ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত

0
782

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:১৮,১৯
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:১৮

“অরুনিকাকে আমি নিয়ে এসেছি।”

তিন জোড়া চকিত দৃষ্টি পড়ল জাফরের দিকে। জাফর আরেক দফা বলল—

“রিম, ঝিমকে তোমাদের বাসায় রেখে এসেছি। আর আসার সময় অরুনিকাকে নিয়ে এসেছি। আম্মা কান্নাকাটি করছিল বেশি। তাই তাকে নিয়ে আসিনি। আম্মা বলল, অরুনিকাকে নিয়ে যেতে।”

“আপাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে কে?”

জাফর রুমকির দিকে তাকাল। তারপর দৃষ্টি আবদ্ধ করল শৈবালের দিকে। শৈবালের কৌতূহলী চোখ জোড়াতে কী বিষম উদ্বিগ্নতা! জাফর আলতো গলায় বলল–

“শিমুল।”

শৈবাল অরুনিকার দিকে তাকাল। চোয়াল শক্ত করে বলল—

“বললে না কেন, জাফর ভাইয়ের সাথে এসেছ?”

“আপনি সেই সুযোগ দিয়েছেন?”

শৈবাল সহজ করল দৃষ্টি। জাফরের হাতে হলুদাভ বর্ণের ফাইল। সেটা নিয়ে নিল শৈবাল। স্বাভাবিক গলায় বলল—

“ডক্টর কী বলেছেন?”

জাফর মোলায়েম গলায় উত্তর দিলো।

“ফ্র্যাকচার। কনুয়েই একটু নিচের দিকে হাড় ফে*টে গেছে। ডাক্তার ঔষধ দিয়েছেন। বলেছেন পনেরো দিন পরে এসে আবার এক্স-রে করাতে। তখন অবস্থা বুঝে যা করার করবেন।”

শৈবাল রিপোর্টে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে বলল—

“কতদিন থাকতে হবে আপাকে?”

“কাল সকালেই ডিসচার্জ করবেন। শুধু আজকের রাতটাই।”

“অরু থাকবে এখানে?”

জাফর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—

“আরে না, নিয়ে যাও ওকে। আমি আছি এখানে। রিম, ঝিমের দিকে খেয়াল রেখো।”

অরুনিকা স্বাভাবিক গলায় বলল—

“আপনি একা ম্যানেজ করতে পারবেন তো?”

“পারব। আর একা কোথায়? শিমুল আছে তো।”

শৈবাল হাতের রিপোর্টটা রুমকির পাশে মেডিসিনের ট্রলিতে রাখল। জাফরের দিকে তাকিয়ে স্বর নামিয়ে বলল—

“ওই যে তন্দ্রা আছে না, মেয়েটার সাথে সিঁড়িতে ধাক্কা লেগে যায়। ওকেও হসপিটালে নিয়ে এসেছি। সেকেন্ড ফ্লোরে।”

অরুনিয়া বিপদগ্রস্ত গলায় বলল—

“কী বলছেন? কী হয়েছে মেয়েটার? কোথায় লেগেছে?”

শৈবাল অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে বলল—

“কোথায় লেগেছে জানি না। এডমিট করিয়ে দিয়েছি।”

জাফর আশা দিয়ে বলল—

“আচ্ছা, তুমি যাও। আমি দেখে আসবো কী অবস্থা ওর।”

সহসা অরুনিকা বলে উঠল—

“আমি মেয়েটাকে একটু দেখে আসি।”

শৈবাল কিঞ্চিৎ সন্দেহ নিয়ে বলল—

“তুমি কেন যাবে?”

“মেয়েটার কী অবস্থা দেখে আসি। শুধু ভর্তি করিয়ে দিলেই তো সব কাজ শেষ হয়ে যায় না শৈবাল।”

“ওকে, চলো।”

“আপনার যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারব।”

“একা যাবে কেন?”

