ভালোবাসার_উষ্ণতা,04,05

0
742

#ভালোবাসার_উষ্ণতা,04,05
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৪র্থ_পর্ব

ধীরে ধীরে প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে কি মনে করে নিজেই থেমে যায়। মস্তিষ্ক আর মনের যুদ্ধে আহত সৈনিকের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অয়ন। সুপ বানিয়ে পেছনে ফিরতেই খানিকটা ভয় পেয়ে যায় প্রাপ্তি। অয়ন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাই নিজের বড় ভাই এর জন্য জীবনটাও বাজি ধরতে পারে অথচ আজ পরাজিত সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে আছে যেখানে আবরারের অবস্থা ভালোর দিকে।
– কিছু লাগবে?

প্রাপ্তির কথায় মাথা তুলে বেশ কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে অয়ন। আজ অয়নের চোখে কোনো ক্ষোভ দেখতে পাচ্ছে না প্রাপ্তি। বরং কিছু চাপা কষ্ট বুকের মাঝে আগলে রাখার প্রমাণ দিচ্ছে এই চোখ জোড়া। প্রাপ্তি অয়নের কাজ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে আপনার? কিছু লাগবে?

প্রাপ্তির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে অয়ন, যেন ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে। অয়নের পাগলামি আগেও দেখেছে প্রাপ্তি। এই বান্দার কাজের যে কোনো ঠিক ঠিকানা নেই খুব ভালো করেই জানা তার। তাই শান্ত ভাবেই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। অয়ন বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে একটা কথাই বললো,
– নিজেকে পরাজিত লাগছে, মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে আমি আজ পরাজিত।

বলেই প্রাপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো। প্রাপ্তি কিছুক্ষণ বোকার মতো অয়নের যাবার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এই লোক কখন কি করে, কেনো করে তার কোনো ঠিক নেই। ভেবে মাথাটার বারোটা বাজবে এছাড়া লাভের লাভ কিছুই হবে না। প্রাপ্তি সুপ নিয়ে আবরারের রুমে প্রবেশ করলো। আবরারকে এখন নল দিয়েই খাবার দেয়া হবে, মুখ দিয়ে খেতে সময় লাগবে। এখনো সে কোনো কথা বলে নি। শুধু তাকিয়েই ছিলো, তবে রেসপন্স করছে। ঘুমের ঔষধ নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে তাকে। কি এমন হলো যে, এতোটা খারাপের দিকে চলে গেলো বুঝতে পারছে না প্রাপ্তি। আবরারের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। খুব শান্ত লাগছে তাকে, মুখের বা পাশটা পুড়ে গেছে এক্সিডেন্টে। যতদূর শুনেছিলো আবরারের ৬০ শতাংশ শরীর পুড়ে গিয়েছিলো। এ যাবৎ চার বার সার্জারী হয়েছে। এটা প্রাপ্তিকে জানানো যে হয়েছিলো তা কিন্তু নয়। এ বাড়ির কাজের লোকদের কানাগুসাতে সে জানতে পারে। এই জন্য হয়তো বাসর রাতের দিন এতো ভয় পেয়েছিলো। আবরারের অবস্থা ভালো হলে ইউ.এস.এ এর ক্যালিফোর্নিয়াতে পাঠিয়ে দিবে অয়ন তাকে। প্রাপ্তির এসব কিছুই জানা নেই। জানার সুযোগ সে কখনো পায় নি আর চেষ্টা সে করে নি। আজ নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে এই লোকটার দেখভাল তার দায়িত্ব ছিলো অথচ সে কিছুই করে নি। এসব ভাবতে ভাবতেই আবরারের পাশে ঠায় বসে থাকে সে।।

রাত ৮টা,
স্থানঃ জার্মান ক্লাব, গুলশান।
একের পর এক হুইস্কির বোতল শেষ করে যাচ্ছে অয়ন। মনকে শান্ত করাটা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এমনটা হোক এটা তো এতোদিন দোয়া করতো তবে আজ কি হলো। নিজের আবেগগুলো কেনো আজ বেসামাল হয়ে পড়েছে। তবে কি ভেতরে থাকা বরফ কঠিন হৃদয় উষ্ণতার আভা পেয়েছে? তার কাঠিন্য হৃদয়ে কি তবে অনুভূতির বীজ রোপিত হয়েছে?
– লিভারটা তো খেয়ে ফেলবি রে এভাবে মদ খেলে! আর কত খাবি?

