ভালোবাসার_উষ্ণতা #সূচনা_পর্ব

0
1953

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

পেটে কারো স্পর্শ পেতেই গা শিরশির করে উঠলো প্রাপ্তির। চোখে ঘুমের সাগর এসে ভর করায় চোখ খুলতে পারছে না। রাত যে বেশ হয়েছে এটা বুঝতে বাকি নেই, এতো রাতে তার ঘরে কারোর আসা সম্ভব নয়। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছে, কেউ তার ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। চোখ খুলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না, চিৎকার করছে; কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। ব্যাক্তিটির হাত তখন প্রাপ্তির সারা শরীরে স্পর্শ করছে। একটা সময় পর তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। প্রাপ্তি আপ্রাণ চেষ্টা করছে নড়তে; এই বাঁধন থেকে বের হতে চাইছে কিন্তু পারছে না। অজানা ব্যক্তিটি কে?

সকাল ৭ টা,
ঘুম ভাঙলে প্রথমেই আশেপাশে নজর ঘোরালো প্রাপ্তি, নাহ কেউ ঢুকে নি তার ঘরে। দরজাটাও ভেতর দিয়ে বন্ধ। শুধু তার পাশের বিছানা চাদরটা খানিকটা কুচকানো, এই বাদে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা না। বেশ কিছুক্ষণ মাথাটা দু হাত দিয়ে চেপে বসে থাকলো, রাতে যা হয়েছে তা কি স্বপ্ন ছিলো! তবে কি সে ঘোরে ছিলো! মাথাটা বন্ধ বন্ধ লাগছে, সাওয়ার নিলে হয়তো ভালো লাগবে। ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আৎকে উঠলো প্রাপ্তি। খেয়াল করে দেখতে পেলো তার গলার খানিকটা নিচে বুকের ঠিক উপরে কিছুটা জায়গা লাল হয়ে আছে। এর মানে কি!! ভয়ে হাত পা জমে গিয়েছে। বাস্তব এবং স্বপ্নের ভেতরে নিজেকে যেন আটকে ফেলেছে প্রাপ্তি; কিছুতেই বের করতে পারছে না। এ নিয়ে এই সপ্তাহে তিন বার এমন হলো। শাওয়ার নেওয়ার পরও মনকে শান্ত করতে পারছে না কিছুতেই। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ঘড়ির বড় কাঁটাটা আটটার উপর বসে আছে। আটটা বেজে গেছে, আবরারের খাবারের সময় হয়ে এসেছে। তার সামনে যেতে না পারলেও লোকটাকে প্রতিদিন খাবার নিজের হাতে বানিয়ে খাওয়ায় প্রাপ্তি।

সিকদার ভিলায় আজ তিন মাস হয়েছে বিয়ে হয়ে এসেছে সে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে চাচাদের বাড়িতে মানুষ হয়েছে; আঠারো বছর হতে না হতেই চাচা-চাচীর ঘরে যেনো বোঝা হয়ে গিয়েছিলো। এই সিকদার বাড়ির বড় ছেলে আবরার সিকদারের সাথে তার বিয়ে হয় তিন মাস আগে। আবরার যেনো নামেই প্রাপ্তির হাসবেন্ড, এই পর্যন্ত প্রাপ্তি তাকে দেখি নি। কারণ সে বরাবরই অসুস্থ থাকে। প্রাপ্তি যতটুকু শুনেছে, একবার তার অনেক ভয়াবহ একটি এক্সিডেন্ট হয়, এক্সিডেন্টের পর থেকে আবরার আর হাটতে পারে নি, তার শরীরের বেশ খানিকটা অংশ এবং মুখের বেশ খানিকটা অংশ পুড়ে গেছে। বাসর রাতে প্রথম প্রাপ্তির সামনে এসেছিলো সে। সেদিন ঝড় বৃষ্টির রাত ছিলো, খুব জোরে জোরে আকাশ ডাকছিলো, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো। এমনিতেই বিদ্যুৎ চমকানো প্রাপ্তির ভয় লাগে। প্রচুর গা ছমছম করছিলো তার; তাই হুট করে আবরারকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলো। তার পর থেকে প্রাপ্তির সামনে আসে নি আবরার। প্রাপ্তি তাকে ভালোভাবে দেখেও নি, বারবার ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু তাতে তার রাগ পড়ে নি। যখনই প্রাপ্তির সাথে কথা বলে রুমের লাইট অফ করে তারপর কথা বলে যাতে প্রাপ্তি তাকে না দেখতে পারে। এতো কিছু জানা সত্ত্বেও প্রাপ্তি এই বিয়েতে রাজি হয়, না না রাজি হতে বাধ্য হয়। চাচার ব্যবসা ভালো চলছিলো না, প্রচুর টাকার প্রয়োজন ছিলো। উপরে প্রাপ্তি যেনো তাদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছিলো। তাই এই বাড়ির ছোট ছেলে অয়ন সিকদার মোটা অংকের টাকা দিয়ে প্রাপ্তিকে নিজের ভাইয়ের দেখভালের জন্য কিনে নিয়েছে। ভদ্র ভাষায় তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। এই বাড়িতে শুধু এই দুই ভাই আর অনেক কাজের মানুষ রয়েছে। প্রাপ্তি যতটুকু শুনেছে, আবরারের মা-বাবা খুব ছোটবেলায় মারা যান। আরেকটি ভাই ও আছে কিন্তু সে এখানে থাকেন না। এই পরিবারের সবকিছুই প্রাপ্তির অদ্ভুত লাগে, মনে হয় হাজারো রহস্য ঘিরে রয়েছে এই বাড়ির আনাচে কানাচে।

