ভালোবাসায়_বন্দিনী #পর্ব_২৫

0
2398

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#পর্ব_২৫
#জান্নাতুল_নাঈমা

হৈমীকে রুমে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি থেকে হৈমীর ব্যাগটা দিয়ে রুদ্র চলে গেছে। ভেজা অবস্থায় সে আর দেরী করেনি।

বাথরুমে দাঁড়িয়ে বুকের বা পাশে হাত চেপে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে হৈমী৷ আর বলছে,

— ভাগ্যিস দাদু রুমে ছিলো তাই দেখতে পাইনি৷ লোকটার মাথা কি খারাপ নাকি কে জানে? এতো লাজহীন মানুষ দুনিয়াতে হয় উফফ!
.
সাতদিন যাবৎ রুদ্র নিজ বাড়ি ফেরেনা। দুদিন আগে সূচনা রেষ্টুরেন্টের সামনে হৈমীর সাথে রুদ্র কে দেখেছিলো। ভেবেছিলো রাতে অন্তত বাড়ি ফিরবে কিন্তু না ফিরেনি। বিছনায় বসে হাঁটু তে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। সুরভী বেগম খাবার নিয়ে এসে এতো জোর করছে তবুও খাচ্ছে না। তা দেখে রুদ্রর দাদি বলেন,

— এই ছ্যাড়ি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্দোস শরম করেনা?
যে কাম দিছিলাম সেইটা তো পারোস নাই যা পারছোস তাই দিয়া মাথা খাটা।

সুরভী বেগম ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলেন,

— কিসের কাজ দিয়েছেন আপনি ওকে। সূচনা কি কাজ দিয়েছে মা তোকে?

সূচনা মুখ গুঁজে কেঁদেই চলেছে। কিছু বলছে না। দাদি বললো,

— মা হয়ে ছেলে,মেয়েদের সব বিষয় শুনতে নেই। তুমি যাও ঘরের কাজ করো গিয়া বউটা একা একা সব কাজ করতাছে যাও যাও। আমি বুঝিয়ে খাওয়াই ওরে।

সুরভী বেগম কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলেন। একদিকে ছেলের সাথে দূরত্ব আরেকদিকে সূচনার বুক ভাঙা যন্ত্রণা কোনটাই সহ্য করতে পারছে না সে। তাঁর মাথা কাজ করছে না। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। দাদি ওকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে নিলেন সুরভী বেগম গিয়েছেন কিনা। তারপর সূচনার সামনে বেশ আয়েশ করে বসলেন। পান চিবাতে চিবাতে বললেন,

— কান্দিস না। গুরুজনরা যা বলে তাই শুনতে হয়। খাবারটা খেয়ে নে দেখি। তুই খা আর আমি ভাবি কি করা যায়।

সূচনা তবুও মাথা ওঠালো না। কেঁদেই চলেছে। দাদি এবার কর্কশ গলায় বললো,

— বুঝছি রুদ্র কে তোর চাইনা। যদি চাইতি তাইলে খেয়ে দেয়ে নিজেকে ঠিক রাইখা মাথা খাটাইয়া রুদ্র কে নিজের করতি৷

সূচনা চোখ তুলে তাকালো। বিষাদে ভরা মুখশ্রী দেখে দাদির খুব মায়া হলো তাই গলা নরম করে বললো,

— আহাগো চেহেরার কি হাল করছোস। এমন ভাবে তো রুদ্রর মন আরো তোর ওপর পড়বো না। তারাতারি খেয়ে নে তারপর আমি তোরে যা বলি তাই কর। একদম পাকা কথা রুদ্র কে কিছু করতে হবেনা যা করবি ঐ মেয়েকে বুঝলি।

সূচনা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। দাদি মিটিমিটি হেসে বললো,

— ঐরকম আশ্রিতা মেয়ে মানুষ আমার বাড়ির বউ হবো সেইটা আমি মানিনা। তুই হলি আমার আত্নীয়র মেয়ে তা ছাড়া তোর বাপ জীবিত আছে। বউ মার জন্য এইখানে থাকোস। তা না হলে বাপের কাছেই থাকতি। তোরে নাতবউ বানাইতে আমার অসুবিধা নাই কিন্তু ঐ চাল,চূলাহীন মেয়েকে আমি নাতবউ বানাতে রাজিনা। সুন্দর মুখ দেখাইয়া রুদ্র রে পাগল করছে। তোর আর আমার দায়িত্ব যে ভাবেই হোক রুদ্রর জীবন থেকে ঐ এক রত্তি মেয়ারে বাইর করে দেওয়া।
.
দাদির কথায় খেয়ে নিলো সূচনা খাওয়া শেষে দাদি বললো,

— শোন আজ বিকালে তুই সুখনীড়ে যাবি। তারপর কি করতে হবে সেটা কি শিখাই দিতে হবো নাকি টের পাইছোস?