পাশে বসতে বসতে সামি বলে উঠে। সামি অয়নের খুব বিশ্বস্ত বন্ধুদের একজন। অয়নের এ টু জি সব খবর সামির জানা। আজ অয়ন মুখে কিছু না বললেও সামি খুব ভালো করেই জানে অয়নের মন যে খারাপ এবং সে নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করে চলেছে। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠে,
– ভাই এখনো ওই মেয়েকে ভালোবাসে।
– ও, তো?
– তো মানে? ওই মেয়েটা তো আমার
– তোর কি? বউ? ওটা তো শুধু কাগজের, আর মেয়েটাও জানে সে আবরার ভাইয়ের বউ। আর তুই তো ওকে অন্য একটা কারণে বিয়ে করেছিলি! নাকি এখন তোর লক্ষ্য বদলে দিয়েছিস? নাকি তুই এখনো মেয়েটাকে ভালোবাসিস?
– কি যা তা বলছিস?
– আমি কিছুই বলছি না। তোর মনের খবর তো তুই জানবি! আমি তো যা দেখতে পারছি তাই বলছি। তোর আজ খুশি হবার কথা অথচ তুই আজ মদ খেয়ে নিজের কষ্টটাকে লুকোচ্ছিস। কেনো কষ্ট হচ্ছে? এজন্য না যে, ভাই যদি জানে তার ভালোবাসাকে তুই বিয়ে করেছিস তখন তোকে ভুল বুঝবে। এজন্য যে তুই যাকে বিয়ে করেছিস সে তোর ভাইয়ের ভালোবাসা।
– তোর ফালতু কথা শোনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই।
– তাই?
– হ্যা, আমি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছি ওর প্রাপ্য শাস্তি তাকে দিতে পারি।
– তাহলে দে, মানা কে করেছে।
– ভাই তো
– ভাই এখনো অসুস্থ, তার জন্য কোথাও না কোথাও মেয়েটা কিন্তু দায়ী। আর আমাদের হাতে সময় কিন্তু নেই বললেই চলে৷
-…
– দূর্বলতা খুব খারাপ জিনিস, কারোর প্রতি দূর্বল হয়ে গেলে সে লক্ষ্য থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলে। বাকিটা তোর উপর।

সামির কথাগুলো যেনো অয়নের ঔষধের ন্যায় কাজ করেছে। সত্যিই তো, তার ভাই এর এই অবস্থার জন্য প্রাপ্তি দায়ী। প্রাপ্তি তার প্রাপ্য শাস্তি তো পেতেই হবে।

রাত ১১টা,
আজ কাজের লোকেদের হাতের খাবার প্রাপ্তি খায় নি। নিজেই রান্না করেছে, রান্না শেষে খেয়ে খাবার গুলো গুছাচ্ছিলো। হুট করেই অয়নের কথাটা মনে পড়ে, লোকটা সেই বিকেলে বেরিয়েছে এখনো বাড়ি ফিরে নি। আচ্ছা, লোকটা খেয়েছে তো? পরমূহুর্তে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিলো মাথা থেকে। ওর চিন্তা করার লোকের অভাব নেই। অহেতুক নতুন করে কারোর চিন্তা করা লাগবে না। এই তিন মাসে কম মেয়েকে তো বাড়িতে আনে নি। দেখা যাবে মদ খেয়ে কোনো নারী সঙ্গে লিপ্ত আছে। খাবার গুলো রাখা শেষে রুমের দিকে যেতে লাগলেই কলিং বেলটা বেজে উঠলো।

