ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত #পর্ব:৮,৯

0
867

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:৮,৯
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:৮

ব্যস্ত সকাল। সারা ঘর দৌড়ে বেড়াচ্ছে রিম, ঝিম। গোলাপী রঙের প্রিন্সেস ফ্রক পরেছে দুই বোন। পনিটেইল করা চুল। মাথার সম্মুখভাগে ক্রাউন লাগানো। আজ তারা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাবে। সেই খুশিতে আত্মহারা হাসিতে বাতাসে আলোড়ন তুলেছে। নমিতা বেগমের পায়ের কাছে জড়িয়ে ধরে আমোদিত গলায় বলল রিম—-

“নানুমনি, তুমি যাবে আমাদের সাথে?”

নমিতা বেগম ঝুঁকে দুই নাতিনের কপালে চুমু আঁকলেন। মনটা বিষণ্ণ তার। গত একমাস ধরে এই নিস্তেজ বাড়ির প্রাণ হয়েছিল রিম, ঝিম। তাদের কলহাস্যে গমগম করত বাড়ি। আজ পূনরায় শীতল, স্তব্ধ হয়ে যাবে। নমিতা বেগম মিষ্টি হেসে বললেন—

“না গো আমার পরীরা। আজকে না। নানুমনি পরে যাবে। হু? আর দুষ্টুমি করবে না। তাহলে কিন্তু আম্মু ভীষণ মা/রবে। ঠিকমতো স্কুলে যাবে। ভালো মেয়ে হয়ে থাকবে।”

দুইবোন সমস্বরে বলল—-

“আচ্ছা।”

তৌফিক সাহেব হেসে হেসে বললেন—

“শুধু নানুমনির আদর নিলে হবে, নানাভাইয়ের কাছেও তো আসতে হবে।”

দুই বোন আহ্লাদীপনা শুরু করে। তৌফিক সাহেব পাখির ছানা দুটোকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখলেন। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে শৈবাল আর অরুনিকা। শৈবালের অধরে মোলায়েম হাসি। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো রুমকি। ব্যস্তসমস্ত হয়ে পার্সের চেইন লাগিয়ে ঝট করে অরুনিকার হাত চেপে ধরল। তাকে একপাশে টেনে নিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল—-

“দেখ অরুনিকা, আমি চলে যাচ্ছি। আমার এই পুরো সংসারটাকে আমি তোর হাতে দিয়ে যাচ্ছি। হুটহাট করে কোথাও যাবি না। আমার ভাই তোকে ভীষণ ভালবাসে।”

অরুনিকা ভ্রূকুঞ্চন করে। অপ্রসন্ন সে। কিন্তু হাওয়ার বেগে ঝুঁকে যায় রুমকি। অরুনিকার পায়ে হাত লাগাতে গেলে তাকে রুখে দেয় সে। বিস্ফোরিত গলায় বলে উঠে অরুনিকা—

“আপা, কী করছেন?”

রুমকি অরুনিকার দুই হাত অঞ্জলিবদ্ধ করে অসহায় গলায় বলল—

“তোর দুইটা হাতে ধরি, আমার ভাইটাকে দেখিস। ও তোকে সত্যিই ভালোবাসে। অরু নামটা অরুমিতার হলেও, যে মানুষটাকে ও ভালোবাসে সেটা তো তুই। আমার শৈবাল তোকে খুব ভালোবাসেরে! ওকে একটু সময় দে। দেখবি, ও একদম ঠিক হয়ে যাবে। তুই ওর কাছে অরুনিকা হয়ে উঠবি। আমার ভাই যদি একবার ঠিক হয়ে যায়, তুই বিশ্বাস কর, তোর গর্ব হবে। তোর মনে হবে, ওর চেয়ে বেস্ট জীবনসঙ্গী আর কেউ হতো না তোর জন্য। একটু সময় দে ওকে নিজেকে সামলে নিতে। তোর দুইটা পায়ে পড়ি আমি।”

অরুনিকা লজ্জার সাথে অনুরক্তি মিশিয়ে বলল—

” আপা! কী করছেন এসব? আমি আপনার ছোটো। আর লজ্জা দেবেন না আমাকে। রাগের মাথায় সেদিন আপনাকে যা তা বলেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

