ভালোবাসার শহরে ( দ্বিতীয় পর্ব )
ঈপ্সিতা মিত্র
<৪>
পরেরদিন সকাল এগারোটার মধ্যেই পরিণীতা হাজির হয়েছিল কলেজে | তবে ওকে তাড়া দিয়ে দিয়ে অর্নাই নিয়েই এসেছিলো আজ | পরিণীতা তো ভেবেছিলো সকালে দুটো স্টুডেন্টকে পড়িয়ে একেবারে দুপুরের দিকে হয়তো কিছুক্ষণের জন্য আসবে একটু | কিন্তু অর্না ফোন এ কথাটা শুনে বেশ প্রতিবাদ করে বলে উঠেছিল,
———— ” তুই কি রে ! অনির্বানদা বললো তাড়াতাড়ি আসতে আজ | তোর পারফর্মেন্স আছে | ও ব্যবস্থা করে দেবে | আর তুই আজকের দিনেও টিউশন পড়ানোর কথা ভাবছিস ?”
এর উত্তরে পরিণীতা একটু নির্বিকারভাবেই বলেছিলো ,
———— ” তুই সেই আনন্দেই থাক ! শোন , ওই কলেজের হিরোর অতো খেয়ে দেয়ে কাজের অভাব হয়নি , যে আমার কথা মনে রাখবে ! আবার কালচারাল কমিটিকে বলে আমাকে গান গাওয়ার সুযোগও করে দেবে ! আজ গিয়ে যদি দেখা হয় না , চিনতেও পারবে না ! আমি বাজি ধরে বলতে পারি কথাটা |”
অর্না এটা শুনে আকাশ থেকে পড়ার মতন ভাব করেই বলেছিলো ,
————- ” অদ্ভুত ! তুই লোকজনকে একটু বিশ্বাস করতে পারিস না কেন বল তো ? তুই গিয়েই দেখ না , অনির্বানদা নিজের মুখে যেটা বলেছে সেটা করে না কি করে না !”
না , আর এর কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি পরিণীতা এরপর | আর অর্নার সাথে তর্ক করে কোনো লাভ নেই ! বলে লাভ নেই যে ওর মতন সাধারণ , রং চটা চুড়িদার পড়া , একদিকে বিনুনি ঝোলানো চশমাধারী একজন মেয়েকে অনির্বানের মতন ছেলেরা কখনো দেখেও দেখে না ! যার আশেপাশে আবার সারাক্ষণ অপ্সরারা ঘুরে বেড়ায় কলেজের | ও তো শুনেছে , অনির্বানের ব্যাচেই পরে , রিমি , তন্বী , অনুশ্রী , এরা তো আবার পার্টটাইম মডেলিং করে | এরাই আছে কালচারাল কমিটিতে | অনির্বাণকে ভীষণ লাইক করে সবাই | এদের পারফর্মেন্স বাদ দিয়ে অনির্বান ওর কথা মনে রাখবে ! এটা কখনো হতেই পারে না | কথাগুলো ভেবেই সেদিন নীল শাড়িতে সেজে পরিণীতা গেছিলো কলেজের অডিটোরিয়ামে | তারপর অর্নাকে সাথে করে একদম পিছনের দিকের রো-টায় বসেছিল ওরা | যদিও অর্না খুব জোরাজুরি করছিলো সামনের সিটগুলোতে বসতে , যদিও সব অলরেডি বুকড | কিন্তু কাউকে রিকোয়েস্ট করে যদি দুটো সিট্ পাওয়া যায় | তাতে না কি অনির্বানের ওকে খুঁজতে সুবিধা হবে | তবে পরিণীতা এই কথাটায় অতো পাত্তা দেয়নি | যে ওকে আর মনেই রাখবে না , তার জন্য শুধু শুধু লোকজনকে রিকুয়েস্ট করে কি লাভ একটা সিটের জন্য ! তার থেকে একটু দূরে বসাই ভালো | এইসব কথা ভেবেই আনমনে বসেছিল চুপচাপ | ওয়েট করছিলো ফাংশন শুরুর | তবে তখনই পাশ থেকে ভিড় কাটিয়ে হঠাৎ একটা নতুন চেনা গলার আওয়াজ কানে এলো , ————– ” আরে তোমরা এখানে এতো দূরে বসে ! আমি সামনে খুঁজছি কতক্ষণ !”
