#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#পর্ব_৪
#জান্নাতুল_নাঈমা
রুদ্রকে সারাদিন বাড়িতে দেখা যায় নি। সে কোথায় গিয়েছে তা কেউ জানে না। এদিকে বউ ভাতের অনুষ্ঠান শেষ। এবার বর কোনে ফিরানী যাবে। রাদিফের সাথে সূচনা আর শোভন কে পাঠানো হবে ঠিক করা হলো। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে ওঠে বসলো নয়না।হৈমীও সকলের থেকে বিদায় নিলো। সকলের সাথে কথা বলে সুরভী বেগমের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— আন্টি,,,আমি কিন্তু জানি তুমি আমার ওপর প্রচন্ড খুশি হয়েছে। তোমার ঐ ভূতের মতো ছেলেটা কে মানুষের মতো দেখতে পেয়ে তোমার খুব ভালো লাগছে তাইনা।
সুরভী বেগম মুখ চেপে হেসে বললো,
— পাগলী মেয়ে আমার ছেলেটা যা রাগী তোমায় যে কিছু বলেনি এই অনেক।
হৈমী বড় বড় চোখ করে তখনকার কথা ভাবলো। এক ঢোক গিলে নিয়ে জোর পূর্বক হেসে বিরবির করে বললো,
— অমন রাক্ষস কাউকে কিছু না বলে ছাড়ে নাকি।
আমার হাতটা ব্যাথা বানিয়ে দিয়েছে,আমার হার্টবিট টা দূর্বল করে ছেড়েছে। ইজ্জতের ওপর আঘাত হানে নাই কিন্তু যে শাস্তির কথা বললো না জানি কি শাস্তি হয়। এর থেকে বরং আমি যতো তারাতারি সম্ভব এই দুই বাড়ির নাগালের বাইরে চলে যাই। রাক্ষস টা আর আমায় খুঁজেই পাবে না হুহ।
সুরভী বেগম ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,
— কিছু বলছো??
— না না কিছুনা টাটা আন্টি। খুব খুব ভালো থেকো। আর আমার জন্য অনেকক দূয়া করো কেমন। যাতে আমি আবার এসে তোমাদের কানের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারি হিহিহি।
হৈমীর কথা শুনে সকলেই হেসে ওঠলো।তা দেখে হৈমী বললো,
— যাক যাওয়ার আগে সব্বাই কে হাসিয়ে ছেড়েছি।
বলেই ভ্রু নাচালো এবার সবাই হৈমীর সাথে বেশ ভালো আচরন করলো তাঁকে আবারো আসতে বললো এ বাড়িতে।
মেয়েটা এমন যে এর ওপর বেশীক্ষণ রেগে থাকা যায় না।এমন এমন কথা বলে যে আদর করে দিতে মন চায়৷ মাহের গাড়ির পিছনে বাইকের ওপর বসে ছিলো। হৈমী যে মেয়ে আলাপ জুরে দিলে সহজে এখান থেকে বের করা যাবে না। তাই সে হৈমীকে ডাক দিয়ে গাড়িতে বসার জন্য তারা দিলো। মাহেরকে দেখে হৈমীর চোখ, মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো।সকলকে টাটা করে মাহেরের কাছে ছুটে এসে বললো,
— ভাইয়া তুমি আমায় বাড়ি দিয়ে আসো প্লিজ। দাদুভাই ওয়েট করছে আমার জন্য। ডিনারটা আমার সাথেই করবে তিনি আর ওরাও তো আমাকে দেখার জন্য ছটফট করছে। দিয়ে এসো না প্লিজ প্লিজ প্লিজ। আমি একাই যেতে পারবো কিন্তু তা তো তোমাদের আবার পছন্দ হবেনা আন্টিকে বলে বকুনি খাওয়াবে। এর থেকে ভালো তুমিই দিয়ে আসো।
হৈমীর কথা শুনে নয়ন চমকে ওঠে গাড়ি থেকে খানিকটা মাথা বের করে বললো,
— সে কি বাড়ি দিয়ে আসবে মানে কোথাও যাবি না তুই। এখনি কিসের যাওয়াযাওয়ি সাতিদনের আগে যাওয়ার কথা মুখেও আনবি না।
হৈমী নাক বুচো করে নয়নের কাছে চলে গেলো।কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কিছু বললো। তারপর নয়নের গালে টোপ করে কিস করে দিলো। নয়ন আর কোন রিয়েকশন দেখালো না।বরং মাহেরকে বললো,
— ভাইয়া এই ক্যাসেটকে দিয়ে আসো।
হৈমীর দিকে চেয়ে বললো,
— আর শোন প্যাকপ্যাকানির মা! গিয়েই ফোন করে জানাবি রাতে অবশ্যই ভিডিও কল করবি। প্যাক প্যাক করতে করতে তো সব ভুলে যাস এসব ভুললে কিন্তু তোর একদিন কি আমার একদিন।
নয়নের গাল টেনে দিয়ে হৈমী বললো,
— ওকে ডিয়ার! দুইজনের মিলে দুইদিন হিহিহি।
.