“ছিঃ!ছিঃ! করছিস কী? তোর ওপর আমার কোনো রাগ নেই। ব্যস, আমার ভাইটাকে ছেড়ে কোথাও যাস না। জানিস তো, কাউকে একটা কথাও বলবে না, একটা শব্দও করবে না। নিজেকে শেষ করে দেবে। তুই যতবার ওর কাছ থেকে দূরে যাস, ও ততবার নিজেকে দোষী ভাবে অরুমিতার মৃ/ত্যু/র জন্য। আর তক্ষুণি নিজেকে অা/ঘা/ত করে।”

অরুনিকার নেত্রযুগলে বর্ষা নামে। সে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে শৈবালের দিকে তাকাল। রিম, ঝিমের সাথে ব্যস্ত থাকা শৈবালকে দেখলে কে ভাববে, এই হাসিখুশি মানুষটা আচমকা পৃথিবীর সবচেয়ে অবোধ্য মানুষ হয়ে উঠে!
,
,
,
জাফর সকালে অফিসে চলে গেছে। রুমকি বাবার বাড়ি এলে এক, দেড়মাস না কাটিয়ে ফেরে না। এতে অবশ্য জাফরের কোনো সমস্যা হয় না। সে নির্বিঘ্নে দিন কাটিয়ে দেয়। শ্বশুরের কোম্পানিতে জেনারেল ম্যানেজার পদে আছে সে। রুমকি ওখানে থাকলে মাঝে মাঝে অফিস থেকে সোজা সেখানে চলে যায়। কখনো কখনো খেয়েই নিজ বাড়িতে ফিরে আসে, আবার কখনো স্ত্রী-কন্যাদের আবদারে রাতটা কাটিয়ে দেয়।
আজও ব্যতিক্রম নয়। তাই শৈবাল রুমকি আর ভাগ্নিদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। ভাইকে খালি মুখে যেতে দেবে না রুমকি। তাই শৈবালকে বসতে বলে চটজলদি রান্নাঘরে ঢুকে সে। রিম, ঝিম বহুদিন পরে পুরোনো আবাসে ফিরে এসে আন্দোলিত। নিজেদের রুমে ঢুকে উল্লাসে ফেটে পড়ে তারা। শৈবাল অনুদ্বেগ ভঙ্গিতে বসে আছে ড্রয়িং রুমের কাউচে। তার হাতে মোবাইল। গ্যালারিতে থাকা অরুনিকার অসংখ্য ছবি একের পর এক স্লাইড করে যাচ্ছে। চকিতে মাথা তোলে শৈবাল। পাশে দাঁড়ানো পুরুষকে দেখে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায় পলেই। ধুম করে তার পাশে বসল শিমুল। চকচকে গলায় বলল—

“কেমন আছিস শৈবাল?”

শিমুলের গায়ে একটা স্লিভলেস পাতলা টিশার্ট। চুলগুলো এলোথেলো। চোখ জুড়ে তন্দ্রা ভাব। মাত্রই বিছানা ছেড়েছে সে। তার করা প্রশ্নে জবাব দিলো না শৈবাল। মাথা নত করে মোবাইলে তাকাল। শিমুল মুচকি হেসে ছোঁ মেরে শৈবালের মোবাইল ছিনিয়ে বলল—

“দেখি, দেখি, ভাবীর ছবি দেখি।”

মোবাইল নিয়েই কাউচে হেলান দিলো শিমুল। শৈবাল বুঝতে পারল না তার কী হলো। উন্মাদের মতো ঝট করে উঠে শিমুলের গলা চেপে ধরে। তার হাত থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে। তবুও রাগ কমলো না শৈবালের। ভীতসন্ত্রস্ত শিমুল থতমত গলায় বলল–

“কী করছিস তুই? ছাড়! তোর বউকে নিয়ে যাচ্ছি না কী!”

শৈবালের গায়ে যেন অপার্থিব কিছু ভর করেছে। সেন্টার টেবিলের ওপরে থাকা ফুলদানি হাতে নেয় সে। তারপর এক বারিতে তার অর্ধেকটা ভেঙে বাকিটা একদম শিমুলের মুখের কাছে নিয়ে আসে। যেন এখনই ভাঙা ফুলদানি বিদীর্ণ করে দেবে শিমুলের সুন্দর মুখশ্রীর ওই পেলব চামড়া! তদ্দণ্ডে শুনতে পায় রুমকির ভয়াতুর কণ্ঠস্বর।

“শৈবাল! কী করছিস তুই?”