কথাটা বলতেই পরিণীতা চোখ তুলে দু সেকেন্ড স্থির হয়ে গেলো যেন | লালচে হলুদ রঙের শর্ট পাঞ্জাবিতে অনির্বান এসে হাজির ওদের কাছে | অর্না ঠিক এই মুহূর্তেই ওর হাতে একটা চিমটি কেটে উঠলো লুকিয়ে | মুখে এখন ওর জয়ের হাসি | ব্যাপারটা পরিণীতা আড় চোখে খেয়াল করতেই অনির্বান ওকে বলে উঠলো ,
————– ” তুমি রেডি তো ? আমি কথা বলে নিয়েছি | ওপেনিং সংই তোমার | ব্যাকস্টেজে চলো !”
কথাটায় পরিণীতার চোখগুলো আপনাআপনিই এবার বড়ো হয়ে গেলো যেন | ও একটু ঘাবড়ে গিয়েই বললো , ——- ” ও ও ওপেনিং ! আমার !”
এর উত্তরে অনির্বান আলতো হেসে বললো , ————— ” এতে ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি |তুমি এতো ভালো গান গাও ! ডোন্ট বি নার্ভাস .. চলো এবার তাড়াতাড়ি | তোমার নাম এনাউন্স হবে এখন |”
কথাটা বলে অনির্বান একটু যেন তাড়ার মধ্যেই পরিণীতার হাতটা ধরে ফেললো হঠাৎ, ওকে ভিড় কাটিয়ে স্টেজের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য | তবে পরিণীতা আজ ফাংশনে গান গাওয়ার জন্য যেমন তৈরী ছিল না , সেরকম এই স্পর্শটার জন্যও ঠিক তৈরী ছিল না ! মনে মনে হঠাৎ থমকে গেছিলো ও | তবে সেই থমকে থাকা মুহূর্তেই অডিটোরিয়ামের ভিড় রাস্তা পেরিয়ে ও অনির্বানের হাত ধরে স্টেজের কাছে এসেছিলো সেদিন | অনির্বান তারপর নিজেই ওর নামটা এনাউন্স করেছিল স্টেজে | তবে সেই মুহূর্তে অডিয়েন্স এ বসে থাকা ছেলেমেয়েরা একটু অধৈর্যই হয়েছিল প্রথম পরিণীতার নাম শুনে | কোথাকার কোন মেয়ে ! কেমন গায় ! কেউ কখনো শোনেইনি আগে কলেজে এই নামটা ! সবাই তো ভেবেছিলো শুরুতেই হয়তো কলেজের ব্যান্ড এর পারফর্মেন্স হবে | কিন্তু সেইসব আশায় জল ঢেলে হঠাৎ পরিণীতার নামটা এনাউন্স হওয়ায় কেউ হাততালি অব্দি দেয়নি প্রথমে | একটু যেন হতাশ মুখেই বসেছিল অডিয়েন্স | পরিণীতারও এই দৃশ্য দেখে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছিলো কেমন | রাগ হচ্ছিলো হঠাৎ অর্নার ওপর | এই মেয়েটার কি দরকার ছিল আগ বাড়িয়ে নামটা লিখিয়ে আসার ওর ! নাম না লেখা হলে কাল ওই শেষ মুহূর্তে জোর করে রিহার্সেলেও আসতো না , আর আজ এইভাবে স্টেজেও উঠতে হতো না ! ঝামেলা থাকতো না কোনো জীবনে | আর দরকার নেই তো কোনো এইসবের | কি হবে সারা কলেজকে ওর গান শুনিয়ে ! নিজের মুখটা চিনিয়ে ! তার থেকে আড়ালে থাকলে তো কোনো ক্ষতি নেই ! কথাগুলো ভেবে একটা দীর্ঘ্যশ্বাসকে সঙ্গী করেই গান ধরেছিলো নিজের | সেই কালকের গান |
” তাকে , যত তাড়াই দূরে দূরে
