ভালোবাসার_উষ্ণতা #দ্বিতীয়_অধ্যায় #৬ষ্ঠ_পর্ব

0
1198

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#৬ষ্ঠ_পর্ব

– আপনি এখানে?
– কেনো বলোতো? আমি আসতে পারি না?

দেরি না করে পিছনে ফিরলেই দেখতে পায় নিশান পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে নিশানকে দেখে প্রথমে প্রাপ্তি ও চমকে উঠে। প্রাপ্তিকে ঘাবড়ে যেতে দেখে নিশান জিজ্ঞেস করে,
– খুশবু, তুমি ঠিক আছো তো?
– জ্বী, আমার কি হবে?
– তোমাকে খুব টেনসড লাগছে, তাই আর কি?
– আপনি কখন এসেছেন? আমার এড্রেস কিভাবে পেলেন?
– সকালে এলাম, আর এড্রেস আমার বন্ধুই দিলো, বললো তুমি নাকি এখানে থাকছো। আসলে তুমি তো বেশ কিছুদিন হয়েছে এখানে, তাই দেখতে এলাম। অফিস যাচ্ছো বুঝি?
– জ্বী, আন্টি-আঙ্কেল কেমন আছেন?
– ভালো, তোমার গলায় কি হয়েছে?
– কিছু না, এল্যার্জি আর কি। চলুন, হাটতে হাটতে কথা বলি।

নিশান আর বেশি ঘাটায় না, প্রাপ্তিও খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে নিশানের প্রশ্নে। একবার বলতে চেয়েও থেমে যায়। শুধু শুধু নিশানকে টেনসন দেওয়ার মানে হয়। তারা দু জন হেটেই রওনা দিলো মেইন রোডের দিক। আড়াল থেকে কেউ একজন খুব নিপুন ভাবে তাদের লক্ষ্য করছিলো। প্রাপ্তির চলে যাওয়ার দিকে তার শান্ত নজর। প্রাপ্তির, নিশানের সাথে চলে যাবার পর সেও গাড়িতে বসে রওনা দেয় গন্তব্যে।

সকাল ১১.৩০টা,
প্রাপ্তি ডেস্কে বসে নতুন প্রজেক্টে কাজ করে যাচ্ছে, আজকে সাইট ভিউয়িং এর জন্য নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে অয়নের সাথে। প্রাপ্তি প্রথমে আপত্তি জানালেও আসফির উপর কথা বলতে পারলো না। মনে মনে অনেক বেশি বিরক্ত সে, কিন্তু কিছুই করার নেই। একটু পর পিয়ন এসে জানায়,
– ম্যাডাম, বস আপনাকে উনার রুমে যাইতে বলছে।
– আচ্ছা।

আসফির রুমের বাইরে দরজা নক করতেই আসফি ভেতরে আসতে বলে। সেখানে অয়ন ও উপস্থিত ছিলো। অয়নকে তোয়াক্কা না করে আসফির উদ্দেশ্যে বলে,
– স্যার, আমাকে ডেকেছিলেন।
– অহ, খুশবু আসো। যার জন্য ডেকেছিলাম, তোমাদের এখনি বের হতে হবে। অয়ন চাচ্ছিলো, সকাল সকাল সাইট ভিউ করে আসবে। আর তোমাকে একাই যেতে হবে।
– কিন্তু স্যার সেটা তো সেকেন্ড হাফ এ ছিলো।
আর আমি একা? থ্যাংক উ আমার উপর ট্রাস্ট করার জন্য বাট…
– নো বাট, আই নো ইউ ক্যান ডু ইট। সো গেট রেডি।