দরজাটা খুলতেই দেখে অয়ন অপাশে দাঁড়িয়ে আছে। শার্টের ইন নষ্ট হয়ে আছে, চুল এলোমেলো। আজও ছাইপাশ খেয়েছে এটা বুঝা খুব কঠিন নয়। ঢুলু ঢুলু চোখে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে রয়েছে অয়ন। তার কাছে এই মূহুর্তে প্রাপ্তিকে কোনো অপ্সরার থেকে কম মনে হচ্ছে না। মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে রয়েছে, পাতলা ঠোঁট জোড়া যেনো গোলাপের ভেজা পাপড়ির ন্যায় লাগছে। ফর্সা নাকটায় ঘামের বিন্দু গুলো স্পষ্ট। ওড়না মাজায় বেধে রেখেছে। পুরো যেনো পাকা গিন্নি তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একবার ইচ্ছে করছিলো ঠোঁট জোড়া ছুয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে আটকে রেখে রুমের দিকে রওনা দিলো অয়ন।

প্রাপ্তি বিকেল থেকেই অয়নের পরিবর্তন লক্ষ্য করে যাচ্ছে। আজ অয়নকে বড্ড অন্যমনস্ক লাগছে প্রাপ্তির। কি এমন হলো তার? বিছানাতে শুয়েও কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিজেকে। আচ্ছা এতো কেনো ভাবছে অয়নের জন্য সে? অয়ন যে কিনা পদে পদে তাকে অপমান করতে পিছ পা হয় না।
এসব ভাবতে ভাবতেই হুট করে দরজার খুট খুট শব্দ শুনতে পায় প্রাপ্তি। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে বুঝতে পারে তার দরজার লক কেউ খুলছে। প্রাপ্তি বুকে কামড় পড়ে যায়, এই রাতে কে আসবে তার রুমে? খুট করে দরজা খুলে কেউ ভেতরে আসে। প্রাপ্তির পিঠ দরজার দিকে ছিলো বলে মানুষটার চেহারা সে বুঝতে পারে নি। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। অচেনা ব্যাক্তিটি তখন…..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#৫ম_পর্ব

অচেনা ব্যাক্তিটি তখন প্রাপ্তির কাঁধ হাত রাখে। এতোদিন যা হচ্ছিলো তা প্রাপ্তির কল্পনা কিংবা স্বপ্ন ছিলো না। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি সে। এখন যদি ব্যাক্তিটিকে না আটকাতে পারে, তবে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। অন্ধকার ঘরে কি হতে যাচ্ছে তার আভাষ পাওয়া এতো কঠিন কিছু না। বিছানার সাইড টেবিলের টেবিল ল্যাম্পের সুইচ প্রাপ্তির হাতের খুব কাছে। লোকটি যখন প্রাপ্তিকে গভীরভাবে স্পর্শ করার কাজে মেতে উঠে তখন ই সুইচটা লাগিয়ে দেয় প্রাপ্তি। দেরী না করে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লোকটিকে ধাক্কা মেরে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় যা চোখে পড়লো তাতে খুব বড় ধাক্কা খায় প্রাপ্তি।
– এতো রাতে আমার রুমে কি করছেন আপনি?

ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুঁই ছুঁই, মুখোমুখি বসে আছে প্রাপ্তি আর অয়ন। হ্যা অচেনা ব্যক্তিটি আর কেউ নয় অয়ন। অয়ন ভেবেছিলো প্রতিদিনের মতো ঘুমের ঔষধের ডোজ কাজে দিবে এবং প্রাপ্তি ঘুমের অতল গভীরে থাকবে। কিন্তু আজকে প্রাপ্তি খাবারটা নিজে বানিয়ে খেয়েছে এটা অয়নের জানা ছিলো না। লাইটটা জ্বলতেই অয়ন খানিকটা ঘাবড়ে উঠে। প্রাপ্তি একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে চলছে। অয়ন কোনো কথা না বলে বিছানায় মাথা নিচু করেই বসে ছিলো।
– কি হলো? কিছু জিজ্ঞাসা করছি তো নাকি?? মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন কেন? আমি তো সম্পর্কে আপনার ভাবি হই, অন্তত আমার সম্মানের কথাটুকু না ভাবেন নিজের ভাইয়ের কথাটুকু তো ভাববেন। নাকি সেটা ভাবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না?