তবু , সে আসে মেঘলা চোখে ঘুরে ফিরে ||”
গানের লাইনগুলো তারপর ও চোখ বন্ধ করেই গেয়েছিল পুরোটা | কার ভালো লাগবে , কার লাগবে না ! কোনো কথা মাথায় রাখেনি আর ! শুধু নিজের মনে গেয়ে গিয়েছিলো গানটা একলা স্টেজে | হারিয়ে গিয়েছিলো সুরগুলোর মধ্যে | কিন্তু গানটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ অনেক হাততালির আওয়াজে বন্ধ চোখটা আপনাআপনি খুলে গেছিলো সেদিন পরিণীতার ! ও অবাক চোখে দেখেছিলো ওই হতাশ অডিয়েন্সের মুখগুলোতে এখন চওড়া হাসি | কিছু ছেলে মেয়ের চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আবদার , ———- ” আর একটা হয়ে যাক পরিণীতা ! প্লিজ ! আর একটা গান |”
পরিণীতার যেন এসব কিছু দেখে শুনেও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না ! সত্যি তার মানে ওর গান সবার ভালো লেগেছে ! কথাটা মনে ভাবতেই ব্যাক স্টেজ থেকে ভেসে এসেছিলো অনির্বানের গলার আওয়াজ | অনির্বানও বেশ খুশি হয়েই ওকে বলে উঠেছিল , ———— ” সবাই যখন বলছে , আর একটা গান গাও | প্লিজ |”
না , আর অনির্বানের কথা ঠিক ফেলতে পারেনি পরিণীতা | ও আবার চোখটা বন্ধ করেছিল নিজের | তারপর গেয়ে উঠেছিল আরেকবার ,
” যখন এসেছিলে , যখন এসেছিলে ,
অন্ধকারে চাঁদ ওঠেনি
সিন্ধুপারে চাঁদ ওঠেনি ||”
তবে সেদিন এই গানটা শেষ হওয়ার পর কয়েক সেকেন্ড পুরো অডিটোরিয়ামই যেন শান্ত হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ | অতো ছেলে মেয়ের ভিড় , তাদের কথা , সব কিরকম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো কিছুক্ষণের জন্য | পরিণীতার এই মুহূর্তে মনে হয়েছিল আনমনে , তাহলে কি গানটা ভালো হয়নি ! কারোর মনের মতন হয়নি ! তবে এই ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ নিঃস্তব্দতা কাটিয়ে প্রথম হাততালি দিয়ে উঠেছিল ব্যাকস্টেজ থেকে অনির্বান | এরপর একে একে প্রত্যেকে হাততালি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে এই গানের সুরে পরিণীতার সঙ্গে বাকিরাও হারিয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ | তাই গান শেষে নিজেদের ভালো লাগাটা বোঝানোর কথাটাও মাথায় ছিল না কারোর ! হাততালি দেয়ার কথাও ভুলে গেছিলো সবাই ! তবে এই আওয়াজে অবশেষে পরিণীতার মুখে হাসি এসেছিলে এখন | একটা স্বস্তির হাসি | যাক , তাহলে ওর গান ভালো লেগেছে সবার ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই তারপর ব্যাকস্টেজে এসে দাঁড়িয়েছিল ও | কিছু ভেবে বলে উঠেছিল অনির্বানকে ,
