#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:১২,১৩
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:১২
চায়ের কাপে চুমুক দিলেন নমিতা বেগম। কিন্তু তার গভীর দৃষ্টি অরুনিকার দিকে। অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করছে অরুনিকা। রান্নাঘর থেকে খাবারঘর, খাবারঘর থেকে রান্নাঘরে তার ছোটাছুটি চলছে। দু’দিন আগে ফোন করে রুমকি বলেছিল, যেন রিম আর ঝিমের জন্মদিনের কেক অরুনিকা নিজের হাতে বানিয়ে নিয়ে আসে। বাচ্চা দুটো মামির হাতে কেক ভীষণ পছন্দ করে। আজ সন্ধ্যায় একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জাফর। রুমকি নিজের বাবা-মা’কেও যেতে বলেছিল। কিন্তু তারা যাবেন না। তৌফিক সাহেবের শরীরটা সকাল থেকে খারাপ করেছে। তিনি শুয়ে আছেন নিজের রুমে।
নমিতা বেগম কিছু একটা বলবে বলবে ভাব নিয়ে বসে আছেন। চা পান করা শেষ হলেও তিনি সাহস যোগাতে পারছেন না অরুনিকাকে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করার। অরুনিকা সকাল হতেই তড়িঘড়ি করে সমস্ত কাজ শেষ করছে। শ্বশুর -শাশুড়ির জন্য রান্না শেষ করে ওভেনে কেকের মিশ্রণ ঢুকিয়ে দিয়ে মাত্রই বের হয়ে আসলো অরুনিকা। তাকে দেখে ডেকে উঠলেন নমিতা বেগম।
“বউমা!”
অরুনিকার মুখশ্রীতে টলটলে ঘাম। গলা বেয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে নামছে। সে কোনোরকমে হাতের উলটো পাশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিল। চোখ জোড়াতে রাজ্যের ক্লান্তি নিতে শাশুড়ির নিকট এসে বলল—
“কিছু লাগবে আম্মা?”
নমিতা বেগম শুকনো ঢোক গিললেন। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া আলতো করে ভিজিয়ে বললেন—
“তোমাকে একটা কথা বলত চাচ্ছিলাম।”
অরুনিকা একগাল হেসে বলল—
“বলুন না।”
তীব্র অপরাধবোধ নিয়ে রয়ে সয়ে বললেন নমিতা বেগম—
“বলছিলাম যে… শৈবালের আব্বার শরীরটা ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। আমারও বয়স হয়েছে। কখন কী হয়ে যায়!”
অরুনিকা চিন্তিত চোখে আশ্বাস নিয়ে বলল—
“এসব কী বলছেন আম্মা? বাবার কথা তো শৈবাল বলেছেন। আগামী শুক্রবারই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। চিন্তা করবেন না। আর আপনার কী হয়েছে? পায়ের ব্যাথা বেড়েছে? বললেন না তো? আসুন, আমি মালিশ করে দিই।”
নমিতা বেগম আহত চোখে চেয়ে মন্থর সুরে বললেন—
“তা না। আসলে আমি বলছিলাম…।”
নমিতা বেগম থেমে গেলেন। চোখ লুকাচ্ছেন বারংবার। তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, অরুনিকা তার বলা কথাটা কীভাবে নেবে! তিনি দ্বিধান্বিত। তবুও মনকে মানাতে পারছেন না। অরুনিকা শাশুড়ির চিন্তামগ্ন দৃষ্টি পড়তে পারল না। সে সহজ, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল—
“আম্মা, এত কী ভাবছেন? বলুন না, কী হয়েছে? আমার কোনো ভুল হয়েছে?”
নমিতা বেগম তটস্থ হয়ে বললেন—
“না, না, মা তোমার কোনো ভুল হয়নি। ভুল তো আমরা করেছি। নিজের ছেলের খুশির জন্য তোমার খুশি কেড়ে নিয়েছি।”
“এভাবে কেন বলছেন আম্মা? মাফ করে দিন। রাগের মাথায় কখন কী বলে ফেলি! আমি ভালো আছি। আপনাদের ছেলের ওই রাগটাই একটু বেশি। আসলে কী বলুন তো, ছোটোবেলা থেকে হৈ-হুল্লোড়, চিৎকার চেঁচামেচি আমার পছন্দ না। এই কারণে, আত্মীয় – স্বজনদেরও অনেক কথা শুনেছি। বিয়ে-শাদীতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। আব্বু-আম্মু জোর করে নিয়ে যেত। সেই আমি যখন আচমকা শৈবালের ওমন রূপ দেখি, মাথা কাজ করে না আমার। তাই…।”
নমিতা বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে খপ করে অরুনিকার হাত ধরলেন। অরুনিকা ভয় পেয়ে যায়। একটা ঝাকুনি খেয়ে বলল—
“আম্মা! আপনি এমন করছেন কেন?”