প্রাপ্তি আর কথা বাড়াতে পারে না। অয়নের দিকে তাকালে দেখতে পায় সে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। প্রাপ্তি রাগী লুক দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। প্রাপ্তি যাবার পর অয়ন আসফিকে বলে,
– থ্যাংক উ সো মাচ, তোমার কাছে আমি ঋণি থাকবো।
– ভাই, তোর আর সামির উপর আমার পাঁচ আনার ভরসা নেই। যাই করিস পুলিশ কেস করাইস না।
– ডোন্ট ওয়ারি। আজকে ওর আমাকে বলতেই হবে কেনো ও আমাকে চিনতে চাইছে না। এতো কিসের রাগ?
– যা ভালো মনে হয় করিস, কিন্তু একটা জিনিস মাথায় রাখিস ওর মেন্টাল কন্ডিশন কিন্তু ভালো নয়। মিসক্যারেজ হ্যান্ডেল করার মত মানসিক ক্ষমতা সবার থাকে না। সি হ্যাস বিন সাফারিং সিন্স দেন। সো টেক কেয়ার অফ হার।
– কিচ্ছু হবে না, আমি ওর কিছু হতে দিবো না।

অয়ন আসফির সাথে কথা বলে সোজা পার্কিং এরিয়াতে চলে যায়। রিয়াদকে দিয়ে এই চার মাস এ কি কি হয়েছে প্রাপ্তির জীবনে সব ডিটেইলস কালেক্ট করেছে সে। প্রাপ্তি এই চার মাস কতোটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো, কিভাবে সে নিজেকে একটি রুমে আটকে রেখেছিলো, তার এই চার মাসের প্রতিটি নির্ঘুম রাতের খোঁজ অয়ন নিয়েছে। কাল যখন প্রাপ্তি তাকে চিনতে পারছিলো না, অয়নের রাগ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো প্রাপ্তিকে নিজের কাছে আটকে রাখলে প্রাপ্তি হয়তো তাকে সত্যিটা বলবে। রাতে অচেনা লোকটি যে প্রাপ্তিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো সে আর কেউ না অয়ন। কিন্তু প্রাপ্তির গলায় কামড় দেবার সময় লক্ষ্য করে তার গলা থেকে একটু নিচ থেকে ক্ষত দেখা যাচ্ছে। প্রাপ্তিকে টোকা দিলে যে মানুষটি নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না সে প্রাপ্তির ক্ষত দাগটি দেখে নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলো না। তাই সেই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। রিয়াদকে ৭ ঘন্টার সময় দেয় যাতে খুশবুর পুরো ডিটেইলস সে বের করে৷ এবং রিয়াদ সেই কাজটি করেও। অয়ন কে রিয়াদ জানায়, প্রাপ্তি এক্সিডেন্ট এবং মিসক্যারেজের পর মানসিক ট্রমার জন্য Transient amnesia হয়েছে। তবে অয়নের ধারণা প্রাপ্তি কিছু ভুলে নি। কোনো একটা কারণে ইচ্ছে করে প্রাপ্তি নিজেকে গোপন করছে। নিজের অস্তিত্ব মানতে সে নারাজ। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গা এলিয়ে দিলো অয়ন। নিজের ভালোবাসা প্রমাণ করার উপায় তার জানা নেই। রিয়াদের কাছ থেকে সব জানতে পেরে প্রাপ্তির কাছে ছুটে যায় সে। কিন্তু অন্য একটি ছেলের সাথে প্রাপ্তিকে দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে অয়ন। প্রাপ্তিকে এবার হারিয়ে ফেললে বেঁচে থাকার আশাটুকু হারিয়ে ফেলবে সে। গাড়ির কাচে টোকা পড়ায় ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে তার। বাহিরে তাকাতেই দেখে প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে এখন আরো বেশি মাতাল করা সুন্দরী লাগে। আগে খুব কম শাড়ি পড়তো, কিন্তু এখন সব সময় শাড়ি পড়ে। চুলগুলো ঢেউ খেলে মাতাল হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে। মুখটা বড্ড শুকিয়ে গেছে, ঠোঁটের নিচের তিলটা আরো ও সুস্পষ্ট। তিলটা মাদকতা সৃষ্টি করে মনের গহীনে। মেয়েটির এমন এমন জায়গায় তিল আছে যা অয়নের শুধু নেশারঝোঁক বাড়িয়ে তোলে। মেয়েটা যেন জ্বলজ্যান্ত নেশার স্তুপ। নিজের দিকে অয়নের নেশাগ্রস্ত দৃষ্টি প্রাপ্তিকে বেশ অপ্রস্তুত করছে। সে এবার একটু দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে,
– যদি যাওয়ার ইচ্ছে না করে থাকে বলতে পারেন। আমার অহেতুক নিজের সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই।
– দরজা খোলা আছে উঠে আসুন।

