ভালোবাসায়_বন্দিনী #পর্ব_১৭

0
2561

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#পর্ব_১৭
#জান্নাতুল_নাঈমা

রুদ্র গভীর রাতে বাড়ি ফিরে সোজা নিজের রুমে গিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। সাদমান, আবির,নিরব কে সুখনীড়ে রেখে এসেছে। বাকি বন্ধুরা যে যার বাড়ি চলে গেছে আবার কাল আসবে। সকাল সকাল আয়োজনে লেগে পড়তে হবে তাঁদের। বাবুর্চি ঠিক করা আছে তাঁরা শুধু সাথে থাকবে। দাদুর সাথে সব আলোচনা করা আছে। সারাদিনের ধকল শেষে বাড়ি ফিরেছে শান্তি তে ঘুমানোর জন্য। ফোন হৈমীর রুমেই রেখে এসেছে নিজের কাছে ছোট একটা বাটন ফোন রয়েছে শুধু। যেটা শুধু নিজের কাজে ব্যবহৃত করে সাদমান ব্যাতিত কোন বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন কেউ জানে না নাম্বারটা এমন কি তাঁর নিজের মাও না। সাদমান জানে কারন সাদমান তাঁর কাজের ব্যাপারেও সব জানে। যার ফলে সাদমান বাদে সকাল এগারোটার আগে রুদ্র কে হারিক্যান দিয়ে খুঁজলেও কেউ পাবে না।

এদিকে বাড়ির সকলেই জানে রুদ্র ঠিক কি করেছে আর কি করছে। রেদওয়ান শেখ চুপচাপ আছে এবং ছেলের একাউন্ট চেক করে দেখেছে দু লাখ পঁচিশ হাজার টাকা রয়েছে তাই আরো দুলাখ পাঠিয়ে দিলো। যদিও ছেলে তাঁর কখনো নিজে থেকে এক পঁয়শাও চায় না তবুও বাবা হিসেবে সে তাঁর সব দায়িত্ব পালন করে যায়। সুরভী বেগম কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে পড়েছিলো নয়না তাঁকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে৷ সূচনা দরজা খুলে নি, সারাদিন মেয়েটা না খাওয়া৷ রাদিফ, নয়না,রেদওয়ান শেখ, রুদ্রর দাদি অনেক ডেকেছে তবুও কাজ হয়নি৷
.
মেঝেতে বসে আছে সূচনা। ফজরের আজান কানে ভাসতেই চোখ, মুখ মুছে বাথরুম গিয়ে ওযূ করে এসে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে মোনাজাতে ডুঁকরে কেঁদে ওঠলো সে৷ “ছোট বেলা মা কে কেড়ে নিয়েছো মায়ের আদর ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য দাওনি গো মাবুদ। বাবা থেকেও নেই, এ পরিবার কেই নিজের পরিবার হিসেবে মেনে এসেছি। এ পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যকে নিজের আপনজন হিসেবে মানি। ছোট থেকে