প্রাপ্তির হাতের ভুনা খিচুড়ি আবরারের খুব প্রিয়, আজ শুক্রবার তাই প্রাপ্তি ঠিক করলো সে খিচুড়ি রান্না করবে। রান্নাঘরে তিন-চারজন কাজের মানুষ আছে। বড়লোক হওয়ার এটাই উপকার, নিজেদের কিছুই করতে হয় না। কিন্তু প্রাপ্তির এই বিলাসিতা পছন্দ নয়। তাই নিজ হাতে সব করতে পছন্দ করে সে। রান্নার মাঝে মনে হতে লাগলো কেউ যেন ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। আচমকা এমনটা হওয়ায় ঘাবড়ে পেছনের দিকে সরে যায় প্রাপ্তি। পেছনে তাকিয়ে যা দেখলো তাতে আরো ভয়ে জমে গেলো সে। এতোক্ষন অয়ন খুব নিখুঁতভাবে প্রাপ্তিকে পর্যবেক্ষণ করছিলো, কখন যে ধীরে ধীরে প্রাপ্তির কাছে চলে আছে এটা নিজেও খেয়াল করে নি। প্রাপ্তির অয়নকে খুব ভয় লাগে। ওর চাহনি যেন বিপদের সংকেত দিতে থাকে, আবার নিজের দিকেও খুব আকর্ষণ করে। প্রাপ্তি কিছুতেই বুঝে উঠে না, এই লোকটার ভেতর কি এমন আছে যা প্রাপ্তিকে নিজের দিকে টানে। তুড়ির আওয়াজে ঘোর কাটে প্রাপ্তির। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর নীল টিশার্ট গায়ে, পকেটে হাত দিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অয়ন। ধীরে ধীরে প্রাপ্তির দিকে এগুতে থাকলে প্রাপ্তি পেছাতে থাকে ওয়ালের দিকে। রান্নাঘরে ওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে প্রাপ্তি থেমে যায়, ওদিকে অয়ন খুব কাছে চলে আসে প্রাপ্তির। কোমরে হাত দিয়ে হ্যাঁচকা টানে নিজের একেবারে কাছে নিয়ে আসে প্রাপ্তিকে সে৷ ভয়ে প্রাপ্তির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে একটা ধুকপুকানি লেগে আছে। ঠিক ভুলের মাত্রা হারিয়ে ফেলেছে। কানের কাছে মুখ লাগিয়ে অয়ন বলতে থাকে,
– এভাবে পেট দেখিয়ে চললে, কি পুরুষের মন জয় করা যায়? কে বলবে তোমার স্বামী মানে আমার ভাই অসুস্থ? তুমি কি ভাবো আমি বুঝি না, সকাল সকাল এতো রুপ দেখিয়ে কাকে বশ করতে চাইছো? তোমার মত মেয়েরা যদি ন্যাংটা হয়ে আমার সামনে হেটে বেড়ায় তাতে এই অয়ন সিকদার পটবে না।

বলেই একরকম ধাক্কা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লো অয়ন। অয়নের এই খারাপ ব্যবহার গুলো একেবারে নিতে পারে না প্রাপ্তি, কি এমন পাকা ধানে মই দিয়েছে তার। সব কিছুতে শুধু কিভাবে প্রাপ্তিকে নিচু দেখাবে সেটাই যেন একমাত্র কাজ অয়নের। প্রাপ্তির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, নিজেকে শান্ত করতে চাইছে কিন্তু হয়ে উঠছে না। আজ হয়তো বাবা-মা থাকলে এগুলো তাকে সহ্য করতে হতো না।