মুচকি হেসে অয়ন প্রাপ্তিকে বলে। প্রাপ্তি কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসে। প্রাপ্তি বসে পড়লে অয়ন গাড়ি স্টার্ট দেয়। আপন গতিতে গাড়ি চলতে থাকে, দুইটি মানুষ পাশাপাশি কিন্তু নিশ্চুপ পরিবেশ। প্রাপ্তি আড়চোখে অয়নকে দেখে যাচ্ছে। মানুষটাকে দেখলেই মনে মোচড় দেয় তার, আচ্ছা মানুষটা ভালো আছে তো!
– লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার কিছু নেই মিস খুশবু।
দেখতে হলে সরাসরি দেখুন। চোরের মতো দেখলে আমার লজ্জা লাগবে।

অয়নের কথায় বেশ লজ্জায় পড়ে যায় প্রাপ্তি। নজর বাহিরে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,
– আপনাকে দেখতে বয়েই গেছে আমার। একজন বিবাহিত পুরুষের দিকে তাকাবো এতোটা নিচ মানসিকতা আমার নয়।
– আমার সম্পর্কে সব জানেন দেখি!
– সারা শহর জানে, আমি জানবো না। আপনার বাগদত্তা জানেন আপনি আমার সাথে আছেন এখন?
– বাগদত্তা?
– হুম, তার সাথে তো আপনার শুধু এনগেজমেন্ট হয়েছে। ওয়াইফ তো বলতে পারছি না।
– হাহাহাহা

প্রাপ্তির কথা শুনে জোরে হেসে উঠে অয়ন। অয়নকে হাসতে দেখে প্রাপ্তি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তাই জিজ্ঞেস করে,
– আপনি হাসছেন যে?
– তো কি করবো? আমার একবার ই বিয়ে হয়েছে। আমার কোনো বাগদত্তা নেই। আর সারা শহর জানে এনগেজমেন্ট আমার না ভাইয়ের ছিলো।
– হুম??
– হুম, আপনি আমার প্রাপ্তির মতো দেখতে, আপনি আমার প্রাপ্তি নন। তাই আপনাকে সিকদার ফ্যামিলির ইন্টারনাল ইস্যু আপনাকে বলতে পারবো না। তবে এটুকু জেনে রাখুন আমার কোনো বাগদত্তা নেই। আমার শুধু একটাই বউ, প্রাপ্তি।
– খুব ভালোবাসেন বুঝি?
– খুব, ও যদি বলে আমি জীবন বাজি রাখতে পারবো
– সত্যি?
– সন্দেহ আছে?
– আমি কে সন্দেহ করার? তবে হয়তো আপনার ভালোবাসায় খুত ছিলো তাই হয়তো উনি….. শুনেছি উনি মারা গেছেন।

প্রাপ্তির কথায় মুখ শক্ত হয়ে যায় অয়নের। গম্ভীর এবং রাগী কন্ঠে বলে,
– আমার প্রাপ্তি মারা যায় নি, রেগে আছে শুধু। যেদিন আমি ওর রাগ ভাঙাতে পারবো ও আবার আমার আছে চলে আসবে।

প্রাপ্তি আর কোনো কথা বলে না, অয়নের রাগ সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। কিন্তু অয়ন কি সত্যি তাকে এতোটাই ভালোবাসে! যদি ভালোবাসতো তবে কি তাকে এতো ছলনার মাঝে রাখতো! একবার তাকে খুঁজার চেষ্টা করতো না! তার অবর্তমানে অন্য একটি মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতায় জড়াতো! যদিও তার এনগেজমেন্ট হয় নি কিন্তু এগুলো তো এড়ানো যায় না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে তার হুশ থাকে না প্রাপ্তির।।

