ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত #পর্ব:১০,১১

0
920

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:১০,১১
লেখনীতে: তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:১০

অরুনিকার পায়ের চামড়া হালকা কে/টে গেছে। ফর্সা টলটলে পায়ের র/ক্তের স্মিত ধারা শুকিয়ে গেছে। তা যত্নের সাথে তুলো দিয়ে মুছে দিচ্ছে শৈবাল। অরুনিকা প্রতিক্রিয়াহীন। তার বাবা-মা এসেছিলেন তাকে এক নজর দেখতে। অরুনিকার বড়ো খালা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তিনি ফোন করেছিলেন মৌমিতা বেগমকে। গ্রামে থাকেন অরুনিকার খালা। অনেকগুলো বছর তার খালার ছোটো ছেলে তাদের এখানে থেকেই পড়াশোনা করেছে। এখন গ্রামে বাবার সাথে ব্যবসায় হাত দিয়েছে। গ্রামে যাওয়ার পূর্বে মেয়েকে এক নজর দেখে যেতে চেয়েছেন অরুনিকার বাবা সাদেক হাসান। কিন্ত ভাবতে পারেনি এমন একটা ঘটনার সম্মুখিন হবেন তারা।

অরুনিকার বাবা-মা অল্প সময় ছিলেন। সেই সময়টুকুতে একা হাতে সব পরিষ্কার করেছে শৈবাল। তারা শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে দেখেছেন। অরুনিকা বাবা-মা’কে হালকা নাশতা দিলে তারা তা খেয়ে কিছুসময় পর বিদায় নিয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে শৈবালের সাথেও কথা হয়। তাদের মধ্যে কোনো ক্ষোভ ছিল না। যেন কিছুই হয়নি।

অরুনিকার পায়ে চুমু খেল শৈবাল। চটজলদি শৈবালের উরুর ওপর থেকে পা নামিয়ে নিল অরুনিকা। বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল—

“এসব কী করছেন আপনি?”

শৈবাল অনুতপ্তার সাথে বলল—

“আই এম সরি, অরু। আমি ইচ্ছে করে তোমাকে আ/ঘা/ত করিনি।”

অরুনিকা কঠোর গলায় বলল—

“আমি কখন বললাম ইচ্ছে করে করেছেন?”

“তুমি আমার ওপর রেগে আছ, অরু।”

“আমার চেহারায় কী তা লেখা আছে।”

“সরি, অরু।”

অরুনিকা শ্রান্ত চোখে তাকাল। চেয়েও এই মানুষটার সাথে রাগ করে থাকতে পারে না। অরুনিকা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। চঞ্চল পা দুটো কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই তাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরল শৈবাল। বুকের মাঝে গুঁজে রাখল। অরুনিকা চোয়াল শক্ত করে। শৈবাল আহত গলায় বলল—

“তুমি এখনো রেগে আছ অরু। সরি বলেছি তো।”

অরুনিকা বদ্ধ শ্বাস ফেলল। তার গলা কাঁপছে। শক্ত কণ্ঠে বলল—

“ছাড়ুন, আমাকে।”

“প্লিজ, সরি। আর হবে না এমন।”

“কী হবে না? কী করেছেন আপনি?”

অরুনিকার চুলে মুখ ডোবাল শৈবাল। লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল—-

“আমি আর এমন করব না। প্লিজ, তুমি রাগ করো না। আব্বু আর আম্মুকেও সরি বলব।”

অরুনিকা শব্দবিহীন শ্বাস ফেলল। টগবগে কণ্ঠে বলল—

“ছাড়ুন, শৈবাল।”

“তুমি এখনো রেগে আছ।”