আমি এ বাড়ির বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি, আমি পরগাছা হয়ে কোথাও থাকতে চাইনি। চেয়েছি নিজের একটা পরিচয়, চেয়েছি রুদ্রর ভালোবাসাকে, চেয়েছি রুদ্র কে আপন করে পেতে। যার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজেকে তাঁর মতো করেই তৈরী করেছি৷ কখনো কোন ছেলের সাথে মেশা তো দূর ভালোভাবে তাকাইওনি৷ আমার ধ্যান,জ্ঞান সবটাই ছিলো রুদ্র কে নিয়ে। কম অপমান কম অবহেলা সহ্য করিনি তবুও আশা ছিলো আমার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা একদিন না একদিন রুদ্র বুঝবে। সেই আশা টুকুও এভাবে শেষ হয়ে গেলো? আমার জীবনে কি কষ্ট ছাড়া কিছু নেই? আমার জীবনে কেনো ভালোবাসার মানুষ থাকে না? কি পাপ করেছি আমি? জন্মের পর থেকে আমার ভাগ্য কেনো এমন? আমার কি সুখে থাকার অধিকার নেই?আমার কি ভালোবাসার মানুষ দের কাছে পাওয়ার অধিকার নেই? সবাই বলে একজীবন কষ্টে কাটলে আরেক জীবন সুখে কাটে কিন্তু আমার সারাটাজীবনই কেনো এমন হলো?
কি করে সহ্য করবো আমি রুদ্রর পাশে অন্য কাউকে? আমার মাঝে কি কমতি ছিলো?আমি তো সব সময় ওর মতো করে নিজেকে সাজিয়েছি,গুছিয়েছি তবুও কেনো পেলাম না ওকে?
কাউকে মন থেকে সত্যি কারের ভালোবাসলে নাকি তাঁকে একদিন না একদিন পাওয়া যায় আমি কেনো পেলাম না? আর কতো পরীক্ষা নেবে তুমি আমার৷ আমি আমার জীবনের শেষ অবদি অপেক্ষা করবো রুদ্র কে আমার চাই, আমি রুদ্র কে খুব ভালোবাসি খুব। সারাজীবন ওর পায়ে ধরে থাকবো তবুও ওকে আমার চাই। একটা কেনো দশটা হৈমী ওর জীবনে আসলেও ও যদি একটা বার আমাকে চায় এই সূচনা সর্বস্ব উজার করে দেবে ওকে। অনেক পরীক্ষা দিয়েছি অনেক পরীক্ষা নিয়েছো। আর পারছিনা রুদ্র কে আমার করে দাও ফিরিয়ে দাও আমার রুদ্র কে। আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না৷ আমার মনপ্রানজুরে শুধু রুদ্র, রুদ্র, রুদ্র। সহ্য করতে পারছিনা বুকের ভিতর এতো কষ্ট কেনো দিচ্ছো? প্রাণ নিয়ে নিবে? একটা বার রুদ্রর বউ হওয়ার সুযোগ করে দাও একটা বার রুদ্রর বুকে মাথা রাখার সুযোগ করে দাও। এই অপূর্ণতা নিয়ে মরলেও যে শান্তি পাবো না। আমার আত্মা যে হাহাকার করবে। ভালোবাসার মানুষ কে না পাওয়ার হাহাকার ”

