#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#পর্ব_২৩
#জান্নাতুল_নাঈমা
কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে গেছে হৈমী। কেঁদে যেনো রুদ্রর বুক ভাসিয়ে সমুদ্র বানিয়ে ফেলবে আজ সে।
তাঁর না হয় বাবা,মা কেউ বেঁচে নেই তাই সে হতভাগী। কিন্তু রুদ্রর তো সব আছে তবুও কেনো সে হতভাগা হলো?
আসলে নিজের কিছু না থাকলে মানুষ নিজেকে দুঃখী ভাবে দরিদ্র ভাবে। আর ভাবে নিজের যা নেই তা অন্যের থাকা মানেই সে সুখী,ধনী। আসলে ভাবনাটা ভুল এ পৃথিবীতে কেউ সুখী নয়। বাইরে থেকে সবাইকে সুখী মনে হলেও ভিতরটা আসলে দুঃখে ভরা। সেই দুঃখ গুলো কে ঘিরেই সুখী থাকতে হয়। নিজেকে সুখী ভাবতে হয়। কেউ কাউকে সুখী করতে পারে না সুখ টা আসলে নিজের। নিজেই নিজেকে সুখী রাখতে হবে। আমার যা নেই তা ভেবে দুঃখী হওয়া যাবে না বরং ভাবতে হবে আমার সব থাকলেও তো আমি সুখী হতে নাও পারি। যেমনটা রুদ্র পারেনি।
হৈমীকে নিজের বুক থেকে ওঠিয়ে তাঁর দুগালে আলতো করে চেপে ধরলো রুদ্র। বুড়ো আঙুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
— আমি তো কাঁদার জন্য এসব বলিনি। আমি এসব বলেছি তাঁর কারন একটাই তা হলো আমাকে হ্যাপি রাখার জন্য। সারাজীবনের সঙ্গী তুমি আমার আমায় হ্যাপি রাখার দায়িত্ব শুধু তোমার। স্ত্রী হিসেবে আমার সবটা জানার অধিকার তোমার রয়েছে। তাই জানিয়েছি। কিন্তু তুমি এভাবে কাঁদছো কেনো?
— আপনি কিছু বুঝেন না। আমি কারো দুঃখ, কষ্ট সহ্য করতে পারিনা। আপনার মতো মানুষেরও দুঃখ থাকতে পারে তা কি আমি জানতাম নাকি। তাই তো কাঁদছি আমি। কান্নামিশ্রিত গলায় অভিমানী কন্ঠে জবাব দিলো হৈমী।
রুদ্র মৃদু হাসলো চোখের পানি ভালোভাবে মুছে দিতে দিতে বললো,
— কেনো আমার মতো খারাপ মানুষের কষ্ট থাকতে নেই বুঝি?
হৈমী লজ্জা পেলো মাথা নিচু করে বললো,
— না নেই। আপনাকে দুঃখী মানায় না৷ আপনাকে রাগী, গম্ভীরই মানায়।
রুদ্র তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে গাল থেকে হাত সরিয়ে বললো,
— আমি দুঃখী কে বললো তোমায়? কি ভাবছো আমার দুঃখের গল্প শুনিয়ে দয়া নিবো তোমার মতো মাথার স্ক্রু ঢিলা মেয়ের থেকে? বিয়ে করা বউ তাই পরিবারের বিষয় গুলো জানানো উচিত ছিলো।
— আপনি আমাকে আবার অপমান করছেন কিন্তু। থাকবো না আমি চলে যাবো। আপনি আসলেই একটা হৃদয়হীন দেখছেন মেয়েটা কাঁদছে কোথায় আদর করবেন তা না অপমান করছেন। বলেই ওঠে দাঁড়ালো।
রুদ্র একটানে নিজের কোলের উপর বসিয়ে এক হাতে আলতো করে ঘাড়ে আরেকহাতে কোমড় চেপে ধরে মুখোমুখি হয়ে বললো,
— এতো ছটফট করো কেনো? চুপ করে বসে থাকো।
হৈমী ঠোঁট ফুলিয়ে রুদ্রর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
— এভাবে ধরেন কেনো ছাড়ুন বসছি আমি।
— এভাবে ধরলে সমস্যা কোথায় বসে থাকো আরো কিছু বলা বাকি আছে।
— এভাবে ছুবেন না, আমার কেমন কেমন লাগে। ছাড়ুন আমি পাশে বসছি।
