#ভালোবাসার_উষ্ণতা,08,09
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৮ম_পর্ব
বেশ কিছুক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে পাশে তাকাতেই প্রাপ্তির শরীর জমে গেলো। অয়ন তখন এক হাটু গেড়ে মাটিতে বসে আছে। হাতে বেশ কিছু গোলাপফুল, রক্তাক্ত লাল রং যেন ফুলগুলোকে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকলে অয়ন বলতে লাগে,
– আজ যে কথাগুলো বলবো তা তোমার কাছে পাগলের প্রলাপ লাগতে পারে, তুমি সবসময় জিজ্ঞেস করতে না আমার সমস্যাটা কি? কেনো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি? আজ সব প্রশ্নের উত্তর আমি নিবো। তখন না বুঝলেও আজ বুঝি আমি ওই গুলো কেনো করতাম। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার জন্য উত্তপ্ত গরমের ঠান্ডা শীতল পরশ। তুমি আমার পাথর হৃদয়ের উষ্ণতা। আমার খালি জীবনের পূর্ণতা তুমি। আমি তোমার সাথে কোনো সময় ভালো ব্যবহার করতাম না এই ভয়ে যদি ভালোবেসে ফেলি তোমাকে। কিন্তু আজ আমায়ার ভয় আমার জীবনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাপ্তি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। আমাকে কি তোমার জীবনের ছোট্ট অংশ হবার সুযোগ দিবে?
– আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?
– হু জানি। সব জেনেই বলছি, একটা সুযোগ কি দেয়া যায় না?
– আমি বিবাহিত অয়ন, আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী।
– আমি জানি, কিন্তু তোমাদের বিয়েটা কি আদৌ বিয়ে? তুমি কি আমার ভাইকে ভালোবাসো?
– না হয়তো বাসি না, তবে আমি আমার স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে বাদ্ধ। আর আমি সেই মেয়েদের মতো হতে চাই না যারা শুধু টাকার লোভে ওই মানুষটাকে বিয়ে করেছে। উনি কি ভাববেন বলুন তো?
– ভাই কিছুই ভাববে না আমি সব ঠিক করে দিবো। একটা সুযোগ কি আমি পেতে পারি না বলো?
– না এটা সম্ভব নয়। আমি উনার সাথে প্রতারণা করতে পারবো না। ক্ষমা করবেন আমায়।
– বেশ, তুমি যদি সেটা ঠিক মনে করো এটাই হোক। তবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ভাই তিন মাস পর দেশে ফিরবে। এর মাঝে যদি আমি তোমার মনে জায়গা করে নিতে পারি তবে আমাকে বিয়ে করতে হবে তোমায়।
এবং আমি তা পারবো।
– চ্যালেঞ্জ করছেন?
– উহু, এটা আমার ভালোবাসার পরীক্ষা। যদি তোমার মনে নিজের জন্য জায়গা করতে পারি তবে তোমাকে কোনোদিন নিজ থেকে আলাদা হতে দিবো না।
– আর যদি তা পারেন?