সূচনা কিছু বললো না শুধু গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
.
বেকেলের দিকে মাহের আসে সুখনীড়ে হৈমী ছাদে বসে পরীকে কোলে বসিয়ে খাওয়িয়ে দিচ্ছে। মাহের ছাদে গিয়ে হৈমীর পাশের চেয়ারে বসলো। আজ আর গান শেখানো হবে না তাঁর। পরীর জ্বর হয়েছে হৈমী বুঝিয়ে, শুনিয়ে ওটা সেটা দেখিয়ে খাওয়াচ্ছে পরীকে। মাহের আসাতে বেশ সুবিধা হলো। কারন মাহের পরীকে কোলে নিয়ে ওটা,সেটা বলছে হৈমী একটু স্বস্তি তে খাওয়াতে পারছে এই সুযোগে। ছাদের অন্যপাশে আরো কয়েকজন মেয়েরা খেলছে কেউ কেউ গল্প করছে। খাওয়ানো শেষে পানি খাওয়িয়ে হৈমী নিচে গিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে আবার ওপরে ওঠে এলো। মাহেরের পাশে গিয়ে বসলো। পরী মাহেরের কোলেই ঘুমিয়ে গেছে হৈমী বললো,

— বাহ মনের মানুষের বুকে কি আরামসে ঘুমাচ্ছে হিহিহি। আসো নিচে যাই ওকে শুইয়িয়ে দিয়ে আমরা গান প্র্যাকটিস করি।

মাহের মৃদু হেসে ওঠে দাঁড়ালো। বললো,

— তোমার আসতে হবে না আমি শুইয়িয়ে দিয়ে আসছি।
.
পরীকে শুইয়িয়ে দিয়ে রুম ছেড়ে বের হতেই মেইন দরজার দিকে চোখ পড়লো মাহেরের। সূচনা দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে, এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। বেশ অবাক হলো মাহের সূচনা সুখনীড়ে কেনো? নয়নার কাছে যতোদুর শুনেছে সূচনা হৈমীকে সহ্য করতে পারছে না। রুদ্র কে হারিয়ে প্রচুর ডিপ্রেশনে ভুগছে। চেহেরা দেখেও স্বাভাবিক লাগছে না। চোখ, মুখ ফোলা ফোলা। এখানে কেনো এসেছে? হৈমীর সাথে দেখা করতে এসেছে কি কিন্তু কেনো? মনের ভিতর হাজারটা প্রশ্ন চেপে রেখে এগিয়ে গেলো মাহের।

— কেমন আছেন আপনি? ভিতরে আসুন, বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?

মাহেরকে দেখে বেশ চমকালো সূচনা। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে জোর পূর্বক ঠোঁটের কোনে হাসি একে বললো,

— ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন? এটাতো হৈমীর বাড়ি আই মিন আশ্রম। আমি ঠিক জায়গায় এসেছি তো?

অথচ মনে মনে ভাবলো,”মাহের এখানে কেনো? এ বাড়িতে বুড়ো একজন ছাড়া তো আর কোন গার্ডিয়ান নেই। যুবতী মেয়ে বলতে হৈমীই এখানে একটা পরপুরুষ কি করে এলাউ হয়? মেয়েটার কি সত্যি চরিএে দোষ আছে? দাদি কি সত্যি বলেছে “?

আশ্রম কথাটা শুনে মাহেরের ঠিক ভালো লাগলো না। তবুও মুখে হাসি রেখে বললো,

— ভিতরে আসুন বাইরে থেকেই কথা বলবেন।

সূচনা মৃদু হেসে ভিতরে গিয়ে বসলো। মাহের বললো,

— আমি হৈমীকে ডেকে নিয়ে আসি আপনি বোধহয় ওর সাথেই দেখা করতে এসেছেন?