জায়নামাজে আমিন ধরেই শুয়ে পড়লো সূচনা।উপরওয়ালার কাছে নিজের সমস্ত আবেগ,সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, না-পাওয়ার কথা জানিয়ে নেতিয়ে পড়লো মেয়েটা৷ চোখের পানিতে জায়নামাজ ভিজিয়ে ফেলছে তবুও তাঁর চোখের পানি বাঁধ মানছে না৷ আর না মানছে তাঁর মন।

২৩ বছরের জীবনে কখনো একটা ছেলে বন্ধু বানায় নি। তাঁর সবটা জুরে রুদ্র ছাড়া আর কেউ নেই। তাঁর ভালোবাসার জন্ম হয়েছে সেই শিশু কাল থেকেই। যখন সে ভালোবাসার মানেটাও বুঝতো না। ভালোবাসার মানে না বুঝলেও বুঝতো শুধু রুদ্র কে। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে শুধু রুদ্র নয় ভালোবাসা, ভালোলাগা সবটাই ছুঁয়ে গেছে তাঁর মনে। স্বামী হিসেবে মেনে এসেছে সে রুদ্র কে। এতোগুলো বছরের ভালোবাসা কি এতো সহজে মুছে ফেলা যায়?এতো সহজে মেনে নেওয়া যায় নিজের জায়গায় অন্য কাউকে? বুকের ভিতরের যন্ত্রণা গুলো কি কাউকে বোঝানো যায়৷ তাঁর এই যন্ত্রণা যদি রুদ্র বা হৈমী বুঝতে পারতো তাদের অনুভূতি টা কি হতো? ভালোবাসা তো ভুল নয়, ভালোবাসা তো অপরাধ নয়৷ নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসলে কষ্ট কেনো পেতে হবে? “প্রিয় মানুষ চোখের সামনে অন্যকারো হয়ে যাওয়ার দৃশ্য টা কি মৃত্যু যন্ত্রণাকেও হার মানায় না”?
.
গায়ে থেকে সব গয়না খুলে ঘুমিয়েছিলো হৈমী। শুধু নুপুরটা বাদে ঘুম থেকে ওঠে আড়মোড়া ভেঙে আশেপাশে তাকাতেই গয়না গুলো আর রুদ্রর ফোনটা দেখতে পেলো। বিছানা ছেড়ে ওঠে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে রুম থেকে বের হয়ে বাচ্চা দের রুমে ওকি দিলো। তাঁরাও ব্রাশ করছে পরী হৈমীকে দেখতে পেয়েই গুটিগুটি পায়ে হৈমীর দিকে এগিয়ে এলো। হৈমী এক গাল হেসে একহাতে পরীর এক হাত আরেক হাতে ব্রাশ করতে করতে ছাদের দিকে চলে গেলো। ছাদে গিয়ে বেশ অবাক হলো হৈমী তিন বন্ধু ছাদে পাটি বিছিয়ে একে অপরের উপর হাত পা ওঠিয়ে কি বিচ্ছিরি অবস্থায় ঘুমাচ্ছে। কাঠের চেয়ারের ওপর দেখতে পেলো ছোট ছোট চারটা কাঁচের গ্লাস একটা বড় বোতল। কেমন বিদঘুটে গন্ধ আসছে। নাক,মুখ কুঁচকে ভাবলো এরা কি নেশা করেছে?সুখনীড়ে এসে মদ খাওয়া এত্তো বড় সাহস। এদের তো ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।

পরী ড্যাবড্যাব করে নিচে তাকিয়ে হৈমীকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আপু এলা এখানে কেনো? দয়াল বাবাল সাথে এরা এসেচে তো? দয়াল বাবা কোতায়?

হৈমী ব্রাশ করা বন্ধ করে নিচে পরীর মুখের দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,

— দয়াল বাবা টা আবার কে? কার কথা বলছিস?
— কেনো তোমাল তো দয়াল বাবার সাথেই বিয়ে হয়েছে।
পরীর কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো হৈমী। এই ছিলো তাঁর কপালে শেষে তাঁর জামাই হলো কিনা দয়াল বাবা,,, নিশ্চয়ই বড় চুল দেখে পরী রুদ্র কে দয়াল বাবা বানিয়ে দিয়েছে।
কপাল চাপড়ে বললো,
— দয়াল বাবা না বইন দয়াল ভাই বল দয়াল ভাই। আপুর বর কে বাবা বলতে হয় না।
পরী অবুঝ চোখ মুখে চেয়ে রইলো। হৈমী মিষ্টি হেসে বললো,
— শোন ইউটিউবে যেসব লোকদের দেখিস অমন তাঁরা দয়াল বাবা আর বাস্তবে কাল যাকে দেখেছিস ওটা দয়াল ভাই বুঝেছিস?

পরী চোখে মুখে হাসির ঝলক নিয়ে বললো,
— একটা দয়াল বাবা আলেকটা দয়াল ভাই মিলে মিলে দুটা দয়াল একটা বাবা একটা ভাই।
হৈমী একটিং করে হিহি করলো পরীও খিলখিল করে হেসে ওঠলো।
.
দাদুকে সকালের চা দেওয়ার সময়ই দাদু বলে দিয়েছে নিজে এবং বাচ্চা দের পরিপাটি করাতে। হৈমী সকাল থেকে রুদ্র কে দেখেনি তবুও মাথা ঘামালো না বাচ্চা দের নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে পড়লো সে।