অরুনিকার মেজাজ চওড়া হলো। এক কথা বারবার! এবার সত্যিই তার রাগ হচ্ছে। রাগের দমকে তার ঠোঁট কাঁপছে। অরুনিকা কী ভাবল কে জানে! এক পলকেই পেছন ফিরে শৈবালের পোলো শার্টের কলার খামচে ধরল। সময় দিলো না শৈবালকে। তার ওষ্ঠাধরের ভাঁজে নিজের পাতলা অধরপল্লব জড়িয়ে নিল। অরুনিকার অবিশ্বাস্য কাণ্ডে হতবাক শৈবাল। তবে প্রেয়সীর গহন ছোঁয়া তাকে অবাধ প্রেমক্রিয়ার জন্য জাগ্রত করল। দুই হাতে অরুনিকাকে নিজের বুকের মাঝে দলিয়ে ফেলল শৈবাল। ব্যয়িত সময় অগণিত। একে অপরের অধরসুধায় কত সময় মত্ত ছিল কারো ধারণা নেই। অরুনিকা দুর্বোধ্য চাহনিতে ক্লান্ত স্বরে বলল—

” এবার বুঝলেন তো আমি রেগে নেই।”

শৈবাল চোখে হাসল। নিচ্ছিদ্র দূরত্ব তাদের মধ্যে। অরুনিকা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শৈবাল ঘাড় কাত করে আরেক দফা প্রেমময় বর্ষণের বজ্রপাত ঘটাল।
,
,
,
চোখ পিটপিট করছে অরুনিকা। তার অসংবৃত দেহকে জড়িয়ে রেখেছে শৈবাল। গলার কাছে উষ্ণ শ্বাসের বিচরণ। শৈবাল ঘুমিয়ে পড়েছে। তার ভারী শ্বাস আছড়ে পড়ছে অরুনিকার গলদেশ থেকে বুকে। অরুনিকার সচলতায় কিঞ্চিৎ নড়ে ওঠে শৈবাল। শক্ত হলো তার হাতের বেষ্টনী। অরুনিকা হালকা গলায় বলে উঠে—

“শৈবাল, লাগছে আমার!”

নিদ্রাচ্ছন্ন শৈবালের কর্ণকুহরে পৌঁছাল না তা। মাথাটা নামিয়ে অরুনিকা বুকের ওপর আনল। অরুনিকা ছোট্ট শ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকাল। এক ঝলক আলো এসে পড়ল তার চোখের কোটরে। নিভুনিভু চোখে দেখে নিল সময়। সন্ধ্যা ছ’টা। আজ সারাদিন শৈবাল বাসায়। অফিস যায়নি সে। সকালের ঘটনায় এতটাই বিক্ষিপ্ত ছিল সবকিছু…! অরুনিকা মাথা উঁচিয়ে চিবুক নিচু করে চুমু খেল শৈবালের চুলে। আলতো হাতে তার মাথাটা নিয়ে পাশের বালিশে রাখল। উঠে বসল অরুনিকা। অনাবৃত উর্ধকায় শাড়ির কিয়ৎ অংশ টেনে নিয়ে মৃদু হাসল। তার মাথার ছেঁড়া চুল লেপ্টে আছে শৈবালের ঠোঁটে । অরুনিকা তা নিতে গেলে বিছানার পাশ টেবিলে রাখা শৈবালের মোবাইল ফোন বাজতে থাকে। তার শব্দ শৈবালের কানে পৌঁছানোর পূর্বেই রিসিভ করে অরুনিকা। অনুচ্চ স্বরে বলল—

“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া। কেমন আছেন?”

জাফর স্বাভাবিক গলায় বলল—

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তোমার কী খবর?”

“এইতো ভালো।”

“তা আমার শা/লা বাবু কোথায়? নতুন বিয়ে হলে না হয় কথা ছিল, আজকাল দেখছি সে ইজি কাজে ভালোই বিজি থাকে। ঘটনা কী?”