নমিতা বেগম কাঁদো কাঁদো মুখ করে অনুনয়ের সুরে বললেন—
“আমি আর ওর আব্বা মারা যাওয়ার আগে ওকে একটু সুখে দেখে যেতে চাই বউমা। তোমাদের বিয়ের বয়স তো এক বছর হতে চলল। আমরা চাই রিম, ঝিমের মতো তোমার কোল জুড়ে কেউ আসুক। এই বাড়ির খুশি নিয়ে ফিরুক। আমি তোমার হাতে ধরি বউমা।”
অরুনিকা লজ্জায় চোখ – মুখ রাঙিয়ে বলল—
“কী করছেন আম্মা!”
নমিতা বেগম জোর দিয়ে বললেন—
“তুমি আর না বলো না বউমা। একটা বাচ্চা হলে শৈবাল আরও শুধরে যাবে। দেখো, বাচ্চা এলে এই রাগ আরও পানি হয়ে যাবে।”
অরুনিকা বদ্ধ শ্বাস ফেলে বলল—
“আপনি বসেন আম্মা।”
নমিতা বেগমকে চেয়ারে বসাল অরুনিকা। আদুরে গলায় বলল—
” এত অনুনয় করছেন কেন? হিরে-মানিক তো চেয়ে বসেননি আমার কাছে!”
নমিতা বেগম মাথা নত করলেন। অরুনিকাকে কোনো আবদার করতেও তার দ্বিধাবোধ হয়। সাথে একরাশ আত্মগ্লানি তাকে ঘিরে ধরে। সংশয়, সংকোচ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় তাকে। অরুনিকা সরল গলায় বলল—
“জয়নাল আংকেলের সাথে কথা বলেছি আমি। আংকেল বললেন, মেডিসিনের পাশাপাশি ওকে ডাক্তার সাবিনার কাছে নিয়ে যেতে। তিনি কয়েকটা সেশন করলেই শৈবালের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে পারবেন। তাই আমি ভাবছি, তার সাথে দেখা করে এসে না হয় এই নিয়ে কিছু ভাবব। আপনি তো জানেন তার রাগ। কখন কী করে বসে! অসুস্থ শরীর নিয়ে তখন তাকে সামলাতেও পারব না। বিয়ে তো একবারই হয় আম্মা। আপনার ওই পাগল ছেলেকে আমি সত্যিই ভালোবাসি। তাকে বলে দিয়েন, এই জনমে তাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না। কোথাও না।”
অরুনিকার দিকে তাকাতেই নিজের চোখে জল চলে এলো নমিতা বেগমের। তিনি কিছু বলার আগেই দৌড়ে চলে গেল অরুনিকা। নমিতা বেগম বুক ভরা চাপা শ্বাসটা বের করে বিড়বিড় করে বললেন—
” আমার আয়ু লাগুক তোমার কপালে! আমার ছেলেটা তোমাকে ছাড়া শেষ হয়ে যাবে। অরুমিতার জন্য ও যে পাগলামি করেছে তার এক সিকি পরিমাণ যদি তুমি দেখতে পেতে, তাহলে এক লহমায় তুমি বুঝে নিতে ওর জীবনে তোমার স্থান কোথায়।”
নমিতা বেগম ডুকরে উঠলেন।
,
,
,
“ভেতরে আসতে পারি?”
তন্দ্রার কণ্ঠে সপ্রতিভ হলো শৈবাল। কেবিনে একা বসে আছে। তার মোবাইল ফোনের স্লাইডশো তে একের পর এক ভেসে উঠছে অরুনিকার ছবি। সেখানে দৃষ্টি রেখে বলল—
” এসো।”
তন্দ্রা নরম পায়ে এসে শৈবালের সামনে বসল। তার হাতের সবুজ রঙের ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল—
“ফাইলটা একবার দেখে নিন, স্যার।”
শৈবাল অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল—
“হুম।”
এক হাতে মোবাইল, সেখানে আবদ্ধ দুই বিমোহিত নেত্র, অন্য হাতে ফাইলটা টেনে নিল শৈবাল। তন্দ্রা মোহিত হলো। শৈবালের স্থির দৃষ্টিতে থাকা ওই মোহ, অদৃষ্টের মাঝ বরাবরের অস্পষ্ট ভাঁজ, নিষ্কম্প পুরুষ্ট ওষ্ঠাধরসহ আসক্তিতে টইটম্বুর ওই পৌরষদীপ্ত আননে পলকহীন, বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল তন্দ্রা। তার অগোচরেই ফাইলটা দেখা শেষ করে আঙুলের ধাক্কায় ঠেলে দিল শৈবাল। শক্ত ফাইলের আবরণ বুকের কাছে লাগতেই সম্বিৎ ফিরে পায় তন্দ্রা। এক লহমায় চোখ বড়ো বড়ো করে বলল—
“জি, স্যার!”
