#ভালোবাসার_উষ্ণতা,10,11
মুশফিকা রহমান মৈথি
#১০ম_পর্ব
ফোন রিসিভ করতেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো অয়ন। অপরপাশ থেকে শুনতে পেলো রাইসা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। অয়ন উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো,
– হ্যালো, হ্যালো। কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো!
কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে উত্তর দিলো,
– আপনি কি অয়ন? রাইসার হুট করে পেইন উঠেছে। আমি ওর বান্ধবী, আপনি কি একটু উত্তরা ১১ নম্বরে আসতে পারবেন? ওকে হসপিটালে নিতে হবে হয়তো।
– আচ্ছা আমি আসছি।
ফোনটা রেখেই তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যাচ্ছিলো অয়ন, পেছন থেকে প্রাপ্তি হাতটা টেনে ধরে বললো,
– কোথায় যাচ্ছেন?
– একটা কাজ পড়ে গেছে, আমার হয়তো আসতে দেরি হবে।
– আচ্ছা
– আচ্ছা শুনো?
– জ্বী
– খেয়ে নিও ঠিক মতো, আমি চলে আসবো।
বলেই অয়ন বেরিয়ে গেলো। প্রাপ্তির মুখে না বললেও মনে মনে বড্ড চিন্তায় পড়ে গেলো কারণ অয়নের এভাবে হুট করে বেরিয়ে যাওয়াটা বড্ড অস্বাভাবিক লেগেছে প্রাপ্তির কাছে।
রাত ৮টা,
আজ সারাদিন অয়নের একটা খোঁজ পায় নি প্রাপ্তি। নিজ থেকেও ফোন করে নি, এই ভেবে যে ও ব্যস্ত আছে হয়তো। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে নিজ মনে স্কেচ করতে করতে অয়নের কথাই ভাবছিল সে। বেশ কিছুক্ষণ পরে, খেয়াল করে দেখলো নিজের আনমনে অয়নের চেহারাই এঁকেছে সে। প্রথম যে দিন অয়নকে দেখেছিলো তখন সে সবে মাত্র এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। তখন জানতো না অয়ন তার স্বামী। ভুল বশত অয়নের রুমে ঢুকে পড়ায় কি ঝাড়িটাই না খেলো। তখন অয়নকে বড্ড বেশি ভয় পেত। ভয়ে কুকড়ে থাকতো এই বুঝি কি না কি বলবে! কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ভয়টা অভিমানে পরিণত হলো। অভিমানটা কখন ভালোলাগা তারপর ভালোবাসায় পরিণত হলো কে জানে। মনের বন্ধ দরজা ভেদ করে ধীর পায়ে ভালোবাসার বীজ বুনে দিলো লোকটা। লোকটার কথা বড্ড মনে পড়ছে তার। একটিবার ফোন দিলে কি খুব মন্দ হবে! হয়তো না, তাই লোকমান কাকার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন লাগালো অয়নের নাম্বারে। বেশকিছুক্ষণ বাজার পর যখন ধরলো না প্রাপ্তির মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আচ্ছা, লোকটার কি সত্যি তার কথা মনে নেই!!
রাত ১১টা,
ডাইনিং টেবিলে খাবার নিয়ে বসে থাকতে থাকতে হাতের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে প্রাপ্তি। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে যায় তার। চোখ কচলিয়ে দরজা খুলে দেখে অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো উসখো খুসখো, বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে তাকে। সারাদিনে পেটে দানা পড়েছে কিনা সন্দেহ। প্রাপ্তিকে দেখেই বলে উঠলো,
– বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। একটু খাবার বেড়ে দিও প্লিজ।
বলেই রুমের দিকে চলে যায় অয়ন। প্রাপ্তির খানিকটা রাগ ও হলো। সারাদিন একটা খোঁজ নিলো না লোকটা। কি এমন জরুরি কাজ ছিলো! একটাবার ফোনটাও ধরা যায় না? রান্নাঘরে খাবার গুলো গরম করে ডাইনিং টেবিলে দেয় সে। ততক্ষণে অয়নও চলে আসে। খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললো,
– সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি নাকি?
– না, আর বলো না সারাটাদিন একবিন্দু বসার সুযোগ পাই নি।
– এতো জরুরি কাজ ছিলো বুঝি?
– তাতো ছিলোই।
– জানা যাবে কি? কি এমন করছিলেন?
– তুমি খেয়েছো রাতে?
– কথা পাল্টাচ্ছেন?