————- ” থ্যাঙ্ক ইউ .. আপনার জন্যই গানটা গাইতে পারলাম |”
অনির্বান কথাটা শুনে একটু জোর দিয়েই বলেছিলো , ———— ” আবার আপনি ! আমি কোনো সিনিয়র সিটিজেন নোই | শুধু সিনিয়র | তাই তুমিটাই ঠিক আছে |”
এর উত্তরে পরিণীতা বেশ লজ্জা পেয়ে অল্প হেসে বলেছিলো , ————— ” আচ্ছা , ঠিক আছে | তুমি বলবো |”
অনির্বান এটা শুনে একটু দৃঢ়ভাবে বলে উঠেছিল , ————– ” আমি আজ অব্দি অনেকের গান শুনেছি ! কিন্তু কাউকে এরকম গাইতে দেখিনি , যার গান শুনে একটা পুরো কলেজ চুপ হয়ে যাবে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ! একচুয়ালি, ইউ হ্যাভ আ ইউনিক ভয়েজ … যত্নে রেখো এটাকে | ”
কথাগুলোর উত্তরে পরিণীতা আলতো হেসে বলেছিলো আস্তে গলায় , ———– ” আচ্ছা | মনে থাকবে |”
তারপর আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাকস্টেজটা খালি করে বেরিয়ে এসেছিল অডিটোরিয়ামের বাইরে , করিডোরে | কিন্তু এই মুহূর্তে হাততালির আওয়াজটা যেন কানে বাজছিলো এখনো | তার মধ্যেই ওর হঠাৎ মনে হলো , গানের মাঝে ও চোখ বন্ধ করে অনির্বানের মুখটাই দেখছিলো না বার বার ! ওই চশমা পড়া , হালকা দাড়িতে ঢাকা মিষ্টি মুখটাই তো আসছিলো ভেসে , বন্ধ চোখের আড়ালে | সবার মাঝে |
<৫>
” গরীবের কথা বাশি হলে ফলে ! দেখলি তো ! এমনিতে তো আমার কথায় পাত্তা দিস না । কিন্তু অর্না মুখার্জি কখনো না ভেবে কিছু বলে না ! অনির্বানদা কে তো দেখলেই বোঝা যায় , এমনি এমনি কোন কথা বলার ছেলে না। ফাংশনের দিন সেটা প্রমাণ হোয়ে গেল ! ভাগ্যিস তোকে সকালে ফোন করে তাড়া দিলাম সেদিন । নইলে তো তুই হেলে দুলে দুপুরে আসতিস ! তাহলে হয় তো আর অনির্বানদা স্টেজ ম্যানেজ করতে পারতো না ।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বুক ফুলিয়ে বলে গেল অর্না । কলেজ শেষের বিকেলবেলা এখন ।
আকাশের সূর্যটা লাল আভা ছড়িয়ে পশ্চিমের দিকে যাওয়ার রাস্তায় | তার মাঝেই পরিণীতা বলে উঠলো ,
———- ” তিন দিন হয়ে গেছে ফাংশন শেষ হয়ে | আর এই তিন দিনে তুই এই কথাটা প্রায় তিনশো বার বলেছিস ! আচ্ছা , আমি তো মেনে নিয়েছি , আমি অনির্বানদার ব্যাপারে ভুল ভেবেছিলাম | আর ও যে আমাকে স্টেজ এ গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে , তার জন্য আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো ! আর সত্যি , তোরও বিশাল ক্রেডিট ! তোর কথাকে এরপর থেকে সিরিয়াসলি নেবো | তুই যা বলবি , আমি তর্ক না করে সেই কথাটাই শুনবো | এবার শান্তি ?”