“আমি এখানেই শৈবাল। অন্য কোথাও যাচ্ছি না।”

শৈবাল অপ্রভ চোখ তাকাল। অরুনিকার চোখ দুটো তখনও একরাশ অভিমানে নিমজ্জিত।
,
,
,
সফেদ বিছানাতে বসে আছে তন্দ্রা। পিঠের দিকে দুটো বালিশে ঠেস দেওয়া। নার্স তাকে ঔষধ খাইয়ে মাত্রই কেবিন থেকে বের হলো। ঠিক তখনই প্রবেশ করল অরুনিকা। তাতে ঈষৎ চমকাল তন্দ্রা। তার চাহনিতে প্রশ্নের ঝাঁক। হালকা বাদামী রঙের সুতি শাড়ি জড়ানো মায়াবী মুখের এই নারীকে আগে কখনো দেখেনি সে। অরুনিকা ধীরে পা চালাতে চালাতে প্রশ্ন করল—

“এখন কেমন লাগছে?”

তন্দ্রা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলে। তার মসৃন কপালে ভাঁজ ফুটে উঠল। সন্ধানী গলায় বলল—

” আপনি কে? ডক্টর?”

অরুনিকা মিহি হাসল। তন্দ্রার কাছে বেশ মিষ্টি লাগল সেই হাসি। অরুনিকা সরস গলায় বলল–

” আমাক দেখে তাই মনে হয়? এপ্রোন পরিনি তো! চোখে চশমাও লাগাইনি। অত পড়াশোনা আমার দ্বারা হয়নি।”

তন্দ্রা চোখে হাসল। সেই সাথে নেচে উঠল তার ওষ্ঠাধর। অরুনিকা পূনরায় বলল–

“আমি অরুনিকা। তোমাদের স্যারের ওয়াইফ।”

তন্দ্রা অবাক উচ্ছ্বাসের সাথে বলল—

“শৈবাল স্যারের ওয়াইফ?”

অরুনিকা অস্পষ্ট আওয়াজে বলল—

“হুম।”

“কেমন আছেন আপনি?”

“ভালো। তুমি?”

“আমিও।”

“শৈবালের পক্ষ থেকে আমি সরি।”

“আরে, আপনি কেন সরি বলছেন? দোষটা আমারই। আমিই বেখেয়ালে হাঁটছিলাম। জাফর স্যারের ওয়াইফ কেমন আছেন?”

“ভালো।”

অরুনিকা বিছানার একদম কাছে এলো। তন্দ্রার কোমরের হাড়ে চাপ লেগেছে। কয়েকদিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। তন্দ্রা কেমন ঘোরগ্রস্তের মতো চেয়ে রইল অরুনিকার দিকে। অরুনিকা মৃদুহাস্য অধরে মায়া নিয়ে বলল—

“চিন্তা করো না। তুমি এখানেই রেস্ট নাও। সমস্ত খরচ শৈবাল দেবে। তোমার চিকিৎসার কোনো খামতি থাকবে না।”

তন্দ্রা আচ্ছন্ন গলায় বলল—

“আপনাকে দেখার অনেক ইচ্ছে ছিল আমার। ওই যে বলে না, কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়। আজ যদি আমার কোমর না ভাঙত, তাহলে হয়তো আপনার সাথে কখনো দেখা হতো না।”

তন্দ্রা ছোট্ট হাসে। সে হাসিতে শব্দ হয় না। তবে মায়া ঝরে পড়ে রিমঝিম বৃষ্টির মতো। ছোট্ট ওষ্ঠাধরের ভাঁজ খুলে যখন তন্দ্রা হাসে, অরুনিকার বেশ লাগে মেয়েটাকে দেখতে। মেয়েটার চোখগুলোতে কী অদ্ভুত মায়া! যেন গ্রাস করে নেয়। অরুনিকা মন্থর সুরে বলল—

” এমন বলছ কেন? হয়তো দেখা হওয়ারই ছিল আমাদের। আর সবসময় কিছু পেতে হলে যে কিছু হারাতে হবে তা কেন? ”

“আপনি খুব ভালো।”

অরুনিকা অধর ছড়াল। মোহনীয় গলায় বলল—

“এক দেখায় বুঝে ফেললে আমি ভালো?”

“ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ বেস্ট ইম্প্রেশন।”

খিলখিল করে হেসে উঠে তন্দ্রা। অরুনিকার ভীষণ ভালো লাগল মেয়েটার হাসি দেখতে। এক নির্ভেজাল, আত্মতৃপ্তির হাসি। অরুনিকা বলল—

“তোমার বাড়ির কাউকে খবর দাওনি?”