শৈবালের জ্বলন্ত রাগের আস্ফালন স্তিমিত হলো। ফুলদানি ছুড়ে ফেলতেই তা দেয়ালে ছিটকে পড়ে। বিক্ষিপ্ত হয় তা মেঝের বুকে। শৈবাল সোজা হয়। লালাভ চোখে চেয়ে থেকে উগ্র গলায় বলল—

“আমার অরুর আশেপাশেও যেন ওকে না দেখি আমি। তাহলে জানে মে/রে ফেলব।”

গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে যায় শৈবাল। উঠে দাঁড়ায় শিমুল। বুকে থুথু ছিটিয়ে বিদ্রুপাত্মক গলায় বলল—

“কী পাগল রে ভাই! আরেকটু হলে তো আমাকে ওপরে পাঠিয়ে দিতো ! ওর মাথা কি এখনো ঠিক হয়নি?”

ফুঁসলে উঠে রুমকি। ঝড়ো বেগে বলল—

“কী বলেছ তুমি ওকে?”

“আমি আবার কী বললাম! শুধু ওর বউয়ের ছবি দেখতে চেয়েছি। আর ওমনেই রেগে গেল! আমি তো ভেবেছি, এতদিনে ওর মাথাটা ঠিক হয়েছে। এখন তো দেখছি আরও ঘেঁটে গেছে। বেচারি অরুনিকা! কবে যেন মেয়েটাকে অরুমিতার কাছে পাঠিয়ে দেয়!”

“কী বলছ এসব তুমি!”

শিমুল শুষ্ক গলায় শ্লেষ মিশিয়ে বলল—

“ঠিকই বলছি ভাবী। কই ভাইকে চিকিৎসা করাবে, তা না, করিয়ে দিলে বিয়ে! ও কতটা ভা/য়োলে/ন্ট দেখেছ? শুধু দেখতে চেয়েছি বলে এ অবস্থা! মাই গড! যদি অরুনিকার আশেপাশে কোনো পুরুষ মানুষকে দেখে তো কী হবে আল্লাহ মালুম! তখন ভাইকে হাসপাতালে নয়, সোজা জেলে খুঁজে পাবে। ধুর! মেজাজটাই খারাপ করে দিলো আমার!”

শিমুল লম্বা লম্বা পা ফেলে ভেতরে দিকে গেল। রুমকির বুকটা ধকধক করছে। হঠাৎ এমন ক্ষেপে গেল কেন শৈবাল?
,
,
,
লাগাতার কলিং বেল বাজছে। অরুনিকা ছুটে আসারও সময় পাচ্ছে না। নমিতা বেগম নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছে অরুনিকা। বলল—

” আপনি যান আম্মা, আমি দেখছি।”

নমিতা বেগম আপত্তি করলেন না। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করল শৈবাল। কোনো দিকে তাকাল না। অস্থির, উৎকণ্ঠিত মস্তিষ্কে হেঁটে গেল দ্রুত। অরুনিকা আর নমিতা বেগম যারপরনাই অবাক হলো। এক অপরের দিকে চোখাচোখি হতেই ইশারায় শাশুড়িকে আশ্বাস দিলো অরুনিকা, যে সে সামলে নেবে।

নিজের রুমে নরম পায়ে প্রবেশ করে অরুনিকা। ধীর হাতে দরজা লাগিয়ে দেয়। নম্র গলায় প্রশ্ন করল—

“কী হয়েছে শৈবাল? বাসায় ফিরে এসেছেন কেন? আপনার তো আপার বাসা থেকে সরাসরি অফিসে যাওয়ার কথা।”

দুই হাতে কপালের দুইপাশ চেপে ধরে মাথা নত করে রেখেছে শৈবাল। অরুনিকার কথায় কপাল থেকে হাত নামিয়ে ব্লেজারটা খুলে ছুড়ে ফেলে। কোথায় গিয়ে পড়ল তাতে তার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই।।অরুনিকা কিছু বলল না। সে খুব করে বুঝতে পারল, কিছু ঘটেছে শৈবালের সাথে। সে কয়েক কদম এগিয়ে এসে শৈবালের সামনে দাঁড়াল। সরল কণ্ঠে বলল—

“কী হয়েছে আপনার?”