সকাল সকাল বাবুর্চি রা এসে গেছে সাদমান, আবির,নিরব ব্রাশ করছে আর বাবুর্চি দের আশে পাশে ঘুরাফিরা করছে। দাদু চেয়ার টেনে রান্না হওয়ার ওখানেই বসে পড়লো। হৈমী নয়নকে অনেকবার ফোন করা সত্ত্বেও সে ফোন ধরেনি। বাধ্য হয়ে মাহেরকে ফোন করলো সে। মাহের ফোন রিসিভ করতেই হৈমী চিল্লাতে শুরু করলো। নয়ন কেনো ফোন ধরছেনা তুমি এখুনি নয়নকে নিয়ে এ বাড়ি আসো। মাহেরের গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না তবুও বহু কষ্টে সে জানালো নয়নকে পাঠিয়ে দেবে। তা শুনে হৈমী বায়না ধরলো “তোমাকেও আসতে হবে তুমি না এলে আমি কান্না কাটি করবো। বাচ্চা রা কাঁদবে আমরা কেউ খাবার খাবো না তোমার সাথে সবাই কাট্রি দিয়ে দিবো” এই সেই নানান কথা বলে ফোন রেখে দেয় হৈমী। গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মাহেরের।
.
রুদ্র সাদমান কে ফোন করে এদিককার খবর জানতে চাইলে সে বলে,
— তোমার বউ বাচ্চা দের নিয়ে আচার বানাতে ব্যাস্ত। আর আমরা তোমার বউয়ের বিয়ের ট্রিট প্রস্তুত করতে ব্যাস্ত। বাড়ি বসে বন্দুক চালানো বন্ধ করে এখানে আসলে একটু উপকার হতো টিটকারি দিয়ে কথা বলে ফোন কেটে দিলো সাদমান।

হৈমী আমের আচার বানাচ্ছে পরী খেলছে বাইরে। বাকিরা টুকটাক কাজ করছে। যারা পড়া ভক্ত তাঁরা রুমে বসে পড়াশোনা করছে। হৈমী কাজের পাশাপাশি এটা সেটা গল্প করছে এলা তাঁর গল্প শুনছে আর আচার বানানো মনোযোগ সহকারে দেখছে। আচার বানানো শেষ, ঘেমে শরীর ভিজে কাপড় চুপচুপে হয়ে গেছে। নয়ন এখনো আসেনি আবারো মাহেরকে ফোন করলো হৈমী। সিরিয়াস কান্না করে দিলো সে। তাঁর কান্না শুনে মাহের বললো,

— ডোন্ট ক্রাই হৈমী কাঁদলে কিন্তু তোমায় খুব পঁচা লাগে। তাছাড়া আজ তো একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে তাই না তুমি বরং সাজগোজ করো রেডি হয়ে নাও আমি নয়নকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

— তুমি না এলে আমাকে কে গান শোনাবে বাচ্চা রাও তো তোমার জন্য অপেক্ষা করবে। তুমি এতো সুন্দর গান গাও অথচ আমার বিয়ে উপলক্ষে একটা গানও গাইবে না? এমনিতেই নিরামিষ, রোবট লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে তুমি না এলে মজাই হবে না। তুমি এসো অনেক মজা হবে আমরা খুব আনন্দ করবো আজ প্লিজ ভাইয়া তুমি এসো। তোমরা এলে একসাথে দুপুরে খাবো নয়তো না এই বলে দিলাম। বলেই ফোন কেটে দিলো হৈমী।
.
গোল্ড কালারের গাউন পড়ে আয়নার সামনে এসে নিজেকে ড্যাব ড্যাব করে দেখে নিলো হৈমী। রুদ্রর দেওয়া গয়না পড়বে কি পড়বে না তাই ভাবছে। চুল আঁচড়ে পুরো পিঠ জুরে মেলে দিলো শুখিয়ে এলেই বাঁধবে আপাতত ছাড়া থাকুক। মুখে হালকা মেকআপ করে চোখে কাজল,ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগালো। সাজতে তাঁর বরাবরই ভীষণ ভালো লাগে তাই এ ব্যাপারে তাঁর কোন অলসতা নেই। হালকা সাজ সাজলো রুদ্রর দেওয়া গলার হাড়, চুড়ি পড়ে সাথে দুহাত ভর্তি গোল্ড রঙের ব্রাইডাল চুড়ি পড়ে নিলো সাজ শেষে আয়নায় নিজেকে দেখে বেশ গর্জিয়াছ লাগছে ভেবেই দুষ্টু হাসি হাসলো। বিছানা থেকে ওড়না টা নিয়ে নিজেকে আয়নায় তাকিয়ে দেখলো ওড়না ছাড়াই বেশ লাগছে। এই গাউনে বডিশেফটাও তেমন বোঝা যায় না। সে কি মোটা গাম্বাস মহিলা নাকি হুহ সে তো ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতো ভেবেই মুচকি হাসলো। কোনরকমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বের হলো পরীকে সাজিয়ে দেবে বলে। রুমে পরী নেই বাইরে এতো মানুষ রুদ্রর বন্ধুরা এসেছে বেশ কজন বাচ্চা রা এতো মানুষ জন দেখে বাইরে ঘুরাফিরা, খেলাধূলা করছে। পরী নিশ্চয়ই ওর সুন্দর লাল ফ্রক টা নষ্ট করে ফেলেছে ভেবেই দ্রুত পা ফেললো বাইরে। রুদ্র ফোনে কথা বলতে বলতে ভিতরের দিকে আসছিলো। রাদিফ অফিস শেষ করে একবার আসবে বলেছে রেদওয়ান শেখও আসবে। সুরভী বেগম আসবে না বলেই নয়না আসতে পারবে না শাশুড়ি বলে কথা। তাই রুদ্র রাদিফের সাথে টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা বলছিলো। হৈমীও ঝড়ের বেগে মেইন দরজা দিয়ে বের হতে নিচ্ছিলো রুদ্রের বুকের সাথে হঠাৎই ধাক্কা খেয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলো হেমী।