অপরদিকে,
আবরারের রুমে বসে আছে অয়ন। অক্সিজেন লাগানো অবস্থাতে শুয়ে রয়েছে আবরার। দিন পাঁচেক শরীরের অবস্থাটা ভালো নেই তার। ডাক্তার ইহরাম হক বলেই দিয়েছে, আবরারের বেঁচে থাকার ইচ্ছে টুকু নেই। একারণে তার রিকোভারির চান্স খুব কম। আবরারের ডান হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে চোখের পানি ফেলে দিলো অয়ন।
– ভাই তুমি কমে সুস্থ হবে? তুমি কি সত্যি সেরে উঠবে না?? আজ যাদের জন্য তোমার এই হাল আমি তাদের নাকানিচোবানি খাওয়েছি, এখন মৃত্যুর অপেক্ষা করছে কেবল তারা।
-….
– ভাই, আমার তুমি বাদে কেউ নেই, আবীর খুব প্রেসার দিচ্ছে বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের। ওর ধারণা ও চাইলেই কোম্পানি সি.ই.ও হয়ে যেতে পারবে। আমি তা কিছুতেই হতে দিবো না। যেটা তোমার সেটার তোমার ই থাকবে। আর সিকদার পরিবারের সামনের উত্তরাধিকার যাতে দ্রুত আসে আমি সেই ব্যবস্থাই করছি।
– অয়ন বাবা, মেয়েটা তো সত্যিটা জানেই না!

সিকদার বাড়ির বিশ্বস্ত লোকমান কথাটা বলতেই অয়নের চোখ মুখ কুচকে যায়। রাগে মাথার রগ ফুলে উঠেছে। কঠিন গলায় বলে,
– ওই দু টাকার মেয়ের সত্যিটা জানার প্রয়োজন ও নেই। ওর কাজ আমাদের উত্তরাধিকার দেওয়ার। যতদিন ভাইয়ের সুস্থতা প্রমান না হবে ততদিন মেয়েটার এই বাড়িতেই থাকতে হবে।
– কিন্তু, ও তো
– একটা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার টুল মাত্র। আপাতত অনেক কিছু সামলাতে হবে। ওই টাকার লোভী মেয়েটাকে নিয়ে না ভাবলেও চলবে লোকমান কাকা।

দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে অয়ন চুপ করে যায়। বাইরে প্রাপ্তি দাঁড়ানো, হাতে সকালের নাস্তা।
– শুনছেন, আমি আপনার খাবার এনেছি। আপনার যা যা পছন্দ সব বানিয়েছি। শুনছেন।

প্রাপ্তির কথা শুনে লোকমান কাকাকে ইশারা করে অয়ন। দ্রুত লোকমান কাকা দরজাটা খুলে খাবার গুলো নিয়ে দরজা দিয়ে দেয়। প্রাপ্তিকে কোনো কথা বলার সুযোগ টুকু দেয় না লোকমান কাকা। দরজার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজের রুমে চলে যায় প্রাপ্তি। এটা তার নসিব, তার ভাগ্যে হয়তো সুখটা থাকে না।

রাত ১০টা,
প্রাপ্তি বিছানা করে শুয়ে পড়েছে। সারাদিন অয়ন কিংবা আবরারের সাথে কথা হয় নি। একা একা রুমে কাটিয়েছে। দরজাটা আটকিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে প্রাপ্তি। এ বাড়ির রহস্যগুলো মাথায় যেন একেবারেই ঢুকে না; প্রাপ্তির মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে মন চায়। কিন্তু যাওয়ার জায়গাও নেই। এখানে তবু আরামে আছে, চাচার বাড়ি চাচির মার সহ্য করার থেকে ঢের ভালো। ভাবতে ভাবতেই ঘুমের জগতে পাড়ি দেয় প্রাপ্তি। মাঝ রাতে আবার কারোর উপস্থিতি অনুভব করতে লাগে প্রাপ্তি। কেউ তার গলায় স্পর্শ করছে, গরম নিঃশ্বাস যেন বুকের ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। খুব করে চাচ্ছে যাতে চোখটা খুলতে পারে কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছে না। অচেনা ব্যক্তিটি যখন পায়জামায় হাত দিতে নিয়েছে অমনি…

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here