“ফাইলটা রি-চেক দিয়ে এসো।”
“কেন স্যার?”
“চেক করলেই বুঝবে। যাও।”
তন্দ্রার মন ক্ষুণ্ণ হলো। অধর ফাঁক করল কিছু বলার জন্য। তখনই ফোন বেজে উঠল শৈবালের। শৈবাল রিসিভ করল। অল্পকালেই তার গম্ভীর, কঠোর মুখটা সতেজ হলো। ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠল মধুর হাসি। সে সানন্দে বলল—
“হ্যালো!”
“কী করছেন?”
“কিছু না। তুমি?”
অরুনিকা মৃদু হাসল। মিহি গলায় বলল—
“কী নিয়ে আসতে বলেছি মনে আছে তো?”
শৈবাল তেরছা হাসল। মিষ্টি করে বলল—
“উহু।”
অরুনিকা নাক-মুখ কুঁচকাল। সে ভালো করেই জানে মিথ্যে বলেছে শৈবাল। তবুও আগ্রহ নিয়ে বলল—
“দু’ প্যাকেট চকলেট, দুটো টেডি বিয়ার, দুটো আইসক্রিমের বক্স, দু’জোড়া বাতি জ্বালানো জুতো, আর আপনি।”
জুতোর কথা শুনতেই হেসে ফেলে শৈবাল। ওপাশ থেকে অরুনিকা মিহি সুরে হাসে। শৈবাল এক ভ্রূ উঁচু করে তাকাল তন্দ্রার দিকে। তন্দ্রা এখনো ধুম ধরে তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। শৈবাল মৃদু হেসে বলল—
“আমি? ”
“জি,আপনি। জলদি আসবেন। নাহলে ওরা রাগ করবে।”
“আর তুমি?”
অরুনিকা নিঃশব্দে হাসল। ঠোঁট চিপে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল—
“বব্ব না। আমাল শলম কলে।”
টুক করে লাইন কেটে দেয় অরুনিকা। চোখ হাসে শৈবালের। তার ওই আলো ঝলমলে চোখের হাসিতে কী যেন দেখল তন্দ্রা! শৈবালের অবিমিশ্র,অবাধ অধরোষ্ঠের হাসিতে মোমাচ্ছন্ন সে। তার ঘোর লেগে আসে। শৈবাল কান থেকে ফোন সরিয়ে পূর্বের ন্যায় কণ্ঠ শক্ত করে বলল—
“তুমি এখনো যাওনি কেন? আধা ঘণ্টা, আধা ঘণ্টার মধ্যে ফাইল চেক করে আমার সাইন নিয়ে যাবে।”
তন্দ্রা ভ্রূতে ছোটো ছোটো ভাঁজ তুলে বলল—
“কিন্তু স্যার….।”
“যেতে বলেছি তোমাকে।”
তন্দ্রা নিরুপায় হয়ে উঠে দাঁড়ায়। আধা ঘণ্টায় তার পক্ষে কোটি টাকার হিসাবে কী গড়মিল হয়েছে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! সে আহতচিত্তে হেঁটে হেঁটে দরজার কাছে পৌঁছাতেই শৈবাল বলে উঠে—
“শোনো!”
তড়িৎ বেগে ফিরে তাকাল তন্দ্রা। শৈবাল ফোঁস করে দম ছেড়ে বলল—
“এক লক্ষ টাকা এই কোম্পানির জন্য অনেক বড়ো কিছু না হলেও তোমার জন্য অনেক বড়ো সমস্যার সৃষ্টি করবে। যাও।”
চট করে হেসে ফেলল তন্দ্রা। সে তার সংকেত পেয়ে গেছে। গদগদ গলায় চকচকে চোখে চেয়ে ফলল–
” থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ, স্যার।”
শৈবাল নত মুখে চেয়ে আছে। তন্দ্রার দিকে তাকালে হয়তো বুঝতে পারত মেয়েটার চোখে জল নেমে এসেছে!
