ভালোবাসার_রাত Season_2,পর্ব (৭)

0
3310

ভালোবাসার_রাত Season_2,পর্ব (৭)
রোকসানা_রাহমান

সন্ধ্যার হাঁসিমাখা ধন্যবাদটাও রাত এতদুর থেকে পড়ে ফেলেছে। যে ছাতার নিচে রাত আর সন্ধ্যা থাকার কথা সে ছাতার নিচে অন্য ছেলে?? রাগে পুরো শরীর দিয়ে যেন আগুন জ্বলছে রাতের। সেই আগুনে বৃষ্টির শুদ্ধ,ঠান্ডা পানিগুলোও গরম হয়ে বাষ্পাকারে উড়ে যাচ্ছে!

রাত সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে নির্লিপ্তে। ও কি আমাকে দেখতে পায়নি?? নাকি ইচ্ছে করেই না দেখার অভিনয় করে যাচ্ছে?? তুই কি এখন অভিনয়ও শিখে গিয়েছিস সন্ধ্যা?? তোর পরিবর্তনের এতো চতুরতা আমি যে মেনে নিতে পারছিনা।

সন্ধ্যা চলে যাওয়ার পানে চেয়ে রয়েছে রাত। আকাশ চিড়ে ভেঙে পড়া বৃষ্টির অতিক্ষুদ্র ফুটাকেও যেন রাত গুনে নিচ্ছে। শরীরের টুপটাপ পড়ে ছিটকে যাচ্ছে বৃষ্টির টুকরো। আজ সে নড়বেনা এখান থেকে। চোখের বৃষ্টিতে নয় আজ সে আকাশের মুশলবৃষ্টিতে নিজেকে ভেজাবে।

সন্ধ্যা চোখের আড়াল হতেই রাত আধখোলা ছাতাটা দুরে ঢিল মেরে ফেলে দিলো। ইচ্ছে করছে সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। কিন্তু এই খোলা রাস্তায় সে কি ভাঙবে??

~~

শরীর ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে রাতের আপাদমস্তক। মনে হচ্ছে সে নিজেই এখন আকাশ বনে আছে। আর সারা শরীর বেয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির পানির ঝরণা প্রপাত। তিয়ামতী গলায় শাসনীর সুরে বললো,,

“” এভাবে ভিজেছিস কেন,রাত?? তোর ফর্সা শরীরটা কেমন কালোরঙ ধারণ করে আছে। আর চোখটা দেখেছিস,লালের বন্যা।””

রাতের দায়সারা উত্তর,,

“” ইচ্ছে হলো তাই।””

তিয়ামতীর শাসনবানী শোনার ধৈর্য্যটুকু নেই রাতের। বাহিরে এখনো অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ফোটা পড়ছে একাধারে। এই বৃষ্টির মাঝে কোথায় গিয়েছিলো সন্ধ্যা? তাও একটি ছেলের সাথে। কে এই ছেলেটি?? খুব কাছের কেউ নাকি হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া কেউ?? রাত নিজের বিক্ষুব্ধ চাহনিতে সন্ধ্যাকে খুজতে ফুজতে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। পেছন থেকে তিয়ামতীর বাক্যব্যয়ের কথা কানে আসছেনা।

সন্ধ্যাকে কোথাও না পেয়ে ওর রুমের কাছ ঘেসে এগিয়ে যাচ্ছে রাত। দরজা মেলে ভেতরে ঢুকবে তখনি রিমার বিরক্তিকন্ঠ,,

“” তুই দেখি বাড়িটাকে সমুদ্রের মধ্যে ডুবিয়ে ফেলেছিস,রাত। তুই জানিস না আমি সাতার জানিনা? যদি ডুবে মরে যায় তখন তোদের রেধে-বেড়ে খাওয়াবে কে?””

