ভালোবাসা কারে কয়,০৫,০৬
শবনম মারিয়া
পর্ব ৫
সন্ধ্যা হয়েছে। চন্দ্রা আজ ভার্সিটিতে যায় নি। সারাদিন ঘরেই শুয়ে ছিল। মাঝে মাঝে গিয়ে একটু নানা নানুর সাথে কথা বলে এসেছে। হঠাৎ করে ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো। চন্দ্রা বিছানা থেকে উঠে গিয়ে জানালাটার পাশে দাড়ালো। বাতাস এসে লাগছে চন্দ্রার মুখে। এলোমেলো খোলা চুলগুলো উড়ছে। বিষন্ন মনটায় একটু ভালোলাগারা এসে যেন ছুঁয়ে দিচ্ছে।
চন্দ্রা হঠাৎ গাড়ির হর্ণ শুনে বিল্ডিংয়ের নিচের দিক তাকালো। প্রণয়কে দেখতে পেয়ে কেমন যেন হতে লাগলো। চন্দ্রার ভালো লাগে না। কিন্তু লোকটা ওর জন্য অনেক করে। কেন করে? এসব করে কি লাভ? চন্দ্রা কে হয় ওর? চন্দ্রার কেউ না হয়ে ওর জন্য কেন এই লোকটা নিজের সময় নষ্ট কষ্ট করে? কেন অপরাধে জড়িয়ে পরে? ওর কি আর কোনো কাজ নেই?
চন্দ্রা এগুলো ভাবতেই তার চোখের কার্নিশে অশ্রু জমে। কেন জমলো তাও জানে না চন্দ্রা। ওর ভালো লাগে না। ও শুধু চায় ওর জন্য যা করার সব তূর্ণ করবে। কারণ তূর্ণ ওর ভাই। এছাড়া চন্দ্রা অন্য অপরিচিত লোকদের যত্ন পেতে চায় না। ওর মনে হয় মানুষ ওর উপর দয়া দেখায়। এই দয়াটুকুই চন্দ্রা চায় না৷ কেন চাবে? ও কি এতোই অবহলিত? বাবা মা ছাড়া মেয়ে নানু বাড়িতে বড় হলেই কি তার উপর এভাবে দয়া দেখাতে হবে? আর কতদিন চন্দ্রা এভাবে এখানে থাকবে? অবশ্য কেথায়ই বা যাবে? কার কাছে যাবে? চাইলে কি যেতে পারতো না? কিন্তু এই পৃথিবীতে তো এক নানা নানু আর তূর্ণ ছাড়া ওর কেউ নেই। মাঝে মাঝে নানা নানুকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়। এদের অনেক বয়স হয়েছে। দিন ঘনিয়ে আসছে। যদি এরাও চন্দ্রার মায়ের মতো চন্দ্রাকে একা ফেলে যায়? তখন কি হবে? তখনও কি প্রণয় আসবে ওকে দয়া দেখাতে?
অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজাচ্ছে প্রণয়। বাসার সবাই কোথায় কে জানে। দাদা দাদু তো বয়স্ক মানুষ। দাদা তো হুইল চেয়ারে করে দরজা খুলতে আসেন না। দাদিও যায় না বাসায় কাজের লোক থাকলে। কাজের লোকেরা কই? আমিনা খালাও কি নেই?
চন্দ্রা? চন্দ্রা তো দরজা খুলতে পারতো। সে তো নিশ্চয়ই ঘরে আছে। নাকি কোথায় গিয়েছে আবার! এই মেয়ে রাতের বেলা কিংবা সন্ধ্যায় বের হলেই সাংঘাতিক কান্ড ঘটিয়ে বসে থাকে। এগুলো ভেবেই ঘেমে যাচ্ছে প্রণয়। প্রণয় কেন যেন না চেয়েও এই মেয়েটার সব ধরনের কাজের সাথে সাক্ষ্যি হয়েছে। সব কাহিনী শুনলে যে কেউ বলবে তূর্ণর মতো মানুষের বন্ধু হয়েই ভুল করেছিল প্রণয়। কিন্তু প্রণয়ের কাছে এটা আশীর্বাদও। চন্দ্রার মতো মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে তূর্ণ বন্ধু হওয়ার কারণেই তো। ভীষণ ভালো লাগে চন্দ্রাকে ওর। কখনো বলতে পারে নি৷ বলতেও পারবে না। তবে মেয়েটার জন্য অপরাধ করতেও বাধে না প্রণয়ের।
চন্দ্রার দরজা খুলতেই প্রণয়ের এসব ভাবনার অবসান ঘটে। চন্দ্রা দরজা খুলে নরম স্বরে বলল,
“আপনি এই সময়?”
“হুম।”
“ভাইয়া তো বাসায় নেই।”
“ভাইয়া না থাকলে আসা যায় না? ভাইয়া ছাড়া কি বাসার বাকি সবাই ভূত?” হেসে বলে প্রণয়।
চন্দ্রা দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল,
“ভিতরে আসুন।”
প্রণয় ভিতরে এসে বসে। প্রণয় বসে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছো?”