– তোমার আর ভাইয়ের জীবন থেকে চিরকালের মতো সরে যাবো। প্রমিস
– আমি বাড়ি যাবো।
– আচ্ছা চলো।
বাড়ি আসার পথে রাস্তার দুজনের কোনো কথা হয় নি। গাড়ির গ্লাসে মাথা ঠেকিয়ে সারা রাস্তা প্রাপ্তি শুধু অয়নের বলা কথাগুলোই ভেবেছে। এতো মনের মাঝে যে ক্ষীণ ভয়টা ছিলো তা আজ যেন তীব্র হতে লাগলো। সত্যি যদি এই চ্যালেঞ্জ এ জিতে যায় অয়ন! তখন কি করবে? যত যাই বলুক না কেনো, ভালোবাসা কখন কার প্রতি জন্মাবে তা বলা কঠিন। যতই নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করা হোক না কেনো মনের উপর কোনো কিছুর জোর চলে না। হুট করে ব্রেক লাগতেই হুশ ফিরে প্রাপ্তির। বাহিরে তাকালে দেখতে পায় সিকদার ভিলার বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। কোনো কথা না বলে সরাসরি বাড়ির ভেতরে চলে যায় সে। অয়ন তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে একটি বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে৷
দুই সপ্তাহ পর,
সন্ধ্যা ৭ টা,
স্থানঃ হাভিলি রেস্টুরেন্ট, উত্তরা।
একটা টেবিলে বসে আসে অয়ন। আজ দুই সপ্তাহ “প্রাপ্তি শেখ” আইডিটি শুধু ঘুরিয়ে যাচ্ছে আজ দেখা করবে, কাল দেখা করবে। এই নিয়ে প্রায় ৫-৭ হাজার টাকার গিফট তাকে পাঠানো হয়ে গেছে। আজ অবশেষে সে দেখা করতে রাজি হয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কোন আইপি এড্রেস দিয়ে ম্যাসেজ গুলো পাঠানো হচ্ছে এটাও ট্রাক করা হয়ে গেছে। এখন শুধু ব্যাক্তিটির আশার অপেক্ষা। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেলো অয়ন। পাশ ফিরে তাকালে একটি নীল শাড়ি পরিহিতা নারী দাঁড়িয়ে আছে।
– আপনি অয়ন সিকদার ?
– জ্বী আপনি?
– আমি রোশনি শেখ। প্রাপ্তি আমাকে পাঠিয়েছে। এখানে বসা যাবে?
– জ্বী বসুন।
– আমাকে প্রাপ্তি পাঠিয়েছে আপনাকে এটা বলতে সে আপনার সাথে দেখা করবে না।
– কেনো?
– কারণ, সে এখন আর আপনার প্রতি ইন্টারেস্টেড না। এটা প্রাপ্তির আজকের ব্যাপার না, ও এমন বড়লোকদের পটায়; পটিয়ে পটিয়ে টাকা, গিফট এগুলো নেয়। আসলে এসব দেখেই বাবা ওকে একজনের সাথে নিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আমি জানি না কে তিনি তবে শুনেছি অসুস্থ একজন নাকি। যাক গে, আমি আপনাকে এগুলো বলতে এসেছি। এসব নর্দমায় কেনো মুখ দেন সত্যি বুঝি না। ভালো মেয়ের কি অভাব?
এতোক্ষণ চুপ করে বসে ছিলো অয়ন। কিন্তু প্রাপ্তির নামের বাজে কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না সে। একে তো নির্দোষ একটা মেয়ে যে জানেই না তার নামে ছেলেদের সাথে ছলনা করে যাচ্ছে উপর থেকে তার নামে যা নয় তাই বলে যাচ্ছে। নিজেকে নিতান্ত শান্ত করে অয়ন জিজ্ঞেস করলো,
– প্রাপ্তি যদি বিবাহিতা হয় তবে তার হাসবেন্ড তো খুব সহজেই এসব কথা জেনে যাবে।
– ওর হাসবেন্ড তো অসুস্থ। জানবে কিভাবে?
– তোমাকে এখানে আসার কথা কি ওই জানিয়েছে?
– হুম, ওই আমাকে কালকে জানিয়েছে ফোন করে।
– ফোন নাম্বারটা পেতে পারি?
– জ্বী?
– ফোন নাম্বারটা পেতে পারি? বাংলা ভাষায় বলেছি
– ফো..ফোন নাম্বার?
– খুব কি কষ্ট হয়ে যাবে ফোন নাম্বার দিতে?