রাত পেছন ঘুরে ফুপির দিকে তাকালো। তার চক্ষুদ্বয় রাতের দিকে নয়,মেঝেতে। তাকে অনুসরন করে সেও মেঝেতে তাকিয়ে আছে। নিজের ভিজে শরীর থেকে পানির টপটপানিতে পুরো ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে। আকাঁবাকা খালের ন্যায় সরু রাস্তাকারে ছুটে চলছে আপনমনে। রাত ছোট্ট করে বললো,,

“” সরি,ফুপি।””
“” তোর কি মনে হয় এখন সরি বললেই এই সমুদ্র শুকিয়ে যাবে?? আচ্ছা তোর মা,আমার ছোটবেলার বান্দুবী,কাকার মেয়ে,আমার ভাইয়ের বউ তাই এখনো ভালোবেসে আমি একাহাতে ঘর সামলাচ্ছি। আর তুই আমার বাবার একমাত্র নাতি,আমার ভাইয়ের ছেলে,আমার বান্ধুবীর ছেলে,আমার কাকারও নাতি আবার আমারও ভাইপো তাই তোকেও ভালোবেসে একটা শক্ত কথাও শুনাইনি কখনো। কিন্তু আমি কি তোদের কিছু হইনা? আমাকে এভাবে খাটিয়ে মারছিস কেন বলতো?? আমি কি কলুর বলদ??””

রাত ঠোঁটটিপে হেঁসে মজার ছলে বললো,,

“” তুমি তো আমার হবু শ্বাশুড়ি,হবু বউয়ের আম্মু,হবু ছেলের নানি,আমার আম্মুর হবু বেয়াইন তাই জ্বালাচ্ছি। যখন এই হবুটা চলে যাবে তখন আর জ্বালাবোনা,এই তোমার সমুদ্র ছুয়ে প্রমিস করছি।””

রিমা শক্ত চাহনি নিয়ে গভীর আদরে বললো,,

“” হবু জামাই,যাও এবার গোসল করে নাও। নাহলে সর্দি লাগিয়ে তো আমার হবুটা টুপ করে মরে যাবে।””

রিমা মহাসমুদ্র বন্ধ করার ব্যবস্থাতে নেমে পড়লো। রাত সন্ধ্যার দরজার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা ফেলতেই ভেতর থেকে ডাক পড়েছে।

“” রাত ভাইয়া,ও রাত ভাইয়া।””

সন্ধ্যার এমন আদরমাখা ডাককে পিছে ফেলে এগুনোর শক্তিটুকু কি আছে রাতের?? নিজের সব রাগ ধুয়েমুছে নিংড়ে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। রুমতো ফাঁকা তাহলে কি আমি ভুল শুনলাম?? রাত বিড়বিড় করতে করতে বের হওয়ার উপক্রম হতেই সন্ধ্যা আবার ডেকে উঠে,,

“” কই তুমি? আমার ডাক কি তুমি শুনতে পাওনা? জলদি এদিকে এসো।””

সন্ধ্যার কন্ঠধ্বনি অনুসরণ করে ওর ওয়াশরুমের দিকে এগুচ্ছে। দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো। তবে কি ওয়াশরুমে? রাত ছোট্টকরে ডেকে উঠলো,,

“” সন্ধ্যা!””

সাথে সাথে দরজা খুলে গিয়েছে। নিজের অর্ধঢাকা পিঠটা রাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,,

“” কখন থেকে চেইনটা লাগানোর চেষ্টা করছি,কিন্তু পারলাম কই? তুমি এতো লেটে এলে কেন??””

সন্ধ্যার পরবর্তী কথাগুলো কি রাতের কানে ঢুকছে? তার চোখ তো অন্য জায়গায় আটকে আছে। বেগুনি রঙের জামাটা চিড়ে গিয়ে দুধারে হেলে আছে,তার ঠিকমাঝখানেই খোলা পিঠের সাদা আলো ঝলকে উঠেছে। তবে স্পষ্ট নয়। সন্ধ্যার কাধছাড়া চুলগুলো ভিজে বিভিন্নভাগে ছড়িয়ে আছে সন্ধ্যার খোলা পিঠে। চুলগুলো সরালেই ওর বক্ষবন্ধনীর কালো ফিতের এটে যাওয়াটা হয়ে উঠবে অনাবৃতে!

সন্ধ্যার সদ্যগোসলের স্নিগ্ধ শরীরে একটু ছুয়ে দিতে ইচ্ছে জেগে উঠলো। ভেজা চুলের,কোমল সুগন্ধে ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে সুখস্পর্শে। একটু কি ছুয়ে দিবে? হস্ত ছোয়া অথবা অধর ছোয়ায়?