অয়ন শূন্য দৃষ্টিতে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। অয়নের শূন্যতা প্রাপ্তিকে ভাবাতে বারংবার বাধ্য করছে। কিন্তু পর মূহুর্তে অগ্নিরুপ ধারণ করে বলতে লাগলো,
– তিন মাস ধরে আপনাকে সহ্য করে যাচ্ছি, মুখ বুঝে আপনার অন্যায় গুলো মেনে নিচ্ছি বলে এটা ভাববেন না, যে সামনেও তাই হবে। এমন কিছু করার কথা চিন্তাতেও আনবেন না৷ যা আমার চরিত্রে কালিমা লেপে দেয়। আমি কিন্তু বরদাস্ত করবো না। আমার চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যাবেন এবং এই মূহুর্তে।
-……
– আপনি নির্লজ্জ জানতাম, কিন্তু এতোটা নিচ কল্পনায় ও আসে নি। এতোদিন আমার সাথে যা যা হতো তার মানে তা আপনি করতেন। আমি নিজেকে পাগল ভাবতে লেগেছিলাম আপনার জন্য। আমি যে একটা কথাও ভুল বলছি না তা আপনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। কি হলো মুখে কথা নেই কেনো আজ?
-…..
– আপনি আসলে সব লোকদেখানো করেন। এই যে ভাইকে ভালোবাসা এসব সব নাটক। আপনি আপনার ভাইকে ভালোবাসলে এই রাতের অন্ধকারে আমার রুমে এসে নিজের ভাইয়ের বিশ্বাসকে এভাবে ভাঙ্গতে দিতেন না।

প্রাপ্তির কথাগুলো ছুরির মতো অয়নের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করছে। আজ সে কোনো খারাপ মতলবে আসে নি; শুধু প্রাপ্তিকে জড়িয়ে ঘুমোতে চেয়েছিলো। তার সে আজ বড্ড উষ্ণতার প্রয়োজন ছিলো। প্রাপ্তি এই তিনটি মাসে অয়নের নেশা কিংবা অভ্যাস যাই বলা হোক তাতে পরিণত হয়েছিলো। রোজ রাতে প্রাপ্তি যখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকতো, অয়নের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে সে লক খুলে এই রুমে আসতো। কখনো তাকে দেখতে তো কখনো তার পাশে ঘুমোতে। এই দুই সপ্তাহ প্রাপ্তির ঘুমের ঔষধের ডোজ বাড়িয়ে দিয়েছিলো যাতে প্রাপ্তির অজান্তেই তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারে। এতে এক দিকে যেমন সিকদার বাড়ির উত্তরাধিকার আসবে অপরদিকে প্রাপ্তির সম্মানহানির সাথে সাথে সে মানুষিকভাবে ভেঙে পড়বে। কিন্তু যতবার প্রাপ্তির কাছে এসেছে ততোবার বিবেকের তাড়নায় ব্যর্থ হয়েছে। প্রাপ্তির নিস্পাপ মুখ যে কোনো বারবার বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর আজ আবরারের সুস্থতার অগ্রগতি তাকে এই প্লান স্কিপ করতে বাধ্য করেছে। তবু আজ প্রাপ্তির কথাগুলো কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো কাজ করছে। নাক মুখ খিঁচে বললে লাগলো অয়ন,
– বড্ড বেশি বুলি ফুটেছে দেখি! জবান তো না যেনো কেঁচির মতো চলছে।
– এবার হাত চলতে বাধ্য হবে।

প্রাপ্তির সাহস আর কথার ভঙ্গিতে তড়িৎ গতিতে রেগে যায় অয়ন। আচমকা খুব কাছে চলে আসে প্রাপ্তির, কোমড় চেপে নিজের কাছে টেনে নেয় তাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে লাগে,
– চালাও হাত, আমিও দেখি তুমি কতোটা সাহসী।

