#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:১৬,১৭
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:১৬
ছিটকে পড়ল শিমুল। ধাতস্থ হয়ে আহত চোখে তাকাল শৈবালের দিকে। রোষানলে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে শৈবালের চোখের কোটর। সে তেড়ে গিয়ে শিমুলের শার্ট চাপড়ে ধরে তাকে দাঁড় করাল। ক্ষিপ্ত স্বরে বলল—
“তোকে কী বলেছি বুঝতে পারিসনি? কী চাস তুই?”
শিমুল উগ্র গলায় ঝাড়া মেরে বলল—
“ছাড় আমাকে। হাত কিন্তু আমারও আছে।”
“তোকে আমি…।
শৈবাল মুষ্টিবদ্ধ হাত শিমুলের মুখের কাছে আনতেই টগবগিয়ে বলে উঠে শিমুল—
” অরুমিতা তোর যোগ্য ছিলই না।”
থেমে যায় শৈবাল। হাত নামিয়ে নিয়ে ফোঁস করে দম ছাড়ল। শিমুলের কাছ থেকে সরে এসে টেবিলের ওপর দুই হাতের ভর দিয়ে ঝুঁকল। হতাশ্বাস ফেলে বলল—
” আমি কিছু শুনতে চাই না। অরুমিতা নেই। যে আছে সে….। আমি তোর ছায়াও ওর পাশে দেখতে চাই না। অরুর নামে আর একটা কথাও বলবি না। ওকে আমি ভালোবাসি।”
“সত্যিই ভালোবাসিস?”
শৈবাল লালাভ চোখে তাকাল শিমুলের দিকে। যেন মনে হলো ওই অগ্নিঝরা চোখ দুটো দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে শিমুলকে। শৈবাল বক্ষস্থল সোজা করে দাঁড়াল। কঠোর গলায় বলল—
“ভালোবাসি ওকে আমি। ওকে আমি এক মুহুর্তের জন্য নিজের কাছ থেকে দূরে সরাব না। যে ভুল অরুমিতা করেছে, তা আমি অরুকে করতে দেবো না। ”
শিমুল দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল—
“তুই ঠিক আছিস? অরুমিতাকে অরুমি…তা বলে ডাকছিস। আর অরুনিকাকে অরু। তুই বদলে গিয়েছিস শৈবাল। অরুনিকা তোকে সত্যি বদলে দিলো। আই এম গ্লাড! ব্যস, এবার কোনো ভুল না হোক। ভালো থাক তুই।”
শৈবাল তাচ্ছিল্যের সাথে বলল—
“সে সুযোগ আমি ওকে দেবো না। অরুমিতাকে আমি ভালোবাসলেও, ও আমাকে ভালোবাসতে পারেনি। যদি ভালোবাসত তাহলে ও আমাকে ধোঁকা দিতে পারত না। ক্ষমা করব না ওকে আমি। কখনো না।”
শিমুল ঢোক গিলল। সন্দেহ চোখে তাকিয়ে বলল—
“সেদিন সত্যিই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল?”
“তোর কী মনে হয়?”
শিমুল কথা বলল না। বিয়ের আগেই সে সবকিছু জানিয়েছিল শৈবালকে। যদি ভালো নাই বাসতো তাহলে বিয়েটা অন্তত হতো না। কিন্তু….
,
,
,
রেস্তোরাঁর দরজা পুশ করে ভেতরে ঢুকল তন্দ্রা। হন্তদন্ত করে কোণার দিকের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। হ্যান্ডব্যাগটা চেয়ারে রেখেই বলে উঠল—
“সরি, সরি! একটু দেরি হয়ে গেল।”
তন্দ্রা চেয়ারে বসল। অমিত মোবাইল থেকে মাথা তুলে বলল—
“ইটস ওকে।”
তন্দ্রা কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল—
“হঠাৎ দেখা করতে চাইলে যে? তোমার তো এই সপ্তাহে আসার কথা না।”
অমিত মন্থর গলায় বলল—
“খালা আর খালুকে পৌঁছে দিতে এলাম। তাই ভাবলাম তোমার সাথেও দেখা করে যাই। আবার কবে আসা হবে বলতে পারছি না।”
“কেন? কাজের চাপ কী বেড়েছে?”
“তেমনটাই। বাবার শরীর ভালো নেই। একা সামলাতে হয় সব। যাই হোক, তোমার কী অবস্থা? কাজ কেমন চলছে?”
তন্দ্রা আফসোসের সাথে বলল—
“আর বলো না। কী যে একটা ঝামেলায় পড়েছিলাম। থ্যাংকস গড! শৈবাল স্যার ছিল বলে! তা নাহলে তো।”
“কেমন আছে তোমার স্যার?”