চলবে,,,
#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:১৩
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি
রিম, ঝিমের খুশিতে ঝলমল করছে বসারঘর। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের খলখলানিতে কূজিত চারপাশ। মামির আহ্লাদে আটখানা রিম, ঝিম। অবলীলায় করা আবদার পরিপূর্ণ। শৈবালের নিয়ে আসা জুতো পরে দুই বোন ভীষণ আনন্দিত। মামিকে আগ্রহের সাথে টুকটুক করে হেঁটে দেখাচ্ছে। কেক কাটা শেষ। বাকি বাচ্চারাও নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। একটু দূর থেকে প্রাণপাখিকে আঁখিবদ্ধ করে রেখেছে শৈবাল।
লাইট অলিভ রঙের শাড়ি পরেছে অরুনিকা। কানে সোনালী রঙের চ্যাপ্টা দুল। চুল খোলা রাখতে চেয়েও শৈবালের কথায় খোঁপা করে রেখেছে। সিঁথিতে সগর্বে শোভা পাচ্ছে টিকলি। অরুনিকা ঝুঁকে কথা বলছে। তার টিকলি ঝুলে যেতেই ছোটো ছোটো হাতে তা অরুনিকার কপালের সাথে চেপে ধরেছে ঝিম। মিঠে গলায় বলল—
“মামিমা, তোমাকে সুন্দর লাগছে!”
অরুনিকা ঝকঝকে হেসে বলল—
“তাই?”
দুই বোন একসাথে মাথা দোলালো। অরুনিকা চোখে হেসে দুই বোনের গালে টুস করে চুমু দিয়ে বলল—
” আমার মামুনিদেরও সুন্দর লাগছে। একদম পরীর মতো!”
দুই বোন খিলখিল করে হেসে ওঠে। সচ্ছল হাসির দমকে রিম, ঝিমের চোখ দুটো ক্ষুদ্রাকৃতির হয়ে যায়। নাক কুঁচকে যেতেই মিষ্টি লাগে আরও। অরুনিকা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার দুই হাত ভর্তি ঝনঝন করছে চুড়ি। চুড়ির শব্দ একদম পছন্দ না তার। কিন্তু শৈবালের পছন্দ। গোলাপী আবিরে রাঙানো ওষ্ঠাধরে চিরল হাসি। সেই হাসিতে আবিষ্ট শৈবাল। অকস্মাৎ ফোনকল অ্যাটেন্ড করতে সরে আসে সে। তদ্দণ্ডে এগিয়ে আসে শিমুল। অরুনিকার সন্নিকটে দাঁড়িয়ে সতেজ গলায় বলল—
“কেমন আছেন, মিসেস শৈবাল?”
অরুনিকা প্রাণবন্ত হাসল। জড়তাহীন গলায় বলল—
“আলহামদুলিল্লাহ! ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
শিমুল ছোট্ট করে হেসে বলল—
“এই তো চলছে! চিনতে পেরেছেন তাহলে! আমি তো ভেবেছিলাম, চিনবেন না।”
“না চেনার কী আছে!”
শিমুল মোলায়েম হেসে বলল—
“বিয়েতে আসতে পারিনি, সরি। গিফ্ট পাঠিয়েছিলাম। পেয়েছেন তো?”
অরুনিমা সহজ হেসে বলল—
“জি।”
“পছন্দ হয়েছে?”
“হুম।”
“শৈবালের অবস্থা এখন কেমন?”
অরুনিকার হাসি নিভে গেল। তবুও চোখে প্রসন্নতা রেখে বলল—
“আগের চেয়ে ভালো।”
শিমুল আফসোসের সুরে বলল—
“সব শুনেছি আমি ভাবীর কাছে। ভেরি স্যাড! অরুমিতাকে পাগলের মতো ভালোবাসত শৈবাল। অনেক খুশিও ছিল। কী থেকে যে কী হয়ে গেল!”
গলায় যেন কাঁটা বেঁধে গেল অরুনিকার। না সে তা গিলতে পারছে, না উগরে দিতে। কয়েকটা বড়ো বড়ো শ্বাস নিতেই তার চোখ-মুখ অস্থির দেখাল। শিমুল উদ্বিগ্ন গলায় বলল—
“আপনি ঠিক আছেন তো?”