বেশ পুরোনো একতলা বাড়ির সামনে এসে বাইক থামালো মাহের। পুরো রাস্তা হৈমী ননস্টপ কথা বলে গেছে। আর মাহের তাঁর মনের কান দিয়ে সব কথা শুনেছে। সেও বলেছে অনেক কথা তবে শুনেছে বেশী। হৈমী কথা বলার সময় বাকি লোক কথা বলার সুযোগ খুব কমই পায়। চার বছর যাবৎ হৈমীকে দেখে আসছে সে। তাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এভাবেই।
হৈমীর কোন আচরনই তাঁর বিরক্ত লাগে না। বরং পাঁচ বছরের ছোট বাচ্চার মতো কোমলপ্রাণ মেয়েটাকে দেখে তাঁর ভালো লাগে গর্ববোধ হয় এমন একটা মেয়ের আশে পাশে নিজেকে রাখতে পেরে।নিজেকে নিয়ে নিজেরই গর্ববোধ হয় যে সে এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসে। এমন একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবে। “পরিবারের কাউকে তার ভালোবাসার কথা জানানো হয়নি আর না জানানো হয়েছে এই মেয়েটাকে। কিন্তু আর বেশী দিন দেরী করা যাবে না। হৈমী এখন বড় হচ্ছে ওর জীবনে অন্য কেউ আসার আগেই আমার মনের কথা ওকে জানিয়ে দিতে হবে” ভাবলো মাহের।
বাড়ির ডানপাশে ছোট পুকুর বাম পাশে ছোট ফুলের বাগান।বাগানের ফুল গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলো দশ,এগারো বছর বয়সি ছোট ছোট বাচ্চা রা। হৈমী আর মাহেরকে দেখে সকলের মুখে হাসি ফুটে ওঠলো। হৈমী আপু, মাহের ভাইয়া বলেই ছুটে এসে কয়েকজন হৈমীকে কয়েকজন মাহের কে জরিয়ে ধরলো। হৈমীও তাঁদের জরিয়ে ধরলো এক এক করে সকলের গালে, কপালে কিস করলো। সব থেকে বাচ্চা মেয়ে বয়স চার বছর নাম পরী তাঁকে কোলে তুলে নিলো মাহের। বাচ্চা টা আধো গলায় বললো,
— আমাল বয়ফেলেন এসেচে, আমাল বয়ফেলেন এসেচে।
মাহের, হৈমী সহ সকলেই বেশ শব্দ করে হেসে ওঠলো। হৈমী পরীর দুগাল টেনে দিয়ে বললো,
— ওলে বাবালে বয়ফ্রেন্ড এসেছে চলো চলো ভিতরে নিয়ে চলো। তাঁকে তো আপ্যায়ন করতে হবে।
বাড়ির ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই রিয়াজ উদ্দিন সোফা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চোখে চশমাটা ভালো করে গুঁজে দিয়ে এগুতে এগুতে বললো,
— গিন্নি সাহেবার তাহলে আসার সময় হলো??