রুদ্র বিরক্তি চোখ, মুখে ফোন কেটে তাকালো হৈমীর দিকে। হৈমী মাথায় হাত দিয়ে চোখ পিটপিট করতে করেত কান্নার ঢং করে বললো,

— চোখে দেখেন না চোখ কি পিঠে লাগিয়ে ঘুরেন। ভাগ্যিস আমি লম্বা না নয়তো মাথায় ঠোকা খেতাম তখন যদি বাংলা সিনেমার মতো স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলতাম কি হতো?

গোলাপি রাঙা ঠোঁট জোরা বেশ দ্রুতই নড়ছে,কাজল কালো চোখ জোরার পিটপিটানিতে সে চোখে নিজের দৃষ্টি স্থির রাখতে পারছে না রুদ্র। মেয়েটা বড্ড বেশী কথা বলে এমন পরিস্থিতি তে তাঁর চুপ করে চোখে,মুখে লাজুকলতা মিশিয়ে রুদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত ছিলো। অথচ মেয়েটা ননস্টপ চিল্লিয়ে যাচ্ছে পা থেকে মাথা অবদি বেশ ভালো করেই চোখ বুলালো রুদ্র। এক ঢোক গিলে নিয়ে হাত ওঠিয়ে বললো,

— স্টপ!

হৈমী এক ঢোক গিলে পিছিয়ে গেলো। থাপ্পড়ের কথা মনে পড়তেই বেশ কয়েকবার ঢোক গিলে নিয়ে রুদ্র কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রুদ্র তাঁর হাত চেপে ধরলো। হৈমী এক ঢোক গিলে নিয়ে মিনমিনে স্বরে বললো,

— দেখুন, আজকে মারলে কিন্তু আমি আপনার সবগুলো চুল তুলে নিবো দয়াল বাবাকে চান্দু বাবা বানিয়ে দিবো একদম!
— এইসব লেইম কথাবার্তা বন্ধ না করলে মার একটাও মাটিতে পড়বে না সবকটা গালে পড়বে।
— কি আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন। চোখ বড় বড় করে মুখ হা করে বললো হৈমী।
— এখুনি রুমে যাবে সুন্দর করে মাথায় ওড়না চাপিয়ে তারপর রুম থেকে বের হবে যাও। শীতল চোখে চেয়ে নরম গলায় বললো রুদ্র।
— কেনো ওড়না তো ঠিক জায়গায়ই আছে। তাছাড়া কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। আপনি এমন বাড়াবাড়ি করছেন মনে হচ্ছে আমি মেয়ে না আপনিই মেয়ে আর এই শরীরটাও আপনার যত্তসব ঢং।