— আপনি কি এখানেই থাকেন? কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করলো সূচনা।

— না আমি বাচ্চা দের গান শেখাই ফ্রাইডেতে। বলেই ছাদের দিকে হাঁটা ধরলো মাহের।

সূচনার বিরক্তি চোখে চেয়ে রইলো ছাদের সিঁড়ির দিকে।
.
দাদু সোফায় অচেনা একজন মেয়েকে বসে থাকতে দেখে চশমা পড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ইদানীং শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তাঁর বয়স হচ্ছে হাঁটা, চলা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে গত দুমাস ধরে লাঠি ভর করে চলা ফেরা করতে হচ্ছে তাঁকে। লাঠির ঠকঠক শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালো সূচনা। দাদুকে দেখেই ওঠে দাঁড়ালো। দাদু জিগ্যেস করলো,

— তুমি কে তোমায় তো চিনতে পারলাম না৷ হৈমীর কোন বান্ধবী?

— আমি সুচনা নয়নের বোন নয়নার ননদ হই।

— ওও আচ্ছা তুমি তাহলে রুদ্রর বোন? বলেই সোফায় বসলো দাদু।

সূচনার প্রচন্ড রাগ হলো তবুও শান্ত ভঙ্গিতে বললো,

— না খালাতো বোন।

— ঐ একি হলো। হৈমীর সাথে দেখা করতে এসেছো বুঝি এ প্রথম আলাপ? রুদ্র পাঠিয়েছে?

সূচনা কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই হৈমী ঢাশঢাশ শব্দ করো সিড়ি দিয়ে নেমে এলো। সূচনা কে দেখেই খুশিতে চিল্লিয়ে এসে জরিয়ে ধরলো।

— সূচনা আপু তুমি এসেছো? ওয়াও আই এম সো হ্যাপি কতোদিন পর তোমাকে দেখলাম। তুমি নিজে এখানে এসেছো আমি তো বিলিভই করতে পারছিনা আপু। আমি কত্তো লাকি গো আপু বলেই সূচনার গালে টোপ করে চুমু খেলো।

সূচনা বিরক্তির চরম পার্যায়ে পৌঁছে গেলো। আগে এসব বিহেভে বিরক্ত না লাগলেও এখন এসব সিরিয়াস বিরক্ত আর ন্যাকামো লাগে তাঁর কাছে। মনে হয় এসব ন্যাকামো দিয়েই রুদ্র কে সে বশ করেছে। সূচনার এই বিরক্তি মাহেরের চোখে ঠিক ধরা পড়লো। তাই মাহের বললো,

— হৈমী ছাড়ো ওনাকে। বাসায় মেহমান এসেছে আপ্যায়ন করো।

হৈমী সূচনাকে ছেড়ে মাহেরের দিকে চেয়ে বললো,

— তুমি যে কি বলো না ভাইয়া আপু তো আমার নিজের বড় বোনের মতো। মেহমান না নিজের লোকই। জানো আপু আমায় কতো ভালোবাসে। দেখোনা আমাকে দেখতে চলে এসেছে। বলেই সূচনার পাশে বসে সূচনার হাত চেপে ধরে বলতে লাগলো,

— আজকে কিন্তু তুমি এখানে আমাদের সাথে থাকবে। আমরা খুব মজা করবো। আমার নিজের হাতে বানানো আচাড় খাওয়াবো তোমাকে। কাল সকালে খিচুড়ি রেঁধেও খাওয়াবো দাঁড়াও আমি নয়নকে ফোন করছি। না না মাহের ভাইয়া তুমি নয়নকে এখুনি নিয়ে আসো। আজকে তো আমি হেব্বি খুশি বলেই দুহাত উঁচিয়ে আরাম করে বসলো সোফায়।

সূচনার ইচ্ছে হচ্ছে এক থাপ্পড়ে সব ন্যাকামো বের করে দিতে। এসব ভালোমানুষি দেখিয়ে অনেক বড় ক্ষতি করেও সাধ মেটেনি আবার এসেছে ভালোমানুষি, বাচ্চামি ন্যাকামি দেখাতে। ভেবেই গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

দাদু বললো, — তোমরা তাহলে কথা বলো আমি হাটাহাটি করে আসি।

মাহের বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো কি করবে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তখনি সূচনা বলে ওঠলো,

— আমি হৈমীর সাথে একাকী কথা বলতে চাই। হৈমী আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে। মাহেরের দিকে চেয়ে বললো,– আপনি কি একটু যাবেন প্লিজ।

মাহের থতমত খেয়ে গেলো। জোর পূর্বক হেসে বললো,

— শিওর! হৈমী আজ আসি সামনে সপ্তাহে আসবো আবার।

হৈমী কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলো মাহের। হৈমী সূচনার দিকে চেয়ে বললো,

— আপু নয়না আপু কেমন আছে?