— উহম ছাড়া যাবে না বলেই কপালে আলতো করে কিস করলো। হৈমী চোখ বুজে ফেললো অদ্ভুত এক ভালোলাগা ছেঁয়ে গেলো তাঁর হৃদয় জুরে।
কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে দুগালে আলতো ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর নাকে তারপর থুতনিতে। হৈমীর ছটফটানি কমে এলো সে আর ওঠার চেষ্টা করছে না।দুহাতে রুদ্রর দুকাধ শক্ত করে খামছে ধরে আছে। মূহুর্তটা ফিল করছে দুজনই। রাতের আঁধারে প্রকৃতির মৃদু বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে দুজনকে। হৈমীর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। এ মূহুর্তে রুদ্রর স্পর্শ তাঁর বিরক্ত বা খারাপ লাগছে না৷ বরং হৃদয় দিয়ে অনুভব করছে সে। রুদ্রও তাঁর ভালোবাসা মাখা আদরের স্পর্শ দিচ্ছে। নিজের সাথে আরেকটু হৈমীকে চেপে নিয়ে তাঁর ঠোঁট জোরায় নিজের দু ঠোঁট মিলিয়ে দিলো। অনেকটা সময় নিয়ে গভীরভাবে চুমু খেলো।
ঠোঁট জোরা ছাড়তেই হৈমীর ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ পেলো রুদ্র। নিজের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে হৈমীর মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে হাত সরিয়ে ফেললো।এক হাতে হৈমীর কোমড় চেপে আরেক হাতে হৈমীর এক হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল দিয়ে শক্ত করে ধরে রইলো। হৈমীও তাঁর বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে ভারী ভারী শ্বাস ফেলছে। রুদ্রর বুকের ডিপডিপ আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে এবং গুনতে পারছে সে। বেশ অনেকটা সময় দুজন নিরব থেকে একে অপরের অনুভূতিগুলো অনুভব করলো।
— হৈমী,,,মৃদু স্বরে ডাকলো রুদ্র।
— হুমহ।
— আমার মা সূচনা কে আমার বউ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলো।
হৈমী ওঠতে নিতেই রুদ্র বিরক্তি স্বরে বললো,
— উমহ ওঠতে বলেছি আমি? চুপচাপ থাকো যেভাবে ছিলে শুধু শুনে যাও।
মৃদু ধমক শুনে আবারো আগের ন্যায় মাথা রেখে চোখ বুজে রইলো হৈমী। রুদ্র বলতে শুরু করলো,
— প্রত্যেক বাবা মায়েরই অধিকার আছে নিজের ছেলে,মেয়েদেরকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করানোর। তাই আমি মায়ের ভুল দেখিনি এ বিষয়ে। কিন্তু ওনি আমাকে না জানিয়ে সূচনা কে কথা দিয়ে ভুল করেছে৷ কারন বিয়েটা প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। যাকে বিয়ে করবো তাঁকে যদি ভালোই না বাসতে পারি তাহলে কেনো বিয়ে করবো? হ্যাঁ সূচনা কে আমি ভালোবাসি।
কেঁপে ওঠলো হৈমী চোখ খুলে ফেললো। তাঁর নিঃশ্বাস থেমে গেছে৷ রুদ্র বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বললো,
