ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত #পর্ব:২০,২১

0
890

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:২০,২১
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:২০

বিয়ের দুই মাস পর একদিন সকালে শৈবালকে অফিসে নিয়ে যায় জাফর। শৈবাল তখনো মানসিকভাবে ফিট নয়। তৌফিক সাহেব একা ছাড়লেন না ছেলেকে। তিনিও সাথে গেলেন। বাড়িতে শুধু নমিতা বেগম আর অরুনিকা। স্বামী-স্ত্রীর বাধ্য সম্পর্কের বাইরে ততটা মনের সম্পর্ক তখনো গড়ে ওঠেনি অরুনিকা আর শৈবালের মধ্যে। বন্দি জীবন, শৈবালের অসহনীয় ব্যবহার, মন খারাপের বিকেল। ঠিক তখন বসন্তের হাওয়ার মতো এলো একটা ফোন কল। অরুনিকার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী স্বাধীনতা ফোন করেছে। বাসায় তেমন কেউ না থাকায় সুযোগ পেল অরুনিকা। শাশুড়ির কাছ থেকে ঘণ্টা দেড়েকের সময় চেয়ে বেরিয়ে পড়ল। দুই বান্ধবীর খোশগল্পে কখন বিকেল পেরিয়ে সাঁঝের মায়ায় ঘিরে ধরল ধরণীকে অরুনিকা টের পেল না।

শৈবাল বাসায় ফিরল সন্ধ্যার একটু আগেই। অরুনিকাকে না পেয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। সোজা নিজের রুমে গিয়ে বসে রইল। জরুরি কাজ শেষ করে তৌফিক সাহেব ফিরলেন সন্ধ্যায়। অরুনিকা তখনো ফেরেনি। শৈবালের নীরবতায় তারাও তেমন সাড়াশব্দ করল না।

সন্ধ্যার আকাশ যখন রাতকে ছুঁই ছুঁই করছে তখন বাসায় ফিরে অরুনিকা। খোলা আকাশের নিচে নিঃশ্বাস নিতে পেরে নিজেকে আজ জীবন্ত মনে হচ্ছে তার। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসও কিনেছিল নিজের পছন্দ মতো। তার জন্য দরজা খুলেছে নমিতা বেগম। তার কাছ থেকেই শৈবাল ফিরে আসার কথা জানতে পারল। একরাশ খুশির সাথে যখন নিজেদের রুমে ঢুকল অরুনিকা এক আত্ম চিৎকারে নিস্তব্ধ বাড়িতে আলোড়ন তুলে ফেলল।

শৈবাল বসে আসে বিছানার পাশে। তার চোখ দুটো বন্ধ। হাতের কাছের মেঝে সয়লাব রক্তজলে।
শৈবালকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার এই অবস্থা দেখে ঠিক থাকতে পারল না অরুনিকা। লাগাতার বমি হতে হতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার দেহ।

শৈবালকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অরুনিকাকে পাঠানো হয় তার বাবার বাড়ি। রোজ মোবাইল ফোনেই চলে শৈবালের খবর নেওয়া। নমিতা বেগম, রুমকি, তৌফিক সাহেব, জাফর সকলের যায় যায় অবস্থা। শৈবাল আর অফিসকে একসাথে সামলাতে হিমশিম খেতে হয় জাফরকে। মা’কে সামলাতে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ে রুমকি। বাচ্চা দুটোরও তখন বেজায় খারাপ অবস্থা।

শৈবালের এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করে অরুনিকা। সেই রক্তাক্ত দৃশ্য আর মনঃকষ্ট তাকে পিষে ফেলছে নিরন্তর। মানসিক যন্ত্রণার সাথে তার শারীরিক যন্ত্রণাও বাড়তে থাকল। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কিছুদিন কাটাতেই তার দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। এতকিছুর মাঝে হঠাৎ একদিন তলপেটে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো তার। তাতে পাত্তা দিলো না অরুনিকা। কিন্তু সময়ের সাথে সেই ব্যাথা ক্রমশ বাড়তে থাকল। ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বিছানা থেকে নামতেই তার মনে হলো, উষ্ণ তরল তার নিম্নাংশ দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। অরুনিকা কঁকিয়ে উঠল। তলপেটে এক হাত চেপে অন্য হাতে বিছানায় ভর দিয়ে নিচে বসে পড়ল। রক্তে তার দুই পা ভিজে উঠেছে।