– উহু, তুমি না খেলে প্লেট আনো। একসাথে খেতে খেতে বলছি।
– আমার ক্ষুদা নেই।
– তা বললে তো হবে না, যাও প্লেট আনো একটা।
– জোর করছেন কেন? ক্ষুদা নেই বললাম তো।
– আচ্ছা বাবা সরি, আর এমন করবো না। কি কাজে গিয়েছিলাম শুনলে তুমিও রাগ করতে পারবে না।
– তাইলে বলেন সারাদিন কি এমন কাজে ব্যস্ত ছিলেন যে ফোন করেও আপনাকে খুজে পাই নি।
– আমার এক আপু, প্রেগন্যান্ট ছিলো। হুট করেই লেবার পেইন উঠেছে সাথে ব্লিডিং শুরু হয়। ও বান্ধবীর সাথে থাকতো, তাই আমাকে ফোন করেছে। প্রেগ্ন্যাসির আট মাস চলছিলো। হুট করে লেবার পেইন উঠায় ঘাবড়ে গিয়েছিলো। তারপর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, কমপ্লিকেশন ছিলো অনেক। ডক্টর ভেবেছিলো বাচ্চাটাকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ছেলে হয়েছে। এখন আপুকে রুমে দিয়েছে। বাচ্চাটাকে প্রিম্যাচ্যুরিটির জন্য আই.সি.উ তে রাখা হয়েছে। এখন ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে রেখেছে। তুমি বলো, ফোন কিভাবে ধরতাম?
– উনার পরিবারের কেউ নেই? আর উনার স্বামী?
– ভালোবাসা খুব বাজে জিনিস, মাঝে মাঝে ভুল মানুষকে ভালোবাসলে জীবনটা নরক হয়ে যায়। আর ভালোবাসায় ধোকাটা মানুষকে জীবন্ত মেরে ফেলতে সক্ষম। আপুর ক্ষেত্রে ও তাই। এই বাচ্চাটা না বাঁচলে আপুর বাঁচার আশাটুকু শেষ হয়ে যেত।
– আমাকে নিয়ে যাবেন তার সাথে দেখা করাতে?
– কি সম্পর্কে যাবে তুমি?
– যেটা আমাদের সম্পর্কের সত্যতা, সেটা তো বদলানো যাবে না। সেই সম্পর্কেই যাবো।
– আচ্ছা, আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কি প্রাপ্তি?
– মানে?
– আমি দুই সপ্তাহ আগে তোমার কাছে কিছু চেয়েছিলাম। তুমি কালকে সেটার উত্তর দিয়ে দিয়েছো। এর পরে আমাদের মাঝে ঠিক সম্পর্ক আছে প্রাপ্তি?
– আমাকে সত্যিটা বলে দিলে হয়তো আমি এতো কঠোর হতাম না। আপনার কি মনে হয়না কোনো সম্পর্কের ভিত্তি হয় সেই সম্পর্কের সত্যতা। আমাদের সম্পর্কটা একটি মিথ্যে জালে জড়িত ছিল। আমি এতোদিন আপনাকে একজন পরপুরুষ ভাবতাম। কাল লোকমান কাকা যদি আমায় সত্যিটা না বলতো তবে আজও আমি সেই মিথ্যের আড়ালে থাকা সত্যিটুকু জানতে পারতাম না। এবার বলুন আমি কি আমার দিকে ভুল ছিলাম? আমি কিভাবে আপনার প্রেম নিবেদনের উত্তর দিতাম?
– তুমি জানো সব? তুমি কি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছো?
– বেহায়া মনটার সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত আমি। বাড়ে বাড়ে আপনাকেই চায়, বাড়ে বাড়ে আপনার রঙে নিজেকে রাঙাতে ব্যস্ত সে। কি করবো বলুন?
প্রাপ্তির কথাটুকু শুনে চেয়ার ছেড়ে প্রাপ্তির সামনে এসে দাঁড়ায় অয়ন। হাটু গেড়ে নিচে বসে প্রাপ্তির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয় সে। চোখে তার সুখের অশ্রুধারা, এ যেনো জানান দিচ্ছে তার ভালোবাসা জিতে গেছে, আজ সে পরাজিত নয়। প্রাপ্তির চোখে চোখ রেখে বলে,
– আমায় ক্ষমা করে দাও প্রাপ্তি। তোমায় অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না। বিশ্বাস করো ভরসা পাই নি, পরিস্থিতি আমাকে একটা গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছিলো। আজ আমার সামনে সব যেনো পানির মতো পরিষ্কার। এই অয়নটা খুব খারাপ, খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে তোমায়। কথা দিচ্ছি, আর দিবে না। আমার মায়াবতীকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখবো দেখো। কোনো কষ্টের ছিটা তোমার গায়ে লাগতে দিবো না। ভালোবাসি যে, বড্ড ভালোবাসি। আমার এই একলা দুনিয়াতে আমার সঙ্গী কি হবে তুমি?