— কিন্তু এই ভালোবাসা টা তোমার প্রতি যেটা সেটা নয়৷ এটা বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা। ওকে আমি নিজের বোনের মতো ভাবি। ওর প্রতি আমার আলাদা কোন ফিলিংস কোন কালেই ছিলো না। আর আমি জানি সূচনারও ছিলো না কিন্তু মা যখন আমার বউ করতে চেয়েছে ওকে তখন থেকে ও আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। কিন্তু যাকে বোন হিসেবে দেখেছি তাঁকে বউ হিসেবে মানাটা খুবই বিশ্রি ব্যাপার আমার কাছে। কিন্তু মা তো আমারই আমার মতোই জেদি তাই সে কথা দিয়ে কথা ভঙ্গ করতে নারাজ। তাই ছেলের ভালোবাসা কে মূল্যায়ন করছে না৷ ছেলে কিভাবে ভালো থাকবে ছেলের কি ভালো লাগে কি খারাপ লাগে এ বিষয়ে ছোট থেকেই তেমন মাথা ঘামায়নি৷ ঘামালেও বুঝে ওঠতে পারেনি তাঁর কোনটা করা উচিত কোনটা করা উচিত নয়। এখনো বুঝে ওঠতে পারছে না। তাই তোমায় মেনে নিচ্ছে না৷ এতে আমার জায় আসে না৷ কারন আমি তোমাকে নিয়ে ও বাড়িতে থাকবো এটা কখনোই ভাবিনি। সুখনীড়ে কিছুদিন পর থেকেই কাজ ধরবো। রেদওয়ান শেখের টাকায় নয়৷ আমার নিজের টাকায় আমি আমার আর আমার বউয়ের সুখের রাজ্য তৈরী করবো৷ একপাশে থাকবে সুখনীড় অন্যপাশে থাকবে সুখরাজ্য।
— আমি একটু ওঠি মুখের দিকে তাকিয়ে কথা না শুনলে তৃপ্তি পাওয়া যায় না৷ এখানে আপনার হৃদস্পন্দন আমাকে আপনার কথায় মনোযোগ দিতে দিচ্ছে না৷ শুধু বলছে হৈমী কথা শুনিস না আমাকে অবুভব কর। খুব জ্বালাচ্ছে। মিনমিনে গলায় বললো হৈমী৷
রুদ্র হেসে ফেললো চাপা হাসি। মৃদু স্বরে বললো,
— ওকে।
হৈমী মাথা তুলে চোখ পিটপিট করে বললো,
— এবার বলুন।
— সুখনীড়ের ডানপাশে বাগান থেকে নিয়ে ওপাশ অবদি বেশ জায়গা জুরে যে জমিটুকু ছিলো পুরোটাই কেনা হয়ে গেছে। এখন শুধু সুখের রাজ্য তৈরী করা বাকি।
— আমি কিছুই জানি না দাদু তো আমাকে কিছু বলেনি।
— সারপ্রাইজ ছিলো আজ বলে দিলাম।
— আজ কেনো?
— এতো শুনে কি করবে? যতোটুকু বলছি এনাফ এটুকু মাথায় বেশী কথা চাপাতে চাইনা। আজ কোনো এটুকু বলছি সেটা নিজেই বুঝে নাও। না বুঝলে চুপ থাকো।
— আপনি আবার ধমকালেন আমাকে?
— অদ্ভুত ধমকালাম কখন। এতো ডিটেইলে বলতে পারবো না। বলেই ফোন বের করে টাইম দেখে নিয়ে বললো,
— চলো এবার ঘুমাতে হবে অনেক রাত হয়েছে। বলেই ওভাবেই হৈমীকে কোলে নিয়ে ওঠে দাঁড়ালো।
— একি কোলে নিচ্ছেন কেনো?
— শাড়ি পড়ে হাঁটতে পারো না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবে?
হৈমী কিছু বললো না। মনের ভিতর ভয় কাজ করছে খুব৷ বলা নেই কওয়া নেই হুট করে যা সব করে লোকটা । একরুমে একসাথে থাকলে যদি,,, আর ভাবতে পারছেনা সে। এক ঢোক গিলে নিয়ে আবছা রুদ্রর মুখটা দেখতে লাগলো। রুদ্র সামনের দিকে চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হৈমীর মনে যে ভয় চলছে তা কি সে বুঝতে পারছে? যদি তাঁর সাথে এক রুমে এক বিছানায় থাকে এই ভয়েই তো বুকে কম্পন ধরে যাচ্ছে হৈমীর । এই কম্পন কি কমবে নাকি আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবে রুদ্র?