অরুনিকা লজ্জামিশ্রিত হাসল। পাশ ফিরে তাকাল শৈবালের ঘুমে নিমজ্জিত পেলম আননে। তারপর দেহের ভঙ্গি সম্পূর্ণ ফিরিয়ে ঝুঁকে গেল তার ওপর। আলতো করে ফুঁ দিলো শৈবালের ঠোঁটে। একটা চুল এখনো নামহীন রাজত্ব করছে তার স্বামীর অধরে। প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। অরুনিকা মিষ্টি করে হেসে শৈবালের ঠোঁটের ওপর থেকে নিজের আদুরে ভঙ্গিতে সেই চুল তুলে নিল। নিজের ঠোঁট থেকে থু.. শব্দে তা মেঝের দিকে ছুড়ে ফেলল। জাফর অস্পষ্ট আওয়াজ শুনেই বলে উঠল—

“ঘটনা কী অরুনিকা? শা/লা সাহেব কী কণ্ঠরোধ করে রেখেছে না কী?”

অরুনিকা ফিক করে হেসে ফেলল। শব্দ হলো না তাতে। নরম গলায় বলল—

“শৈবাল ঘুমাচ্ছে। খুব দরকার?”

“তাই বলো। আমি তো অন্যকিছু ভেবেছিলাম।”

অধর চওড়া হলো অরুনিকার। জিব কামড় দিয়ে চুপ করে রইল। জাফর টলটলে গলায় বলল—-

“এক কাজ কোরো, শৈবাল ঘুম থেকে উঠলে ওকে একটু অফিসে আসতে বলো। একটা মিটিং আছে। তারা কোম্পানির সিইও ছাড়া ডিল করবে না।”

“জি, বলব।”

জাফর হেসে উঠল। তার হাসি এপাশ থেকে শুনতে পেল অরুনিকা। সন্ধানী মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন করার পূর্বেই ওপাশ থেকে ফিচেল গলায় বলল জাফর—

“বেচারা বেশি ক্লান্ত হলো ঘুমাতে দিয়ো। আমি না হয় কাল আসতে বলব তাদের। কী বলো?”

অরুনিকার টসটসে গাল দুটো লাল হয়ে উঠল।সে ঝট করে লাইন কেটে দেয়। অবিচল দৃষ্টিতে বসে থাকে। তার শাড়ির অর্ধেকটা শৈবালের পিষ্ঠদেশের নিচে পিষে আছে। অরুনিকা চুমু খেল শৈবালের ললাটে। তারপর চোখে, নাকে, চিবুকে। প্রগাঢ় ঘুমে বিভোর শৈবাল কিছুই টের পেল না। ক্লান্তিতে তার শরীর ভার হয়ে আছে। অরুনিকা সাবধানে শাড়ি বের করে নিল শৈবালের পিষ্ঠদেশ থেকে। আচানক শৈবাল উপুর হলো। তার বলশালী হাতের অকস্মাৎ ধাক্কায় শাড়ির গুঁজটা পড়ে গেল অরুনিকার হাত থেকে। নিয়ে নিল শৈবাল তা বুকের নিচে। বিপাকে পড়ল অরুনিকা। হাল ছেড়ে দিলো। শাড়ি ছাড়াই বিছানা ছাড়ল সে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চুলের পানি শুকিয়ে নিচ্ছে অরুনিকা। অনবরত বেজে যাচ্ছে তার মোবাইল। ঘুমের ঘোরে কথা বলল শৈবাল—

“অরু, ফোনটা ধরো। সে কখন থেকে রিং হচ্ছে।”

অরুনিকা ব্যস্ত পায়ে ছুটে এলো। স্ক্রিনে তখন বড়ো বড়ো করে ভেসে উঠেছে সেই অপরিচিত নাম্বার!

চলবে,,,

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:১১
লেখনীতে: তাজরিয়ান খান তানভি