শৈবাল মনমরা গলায় বলল—

“কিছু হয়নি। ভালো লাগছে না আমার।”

আচানক অরুনিকার কটিদেশ জড়িয়ে ধরল শৈবাল। অরুনিকার উদরের সাথে মাথা চেপে রাখল। অরুনিকা তার হাত গলিয়ে দিলো শৈবালের চুলে। কাঁধে হাত রাখতেই টের পেল, অস্বাভাবিক গরম শৈবালের দেহ। সাথে কাঁপছেও সে। অরুনিকা হাত ছাড়িয়ে নিল শৈবালের। শৈবাল কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। সে প্রাণহীন পুতুলের মতো বসে রইল। অরুনিকা চঞ্চল পায়ে বিছানার পাশে থাকা টেবিলে ওপর থাকা ঔষধের বাক্স থেকে একপাতা সাদা রঙের ট্যাবলেট নিল। পানির বোতলসহ সেই ঔষধ এনে দিলো শৈবালের কাছে। শৈবাল বিনা প্রশ্নে সেই ঔষধ খেয়ে নিল। মুক্ত শ্বাস ফেলল অরুনিকা। সেখান থেকে সরে আসতে গেলেই তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শৈবাল। নিচ্ছিদ্র ছোঁয়ার আশ্লেষে বলল—

“তুমি কখনো নিজ থেকে আমার কাছে আসো না অরু!”

অরুনিকা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল—

“কখনো নিষেধও করিনি আপনাকে।”

প্রেমপাত্রীর সাড়া পেয়ে অবাধ্য হয়ে উঠল শৈবাল। প্রেয়সীর গহন শ্বাসে নিজের অস্থিরতার বিসর্জন দিতে চায় সে।

চলবে,,,

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:৯
লেখনীতে: তাজরিয়ান খান তানভি

সকাল বেলা এক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হলো অরুনিকা। একটা রং নাম্বার থেকে কল আসে। অরুনিকা যতবার রিসিভ করেছে, ততবার ওপাশের মানুষটি নিশ্চুপ। শেষবার যখন সে কল রিসিভ করে তখন ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে বলে উঠে অরুনিকা—

“কে আপনি? বারবার ফোন কেন করছেন? আর করছেন-ই যখন কথা কেন বলছেন না?”

অপরিচিত পুরুষটি মৃদু হাসল। মন্থর গতিতে বলল—

“কেমন আছেন?”

“কে আপনি?”

চমকে প্রশ্ন করল অরুনিকা। পুরুষটি তার শীতল গলায় প্রত্যুত্তর করে—

“শুভাকাঙ্ক্ষী।”

অরুনিকা ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। হতভম্ব গলায় বলল—

“কে আপনি? আর কাকে চান?”

পুরুষটি নরম কণ্ঠে বলল—

“যদি বলি আপনাকে।”

ঢোক গিলল অরুনিকা। সচেতন চোখে এদিক-ওদিক তাকাল। এপাশ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ওপাশের পুরুষটি একটু আওয়াজ করেই হেসে উঠল। বলল—

“ভয় পাবেন না অরুনিকা। বলেছি শুভাকাঙ্ক্ষী, আশিক নই। কেমন চলছে আপনার বিবাহিত জীবন?”

অরুনিকা কান থেকে মোবাইল ফোন সরিয়ে বিস্ময়ে আবিষ্ট নয়নে তাকিয়ে স্ক্রিনের নাম্বার দেখছে। না, চিনে না সে এই নাম্বার। কিন্তু লোকটা তাকে চেনে, নাম পর্যন্ত জানে, এমনকি তার বিয়ের খবর অবধিও সে জানে। আর কিছু? অরুনিকা ভাবতে লাগল। নীরবতায় ফুড়ে বলে উঠে পুরুষটি—

“কী ভাবছেন অরুনিকা? এটাই যে আমি এতকিছু জানি কী করে? ”

পুরুষটি মৃদু ছন্দে হেসে ওঠে। অরুনিকার হাত-পা জমে গেল সেই হাসিতে। ভয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল—

“কে…কে… আপনি? এখানে কেন ফোন করেছেন?”