হৈমী চট করে এসে দাদুকে জরিয়ে ধরে বললো,
— আই মিস ইউ ডিয়ার কর্তা।আপনাকে আমি প্রচন্ড মিস করেছি।
রিয়াজ উদ্দিন হোহো করে হেসে হৈমীর কপালে চুমু খেলো। মাহেরের দিকে তাকাতেই হৈমী সাইট হয়ে দাঁড়ালো। মাহের তাঁকে সালাম করলো। হৈমী বললো,
— তোমরা বসো আর বাচ্চা রা আমার সাথে চলো।
এবার আমরা চা, চানাচুর পার্টি করবো ওক্কে??
সকলেই হৈহৈ করে ওঠলো। পরী বললো,
— আমি আমাল বয়ফেলেন কে ছেলে যাবোনা।
মাহের হেসে ফেললো পরীকে আরেকটু জরিয়ে নিয়ে বসলো৷ হৈমী মুখ ভেঙচি দিয়ে বললো,
— থাক তুই তোর বয়ফেলেন নিয়ে। এই যে বয়ফেলেন আপনার গারাল ফেলেন কে বলুন আপনার থেকে কেউ তাঁকে ছিনিয়ে নিবে না ঢং।
হৈমী সটাং সটাং করে চলে গেলো। তাঁর পিছু পিছু বাকি বাচ্চা রাও গেলো। মাহের মুচকি হাসলো হৈমীর যাওয়ার পানে চেয়ে।
.
রাত আটটার দিকে বাড়ি ফিরলো রুদ্র। ড্রয়িং রুমেই বসে ছিলেন সুরভী বেগম। ভেবে রেখেছিলেন আজ ছেলেকে বকবে খুব বকবে বকার পর যা রিয়েকশন হওয়ার হবে। কিন্তু আজ সে তাঁর ছেলে কে শাসন করবেই। কেমন ছেলে সে কেমন ভাই যে বড় ভাইয়ের বউভাতের অনুষ্ঠানে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
মেহমান দের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মুখ ব্যাথা হয়ে গেছে। জীবনটা তাঁর ঝালাপালা এই ছেলেকে নিয়ে।
এতো কিছু ভেবে রেখেছিলো সুরভী বেগম কিন্তু ছেলেকে দেখে তাঁর মনটা মাখনের মতো নরম হয়ে গেলো। ছেলে যে চুল দাঁড়ি সব সাইজ করে এসেছে।
ইশ এমন রাজপুত্রর মতো ছেলেটা কি বেশেই না ছিলো এতোগুলো দিন৷ এবার ঠিক আছে ইশ নজর না লেগে যায়৷ মায়ের নজরই তো বেশী লাগে৷ ভেবেই রুদ্রর কাছে গিয়ে সামনে দাঁড়ালো।
মা তাকে হয়তো এটা সেটা প্রশ্ন করবে তাই মুখে বিরক্তির ছাপ এনে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।
সুরভী বেগম ছেলের ডানহাত নিয়ে কনিষ্ঠ আঙুলের মাথায় আলতো কামড় দিয়ে দিলো। মুখে হাসি টেনে বললো,
— খাবাড় দিবো??
রুদ্র অবাক হলো ভীষণ তাঁর মা তাঁকে কোন প্রশ্ন করলো না।তবে তাঁকে দেখে খুশি হয়েছে বেশ বুঝলো।তাই ছোট করে হুম বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো উপরে। সুরভী বেগম মুচকি হেসে খাবাড় বাড়তে গেলো।
.