“কাকে দেবো?বাবা তো নেই! মা অসুস্থ, আর ছোটো বোন ক্লাস সেভেনে পড়ে। ফোন করে বলে দিয়েছি, বান্ধবীর বাসায় থাকব।”

অরুনিকার বুক ভার হলো। পুরুষ না থাকা একটা পরিবার টেনে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি! সে তার ভাবনা কাটিয়ে বলল—

“মিথ্যে বলেছ কেন?”

“চিন্তা করবে যে? ”

“মা কী জানবে না? মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সহজ?”

“না তো! ঠিক বুঝে নেয়। তাই দুইদিন বান্ধবীর বাসায় থাকব। তারপর বাসায় ফিরে যাব। স্যার, নিশ্চয় আমাকে দুই দিনের ছুটি মঞ্জুর করবেন?”

অরুনিকা চট করে তন্দ্রার কপাল ছুঁয়ে দেয় তার পদ্মকোরকের মতো কোমল ওষ্ঠাধর দিয়ে। মাতৃ পরশের এক চাঁদোয়ায় জড়িয়ে যায় তন্দ্রা। সে নির্নিমেখ চেয়ে থাকে অরুনিকা মুখের দিকে। অরুনিকা হেসে বলল—

“কেন দেবে না! তুমি যতদিন সুস্থ না হচ্ছ অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। জীবনের জন্য কাজ, কাজের জন্য জীবন নয়। নিজের খেয়াল রেখো। আসি আমি।”

তন্দ্রা আহত হরিণ ছানার মতো নিরবধি চেয়ে থেকে আঁখুটে গলায় বলল—

“আমি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?”

অরুনিমা নিজেই জড়িয়ে ধরল তন্দ্রাকে। তন্দ্রা একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিল। অরুনিকার যাওয়ার পর তন্দ্রা বিবশ দৃষ্টি চেয়ে রইল ওই শূন্য পথের দিকে। তন্দ্রার মনে হলো, তাকে ঘিরে রেখেছ এক মাতৃস্নিগ্ধ আবেশ, এক নেশাতুর আদুরে ঘ্রাণ; যা সে অরুনিকার দেহ থেকে নিংড়ে নিয়েছে। যেমনটা সে তার মায়ের বুকের কাছে পেয়ে থাকে!
,
,
,
রুমকির কেবিনের সামনে ওয়েটিং চেয়ারে দেয়ালে মাথা হেলিয়ে বসে আছে শৈবাল। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অরুনিকা জড়ানো গলায় বলল—

“এখানে বসে আছেন কেন?”

শৈবাল চোখ খুলল। সোজা হয়ে বসল। ক্লান্ত গলায় বলল—

“কিছু না। বাসায় চলো অরু।”

“আপাকে বলেছেন?”

“বলেছি।”

“তাহলে বসুন, আমি আপার সাথে দেখা করে আসি।”

শৈবাল চোখ বুঝে ইশারা করল। করিডর দিয়ে চঞ্চল পায়ে হেঁট আসছে শিমুল। তাদের নিকটে আসতেই বলল—

“ভাবি কোথায়?”

শৈবাল বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। অরুনিকা ঠোঁট চেপে শ্বাস ফেলছে। শৈবাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল—

“তুই কোথায় ছিলি?”

“আমি তো তোদের বাসায় গিয়েছিলাম। ভাইয়া বলল, রিম, ঝিমকে তোদের ওখানে রেখে আসতে।”

“ও, আচ্ছা। ওই যে আপার কেবিন।”

“আচ্ছা।”

শৈবাল আর কোনো কথা বলল না। অরুনিকার চোখ জলে ভরে ওঠে। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাঁটা শুরু করে শৈবাল। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যন্ত্রচালিত মানবের মতো করিডর ধরে সোজা হাঁটতে থাকে। অরুনিকা সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট ভেঙে কান্না আসছে তার। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে অরুনিকা।

চলবে,,,

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:১৯
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি

পুরো রাস্তায় আর একটা কথাও বলেনি শৈবাল। অরুনিকাকে কোনো প্রশ্নও করেনি। শৈবাল শুধু একমনে ড্রাইভ করেছে। আর তার দিকে আবক্ষ পানিতে ডুবে যাওয়া মনুষ্যের মতো একরাশ আশা নিয়ে চেয়ে ছিল অরুনিকা।

তারা দুইজন বাসায় ফেরার পূর্বেই ঘুমিয়ে পড়েছে রিম,ঝিম। নমিতা বেগম আর তৌফিক সাহেব না খেয়েই শুয়ে পড়েছেন। অরুনিকা একবার জোর করেছিল কিন্তু তারা খাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

বাসায় ফেরার পর কোনো ঝামেলা করেনি শৈবাল। তা দেখে অতিমাত্রায় বিস্মিত হয় অরুনিকা। হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে শৈবাল। অরুনিকা টেবিলে খাবার রেখে রুমে এসে ঢুকে। শৈবাল লম্বা হয়ে শুয়ে কপালে আড়াআড়ি হাত দিয়ে রেখেছে। অরুনিকা অনেকটা নিচু স্বরে রয়ে সয়ে বলল—

“খেতে আসুন, শৈবাল।”

ক্ষণপলেই কথা বলল শৈবাল।

“আমার খিদে নেই অরু। তুমি খেয়ে নাও।”

অরুনিকা ভীতসন্ত্রস্ত। তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। শুষ্ক গলা থু থু জমিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলল—

“প্লিজ শৈবাল, খেতে আসুন।”

“আমার ইচ্ছে করছে না অরু।”

অরুনিকা চপল গলায় ভীতিহীন মনে বলল—

“এখানে নিয়ে আসি? আমি খাইয়ে দেবো আপনাকে।”

শৈবাল কপালের ওপর থেকে হাত সরাল। তৎক্ষণাৎ তার আরক্ত চোখ জোড়া দেখে শিউরে উঠল অরুনিকা। সে চোখের পাতা প্রশস্ত করল। শৈবাল অরুনিকার দিকে চেয়ে ঠান্ডা মেজাজে বলল—

“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না অরু। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ না?”

অরুনিকা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। শৈবালের শীতল কণ্ঠস্বর তার রক্তহীম করে দিলো। শৈবাল কাত হলো।অরুনিকা যে পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার উলটো দিকে মুখ করে শুল। একটা পাতলা সাদা টিশার্ট পরেছে শৈবাল। তার পিষ্ঠদেশের ওপর কালো কালিতে ইংরেজিতে দ্যা শ্যাডো লেখা। কৃত্রিম বাতির ঝলমলে আলোতে তা স্পষ্ট দেখল অরুনিকা।

“বাতিটা নিভিয়ে দাও অরু। তুমি খেয়ে আসো।”

শৈবালের কথায় রুমের বাতি নিভিয়ে বেরিয়ে এলো অরুনিকা। গরম করে টেবিলের ওপর রাখা খাবারগুলোর খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। অপলকে চেয়ে আচমকা বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘ প্রশ্বাস ফেলল । অরুনিকা নিজেও খেল না। কিছু খাবার ফ্রিজে আর কিছু খাবার রেকের ভেতর রেখে রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে দিলো।