কথাটা শেষ করে ও একটু উদাসীনভাবে তাকালো অর্নার দিকে , আর খেয়াল করলো যে অর্না যেন এই শেষ লাইনগুলো শুনে মনে মনে বেশ খুশি হয়ে গেছে হঠাৎ | অদ্ভুত গর্বের হাসি ওর মুখে | তবে পরিণীতা এই মুহূর্তে আর কথা না বাড়িয়ে বাস স্টপের উল্টো দিকে বসে থাকা একজন বয়স্ক মহিলার কাছে এগিয়ে গেলো | রোগা লিকলিকে চেহারা , ছেঁড়া শাড়ি পড়া ঠাকুমা সব সময় ওদের কলেজের উল্টো দিকে এই বাস স্টপের এক কোনায় বসে থেকে ভিক্ষা করে | অনেকেই ওনাকে কলেজ যাওয়া আসার সময় দেখে | কেউ নোটিশ করে , কেউ করে না | কেউ হয়তো দু পাঁচ টাকা দেয় | কেউ না দেখার ভান করে চলে যায় | তবে পরিণীতার কিন্তু এই ঠাকুমার সঙ্গে কলেজের প্রথম দিন থেকে বেশ ভাব শুরু | কখনো খাবার কিনে দেয়া , তো কখনো বাড়ি থেকে কিছু রান্না করে টিফিন বক্স এ করে দিয়ে যাওয়া , এইসব ওর লেগেই থাকে প্রায় | আজ যেমন ব্যাগে করে একটা চাদর এনেছে গায়ে দেয়ার | আসলে বর্ষা কাল | রাতে হালকা হালকা ঠান্ডা লাগে ঝোড়ো হাওয়ায় | কথায় কথায় কথাটা বলেছিলো ঠাকুমা ওকে | তাই আজ চাদরটা এনেছে |
সেদিন এই কলেজ শেষে ও ঠাকুমার কাছে গিয়ে চাদরটা ব্যাগ থেকে বার করে হাসি মুখে জড়িয়ে দিয়েছিলো হঠাৎ | ঠাকুমা তো অবাক হয়ে গিয়েছিলো এই নতুন চাদরটা পেয়ে ! আসলে এইভাবে কেউ ওনার জন্য আগে কখনো কিছু করেনি তো , তাই অবহেলাটাই অভ্যেস হয়ে গেছে | সেখানে একটা অচেনা মেয়ে যে ওনাকে নিয়ে এতটা ভাবে , এটা দেখে মাঝে মাঝেই খুব অদ্ভুত লাগে ! চোখে জল এসে জমা হয় | এই যেমন আজ হলো ! তবে তার মাঝেও উনি পরিণীতার মাথায় হাত রেখে একটু আদর করে দিলেন খুশিতে | পরিণীতার মুখেও এই সময়ে এক টুকরো হাসি এসে জমা হলো | টিউশনির টাকা থেকে চাদরটা কিনেছিলো ও | নিজের দিদা তো অনেকদিন আগেই মারা গেছে ! এখন তো চাইলেও আর কিছু দিতে পারবে না দিদা কে ! তবে এই ঠাকুমাকে কলেজের প্রথম দিন থেকে দেখেই খুব নিজের লাগে | তাই ওনার জন্য কিছু করতে পারলে মনে একটা অদ্ভুত শান্তি হয় ওর |
তবে সেইদিন এই দৃশ্যটা কলেজের গেটের ওপার থেকে পরিণীতার অজান্তে আরো একজন দেখছিলো নিস্পলক ভাবে | অনির্বানের ক্লাস সেদিন ওই বিকেলের দিকেই শেষ হয়েছিল | আজ আর এরপর কোথাও পড়তে যাওয়া নেই | তাই একটু আস্তে ধীরেই বেরোচ্ছিল কলেজ থেকে | কিন্তু এই গেটের সামনে এসে ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল হঠাৎ | পরিণীতার গানের গলার জন্য ওর মুখটা ভোলার নয় ! তবে সেই চেনা মুখের আড়ালে থাকা মানুষটাকে আজ প্রথম দেখলো অনির্বান | ও নিজেও বাস স্টপে অনেকদিন খেয়াল করেছে এই বয়স্ক মহিলা | কখনো কখনো দশ বিশ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে আনমনে | তবে এর বেশি কিছু কখনো করার কথা মাথায় আসেনি ! বা সময় হয়নি ভাবার | কিন্তু পরিণীতাকে এইভাবে ওনার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিতে দেখে ও কয়েক সেকেন্ড অবাক না হয়ে পারলো না ! হঠাৎ মনে হলো , সত্যিই তো , দশ কুড়ি টাকার বেশি কিছু ও ভাবা যায় ওনাকে নিয়ে ! একটু হেসে কথা বলা যায় ! আলাপ জমানো যায় কলেজ যাওয়া আসার সময়ে । তবে এই হিসাবের বাইরের ভাবনাটা কজন আর ভাবতে পারে এই মেয়েটার মতন !