রুমে এসে দরজা ভিড়াতেই সাদা টাইলসে গোল্ড নেকলেস টা চিকচিক করছে দেখতে পেলো।
ভ্রু কুঁচকে নিচু হয়ে নেকলেসটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগ দিলো। “বিয়ের দিন গেটের সময় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হৈমীর ফর্সা গলায় নেকলেসটা চিকচিক করছিলো তা ভুলে যাই কি করে??এটাতো হৈমীর এখানে পড়ে আছে কেনো”??ভাবলো রুদ্র।পরোক্ষনেই মনে পড়ে গেলো সেই তো টেনে নিয়ে এসেছিলো এ রুমে তখনি কোনভাবে খুলে পড়েছে হয়তো। টিকলিটাও তার কাছে এখন এই নেকলেসটাও মেয়েটা বড্ড কেয়ারলেস বিরবির করতে করতে কয়েক পা হাঁটাহাটি করলো রুদ্র। দৃষ্টি তাঁর হাতে থাকা নেকলেসটার দিকেই। লকেট টা দেখে বেশ কৌতূহল জাগলো তাঁর ভারী মোটা লকেট। লকেট খুলতেই একসাইটে দুজন নারীপুরুষের ছবি দেখতে পেলো। খুবই ছোট যার দরুন সেভাবে স্পষ্ট বুঝতে পারছেনা দুজনের মুখ। আরেকপাশে হৈমীর ছবি এটাতে আরো বাচ্চা বাচ্চা লাগছে হৈমীকে। বাঁকা হাসলো রুদ্র। নেকলেসটা নিজের কাবলীর পকেটে রেখে কাবার্ডে রাখা মানিব্যাগ থেকে নিজের স্ট্যাম্প সাইজ একটা ছবি নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
.
সুরভী বেগম খাবাড় বেড়ে অপেক্ষা করছিলেন সেদিকে কোন খেয়াল নেই। বড় বড় পা ফেলে দৃষ্টি এক দিকে স্থির রেখেই রোবটের ন্যায় বেরিয়ে গেলো। সুরভী বেগম এতো ডাকাডাকি করলেন দরজা অবদি এসেও ডাকলেন তবুও দাঁড়ালো না সে৷ চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না আর সুরভী বেগম। আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে ভিতরে চলে গেলেন তিনি।
.
হালকা নাস্তা পানি করার পর এবার বাচ্চা রা চেপে ধরেছে মাহেরকে। তাঁরা মাহেরের গলায় গান শুনবে।
মাহের লজ্জা পেলো সকলকে নিষেধ করলো সে গাইবে না৷ এবার হৈমী কোমড়ে দুহাত রেখে বড় বড় চোখ করে চেয়ে বললো,
— এই মি.পরীর বয়ফেলেন গান না গাইলে আপনাকে ছাড়ছিনা আজ।
মাহের মনে মনে বললো,
— ধরে রাখো না নিষেধ কোথায়। মনে মনেই হাসলো মাহের।
হৈমীও বায়না শুরু করলো গান শুনবে। হৈমীর বায়নাকে ওপেক্ষা করার শক্তি যে তাঁর নেই গিটার বিহীন কোন প্রকার বাজনা বিহীন গান ধরলো মাহের।গান ধরতেই হৈমী মেঝেতে সকল বাচ্চা দের নিয়ে হাঁটু ভাজ করে বসে পড়লো৷ মাহেরের সামনাসামনি বসে গালে হাত রেখে চুপচাপ গানে মনোযোগ দিলো সে। মাহের হৈমীর দিকে একবার আর তাঁর কোলে বসা পরীর দিকে একবার চেয়ে গান গাইতে থাকলো,
জানে এই মন জানে তুমি যে আমার,
তোমারই স্বপ্নে আমার রোজ পারার।
জানে এই মন জানে তুমি যে আমার,
তোমারই স্বপ্নে আমার রোজ পারার।
ভালোবাসার খামে চিঠি লিখে তোমার নামে,
পাঠিয়ে দিলাম আমি পড়ে নাও এবার।
জানে এই মন জানে তুমি যে আমার,
তোমারই স্বপ্নে আমার রোজ পারার।
ইচ্ছেগুলো আমার তোমাকে খুঁজে ফিরে,
চাই শুধু তোমাকে হাজার মুখের ভিড়ে।
তুমিতো আমারই জানুক এ গ্রহ তারা,
থামবে না কখনো প্রেমেরই স্রোত ধারা।
বলো না তোমার কাছে কি এমন যাদু আছে,
ছুটে আসি এই আমি কেনো বারেবার।
জানে এই মন জানে তুমি যে আমার,,,
পুরো গান গেয়েই শুনালো মাহের৷ হৈমীর দিকে অপলকভাবে চেয়েই শেষ লাইনগুলো গাইলো সে।
হৈমীর সেদিকে কোন খেয়াল নেই গান শেষে সে জোরে চিৎকার করে বললো,
— ওয়াও সুপার ভাইয়া জাষ্ট অসাধারণ ভয়েস তোমার। বাচ্চা রা হাত তালি দাও,,,
সকলেই হাত তালি দিলো মাহের মিটিমিটি হাসলো সকলের এতো খুশি এতো আনন্দ দেখে। পরী এবার সেই খুশির মাঝেই বলে ওঠলো,
— বয়ফেলেন বয়ফেলেন তুমি এতা আমাল জন্য গেয়েচো???