মৌমিতা বেগম সে কথা কাউকে জানাননি। স্বাধীনতার মা’কে ফোন করেন। ভদ্রমহিলা যে হাসপাতালে বসেন সেখানের ঠিকানা দিতেই অরুনিকাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয়।

লুকোচুরির খেল চলল কিছুদিন। এর মাঝে এক ছোট্ট প্রাণ হারিয়ে গেল কতগুলো মানুষের অগোচরে। অরুনিকাকে শৈবালদের বাসায় ফিরিয়ে আনা হলো শৈবালের দুর্ঘটনা ঘটার বিশ দিন পর। শৈবাল তখনো শান্ত। অরুনিকা পূর্বের ন্যায় সংসারে মনোযোগী হলো। দূরত্ব তৈরি করে নিল সে। শৈবাল প্রশ্ন করল না। সময় চলতে লাগল আপন গতিতে। আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করল তাদের দাম্পত্য জীবন। তবে এবার আর ভুল নয়। কোমলতাকে শক্ত কাচের প্রলেপ লাগিয়ে দিলো অরুনিকা। হয়ে উঠল এক অন্য অরুনিকা। হজম করে নিল নিজের সন্তান হারানোর এক সাগর কষ্টকে। বছর ঘুরে আসতেই আজ আবার সে ক্ষত তাজা হয়ে উঠল।

চকিতে চোখ মেলল অরুনিকা। ঘুমো ঘুমো চোখ দুটো মেলে ধরে বলল—

“শৈবাল আপনি?”

অরুনিকা বিভ্রব নিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। শৈবাল আলতো গলায় বলল—

“এখানে বসে আছ কেন অরু?”

অরুনিকা সোজা হয়ে বসল। নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে ঘুমো কণ্ঠে বলল—

“তেমন কিছু না। এমনেই বসেছিলাম। কখন যে চোখ লেগে এলো। আপনি…আপনি এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে?”

“সন্ধ্যা সাতটা বাজে অরু। আর তুমি ফ্লোরে বসে আছ কেন?”

অরুনিকা উঠে দাঁড়াল। অতীতে ডুব দিতেই কখন যে তার চোখে ঘুম লেগে এসেছে!
অরুনিকা মৃদু গলায় বলল—-

“সাতটা বেজে গেছে! ইশ! আম্মাকে চা দেওয়া হয়নি। বাচ্চা দুটোকেও কিছু খেতে দেইনি। আমার যে আজকাল কী হয়েছে! ”

অরুনিকা চপল পায়ে সরতে গেলে তার হাত ধরল শৈবাল। আবিষ্ট গলায় বলল—

“তুমি কাঁদছিলে অরু?”

অরুনিকা সরস হাসল। মিথ্যে অভিনয় তো তাকে রোজই করতে হয়। কখনো নিজের সাথে তো কখনো অন্যকারো।

“নাতো।”

“তুমি মিথ্যে বলছ অরু। কেন কাঁদছিলে তুমি? তোমার চোখের এই অবস্থা কেন?”

অরুনিকা চঞ্চল হেসে বলল—

“আজকাল আমার খুব ঘুম পায়। আপনিই বলুন, এত ঘুম পেলে চলে? এই জন্য চোখ লাল হয়ে আছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। সাতটা বেজে গেছে। রিম, ঝিমকে খাইয়ে দিই। নাহলে আবার ঘুমিয়ে পড়বে।”

শৈবাল হাত ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে রইল। অরুনিকা পা বাড়িয়ে আবার পেছন ফিরল। হাতের দিকে তাকিয়ে বলল—

“হাতটা ছাড়ুন শৈবাল।”

“তুমি কাঁদছিলে কেন অরু? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?”