রাত ৯ টা,
মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাপ্তি এবং অয়ন। কাজ শেষে ঢাকার পথে রওনা দেয় তারা। কিন্তু মাঝ রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় অয়নের।
একে তো রাত উপর থেকে নাস্তায় তেমন ট্রান্সপোর্ট ও নেই যাতে তারা ঢাকায় যেতে পারে। উপায়ন্তর না দেখে অয়ন প্রাপ্তিকে বলে,
– আমার ভিলা পাশেই আছে, বেশি না বিশ মিনিটের রাস্তা। তোমার আপত্তি না থাকলে আমরা সেখানে থাকতে পারি।
– আপনার মাথা ঠিক আছে? আমি বাসায় যাবো ব্যাস
– কিভাবে যাবা? না তুমি আমাকে বলো কিভাবে যাবা? ওয়ে থাকলে আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যেতাম কিন্তু উপায় কোথায়?
– আর কোনো ওয়ে নেই?
– নাহ, এতোরাত আমি মেকানিক পাবো না, কাল সকাল অবধি এখানে থাকার থেকে ভিলায় আরামসে থাকাটা অনেক বেশি ভালো বলে আমার মনে হয়। আর বৃষ্টি আরম্ভ হবে এখুনি। তুমি থাকতে চাইলে আমার সমস্যা নেই। তবে আমি এখানে রাত কাটাবো না।
– ঠিক আছে, ঠিক আছে। চলুন।

অয়ন মুচকি হেসে রাস্তায় হাটা শুরু করলো। প্রাপ্তিও পিছু পিছু ধীর পায়ে হাটতে লাগলো। ভিলায় পৌছাতে পৌছাতে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গগণ বিদারী আওয়াজে মেঘ ডাকছে। ভিলায় যেয়ে প্রাপ্তিকে একটি রুম দেখিয়ে দেয় অয়ন। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় প্রাপ্তি। বৃষ্টির ছিটা প্রাপ্তির মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। আজ প্রাপ্তির মাঝেও উম্মাদনার ছোয়া লেগেছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করতে। ঠান্ডা বাতাস আরো উম্মাদনার সৃষ্টি করছে। আজ ভিজতে ইচ্ছে করছে প্রাপ্তির, মন উজাড় করে বৃষ্টির কাছে নিজেকে সপে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই আর নিজেকে না আটকে ছাদের দিকে রওনা দেয় সে।

বেশকিছুক্ষণ ভেজার পর এক জোড়া উষ্ণ হাত তাকে পেছন থেকে আলিঙ্গন করে। শীতল শরীরে উষ্ণ হাতটি যেনো ভালোবাসার উষ্ণতা প্রাপ্তির প্রতিটি লোমকোষে পৌছে দিচ্ছে। পেছনে ফিরতেই দেখে নেশাগ্রস্ত চোখে অয়ন তাকে দেখছে। অয়নের কাছে প্রাপ্তিকে কোনো অপ্সরার চেয়ে কম লাগছে না। ভেজা ঠোঁট জোড়া ছুয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা তাকে মাতাল করছে। মাঝে মাঝে পুরুষের পক্ষে নিজেকে আটকএ রাখা যা বড্ড কঠিন। নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টায় অয়ন হার মেনে নেয়। প্রাপ্তি ও যেনো একটা ঘোরের মাঝে আছে, আজ বৃষ্টি যেন মাতাল করে তুলেছে দুইটি হৃদয়কে। অয়ন প্রাপ্তির নিজের খুব কাছে নিয়ে আছে। শুধু দুজনের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি আর প্রকৃতির মাতাল শব্দ শুনা যাচ্ছে। অয়ন প্রাপ্তির কাছে আসতেই……

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here