পরীর কথা শুনে হৈমী ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলো পরীর দিকে। সে ভেবে পায় না এই পুচকিটা এতো পাকা পাকা কথা কোথায় শেখে। পরোক্ষনেই ভাবলো “আমি কি কম পাকা নাকি এরা তো আমারই শিষ্য” মুচকি হাসলো হৈমী।মাহেরও হৈমীর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে পরীর দিকে তাকালো আর বললো,
— হুম,,,এটা তো আমার ভালোবাসার মানুষের জন্যই গেয়েছি মাই ডিয়ার লিটল ওয়াইফ!
.
দুদিন পর নয়নকে ফোন করে হৈমী। ফোন রিসিভ হতেই হৈমী চিল্লিয়ে বলে,
— ঐ ঐ তুই জানিস কি হয়েছে??
— না বললে জানবো কি করে??
— টিকলি হারিয়েছে ওকে ফাইন দুঃখ টা সামলানো যায়। কিন্তু আমার স্বর্নের চেইন আমার শেষ স্মৃতি সেটা কেনো হারালো নয়ন??
— মানে কি বলছিস!
— হ্যা আমি ঠিক বলছি আজ সকালেই খেয়াল হলো আমার চেইনটা না গলায় না পার্স না ব্যাগ কোনটাতেই নেই।
— কি বলছিস হৈমী ওটাতো তোর বাবা,মা তোকে দিয়েছিলো৷ ওটাই তোর শেষ স্মৃতি। ওখানে তোদের ফটোও আছে। ওটা কি করে হারালি। এত্তো কেয়ারলেস কি করে হতে পারিস তুই। সারাদিন শুধু মুখই চালাস মাথাটা চালাস না কেনো??
— মাথা চালানোর জিনিস না তাই!
নয়ন বেশ রেগে বললো,
— হৈমী,,,
— প্লিজ জান রাগ করিস না৷ কিভাবে খুঁজবো সেই টা বল প্লিজ প্লিজ। সব ঐ রাক্ষস টার দোষ যেদিন থেকে আমার জীবনে এসেছে সেদিন থেকে একের পর এক অঘটন ঘটেই চলেছে।
— সে কি রে তোর জীবনেও চলে গেছে??