– ইয়ে.. মানে
– আসলে কি বলেন তো, প্রাপ্তির সাথে আপনার বিগত চার মাসে একবার কথা হয় নি। তাই অহেতুক নাম্বার কোথায় পাবেন? প্রাপ্তির আগে একটা মোবাইল ছিলো, আপনি কোনো ভাবে মোবাইলটা চুরি করেন। এবং তার পর থেকে প্রাপ্তিকে নিচু করতে ওর আইডি থেকে ছেলে ফাসানোর ধান্দা করেন। পরে এতে আপনার প্রেমময় ম্যাসেজে অনেক বাকরা ফাসতে থাকে তাই এটা আপনার একটা নিত্য দিনের কাজ হয়ে যায়। সমস্যাটা হয় যখন প্রাপ্তির বিয়ে ঠিক হয়ে যায় আপনি যেনো কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তারপর তিন মাস আইডিটা বন্ধ থাকে। তারপর আবার এক মাস হয়েছে আইডিটি এক্টিভেট করেছেন আপনি।
– এসব কি বলছেন আপনি?
– আমি যে ভুল বলছি না তা আপনি খুব ভালো করেই জানেন। এতোদিন আমার সাথে প্রাপ্তির আগের নাম্বার দিয়ে আপনি ই কথা বলতেন চ্যাট করতেন। এখন যখন দেখছেন আমি নাছোরবান্দা তখন আপনি আমার সামনে এসে হাজির হয়েছেন এবং প্রাপ্তির নামে যা নয় তাই বলছেন।
– আপনি কি আজে বাজে কথা বলছেন? আমি ভদ্র ঘরের মেয়ে
এবার মেজাজ তুঙে উঠে গেলো অয়নের। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
– এখন ভালোয় ভালোয় স্বীকার করে নেন, নয়তো পুলিশের ডান্ডায় সব ঠান্ডা হয়ে যাবেন।
– আপনি এতো কিছু জানেন কিভাবে? আপনি কে?
– আমি ওর হাসবেন্ড। আর তোমার কৃতকর্মের জন্য আমি ওই নিস্পাপ মেয়েটাকে দিনের পর দিন শুধু কষ্ট দিয়েছি।
– আপনি? ওর হাসবেন্ড না অসুস্থ ছিলো?
– ওইটা তোমাদের ফ্রড পরিবারকে ধোয়াশায় রাখতে আমিই অসুস্থতার বাহানা দেই। যাক গে, এবার বলতো আবরার সিকদারের সাথে তোমার থুক্কু অনলাইনের প্রাপ্তি শেখের সম্পর্ক কতোদিনের ছিলো?
– আবরার সিকদার? আমি চিনি না। কে উনি?
– পুলিশের কাছে না নিলে দেখি মুখ খুলবে না।
– বলছি, বলছি। উনি অনেক পাকাও ছিলেন।এগারো মাস বা তার ও আগে উনার সাথে আমার দেড় মাসের মতো রিলেশন ছিলো। তারপর আমি ওকে ব্লক করে দেই। অই লোক এই ফোনেও অনেক ফোন করতো। কিন্তু তাও আমি রিসিভ করতাম না, পরে না পেরে ব্লক করে দিয়েছলাম। আর তার সাথে আমার যোগাযোগ হয় নি।
– এগারো মাস মানে এক বছর। এতোদিন আগে তার সাথে তোমার ব্রেকআপ হয়েছে? তুমি শিউর? সাত মাস আগে তোমার সাথে তার কথা হয় নি?
– হ্যা? এতে আনশিউর হওয়ার কি আছে? না হয় নি তার সাথে আর কথা।
– ঠিক আছে, আমি তোমাকে দুই ঘন্টার সময় দিচ্ছি প্রাপ্তির আইডি যাতে ডিএক্টিভ হয়ে যায়। আর যদি আমার চোখে পড়ে তো জেলে ঘানি টানার জন্য প্রস্তুত থাকবে তুমি।
বলেই গট গট করে ক্যাফের বাইরে চলে যায় সে। গাড়িতে উঠতেই একটা পিচ্চি গ্লাসে টোকা মারে।
– ভাই, ফুল নিবেন? তাজা বেলি ফুলের মালাও আছে। ভাবিরে দিলে খুশি হইয়ে যাইবে।
– সত্যি খুশি হবে তো?