অতর্কিত কাছে আসার কারণে প্রাপ্তি যেন জমে যায়, ফ্যালফ্যাল নয়নে অয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু। প্রাপ্তির রেসপন্স না পেয়ে অয়ন পুনরায় বলতে লাগে,
– কি হলো? সাহস উবে গেলো। তোমাদের মতো মেয়েরা টাকার গন্ধে ছেলেদের বিছানায় যেতে দুবার ভাবে না। অথচ এখন সতী সেজে বসে আছো। আমার ভাই সিকদার বারির বড় ছেলে বলেই তুমি যে তাকে বিয়ে করেছো এটা আমার অজানা নয়। তাই চরিত্রে কালিমা লেপে দেয়ার কথাটা তোমার মুখে মানায় না। আরে তোমার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে আমাকে পাওয়ার জন্য হাসফাস করে। আর আমি কিনা যাক গে। মদের নেশায় ভুলে এ রুমে চলে এসেছি। তোমার মতো নোংরা মস্তিষ্কের কাউকে আমার ঘরে আসতে ঢুকতে দেই না, মনের ঘরে কথাতো অনেক দূরের। আগে একবার বলেছি, তুমি নগ্ন আমার সামনে দাঁড়ালেও আমি ফিরে তাকাবো না। এই নারীর দেহে অয়ন সিকদারের না কোনোদিন মোহ ছিলো না হবেও না। নারীরা পারে শুধু ছলনা করতে, হয় দেহ নিয়ে নয় রুপ দিয়ে।

বলেই রুম থেকে গটগট করে বেরিয়ে গেলো অয়ন। প্রাপ্তির চোখ থেকে অশ্রুধারা যেনো থামতেই চাইছে না। বারবার চোখ মুছছে লাভ হচ্ছে না। লাল চোখগুলো বড্ড অবুঝ হয়ে পড়েছে। এর আগেও অয়ন তাকে অপমান করেছে। কিন্তু আজ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছিলো। এই লোকটা কি চায়! কি এমন করেছে সে, বারবার তাকে এভাবে হেনস্তা হতে হয়। অজান্তে আজ পর্যন্ত কাউকে কষ্ট দিয়েছে বলে জানা নেই তার। অথচ বারবার তার অপমানিত হতে হয়। পাশাপাশি দুটো রুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে দুটো মানুষের নির্ঘুম রাত্রি যাপন। চোখে ঘুমের রেশটুকু নেই। একজনের চোখের পানি বাধ মানছে না, তো আরেকজনের সুপ্ত কষ্টগুলো এলকোহল আর নিকোটিনের আড়ালে মাটি চাপা দিচ্ছে।

সকাল ৮ টা,
ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি নারী ও পুরুষ। গতকালের ঘটনার পরে এখন অবধি তারা কেউ কারোর সাথে কথা বলে নি। সকালে আবরারের রুমে একবার ঢু দিয়েছিলো, লোকমান কাকা জানিয়েছেন উনি ঘুমোচ্ছে। তাই প্রাপ্তি কথা বাড়ায় নি। ডাইনিং টেবিলে আসতে না আসতেই অয়নের সাথে দেখা। মুখ খিঁচিয়ে নাস্তা করতে বসে প্রাপ্তি। অয়নের চোখের নিচের কালি আর লাল চোখ দুইটি নির্ঘুম রাত কাটানোর প্রমাণ দিচ্ছে। নাস্তা করার মাঝখানে অয়নের ফোন বেজে উঠে। নামটি দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় অয়নের। না চাওয়া সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করে সে। অপাশ থেকে কিছু বলতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায় তার। ফোন রাখার পর প্রাপ্তিকে বলে উঠে,
– তুমি কাল থেকে ভার্সিটি যাওয়া শুরু করবে তুমি।
– আমি?
– হ্যা, কেনো কোনো অসুবিধা?
– না, তা নয় কিন্তু আমি পড়াশুনা ছেড়েছি বছর হবে। ইন্টারের পর আর সুযোগ হয়ে উঠে নি।
– সেটা সমস্যা নেই, আমি দেখে নিবো। ভাইয়ের বউ মূর্খ হলে তো সমস্যা। আর দাদীমা চাচ্ছিলেন তোমার নামে কিছু শেয়ার লিখে দিবেন।
– দাদীমা?
– আমাদের যিনি পেলেছেন। তিনি একেবারেই চান না ভাই এর পজিশন অন্যকারোর হাতে যাক। আমি কালকে এইটার ব্যবস্থা করে দিবো। রেডি হয়ে থাকা হয় যাতে।
– ঠিক আছে।
– তোমার কাকা বেশ কিছুদিন ধরে তোমাকে দেখতে চাইছিলেন। আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত।