হৈমী থতমত খেয়ে গেলো আমতা আমতা করতে শুরু করলো শেষে রেগেমেগে বললো,
— তুই আমাকে আর ফোনই দিবি না শয়তান মেয়ে বিপদে পড়েছি সাহায্য না করে মজা নিচ্ছিস তোর মুখে পোকা পড়ুক তোর বত্রিশপাটি দাঁতে চৌষট্টিপটি দাঁত হোক ডায়নী বুড়ি হয়ে যা তুই শাঁকচুন্নি। একদমে বকে ফোন কেটে দিলো হৈমী। রাগে ফুসফুস করতে করতে ফোন বিছানায় রেখে বেরিয়ে পড়লো৷ এদিকে নয়ন আবারো তাঁকে ফোন করে যাচ্ছে সমানে অথচ রিসিভ করার নাম নেই। মনে মনে ভাবলো “নয়না আপুকে ফোন করি এ বাড়ি থাকলে মা, ভাইয়ার চোখে বা আমার চোখে পড়তো তাহলে আপুর শশুর বাড়িও ফেলে আসতে পারে। এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পাড়া যায় না ধুর বলেই ফোন করলো নয়না কে। নয়না কে ফোন করে যা শুনলো এতে দুমিনিট মাথা ভনভন করে ঘুরতে থাকলো নয়নের। রুদ্র হৈমীর নেকলেস নিয়ে নয়নাকে দেখিয়েছে। নয়না তাঁর নিজের কাছে নেকলেস রাখতে চেয়েছিলো আর বলে ছিলো সেই হৈমীকে দিয়ে দিবে৷ কিন্তু রুদ্র নয়নাকে নেকলেস দেয়নি। বরং হৈমী কোথায় থাকে? কোন কলেজ পড়ে?বাড়িতে কে কে আছে সব জেনে নিলো রুদ্র। সব শুনে খানিকটা অবাক হয়েছে রুদ্র। যদিও ডিটেইলে কিছু বলেনি নয়না শুধু এটুকু বলেছে হৈমীর বাবা,মা বেঁচে নেই। রিয়াজ উদ্দিন এবং সাথে বিশ পঁচিশ জন বাচ্চার সাথেই থাকে হৈমী এর যোগসূত্র কি তা বলেনি নয়না৷ রুদ্রও বেশী প্রশ্ন করেনি। সবটা শুনে নয়ন ফোন কেটে আবার হৈমীকে ফোন দিলো কিন্তু না ফোন ধরার কোন নাম নেই মেয়েটার।
.
বিয়ের তৃতীয় দিন রুদ্র নয়নার একমাএ দেবর তার সাথে প্রথম কথা বললো।তবুও সাবজেক্ট হৈমী৷ বেশ অবাক হলো নয়না এবং সূচনা। অজানা ভয় আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরলো সূচনা কে। তবুও মনকে মিথ্যে স্বান্তনা দিতে লাগলো সে। বুকের ভিতর কেমন শূন্যতা হতে লাগলো। অস্থিরতা রা ক্রমশও চেপে ধরলো তাঁকে। সহ্য করতে না পেরে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে চোখের পানি ফেলতে লাগলো সে। ছোট বেলা থেকে মা কে পায়নি, মায়ের আদর ভালোবাসা পায়নি। নিজের বাবাকেও পায়নি। খালামুনির ভালোবাসায় বেড়ে ওঠেছে সে। বোঝ বয়স থেকেই রুদ্রর প্রতি আলাদা এক টান অনুভব করেছে সে। রুদ্রর খুটিনাটি সকল বিষয় সব সময় খেয়াল রেখেছে। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে রুদ্রর প্রতি তাঁর টানের মানে, অনুভব করতে শিখেছে তার ভালোবাসা কে । প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে সে রুদ্র কে। তাঁর খালামুনি তাঁর এই ভালোবাসা দেখে তাঁকে কথা দিয়েছে সেই হবে শেখ বাড়ির ছোট ছেলের বউ।
.
