার রুমে কেন ঘুমাবি? তোর রুম নেই?””
“” না। দান করে দিয়েছি।””
“” তাতে আমার কি? তোর আমার রুমে জায়গা নাই। যা এখান থেকে।””
“” যাবোনা। কি করবে?””
“” তুই যাবি নাতো?””
সন্ধ্যা মুখ বাকিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। রাত ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু সময় পার করলো। কাধে হাত রেখে ওকে সোজা করে শোয়ালো। সন্ধ্যা কপাল কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করতেই রাত ধপ করে ওর উপর শুয়ে পড়লো। সন্ধ্যা সুক্ষ আর্তনাদে বললো,,
“” ও মা গো,তোমার মেয়েকে মেরে ফেললো গো। তোমার কি জায়গা অভাব পড়েছে,রাত ভাইয়া?””
সন্ধ্যা বেশ বল প্রয়োগ করেও রাতকে সরাতে পারছেনা। রাতের দিক থেকেও কোনো নড়নচড়ন নেই। শিথীলভাবে শুয়ে আছে। সন্ধ্যা আচমকা সন্দেহ নিয়ে চিৎকার করে উঠলো,,
“” রাত ভাইয়া,তুমি কি অজ্ঞান হয়ে গেলে? হলে তো হলে,আমার উপর এসেই হতে হলো?? এখন তো তোমার ভারে আমিও অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি!””
চলবে