– আমিও যে এই জেদি, রাগী, খারাপ ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছি। আমার হাতে যে কিছুই নেই। যে মায়ায় জড়িয়ে আছি তা থেকে যে আমার নিস্তার নেই। বড্ড ভালোবাসি, এই দুনিয়ায় আমি বড্ড একা। আমার কষ্ট সহ্যশক্তি খুব কমে গেছে, কথা দিন আর আমাকে জ্বালাবেন না। আমাকে একা করে দিবেন না। কথা দিন?
– কথা দিলাম মায়াবতী। আমি তোমাকে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিবো। আমাকে তুমি পরিবারের সুখটা কি দিবে?
– আমার সকল সুখ আপনার, আপনার সকল দুঃখ আমার।
বলেই অয়নকে জড়িয়ে ধরলো প্রাপ্তি। অয়ন ও খুব যত্নে তাকে আগলিয়ে নিয়েছে। আজ দুটি হৃদয় একই সুতোয় বাঁধা পড়েছে। অয়ন পরম যত্নে প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নেয়। নিজের রুমে বিছানার উপর বসিয়ে পরম আদরে প্রাপ্তির কপালে ভালোবাসার উষ্ণ ছোয়া দেয় সে। দুটি দেহ আজ তাদের মিলনে ব্যস্ত। দুটি হৃদয় আজ তাদের প্রাপ্য সুখ কুড়াতে ব্যস্ত। এতোদিনের মান, অভিমান, রাগ, কষ্ট গুলো যেন সুখের তরীতে ভেসে যাচ্ছে। থাক না সাক্ষী হয়ে ঘরের সাদা দেয়াল, আকাশের ওই উজ্জ্বল চাঁদ আর নিঝুম রাত তাদের মিলনের, তাদের ভালোবাসা পাক না পূর্ণতা।
আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গে প্রাপ্তির। চোখ খুলতেই নিজেকে অয়নের বাহুডোরে পায় সে। ক্লান্ত হয়ে চারটার দিকে ঘুমিয়েছে সে। নিজের বরটাকে আজ বড্ড বেশি সুন্দর লাগছে তার কাছে। আচ্ছা, সে কি আসক্ত হয়ে পড়ছে এই মানুষটার প্রতি। হলেও ক্ষতি কি! মানুষটা যে তার একান্ত নিজের। অয়নের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে গোসল করে নেয় সে, ফজরের নামাযের সাথে দু রাকাত নফল নামায পড়ে নেয় সে। এতো সুখ আবার হারিয়ে যাবে নাতো! ধরে রাখতে পারবে তো!! সুখের সময়টা খুব ক্ষণস্থায়ী, আসছে সময় সম্পর্কের কি রুপ নেয় তা হয় তো কারোর জানা নেই।
সকাল ১০টা,
বোর্ড মিটিং এ বসে আছে অয়ন। আবীর বোর্ড মিটিং দেখেছে, আজ ভোট হবে তাতে নির্ধারিত হবে সিকদার কোম্পানির সি.ই.ও কে হবে? অয়নের মুখ শক্ত হয়ে আছে। রাগে গা রি রি করছে। সকালবেলায় রিয়াদ ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে আবীরের পরিকল্পনা। প্রাপ্তিকে কিছু না বলেই চলে আসতে হয়েছে তাকে। আবরার না থাকায় বাধ্য হয়ে মহিমা সিকদার অর্থাৎ আবরারের দাদীজান অয়নকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। অনেক কথা কাটাকাটির পর বাধ্য হয়েই এই সিদ্ধান্তে রাজি হয় অয়ন। এখন শুধু ফলাফলের অপেক্ষা। রিয়াদ আগ থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। আজ আবীরের সকল খেলার পর্দা উম্মোচিত হবে। দরজায় নক করেই রুমে প্রবেশ করে রিয়াদ। ফলাফল তার হাতে, আবীরের মুখে বিজয়ের হাসি কারণ সব মেম্বারদের টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে নিয়েছে সে। রিয়াদ বলতে লাগলো,
– এখন আমার হাতে সকল ভোটের গণনা রয়েছে, সিকদার কোম্পানির নতুন সি.ই.ও হলেন…..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#১১ম_পর্ব
– এখন আমার হাতে সকল ভোটের গণনা রয়েছে, সিকদার কোম্পানির নতুন সি.ই.ও হলেন আবীর সিকদার।