“ভালো।”
“দাদু দাদীমা কেমন আছেন?”
“ভালো। ভেতরে আছে। চাইলে দেখা করে আসতে পারেন।”
“কাল তো দাদুর জন্মদিন ছিল তাই না?”
“হুম।”
“তূর্ণ উপস্থিত ছিল কি? আসলে ব্যস্ততায় কথা হয়ে উঠে নি। আজ ও ব্যস্ত।”
“হ্যাঁ, ছিল। তবে রেগে গিয়েছিল। বিয়ে নিয়ে কথা বলেছিল আবার দাদু।”
“তা তো হবেই।”
“ভাইয়ার আসতে দেরি হবে। জ`ঙ্গি হা`মলার কাহিনিতে অনেকেই আ`হত হয়েছে। প্রচুর ব্যস্ত।”
“হুম। কি একটা অবস্থা!”
দুজনেই চুপ থাকে কতক্ষণ। এরপর প্রণয় বলে উঠে,
“বারবার এক কথা বলছো কেন বলো তো?”
“কি কথা?”
“তূর্ণর আসতে দেরি হবে। যদি আমি ভুল না হই তাহলে কি তুমি চাচ্ছো আমি চলে যাই?”
“আমি কেন তা চাইব? আপনার বন্ধুর বাসা। আপনার বন্ধু চাইলে, আপনি চাইলে থাকতেও পারেন।”
“তোমার সমস্যা হবে না তো?”
“আমার আবার কিসের সমস্যা?”
“তবে আমি আসলে এভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ো কেন?”
এই নিয়ে আর কিছু বলে না চন্দ্রা। চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“চা খাবেন?”
“একা?”
“নানু খান না। আর নানার খাওয়া মানা। আমিনা খালা শুধু সকালে খান। তূর্ণ ভাইয়া বাসায় নেই। বাকি রইলাম আমি আর আপনি। আমি তো এমনিই বানাতে যাচ্ছিলাম। আপনি চাইলে আপনাকেও দিব।”
“তুমি বানালে এক কাপ চা পান করাই যায়।”
“কেন অন্য কেউ বানালে কি পান করতেন না?”
“না মানে তূর্ণ বানালে সেটা খাওয়া যায় না।”
এবার চন্দ্রা হেসে দিল। হেসে বলল,
“বসুন। নিয়ে আসছি।”
চন্দ্রা দু’কাপ চা নিয়ে এসে বসলো প্রণয়ের সামনে। প্রণয়ের কাছে এগিয়ে দিলো একটা কাপ। প্রণয় নিয়ে ধন্যবাদ জানালো। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই চন্দ্রা প্রশ্ন করলো,
“কেমন হয়েছে? চিনি ঠিকাছে?”
“পারফেক্ট। আমি তো বলি তূর্ণকে একটু চা বানানো শিখাও।”
“ওর এতো সময় আছে নাকি? রাত দুপুরে ঘুম না আসলে ইলেক্ট্রিক জগে পানি গরম করে কাপে ঢেলে তাতে কড়া করে কফি নিয়ে নেয়। এরপর তাই খায়। ওর কফি ওর মতোই তিতা।”
“তাহলে তোমার হাতের চা কেন মিষ্টি? ঝাল হওয়া দরকার ছিল।”
“মানে? কি বুঝাতে চাচ্ছেন? আমি ঝাল প্রকৃতির?”
“জিজ্ঞেস করছো আবার?”
চন্দ্রা আচমকাই হেসে দেয়।
প্রণয় বলে,
“সব ঠিকাছে চন্দ্রা। শুধু কি নিজের মধ্যের ঐ ভয়ংকর জিনিসটা আর নিজের ক্ষতি করা বাদ দিতে পারো না? নিজেকে পাল্টাতে চাও না কখনো?”
“জানেন তো ততদিন পাল্টাবো না যতদিন….”
“থাক আর বলা লাগবে না। জানা আছে। খুব ভালো করে জানা আছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রণয়।
“মুখে আটকালেও কাজে আটকাতে পারবেন না।”
“পারিনি তো। কত চেষ্টা করলাম।”
আবার পিনপতন নীরবতা দুজনের মাঝে। নীরবতা ভেঙে চন্দ্রা বলল,
“বাসার সবাই কেমন আছেন?”
“ভালো।”
“প্রণয়িনী?”