রাতের ভেতরের অস্থিরতায় উথালপাথাল হয়ে যাচ্ছে সব। এতো কেন উতলা হয়ে যাচ্ছে আমি? এতো কেন ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে?? আগে তো কখনো এমন হয়নি। সন্ধ্যার শরীরদর্শন তো আমার জন্য নতুন নয়। তাহলে?? তবে কি ওর দুরত্বতা আমার ভেতরটা খাইখাইপনা জাগিয়ে দিচ্ছে?? ওকে কাছে পাওয়ার প্রবলটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে! যে কাছে পাওয়ার ইচ্ছেটাকে এতোদিন দমে রেখেছিলাম সেটা এতো বেশি উগ্র হয়ে জাগছে কেন?? কেন কেন??

“” কি হলো তুমি কি আমার আটকে যাওয়া চেইনটার দুরত্ব মাপছো? কতটা শক্তি ব্যয় করবে তার হিসেবনিকেশ করছো?? এইভাবে আর কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবো। আমার খোলা পিঠটাকে এবার তো একটু বস্ত্র দান করার ব্যবস্থা করো। চেইনটা লাগাও রাত ভাইয়া।””

সন্ধ্যার কথাতে রাতের হুশ এলো। চোখের চাহনিকে প্রশ্রয় না দিয়ে ওর চুলে হাত দিয়েছে।

“” এই সন্ধ্যেবেলায় গোসল করলি যে?””
“” বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলাম।””
“” তুই কি সবে বাসায় এসেছিস?””
“” না,তোমার আগে এসেছি। এসেই তো গোসলে ঢুকলাম।””

রাত চুল থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো।

“” আমি ফুপিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।””

রাত দ্রুত সন্ধ্যার রুম থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। এখানে আর সে এক মুহুর্তও দাড়াবেনা৷ এক মুহুর্তও না। সকালে বেড়িয়ে রাত করে বাড়ি ফেরা। তাও এই বৃষ্টিবাদলায়?? কই ছিলি তুই? কার সাথে ছিলি?? তুই কি পদে পদে আমার চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছিস?? তুই কি পেছন ফিরে একবারও দেখছিস না,তোর পদের নিচিহ্ন জায়গাটা কেমন গভীর কালো হয়ে আমি হারিয়ে যাচ্ছি???

রাত ওয়াশরুমে ঢুকে মাথায় পানির ঝরণা ছেড়ে দিয়েছে। শরীরের উত্তাপটা ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছেতে। জামাকাপড় যেমন ছিলো তেমনি রয়েছে। চেন্জ করবেনা সে। এভাবেই থাকবে। আজ সে ভেজারাত কাটাবে।

রাত যত গভীর হচ্ছে রাতের শরীরটা তত গরম হয়ে আসছে। যন্ত্রণারা মাথাটা নাড়া দিয়ে তুলছে। চোখ দিয়ে বের হচ্ছে গরম ভাপসা। শরীর বারবার কাপুনি দিয়ে উঠছে। তাতেও যেন রাত দমে যাচ্ছেনা। চোখের সামনে বারবার সন্ধ্যার খোলাপিঠটা ভেসে উঠছে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে ওর কাছে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই অন্যকারো ছাতার ছায়ায় সন্ধ্যার মুখটা ভেসে উঠছে।

ভেজা শার্টটা এখন অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে। এভাবেই বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো রাত। না চাইতেও গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে।

~~

তিয়ামতী ফযরের নামাজ শেষে ছেলের রুমের দিকেই এগিয়েছে। ছেলেটার মনে কি চলছে কে জানে?? রাতে খেতেও এলোনা৷ রাতের রুমের সামনে গিয়েই থমকে গিয়েছে।

“” এতো সকালে রাতের রুমে কি করছিস,সন্ধ্যা?””

সন্ধ্যা উল্টোঘুরে বাহির থেকে নিশব্দে দরজা লাগানোতে মনোযোগি ছিলো। আচমকা শব্দতে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। হাত থেকে ছোট্ট পেয়ালা শব্দ করে পড়ে গিয়েছে।

তিয়ামতী মেঝেতে তাকালো। পেয়ালা ফেটে গিয়েছে,চারপাশে পানি ছড়িয়ে আছে,কিছুদুরেই একটা ছোট কাপড়ের টুকরো।

সন্ধ্যা পা চালিয়ে চলে যেতে নিলে ওর সামনে এসে দাড়ালো তিয়ামতী,,,

“” তুই চাচ্ছিসটা কি বলতো। সবার চোখে তুই যেমন রুপেই থাকনা কেন,আমি কিন্তু তোর আসল রুপটা জানি। কেন এতো লুকোচুড়ি তোর মধ্যে??””