“শৈবাল কেমন আছে অরু?”

দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড় অরুনিকার। এই নামে তাকে তার বান্ধবী স্বাধীনতা ডাকত। তার কারণেই তো এই অঘটন ঘটেছে। সেদিন রাস্তা পার হতে গেলে স্বাধীনতা অরুনিকাকে অরু বলে ডেকে ওঠে। আর সেই ডাক শুনতে পায় শৈবাল। বিধ্বস্ত শৈবাল সেই নামেই ডুবে গেল। তার বিপর্যস্ত, অগোছালো, নিয়ন্ত্রণহীন মস্তিষ্ক অরুনিকা আর অরুমিতার পার্থক্য করতে পারল না। উন্মাদের মতো মাঝ রাস্তায় গভীর আশ্লেষে ছুঁয়ে ছিল অরুনিকাকে। তারপর থেকে এই একটি মানুষ তাকে অরু বলে ডাকে। আর সে হলো শৈবাল। অরুনিকা রুদ্ধশ্বাসে বলল—

“কে আপনি? আমি অরু নই।”

পুরুষটি শান্ত গলায় বলল—

“জানি আমি। আপনি অরুমিতা নন। অরুনিকা। কিন্তু আপনার স্বামীকে তা কে বোঝাবে?”

অরুনিকা দৃঢ়চিত্তে অসহ্য গলায় বলল—

“আপনি কেন ফোন করেছেন?”

“শৈবাল সত্যিই আপনাকে ভালোবাসে তো অরুনিকা?”

স্তব্ধ হয়ে গেল অরুনিকা। নির্বাক চোখ জোড়াতে জল থৈ থৈ করছে। চকিতে ফিরে তাকাল সে।

“কার সাথে কথা বলছ অরু?”

অরুনিকা ধাতস্থ হয়ে লাইন কেটে দেয়। উলটো দিকে ফিরে চোখের পানি মুছে নেয়। শৈবাল ভ্রুকুটি করে বলল—

“কী হলো অরু?”

নিজেকে সংযত করে অধরে কৃত্রিম হাসির দোলা দিলো। ফিরে তাকাল শৈবালের দিকে। মিহি গলায় বলল—

“আপনি টেবিলে গিয়ে বসুন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

শৈবালের কৌতূহল তার চোখের পাতায় দৌড়ে বেড়াতে লাগল। তবুও সে আর কোনো প্রশ্ন করল না। বিনা শব্দে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে টেবিলে রাখল অরুনিকা। তার দিকে প্রশ্নের ঝাঁক নিয়ে চেয়ে রইল শৈবাল। অরুনিকা একটু পরপর খাবার পরিবেশন করার ফাঁকে শৈবালের দিকে তাকিয়ে আলগোছে হাসে। শৈবাল স্থির, নিষ্কম্প। অরুনিকা মিঠে গলায় বলল—

“আপনি খেয়ে নিন, আমি আম্মাকে চা দিয়ে আসছি।”

অরুনিকার হাতটা সাবধানে ধরল শৈবাল। বিনীত গলায় প্রশ্ন করল—

“তোমার কিছু হয়েছে অরু?”

অরুনিকা চোখের সাথে অধরও বিস্তৃত করল। শীতল গলায় বলল—

“না তো। আপনি খান, আমি আসছি। আম্মার চায়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

অরুনিকার যাওয়ার পানে চেয়ে রইল শৈবাল। বেলা এগারোটা। শৈবাল আজ দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। অফিস যাবে। টেবিলের কাছে এসে যখন অরুনিকাকে দেখল না, তখন হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল। পেলও বটে। তবে অরুনিকা তখন মোবাইলে কথা বলছিল। তা ভালো লাগেনি শৈবালের। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়াও করল না। কারণ, অরুনিকার চোখের জল!