কৃষ্ণবর্ণ অম্বরতলে সুরূপা সুধানিধির উদ্ভাসিত বিভায় মুগ্ধ অরুনিকা। বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে অনিমেষ চেয়ে আছে সূদুর অন্তরিক্ষে। অপ্রবল, শ্বেত রঙা বিধুর প্রভাতে আঁখিতে জাগে স্বপ্ন। মলয়ের নিপুন সংসর্গে দেহের অভ্যন্তরের উষ্ণতা ঢলতে শুরু করেছে। এমন মুগ্ধকর অকৃত্রিম বাহ্যজগতের অভিরামে মন খারাপ করতে একদম মন চাইছে না অরুনিকার।
সায়ংকালের বিষণ্ণ সময়টা আজ তার কাছে এক পশলা মন কেমনের আঁচলভরা সুখ দিয়ে গেছে। সবকিছুতে পূর্ণতার এক মিষ্টি ঝলক। সায়াহ্নের এই আবছা তমসা তার অন্তঃপুরে খুশির তুফান ডেকেছে।
মোবাইলটা সশব্দে বেজেই যাচ্ছে। বারান্দায় আসতেই আঁধারের এই রূপ অরুনিকার মনে কড়া নেড়েছে। সে বিমুগ্ধচিত্তে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তীব্র বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করেই বলল—

“আপনি আবার কেন ফোন করেছেন?”

ওপাশের ব্যক্তি তেরছা হেসে বলল—

“চিনত পেরেছেন তাহলে?”

অরুনিকা পোক্ত গলায় বলল—

“আপনি কী চাইছেন বলুন তো? কেন বারবার ফোন করছেন?”

“বলেছি তো শুভাকাঙ্ক্ষী।”

“তো?”

“শৈবাল সম্পর্কে কতটুকু জানেন আপনি?”

“যতটুকু জানা প্রয়োজন।”

“অরুমিতাকে শৈবাল খুব ভালোবাসত।”

দুম করে যেন বজ্রপাত হলো অরুনিকার হৃদগহীনে। সে থম মেরে গেল। আজকাল অরুমিতার নামটা তার সহ্য হয় না। একদম না। কেন সহ্য হবে? তার স্বামীর পাশে সে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারবে না। অরুনিকা টগবগে গলায় বলল—

“তাতে আপনার কী?”

“তাহলে কীসের আশায় পড়ে আছেন?”

“কী বলতে চান আপনি?”

পুরুষটি মৃদু শব্দে হাসল। অরুনিকার সারা অঙ্গে যেন কেউ আ/গু/ন ধরিয়ে দিয়েছে। সে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য অনলে। পুরুষটি অবাধ গলায় বলল—

” আপনি ভুল করছেন অরুনিকা। শৈবাল আপনাকে ভালোবাসে না। ও এখনো অরুমিতাকেই ভালোবাসে। আপনি তো শুধু…। আপনি বুদ্ধিমতী। আই থিংক আপনি বুঝতে পারছেন।”

অরুনিকা নিঃশ্বাস আটকে সতর্ক গলায় বলল—

“হ্যাঁ, জানি আমি। সব জেনেই আমি তাকে বিয়ে করেছি। শৈবাল ভালোবাসত অরুমিতাকে। কিন্তু এখন সে আমার স্বামী। আমিই তার স্ত্রী। অরুমিতার সাথে কী হয়েছে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। অরুমিতা শৈবালের অতীত। আমিই তার বর্তমান, আমিই তার ভবিষ্যৎ।”

” হাসালেন অরুনিকা। নিজেকে মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছেন? আদৌ শৈবাল আপনাকে ভালোবাসে? আজ পর্যন্ত আপনাকে আপনার নাম ধরেও ডাকল না। শুধু কী তাই! অরুমিতার সাথে শৈবালের সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল ও আপনাকে বলেছে? বলেনি। ঠকে গেলেন মিসেস অরুনিকা। সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস! চু..চু…।”

অদ্ভুদ শব্দ করে অরুনিকার জন্য মেকি আফসোস প্রকাশ করল পুরুষটি। অরুনিকার শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কান্নারা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে গলায়। চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। থরথর করে কাঁপছে সে। সে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও চাপা স্বরে বলল—

“কে আপনি? আর বারবার কেন এসব বলছেন? আপনি শৈবালকে কতদিন ধরে চিনেন? আর এখন কেন এসব বলছেন? যদি শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকেন তাহলে বিয়ের আগে কেন বলেননি? এখন কেন বলছেন?”