কথাটা মনে আসতেই অদ্ভুত একটা ভালো লাগা এসে ভিড় করলো অনির্বানের মনে । এই প্রথম । মনে হলো এই মেয়েটার সাথে বন্ধুত্ব করলে মন্দ হয় না ! বরং অনেক নতুন নতুন বেহিসাবি কাজ হয়তো শেখা যাবে ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলো বাস স্টপে এর মধ্যে যেই বাস টা এসে দাঁড়ালো , তাতে পরিণীতা অর্না সমেত উঠে গেল নিজে । এই মেয়েটা মনে হয় বেস্ট ফ্রেন্ড পরিণীতার ! সব সময় সঙ্গেই থাকে ! কথাটা আনমনে মনে হলো হঠাৎ অনির্বানের । আর মনে হলো অর্না অনেক কথা বললেও পরিণীতা বেশ শান্ত স্বভাবের । যত টুকু প্রয়োজন তার থেকে বেশি একটা লাইনও বলার চেষ্টা করেনি কখনো অনির্বানের সাথে ।
যাইহোক , অকারণে এইসব এলোমেলো চিন্তার মধ্যেই হারিয়ে ছিল সেদিন অনির্বান । তখনই স্নেহার গলা কানে এলো হঠাৎ । বেশ হাসি মুখেই ও অনির্বাণের জন্য কিছু রেফারেন্স বই নিয়ে হাজির কলেজ শেষে । অনির্বাণ তো এসব দেখে একটু ইতঃস্তত হয়েই বললো ,
——— ” তুই এত বই নিয়ে হঠাৎ ! এইসব এর দরকার ছিল না ।”
এই কথার উত্তরে স্নেহা বেশ নরম সুরেই বলে উঠলো , ——— ” তুই তো কদিন ধরে লাইব্রেরীতে খুঁজছিলিস বইগুলো । লাইব্রেরিয়ান কে লিস্ট ও দিয়েছিলিস ।আমি ওই সময় লাইব্রেরীতে ছিলাম । তাই শুনেছিলাম বইগুলোর ব্যাপারে । তুই যদিও আমাকে খেয়াল করিসনি এজ ইউজুয়াল ! যাইহোক , কাল কলেজ স্ট্রিট গেছিলাম , তাই তোর ওই লিস্ট এর কটা বই আমি খুঁজে পেয়েছি । রাখ বইগুলো নিজের কাছে , হয়ত কাজে লাগবে !”
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেল স্নেহা । অনির্বাণ এরপর আর কথা না বাড়িয়ে নিয়ে নিল বইগুলো নিজের কাছে । আসলে জানে ও, এইসব বাড়তি কাজগুলো যেচে পরে স্নেহা কেন করে বার বার ওর জন্য ! আসলে সেই স্কুল লাইফ থেকেই স্নেহা ওকে পছন্দ করে । আর যেহেতু স্নেহার বাবা আর অনির্বাণের বাবা বিজনেস পার্টনার , তাই বাড়িতেও যাওয়া আসা লেগেই থাকে মেয়েটার । এমনকি স্নেহার মা তো কথায় কথায় ওর মা কেও বলেছে , পড়াশোনা কমপ্লিট হলে দুজনের বিয়ে দিয়ে দিলে খারাপ হবে না ! অনির্বাণ আর স্নেহাকে না কি ভীষণ মানায় একসাথে । তবে অনির্বাণের এইসব একদম ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই ! যেহেতু একটা বিজনেস রিলেশন আছে বাবার , তাই অনির্বাণ কখনোই মুখের ওপর না বলতে পারে না ওদের কোনো কথায় । শুধু সব শুনে এড়িয়ে যায় কথাগুলো । স্নেহাকে । এই যেমন আজও , স্নেহা বইগুলো দিয়ে বেশ আলতো স্বরেই বলে উঠেছিল অনির্বানকে ,
——— ” বাড়ি যাচ্ছিস তো ? আমি ড্রপ করে দিই ? ড্রাইভার কাকু চলে এসেছে গাড়ি নিয়ে । আর বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় নতুন একটা কফিশপ হয়েছে দেখলাম । ওখানে যাবি ? একটু কফিও খেতাম তাহলে !”