.
রুমে এসে হৈমীকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে দরজার সিটকেরী লাগিয়ে দিলো রুদ্র। হৈমী চেচিয়ে উঠলো,
— একি সিটকেরী লাগাচ্ছেন কেনো?
— দরজা খুলে নবদম্পতি ঘুমানোটা অনুচিত।
হৈমীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। চটপট বলে দিলো,
— আমি আপনার সাথে ঘুমাবো না। ছেলেদের সাথে এক বিছানায় থাকা ওহ মাই গড ইম্পসিবল।
রুদ্র নিজের কাবলীটা খুলে রুমে বাঁধা রশীতে মেলে দিয়ে পিছন ঘুরে এগুতে এগুতে বললো,
— এসব কি কথাবার্তা ছেলেদের মানে। মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলবে তুমি তোমার হাজব্যান্ডের সাথে ঘুমাবে। হৈমী বসা থেকে ওঠে পড়লো রুদ্র হৈমীকে পাশ কাটিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। হৈমী আড় চোখে রুদ্রর দিকে চেয়ে আছে আর ভাবছে,
— বাপরে কি ধামড়া একটা মানুষ। এমন বডি বিল্ডার বাস্তবে আর একটা দেখিনি। কেমন নির্লজ্জ, বেহায়া একটুও লজ্জা পেলো না একটা মেয়ের সামনে কাপড় খুলতে অদ্ভুত। সাদা সেন্ডো গেঞ্জি পড়ায় বুকের দিকে কালো লোমগুলো ওকি দিচ্ছে। হৈমী বিরবির করছে আর আড় চোখে দেখছে রুদ্র কে। রুদ্র চোখ বুজেই বললো,
— হা করে চেয়ে না থেকে শুয়ে পড়ো। আমার লজ্জা একটু কমই আছে।
হকচকিয়ে তাকালো হৈমী। এক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
— আমার বেশ লজ্জা আছে সো আমি শুবো না আপনার সাথে।
— বাজে কথা বন্ধ করে চুপচাপ পাশে এসে শুয়ে পড়ো।
— শুবো না আমি আমার ভয় করে আপনি আবার কিছু করবেন না তো?
চোখ খুললো রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো,
— কি করবো?
হৈমী পিছন ঘুরে দাঁড়ালো আমতা আমতা করে বললো,
— কিছুনা,জানিনা আমি। দুহাতে শাড়ি খামচে ধরে বললো।
রুদ্র বাঁকা হেসে ওঠে বসলো ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে হৈমীর পিছন গিয়ে পিছন থেকেই পাজাকোল করে নিয়ে বিছানায় শুইয়িয়ে দিয়ে অর্ধেক শরীর হৈমীর ওপর ছেড়ে দিলো। হৈমী ধীরে চিৎকার দিতে লাগলো,
— অ্যা আমি শুবো না। আপনি আমার সাথে কিসব করবেন আমি আপনার সাথে থাকবো না৷ আমি চলে যাবো৷ ছাড়ুন আমায়।
— চুপপ! আগে উত্তর দাও আমি কি করবো তোমার সাথে। উত্তর না দিলে সত্যি কিছু ঘটে যাবে।
হৈমী মুখটা কাচুমাচু করে বললো,
— বিয়ে হলে বাসর ঘরে যা করে তাই করবেন আমি কি আপনার মতলব বুঝিনা। বেশ বুঝছি সব।
হকচকিয়ে গেলো রুদ্র তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আবারো জিগ্যেস করলো,
— বাসর ঘরে কি করে?