— ভালো। তোমার রুম কোন দিকে? সিরিয়াস চোখ, মুখে জিগ্যেস করলো সূচনা।

হৈমী হাসিমুখেই নিজের রুমে নিয়ে গেলো। রুমে ঢুকে বিছানায় বসতে বললো কিন্তু সূচনা বসলো না। সে দরজার সিটকেরী লাগিয়ে দিলো। হৈমী ভ্রু কুঁচকালো সূচনা হৈমীর দিকে ফিরে বিছানায় গিয়ে বসতে বসতে বললো,

— তুমি কি ভাবছো আমি তোমার সাথে খোশগল্প করার জন্য এ বাড়িতে এসেছি?

অবাক চোখে তাকালো হৈমী।সূচনা মৃদু হেসে বললো,

— দাঁড়িয়ে আছো কেনো বসো।

হৈমী চুপচাপ পাশে বসলো মনের ভিতর খুব ভয় কাজ করছে এবার হৈমীর। সূচনা সোজাসাপটা বললো,

— রুদ্রর জীবন থেকে সরে যাও।

— মানে কি বলছো আপু এসব (কাঁপা গলায়) বললো হৈমী।

— কেনো শুনতে পাচ্ছো না? তুমি আমাদের মাঝখানে এসে ঠিক করোনি৷ এটুকুন মেয়ে মাথায় এতো কুবুদ্ধি আছে ভাবতেও পারিনি। আমি রুদ্র কে ভালোবাসি তুমি না এলে এতোদিনে রুদ্র আমাকে বিয়ে করে ফেলতো।

বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো হৈমী হাত,পা কাঁপছে তার সে জানতো সূচনা রুদ্রর প্রতি দূর্বল রুদ্রর মা তাঁদের বিয়ে ঠিক করেছিলো তবুও সূচনার এভাবে বলাতে বুকের ভিতর কেমন যেনো করছে শরীরটা অবশ অবশ লাগছে। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিয়ে কাঁপা গলায় বললো,

— আপু কি বলছো এসব বিয়ে হয়ে গেছে আমাদের।

সূচনাও দাঁড়িয়ে পড়লো। ত্যাজি গলায় বললো,

— এটা কোন বিয়েই নয়৷ পরিবার ছাড়া বিয়েকে বিয়েই বলে না। তাছাড়া হুট করে তুমি উড়ে এসে জুরে বসবে তা তো হতে পারে না।

হৈমী স্তব্ধ হয়ে গেলো সূচনার বিহেভিয়ার দেখে৷ এতোদিনের সূচনা আর এই সূচনার মাঝে যেনো কোন মিলই পাচ্ছে না৷ মানুষ কেমন গিরগিটির মতো রঙ পাল্টায় তা এ মূহুর্তে সূচনাকে দেখে বেশ বুঝতে পারছে হৈমী।

— আপু এসব আমাকে বলো না। তুমি ওনার সাথে কথা বলো এসব নিয়ে ওনি যা বলবে তাই হবে।

তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠলো সূচনা। চিৎকার করে বললো,

— ওনি কি বলবে বশ তো ভালোই করেছো। আর বলছো ওনি যা বলবে তাই৷ ওনি কি বলবে? কি বলবে ওনি ঘর ভেঙেছো তুমি আমার। ভালোই ভালোই বলছি রুদ্রর জীবন থেকে সরে যাও নয়তো তোমায় পস্তাতে হবে৷ তোমার জীবন নরক করে দেবো আমি। রুদ্র তোমাকে ভালোবাসে না রুদ্র আমাকে ভালোবাসে। তোমার প্রতি ওর যা আছে তা মোহ কিছুদিন গেলেই সেই মোহ কেটে যাবে।

হৈমীর বুকটা ধক করে ওঠলো। চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে। ইচ্ছে হচ্ছে সূচনাকে এক ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতে কিন্তু সে বেয়াদবি করবে না। ইচ্ছে টাকে মাটি চাপা দিয়ে এক ঢোক গিলে বললো,

— হুম ভালো যখন বাসে তখন আমাকে কেনো সরে যেতে বলছো আপু তোমরা দুজন ঠিক থাকলে আমি কে তোমাদের মাঝে আসার?

সূচনা বুঝলো এই মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলে কাজ হবে না৷ তাই নিজের ফোন টা বের করলো। সেদিন রাতে রুদ্রর কি হয়েছিলো জানে না সে। সব প্ল্যান নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর রুদ্রকে কোনভাবেই নিজের দিকে নিজের কাছে আনতে পারেনি সে৷ একটা ছেলে উত্তেজক ওষুধ খেয়ে কি করে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় যে একটা মেয়ের সংস্পর্শ পেয়েও ঘুম ভাঙে না। রুদ্র কে কোনভাবেই নিজের কাছে আনতে পারেনি সে। তাই বলে সে পিছুপা হয়নি রুদ্রর বুকে মাথা রেখে দুহাতে জরিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়েছে তাঁরই কিছু মূহুর্ত ভিডিওতে আছে যা হৈমীর সামনে তুলে ধরলো সূচনা।

ভিডিও টা দেখে দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো হৈমীর। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে। যে মানুষটার নামে তিন কবুল বলেছে সে মানুষ টার বুকে অন্যকারো মাথা দেখতে পেলে বুকের ভিতর কতোটা যন্ত্রণা হয় যারা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে তাঁরাই জানে। হঠাৎই হৈমীর চোখের সামনে ভেসে এলো তাঁকে দেওয়া রুদ্রর কিছু স্পর্শ। রুদ্রর মুখটা ভেসে এলো চোখের সামনে মনে পড়ে গেলো সেই রাতের কথোপকথন যেই রাতে রুদ্র তাঁর অতীতের সবটা বলেছিলো তাঁকে। সেই সাথে এ কথাও মনে পড়লো ‘হ্যা আমি সূচনা কে ভালোবাসি বোন হিসেবে’ খোলা চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো হৈমী। তা দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেলো সূচনা। বললো,

— এবার বুঝলে তো কেনো বলছি সরে যেতে। তুমি রুদ্রর জীবনে থাকলে শুধু কষ্টই পাবে৷ ও বাড়িতে কিন্তু রুদ্র তোমায় নিয়ে যায়নি৷ ও বাড়িতে আমার জায়গায় রুদ্র তোমাকে কখনোই নিয়ে যাবে না। যতোদিন মোহ থাকবে ততোদিনই তোমার কাছে আসবে মোহ কেটে গেলে তোমাকেও ঝেড়ে ফেলবে।

চোখ খুললো হৈমী। মনে পড়ে গেলো রুদ্রর বলা সেই কথাটা। রুদ্র বলেছিলো সে তাঁকে শেখ বাড়ি নিয়ে যেতে চায় না৷ সুখনীড়েই তৈরী করতে চায় সুখের রাজ্য। কিন্তু সূচনা তাঁকে এমন বিষাক্ত কথা কেনো বলছে কেনো তাঁর কানদুটো বিষিয়ে তুলছে না সে শুনবে না। সূচনার কোন কথাই সে শুনবে না৷ ভেবেই কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু পারলো না ভেজা কন্ঠে বললো,

— আপু ওনাকে নিয়ে এসব বলো না। ওনি জানলে কষ্ট পাবে।

সূচনা যেনো দ্বিগুণ ক্ষেপে গেলো আর বললো,

— একদম ন্যাকামো করবে না। কি বোঝাতে চাচ্ছো রুদ্র কে তুমি ভালোবাসো? কয়েকমাসের ব্যবধানেই ভালোবাসা হয়ে গেছে তোমাদের ? আর এতোগুলো বছর ধরে আমি ওর জন্য এতোকিছু করেও ওকে ভালোবাসিনা?কিসে ওর কষ্ট কিছু বুঝিনা? তুমি কি ভিডিও টাতে দেখতে পারছো না আমরা দুজন দুজনকে নিয়ে কতোটা হ্যাপি? ওর বুকে শুধু আমার অধিকার?