“ভালো আছে।”
“মাঝে মাঝে ওকে একটু নিয়ে আসলে পারেন। খুব ভাল্লাগে ওর সাথে সময় কাটাতে।”
“নিয়ে আসলে পাগল হয়ে যাবে। দিন দিন বড় হচ্ছে আর বেশি বিরক্ত করছে।”
“বিরক্ত করছে না। সে তার বাবার সাথে সময় কাটাতে চায়। কিন্তু তার বাবা তাকে সময় দিচ্ছে না। তার বাবা অফিসে আর বাহিরেই সময় দেন। বলছি মা ছাড়া মেয়েটা বড় হচ্ছে। একটু যত্ন নিতে শিখুন। আপনি ছাড়া ওর কে আছে? বাবাকে কাছে পেতে চায় মেয়েটা।”
“বাচ্চা মানুষ সামলানো আমার পক্ষে কঠিন। মা সামলায়। হেল্পিং হ্যান্ড দেখাশুনা করে। আমি শুধু বাসায় যেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেই কোলে নিয়ে।”
“পড়ালেখা শিখানো শুরু করেন। স্কুলে দিতে হবে। আগে বাসায় যাবেন। একটু পড়াবেন। আর যদি না-ই পারেন তবে আরেকটা বিয়ে করেন। ওর একটা মা দরকার।”
“তোমাকে দেখে অবাক হই চন্দ্রা!”
“কেন?”
“মা ছাড়া করে আবার মা দিতে বলছো আমার মেয়েকে?”
“মা ছাড়া করেছি দেখেই তো দায়বদ্ধ। তাই তো এতো চিন্তা।”
অট্টহাসিতে মেতে উঠে প্রণয়। আবার ক্ষনিকের পলকেই হাসি মিইয়ে যায়।
চন্দ্রা বলল,
“আমাকে বলেন, মাঝে মাঝে নিজেই অস্বাভাবিক আচরণ করে বসেন কিন্তু।”
“তোমার অস্বাভাবিক কাজগুলোর সাক্ষী হয়েই এই হাল হয়েছে।”
“ওসব বাদ দেন। সিরিয়াসলি বলছি একটা বিয়ে করেন। এমন মেয়েকে বিয়ে করবেন যে আপনার মেয়ের প্রকৃত মা হবে। যত্ন নিবে। আর আপনাকেও ভালোবাসবে। আপনাকে ঠ…”
চন্দ্রা কথা শেষ করার আগেই রোকেয়া এসে বলল,
“কথা কিন্তু ঠিক বলসে আমার নাতি। প্রণয়, ভাই একটা বিয়ে করে নাও। ছোট্ট মেয়েটারে পালতে বিয়ের দরকার। বুঝি আগের বউরে ভালোবাসতে। তার মৃত্যু মানতে পারো না। কিন্তু আর কতদিন? অবশ্য তোমার ভালোবাসা গভীর ছিল। খুব ভালোবাসো দেখেই হয় তো পারলে না ওরে ভুলতে। দেখ চন্দ্রা, আমি সবসময় তোদের বলি না ভালোবাসা কারে কয়? ভালোবাসা এরেই বলে। বউ মারা গেল তিন বছরের বেশি সময় হইসে। ছোট্ট বাচ্চারে একা সামলায়। অথচ একটা বিয়ে করে না।”
রোকেয়ার কথা শুনে আর চোখে চন্দ্রার দিক তাকিয়ে ম্যাকি হাসে প্রণয়। একইভাবে হাসে চন্দ্রাও। এই হাসিতেও একটা গল্প লুকিয়ে আছে। এই অজানা গল্প শুধু চন্দ্রা আর প্রণয়েরই জানা৷
প্রণয় বলল,
“আসলে দাদীমা ব্যাপারটা হলো, বিয়ে করার আর ইচ্ছে নেই। মেয়েটার জন্যই মূলত। আমার মনে হয় না, আমার মেয়েটাকে অন্য কোনো মহিলা এসে মায়ের ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করে পালতে পারবে। তাই ভাবিনি এসব নিয়ে।”
“তাও ভুল চিন্তা করো নাই। কিন্তু নিজের একা থাকতে ভালো লাগে? ওহ্ তোমরা তো আবার ডিজিটালে যুগের পোলাপান৷ একা থাকতে ভালোবাসো। দেখো না আমার অপদার্থ নাতি নাতনিদের। বিয়ের নাম নেওয়া যায় না।”
প্রণয় বলল,
“আচ্ছা দাদীমা ওসব কথা না হয় পরে হবে। আগে বলেন আপনি কেমন আছেন? শরীর কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“দাদু কোথায়? কেমন আছেন?”
“ঘুমিয়েছে। শরীরটা ভালো লাই। খুব চিন্তা হয়।”
“একদম চিন্তা করবেন না। ইন শা আল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবেন দাদু। বার্ধক্যে এটুকু একটু হয়।”
“হুম। আচ্ছা তোমরা কথা বলো। আমি যাই। তোমার দাদু উঠলে খাবার দিতে হবে।”
এই বলে চলে গেলেন রোকেয়া।
.
নানু যেতেই চন্দ্রা হেসে বলল,
“হুহ্! ভালোবাসা কারে কয়! একে বলে? কিভাবে?”
“জানি না। তবে দাদীর এই একটা কথা আমার ভীষণ মনে ধরে। সত্যিই ভালোবাসা কারে কয়? ভালোবাসাকে কি স্পেসিফিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? নাকি যায় না?”