— আহ ন্যাকা ষষ্ঠী মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেন না। আমি সব বুঝি সব জানি আর এটাও জানি আপনি ওসবের জন্যই আমার সাথে ঘুমাতে চাইছেন৷
রুদ্র ধীরে ধীরে মুখ এগিয়ে নিয়ে হৈমীর নাকের সাথে নাক ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
— বাহ বেশ ভালোই বুঝো দেখছি। আমার আর কষ্ট করে বোঝাতে হবে না৷ তা এসব কোথা থেকে বুঝলে? বদ বুদ্ধি একটাও দেখি বাইরে রাখোনি সব মাথায় রেখেছো।
— কিহ আপনি বদ বুদ্ধির ভান্ডার। আর আমি জানলেই দোষ। নয়না আপুর বিয়ের সময়ই সব শুনে ফেলেছি আমি আর নয়ন৷ পরেরদিন আপনার দাদির ফিসফিসানিও শুনেছি।
রুদ্র হৈমীর নাক থেকে নিজের নাক সরিয়ে হৈমীর গলায় মুখ ডুবালো। আলতো ছোঁয়া দিয়ে নাক ঘষতে লাগলো।
হৈমী সমানে নড়াচড়া করতে লাগলো৷ গলার স্বর নিচু হয়ে এলো। কাঁপা গলায় বললো,
— আপনি কিন্তু ঠিক করছেন না। আমি কেঁদে দিব কিন্তু।
— হুমহ আমার সবই ভুল আর তুমি যে ঐ বদ মহিলার কথায় কান দিয়ে পাকা হয়ে গেছো তাতে ভুল নেই।
গলায় ঠোঁট রেখেই বললো রুদ্র। ঠোঁটের নড়াচড়ায় হৈমী বার বার শিউরে ওঠতে থাকলো। রুদ্রর মাথার চুল খামচে ধরে ওঠানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
— প্লিজ ওঠুন আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এমন করছেন কেনো?
— এটুকু সহ্য করতে পারছোনা আরো অনেক কিছুই সহ্য করতে হবে বলেই সরে গেলো।
হৈমী কয়েকদফা শ্বাস নিয়ে বললো,
— পানি খাবো।
রুদ্র বাছানার সাইট টেবিলে জগ আর গ্লাস দেখতে পেলো৷ এক গ্লাস পানি ভরে হৈমীর দিকে এগিয়ে দিলো। হৈমী রুদ্রর দিকে এক পলক চেয়ে পুরো পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। রুদ্র গ্লাসটা রেখে শুয়ে পড়লো।
হৈমী চুপচাপ বসে আছে। শরীর মৃদু কাঁপছে তাঁর। কেমন অসহনীয় অনুভূতি। এই লোকটা তাঁকে এমন নতুন নতুন অনুভূতি দিচ্ছে কেনো আর দিচ্ছেই যখন সহনীয় নয় কেনো কেনো এই অনুভূতি গুলো অসহনীয় করে তুলছে আমায়? ভাবছে হৈমী।
রুদ্র বললো,
— তাঁর মানে তুমি আমার কথা শুনবে না। আর বাঁধ্য করবে ধমকাতে বা তোমায় স্পর্শ করতে?
— না না না এই তো শুয়েছি এই যে দেখুন৷ চট করে শুয়ে বললো হৈমী৷
— দেখতে গেলেই লোভ লাগবে না দেখাই ভালো ঘুমিয়ে পড়ো।
লজ্জা পেলো হৈমী ওপাশ ঘুরে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রইলো। শাড়িটা এখনি এলোমেলো হয়ে গেছে সারারাতে কি হবে কে জানে ভেবেই এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুদ্র অন্যপাশ ঘুরে চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে রইলো ।
.