একটানে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দাঁত কটমট করে বললো,
— বেশী কথা না বলে যা বলেছি তাই করো।
— আপনি একটু বেশীই বোঝেন আদিক্ষেতা দেখাবেন না নিজের কাজে যান আর আমাকে আমার কাজে যেতে দিন। অতো ফালতু সময় আমার নাই পরীকে রেডি করাতে হবে আমার৷ অনেক কাজ আছে বলেই বাইরে যেতে পা বাড়াতেই রুদ্র পিছন থেকে একহাতে হৈমীর পেট জরিয়ে শূন্যিতে তুলে নিয়ে পা বাড়ালো হৈমীর রুমের দিকে।
হৈমী চিল্লাতে শুরু করলো,

— ছাড়ুন আমায় ছাড়ুন আমি পরীর কাছে যাবো পরীকে সাজাবো আরে ছাড়ুন না। আপনি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছেন ভালো হবে না কিন্তু।

রুমে নিয়ে হৈমীকে নামিয়ে দিয়ে দরজার সিটকেরী লাগাতে লাগাতে বললো,
— খারাপও হবে না।
হৈমী এক ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে করতে বললো,
— কি করছেন আমি বাইরে যাবো দরজা লাগালেন কেনো? বলেই দরজার দিকে যেতে নিতেই রুদ্র হৈমীকে সামনে থেকে এক হাতে কোমড় পেঁচিয়ে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। তাঁকে নিজের কোলে বসিয়ে একহাতে বেশ শক্ত করে কোমড় জরিয়ে রইলো।

হৈমী সমানে ছটফট করছে আর বলছে,
— ছাড়ুন আমায় ভালো হবে না কিন্তু উফফ কি গরম! ছাড়ুন এই পাঠার মতো শরীর দিয়ে আমাকে ধরবেন না একদম। ইশ আমার সব সাজ নষ্ট হয়ে গেলো রে! ছাড়ুন না,,,

হৈমী ছটফট করতে করতে ছাড়াতে চেষ্টা করছে। অথচ রুদ্র ঘোর লাগা চোখে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। যে ঘোর এ জীবনে কাটানো হয়তো আর সম্ভব না।
একবার যদি সে ঘোর লাগা চোখে চোখ রাখতো হৈমী তাহলে হয়তো এই ছটফট টা সে করতো না। রুদ্রর চোখের আকুলতা, ব্যাকুলতাকে ওপেক্ষা কি সে করতে পারতো? কতোটা মোহনীয় করে তুলেছে হৈমী আজ রুদ্র কে তা হৈমী নিজেও জানে না। নেশা ধরা চোখে চেয়ে আছে রুদ্র। মেয়েটা এতো ছটফট কেনো করে? একদন্ড কি চুপ করে বসা যায় না? একটু কথা কি শোনা যায় না? কোমড়ে আলতো করে চেপে ধরে নিজের খুব কাছে টেনে নিলো, হৈমী এবার কিছুটা চুপ করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো রুদ্রর দিকে। ঝাঁঝালো গলায় বললো,
— কি অসভ্যতামো ছাড়ুন বলছি আমার ব্যাথা লাগছে ছাড়ুন কেঁদে দিবো কিন্তু।

রুদ্রর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সে তাঁর মতো হৈমীর সামনে এসে পড়া চুল সরাতে ব্যাস্ত। সবগুলো চুল পিছনে মেলে দিয়ে এক হাতে আলতো করে ঘাড় চেপে ধরলো। হৈমী চিল্লিয়ে ওঠলো,

— একি সুড়সুড়ি লাগছে আমার এভাবে ধরছেন কেনো ছাড়ুন, ছাড়র,,,আর কিছু বলতে পারলো না হৈমী৷শরীরটা যেনো কারেন্টে শক খেলো এভাবে কেঁপে ওঠলো সে। চুড়ির ঝনঝন শব্দ হচ্ছে তাঁর নড়াচড়ায় রুদ্র তাঁর পুরো গলা জুরে দুঠোঁটের শীতল স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