“হয়েছে। ভালোবাসা নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেন না আবার ইন্জিনিয়ার সাহেব।”
“তাহলে ডাক্তার সাহেবকে বলো গবেষণা করতে।”
“তবে আর হয়েছে। আর লোক পেলেন না। হা হা হা। তূর্ণ ভাইয়া করবে ভালোবাসা নিয়ে গবেষণা!”
“হা হা হা।”
“আচ্ছা শুনেন।”
“হুম বলো।”
“মাঝে মাঝে প্রণয়িনীকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। আমি ওর সাথে সময় কাটাতে চাই।”
“তোমার ভার্সিটি! দুইদিন পর চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে। তুমি আগে নিজেকে সামলাও।”
“না প্লিজ, ছুটির দিন নিয়ে আসবেন।”
“আচ্ছা যাও। নিয়ে আসবো। মেয়ে পাগল বানিয়ে দিলে কিন্তু এই অসহায় বাবা দায়ী নয়।”
“একদম দায়ী নয়। সব দায় মেয়ের চন্দ্রা আন্টির।”
“ঠিকাছে।”
“মেয়েকে মা ছাড়া যখন করেছি, মায়ের কিছু দায়িত্বও পালন করে দিব।”
প্রণয় ফিসফিসিয়ে বলল,
“চুপ। একদম চুপ। বেশি কথা বলো। কেউ শুনে ফেলবে।”
“আচ্ছা।”
“আর শুনো, ওসব কথা একদম মনে করবে না। বরং আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমাকে আর একটা মিথ্যে সম্পর্কে টিকে থাকতে হয় নি। আমি ভালো আছি আমার মেয়েকে নিয়ে।”
“জানি। কিন্তু প্রণয়িনী তো একটা মা চায়।”
“প্রণয়িনীর চন্দ্রা আন্টি আছে তো।”
“মানে?”
“কিছু না। আজ আসি।”
“আচ্ছা।”
চলে গেল প্রনয়। দরজাটা আটকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দ্রা। সে কি ভুল করছে? প্রণয়িনীর সাথে সময় কাটাতে চেয়ে? না সে ভুল করছে না। প্রণয়িনীর বাবা তাকে অনেক সাহায্য করে। তার উপর দয়া করে হয় তো। তাই এই ঋণ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই চন্দ্রা প্রণয়িনীর সাথে কিছু সুন্দর সময় কাটাতে চায়। প্রণয়িনীকে দেখলে ভীষণ মায়া হয় ওর। বাচ্চাটার দোষ কি ছিল? সে তার মায়ের গর্ভে জন্মেছিল। এটাই কি তার দোষ? নাকি তার বাবা তার মাকে বিয়ে করেছিল, ভালোবেসেছিল এটা তার দোষ?
এসব ভেবেই মনে পরে তূর্ণ একদম ঠিক। বিয়ে করাই উচিত না। বিয়ে করে একটা সন্তান জন্ম দিয়ে তার কথা ভাবে না তার বাবা মা। তারা নিজেদের নিয়ে মগ্ন থাকে। সন্তানটাকে ফেলে রাখে এক কোণে অযত্নে। এই পৃথিবীটাই স্বার্থপর নিকৃষ্ট মানুষে ভরা। সবাই অবশ্য তেমন না। যেমন প্রণয়, চন্দ্রার মা এরা এসব মানুষদের জালে জড়িয়ে ভিক্টিম।
উফ, মায়ের কথা মনে পড়ে গেল কেন আবার চন্দ্রার? মায়ের কথা মনে পড়তেই মাথাটা আবার ধরে আসলো।
চলবে…
ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ৬
পরশির জ্ঞান ফিরেছে মাত্র। জ্ঞান ফিরার পর নার্স তূর্ণকে ডেকে নিয়ে এসেছে৷ তূর্ণ চেকাপ করে বলল,
“এভরিথিং ইজ ফাইন। অফিসার কেমন ফিল করছেন?”
পরশি নরম স্বরে বলল,
“বেটার।”
তূর্ণ বলল,
“আপনাদের মতো মানুষরা তো দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন। আপনাদের নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হয় না। পুরো দেশ সামলান আপনারা। আপনাদের নিয়ে আর কিসের টেনশন। আমি তো আপনাদের নিয়ে চিন্তা করছি না। চিন্তা তো সাধারণ জনগণদের নিয়ে। তবে তারাও বেশ ভালো আছে শুধুমাত্র আপনাদের জন্য।”
পরশি সামান্য হেসে বলল,
“শুধু কি আমাদের জন্য? আপনাদের জন্যই বেঁচে আছে। বাঁচিয়েছেন তো আপনারা। আমরা শুধু উদ্ধার করে আপনাদের কাছে এনে দিয়েছি৷ বাঁচিয়েছেন আপনারা। আমাদের জীবনও আপনারাই বাঁচান। আমাদের প্রফেশন যেমন সম্মানীয়, আপনাদের প্রফেশনও।”
তূর্ণ সৌজন্যতার হাসি হাসে।
“আচ্ছা এখন রেস্ট নিন।”
এই বলে তূর্ণ যাওয়া ধরছিল, পরশি পিছন থেকে ডাক দিল,
“এক্সকিউজ মি৷ একটু শুনবেন।”
নার্স আর তূর্ণ দুজনেই থেমে পিছনের দিক তাকালো। তূর্ণ বলল,
“কিছু বলবেন?”