পরের দিন হৈমীকে সুখনীড়ে পৌঁছে দিয়ে রুদ্র চলে যায়। হৈমীর মন কেমন যেনো করে রুদ্র চলে যাওয়ায়। মন বলে আরেকটু থেকে যান না কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনা৷ ভাবে থাক আবারো তো আসবে সেই স্বান্তনা দিয়ে নিজেকে সংযত রাখে।
প্রতিটি মানুষের মনে থাকে সীমাহীন প্রেম সীমাহীন ভালোবাসা। সেই সীমাহীন প্রেম, ভালোবাসা হুট করেই একজন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য জেগে ওঠে। বিপরীত স্বভাবের মানুষের প্রেমে পড়া সহজে হয়ে ওঠেনা। তবে কখনো কখনো সহজে হয়ে যায়। কারন হিসেবে তুচ্ছ একটা বিষয়ই যথেষ্ট। হৈমীর মনেও রুদ্রর প্রতি নতুন নতুন অনুভূতির সৃষ্টি হতে থাকে।
দুদিন কেটে গেলেও যখন রুদ্র আসেনা৷ তখনি তাঁর মনের ভিতর নিত্য নতুন অনুভূতিগুলো ওকি দেয়। মনের ভিতর কখনো প্রচন্ড সুখ সুখ লাগে। আবার কখনো চিনচিনে এক ব্যাথা অনুভূত হয়৷ অজান্তেই নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেকে রোবট জামাইটা আর আসেনা কেনো? একটা ফোনও তো দেয় না? তাঁর কি বউয়ের কথা একবারো মনে পড়েনা? তাঁর কি ছটফট লাগেনা বউকে দেখার জন্য, বউকে কাছে পাবার জন্য?
পড়ায় মন বসে না। খেতে ইচ্ছে করেনা। দাদুর সামনে প্লেট ভর্তি ভাত নেয় কিন্তু গলা দিয়ে খাবার নামে না। দাদুর অগোচরে খাবার ফেলে দেয়। নয়নকে তাঁর এই অশান্তির কথা জানালে সে বলে ফোন দিয়ে কথা বল। দেখা করতে বল সামনে পরীক্ষা এখন এমন অবস্থা হলে পরীক্ষা তো জগাখিচুরি হবে। নয়নের কথা শুনে ফোন করতে গিয়েও করেনা৷ বুকটা কেমন যেনো করে ওঠে ধুকপুকানি বেড়ে যায়। ইশ কি যন্ত্রণা। এ বয়সের সদ্য প্রেম গুলো এমন যন্ত্রণা দিয়ে থাকে বুঝি?
চারদিন কেটে যায় তবুও রুদ্রর খোঁজ নেই। এবার চোখের পানি যেনো বাঁধ মানে না৷ বুকের ভিতর কেমন কেমন করে কাউকে বোঝাতে পারেনা সে। নয়ন এমন অবস্থা দেখে ইচ্ছে রকম বকলো হৈমীকে।বকা শুনে হৈমী রুদ্রর দেওয়া দ্বিতীয় চিঠিটা বের করে তেরো বার পড়লো। আর সিদ্ধান্ত নিলো ফার্স্ট মেসেজটা পাঠাবে এই চিঠির উত্তর দিয়েই। তাঁর বিশ্বাস এই উত্তর দিলে রুদ্র যেখানেই থাকুক ঠিক ছুটে আসবে তাঁর কাছে।
.
“তোমার ভালোবাসায় আমায় তুমি করে নাও গো বন্দিনী। তোমার ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় ছুঁয়ে দাও আমার হৃদয়খানি”
বিকেল তিনটা বেজে বিশ মিনিটে মেসেজ আসে রুদ্রর ফোনে। গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে ঢাকার বাইরে আছে সে। মেসেজ চেক করতেই হৈমীর মেসেজটা পায়৷ সাথে সাথে হৈমীকে কল করে। রুদ্রর ফোন পেয়ে কেঁদে ফেলে হৈমী৷ নয়ন তা দেখে বলে,
— ওরে আমার লায়লী রে ঢং বাদ দিয়ে ফোন ধর। কেটে গেলে আবার বুকে ব্যাথা পাবি।
হৈমী চোখের পানি মুছে রিসিভ করতেই রুদ্র গম্ভীর গলায় বলে,
— কদিন ধরে প্রাইভেট যাচ্ছো না কেনো? সমস্যা কি? সামনে পরীক্ষা সেই খেয়াল আছে? রেজাল্ট খারাপ হলে মাথায় একটা বাড়ি দিবো বেশী না। কাল সকালে প্রাইভেট যাবে নয়টার দিকে আমি নিতে যাবো রাখছি।
হৈমীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজের মতো কয়েকটা ধমক দিয়ে ফোন কেটে দিলো রুদ্র।
.