আবীরের মুখে বিজয়ের হাসি, কিন্তু অয়নকে বড্ড শান্ত লাগছে যেন কিছুই হয় নি। হঠাৎ পেছনের প্রজেক্টেরটা অন হয়ে যায়। কিছু ভিডিও র্যান্ডমলি চলতে থাকে। তাতে আবীর যে যে বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের ঘুষ দিয়েছে সেটার মূহুর্তগুলি রয়েছে। আবীরের মুখে বিষ্ময় আর ভয় দেখা যাচ্ছে, মুখটা রক্তশূন্য লাগছে। এর পর আরেকটি অডিও ক্লিপ শুরু হয় যাতে আবীরের কন্ঠ স্পষ্ট,
– আমি ১ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। আবরার সিকদারের লাশ দেখে আরো এক লাখ টাকা পেয়ে যাবে।
আবীরের যেন কিছুই মাথায় আসছে না। এগুলো এতোটা সুন্দর করে কিভাবে যোগাড় করলো অয়ন? এর পর কিছু ভিডিও অন হয় যাতে স্পষ্ট, সিকদার কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির কাছে বেঁচে দিচ্ছে আবীর। এসব ভিডিও দেখে আবীর ধপ করে চেয়ারে বসে পরে। অয়ন রিয়াদকে ইশারা দিলে পুলিশরা রুমে ঢুকে। হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে আবীরকে নিয়ে যাওয়ার সময় অয়নকে ডেকে বলে,
– আবীর ভাই, তুমি যদি চলো ডালে ডালে, আমি চলি শিরায় শিরায়। তাই তোমার এই বানানো খেলাটা শেষ অনেক আগেই করতে পারতাম। কিন্তু আমি দেখতে চাচ্ছিলাম, তুমি কতোটা নিচে নামতে পারো। এখন জেলের ঘানি টানো।
কথাটা শেষ হবার পর আবীরকে নিয়ে যায় জেলে। অয়ন এবার বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের সোজা ভাষায় বলে দেয়,
– এখন আপনাদের সি.ই.ও জেলে, এবার ডিসাইড করেন আমাকে কি সি.ই.ও হিসেবে মেনে নিবেন নাকি জালিয়াতির জন্য আপনাদেরও জেলে পুরতে হবে?
– না না, আপনি যা বলবেন তাই হবে (সবাই)
বড় একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দেয় অয়ন। আবীর নামক ঝামেলাটি এতোদিন পর একেবারেই ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে সে। এখন হয়তো তাদের জীবনে কোনো বাঁধা আসবে না। কিন্তু আবরার সেদিন কেনো বের হয়েছিলো এটা জানাটা খুব দরকার। আবার রাইসার জীবনটাও নতুন করে সাজানোটা জরুরি।
হাসপাতালে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর জানতে পারে, বাচ্চাটার অবস্থা এখন স্ট্যাবল। ডাক্তারের সাথে কথা বলে আই.সি.উ তে যায় অয়ন। বাচ্চাটি যে এতো সুন্দর, দেখে মনে হচ্ছে একটা শিউলি ফুলের গোছা। ধবধবে সাদা বাচ্চাটির ছোট ছোট চোখগুলো যেন এক অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছে অয়নকে। আচ্ছা, ওর আর প্রাপ্তির জীবনেও কি এরুপ সুখ আসবে? আসবে না কেনো? অবশ্যই আসবে। আল্লাহ যদি তাদের এক সুতোয় বাঁধতে পারে তবে এই সুখটিও অয়নের ভাগ্যে ঠিক লিখবেন। একদিন হুট করে হয়তো জানতে পারবে, প্রাপ্তি আর ওর ভালোবাসা প্রাপ্তির ভেতরে ধীরে ধীরে বাড়ছে। প্রাপ্তির যত্নে কোনো কমতি রাখবে না সে, দিন শেষে মেয়েটাকে সুখের টুকরি সপে দিবে সে। হয়তো দেখতে দেখতে নয় মাস পেরিয়ে ডেলিভারির সময় হবে। তাদের ও একটি ছোট্ট মেয়ে হবে। যাকে কোলে নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হবে সে। রাইসার ছোট্ট শিশুটিকে দেখে কল্পনার সুখের রাজ্যে হারিয়ে গেলো অয়ন। চোখ থেকে খুশির নোনা জল গাল বেয়ে পড়ছে। চোখ দুটি মুছে রাইসার রুমে গেলো সে। রাইসা প্রচুর দূর্বল হয়ে পড়েছে। এই সময়টায় ভালোবাসার মানুষটি সাথে থাকলে হয়তো আজ মেয়েটাকে এতো কিছু সহ্য করতে হতো না। ভালোবাসা নামক জিনিসটি কারো কারো কাছে অমৃত তো কারো কারো কাছে বিষ।
– কেমন আছো আপু?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই?