“যদি আপনার মূল্যবান সময় থেকে আমাকে একটু সময় দিতেন, কিছু জানার ছিল।”
“জি অবশ্যই।”
“আমার কোলে একটা বাচ্চা ছিল। ও কি ওর বাবা মাকে পেয়েছে?”
“তা তো বলতে পারছি না। আপনি এখানে আহত অবস্থায় এসেছিলেন৷ কোলে বাচ্চা ছিল না।”
“ওহ্ সরি।”
“ইটস ওকে।”
“আচ্ছা অন্যান্য আশে পাশের থানার অফিসার যারা এসেছিলেন উনারা ঠিক আছেন তো? একজনের হাতে গুলি লেগেছিল। উনি কোথায়?”
“থানা উল্লেখ করে বলতে পারছি না ঠিকমতো, তবে একজন বয়স্ক করে যিনি ছিলেন তাকে আনতে আনতে মারা গিয়েছেন৷ আর যার হাতে গুলি লেগেছিল সে ঠিক আছেন।”
“ওহ্! মারা গিয়েছেন!”
মন খারাপ হয়ে যায় পরশির৷ তূর্ণ বলল,
“ভেঙে পড়বেন না। আপনাদের প্রফেশনটাই এমন। মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিতেই হয়।”
“হুম যতদিন ধরে এই চাকরিতে আছি, ততদিন এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। উপর থেকে শক্ত থাকলেও, অনেক কষ্ট লাগে। সামনের উপর একজনের যখন গুলি লাগে, তখন অন্তর ঠিকই কেঁপে উঠে। কিন্তু উপর দিয়ে শক্ত থেকে বাকিদের বাঁচাতে হয়। নিজের বাঁচতে হয়।”
“হুম।”
“আমি বাচ্চাটার কথা জানতে চাচ্ছিলাম। ছোট্ট বাচ্চাটা লুকিয়ে ছিল। ওকে প্রমিজ করেছিলাম বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিব। কিন্তু তার আগেই গুলিটা লাগে।”
“ওহ্, শুনে খারাপ লাগলো ভীষণ।”
“একটু হেল্প করতে পারবেন?”
“জি বলুন।”
“বাসায় যোগাযোগ করাটা দরকার। কিন্তু আমার ফোন কোথায় আমি জানি না। একটু হেল্প করতে পারবেন?”
“জি অবশ্যই।” বলই তূর্ণ এগিয়ে গিয়ে নিজের ফোনটা নিয়ে পরশির হাতে দিল। পরশি ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা হাতে নিল।
তূর্ণ বলল,
“আপনি কথা বলুন। আমি একটু পর এসে ফোন নিয়ে যাবো।”
“ধন্যবাদ। আমি দুঃখিত কষ্ট দেওয়ার জন্য।”
“না, না। কিসের কষ্ট? আপনার পরিবারের সাথে আপনার যোগাযোগ করাটা জরুরি। এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। আপনার ফ্যামিলির সবাই নিশ্চয়ই চিন্তিত আছেন? আপনি তাড়তাড়ি ফোনটা করে জানিয়ে দিন।”
“জি। ধন্যবাদ।”
তূর্ণ চলে গেল।
পরশি ফোন করল ওর মাকে। ফোনটা রিসিভ করতেই পরশির মা স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন,
“হ্যালো।”
“হ্যালো মা। আমি পরশি বলছিলাম।”
পরশি মা সেলিনা বেগম বললেন,
“ওহ্ পরশি। হ্যা, বল কি হয়েছে? এটা আবার কোন নাম্বার? অফিসের?”
“না মা হসপিটালের।”
“হসপিটালের মানে?”
পরশি একটু অবাক হলো। ওর মা কি কিছুই জানে না? খবর কি দেখেননি এখনও? হয় তো দেখেনি। দেখলে তো পরশির জন্য চিন্তায় পড়ে যেতেন। পরশি স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
“খবর দেখোনি? কি হয়েছে জানো না?”
“কি হয়েছে? ওহ্, হুম জঙ্গি হামলা হয়েছে দেখেছিলাম। তোর ভাইয়া বাসায় এসে বলেছিল পর টিভি চালিয়ে দেখেছিলাম।”
পরশি একটু ধাক্কা খেল। এই খবর জানার পর, পরশি কোন থানায় আছে তাও জানার পর ওর পরিবারের কারো একটুও মাথা ব্যাথা নেই কি? বাবা অসুস্থ। তাই মা বাবাকে ফেলে কোথাও যায় না। কিন্তু পরশির ভাই তো ফোন করতে পারতো! ভাবীও খবর নিতে পারতো। ছোট বোন তো রেগেই আছে। আচ্ছা এগুলো শুনেও কেউ রেগে থাকতে পারে? একটাবারের জন্যও কি কারো পরশির কথা মনে পরেনি? পরশির বলার আর কিছু নেই। তবুও সে বিস্ময় চেপে বলল,
“জানো না এটা কোনদিকে? আমার থানার এদিকে হয়েছিল। সেই অভিযানে গিয়েই একটু আহত হয়েছিলাম। এখন ঠিক আছি। চিন্তার কিছু নেই। তাই জানাতে ফোন করলাম।”
পরশির মা এবার একটু চিন্তিত স্বরে বললেন,
“সব ঠিকাছে? বেশি ব্যাথা পেয়েছিস কি?”