ওপাশ থেকে কল কেটে গেল। অরুনিকা বারকয়েক হ্যালো বলে থেমে গেল। ফিরতি কল করার প্রয়োজনবোধ করল না। চকিতে শব্দ হলো। অরুনিকা বুঝতে পারল ওয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছে। তা খুলে দেখতেই তার মস্তিষ্কের নিউরণগুলো মূহুর্তে অস্থির হয়ে উঠল। এলোমেলো, ঝাপসা চোখে সে দেখতে পারছে একটা ছবি। যাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মেঝেতে শুয়ে আছে শৈবাল, তার বুকের ওপর শুয়ে আছে অরুমিতা। দুইজনের ঠোঁটেই অকপট হাসি। চোখের তারায় উচ্ছ্বাস। তাদের চাহনিতে বোঝা যাচ্ছে, যে বা যারা ছবিটা তুলেছে তাকে তারা চেনে। তার মানে অরুনিকাকে যে ফোন করেছে, সে শৈবালকে খুব কাছ থেকেই জানে।

গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে অরুনিকার। সব জানার পরও ওই মানুষটাকে সে কারো সাথে ভাগ করতে পারবে না। কখনো কখনো তার মনে হয় অরুমিতা ম/রে গিয়ে ভালোই করেছে। নাহলে শৈবাল তার কখনো হতো না। মানুষটার রাগ, তেজ সবটা সহ্য করে নেবে সে। ওই একটু হাসির জন্য, তার খুশির জন্য, তাকে ভালোবেসে বুকের উষ্ণতায় কাছে টেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু….।
অরুনিকা দেয়াল ঘেষে ব্যলকনির মেঝেতে বসল। তার মুখটা রুমের দিকে ফেরানো। দুই হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে ফুঁফিয়ে যাচ্ছে সে। ওই, ওই টুকু দৃশ্য তার ভেতরটাকে বিনা অ/স্ত্রেই ক্ষত-বিক্ষত করেছে। তার অন্তঃকরণের র/ক্তক্ষরণ কে দেখবে?
কান্নার দমকে অরুনিকার পিঠ উঁচুনিচু হচ্ছে। হাঁটুর শাড়ি আর্দ্র হয়ে যাচ্ছে আঁখিজলে।
,
,
,
“অরু!”

ঘুম ভাঙতেই উঠে বসল শৈবাল। ঘুম ঘুম চোখে অরুনিকাকে ডাকল। অবাধ কান্নার স্রোতে ভেসে যাওয়া অরুনিকা চোখ-মুখ মুছে হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করল। লালাভ চোখ, ফ্যাকাশে দৃষ্টি, আরক্ত নাকের ডগা, ফুলে যাওয়া ঠোঁট চোখ এড়াল না শৈবালের। সে তটস্থ হয়ে বিছানা থেকে নামলো। অরুনিকা কাছে দাঁড়িয়ে তার দিকে সতেজ চোখে তাকিয়ে বলল—

“কী হয়েছে অরু? তুমি কাঁদছ?”

অরুনিকা কৃত্রিম হাসল। বিস্তৃত হলো তার অধর। বলল—-

“না তো।”

“কী হয়েছে তোমার?”

শৈবালের কণ্ঠে উদ্বেলতা। সে ভয়জড়িত চোখে চেয়ে বলল।
অরুনিকা নাকের ডগায় ঘষা মেরে বলল—

“কিছু হয়নি আমার।”

শৈবাল মানলো না। অরুনিকার দুইহাত নিজের অঞ্জলিতে নিয়ে বলল—

“কী হয়েছে তোমার বলো? কেউ কিছু বলেছে? ”

অরুনিকা আড় চোখে তাকাল। তারপর রুদ্ধশ্বাসে বলল–

“কিচ্ছু হয়নি আমার। জাফর ভাই ফোন করেছিলেন। আপনাকে অফিসে যেতে বলেছে। কারা যেন অপেক্ষা করছে।”

অরুনিকা দাঁড়াল না। চোখ ফেটে জল নামবে তার। তা লুকাতেই দ্রুত হাঁটা ধরল। শৈবাল ডেকে উঠল–

“অরু!”