রুমের ভেতর ঢুকতেই কেমন শিরশির করে উঠল তার কোমল দেহ। দরজা বন্ধ করে স্থির চোখে তাকাল। শৈবালকে এতটা শান্ত বিয়ের পরে আর কখনো দেখিনি সে। এত বড়ো একটা ঘটনায় যে শৈবাল এমন ব্যবহার করবে তা অরুনিকার ভাবনাতীত। সে নরম পায়ে বিছানার কাছে এলো। তারপর বিনা শব্দে বিছানায় বসল। শৈবাল ঘুমিয়ে পড়েছে? নিজেকে প্রশ্ন করল অরুনিকা। সে কী একবার কথা বলে দেখবে? যদি ক্ষেপে যায়! নিজেকে নিজে নানা প্রশ্ন করে অরুনিকা। ঘুরে ফিরে তার উত্তর একটাই। সে আর কিছু ভাবতে পারল না। বিনা শব্দে ডানপাশে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ল। হরিৎ রঙের গোলাকার বাতিটির ক্ষীণ প্রভাতে কেমন ঘোর লেগে এলো অরুনিকার চোখে। সেই অস্পষ্ট, অপ্রভ আলোতে চোখ মেলে দীর্ঘসময় চেয়ে রইল অরুনিকা। নিস্তেজ, নিস্তরঙ্গ দৃষ্টি। দক্ষিণা বাতাস খোলা বাতায়নের পর্দা উড়িয়ে হুরহুর করে ঢুকছে। শীতলতার চাদর নামছে সংগোপনে। অরুনিকা দেহভঙ্গিমা বদলে সোজা হলো। আড়চোখে তাকাল শৈবালের দিকে। মানুষটা কী সত্যি ঘুমাচ্ছে? অরুনিকা পুরোদস্তুর কাত হলো শৈবালের পিঠের দিকে। হাত উঠিয়ে ছুঁতে গিয়েও থেমে গেল।
একে অপরের নিঃশ্বাসে ক্লান্ত হওয়া দুটো প্রাণ এখন পাশাপাশি থেকেও কতটা দূরত্বে ! অরুনিকা ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছে। সে শৈবালের সাথে কথা বলার চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। বরঞ্চ টুক করে তার মনে উঁকি দিলো এক গুচ্ছ গোলাপ ফুলের সুগন্ধের টান। সে ভেবে নিল, শৈবাল হয়তো সুস্থ হচ্ছে! নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে সে। প্রফুল্লচিত্তে মুচকি হাসে অরুনিকা। বালিশের ওপর প্রথমে বাম হাত পরে ডান হাতে রেখে তার ওপর মাথা রাখে সে। গোলাপের কুঁড়ির মতো হাসছে তার ওষ্ঠাধর। সে গুটিশুটি মেরে নিজের সমস্ত ভাবনা কেন্দ্রীভূত করে চেয়ে রইল শৈবালের দিকে। সেই নিরবচ্ছিন্ন, মোহের দৃষ্টি কাটিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল তা সে জানে না।

রাতের মধ্যভাগ। নিস্তব্ধ শহরে জ্বলে আছে শুধু রাস্তায় পাহারারত সোডিয়াম লাইট। অন্ধকার আকাশের বুকে রূপালি চাঁদ। থোকা থোকা কালো মেঘ একটু পরপর আড়াল করছে বিধুকে।

চকিতে ঘুম ভেঙে যায় অরুনিকার। শৈবালের অত্যন্ত নিকটে থাকার দরুন তার কিছু অনুভূত হলো। তড়িঘড়ি উঠে বসে অরুনিকা। ভীতিগ্রস্ত চোখে আরেকটু এগিয়ে এলো শৈবালের কাছে। তার বাজুতে হাত দিতেই অরুনিকা বুঝতে পারল শৈবালের দেহ কম্পিত হচ্ছে। অরুনিকা অধৈর্য গলায় ডেকে উঠল—

“শৈবাল! শৈবাল! আপনি ঠিক আছেন?”