কথাটা শুনে অনির্বাণ কিছুটা এলোমেলো হয়েই উত্তর দিলো ,
——— ” না রে । আজ হবে না । কিছু কাজ আছে আমার । তুই বাড়ি যা । পরে দেখা হবে ।”
কথাটা বলেই অনির্বাণ আর কোনো প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কলেজের গেটের ওপারে চলে এলো নিজে । তারপর একটু যেন নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস নিল এখন । আসলে স্নেহা খারাপ মেয়ে না । দেখতে এত সুন্দর যে ওদের ব্যাচের অনেক ছেলেই লাইন দিয়ে পরে আছে । তবে জানে না কেন অনির্বাণের ওকে দেখে কখনো অন্য রকম কিছুই ফিল হয়নি কখনো ! বরং ওর এই গাড়ি করে কলেজ আসা যাওয়া, সব সময় ব্র্যান্ডেড জিনিস ইউজ , কথায় কথায় নিজের বাবার পজিশনের রেফারেন্স দেয়াটা অনির্বাণের পছন্দ না । আসলে ওর শো অফ্ জিনিসটাই পছন্দ না । সেই জন্য নিজে অতো বড়ো বিজনেসম্যান এর ছেলে হওয়ার পরেও এমন ভাবে ঘুরে বেড়ায় , যে কেউই বাইরে থেকে দেখলে কিছু বুঝতে পারবে না ! খুব সহজে বাসে ট্রামে উঠে ধাক্কা খাওয়া থেকে সস্তার দোকানে চা ঘুগনি খাওয়া , একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেরা ঠিক যে রকম জিনিস গুলো করে , অনির্বাণ ও ঠিক তাই করে রোজকার জীবনে । আর সেই জন্যই বোধ হয় কলেজের অনেকে ওর আসল পরিচয়টা জানেও না বিশেষ ।
যাইহোক , সেদিন এরপর কলেজ থেকে বেরিয়ে ও একটা চলতি অটো তে উঠে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি । কারণ বাস স্টপে দাঁড়ালে আবার হয়ত স্নেহা একেবারে গাড়ি নিয়েই হাজির হবে ওর সামনে ! ইনসিস্ট করবে ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্য । তার থেকে বাবা অটো র ব্রেক জার্নিই ভালো ওর । বাড়ি পৌঁছতে একটু দেরি হবে যদিও । কিন্তু সেটা ঠিক আছে , চলবে । কথাটা ভাবতে ভাবতেই আনমনে হঠাৎ খেয়াল হলো অনির্বাণের পরিণীতার বাস টা কি গড়িয়ার দিকে যাওয়ার বাস ছিল ! ও কি নর্থ এর মেয়ে ! না কি সাউথের । তবে কথাবার্তা , একদিকে বিনুনি , সাধারণ চুড়িদার দেখে মনে তো হয় না কলকাতার মেয়ে ! তাহলে কি অন্য কোথাও থেকে এসেছে পরিণীতা ! ভিড় রাস্তায় ট্র্যাফিকের লাইনে দাঁড়িয়ে কেন জানে না আনমনে এইসব প্রশ্ন এসেই জমা হলো কেমন অনির্বাণের মনে । আর ও উত্তরহীন হয়ে বসে রইলো সূর্য অস্ত যাওয়া এক লালচে আভা ছড়ানো কলকাতায় ।
চলবে