কি হচ্ছে হৈমী বুঝে ওঠতেই পুরো শরীরে কাঁপুনি ধরে গেলো। শরীরটা যেনো অবশ হয়ে আসছে দুহাত দিয়ে রুদ্রর বুকে ধাক্কাতে শুরু করলো। সে যতোই ধাক্কা দেয় রুদ্র ততোই গভীরভাবে তাঁর পুরো গলায় ঠোঁট ছোঁয়াতে থাকে। ক্রমাগতই রুদ্র হৈমীকে তাঁর সাথে একদম মিশিয়ে নিতে লাগলো। পুরো গলা জুরে মিশাতে লাগলো তাঁর ঠোঁটের আলতো শীতল পরশ।

যে বারণে বিপরীত মানুষটা দ্বিগুন নিজের সাথে লেপ্টে নিচ্ছে সে বারণ করে কি লাভ? কিন্তু এই স্পর্শও তো সহ্য করা যায় না। কেমন কেমন অস্থিরতা এটা? কেমন যন্ত্রণা বলে এটাকে? এমন ভয়ংকর ছোঁয়া কেনো দিচ্ছে? সহ্য করতে না পেরে একহাতে রুদ্রর পিঠ আরেকহাতে রুদ্র চুলগুলো খামচে ধরলো। ঘনশ্বাসের বাড়ি পড়ছে কানে ক্রমাগত যা আরো দ্বিগুন পাগল করে দিচ্ছে রুদ্র কে। গলা ছেড়ে নিচের দিকে ঠোঁট নিতেই দরজায় টোকা পড়লো। হৈমীর চোখ দিয়ে সমানে নোনাপানি বের হচ্ছে। রুদ্র থেমে গিয়ে দরজার দিকে একবার হৈমীর দিকে একবার তাকালো। ঠোঁট তাঁর তখনো হৈমীর গলায় লাগানো আরেকবার টোকা পড়তেই রুদ্র আলতো করে কামড় বসালো হৈমীর গলার মাঝ বরাবর ঘন শ্বাসের ভীড়ে হৈমীর মৃদু আর্তনাদ স্পষ্ট শুনতে পেলো রুদ্র। গলা থেকে ঠোঁট সরিয়ে কোমড় থেকে হাত সরালো। হৈমীর সর্বস্ব শক্তি যেনো শুষে নিয়েছে রুদ্র শরীরটা কেমন নেতিয়ে পড়লো মেয়েটার। চোখের পানিতে সাজ নষ্ট হয়ে গেছে রুদ্র একটু ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে ওঠে পড়লো। দরজা খুলতে যাবে ভেবে পা বাড়াতেই পিছন ঘুরে হৈমীর দিকে তাকালো একবার। মেয়েটা হাঁপাচ্ছে খুব,দূর্বল ভাবটাও বেশ বুঝলো। প্রথম কোন পুরুষের স্পর্শ পেয়েছে সে তা তাঁর অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে হৈমীর গায়ে জরিয়ে দিয়ে দরজার দিকে এগুলো। দরজা খুলতেই নয়ন কে দেখতে পেলো।

নয়ন রুদ্র কে দেখে খানিক অবাক হলো পরোক্ষনেই বিয়ের কথা মনে হতেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো।
রুদ্র বললো,

— ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসো হৈমী আসছে।

নয়নের বেশ রাগ হলো হৈমীর রুমে ঢুকতে দিলো না রুদ্র তাঁকে। নিজের বান্ধবীর কাছে এসেছে অথচ তাকে অন্যঘরে বসতে বলা হচ্ছে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলো নয়ন৷