– হো, ভাইজান।
– দে তাহলে।
মুচকি হাসি দিয়ে পিচ্চিটাকে বলে।
– এই নেন পনেরো টেকা।
– তুই এটা রাখ। আজ ভালো করে খাবি ঠিক আছে?
– এইটা তো এক হাজার টাকা।
– রাখতে বললাম তো। এই মালাটা খুব দামী লোকের জন্য নিচ্ছি।
বলে চোখ টিপ্পনী নিয়ে পিচ্চিটাকে এক হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে শিকদার ভিলার দিকে রওনা দেয় অয়ন। আজ তার মন খুব ভালো। এতোদিনের প্রতারকটিকে সে ধরতে পেরেছে। তবে একটা সন্দেহ তার মনের মধ্যে ঘাপ্টি মেরে আসেই। আবরারের যদি এই নকল প্রাপ্তির সাথে এক বছর আগ ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকে তবে সাত মাস আগে সেদিন কেনো এতোটা তাড়াহুড়ো করে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলো! অয়ন জানতো সেদিন প্রাপ্তির সাথে দেখা করতেই এতোটা উত্তেজিত ছিলো আবরার। না এসবের জট আবরার ছাড়া কারোর পক্ষে ছাড়ানো সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতে একটা শাড়ির দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো অয়ন। তৎক্ষনাৎ ব্রেক কসে সে। দোকানের পুতুলের গায়ে একটি কালো শাড়ি খুব ভালো করে চোখে পড়ে তার। বিয়ের এতোদিন পরে প্রাপ্তির জন্য কিছুই কিনা হয় নি অয়নের। কি মনে কিরে শাড়িটা কিনে নেয় সে।
রাত ৯টা,
প্রাপ্তি তখন রান্নাঘরে রাতের খাবার রান্না করছিলো। হঠাৎ কেউ কোমড় জড়িয়ে ধরলে আৎকে উঠে সে। পেছনে ফিরতেই দেখে অয়ন তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। খানিকটা ধাক্কা দিয়ে বলে উঠে,
– লজ্জা করে না আপনার? এভাবে আমাকে ধরার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে?
– প্রাপ্তি এভাবে বলছো কেন?
– আমি অন্য কারোর স্ত্রী ভুলে যাবেন না। আর কি জানি একবার বলেছিলেন, আমার মতো মেয়ে নগ্ন দাঁড়িয়ে থাকলেও আপনি নাকি ফিরে চাবেন না। তবে কেনো আমার কাছে এসেছেন?
– প্রাপ্তি আমি তোমাকে ভালোবাসি।
– আপনাদের ভালোবাসা খুব ভালো করে জানা আছে। লাগবে না আমার এরুপ ভালোবাসা যেখানে আমি শুধু অপমান পেয়েছি।
– আমি কতবার ক্ষমা চাইবো প্রাপ্তি? এই দুই সপ্তাহে কি আমার ভালোবাসা কোথাও বুঝতে পারো নি তুমি? এই দেখো আমি তোমার জন্য এই শাড়ি আর এই মালাটা এনেছি, দেখো।
– কেনো এনেছেন? আমি বলেছিলাম।