প্রাইভেট শেষে হৈমী বের হতেই দেখতে পায় সাদমান আর আবির কে। সাদমান এগিয়ে এসে বলে,
— কি গো পিচ্চি রা কেমন আছো? এই যে পিচ্চি ভাবি এতোদিন প্রাইভেট আসলে না কেনো? তোমার বান্ধবী তো ঝগরা করতে করতে আমার বুক জ্বালিয়ে ফেলেছে।
নয়ন সাপের মতো ফুঁস করে ওঠলো।
— দেখুন বাড়াবাড়ি করবেন না।
হৈমী খিলখিল করে হেসে ওঠলো আর বললো,
— ভালো ভাইয়া আমার বান্ধবী কিন্তু মোটেই ঝগরাটে না। এটা যদি আমার বেলায় বলতেন মেনে নিতাম। কিন্তু আমার যেনো কেমন সন্দেহ লাগছে আপনি আবার আমার বান্ধবীর সাথে লাইনটাইন মারতে চান না তো?
সাদমান মৃদু হেসে মাথা চুলকাতে লাগলো৷ নয়ন হৈমীর হাতে চিমটি কেটে বললো,
— শয়তানি, রাক্ষসী পাঁচ দিন ধরে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছোস এখন জামাইরে ওয়েটিং রাইখা বকবক করতে লজ্জা করে না।
— ঐ তুই আমাকে চিমটি দিলি ক্যান। ভালো ভাইয়ার মতো ছেলে কি তুই দুইটা পাবি। আর তুই তো বলিসনি ভালো ভাইয়া এখানে আসে রোজ তাহলে তো আমি ভালো ভাইয়ার থেকেই ওনার খোঁজ নিতে পারতাম যেচে মেসেজ দিয়ে ধমক শুনতাম না অপমানিতও হতাম না।
সাদমান হৈমীর কথা শুনে মাথা উঁচু করে শার্টের কলার পিছন দিক দিয়ে একটা ভাব নিয়ে দাঁড়ালো।কারন হৈমী তাঁর প্রশংসা করেছে। নয়ন মুখ ভেঙচি দিলো। আবির এসে বললো,
— রুদ্র কিন্তু রেগে যাচ্ছে তারাতাড়ি গাড়িতে গিয়ে বসো।
হৈমী চুপসে গেলো গাড়ির দিকে চেয়ে আবার নয়নের দিকে চেয়ে বললো,
— চল। কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেবো আজকে ওনাকে।
— তুই যা আমি রিকশা নিয়ে বাড়ি যাই। তোদের মাঝে আমি গিয়ে কি করবো হুদাই যা তই বলেই নয়ন পাশ কাটিয়ে হাঁটা ধরলো। পিছন পিছন সাদমানও গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো,
— পিচ্চি ভাবি টাটা।
হৈমী চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে বসে তীক্ষ্ণ চোখে একবার রুদ্র কে দেখে নিলো। রুদ্র একবারো তাকালো না হৈমীর দিকে। সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে সিট বেল্ট লাগাতে বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
গাড়ি থামালো বেশ বড়সড় রেষ্টুরেন্টের সামনে। হৈমীকে ইশারা করলো নামতে। হৈমী ভ্রু কুঁচকে গাড়ি থেকে নামলো। রুদ্র গাড়ি লক করে নেমে হৈমীর হাত ধরে রেষ্টুরেন্টের ভিতরে চলে গেলো।
এই দৃশ্য টা দূর থেকে দেখতে পেলো সূচনা। সে বান্ধবীদের সাথে একটু শপিংয়ে যাচ্ছিলো। এক রিকশায় তিন বান্ধবী বসেছে। রেষ্টুরেন্টের সামনে আসতেই চোখ যায় রেষ্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকতে থাকা রুদ্র আর হৈমীর দিকে।
চলবে।