পরশির কান্না পাচ্ছিলো। সে কান্না চেপেই বলল,
“সব ঠিকাছে। আমি ঠিকাছি। একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম। তেমন কিছু হয় নি। আজ রাতে বাসায় আসতে পারব না তাই জানাতে ফোন করেছিলাম।”
“আচ্ছা।” খুব শান্ত কন্ঠেই বললেন সেলিনা।
“বাবার খেয়াল রেখো। ঠিকমতো ওষুধ দিও।”
“হুম।”
“রাখছি।”
“আচ্ছা।”
পরশি কলটা কাটার আগেই সেলিনা ফোনটা কেটে দিলেন। পরশি অবাক! এমনও মা হতে পারে? কেন তাকে কেন পরিবারের কেউ পছন্দ করে না? কেন সহ্য করতে পারে না? অন্যায় কি তার? পরশির মাঝে মাঝেই মনে হয় এই সমাজে সে একজন প্রশংসিত নারী না হলে আর উপার্জন না করলে তার পরিবারের কেউ হয় তো চাইতোও না যে সে তাদের সাথে থাকুক। তার সাথে সম্পর্ক রাখতো না। ঢাকায় পোস্টিংটা না হয়ে অন্য কোথাও হলে ভালো হতো। দূরে থাকতে পারতো।
এসব ভেবেই পরশি অঝোরে কান্না করতে থাকে।
.
তূর্ণ পরশিকে ফোন দিয়ে অন্য রোগীদের দেখতে আসে। আজ তার অবস্থা যা তা হয়ে গিয়েছে। একটুও বসতে পারেনি। একটা দিনেই কত মানুষের মৃত্যু দেখতে হয়েছে। ভালো লাগছে না তার। তবুও হাজারো ক্লান্তি নিয়ে রোগীদের সাথে হাসি মুখে কথা বলছে। রোগীদের পরিবারের লোকদের সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ দেখা হলো ইভার সাথে। ইভা তূর্ণকে দেখতে বলল,
“কি অবস্থা?”
“সিচুয়েশন দেখছো না হসপিটালের? কেমন আর হওয়ার কথা।”
“হুম। খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছো তাই না?”
“ডাক্তার হয়ে কি রকম প্রশ্ন যে করো না ইভা! আমাদের ক্লান্তি আছে?”
“আরে বাবা এমনিই জিজ্ঞেস করেছি। এতোটা সিরিয়াস হওয়ার কি আছে? রাতের বেলা ঘুমাও নি। সকাল সকাল চলে এসেছো হসপিটালে। আবার অনেক রাত হয়েছে। তাই বলেছিলাম।”
কথাগুলো একটু অভিমানের স্বরে বলল ইভা।
তূর্ণ বলল,
“তুমিও তো রাতে হসপিটালেই ছিলে। একই অবস্থা তোমারও। তাই বলেছি৷ রেগে যাচ্ছো কেন?”
“বাহ্ রে! আমি তো না হয় সব সময়ই তোমার কথা ভাবি। তুৃমিও ভাবো আমার কথা?”
ইভার এসব কথা তূর্ণর একদম পছন্দ না৷ এই মেয়েটা সব সময় এমন করে। তূর্ণ ভালো স্বাভাবিক কোনো কথাও মেয়েটা অস্বাভাবিকভাবে নিয়ে নেয়। তূর্ণ স্বাভাবিকতা বজায় রেখে শান্ত গলায় বলল,
“কেন ভাববো না? আমার কলিগ, বন্ধু, হসপিটালের সব স্টাফদের কথা তো ভাববোই। অস্বাভাবিক কিছু তো না তাই না? জানি সবার কষ্ট হচ্ছে এই সময়। কিন্তু দায়িত্ব তো পূরণ করতেই হবে।”
তূর্ণর কথা শুনে ইভা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে ভাবে এই লোকটার মধ্যে কখনো কোনো পরিবর্তন আসবে না। লোকটা আজীবন এমনই থেকে যাবে। রসকষহীন একটা মানুষ। যার জীবনে দায়িত্ব ছাড়া আর কোনো কথা নেই। দায়িত্ব ভালোই পালন করতে জানে তূর্ণ। ইভার খুব মন চায় এই দায়িত্বশীল মানুষটার ভালোবাসা পেতে। মানুষটাকে পেতে। কিন্তু লোকটা সবকিছুর দায়িত্ব পূরণ করলেও নিজের জন্য কিছু করে না। কেন পারে না কি নিজের ভালো থাকার জন্য একটা মানুষের সঙ্গ নিতে, একটা মানুষকে ভালোবাসতে? ভালোবাসাও কি একটা দায়িত্ব নয়? ভালোবাসা আসলে কি? এখানেও গিয়ে ঐ একটা প্রশ্নেই সবটা আঁটকে যায়, ‘ভালোবাসা কারে কয়?’ এই প্রশ্নটার প্রকৃত উত্তর যদি সকলে খুঁজে বের করতে পারতো, তবে হয় তো অনেকেই ভালোবাসার উপর বিশ্বাস করতে পারতো। মানুষকে ভালোবাসতে পারতো।
“কি হয়েছে তোমার? কোন দুনিয়ায় চলে গিয়েছো?”