মনটা ভীষণ খারাপ৷ হৈমীর মন খারাপ বেশীক্ষণ থাকা মানে বিশ্বে বড়সড় একটা রেকর্ড তৈরী হয়ে যাওয়ার মতো। আর এমন রেকর্ড হৈমী তৈরী করতে চায় না। সাইকেলটা নিয়ে ওড়না দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়লো হৈমী। রাত তখন আটটা ছুঁই ছুঁই। ছোট বেলা থেকেই অভ্যেস তাঁর রাতের বেলা চিকু মামার দোকানের আইসক্রিম, চকলেট খাওয়া। দিনের বেলা কিনে এনেও রাতে খাওয়া যায় কিন্তু সেটাতে হৈমী মজা পায় না৷ হৈমী মজা পায় রাতের বেলা দাদুভাইকে লুকিয়ে সাইকেল নিয়ে বের হওয়াতে। দিনের বেলা মেয়ে মানুষ সাইকেল চালিয়ে বাইরে যাওয়া টা সবাই ভালো চোখে দেখে না। বলেছেন দাদু৷ রাতের বেলা মুখ ঢেকে বের হলে মানুষের নজরে পড়লেও সেভাবে বোঝা যায় না৷ এনজিওতে জব করা অনেক মহিলাই সাইকেল করে যাওয়া আসা করে। রাত আটটা অবদি এমন অনেক মেয়েকে দেখা যায় বাইরে তাই আটটার ভিতরেই সে বের হলো পনেরো মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসবে ভেবে। আসার সময় বাচ্চা দের জন্যও চকলেট নিয়ে আসবে এবং সকালে দেবে৷ আর কাল সকালেই চেইন খোঁজার জন্য বের হবে প্রথমে নয়নদের ওখানে যাবে। তারপর নয়না আপুর শশুর বাড়ি। এসব ভাবতে ভাবতেই সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে।
হঠাৎ সামনে এসে পড়লো কালো রঙের প্রাইভেট কার। ভাবনায় ছেদ ফালিয়ে তারাহুরোয় সাইট করতে গিয়ে মেইন রাস্তার বাইরে মাটিতে পড়ে যায় সাইকেল সহ হৈমী।
— ও মা গো মরে গেলাম গো আমাকে কেউ ধরো, ধরো গো। চিকু মামা গো আমার বুঝি তোমার দোকানের আইসক্রিম, চকোলেট আর খাওয়া হবেনা গো। কার বাপের এতো বড় গাড়িরে কার বুকের এতো বড় পাটারে হৈমীর সাইকেলের সামনে এসে পড়লি রে। হৈমীর কোমড় ভাঙলিরে মরে গেলাম রে আমি মরে গেলাম। আমি যদি বেঁচে ফিরিরে তোর গাড়ির বারোটা বাজাই দিবো রে।
হৈমীর কান্নাজরিত আহত গলা শুনেই অবাক হলো রুদ্র। তাঁর বোঝা হয়ে গেলো এমন বাচাল মেয়ে হৈমী ছাড়া আর কেউ না।দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো সে। আশে পাশে বেশ নির্জন তেমন গাড়িও চলছে না। দূরে কয়েকজন লোক দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে দেখে রুদ্র হৈমীর কাছে চলে গেলো।
হৈমীর অবস্থা দেখে নিচু হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— জাষ্ট স্যাট আপ ডোন্ট শাউট। বলেই হৈমীকে কোলে তুলে নিলো। এতে হৈমী দ্বিগুণ চেঁচামেচি শুরু করলো।
— বাঁচাও কে আছো বাঁচাও এক সুন্দরী মেয়ের কোমড় ভাঙার সুযোগ নিয়ে বাংলা সিনেমার ডিপজলের মতো এক গাম্বাস পুরুষ মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
রুদ্র দেখলো লোক গুলো এবার দৌড়াতে শুরু করেছে। রুদ্র জোর গলায় বললো,
— ড্রাইভার জলদি সাইকেলটা গাড়ির ডিকিতে ওঠাও। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার শরীফ সাইকেল ডিকিতে ওঠালো।
রুদ্র হৈমীকে নিয়ে গাড়িতে ওঠতেই শরীফ গাড়ি স্টার্ট দিলো হৈমী এতো চেচামেচি করছিলো যে রুদ্র বাধ্য হয়ে একহাতে হৈমীর মুখচেপে অন্যহাতে হৈমীর কাঁধ চেপে নিজের সাথে জরিয়ে বসে রইলো।
চলবে।