শৈবাল কথা বলল না। তপ্ত দেহ যেন জ্বলন্ত অনল। অরুনিকা চটজলদি বিছানা থেকে নামলো। বিছানার পাশ টেবিলে থেকে হাতড়ে ঔষধ বের করল। বোতলে পানি নেই। আবছা আলোতেই দরজা খুলে দ্রুত ছুটে গেল ড্রয়িং রুমে। সেখানে বাতি জ্বলছে। জগ থেকে পানি ঢালল গ্লাসে। তূরন্ত বেগে পা চালিয়ে ফিরে এলো সে। শৈবাল তখনও কাঁপছে। পানি আর ঔষধ পাশে রেখে শৈবালকে ধরে বসায় অরুনিকা। ঔষধটা খাইয়ে দিয়ে বদ্ধ শ্বাস ফেলল। অরুনিকা বুঝতে পারল, এমনটা হওয়ার কারণ। এই কারণেই শৈবালের উগ্রতাতেও চুপ করে থাকে সে। নিজের রাগ ঝারতে না পারলে শৈবালের মেন্টাল কন্ডিশন আরও বেগতিক হয়। তার পালস রেট বেড়ে গিয়ে দেহে কম্পন শুরু হয়।
অকস্মাৎ ভয় কিংবা অতি ভয়ং/কর কোনো দুঃচিন্তায় মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে শৈবালের ক্ষেত্রেও তেমন ঘটে। তার রাগ আর জেদ শিরায় শিরায় তখন তান্ডব চালায়। কিছুক্ষণ যেতেই শান্ত হয়ে আসে শৈবালের দেহ। তাকে বিছানায়া শুইয়ে দেয় অরুনিকা। মাথার কাছে বসে সে। শৈবাল তখন নিশ্চুপ। তার লালাভ চোখ দুটোতে অস্থিরতা, কাতরতা, বিধুরতা। শৈবালের চুলে হাত গলিয়ে দেয় অরুনিকা। এক হাতে আলগোছে অরুনিকার কটিদেশ জড়িয়ে ধরল শৈবাল। অরুনিকা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো শৈবালের। তদ্দণ্ডে নিজের মাথাটা অরুনিকার গুছানো কোলে রাখল শৈবাল। অরুনিকা নম্র গলায় বলল—

” আপার এমন অবস্থাতেও যদি আমি তাকে দেখতে না যেতাম, তাহলে কী তা ভালো দেখাত? জাফর ভাই কী করে আপাকে রেখে আমাকে নিতে আসত? বাবার শরীরটাও তো ভালো নেই যে আমাকে দিয়ে আসবে। আর তখন এত সময়ও ছিল না, যে আপনাকে ফোন করে আমি অপেক্ষা করব। এত কেন ভয় পান আপনি শৈবাল?”

শৈবাল জবাব দিলো না। ছোট্ট বাচ্চারা যেমন আদর পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে তেমন করে নিজেকে প্রিয়তমার নিকট সমর্পণ করল শৈবাল। অরুনিকার জলপুকুর টইটুম্বুর। সে কপট হাসি হেসে বলল—

“যদি আমার মৃ/ত্যুই থাকে তাহলে তা যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় হতে পারে। এই বাড়ির ভেতরে বা বাইরে, বাস হোক বা প্রাইভেট কার। মৃত্যুকে কেউ ঠেকাতে পারে না শৈবাল। আপনি বা আমিও নই। আমরা শুধু অপেক্ষা করতে পারি সেই দিনের। তা কোনো যুগে বা বছরে, মাসে বা দিনে, মিনিটে বা সেকেণ্ডেও আমাদেরকে তার দর্শন দিতে পারে। আমরা চেয়েও তাকে টলাতে পারব না।”

শৈবার এবারও কথা বলল না। দুই হাতে অরুনিকার কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার উদরে মুখ গুঁজে দিলো। অরুনিকা হতাশ শ্বাস ফেলল। বলল—

“আল্লাহ পাক কী বলেছেন জানেন? বলেছেন, যদি তাঁর বান্দা তাঁর থেকে অন্য কাউকে বেশি ভালোবাসে তাহলে তিঁনি ওই ব্যক্তির কাছ থেকে তার সেই প্রিয় মানুষকে কেড়ে নেবেন। আপনি কী আমাকে তেমন ভালোবাসেন শৈবাল?”

“আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না অরু।”

যেন এক লহমায় দুনিয়া নড়ে উঠল অরুনিকার। শৈবালের ব্যাথা ঝরা কণ্ঠে কী করুন স্বীকারোক্তি! অরুনিকা নিশ্চুপ। তার চোখের জল অবাধে গড়িয়ে পড়ছে শৈবালের চুলের ভেতর।