অরুনিকা ফিরে তাকাল। শান্ত, শীতল, শাণিত চোখে তাকিয়ে আছে শৈবাল। শৈবালের এই নীরবতা ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। অরুনিকা শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিল। শৈবাল সেভাবেই নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। আকস্মিকভাবে শৈবালের উন্মুক্ত বুকে ঝাপিয়ে পড়ল অরুনিকা। মন্থর স্বরে বলল–

“কিছু হয়নি আমার। আব্বু- আম্মুর কথা মনে পড়ছিল তাই।”

তাকে আলগোছে জড়িয়ে ধরল শৈবাল। স্নেহাসক্ত গলায় বলল—

“তারা ফিরে আসুক। নিয়ে যাব তোমাকে। প্লিজ কেঁদো না অরু। প্লিজ।”

অরুনিকা অস্ফুট কণ্ঠে বলল—

“হু।”

শৈবালের অগোচরেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরুনিকা। যন্ত্রণার বৃষ্টি কেন এত নির্দয়? সময়- অসময়ে ঝড়ে?
,
,
,
অধৈর্য পায়ে চলছে শৈবাল। মিটিং শেষ করে এক মিনিটও বসেনি। ক্লাইন্টদের রেখেই সে বেরিয়ে এসেছে। জাফর বাকিটা সামলে নেবে। করিডর দিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটতেই এক ইমপ্লয়ির সাথে ধাক্কা লাগে শৈবালের। জিন্স আর টপস পরা মেয়েটি আঁতকে ওঠে। শৈবালের মোবাইল ফোন তখন শুভ্র টাইলস থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি থতমত গলায় বলল—

“সসসসরি স্যার।”

শৈবাল সেদিকে তাকালই না। সে ধাতস্থ হয়ে হাঁটু ভেঙে বসল। মোবাইলের পার্টসগুলো কুড়িয়ে নিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি আস্ত চোখে তাকিয়ে আছে। বৃহৎ ঢোক গিলছে সে। শৈবাল খুব সময় অফিসে থাকে না। যেটুকু থাকে তাও গুরুগম্ভীর। তাকে হাসতে খুব কম মানুষই দেখেছে অফিসের। ইমপ্লয়িদের কাছে তো সে এক যন্ত্রমানব, যার চাবি সে বাড়িতে রেখে আসে। খুব কম কথা বলে শৈবাল। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছাড়া বাকি বিষয়ে সে উদাস থাকে। কিন্তু নিয়ম শৃঙ্খলার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। মেয়েটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। শৈবাল মোবাইল সেট করে অন করল। মেয়েটি আবারও ভয়াতুর কণ্ঠে বলল—

“আই এম রিয়েলি সরি, স্যার।”

মোবাইল অন হতেই মাথা ঝাঁকাল শৈবাল। গাঢ় স্বরে বলল—-

“দেখে হাঁটো।

“জি, স্যার।”

শৈবাল হাঁটা ধরল। একবারের জন্য মেয়েটির দিকে তাকাল না। তবে মেয়েটি অবাক হয়নি। শৈবালের এরূপ আচরণ সম্পর্কে সবার ধারণা আছে।
,
,
,
ক্যান্টিনে কোল্ড ড্রিংকস পান করছে তন্দ্রা। তার ফাঁকেই ঝকমকে গলায় বলল—

“এই শৈবাল স্যারটা কী দিয়ে তৈরি বল তো? মানে, সিরিয়াসলি! আমার তো তাকে রোবট ছাড়া কিছুই মনে হয় না।
ধাক্কা লেগে মোবাইল পড়ে গেল, কই ভাবলাম একটা রাম ধমক দেবে, তা না। বলল, দেখে হাঁটো। আরে ভাই, না দেখে কেউ হাঁটে না কি!”

মিম্মা কলকল করে হেসে বলল—

“তুই তাহলে ইচ্ছে করে ধাক্কা খেয়েছিস?”