বলেই শাড়িটা আর মালাটা ছুড়ে ফেলে প্রাপ্তি। আর এক মূহুর্ত না দেরি করে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে বসে থাকে। চোখের পানিরা বাধ মানছে না। না চাইতেও কেনো এই লোকটার দিকে মনটা ঘুরে। সে তো অন্য কারোর বউ, কেনো তবুও এই লোকটার রং এ মনটা রাঙতে চায়? প্রাপ্তি দোটানার বেড়াজালে আটকে আছে। যার থেকে মুক্তির রাস্তা তার কাছে নেই। হঠাৎ ঘরে চিৎকার চেচামেচি শুরু হয়ে যায়। লোকমান কাকা “অয়ন বাবা, অয়ন বাবা” বলে চিৎকার করছেন। প্রাপ্তি এক মিনিট দেরি না করে অয়নের রুমের দিকে রওনা হয়। সেখানে যা দেখতে পায় তাতে মূহুর্তে হাত পা জমে যায় তার। অয়ন তখন….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#৯ম_পর্ব
প্রাপ্তি এক মিনিট দেরি না করে অয়নের রুমের দিকে রওনা হয়। সেখানে যা দেখতে পায় তাতে মূহুর্তে হাত পা জমে যায় তার। অয়ন তখন একটা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। ডান হাত থেকে টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। ইজি চেয়ারের পাশে কালচে রক্তগুলো জমাট বেধে রয়েছে। লোকমান কাকা একমূহুর্ত দেরি না করে ডাক্তার ডেকে আনলেন। ডাক্তার হাতের রক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে, সাথে ঘুমের ঔষধ খাওয়িয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। চলে যাবার সময় যাতে ডান হাতে পানি না লাগে সেদিকে খেয়াল করতে বলেছেন। অতিরিক্ত এলকোহলের নেশায় ভাঙ্গচুর করতে করতে হাতটা বাজে ভাবে কেটে গেছে অয়নের। প্রাপ্তির এরুপ রুঢ় আচরণ যেন একদম মেয়ে নিতে পারে নি অয়ন। অয়নের এই দুইটা দোষ, ওর রাগ আর ওর জিদ। এই দুইটায় অন্ধ হয়ে জীবনে কতো এ ভুল করেছে তার হিসেব হয়তো জানা নেই। প্রাপ্তি নিজের রুমের দিকে যেতে নিলে লোকমান কাকা তাকে থামিয়ে দেয়,
– মা, তোমাকে কিছু বলার আছে আমার।
– কি হয়েছে লোকমান কাকা?
– আজ তোমাকে কিছু কথা বলব। কথাগুলান আগেই বলা উচিত ছিলো। কিন্তু অয়ন বাবার জন্য বলতে পারি নাই। হয়তো কথা গুলো শুনলে তুমি অয়ন বাবার উপর আরো রাইগে যাবা। কিন্তু কথা গুলো না বললে পরে ব্যাপারটা ঘোলাটেই থাকবে।
– কি কথা কাকা?
– তোমার বিয়া, বড় বাবার সাথে হয় নাই। হইছে অয়ন বাবার সাথে।
– জ্বী?? আপনি কি উল্টা পাল্টা কথা বলছেন?
– আমি উল্টা পাল্টা কথা বলি নাই মা, এটাই সত্যি। মা তোমাকে কিছু কথা কই, মন দিয়া শুনবা। তারপর তোমার যদি মনে হয় অয়ন বাবার ভুল আছে, তুমি ওরে যা শাস্তি দিবা অয়ন বাবা তাই মাইনে নিবে।
-…….