অরুনিকা খিলখিল করে হেসে উঠল। শৈবালের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। জিব বের করে বাচ্চাদের মতো ভেঙচি কে/টে চোখ রাঙিয়ে বলল—

“ভূতে বলেছে। যান তো। ফ্রেশ হয়ে আসুন। ”

“তুমি সত্যি বলছ অরু?”

“উহু, মিথ্যা। তাহলে কী শাস্তি দিবেন আমাকে?”

ঝট করে অরুনিকাকে জড়িয়ে ধরল শৈবাল। অরুনিকার সমস্ত ক্লান্তি, বিষাদ যেন এক নিমেষে উবে গেল। স্বামীর বুকে মাথা লেপ্টে দিয়ে পরম শান্তিতে নিঃশ্বাস নিল সে।
,
,
,
“মামিমা বেশি করে ডিম দাও।”

“দিচ্চি।”

রিম আর ঝিমকে খাইয়ে দিচ্ছে অরুনিকা। দুই বোন খাচ্ছে আর টুকটুক করে কথা বলছে। শৈবাল এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে। তাকে দেখে রিম চেয়ে রইল। দন্তপাটি বের করে ভ্রূ উঁচুনিচু করে অরুনিকাকে ইশারা করছে। ঝিম চিৎকারে করে বলে উঠে—

“মামা! ”

শৈবাল স্মিত হেসে ভেতরে প্রবেশ করে। অরুনিকা বিছানার ওপর বসে দুই বোনকে খাইয়ে দিচ্ছিল। ঠিক তার পেছনে লেগে বসে শৈবাল। রিম উচ্ছল গলায় বলল—

“মামিমা, মামাকেও খাইয়ে দাও।”

অরুনিকা ছোট্ট করে হেসে রিমের মুখে ভাতের লোকমা পুরে দিয়ে বলল—

“মামা পরে খাবে।”

ঝিম আদুরে অভিলাষে বলল—

” এখান থেকে খাইয়ে দাও।”

শৈবাল মিষ্টি করে হাসে। অরুনিকার একদম পেছনে লেগে বসে আছে সে। মুখটা অরুনিকার কানের কাছে নিয়ে বলল—

“খাইয়ে দাও।”

অরুনিকা ঝাড়া মেরে বলল—

“পাগল হয়েছেন? সিদ্ধ ডিম দিয়ে ভাত খাচ্ছে ওরা।”

“তাতে কী? খেয়ে নেব আমি। দাও।”

রিম, ঝিম একসুরে বলে উঠল—-

“দাও, দাও, মামাকেও খাইয়ে দাও।”

“উহু। তোমাদের মামার হাত আছে। সে নিজেই খেয়ে নিতে পারবে।”

রিম একগাল হেসে বলল—

” আমাদেরও তো হাত আছে মামিমা।”

শৈবাল ফিচেল হাসল। অরুনিকার কানে ফুঁ মেরে বলল—-

“এবার বলো।”

“আপনি যান এখান থেকে। আমি ওদেরকে খাইয়ে আসছি।”

“আপা কোথায়?”

“আম্মার ঘরে।”

রিম বলল—

“মামা, তুমি আমাদের স্কুলে যাবে? কাল মিটিং আছে।”

শৈবাল ভ্রূকুঞ্চন করে বলল—

“কীসের মিটিং?”

অরুনিকা ঝিমের মুখে খাবার দিয়ে বলল—-

“প্যারেন্টস মিটিং। জাফর ভাইকে ফোন করেছিলাম। বলল, যেতে পারবে না। কী যেন জরুরি কাজ আছে তার। আপাও যাবে না বলেছে।”

“তাহলে তুমি চলে যাও।”

“আমি কী করে যাব?”