তন্দ্রা ভ্রূ কুঁচকে বলল—
“তোমার ধারণা একদমই ঠিক নয় অমিত। স্যার মোটেও তেমন নয়। আমি অনেকবার চেষ্টা করে স্যারকে একটুও টলাতে পারিনি। আরে বাবা! চোখ তুলেও তাকায় না।”
অমিত গা দুলিয়ে হেসে উঠল। রসালো গলায় বলল—
“মেয়ে মানুষ হলো মধুর চাক! পুরুষের সাধ্য কই সেই মধু থেকে নিজেকে দূরে রাখার। তুমি ঠিক ঠাক চেষ্টা করোনি। নাকি বুঝে নেব তোমার মাঝে সেই জিনিসটাই নেই।”
তন্দ্রা ভীষণ বিরক্ত হলো। নিজের গার্লফ্রেন্ডকে কেউ অফিসের বসের পেছনে লাগায়! তন্দ্রা বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল—
“তুমি যাই বলো, আমি আর পারব না। আমি কেন, অফিসের কোনো মেয়ের প্রতি স্যারের কোনো অ্যাট্রাকশন নেই। সে তো নিজের পিএ ও একজন পুরুষ রেখেছে।
আর যাই হোক, তুমি যেমনটা বলেছ শৈবাল স্যার মোটেও তেমন নয়। মেয়েরা অনেক সিকিউর ফিল করে তার সান্নিধ্যে। অন্তত আমার তা মনে হয়। এমনকি জাফর স্যারও অত্যন্ত অমায়িক একজন মানুষ। অফিসের অনেকের গসিপের স্বীকার তিনি। যে, জামাই শ্বশুড়ের কোম্পানিতে দাপট করে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। শৈবাল স্যার যদি ছাতা হয় তাহলে তিনি বৃষ্টি। একে অপরের পরিপূরক। চমৎকার দুজন মানুষ। অফিসে নতুন কেউ ধারণাই করতে পারবে না তারা শালা -দুলাভাই।”
অমিতের সমান্তরাল ললাটে বিরক্তির ভাঁজ ফুটে উঠল। তেতো মুখে বলল—
“ভালো হলেই ভালো। আজকাল বসদের সাথে খাতির না থাকলে অফিসে টেকা যায় না। তাই বলেছিলাম স্যারদের সাথে একটু মিলিয়ে চলতে। তুমি যখন বলছ, তাহলে ভালোই হবে সব। বাদ দাও, কী খাবে বলো?আমাকে আবার ট্রেন ধরতে হবে।”
“তুমি কী এক্ষুণি চলে যাবে নাকি?”
অমিত সম্মতি দিয়ে বলল—
“হ্যাঁ। টিকেট কেটে রেখেছি।”
তন্দ্রা আবেগপ্রবণ হয়ে বলল—
“আমরা বিয়ে করছি কবে? তুমি তো এখনো কিছু ভাবলে না!”
অমিত হালকা ঝুঁকে এলো সামনে। গাঢ় স্বরে বলল—
“আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। আম্মাকে বলেছি তোমার কথা। এখনো কিছু বলেনি তারা। বুঝই তো গ্রামের মানুষ, বিয়ের পর তুমি শহরে থাকবে শুনে তারা এগোতে চাচ্ছেন না।”
“আমার কিছু করার নেই অমিত। আমি কোনোভাবেই এই জব ছাড়তে পারব না। আমার ইনকামে আমার মা আর বোনের লেখাপড়া চলে। বাবা নেই আমার।”
অমিত আলতো করে তন্দ্রার হাত চেপে নিল নিজের হাতের মাঝে। মায়াময় কণ্ঠে বলল—
” এত চিন্তা করো না। আমি বুঝিয়ে বলব সবাইকে।”
স্বস্তির শ্বাস ফেলল তন্দ্রা। মেয়ে হয়ে একা সমাজে চলা বড়ো কষ্টকর!
,
,
,
মাগরিবের আযান পড়েছে। সায়ংকালের আঁধার জড়িয়ে নিয়েছে প্রকৃতিকে। তমসার চাদর ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে বিধু। তার স্নিগ্ধ দ্যুতিতে পরিবেশ হয়ে উঠছে লাবণ্যময়।
আজ বাতাসে শীতলতা বইছে। অরুনিকার চট করে মনে হলো, বৃষ্টি এলেই রিম, ঝিম ভুনা খিচুড়ি খাওয়ার বায়না ধরত। অল্প ঝাল দিয়ে গাঢ় ঝোলের ডিম ভুনা আর মুরগির মাংসও ভীষণ প্রিয় দুই বোনের। চুলোতে চায়ের পানি বসাতেই রান্নাঘরের জানালা দিয়ে হুরহুর করে ঢুকে পড়া ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে উঠল অরুনিকা। চট করেই তখন খিচুড়ির চিন্তা আসলো তার মাথায়। তাই দেরি না করে ব্যস্ত হয়ে চাল ডালের মিশ্রন নিয়ে ট্যাপের নিচে দিতেই বেসুরে আওয়াজে বেজে উঠল তার ফোন। পাশ থেকে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বার দেখে একগাল হেসে রিসিভ করতেই ওপাশের মানুষের উৎকণ্ঠিত কথার বিপরীতে বলে উঠে অরুনিকা—-
“কী বলছেন? এসব হলো কী করে?”
চলবে,,,