অরুনিকা অনেক কষ্টে ওষ্ঠাধর গলিয়ে শ্বাস ফেলল। ভেজা নেত্রযুগল প্রস্ফুটিত রেখে গহন শ্বাসের সাথে বলল—
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি ঠিক আছি।”
অরুনিকা হালকা পেছনে গেল। একটা ছোটো বাচ্চা দৌড়ে যাচ্ছিল তৎক্ষণাৎ। অরুনিকার সাথে ধাক্কা লাগতেই বাচ্চাটির হাতে থাকা কেক মেখে যায় অরুনিকার শাড়িতে। শিমুল ব্যস্ত হয়ে বলল—
“ইশ! শাড়িটা শেষ! ”
একটা টিশু নিয়ে এসে অরুনিকা শাড়িতে ঝাড়া দিতেই ঝড়ের বেগে শিমুলকে ধাক্কা মারল শৈবাল। হতভম্ব হয়ে গেল উপস্থিত সবাই। তাদের এলোমেলো, ভয়ে অস্থির দৃষ্টি শৈবালের দিকে। জাফর তার এক প্রতিবেশীর সাথে কথা বলছিল। দৈবাৎ ঘটনায় সে হতবাক। শৈবালের চোয়াল শক্ত, চোখের চাহনি উগ্র, রোষানলে জ্বলছে কায়া। ফোঁস ফোঁস করে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে অচিরেই। শিমুল ধাতস্থ হওয়ার সময় পেল না। তার পূর্বে কেক রাখার টেবিলের ওপরে থাকা ঠান্ডা পানীয়ের বোতল হাতে নিয়ে নিল শৈবাল। টেবিলের কোণার সাথে বাড়ি মারতেই তা ছিটকে পড়ল এধারে ওধারে। তার ব্লেজার ভিজে গেল, চোখ-মুখে ছটকা পড়ল পানীয়ের। ভাঙা বোতলের অবশিষ্টাংশ নিয়ে এক লহমায় শিমুলের কাছে গিয়ে তার শার্ট চেপে ধরে চোখে গেঁথে দিতে গেলেই, অভাবিত ধাক্কায় পিছিয়ে যায় শৈবাল। পায়ের ভার দৃঢ় করতেই স্থির হলো সে। ভাইয়ের পেছনে আশ্রয় নিল শিমুল। রিতিমতো গা কাঁপছে অরুনিকার। জাফর হলকে উঠে বলল—
” এসবের মানে কী শৈবাল? কী করছিলে তুমি?”
শৈবাল হিংস্র কণ্ঠে বলল—
“ওকে বলেছি অরুর আশেপাশে না আসতে। শুনতে পায়নি ও?”
“মাই গড! কথাই বলছিল শৈবাল।”
“বলবে না, কোনো কথা বলবে না।”
শিমুল দাঁতে দাঁত কষে বলল—-
“তোর বউকে কী আমি নিয়ে যাচ্ছি নাকি! আজব পাবলিক ভাই! ”
শৈবাল শব্দ করে শ্বাস ফেলছে। রিম, ঝিম ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বোতল ফেলে ঘুরে গিয়ে অরুনিকার হাত চেপে ধরে হাঁটা শুরু করে শৈবাল। অরুনিকা পুতুলের মতো হেঁটে চলছে। রিম, ঝিম দৌড়ে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ায়। ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল রিম—
“মামা, মামিমা’কে নিয়ে যেয়ো না। হ্যাপি বার্থডে তো শেষ হয়নি।”
অরুনিকার হাত ছেড়ে দেয় শৈবাল। হাঁটু মুড়ে বসে রিম, ঝিমের হাতে চুমু খেয়ে নিস্পন্দ গলায় বলল—
“হ্যাপি বার্থডের জন্য অপেক্ষা করলে আমি শেষ হয়ে যাব, আম্মু। আসি।”
শৈবাল উঠে দাঁড়ায়। রিম, ঝিমের অনুভূতিকে পায়ের তলায় পিষে রেখে অরুনিকাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সবাই।
,
,
,
খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে মেঝেতে বসে আছে শৈবাল। অরুনিকার কপোল বেয়ে পড়া পানি চুকচুক করে শুঁষে নিচ্ছে তার শাড়ি। শৈবাল নির্মোহ গলায় বলল—-
“খেয়ে নাও অরু।”
অরনিকা তিক্ত গলায় বলল—
“ইচ্ছে করছে না আমার।”
“প্লিজ খেয়ে নাও। সরি বলেছি তো।”
অরুনিকা ঝাঁঝিয়ে উঠল। সরোষে বলল—
“কীসের সরি, কীসের সরি?”