“তুমিও ওদের মা। মামি…মা।”

রিম উচ্ছ্বাসের সাথে বলল—

“হ্যাঁ, তুমিও মা। তোমার গায়েও আম্মু আম্মু গন্ধ।”

রিম হাঁটুতে ভর দিয়ে উঁচু হয়। অরুনিকার হাতে নাক ঘষতে থাকে। ঝিমও বাদ যায় না। সেও এঁটো মুখে অরুনিকার গালে চুমু বসিয়ে বলল—

“হ্যাঁ, তোমার গায়েও আম্মুর মতো গন্ধ। আম্মু, আম্মু।”

অরুনিকা কপট বিরক্তি ঝেড়ে বলল—

“আরে কী শুরু করলে! বসো।”

দুই বোন কলকল করে হেসে ওঠে। শৈবাল চাপা গলায় বলে উঠে—

“সাবিনা ম্যামকে কল করেছি। কাল যেতে বলেছেন। ওদেরকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে তারপর যাব। তুমি যাবে আমার সাথে।”

“না যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই।”

শৈবাল বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। পরক্ষণেই ঝুঁকে গিয়ে অরুনিকার কানে ফিসফিসিয়ে বলল—

“মেয়েরা মা হলে নাকি তাদের দেহে মা মা গন্ধ হয়। ওরা সত্যি বলছে অরু?”

অরুনিকা বিভ্রান্ত চোখে তাকাল।

চলবে,,,

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:২১
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি

পোলাও আর মাংসের সুগন্ধে মৌ মৌ করছে বসার রুম। রিম, ঝিম খুশিতে আত্মহারা। ছোটাছোটি করছে তারা দুইজন। লাভ শেপ বেলুনের ঢল মেঝের বুকে। আজ শৈবাল আর অরুনিকা প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। বাইরের কাউকে দাওয়াত করা হয়নি। একান্ত প্রিয় মানুষগুলোকে শুধু বলা হয়েছে।

অরুনিকার বাবা-মাও এসেছেন। জাফর এসেছে শিমুলকে সাথে নিয়ে আর সাথে তাকে সাবধান করে দিয়েছে যেন অরুনিকার আশেপাশে না যায়। শিমুল দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। রিম, ঝিম হাতের কেক খাইয়ে দিচ্ছে মামাকে। পালাক্রমে দুইজনের হাতেই কেক খেল শৈবাল। নমিতা বেগম আর রুমকি রাতের খাবার গুছিয়ে রাখছেন টেবিলের ওপর। তৌফিক সাহেব অরুনিকার বাবা হাসান আলীর সাথে কথা বলছেন একপাশে বসে।

বেবি ব্লু কালারের শাড়ি পরেছে অরুনিকা। তার পিঠে ছড়ানো চুল। মৃদুহাস্য অধর। চোখে অকৃত্রিম সতেজতা। সাদা রঙের একটা মিষ্টি জাফরকে জোরপূর্বক খাইয়ে দিলো। জাফর নাক কুঁচকে বলল–

” এটা কিন্তু একদম ঠিক নয়।”

অরুনিকা একগাল হেসে বলল—

“ঠিক বেঠিক পরে হবে। আগে হাতটা দিন।”

“কেন? আমার হাতের আবার কী হলো?”

“হয়েছে বলেই মিষ্টিমুখ করালাম আপনাকে।”

জাফর মনখোলা হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়। অরুনিকা একটা সিলভার কালারের ঘড়ি পরিয়ে দেয় জাফরের হাতে। জাফর চমকিত চোখে চেয়ে বলল–

“আরে, অ্যানভার্সিরি তোমাদের! গিফ্ট আমাকে কেন?”

“এটা আমার ভাইয়ের জন্য।”

জাফরের চমকে যেন ভাটা পড়ল! সে নিভে যাওয়া চোখে বলল—

“মানে?”