– বড় বাবা আর অয়ন বাবা আপন ভাই না। অয়ন বাবাকে দত্তক নিছিলেন ম্যাডাম। তারপর, একটা এক্সিডেন্টে সাহেব আর ম্যাডাম মারা যান। এর পর বড় ম্যাডাম মানে তাগোর দাদীজানই আবরার বাবা, আবীর বাবা আর অয়ন বাবাকে দেখাশুনা করেন, বড় করেন। আবীর আর আবরার বাবার বয়সের তফাৎ ২ বছর। বড় হইলে আবরার বাবাকে সিকদার কোম্পানীর সি.ই.ও বানানোর সিদ্ধান্ত নেন বড় ম্যাডাম। অয়ন বাবা পালিত বলে তারে কোনোদিন তাদের মধ্যে গুনতো না উনি। এই কারণে আবরার বাবাই অয়ন বাবার সব কিছু ছিলো। যেদিন আবরার বাবারে সব কিছুর দায়িত্ব দেবার চান বড় ম্যাডাম সেই দিন অয়ন বাবা মনে মনে খুব খুশি হইছিলেন। কিন্তু এই খুশি টিকলো না, আবীর বাবা হিংসার কারণে আবরার বাবার নানা রকম ক্ষতি করার কথা চিন্তা করেন। সেটার শাস্তি অবশ্য অয়ন বাবা তারে দিছে। তারপর সাত মাস আগে আবরার বাবা একটা মাইয়ার সাথে দেখা করার জন্য গাড়ি নিয়ে বাইর হইছিলো। তারপর আর কি আবীর বাবার কথায় একটা ট্রাক তার গাড়িরে এক্কেবারে পিসে ফালায়। তার ফলাফল তোমার সামনে। ছয় মাস আবরার বাবা কোমায় ছিলো। এতো চিকিৎসা কোনো কাজে আসে না। এগুলো শুধু বড় ম্যাডাম আর অয়ন বাবা জানতো। বড় ম্যাডাম সিদ্ধান্ত নেয়, আবরার বাবার এই ঘটনা ধামাচাপা রাখবেন। তাই উনি অয়ন বাবাকে বিভিন্ন মেক আপ এর দ্বারা আবরার বাবার মতো সাজায়ে সবার সামনে আনেন। সবাইরে জানান আবরার বাবার শুধু মুখটা পুইড়া গেছে আর হাটতে পারতেছেন না, পড়ে ঠিক হইয়া যাবে। এবং এই নাটকটারে আরো ও বাড়াইতে আবরার বাবার বিয়ের ঘোষণা দেয়। এই নিয়ে অয়ন বাবা আর বড় ম্যাডামের অনেক কথা কাটাকাটি হয়। নিজের সব সম্পত্তি আর উত্তরাধিকারীর ভালোর জন্য অয়ন বাবারে ঢাল বানাইয়ে রাখে বড় ম্যাডাম। বিয়ে করবে অয়ন বাবা, এমনকি বিয়ের পর বাচ্চাটাও তারই হবে কিন্তু সবাই জানবে আবরার বাবার বিয়ে হইছে, বাচ্চাটাও তার। তোমার সামনে আবরার বাবা যতবার দাঁড়াইছে সেটা অয়ন বাবা ছিলো। জানি বিশ্বাস করতে তোমার একটু কষ্ট হইতেছে কিন্তু এটা সত্যি। আর আবরার বাবা যখন ভালা হইয়ে যাবে তখন একটা ডিভোর্স এর একটা নাটক করতো। এই কারণেই ছোট পরিবারের একটা মেয়ে খুইজে বাইর করতে অয়ন বাবাকে আদেশ দিছিলেন। অয়ন বাবা বাধ্য হইছে এগুলা করতে। তবে ওর দোষ ছিলো, নিজের জিদের বসে তোমারে এই গোলকধাঁধাঁয় রাখছিলো। ও ভাবছিলো তুমি টাকার লোভে তারে বিয়ে করছিলা। ওই ছোট বেলা থেকে ভালোবাসার জন্য ছেলেটা ক্ষুধার্ত ছিলো। সে চাইছিলো, তুমি যাতে তারে ভালোবাসো। তার সাথে বিয়া হইছে বা তার টাকার জন্য তার কাছে যাতে তুমি না থাকো। আমি জানি এতোদিন এই ব্যাপার গুলা তোমার কাছে লুকায়ে কাম ডা ভালা করে নাই অয়ন বাবা। কিন্তু বড় ম্যাডামের কথার উপর কথা বলার সাহস বা অধিকার কিছুই নাই তার। এখন তুমি একটু ভাইবে দেইখো তুমি কি করবা।