সন্ধ্যা অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। তিয়ামতী ওর গাল ছুয়ে বললো,,

“” আমাদের সন্ধ্যা যে সেই ছোট্টকালেই বড় হয়ে গিয়েছে সেটা আমার চোখের আড়াল নয়। তুই ও তা জানিস। তাহলে কেন কষ্ট দিচ্ছিস আমার ছেলেটাকে??””
“” দিবোই তো আরো দিবো। আমি যা চায় সে আমাকে দেয়না কেন?””
“” কি এমন চাস যে রাত তোকে সেটা দেয়না। আমি যতটুকু জানি তুই চাইলে ও ওর প্রাণটাও তোকে দিয়ে দিতে পারে। “”
“” তোমার ছেলের প্রাণ নিয়ে আমার কি কাজ? নিজের প্রাণ নিয়ে চলতেই হোচট খেতে খেতে আধমরা হয়ে যাচ্ছি আবার দুটো প্রাণ??””
“” তাহলে কি চাস?””

সন্ধ্যা ঠোঁটে দুষ্টু হাঁসি নিয়ে মেঝে থেকে পেয়ালা তুলতে তুলতে বললো,,

“” তোমাকে বলা যাবেনা।””
“” কেন?””
“” কারণ তুমিও তোমার ছেলের মতো মুখ পাতলা।””
“” মানে?””

সন্ধ্যা বসা থেকে উঠে দাড়ালো। তিয়ামতীর মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো,,

“” তোমার ছেলের সাথে আমার ঘটে যাওয়া অকাম-কুকাম তোমাকে বলেনি?””
“” হুম,বলেছে।””
“” তাহলে ভাবো,যে ছেলে তার গার্লফ্রেল্ডের লজ্জাজনক ঘটনা তার মায়ের সাথে শেয়ার করে সে কতটা মুখ পাতলা স্বভাবের!””
“” রাত বলেছে,আমি তো বলিনি।””
“” বলোনি,বলতে কতক্ষণ। তোমাদের মা-বেটার ভালোবাসায় আমি ভয়ার্ত।””
“” এখানে ভয়ের কি হলো? তুই এইভাবে তোর মামিকে মুখ পাতলা বানিয়ে দিতে পারলি? তাও কোনো দোষ না করে?””
“” আমি আমার মামিকে বানিয়েছি,তোমার মামিকে তো বানায়নি। তাহলে তোমার মুখ পানসে হয়ে যাচ্ছে কেন?””

সন্ধ্যার কথার উত্তরে তিয়ামতি কি বলবে বুঝতে পারলোনা। সে যে বরাবরই তর্কে পিছিয়ে তা তো কারো অজানা নয়। তিয়ামতীর এমন চুপসে যাওয়া চেহারাটা বেশ উপভোগ করলো সন্ধ্যা। বিজয়ীর হাঁসি হেঁসে চলে যেতে নিলে তিয়ামতী পেছন থেকে বললো,,

“” যা চাস তা চেয়ে নিলেই তো হয়। এমন অগোচরে দন্দ্ব না করলেই কি নয়?””

সন্ধ্যারও চলতি পথের উত্তর,,

“” তোমার ছেলে যদি না চেয়ে থাকতে পারে আমিও পারবো। হয় দেখাবে নাহয় চাইবে। দুটোর একটা তার করতেই হবে নাহলে আমার আগুনে জ্বলবে।জ্বলতে জ্বলতে ছাইয়ের টিলাতে পুর্ন হবে। আর আমি বাতাস হয়ে তার সবকিছু উড়িয়ে দিবো।””

~~
সকালে সন্ধ্যার চিৎকারে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠেছে রাত। গাঢ় ঘুম থেকে আচমকা লাফিয়ে উঠাতে মাথাটা ঝিম ধরে রইলো। চারপাশে কি চলছে বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সময় কই? সাথে সাথে সন্ধ্যার দ্বিতীয় চিৎকার তবে এবার আল্লাহর জায়গায় রাত ভাইয়া শব্দ ভেসে এলো রাতের কানে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here