তূর্ণর এই কথায় ইভার ভাবনার অবসান ঘটে। ইভা তূর্ণর দিক তাকিয়ে মেকি হেসে বলল,
“কিছু না। আসছি। তাড়তাড়ি বাসায় ফিরে যেও। ইমারজেন্সিতে অনেক ডাক্তার আছে। তুমি বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।”
এই বলে চলে যায় ইভা। তূর্ণ ইভার যাওয়ার দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার রোগী দেখে। রাউন্ড শেষে তার হঠাৎ মনে পড়ে আজ সারাদিন সে বাসায় কারো খোঁজ নেওয়ার সময় পায় নি। চন্দ্রার সাথে কথা হয় নি। না জানি মেয়েটা কি করছে। দাদু দাদির খোঁজও নেয় নি। সকালে ভেবেছিল কথা বলবে। তাও বলার সময় পায় নি৷ দাদু হয় তো ভীষণ মন খারাপ করে বসে আছে। দাদুর কথা মনে করতেই তূর্ণ একা একা হেসে ফেলল। লোকটা ভারী পাগলামি করেন। অসুস্থ হয়েছেন পাগলামি বেড়েছে। বিয়ে ছাড়া তার আর কোনো কথা নেই। তার জীবনের শেষ ইচ্ছা নাকি তার নাতিদের বিয়ে দেখা। তূর্ণ ধমকালেই মুখটা কালো করে বসে থাকেন। আজ সারাদিন কথা হয় নি। নিশ্চয়ই সারাদিন মুখ গোমড়া করেছিলেন। আর একটু পর পর একে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছেন তূর্ণ বাসায় এসেছে কি না। এমন অপেক্ষা করতে করতে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
তূর্ণ ভাবলো চন্দ্রাকে ফোন করবে। ফোন করার জন্য পকেটে হাত দিয়ে দেখতে পেল ফোন নেই। হঠাৎ মনে পড়লো তার ফোন সে অফিসারের কাছে দিয়ে এসেছে। ফোনটা আর আনা হয় নি। তূর্ণ পরশি যে দিকে আছে সে দিকে গেল।
তূর্ণ দরজার কাছে গিয়ে একজন মহিলা স্টাফকে বললেন ভিতরে গিয়ে অনুমতি নিতে যে, তার ফোন নিতে সে আসতে পারবে কি না।
এরপর তূর্ণ কেবিনে ঢুকেই বলল,
“সরি, আসলে ফোনটা দরকার ছিল। তাই ডিস্টার্ব করলাম।”
পরশি বলল,
“না না ডিস্টার্ব করেন নি। বরং আমি আপনার ফোনটা নিয়ে ঝামেলা করেছি।”
পরশির কন্ঠে কেমন কান্না জড়ানো। এতক্ষণ যেন সে বসে বসে কান্না করছিল। তূর্ণ পরশির দিক তাকিয়ে দেখল তার চোখ দুটো লাল। চোখের কার্নিশে এখনও অশ্রু জমে আছে। তূর্ণ খেয়াল করলো, শ্যামবর্ণ ত্বকের একটা সুন্দর নারী। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কান্নার কারণে চোখ দুটো ফুলে আছে। অশ্রু জমা হলেও চোখ দুটো ভীষণ মায়াবী। কান্না করার কারণে ঠোঁট দুটো কাঁপছে।
তূর্ণ আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না পরশির দিক। সে তো এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নারীদের রূপ পর্যবেক্ষণ করে না।
তূর্ণ পরশিকে জিজ্ঞেস করলো,
“ম্যাম কোনো সমস্যা?”
পরশি কাঁপা কন্ঠে বলল,
“না।”
“আর ইউ শিওর?”
“হুঁ।”
“আপনার চোখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আপনি কষ্টে আছেন। কান্না করছিলেন। আপনার কি খুব বেশি পেইন হচ্ছে পিঠে? দেখুন একটু পেইন হবে। তাও ওষুধ তো দেওয়া হয়েছে। তবে এতো বেশি পেইন হওয়ার কথা না। যদি হয় ব্যাপারটা সমস্যা। আমাকে দেখতে হবে।”
“না কোনো পেইন হচ্ছে না। পিঠে কোনো পেইন নেই।”
এই বলতেই পরশির চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তূর্ণ দেখে আরও ঘাবড়ে গেল। সে বলল,
“অন্য কোথাও ব্যাথা পেয়েছেন কি? দেখুন সমস্যা হলে তো আমাকে জানাতে হবে। ডাক্তারকে সব বলা উচিত।”
পরশি হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো,
“ব্যাথাটা যদি শারীরিকভাবে না পেয়ে মানসিকভাবে পাই, তাহলে কি ডাক্তারকে বললে সমাধান পাব?”