” অফকোর্স।”

“তোর তো হেভি সাহস?”

“সাহসের কী? জানতাম রোবটটা এমন কিছুই বলবে।”

“আরে স্যারের মাথা ঠিক নেই।”

তৎক্ষণাৎ মিম্মার মাথায় চাটি মা/রল মিরন। চেয়ারে বসতে বসতে বলল—

“মাথা ঠিক নেই বলেই তো এখনো মেয়েরা শান্তি মতো তার অফিসে কাজ করতে পারে। রাত করে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারে। নাহলে তো তোদের এই জায়গায় ওই জায়গায় হাত দিয়ে বসে থাকত।”

তন্দ্রা চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল—

“তা যা বলেছিস। শৈবাল স্যার কিন্তু সত্যিই গ্রেট। মেয়েদের জন্য কত সুযোগ -সুবিধা রেখেছেন। লেট হলে অফিসের গাড়ি করে স্টাফদের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তন্দ্রা। ফিচেল হাসল মিম্মা আর মিরন। একসাথে কাজ করাতে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাদের মধ্যে। মিরন হেসে হেসে বলল—

“তোর মনে হয় হেব্বি কষ্ট হচ্ছে। স্যারকে বলি, আল্লাহর নাম নিয়ে তিন নাম্বার বিয়েটাও সেরে ফেলতে। অবশ্য তোকে বিয়ে করলে স্যারের আর ঠিক হতে হবে না। সোজা তাকে পাগলাগারদে পাঠাতে হবে।”

“আজাইরা কথা বলিস কেন তুই? আমি কেন কারো তিন নাম্বার বউ হতে যাব?”

মিম্মা হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল—

“কারণ, স্যার অলরেডি দুটো বিয়ে করে ফেলেছে। প্রথম বউ তো নেই তবে দ্বিতীয়টা আছে। শুনেছি, তার প্রথম স্ত্রীর মারা যাওয়ার পর উনি খুব ভেঙে পড়েন। তারমধ্যেই আবার দ্বিতীয় বিয়ে।”

“ওইটা আমিও শুনেছি।”

মিরন কথার ফোড়ন কেটে বলল—

“তাহলে যা শুনিসনি তা শোন। তোর এই ময়দা মাখা চেহারা দিয়া কিচ্ছু হবে না। তাই অন্য পথ ধর।”

তন্দ্রা তীব্র অপমানবোধ করল। ধুম করে এক কিল বসাল মিরনের বাজুতে। মিরন গা দুলিয়ে হেসে ওঠে। বলল—

“শুনেছি মেয়েটা খুব ভালো। দেখছিস না, স্যার আগের চেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক আচরণ করে। সেদিন প্রেজেন্টেশন রুমে তো আমি পুরো শেষ হয়ে যেতাম। ব্লু রয়েলসের ফাইলের বদলে নিয়ে আসলাম কানাডা শিপমেন্টের ফাইল। যা তা অবস্থা আমার! জাফর স্যার খুব ক্ষেপেছিল। ভাগ্যিস, শৈবাল স্যার ছিল সেখানে। ইনভেস্টরদের রিকোয়েস্ট করে বসিয়ে রেখে আমাকে বাসায় যাওয়ার সময় দিয়েছিলেন। উফ! ভয়ংকর অবস্থা!”

“মেয়েটাকে চিনিস না কী তুই?”

তন্দ্রার কণ্ঠে কৌতূহল। মিরন স্বাভাবিক গলায় বলল—

“আরে না। স্যারের বাসার পাশেই আমার এক বন্ধু থাকে। ওর থেকেই শুনেছি। আর মেয়েটা কীরে? ম্যাম বল। স্যার শুনলে এক লাথি মেরে বের করবে দুইটারে।”

মিম্মা আর তন্দ্রা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ঠোঁট চেপে মিইয়ে গলায় বলল মিরান–

“হ্যাঁ…আমাকেও।”

ঝরঝর করে হেসে ফেলল মিম্মা আর তন্দ্রা।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here