রুদ্র দরজাটা আবার লাগিয়ে দিলো। ধীরপায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে হৈমীর পাশে বসলো।হৈমী চোখ বন্ধ করে বিছানার চাদর খামচে ধরে বসে আছে। হাত কাঁপছে তার ঠোঁট জোরাও কাঁপছে।নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ মুখ খিচে বসে আছে সে। ভেজা চোখের পাতা জোরাও কাঁপছে। এমন অবস্থা দেখে এক ঢোক গিললো রুদ্র মৃদু আওয়াজে ডাকলো” হৈমী”

কোন সাড়া পেলো না বরং হৈমী গুটিশুটি হয়ে বসে রইলো। রুদ্র একটু এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলো।মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— নয়ন এসেছে।

চোখ খুললো হৈমী রুদ্রর থেকে বেশ সরে বসলো। কেমন যেনো একটা খারাপ লাগছে তাঁর না নিজে বুঝতে পারছে আর না কাউকে বোঝাতে পারবে। চোখ দিয়ে আবারো দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

রুদ্র খেয়াল করলো ফর্সা গলাটা পুরোই লাল হয়ে গেছে কামড়ের জায়গাটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যা সে ইচ্ছে করেই করেছে। এটার ছুঁতোয় মাথায় কাপড় দেওয়ানো যাবে প্রথম বার ভালো করে বুঝিয়েছে দ্বিতীয় বার কড়া করে বুঝিয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি এবার নিশ্চয়ই কাজ হবে। কোন রোগের কি ওষুধ তা ভালো করে জানা আছে রুদ্রর। পাগলামি ছুটিয়ে ফেলবে একদম।ভেবেই এক লম্বা শ্বাস নিলো রুদ্র।

— হৈমী? মৃদু স্বরে ডাকলো রুদ্র।

কাঁপা গলায় কাঁদো কাঁদো হয়ে হৈমী বললো,
— আপনি আমার সাথে এটা কি করলেন? আমি মরে যাচ্ছি আমাকে আপনি মেরে ফেললেন। আমার এমন লাগছে কেনো? আপনি আমার ইজ্জত নিয়ে নিলেন? আপনি খুব খারাপ, খুব অসভ্য,আপনি একটা লুইচ্চা। আমার মতো অবলা মেয়ের সাথে আপনি যা তা করলেন। বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো।

রুদ্র তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে এক হাত বাড়িয়ে হৈমীকে একটানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। কানের ঝুমকো জোরা প্রায় খুলে যাবে তাই সে নিজ হাতে ঠিক করে দিলো। বেশ গরম দুজনের শরীরই ঘেমে একাকার অবস্থা হৈমীর শরীরের ঘামের গন্ধ খুব কাছ থেকে পাচ্ছে রুদ্র যা মারাত্মক ভাবে হৈমীর দিকে টানছে তাঁকে।

প্রেম,ভালোবাসা বড় মারাত্মক জিনিস মানুষ যার প্রেমে পরে বা যাকে ভালোবাসে তার প্রতি স্বাভাবিক ভাবেই শারীরিক আকর্ষণ বোধ করে। আর এ কারণেই ভালোবাসার মানুষের সান্নিধ্য উপভোগ করার জন্য সারাক্ষণ অস্থিরতায় ভোগে তাঁরা। ভালোবাসার মানুষের একটুখানি পাশে বসা বা তাঁর হাতের একটু খানি ছোঁয়া কিংবা সামান্য ধাক্কাতেও শিহরিত হয়ে ওঠাই তখন স্বাভাবিক। রুদ্র একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সেও স্বাভাবিক ভাবে আকর্ষিত হচ্ছে হৈমীর প্রতি। কিন্তু তাঁর অনুভূতি আর হৈমীর অনুভূতি একেবারেই আলাদা। যে প্রেম তাঁর হৃদয় ছুঁয়েছে সে প্রেম হৈমীর হৃদয় ছুঁয়ে দিতে পারেনি। তাঁর প্রেমে তাঁর ভালোবাসায় বন্দিনী করতে আরো অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে বেশ বুঝলো রুদ্র। তবে সময়টা খুব বেশী দীর্ঘ হবে না। কিশোরী মনে প্রেম জাগাতে ততোটাও পরিশ্রম করা লাগবে না তাঁর।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here