লোকমান কাকা কথাগুলো বলে রুমের বাইরে চলে গেলো। প্রাপ্তি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখের পানি যেন থামতেই চাচ্ছে না। অয়নের সেই কাজগুলো করার কি দরকার ছিলো! তাহলে দুজনকেই এতোটা কষ্ট পেতে হতো না। আজ হয়তো তাদের ও একটা সুখের সংসার থাকতো। একদিকে ভালোই হয়েছে, এতোদিনের দোটানার অবসান ঘটলো। মনটা হয়তো একারণেই এই মানুষটার দিকে ঘুরতো। এই মানুষটার কথা সারাক্ষণ ভাবতে চাইতো বেহায়া মনটা। শুধু সম্পর্কের মার প্যাঁচে নিজেকে শিটিয়ে রাখতো প্রাপ্তি। আজ এই ধোঁয়াশাও পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্যু এতো সহজে এই লোকটাকে ক্ষমা করে দিলে তো হবে না, শাস্তিতো পেতেই হবে। প্রাপ্তি মনে মনে ফন্দি আঁটে কিভাবে অয়নকে শাস্তি দেয়া যায়! এখন শুধু সকালের অপেক্ষা।
সকাল ৯টা,
মুখে পানির ছিটা পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় অয়নের। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখে কালো শাড়ি পড়ে এক নারী দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। এই শাড়িটি কাল রাতে কিনে এনেছিলো অয়ন। খুব নিপুন করে চুল মুছছে সে। সকালের শুভ্রতা যেন নারীটি প্রতিটি কণায় জড়িত। নারীটি আর কেউ নয় তার মায়াবতী, তার প্রাপ্তি। প্রথমে মনে হয়েছিলো এটা হয়তো কল্পনা। ঘুমের ঔষধ আর এলকোহলের ঘোরে মিষ্টি স্বপ্ন দেখছে সে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগছে ঘাড়ের গাঢ় কালো তিলটি। খুব ছুয়ে দিতে মন চাচ্ছিলো, পরক্ষণে রাতের ঘটনাগুলো মনে পড়তেই মনটা ছোট হয়ে গেলো। চোখ কচলে সামনে তাকালে দেখতে পায় রাগী রাগী চোখে প্রাপ্তি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বলে উঠে,
– কি ভেবেছিলেন, সুইসাইডের নাটক করলে আমি পটে যাবো??
– তুমি কল্পনা নও?
– কল্পনা হতে যাবো কেনো? সশরীরে দাঁড়িয়ে আছি। সকাল সকাল নেশা করেছেন নাকি?? উঠুন, উঠুন। বেলা হয়ে এসেছে, নবাব এখানে ভস ভস করে ঘুমোচ্ছে।
– আমার ক্ষুদা লেগেছে।
– ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন, খাবার রেডি।
– প্রাপ্তি, তোমাকে কিছু বলবো
– আমি কিছু শুনবো না, এখনই ফ্রেশ হয়ে নিচে নামেন।
বলেই নিচে চলে আসে প্রাপ্তি। পেছনে ঘুরে তাকালে হয়তো অয়ন হতবাক চেহারাটা চোখে পড়তো। খুব হাসি পাচ্ছে তার। অপরদিকে প্রাপ্তির বদলে যাওয়া অয়নের মনে শত প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটাচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতেই চক্ষু চোরাকগাছ, আজ সকালের নাস্তা সব অয়নের পছন্দের। লোকমান কাকার দিকে চোখ পড়তেই তিনি না সূচক মাথা নাড়লেন। তার মানে প্রাপ্তি এসব রান্না করেছে। মা মারা যাবার পর থেকে লোকমান কাকা ছাড়া অয়নের পছন্দ না পছন্দ কেউ খেয়াল রাখে নি।
– কি হলো, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
– এগুলো তুমি করেছো?
– না, আসমান থেকে ডেলিভারি এসেছে।
– সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে কি হয় তোমার?
– কিছুই হয় না, বসুন বেড়ে দিচ্ছি।
আজ বহুদিন পর তৃপ্তি করে খাবার খেয়েছে অয়ন। কালরাতের ঘটনার পর, প্রাপ্তিকে এভাবে দেখবে আশা করে নি। খাওয়ার মাঝে ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই “রাইসা আপু” নামটা ভেসে উঠে। ফোন রিসিভ করতেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো অয়ন। অপরপাশ থেকে শুনতে পেলো…..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি