ভালোবাসায়_বন্দিনী #পর্ব_৩৪

0
2544

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#পর্ব_৩৪
#জান্নাতুল_নাঈমা

পার্লারের মেয়েদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হৈমীর সাজ কমপ্লিট তাই সাদমান এসে তাঁদের নিয়ে গেছে খাওয়ানোর জন্য। রুমে একাই বসেছিলো হৈমী। তাঁকে একা বাইরে যেতে নিষেধ করে গেছেন সুরভী বেগম। ভালো লাগছে না তাঁর সাজগোজ করেছে এখন সবাইকে দেখাতে ইচ্ছে করছে। সবার মুখে শুনতে ইচ্ছে করছে তাঁকে কেমন লাগছে৷ অথচ তাঁর শাশুড়ী মা তাঁকে কড়া নিষেধ করে গেলো। ভাবতেই মুডটা অফ হয়ে গেলো তাঁর। আয়নার সামনে গিয়ে বার বার নিজেকে দেখতে লাগলো। বিয়ের সব কেনাকাটা তাঁরা করলেও লাল টকটকে এই ল্যাহেঙ্গাটা রুদ্র নিজে গিয়ে কিনেছে। এতো ভারী পোশাকে একটু কষ্ট হলেও তাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে তাই সেই কষ্ট টা খুবই ঠুনকো মনে হচ্ছে তাঁর কাছে।

রুম জুরে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ফোন হাতে নিলো।কয়েকটা সেলফি ওঠিয়ে বিছানায় ফোন রেখে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো। বেশ গরম লাগছে। এসি চলছে তবুও কপালে, নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে৷ রুদ্রর কথা মনে হতেই আবারো ফোন হাতে নিয়ে বসলো বিছানায়। রুদ্রর নাম্বারে ডায়াল করে ফোন কানে দিলো। খানিক বাদেই রিসিভ হলো ফোন।

— হ্যাঁ বলো।
— আপনি কোথায় বলুন তো সকালে না খেয়েই বেরিয়েছেন দুপুর হয়ে গেলো তবুও আসার নাম নেই।
— কেনো মিস করছো নাকি?
— এহ ঠ্যাকা পড়েছে মিস করতে। কি ভারী একটা ল্যাহেঙ্গা এনেছেন ঘেমে অবস্থা খারাপ আমার। আমার থেকে ল্যাহেঙ্গার ওজনই বেশী মনে হচ্ছে।
— সমস্যা নাই আজকের পর থেকে তোমার ওজনও বেড়ে যাবে।
— মানে। আমতাআমতা করে বললো হৈমী।
— মানেটা না হয় এসে বোঝাবো রাখো এখন খানিক বাদেই ফিরছি৷
— না রাখবো না৷ নয়ন কাছে নেই ওরা সবাই রেডি হচ্ছে। একা একা রুমে বোরিং লাগছে আমার। ভালো লাগছে না কিছু। আর আপনি তো সকাল থেকেই উধাও। নতুন বউ রেখে বাইরে গিয়ে এতো সময় থাকছেন লজ্জা করে না আপনার? বাই দ্যা রাস্তা সত্যি করে বলুন তো আপনি কোথায় আছেন? কাহিনী কি হ্যাঁ আমাকে আপনি একদম অবলা নারী ভাববেন না বলে দিলাম। ঘরে বউ রেখে বাইরে উল্টাপাল্টা কাজ করলে ঠ্যাঙ ভেঙে ঘরে বসাই রাখবো বলে দিলাম।
— উফফ ফোন রাখবে? বউ থাকতে বাইরে উল্টাপাল্টা করার প্রশ্নই ওঠে না৷
—রাখবো না আমি ।
— ওকে আমিই রাখছি।
— খবরদার কাটবেন না তাহলে হাত, পা ছড়িয়ে কান্না শুরু করবো বলে দিলাম৷
— আচ্ছা ঠিকাছে রাখবো না৷ এতো মিস করার কি আছে এখন৷ সময় তো ঘনিয়ে আসছেই আর কিছুক্ষণ বাদেই বাসর সাজানো শুরু হবে। এতো তারা কিসের তোমার একটু তো ধৈর্য্য ধরো।
— ছিঃ৷ আপনি কিন্তু নেগেটিভ নিচ্ছেন।
— আমার লিষ্টে নেগেটিভ বলে কোন কথা নেই জান। যা আছে সব পজেটিভ। আমার বউয়ের যে আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে, আমার স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছে তা খুব বুঝতে পারছি৷ আমার ছোঁয়ায় তোমার এতো নেশা লেগে গেছে জানতাম না বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

লজ্জায় যেনো মরি মরি অবস্থা হৈমীর। এইরূপ রুদ্র দেখলে তাঁর হৃদস্পন্দন কতো সময়ের জন্য থেমে যেতো জাষ্ট ধারনা করা যাচ্ছে না। চোখ বুজে ঘোর লাগা গলায় হৈমী বললো ,
—“আপনার ছোঁয়া বড় মারাত্মক না জানি কবে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাই”
—“যতোদিন না ছাই হচ্ছো ততোদিন আমি চেষ্টা চালিয়ে যাবো”
—“তাই! ছাই হয়ে হাওয়ায় উড়ে যাবো তো”
—“ভয় নেই দক্ষিণা হাওয়া আমার দুয়ারে এসে আমায় ছুঁয়ে দিবে। সে ছোঁয়ায় মিশে যাবে তুমি আমার সাথে। ছাই হও আর যাই হও তুমি আমার আর আমি তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকবো “।

চুপ হয়ে গেলো হৈমী আর কিছু বলতে পারলো না সে। রুদ্র বাঁকা হেসে ফোন কেটে দিলো। কাটার আগে ছোট করে বললো ‘আসছি আমি’।
.
সুখনীড়ের সকলেই এসেছে। বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় প্যান্ডেলর ভিতরে তাঁদের বসতে দেওয়া হয়েছে। একজন,দুজন করে গিয়ে হৈমীর সাথে দেখাও করে আসছে। রুমেই হৈমী সকলের সাথে কথাবার্তা বলছে,আর সেলফি ওঠছে। বেশ কিছুসময় পর নয়না রুমে এসে হৈমীকে নিচে নিয়ে যায়। দাদু বসে ছিলো সোফায়৷ হৈমী গিয়ে তাঁর পাশে বসে। দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে এর মাঝেই চলে আসে রুদ্র। রুদ্র কে দেখে হৈমীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।কারন রুদ্র একদম রেডি হয়েই এসেছে। পড়নে তাঁর সাদা স্যুট। দাঁড়ি ছাটিয়ে অনেকটাই ছোট করেছে,চুলগুলোও বেশ ছোট করেছে। একটা সাইজে এসেছে এখন তবুও পিছনে ছোট্ট ঝুটি বাঁধা। হৈমীর ভীষণ আফসোস হলো মনে মনে বিরবির করে বললো,’ইশ কতো সুন্দর লাগছে আরো বেশী সুদর্শন লাগতো যদি ঐ টুক্কু দাঁড়ির মতো চুলটুকু কেটে ফেলতো’ তাঁর ভাবনার মাঝেই রুদ্র এসে দাদুর সাথে কথা বলতে শুরু করলো। হৈমী একটু ভাব নিয়ে বসে রইলো৷ কারন সে যেমন রুদ্র কে দেখে ক্রাশ খেয়েছে রুদ্রও যেনো তাঁকে দেখে ক্রাশ খায়।
.
পরীকে কোলে নিয়ে মাহের দাঁড়িয়ে আছে ড্রয়িং রুমের এক পাশে। পরী ওটা সেটা প্রশ্ন করছে আর সে উত্তর দিচ্ছে। তাদের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হৈমী ওঠে সেদিকে গেলো। মাহের সামনে দাঁড়িয়ে নাক বুচো করে বললো,

— কি ব্যাপার ভাইয়া আমায় কেমন লাগছে বললে না তো আজ?

হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেলো মাহেরের। পরোক্ষনেই আবার অভিনয় শুরু করলো হাসার। হৈমীর দিকে কিছুক্ষণ থম মেরে চেয়ে রইলো। বুকের ভিতর কেমন যেনো ডিপডিপ করছে তাঁর। মৃদু স্বরে বললো,
— খুব সুন্দর লাগছে এটা কি আর আমার বলার অপেক্ষা রাখে নাকি?
— তবুও বলতে হবে। তুমি জানোনা না বললে আমার মন খারাপ হয়।

নয়ন এসে বললো,
— কেনো রে তোর জামাই থাকতে আমার ভাইয়ের বলতে হবে কেনো? যা জামাইরে গিয়া জিগা।

নয়নের পেটে গুতো দিলো হৈমী। বললো,
— চুপ থাক তো আমার জামাইরে গিয়া তুই জিগা। মাহের ভাইয়া আসোতো আমরা সেলফি ওঠি। পরী সুন্দর একটা পোস দে তো।

হৈমী তাঁর ফোনটা মাহেরের হাতে দিলো। পরীকে কোল থেকে নামালো মাহের। হৈমী নয়নকে ইশারা করলো পরীকে কোলে নিতে৷ নয়ন কোলে নিয়ে হৈমীর পাশে দাঁড়ালো। আর হৈমী মাহেরের বাহু চেপে ধরে বললো এবার ওঠাও। ওরা যখন সেলফি তুলতে ব্যাস্ত তখন রুদ্রর দাদি এসে ঝাঁঝালো গলায় বললো,

— এসব কি নোংরামি? বাড়ির বউ হয়ে অন্য পুরুষের গায়ে পড়ে ছবি তুলো লজ্জা করে না। বাড়ি ভর্তি মেহমান তাঁরা কি ভাববে।

কেঁপে ওঠলো মাহের। বুকের ভিতরটা তাঁর ব্যাথা শুরু করে দিলো৷ অসহায় চোখে একবার তাকালো দাদির দিকে আবার তাকালো হৈমীর দিকে। হৈমী ভ্রু কুঁচকে দাদির দিকে চেয়ে আছে। নয়না দূর থেকে কিছু একটা আঁচ পেয়ে তাঁদের কাছে আসে। বলে,

— দাদি আস্তে বলুন মানুষ শুনছে৷ আমার ভাইকে অন্তত মানুষের সামনে লজ্জায় ফেলবেন না।

দাদির গলার জোর যেনো বেড়ে গেলো বললো,

— তোমার ভাই তো দোষ করেনাই গায়ে পড়ছে তো এই মেয়ে৷ এমন অসভ্য মেয়েকে বাড়ির বউ করলে তো এসবই হবে।
— আপনি কিন্তু অযথা বাজে কথা বলছেন৷ মাহের ভাইয়া আমাদের নিজের লোক৷ আর আপনি এতো হিংসে কেনো করছেন বলুন তে? আপনার ছবি ওঠতে ইচ্ছে হলে আসুন উঠাই দেই।
— চুপপ। বেয়াদব মেয়ে। এই জন্যেই বলেছিলাম বাপ,মা ছাড়া চালচুলোহীন মেয়েরে বাড়ির বউ করিস না রেদু করিস না৷ কেউ কোন কথা শুনলো না। বাপ, মা ছাড়া ভালো শিক্ষা তো পায়ইনাই। পুরুষ মানুষ দেখলেই গায়ে ঢলে পড়ে। এখন তো মনে হচ্ছে এই মেয়ের চরিএে দোষ আছে।

হৈমী কেঁপে ওঠলো এমন নোংরা কথা শুনে। মাহেরের রাগ ওঠে গেলো দুহাত মুঠ করে পুরো শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি মনিকা বেগম মাহেরের মা এসে মাহেরকে টেনে নিয়ে চলে গেলো। নয়না,নয়ন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ হৈমীর চোখ বেয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

দাদির কথা আশেপাশের লোকের কানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রুদ্রর কানেও পৌঁছে গেলো। বাড়ি ভর্তি মানুষ অর্ধেকের বেশী লোকের খাওয়া হয়নি। নয়তো রুদ্র আজ কি করতো তা সবাই কল্পনাও করতে পারবেনা৷ দাদুর পাশ থেকে ওঠে গিয়ে রুদ্র তাঁর দাদির পাশে দাঁড়ালো। তাঁর দাদি রেজিয়া বেগম থতমত খেয়ে বলতে লাগলো,
— দেখ রুদ্র এই বউকে সামলা এখনো সময় আছে। নয়তো কিছুদিন পর কাউকে মুখ দেখাতে পারবি না৷

রুদ্র হৈমীর দিকে একবার তাকালো,তারপর নয়না তারপর নয়ন তারপর আশপাশে চোখ বুলালো। তারপর খুব শক্ত করে দাদির হাতটা ধরলো। এবং পা বাড়ালো উপরের রুমের দিকে। এই দৃশ্য রাদিফ দেখতে পেয়ে দ্রুত এসে রুদ্র কে বললো,
— রুদ্র দাদিকে ছাড় বলছি। মানুষ দেখছে দাদির বয়স হয়েছে তুই কোন রিয়্যাক্ট করবি না।
— দেখ ভাই দেখ কেমন বেয়াদবি করছে বউয়ের অন্যায় না দেখে আমারে শাসন করে। কেঁদে বললো দাদি।

রেদওয়ান শেখের মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে। লোকজন কানাঘুষা করছে সে আর সুরভী বেগম মিলে ধামাচাপা দিতে চেয়েও পারছে না৷ হৈমীর দাদু হতভম্ব হয়ে বসে আছে সোফায়। একজন বয়স্ক মহিলা এভাবে ঝামেলা পাকাতে পারে কোন রুচিতে বুঝে আসছে না তার।হৈমীর ভুল হলে সে ভালোভাবে চুপ করে বোঝাতে পারতো। আলাদা নিয়ে গিয়ে বোঝাতে পারতো বাড়ির বউদের একটু সংযত হয়ে চলতে হয়৷ তা না করে নিজেদের সম্মান নিজেই ডুবাচ্ছে ছিঃ।
.
— আমার ওয়াইফের চরিএ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরও আমি রিয়্যাক্ট করবো না? বাহ দারুণ বিচার তোমার ভাই। বললো রুদ্র।
— তোর বউ অন্য পুরুষের গায়ে পড়ে ছবি তুলে তুই কেমন পুরুষ যে বউকে শাসন করস না? শেখ বাড়ির ছেলে হয়ে এমন কাপুরষ তুই জানা ছিলো না। আমার বংশের অভিশাপ তুই। বললো দাদি৷
— ডোন্ট শাউট। নয়তো খারাপ কিছু ঘটে যাবে। আঙুল ওঠিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো রুদ্র।

রাদিফ বুঝতে পারছেনা কি করবে৷ রুদ্র ভুল নয় এদিকে দাদিকে অসম্মান হওয়া দেখেও ভালো লাগছেনা। তাই রাদিফ জোর করে রুদ্রর হাত থেকে দাদিকে ছাড়িয়ে বললো,
—দাদি তুমি উপরে যাও। প্লিজ রিকোয়েস্ট আমার।

রেজিয়া বেগম আর দেরী করলেন না। তাঁর আদরের বড় নাতীর আদেশে চলে গেলেন উপরে। রুদ্র রাগে হাত শক্ত মুঠ করে রেখেছে। রাদিফ তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললো,
— সরি ভাই দাদির হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি মাফ করে দিস।

রুদ্র রাদিফের হাত নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো সদর দরজার বাইরে৷ নয়না হৈমীকে নিয়ে সোফায় বসিয়েছে। দাদু হৈমীর পাশে বসা। কেউ কোন কথা বলছে না সবাই চুপচাপ। সবাই যখন খেতে চলে গেলো তখন দাদু হৈমীকে অনেক বোঝালো। যাতে মন খারাপ না করে কষ্ট না পায়৷ আর কখনো এমন বাচ্চামি গুলা না করে। কারন সে যেভাবে প্রাণখুলে সহজসরল মনে সকলের সাথে মিশে সবাই সহজসরল মনে বিষয়গুলো দেখে না বা ভাবে না।

‘দুনিয়াটা বড় কঠিন, তাঁর থেকেও বেশী কঠিন দুনিয়ার নিয়মগুলো,দুনিয়ার মানুষ গুলো বড় বিচিএ,তাদের মনোভাবও হয় বিচিএ রকমের। এই দুনিয়ায় আমি তুমি আপন পরের পার্থক্য বুঝিনা। অন্যরাই বুঝিয়ে দেয় কে আপন কে পর। এদের বোঝানো তে যখন তুমি পর কে পর ভাবতে শুরু করে দেবে তখনও তোমাকে অনেক বদনাম সইতে হবে। আর তুমি মেয়ে হয়ে জন্মেছো তোমার বদনাম হচ্ছে সবজায়গায় অটুট৷ ওঠতে পাবে বদনাম বসতে পাবে বদনাম। ভালো কাজ করলে পাবে তিরস্কার খারাপ কাজ করলে হবে বহিষ্কার। আর এখন যেহেতু তুমি কোন বাড়ির বউ সেহেতু তুমি আছো খুবই সাংঘাতিক পরিস্থিতি তে। শশুড় বাড়িতে মেয়েরা এক গ্লাস পানি নিজে ভরে খেলেও সেটা কিভাবে খাচ্ছে তা নিয়েও বদনাম রটে যায়৷ তুমি আস্তে হাঁটলে বলবে,বউ আস্তে হাঁটে নিশ্চিত কোন সমস্যা আছে তুমি জোরে হাঁটলে বলবে,বউ এর সবসময় এতো অস্থিরতা কেন একটু কি স্বস্তি নাই? ধীরে কথা বললে বলবে,বউ সমস্যা আছে নাকি গলার স্বর খাটা মনে হয়। জোরে কথা বললে বলবে,বাবাগো বউ এর গলা বড়। সকলের সাথে মিশে চললে চঞ্চলতা দেখালে বলবে বউ আতপাগলা বেশী কথা বলে। আবার যদি চুপচাপ থাকো তাহলে বলবে এমন হিমটাইলা বউ জীবনে দেখিনাই মুখ দিয়া যেনো রাও বের হয়না।

হৈমীর মাথা ঘুরছে দাদুর কথা শুনে। ভেজা গলায় বললো,
— তোমাকে এসব কে বলেছে দাদু।
— গিন্নি, আমি সেই কোন যুগের মানুষ পচাত্তর বছর ধরে দুনিয়ায় এসেছি পচাত্তর হাজারের বেশী অভিজ্ঞতাই হয়েছে আমার।
— ও দাদু বুকের ভিতর খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে। আমিতো সহজে কষ্ট পাইনা দাদু।
— কষ্ট পেওয়া দিদিভাই। মনের দিক থেকে তুমি খুব শক্ত তোমায় আরো শক্ত হতে হবে। তোমার স্বামী তোমার পাশে আছে তোমার স্বামীই তোমার শক্তি।
.
মাহের ফোন, আর ওয়ালেট নিয়ে প্রচন্ড রাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে। রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি, রাগ হচ্ছে নিজের মায়ের প্রতি। হৈমী কে করা অপমানের জবাব সে দিতে পারেনি। সব কিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে তাঁর। দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে মন চাচ্ছে।

সিঁড়ি দিয়ে নামছে মাহের পিছন পিছন তাঁর মা আর দুইবেন নামছে৷ বাইরের মেহমানরা সবাই এখন খেতে বসেছে। ভিতরে নিজেদের লোকই বেশী। নয়না মাহেরকে থামাতে চেষ্টা করছে তাকে কিন্তু সে থামছে না। হৈমী মাহেরকে ওভাবে নামতে দেখে ওঠতে নিতেই দাদু হাত আটকে থামিয়ে দিলো। মাহের যখন সদর দরজা অবদি যায় পথ আটকে দাঁড়ায় রাদিফ। নিচু স্বরে বলে,

— এভাবে যেওনা মাহের। আত্মীয় স্বজন রা কানাঘুষা শুরু করেছে৷ চলে গেলে আরো কথা ওঠবে। মনিকা বেগম বলেন,
— মাহের তোর জন্য যদি নয়নার সংসারে অশান্তি হয় তুই আমার মরা মুখ দেখবি বলে দিলাম।

মাহের অসহায় চোখে তাকালো মায়ের দিকে। নিজের মা কে আজ সে চিনতে পারছেনা। নিজের মেয়ের জন্য আজ হৈমীর হওয়া অপমানের জবাব দিতে দিলো না মাহেরকে। কসম দিয়ে বসে রইলো। আর এখন ছেলেকে দাঁতে দাঁত কামড়ে এই অনুষ্ঠানে থাকতে বলছে। নিজের মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে অন্যের মেয়ে, নিজের ছেলের ভালোবাসার মানুষের আঘাত পাওয়ার কথাটা চিন্তা করছে না৷ মায়েরা তো এমন টা হয় না। মায়েরা তো তাঁর সব সন্তান কেই এক চোখে দেখে। তাহলে তাঁর মা কেনো হৈমীকে দূরে ঠেলে, হৈমীর আঘাতকে তুচ্ছ করে শুধু নিজের মেয়ের ভালো চাইছে নিজের মেয়ের ভালোটা দেখতে চাইছে। আর তাঁকেও স্বার্থপর হতে বলছে?

তাহলে কি দুনিয়াতে কিছু মায়েরা স্বার্থপরও হয়? মায়েদের রূপও হয় বিচিএ রকমের? তারা নিজের সন্তানের জন্য অন্যের সন্তান কে এভাবেই তুচ্ছ করে দেখে? নিজের সন্তানের দুঃখ কে দুঃখ মনে করে আর অন্যের সন্তানের দুঃখ কে সামান্য গুরত্বও দেয় না? আমি তো মায়ের সন্তান তাহলে আমার মুখ চেয়েও আমাকে জরিয়ে আমার ভালোবাসার মানুষের হওয়া অপমানের প্রতিবাদ করতে দিতে পারতো না?

সব কিছু অসহ্য লাগছে মাহেরের। ভালোবাসার মানুষ কে হারানোটা মেনে নেওয়া যতোনা কঠিন তাঁর থেকেও বেশী কঠিন ভালোবাসার মানুষ কে অপমান হতে দেখা,আঘাত পেতে দেখা, ভালোবাসার মানুষের চরিএ নিয়ে অন্য কাউকে প্রশ্ন তুলতে দেখা। আমার হৈমী কে নিয়ে এমন জঘন্য মন্তব্য যে করেছে তাঁকে আমি কোনদিন ক্ষমা করবো না। দুদুবার ঐ মহিলা আমার হৈমীকে আঘাত করেছে একবার সূচনাকে দিয়ে আরেকবার আমার চোখের সামনে। সহ্য করতে পারছিনা আমি চোখ বুজে ফেললো মাহের। চোখ দিয়ে পানি আসবে আসবে ভাব। নয়না মাহের কে টেনে নিয়ে চলে গেলো রান্না ঘরের এক কোনায়৷ বললো,

— ভাইয়া আমার মুখ চেয়ে আর কিছুক্ষণ থেকে যা৷ না খেয়ে গেলে অনেক কথা ওঠবে৷

মাহের কিছু বললো না। রাদিফ এসে মাহেরের কাঁধে হাত রেখে বললো,
— বয়স্ক মানুষ আর কদিনই বা বাঁচবে বলো? ওনার কথায় কেনো এতো টা এমন করছো। যা হয়েছে ভুলে যাও।
—গা বাচিয়ে কদিন বাঁচা যায়? বয়স্ক হোক আর যাই হোক ওনার আচরণ তো ঠিক নেই। আপনারা ওনার এসব আচরণ কেনো মেনে নেবেন? রেগে বললো মাহের।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here