তূর্ণ একটু থমকে যায়। তাকিয়ে থাকে পরশির দিক। পরশিও তাকিয়ে থাকে তূর্ণর দিকে।
কিছুক্ষণ পর তূর্ণ শান্ত গলায় বলল,
“হ্যাঁ। ব্যাথাটা যদি মানসিক ভাবে পেয়ে থাকে তাহলেও ডাক্তারকে বলা প্রয়োজন।”
পরশি আর কিছু না ভেবেই হঠাৎ করে বলা শুরু করলো,
“কেন জানি না আমি আমার পরিবারের কাছে অনেক বড় একটা বোঝা। পরিবারের কেউ পছন্দ করেন না। বাবা পছন্দ করেন। পরিবারের কেনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাকে জানানো হয় না। হ্যাঁ, টাকার প্রয়োজন হলে ঠিকই জানায়। আমি বাঁচলাম না মারা গেলাম তাতে আমার পরিবারের কারো কিছু যায় আসে না। দেশে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, মেয়ে পুলিশ অফিসার। কেউ একটু ফোন করে আমার খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ফোন দিয়ে আমি জানিয়েছি পরেও তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আমি মরে গেলেই তবে তারা সুখী হবে?”
এসব বলেই আবার কান্না করতে থাকে পরশি। তূর্ণ একটু অপ্রস্তুত আর অবাক হয়ে যায়। তবুও সে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার বাবা মাও এমন করে? মানে আপনার হাজবেন্ডও…. ওহ্ সরি, আপনি বিবাহিত নাকি আমি জানি না। আন্দাজে ভুল করে বলে ফেললাম।”
“না, আমি অবিবাহিত। হ্যাঁ, আমার বাবা-মা, বোন, ভাই-ভাবী কেউই আমার খোঁজ নেয় নি৷ বাসার সবাই আমাকে অপছন্দ করে।”
“তারা আপনাকে অপছন্দ করে, করুক। আপনি তো নিজেকে অপছন্দ করেন না তাই না? নাকি তাও করেন?”
“সবাই এতো অপছন্দ করলে, নিজেকে নিজে কিভাবে পছন্দ করব?”
“এটাই তো মূল। সবার কথা ভেবে নিজেকে অবহেলা করবেন না। নিজেকে ভালোবাসুন। নিজে আগে নিজেকে পছন্দ করুন৷ তারপর না হয় অন্যের কথা ভাববেন। আপনি নিজের সুখটাকে খুঁজে বেড়ান। আর আপনি ভাবছেন আপনার পরিবারের কেউ আপনাকে পছন্দ করে না? না করুক। এমন তে কথা নেই সবার সবাইকে ভালো লাগতে হবে। তাদের কথাই ভাবুন, আজ যাদের আপনি বাঁচিছেন। তারা আপনাকে অপছন্দ করেন না। তাদের পরিবারের লোকেরা আপনাকে পছন্দ করেন না৷ অনেকের অবহেলার মানুষটার কাছেও অনেকে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকেন৷ আপনি মরে গেলে কারা খুশি হবে সেটা না ভেবে ভাবুন আপনি মরে গেলে কাদের আফসোস হবে।”
পরশি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল তূর্ণর কথাগুলো। তূর্ণর দিক তাকিয়ে ওর কথাগুলোর মুগ্ধতায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো পরশির মন।
পরশি বলল,
“ধন্যবাদ। আপনি ঠিকই বলেছিলেন পেইন হলে ডাক্তারদের বলা উচিত। সেই পেইনটা যেমনই হোক না কেন। এখন অনেকটা বেটার ফিল করছি। আপমার কথাগুলো অনেক সুন্দর ছিল। আমি আগে কখনও এতো সুন্দর করে ব্যাপারগুলো ভাবতে পারিনি।”
“ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবেন না। প্রফেশনটাই মানুষের ব্যাথা দূর করা।”
এই বলে তূর্ণ হেসে দিলো। হেসে দিলো পরশিও। পরশির হাসিটাও লক্ষ্য করলো তূর্ণ। ভারী মনোমুগ্ধকর!
“আচ্ছা এখন আসি।”
এই কথা বলে তূর্ণ যাওয়া ধরছিলো। পরশি পিছন থেকে ডাক দিলো।
“শুনুন।”
“জি।”
“আপনার ফোন। যার জন্য এসেছিলেন।”
“ওহ্। থ্যাংকস। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ুন। নাহলে কিন্তু পিঠে ব্যাথা বাড়বে।”
“আচ্ছা।”
চলবে……