হৈমী আর চুপ থাকতে পারলো না।

— না আমি দেখিনি আপু কিছু দেখিনি। ওনার বিষয়ে অন্য কারো থেকে কিছু জানার বা দেখার নেই আমার৷ আমার যা জানার যা বোঝার ওনি নিজে থেকেই জানিয়ে,বুঝিয়ে দিয়েছে এর বাইরে কিছু শুনতে বা দেখতে চাইনা। সরাও এই ভিডিও আমার সামনে থেকে এই ভিডিও টা যদি সত্যিও হয়ে থাকে তবুও আমার জায় আসেনা। কারন এখানে স্পষ্ট দেখতে পারছি ওনি ঘুমিয়ে আছে হতে পারে তুমি সুযোগ নিয়েছো এও হতে পারে সুযোগ নাওনি তোমাদের সত্যি এমন গভীর কোন সম্পর্ক আছে। কিন্তু এটা যতোক্ষন না ওনি নিজের মুখে আমায় বলবে ততোক্ষণ আমি বিশ্বাস করবো না।

— তোমার মতো ছ্যাঁচড়া বাজে চরিএের মেয়ে তো আমি দুটো দেখিনি।

চরিএ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় রেগে গেলো হৈমী। কান্নামিশ্রিত গলায় বললো,

— হ্যাঁ আমাকে তুমি ছ্যাচড়া বলতেই পারো,কিন্তু চরিএহীন নই। তুমি কেমন মেয়ে মানুষ? কেমন ভালোবাসো তুমি ওনাকে যে এভাবে ওনার চরিএে দাগ লাগাতে তোমার বুক কাঁপলো না? নিজের ভালোবাসা পাওনি বলে ছোট বোনের মতো একটা মেয়েকে চরিএহীন বলছো?
এসব কেনো করছো আপু যদি সত্যি ওনি তোমাকে ভালোবাসতো তাহলে তোমার কি এভাবে এসে আমাকে এসব বলার প্রয়োজন পড়তো? তোমাদের ব্যাক্তিগত বিষয় এভাবে আমার সামনে তুলে ধরতে? তোমরা বেডরুমে কি করেছো না করছো সেসব আমায় কেনো দেখাচ্ছো? এসব দেখে আমি সরে যাবো? কোথায় যাবো আমিতো ও বাড়িতে নেই আমি ওনার জীবনেও যাইনি বরং ওনিই এসেছে আমার জীবনে।

সূচনা ধারালো চোখে চেয়ে দুহাত শক্ত মুঠ করে দাঁড়িয়ে রইলো। হৈমী খানিকসময় থেমে আবারো বলতে লাগলো।

— তুমি যদি ওনাকে ভালোই বাসো ওনাকে কেনো অসম্মান করলে আপু? ভালোবাসার মানুষ মানে তো নিজের মানুষ আপু তুমি তোমার মানুষের সাথে কতোটা সময় কাটাবে কিভাবে কাটাবে এটা বাইরের মানুষ কে কেনো দেখাতে যাবে? এটা তো কোন নাটক, সিনেমা না বাস্তব জীবনে এমন ঘৃনিত কাজ কেনো করলে আপু?
যে মানুষ নিজের জিনিসের সম্মানই করতে জানে না সে মানুষের কোন অধিকার নেই কিছু পাওয়ার। তুমি ওনাকে কেমন ভালোবাসো আমি জানিনা । আমি ওনাকে কতোটা ভালোবাসি তাও জানিনা। শুধু জানি ওনাকে আমি সম্মান করি এবং করতে চাই। অন্তত এভাবে ওনাকে কারো কাছে ছোট করতে পারবোনা। কোনদিন না।

— বাহ মায়ের থেকে দেখা যায় মাসির দরদ বেশী? তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো সূচনা।

— নাহ মায়ের দরদ সর্বোচ্চ তারপর বাবার তারপর যদি ওনার জন্য কারো দরদ সর্বোচ্চ হওয়ার থাকে তাহলে স্ত্রী হিসেবে আমারই হওয়ার কথা। ওনার নামে তিন কবুল বলেছি আমি। আর বললে না? পরিবার ছাড়া বিয়ে হয়না এ বিয়েতে কার মত নেই ? ওনার মায়ের তাইতো কিন্তু ওনার বাবা,বড় ভাইয়ের তো মত ছিলো তাহলে এটা কি করে বিয়ে হলো না?
তোমার কাছে বিয়ে না হতে পারে আমাদের কাছে এটাই বিয়ে৷ একটা কথা বলি আপু যাকে ভালোবাসো তাঁকে রেসপেক্ট করতে শেখো। তুমি যা করছো এতে ওনার অপমান করা হচ্ছে। ওনি যদি আমাকে ঠকায় তাহলে ক্ষতি আমার হবে তা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আর আমি যদি কখনো বুঝি ওনি তোমাকে বোন ব্যাতীত অন্য চোখে দেখে তাহলে ওনার সাথে কথা বলেই ওনার থেকে সরে যাবো। এবার তুমি প্লিজ আসতে পারো আপু।

কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই ঠাশ করে গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো সূচনা। হৈমী গিয়ে ছিটকে পড়লো বিছানার এক কোনায়, মাথাটা ঠেকলো কোনার কাঠে। ব্যাথায় কুকিয়ে ওঠলো সে। কপালে হাত দিয়ে ওঠে দাঁড়ালো তরল স্পর্শ পেতেই হাত সমানে আনতেই দেখলো রক্ত। রক্ত দেখে হুহু করে কেঁদে ওঠলো হৈমী। সূচনার দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই সূচনা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হৈমীর দুকাধে চেপে ধরে বললো,

— এই মেয়ে কাঁদছিস কেনো? তুই আমার ঘর ভাঙলি আর আমি তোকে একটু চিমটি দিতেই কেঁদে গা ভাসাচ্ছিস।

হৈমী এক ঝটকায় সূচনার হাত ছাড়িয়ে দিলো।

— তুমি এভাবে মানুষ কে কি করে আঘাত করতে পারো। একটুও মায়া হয় না তোমার ? এই মন নিয়ে তুমি ওনাকে ভালোবাসো বলছো ছিঃ তুমি ওনাকে ভালোই বাসোনা ভালোবাসার মতো কোন মনই নেই তোমার। তুমি কি ভেবেছো তুমি এসে আমাকে যা বলবে তা বিশ্বাস করে ওনার বলা প্রতিটা কথা অবিশ্বাস করবো আমি। আমি যেমনই হই না কেনো। বুদ্ধি হীন, ছ্যাচড়া তবুও আমি বেঈমান না। কারো সাথে বেঈমানী করিনা আমি। স্ত্রী হিসেবে আমার কর্তব্য সর্বপ্রথম নিজের স্বামীকে বিশ্বাস করা। নিজের স্বামীর কথায় বেশী গুরুত্ব দেওয়া। এই সমান্য একটা ভিডিওতে কিছু এসে জায় না। আমি সিনেমার নায়িকা না এটা বাস্তব জীবন। তোমাদের মধ্যে সত্যি কিছু থাকলে সকলের সামনে ওনার সামনে সৎ সাহস দেখিয়ে বলবে। এভাবে চুপিচুপি এসে এসব ভিডিও দেখানোর কোন প্রয়োজন নেই লাভ নেই।

সূচনা রাগে হৈমী কে এক ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দরজার সিটকেরী খুলে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। হৈমী কপালে হাত চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।
.
বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে হৈমী। নিজে নিজেই ব্যান্ডেজ করে রুমে মুখ গুঁজে বসে আছে। দাদুকে বলে দিয়েছে লাফালাফি করতে গিয়ে পড়ে গেছিলো। দাদু অল্প বকে দিয়েছে সে চুপচাপ শুনে রুমে বসে আছে। কাজের মেয়েটা কে বলে দিয়েছিলো রাতের খাবার রুমে দিতে সে তাই করেছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছেনা।
মনটা ভালো নেই রুদ্রর ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তাঁর “এরপর এ বাড়ি আসুক ভিতরে ঢুকতেই দেবো না৷ অপমান করে বের করে দিবো হুহ।জীবনটা আমার তেজপাতা করে দিছে থাপ্পড় আর থাপ্পড় ”
ভেবেই বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে রুম ছেড়ে বের হলো।বসার রুমে যেতে না যেতেই কলিং বেল এর আওয়াজ পেলো।

ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকালো ” নটা বাজে এসময় কে আসবে? দাদুকে ডাকবো নাকি নিজে গিয়েই জিগ্যেস করবো? নয়ন এসেছে কি আমার ব্যাথা পাওয়ার কথা শুনে আমিতো বললাম আসতে হবে না তবুও এলো নিশ্চয়ই মাহের ভাইয়াকে সাথে নিয়ে এসেছে এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না। বিরবির করতে করতে গিয়ে দরজা খুললো।

রুদ্র কে দেখে চমকে গেলো ভীষণ ফিসফিসিয়ে বললো,

— আপনি এতো রাতে? একদম ঢুকতে দেবো না।
যান যান চলে যান৷ বিদায় হোন রাত করে পুরুষ মানুষ এ বাড়ি ঢোকা নিষেধ। মানে আপনার মতো আর কি বলেই মুচকি হাসলো।

রুদ্র তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। চট্রগ্রাম থেকে সোজা সুখনীড়ে এসেছে হৈমীর সাথে দেখা করতে। পাঁচ মিনিট দেখেই বাড়ি ফিরবে আজ। কিন্তু এসে এটা কি দেখছে মাথায় ব্যান্ডেজ সাদা ব্যান্ডেজটার ওপর রক্তের লাল দাগ স্পষ্ট। ব্যাথা পেয়েছে অথচ আমাকে কেউ জানায়নি এই ষ্টুপিড টাও না। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাঁর। হনহনিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লো। একহাতে দুটো শপিং ব্যাগ ছিলো যাতে হৈমীর জন্য আর বাচ্চা দের জন্য চকলেট আছে অনেকগুলো। ট্রি টেবিলে ব্যাগ দুটো রেখে সোফায় গা এলিয়ে বসলো।

হৈমী বললো,

— কি ঢং ভালোভাবে আসতে চাইলেই তো আসতে দিতাম। এভাবে আসার কি আছে?

— কপালে কাটলো কি করে? চোখ বোজা অবস্থায় গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো রুদ্র।

চমকে গেলো হৈমী। কি বলবে এবার সত্যিটা বললে যদি ঝামেলা হয়? রেগে গিয়ে সূচনা আপুকে যদি কিছু বলে না বাবা দরকার নেই দাদুকে যা বলেছি একেও তাই বলি ভেবেই আমতা আমতা করে বললো,

— ইয়ে মানে আসলে আমি একটু লাফালাফি করছিলাম। লাফাতে লাফাতে লাফাতে সোজা বিছানার কোনায় মাথা ঠেকলো আর গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসলো। কি শক্ত কাঠ জানেন না। এতো শক্ত কাঠ দিয়ে কেউ খাট বানায় দাদুকে কালই বলবো নরম কাঠ দিয়ে খাট বানাতে। সেই হবে তাইনা বলেই হাসি হাসি মুখে রুদ্রর দিকে তাকালো।

রুদ্র এতোক্ষণ চোখ বোজা থাকলেও হৈমী সামনে এসেছে বুঝেই চোখ খুলেছিলো। চোখ খুলতেই মাথা খারাপ হয়ে গেলো রুদ্রর। হৈমীর গালে পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট। মাথায় ব্যাথা পেলে গালে আঙুলের দাগ আসবে কি করে? তার মানে হৈমীকে কেউ ইচ্ছে করে ব্যাথা দিয়েছে? গায়ে হাত তুলেছে কেউ? পায়ের রক্ত মাথায় ওঠে গেলো রুদ্রর। একেতো কেউ তাঁর গায়ে হাত তুলেছে এমনভাবে যে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। আবার সেই মানুষ টাকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যাও বলছে। রাগে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করলো রুদ্রর নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বসা থেকে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লো। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে হৈমীর গালে ঠাশ করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো। হৈমী ছিটকে গিয়ে পড়লো মেঝেতে। মাথাটা তাঁর ভনভন করে ওঠলো। হুহু করে কেঁদে দিয়ে বললো,

— মেরে ফেলুন আমাকে সবাই মারুন যে আসবে সেই মারবে, যে আসবে সেই মারবে৷ আমার গালটা যেনো সরকারি গাল যার ইচ্ছে হয় সেই এসে ঠাশ ঠাশ করে লাগিয়ে দেয়। বলেই ওঠে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে চলে গেলো নিজের রুমে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here