চাচাবাড়ির কথা শুনে ভয়ে জড়সড় হয়ে উঠে। প্রাপ্তির এ বছর বিশ বছর হতে চলেছে। প্রাপ্তির বাবা, সোলেমান শেখ ছিলেন খুব নামকরা ব্যাবসায়ীদের একজন। শেখ মার্কেন্টাইল এন্ড কো এর তখন রমরমা অবস্থা। একদিন স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। হাইওয়েতে আচমকা একটা ট্রাক সামনে চলে আসে। ব্রেক তৎক্ষনাৎ কাজ না করায় গাড়িটিকে পিছে ফেলে ট্রাক। শেখ সাহেব এবং তার স্ত্রী জায়গায় মারা যান। অবস্থার প্রতিকূলতার কারণে আগেই সোমা শেখ প্রাপ্তিকে গাড়ি থেকে বাইরে বের করে দেন। যার ফলে আজ প্রাপ্তি জীবিত। সোলেমান শেখের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই খোকন শেখ তার কিছু সম্পত্তি নিজের নামে করিয়ে নেন। কিন্তু ঝামেলা বাধে অন্যখানে। সোলেমান শেখ তার অবর্তমানে সব সম্পত্তি প্রাপ্তির নামে দিয়ে যান, এবং প্রাপ্তি বিশ বছর হলেই এই এসেটগুলো তার নামে ট্রান্সফার হবে। এই কারণগুলোর কারণে বাধ্য হয়ে প্রাপ্তির দেখভাল খোকন শেখ করেন। কিন্তু ব্যবসা কিছুতেই অনুকূলে আনতে পারেন না। অসদ উপায়ে কোনো কিছুতে বরকত হয় না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে তিনি আবরার সিকদারের বিয়ে দিতে রাজী হন টাকার লোভে। প্রাপ্তির ভালো করেই জানা কেনো তার চাচা তাকে দেখতে চাইছেন। যাতে ছলেবলে বাকি সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পারেন।
– আমি ও বাড়িতে যাবো না।
– কেনো? তোমার চাচা তো তোমাকে মেয়ের মতন ভালোবাসেন। তো যেতে না চাওয়ার কারণ কি?
– আমি যাবো না ব্যস। অহেতুক জোর কেনো করছেন।

বলেই উঠে চলে যায় প্রাপ্তি। অয়নের খটকা লাগে কিন্তু কিছু বলে নি। অয়ন নাস্তা করে আবরারের রুমে যায়। আবরার তখন চোখ মেলে শুয়ে আছে। অয়ন আবরারের পাশের চেয়ারটা টেনে সেখানে বসে। আবরারের ক্যানোলা লাগানো হাতটা আলতো করে নিজের হাতে নিয়ে বলে,
– ভাই, তুই ওই মেয়েটাকে খুব ভালোবাসিস তাই না? তাই তো আমার এতো ডাকেও তুই সাড়া দিস নি অথচ ওর কাছে আসাতেই তুই রেস্পন্স করতে লাগলি। ভাই আমাকে ক্ষমা করে দিস। একটা ভুল করে ফেলেছি আমি। তবে ভুলটা আদৌ ভুল কিনা সেটা জানি না। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হ। অনেক হিসাব মিলার বাকি।

এই সময় অয়নের ফোনে কল আসে। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকালে দেখতে পায় অয়নের এসিস্ট্যান্ট রিয়াদ ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করতেই বলে উঠে,
– স্যার একটা নিউজ ছিলো।
– হুম বলো, কি নিউজ?
– স্যার, আবীর স্যার বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের হাত করতে শুরু করেছেন তাড়াতাড়ি কিছু না করলে সমস্যা হবে। আর ছোট ম্যাডামের ব্যাপারে কিছু বলার ছিলো, ছোট ম্যাডামের….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here