এক অদেখা, অপ্রকট, অলক্ষিত ভালোবাসার পরিবৃত্তে পরিবেষ্টিত দুই মানব-মানবী। দুজন দুজনকে হাজারবার ছুঁইয়েও যেন এখনো ছোঁয়া হয়নি। যেন এক অনতিক্রম্য প্রাচীর মাথা চাড়া দিয়ে আছে তাদের দুই জনের অন্তঃপুরে। সেই প্রাচীরের উচ্চতা অজ্ঞাত, অপ্রমেয়। দ্বিধার প্রাচীরের দুই পাশে দাঁড়িয়ে একে অপরকে নিচ্ছিদ্র আশ্লেষে আবদ্ধ করার প্রয়াস।
,
,
,
প্রস্ফুটিত মিহিরের পূর্ণ তাপ গায়ে মাখছে ধরণী। হেসে খেলে উঠছে প্রকৃতি।
দেখতে দেখতে পনেরো দিন চলে গেল। রুমকির হাতে নতুন করে প্লাস্টার করে দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে চিলিক দিয়ে ওঠে তার হাত। সেই ব্যাথা নিরসনের জন্য তাকে ঔষধ দেওয়া হয়েছে। আর বলা হয়েছে আরও বিশ দিন পর যেতে।

রুমকি এখন তার বাবা বাড়িতে থাকে। অরুনিকা পূর্ন যত্ন করে তার। সকালের খাওয়া থেকে শুরু করে রাতের ঔষধ খাওয়া পর্যন্ত, সবকিছু অরুনিকা নিজের হাতেই করে। রিম, ঝিম এখান থেকেই তাদের স্কুলে আসা যাওয়া করে।

বিকেলের দিকে বাচ্চা দুটোর আবদারে পাকোড়া বানিয়েছে অরুনিকা। রিম, ঝিম তাদের নানা-নানীর রুমে খেলছে আর সেখানেই খাচ্ছে। শ্বশুর -শাশুড়িকে চা বানিয়ে দিয়ে রুমকির রুমে এলো অরুনিকা। রুমকির খাওয়ার এক পর্যায়ে যখন অরুনিকা চলে আসতে চাইল তখন সে বলল—

“তোকে একটা কথা বলব?”

“বলুন।”

“আর তো কিছুদিন বাকি তোদের বিয়ের একবছর হতে। তোরা কিছু ভেবেছিস? মা কিছু বলেনি তোকে?”

অরুনিকা মৃদু গলায় বলল—

“আপনিই তাহলে আম্মাকে বলেছেন, বাচ্চার কথা?”

“বলেছি তো কী হয়েছে! সময় কী কম গেছে? দেখ, অরুনিকা, শৈবাল তো ঠিক হচ্ছে। একটা বাচ্চা হলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। ও একদম শান্ত হয়ে যাবে। তুই আর না করিস বোন।”

অরুনিকা মুচকি হাসল। তার চোখভরা তাচ্ছিল্য। সরল গলায় বলল–

“যদি বাচ্চা হতে গিয়ে আমি ম/রে যাই? তাহলে, ভাইকে আবার বিয়ে করাবেন, আপা?”

“এসব কী বলছিস তুই?”

রাগ ঝরে পড়ল রুমকির কণ্ঠে। অরুনিকা নির্ভীক গলায় শ্লেষ মিশিয়ে বলল—

“তা এবার কোন নামের মেয়ের সাথে ভাইয়ের বিয়ে দেবেন? অরুনিমা না কী অরুনিতা?আপনার ভাই তো আবার অরু ছাড়া তার বউকে অন্য নামে ডাকতে পারবে না।”

রুমকি ঘি ঢালা আ/গুনের মতো তেতে উঠল। বলল—

“এসব কী বলছিস তুই? মাথা খারাপ হয়েছে তোর?”

অরুনিকা ম্লান হেসে বলল—

“আমাকে আরেকটু সময় দিন আপা। আমি চাই না, আমি যা সহ্য করছি তা আমার সন্তানও সহ্য করুক।”

অরুনিকা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল। নিজের রুমে এসে বিছানার কাছ ঘেষে মেঝেতে বসল। গলা কাঁপছে তার। শ্বাস রোধ হয়ে আসছে। চকিতে ঝমঝম নোনতা বৃষ্টিতে প্লাবিত হলো তার কপোল। দুই হাঁটু জোড়া করে বিছানায় পিঠ ঠেসে দিয়ে সোজা হয়ে বসল সে। কান্নার দমকে এবার বুক কাঁপছে তার। আচম্বিতে পেটে হাত রেখে বলে উঠল সে—

“আমি তো ওকেই বাঁচাতে পারিনি, তাহলে আরেকজনকে কী করে বাঁচাব?”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here