শৈবালের খাওয়া প্রায় শেষ। অরুনিকা প্লেট গুছাতে গুছাতে বলল—

“রাতে ফেরার সময় জাফর ভাইকে নিয়ে আসবেন। আজ বিরিয়ানি রান্না করব। জাফর ভাই এখানেই খাবেন, আর যাওয়ার সময় আপা আর বাবুদের জন্য বক্সে দিয়ে দেবো। জাফর ভাইকে বলে দিয়েছি আমি। আপনি একটু মনে করে নিয়ে আসবেন তাকে। নাহলে ভুলে আবার বাসায় চলে যাবে।”

শৈবাল স্থির, নিমগ্ন। অরুনিকা আচানক ঠাওর করল টেবিলের ওপর রাখা শৈবালের বাম হাত কাঁপছে। ভয়জড়িত গলায় বলে উঠে অরুনিকা—-

“শৈবাল, খারাপ লাগছে আপনার?”

নতমুখ উঁচু করে শৈবাল। তার রক্তিম চোখ জোড়া দেখে আঁতকে ওঠে অরুনিকা। ভয়ংকর এক শ্বাস ফেলে বলল—

“কী হয়েছে শৈবাল?”

শৈবাল অতি শীতল গলায় বলল—

“ঐ বাড়িতে শিমুলও তো আছে। ওর জন্য পাঠাবে না?”

অরুনিকা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল—

“পা…ঠা…বো। আমি ভু..লে গেছিলাম।”

দাপিয়ে ওঠে শৈবাল। ঝট করে দাঁড়িয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর আস্ত এক ঘুষি বসিয়ে বলল—

“তুমি ওর জন্য কেন পাঠাবে?”

অরুনিকা ভড়কে যায়। পলেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা, শৈবালের রক্তিম নেত্রযুগল তার বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে। অরুনিকা কয়েককদম পিছিয়ে যায়। তার পাশেই অ্যাকুরিয়াম। শৈবাল তটস্থ পায়ে অরুনিকা কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অরুনিকার দুই বাজু চেপে ধরে তিরিক্ষি গলায় বলল—

“বলো, কেন পাঠাবে ওর জন্য?”

অরুনিকা কোনো জবাব খুঁজে পেল না। থরথর করে কাঁপছে শৈবাল। তার মাথার দুই পাশের রগ ফুলে উঠেছে। গলার শিরাগুলো যেন ছিড়ে বেরিয়ে আসবে! পুরু ওষ্ঠাধরে গহন বিধুরতা। অরুনিকার মনে হচ্ছে তার সামনে কোনো ভয়ংকর দৈত্য দাঁড়িয়ে, যে তার আঙুলে ধাক্কাতেই সব ভূলুণ্ঠিত করে ফেলবে। দলিয়ে ফেলবে সব এক নিমিষে। শৈবাল রাগের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। অরুনিকার পাশে থাকা অ্যাকুরিয়ামটা দুই হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেঝের বুকে ফেলে দিলো। কাচের অ্যাকুরিয়াম ঝনঝন শব্দে বিক্ষিপ্ত হতে লাগল সারা মেঝেতে। গলগল করে তার পানি ছড়িয়ে পড়ল। ছিটকে তড়পাতে থাকল অ্যাকুরিয়ামে থাকা মাছগুলো। কোনো কোনোটার মাথা বা লেজ, কিংবা পেট কাটা পড়েছে কাচের টুকরোতে। কিছু কাচ আর পানি ছিটকে এলো অরুমিতার পায়ের ওপর। অ্যাকুরিয়ামের তাকে রাখা ছোট্ট শোপিসগুলো পছন্দ করে কিনেছিল অরুনিকা। সব ভেঙেচুরে একাকার! শৈবাল শুধু চেয়ে রইল। তার দীর্ঘকায় দেহের কম্পন এবার প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে নমিতা বেগম আর তৌফিক সাহেবের চোখে। তারা দুইজন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আওয়াজের আধিক্যে তারা নিজ রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। দরজার কাছে তখন অরুনিকার বাবা-মা। অরুনিকার মা মৌমিতা বেগম তখন অস্ফুটে আওয়াজে ডাকলেন—

“অরুনিকা!”

শৈবাল চট করে চাইল। শীতল, স্তিমিত, নিভে এলো তার রাগ। কিন্তু অরুনিকার বাবা-মায়ের ভয়কাতুরে চাহনিতে তার শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে গেল হিমশীতল স্রোত।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here