অরুনিকা কাতরতা মিশ্রিত হেসে বলল—

“আমার ওই কঠিন মুহূর্তে যদি আপনি পাশে না থাকতেন, তাহলে কী করে আমার আম্মু একা এসব সামলাতো! ”

জাফর সামনে তাকাল। তারপর ধাতস্থ হয়ে অরুনিকার দিকে তাকিয়ে বলল—

“হঠাৎ এসব বলছ কেন? আমি যা করেছি আমার দায়িত্ব মনে করে করেছি। এই বাড়ির সম্মানের কথা ভেবে করেছি। তোমার আর শৈবালের ভালোর জন্য করেছি।”

“জানি। তাই তো এতবড়ো সত্য আজও গোপন রয়ে গেছে।”

“এসব নিয়ে আর ভেবো না অরুনিকা। যা হয়েছে ভুলে যাও। ডঃ সাবিনার সাথে আমার কথা হয়েছে। শৈবাল আগের চেয়ে বেটার। আরেকটু সময় দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হুম।”

“বাবা আমার আর শিমুলের জন্য কম করেননি। আমি যখন তার অফিসে স্বল্প বেতন চাকুরী করি, তখন স্কুলে পড়ত শিমুল। ধীরে ধীরে নিজের যোগ্যতায় আমি তার প্রিয় হয়ে উঠি। নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন তিনি আমাকে। এতটা প্রিয় হয়ে উঠি যে নিজের একমাত্র মেয়েকে আমার হাতে তুলে দেন। আমার বাবা-মা নেই। বিয়ের পর এখানেই ছিলাম একবছর। পাড়া প্রতিবেশীরা তো চুপ করে থাকবে না। তাই বাসা ভাড়া নিলাম। তবুও বছরের বেশিরভাগ সময় রুমকি এখানেই থাকত। ওর কলেজ এখান থেকে কাছে ছিল। শৈবালকেও আমি শিমুলের মতোই আমার ভাই ভাবি।ওর সাথে যা ঘটেছে তা একদম ঠিক হয়নি।”

অরুনিকা শ্রান্ত শ্বাস ফেলল। চোখে-মুখে বিষাদ ছেয়ে গেল। তাকে প্রাণবন্ত করতে জাফর বলল—

“তোমাকে কিন্তু আমায় বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াতে হবে। এই রুমকির হাতের রান্না খেয়ে আমি কিন্তু খুব কষ্টে আছি। বিয়ের পর দুই বছর আমাকে দিয়ে রান্না করিয়েছে। আর তারপর থেকে যা রান্না করে…আমি খেয়ে বেঁচে আছি কোনোরকম।”

অরুনিকা ফিক করে হেসে ফেলল। হেসে হেসে বলল—

“আপাকে কিন্তু বলে দেবো, আপনি তার রান্নার বদনাম করেছেন।”

“এত তাড়াতাড়ি ম*রতে চাই না আমি।”

খিলখিল করে হেসে ওঠে অরুনিকা। টলটল করছে তার চেহারা। খাবার টেবিলের কাছে আসতেই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। অরুনিকা কল রিসিভ করল সেখানেই। ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল। অরুনিকা এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটল।

কিছুসময় পরে যখন খাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত হলো, শৈবাল তখন অরুনিকাকে খুঁজতে লাগল। তাকে বসার রুমে না পেয়ে নিজের রুমে ঢুকল। অরুনিকা বিছানায় বসে আছে। দেয়ালের দিকে সরল দৃষ্টি তার। চোখের স্রোত নামছে নিঃশব্দে। শৈবাল বিচলিত। দ্রুত দরজা আটকে দিয়ে ছুটে এলো অরুনিকার কাছে। তার পায়ের কাছে বসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল—

“অরু, তুমি কাঁদছ কেন? এই অরু, এই, কী হয়েছে তোমার?”

অরুনিকার গলা কাঁপছে। তার চোখ দুটো রক্তবর্ণ। অগ্নি ঝরা কণ্ঠে বলল—

“মে*রে ফেলুন আমাকে। এত কষ্ট না দিয়ে একবারে মে*রে ফেলুন। বেঁচে যাই আমি।”

শৈবাল বিভ্রান্ত চোখে তাকাল। অরুনিকার অনলের মতো ছোড়া বুলি তার বোধগম্য হলো না। সে সন্দিহান গলায় বলল—

“এভাবে কথা বলছ কেন? কী হয়েছে তোমার?”