– এইতো ভালোই আছি। বাবুর নাম কি রাখলে?
– আব্রাহাম,, কেমন হয়েছে নামটা?
– ভালো। ওর বাবা কি জানে আদৌ ওর ব্যাপারে?
– বলেছিলাম, তাতে তার বাক্য ছিলো এটা একটা ভুল। সে আমার সাথে দেখাও করতে চেয়েছিলো। হয়তো সেদিনই এবোরশন করিয়ে ফেলতো। পরে আর আসলো না সে। আমি অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু লাভ হয় নি, এখন তো শুনেছি বিয়ে করে সুখেই আছে।
– আমাকে ওই পাষন্ডের নামটা কি বলবে?
– কি করবি জেনে? কিছুই করার নেই তোর।
– প্লিজ রাইসা আপু, আমাকে নিজের ভাই ভাবো তো নাকি? প্লিজ একটিবার বলো? চ্যাম্পের ও অধিকার আছে তার বাবার নাম জানা। আর সত্যি বলতে, ওই লোকের জানা উচিত সে যেটাকে ভুল বলে এড়িয়ে গেছে আজ সে একজন রক্ত মাংসের মানুষ। তার এক রাতের ভুল তোমার জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছে। প্লিজ নামটা বলো আমাকে।
-…..
– প্লিজ আপু, আজ চুপ করে থেকো না। প্লিজ নামটা বলো। আব্রাহামের ভবিষ্যতের ব্যাপার রাইসা আপু। প্লিজ
– কি করবি জেনে? তোর ভাই কোনোদিন ওকে পিতৃ পরিচয় দিবে না অয়ন। সে আমাকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছিলো আমাদের মধ্যে যা হয়েছে সেটা একটা ভুল ছিলো। ইমোশনাল হয়ে না ভেবে সে ভুল করে ফেলেছে। এবার তুই বল, আমার কি করার আছে?
– তুমি শিওর ভাই আব্রাহামের বাবা?
– জানতাম তুই ও বিশ্বাস করবি না। আমাকে কি ভাবিস তোরা? এতোজনের সাথে বিছানায় গিয়েছি যে আমার সন্তানের বাবা কে সেটাই জানবো না?
– না না, তুমি আমায় ভুল বুঝো না। কিন্তু ভাই দায়িত্ব এড়ানোর মতো লোক নন। আমি শিওর কোথাও ভুল হয়েছে। আমাকে কি পুরো ঘটনাটা খুলে বলা যায় আপু?