শৈবাল নির্বাত চোখে চেয়ে বলল—
“যা হয়েছে তার জন্য সরি। প্লিজ খেয়ে নাও। তুমি কিছুই খাওনি।”
অরুনিকা ওষ্ঠাধরের ভাঁজ খুলে শ্বাস ফেলল। গনগনিয়ে উঠল তার চোখ। দুই হাত দিয়ে তুরিতে মুছে নিল চোখের জল। ক্রুদ্ধ গলায় বলল—
“এই, আপনার কী সমস্যা? কেন এমন করেন আপনি? কী মনে হয় আপনার আমাকে? স্বর্গের পরী মনে হয়? না কী বিশ্ব সুন্দরী ঐশ্বরিয়া মনে হয়? কোনোটাই নই আমি। এমন সুন্দরী নই যে, যে দেখবে সেই লেজ নাড়াতে নাড়াতে আমার পেছনে ঘুরঘুর করবে! তাহলে, তাহলে কী সমস্যা আপনার? কেন পাগলের মতো আচরন করেন? বউ কী শুধু আপনারই আছে! আর কারো নেই?”
শৈবাল শুনল। তার মধ্যে কোনো ভাবের উদয় হলো না। সে নরম চোখে তাকিয়ে বলল—-
“খেয়ে নাও অরু। না খেলে রাতে ঘুম হবে না তোমার।”
“এই, এই আপনি মানুষ? একটা মানুষকে ওভাবে কেউ মা/রতে যায়! আপনার ভয় করল না শৈবাল? যদি শিমুল ভাইয়ের কিছু হয়ে যেত!”
শৈবাল পূর্বের ন্যায় বলল—
“তুমি খাও অরু। অনেক রাত হয়েছে।”
“আপনি প্লিজ যান এখান থেকে, প্লিজ যান। একদম সহ্য হচ্ছে না আপনাকে আমার।”
শৈবাল ক্লান্ত শ্বাস ফেলে অনুরক্তির সুরে বলল—
“কী করলে খাবে তুমি? বলো আমাকে। আমি তাই করব।”
অরুনিকার এলোমেলো ভাবনা স্থির হলো। সে হুট করে শৈবালের প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে নিয়ে বলল—-
“নিন, ফোন করুন শিমুল ভাইয়াকে। তাকে সরি বলুন।”
শৈবাল নির্নিমেষ চেয়ে রইল। অনড়, অচঞ্চল, অচকিত চাহনি। অরুনিকা পর্যাপ্ত পরিমান নিজেকে সংযত রেখে বলল—-
“কী হলো, তাকিয়ে আছেন কেন? ধরুন ফোন।”
“না।”
অরুনিকা চাহনি পরিষ্কার করল। সন্দিগ্ধ গলায় বলল—
“কী না?”
“আমি ওকে সরি বলব না।”
“কেন?”
“কেন সরি বলব ওকে আমি?”
অরুনিকা তাচ্ছিল্য হেসে বলল—
“কী করেছেন মনে নেই আপনার? কাউকে মেরে ফেলতে চেয়েছেন আপনি! একজন মানুষকে শৈবাল। যে আপনার রুপসী বউকে একটু সাহায্য করতে চেয়েছিল। তার সাথে প্রেম করতে আসেনি।”
অরুনিকার কথাগুলো অদ্ভুত শোনাল। তবুও নিঃসংকোচে তা হজম করে নিল শৈবাল। বলল—
“আমি ওকে সরি বলব না, অরু।”
“তাহলে আমিও খাবো না।”
“তুমি সত্যিই খাবে না?
“না, না,না। শুনতে পাচ্ছেন না আপনি!”
শৈবাল প্লেট রাখল বিছানায়। অরুনিকা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সহসা ঝনঝন করে আওয়াজ হতেই সে বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে তাকাল। ঝিমঝিম করে উঠল অরুনিকার দেহ। ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে সব ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। অরুনিকা ঘরের কোথাও ধারালো জিনিস রাখে না। এমনকি রান্নার জন্য ব্যবহৃত দা, ব/টি, ছু/রিও সে যত্নে কিচেন ক্যাবিনেটে রেখে তালা বদ্ধ করে রাখে। শৈবাল নিরুত্তেজ চোখে তাকিয়ে আছে। তার হাতের মুঠোতে কাচ ভাঙা। তাতে চাপ প্রয়োগ করেই অধরে ঝোলালো হাসি।
চলবে,,,