অরুনিকা তেজদীপ্ত কণ্ঠে বলল—

“আপনি কখনো কিছু বোঝেন না। কেন ধোঁকা দিয়েছেন আমাকে? কেন শৈবাল?”

শৈবাল নিরস্ত্র সৈনিকের মতো মুখ করে বলল—

“আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি?”

অরুনিকা হাওয়ার তোড়ে তার চোখের পানি মুছে নিল। গলা শক্ত করে বলল—

“হ্যাঁ, আপনি। শৈবাল, আমি আপনার স্ত্রী। যতকিছুই হোক না কেন, অন্য কারো সাথে আপনাকে ভাবতে আমার কষ্ট হয়। হোক সে মৃ*ত।”

শৈবাল দিকভ্রান্তের তাকাল। অঞ্জলিতে নিল অরুনিকার মুখ। চোখের কাছে চোখ রেখে বলল—

“তোমার কী হয়েছে অরু? কেন এমন করছ? কোনো ভুল করেছি আমি? বলো আমাকে, আমি শুধরে নেব।”

শৈবালের হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে নিল অরুনিকা। শৈবাল মেঝেতে বসে পড়ল। অরুনিকার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। অরুনিকা জ্বলন্ত উনুনের ন্যায় গনগন করে বলল—

“কী শুধরে নেবেন আপনি? কেন মিথ্যে বলেছেন আপনি আমাকে? কেন বলেননি, অরুমিতার সাথে আপনার শুধু মনের নয়, দেহেরও সম্পর্ক ছিল?”

বিস্ময়ের সপ্ত আসমান ছুঁয়ে ফেলল শৈবাল। অবাক গলায় বলল—

“কী বলছ এসব তুমি?”

“আমি ঠিকই বলছি। কতবার রাত কাটিয়েছেন আপনি ওর সাথে, যার দরুন ও আপনার সন্তানের মা হতে চলেছিল?”

শৈবাল জবাব দিলো না। জলহীন মাছের মতো তার অন্তঃকরণ তড়পাতে লাগল। আবিষ্ট নজরে চেয়ে রইল সে। অরুনিকা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল—

“মানছি ও নেই। মানছি যা করেছেন আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে করেছেন। তবুও শৈবাল। আমার কষ্ট হয়। কেন বলেননি আপনি আমাকে এই সত্য? আপনারা বিয়ে ছাড়াই…।”

অরুনিকা আর বলতে পারল না। কন্ঠরোধ হয়ে এলো তার। শৈবাল অনিমেষ চোখে চেয়ে আছে ক্রন্দনরত অরুনিকার দিকে। অরুনিকা বিধ্বস্ত গলায় বলল—

” আমাকে এভাবে ধোঁকা না দিলেও পারতেন। একবার অন্তত বলতে পারতেন সবটা। যদি আজ আপনার জায়গায় আমি হতাম, তাহলে কী করতেন শৈবাল? মেনে নিতেন আমাকে? কখনো না। মেয়েরা তো টিশু পেপার। তাকে একবারই ব্যবহার করা যায়। ”

অরুনিকার ঝমঝম করে চোখের পানি ফেলছে। কান্নার দমকে তার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। গলা ভিজে গেছে। সেই ভেজা গলা লাইটের আলোতে চিকচিক করছে।এতসময় নিশ্চুপ থাকা শৈবাল কথা বলল।

“আমি তোমাকে ভালোবাসি অরু। আমি যা বলেছি তাই সত্য। তোমার আগে আমি কাউকে এতটা গভীরভাবে ছুঁয়ে দেখিনি।”

শৈবাল উঠে দাঁড়াল। তারপর চলতে লাগল লাগামহীন।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here