– হুম
তারপর সাড়ে আট মাস আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো রাইসা অয়নকে বলতে লাগলো।
সাড়ে আট মাস আগে,
সন্ধ্যা ৭টা,
স্থানঃ- ল্যাকভিউ রেস্টুরেন্ট এন্ড বার, উত্তরা।
হঠাৎ ফোন আসায় সেখানে উপস্থিত হয় রাইসা। আবরারের ফোনে যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেনো রাইসা নিজেকে আটকাতে পারে না নিজেকে। মানুষটাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে এসেছে সে। কিন্তু আফসোস এই মানুষটা কোনোদিন তার ভালোবাসা বুঝা তো দুর চেষ্টা ও করে নি। বরং যখনই রাইসা তাকে মনের কথা বুঝাতে চেয়েছে হয় সেটাকে উড়িয়ে দিয়েছে নয় এটাকে বয়সের দোষ বলে রাইসাকে বুঝাবার চেষ্টা করেছে। তাই রাইসাও হাল ছেড়ে দিয়েছে। কি দরকার, ভালোই তো আছে বন্ধু হিসেবে। কিন্তু আজ তার এনগেজমেন্টের কথাবার্তার ভেতরে যখন আবরার তাকে ফোন দিয়ে জানায় সে তাকে চায় রাইসা নিজেকে আটকে রাখতে পারে নি। এখানে এসে দেখে একের পর এক ভটকার গ্লাস শেষ করে যাচ্ছে আবরার। আবরারকে আটকানোর জন্য যখন তাকে বাঁধা দেয়, তখন আবরার বলে উঠে,
– রাইসু, তুই এসেছিস? আমি তো ভেবেছিলাম তুই আসবি না। আচ্ছা আমার সাথেই এমন কেনো হয় বলতে পারবি? আচ্ছা আমি তো মেয়েটাকে মন থেকে ভালোবেসেছিলাম, যখন যা চেয়েছি দিয়েছি তাও কেনো আমার সাথেই এমন হলো? জানিস ওইটা একটা ফেক আইডি ছিলো। আমি মানতেই পারছি না।
বলে রাইসাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের প্রলাপ করতে লাগলো। আজ রাইসার থেকে অসহায় হয়তো কেউ নেই। নিজের ভালোবাসার মানুষটি তার কাছে নিজের ব্যার্থ প্রেমের কথা বলছে অথচ এই মানুষটা একবার যদি বুঝতো রাইসা তাকে কতটা ভালোবাসে। রাইসা খুব কষ্টে তাকে সামলায়। এখন আবরারকে কোথাও নেয়া সম্ভব নয় বিধায় একটা হোটেলে খুব কষ্ট করে নিয়ে আসে। বিছানায় আবরারকে শুইয়ে উঠে যেতে নিলেই রাইসার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে আনে সে। রাইসা কিছু বলার আগেই তার কানের মুখ লাগিয়ে বলে,
– আজ তোকে বড্ড মায়াবী লাগছে, যেনো এক ফালি চাঁদের টুকরো আমার হাতে কেউ এনে দিয়েছে। খুব আপন করে নিতে ইচ্ছে করছে তোকে।
– আবরার তুই নেশায় যা তা বলছিস। ছাড় আমাকে আমি উঠবো।
– নেশা কেটে গেলে তুমিও কেটে যাবে। আজ রাতটা বড্ড বেহায়া হতে মন চাচ্ছে। আমি সত্যি অন্ধ, আমার সামনে পিকাসোর পেইন্টিং থাকতে আমি ছেড়া কাগজের আঁকিবুকির পেছনে ছুটেছি। তোর মাঝে এতো মায়া আমার অন্ধ চোখে পড়লোই না। আজ এ মায়ায় ডুবে যেতে মন চাইছে, দিবি আমাকে সে সুযোগ?
– আবরার কাল সকালে সব ভুলে যাবি তুই, আমি চাই না আমাদের সম্পর্ক এই নেশার বশে একটি ভুলে পরিণত হোক।
– হবে না, আমি তোর গায়ে কোনো আঁচ আসতে দিবো না। তোকে মনের কোঠরে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবো। আজ আমার তোকে খুব করে চাই রাইসু। অন্যদের মত আমায় একা করে দিস না প্লিজ। আমি থাকতে পারবো না। আমার এসব ভালো লাগছে না রাইসু। অয়ন বাদে, কাছের মানুষ কেউ নেই। তুই আমাকে একা করে দিস না প্লিজ। আমি হয়তো মরেই যাবো।
– কখনোই না, এসব কথা মুখেও আনবি না। তুই সবসম্য আমাকে পাশে পাবি, যত ঝড় আসুক না কেন আমি কখনো তোকে ছেড়ে যাবো না কথা দিলাম।
কথাটা শেষ হতেই রাইসাকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে নেয় আবরার। কিছু আর্তনাদ, কিছু বেদনা ধীরে ধীরে কতটা সুখময় হঅয়ে যায় সেটা সেদিন রাইসা অনুভব করতে পারছিলো। ভেবেছিলো এটা সুখের মিলন হবে কিন্তু এই সুখটা যে ক্ষণিকের অতিথি ছিলো সেটা কল্পনাতেও আনে নি রাইসা। এই কালরাত যে কেবল নেশার ঘোরে করা সামান্য ভুল হবে যা তার জীবনকে ৩৬০ ডিগ্রীতে ঘুরিয়ে দিবে সেটার আঁচও তার ভালোবাসায় অন্ধ হৃদয়টি পায় নি।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখতে পায় আবরার শক্ত মুখে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদরটা পেছিয়ে দাঁড়াতেই যা শুনলো তাতে মাটির নিচের জমি খসে পড়ে রাইসার।
আবরার এমন কিছু বলবে তা কল্পনাতেও আনে নি। আবরার তখন বলে…..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি