ভালোবাসা কারে কয়,০৭,০৮

0
226

ভালোবাসা কারে কয়,০৭,০৮
শবনম মারিয়া
পর্ব ৭

তূর্ণ বাসায় এলো একটু রাত করেই৷ তখনো চন্দ্রা ঘুমায়নি। তূর্ণ আসার অপেক্ষাতেই ছিল। ড্রয়িংরুমেই বসে তূর্ণর জন্য অপেক্ষা করছিল। তূর্ণ ঘরের মেইন দরজার লকটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো চন্দ্রা বসে আছে। চন্দ্রাকে দেখে তূর্ণ জিজ্ঞেস করলো,
“এখনও এখানে? ঘুমাস নি কেন? কিছু করেছিস নাকি?”
“আরে না ভাইয়া। তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। কতোটা লেট করলে। আজকে সারাদিন যে তোমার উপর কত ঝড় বয়ে গিয়েছে তা বুঝতে পারছি। জানতাম তুমি এসে আবার ঘুমিয়ে যাবে। সারাদিন তো কিচ্ছু খাওনি। তাই ভাবলাম ওয়েট করি। তোমাকে খাবার দিয়ে তারপর ঘুমাবো।”
“বাহ্! আমার বোনটা তো দিন দিন খুব বুদ্ধিমতী হচ্ছে। কিন্তু আমার জন্য তোর বসে থাকা লাগবে না৷ তুই যা ঘুমা। আমি খেয়ে নিব।”
“কি খাবে? এক কাপ কফি? সারাদিন না খেয়ে রাতে এক কাপ কফি খেয়ে ঘুম দিলে শরীর ভালো থাকবে? এই তুমি ডাক্তার হয়েছো!”
“আরে বাবা!”
“চুপ। একদম চুপ। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমিও খাইনি। দুজনে মিলে এক সাথে খাবো। আমি খাবার রেডি করছি। যাও তুমি।”
“সে কি! এখনো খাস নি? এসব শুনলে কিন্তু রাগ হয় চন্দ্রা।”
“তোমার কাহিনী দেখে আমারও রাগ হয় ভাইয়া। যাও তো।”
“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। দিন দিন দাদী হয়ে যাচ্ছিস।”
“হ্যাঁ। তোমাকে সোজা করতে এই হওয়া লাগবে। দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তবুও এই পুরুষ মানুষের মাথায় একটু বুদ্ধি হলো না।”
“ওতোও বুড়ো হই নি।”
“ইশ আসছে! বিয়ে করলে বাচ্চা বড় হয়ে যেত।”
“এই জন্যই করিনি। হা হা হা।”
তূর্ণ মজা করে নিজের রুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। অন্যদিকে চন্দ্রা টেবিলে সুন্দর করে খাবার পরিবেশন করে নিয়েছে। ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে মেয়েটার। তূর্ণর জন্য যে সে এভাবে ক্ষুধার্ত হয়ে বসে আছে সেটা না৷ সে চাইলেই খেয়ে নিতে পারতো। পরে তূর্ণকে খাবার পরিবেশন করে দিলেই হতো।
কিন্তু সে আজ সন্ধ্যাবেলা প্রণয় যাওয়ার পর থেকে কেন যেন তার কথা মাথা থেকে বের করতে পারছিল না৷ প্রণয়ের সাথে যেদিনই ওর বেশি কথা হয় সেদিনই এমন হয়। আজ চন্দ্রার মাথায় জেঁকে বসেছে প্রণয়িনী। সে প্রণয়িনীর সাথে সময় কাটাতে চায় ঠিক। কিন্তু এতে কি প্রণয় খুশি হবে না? আচ্ছা প্রণয় কি ভয় পায় চন্দ্রার মতো এমন একটা পাগল মেয়ের সাথে তার মেয়েকে সময় কাটাতে দিতে?
আবার চন্দ্রার মাথায় প্রশ্ন আসে, কেন ও এতো বেশি কথা বলতে যায় লোকটার সাথে? কথা বলতে বলতে অতীতের কাহিনীতেই চলে যায় চন্দ্রা। আজ যদি ওর নানু শুনে ফেলতেন, তাহলে কি একটা কাহিনি হতো! প্রণয় তো বারবার মানা করে এসব কথা বলতে। তারপরেও কেন বলে? আচ্ছা প্রণয় কেন ওর এতো খেয়াল রাখে?
এসব ভেবে ভেবেই অনেকটা রাত পার হয়ে যায়। খেতে ইচ্ছে করে না চন্দ্রার। কিন্তু পরে যখন ক্ষুধা লাগে, তখন ভাবে তূর্ণ আসলে একসাথে খাবে। এইজন্যই অপেক্ষা করেছে। দুই ভাই বোন খেতে খেতে কথা বলার জন্যও কিছুটা সময় পাবে।

তূর্ণ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছে চন্দ্রা। তূর্ণ বলে,
“এতো কিছু খাবো এখন?”
“হ্যাঁ।”
“ঘুম এসেছে। অনেক টায়ার্ড। কিছু খাবো না রে। এক গ্লাস পানি খেয়ে নেই আমি৷ তুই বরং খেয়ে নে খাবারগুলো।”
“ভাইয়া! তুমি আমার বড় না হলে খুব মারতাম। চুপচাপ খেয়ে নাও। আমি খাবার বেড়েছি তো।”
“এতো খেতে অনেক সময় লাগবে।”
“সময় কেটে যাবে কথা বলতে বলতে।”
“আচ্ছা কি বলবি বল।”
চন্দ্রা তূর্ণর দিক তার প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে নিজেও প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করে আর তূর্ণকে বলে,
“আজ হসপিটালে অনেক পেশেন্ট ছিল তাই না?”
“হুম। গু`লি লেগে, আ`হ`ত হয়ে এক এক জনের বাজে অবস্থা হয়েছে একদম৷”
“অনেকেই মা`রা গিয়েছে তাই না?”
“হুম।”
“ইভাপুর কি খবর?”
“আছে।”
“জ্বালায় নি আজ?”
“সময় কোথায়? তাও লাস্টে এসে জ্ঞান দিচ্ছিলো। ভাল্লাগে না।”
“জ্ঞান দেয় না। তোমার চিন্তা করেই করে। তুমি তো যা করো না।”
“ওর কথা বাদ দিবি প্লিজ?”
“আচ্ছা ঠিকাছে।”
কিছুক্ষণ পর চন্দ্রা আবার বলল,
“প্রণয় ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে তোমার?”
“এই না রে। ফোন করেছিল সন্ধ্যাবেলায়। ব্যাক করার সময় পাই নি আর।”
“বাসায় এসেছিলেন।”
“ওহ্ তাই নাকি? কখন?”
“এই তো সন্ধ্যাবেলা।”
“ওহ্।”
“বললাম তুমি নেই। বললেন সে নাকি নানা নানুর সাথে দেখা করতে এসেছেন।”
“ওহ্। তা দাদুর সাথে দেখা হওয়ার পর বলেনি, আরেকটা বিয়ে করতে।”
চন্দ্রা হেসে বলল,
“তা আবার কবে না বলে?”
“সেইটাই। ওর আর বিয়ে করে কি হবে? একটা তো করেছিলো। এখন মেয়েটাকে নিয়ে ভালো আছে। বাবা মেয়ে ভালো থাকবে। মেয়ের যত্ন নিবে।”
“ভাইয়া জানো, উনি মেয়েটার যত্ন নেন না। সব আন্টির উপর ছেড়ে দিয়েছে। আন্টির তো বয়স হয়েছে। আর হেল্পিং হ্যান্ড কি ওভাবে বাচ্চার যত্ন নেয় নাকি! উনি বাবা, ওনার উচিত সময় দেওয়া। মেয়েটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।”
“ওর কি আর এতো সময় আছে? সারাদিন অফিস নিয়েই থাকে। তাও ও যেটুকু করে, ওটাই অনেক। কয়জন বাবা এতো সময় দেয় সন্তানকে? আমার বাবা মা কে দেখিস নি?”
এই বলে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে তূর্ণ।
চন্দ্রা বিরক্ত হয়ে বলল,
“আবার সেই কথা! উফ! দেখো প্রণয় ভাইয়া ওরকম না। ওহ্ শুনো না একটা কথা।”
“বল।”
“আমার না প্রণয়িনীর সাথে সময় কাটাতে অনেক ভালো লাগে। আমি প্রণয় ভাইয়াকে বলেছি ছুটির দিনগুলোতে যেন প্রণয়িনীকে আমার কাছে দিয়ে যায়।”
“তোর কাছে?”
“হ্যাঁ।”
“তুই বাচ্চা সামলাতে পারিস নাকি?”
“কেন পারব না? অবশ্যই পারব। আর আমি চাই প্রণয়িনী যেন একটা সঙ্গ পাক। এইজন্য। বাচ্চাটাকে এতো ভালো লাগে! ওর সাথে আমি আসলেই সময় কাটাতে চাই।”
“সেটা বুঝলাম। কিন্তু প্রণয় কি বলেছে?”
“রাজি করিয়ে নিয়েছি।”
“বাহ্। বেশ তো। দুটো বাচ্চা মিলে এক সাথে খেলা করবে।”
“এই কি বললে তুমি?”
“কিছু না।”
দুই ভাই বোনই হাসলো।
তূর্ণ খাওয়া শেষ টেবিল থেকে উঠে চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ভাইয়া খেয়ে নিয়েছি। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাও। যাও। সকালে ক্লাস আছে না?”
চন্দ্রা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“আচ্ছা। তুমিও ঘুমিয়ে যাও।”

.
তূর্ণ রুমে এসে খাটে বসল। চশমাটা খুলে রাখলো। তারপর ফোনটা হাতে নিতেই মনে পড়লো প্রণয়কে ফোন করতে হবে। প্রণয়কে ফোন দিল।
প্রণয় ঘুমন্ত মেয়ের পাশে বসে তাকিয়ে ছিল। প্রতিদিনই প্রণয় এভাবে তার ঘুমন্ত মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ফুটফুটে মেয়েটা! অথচ বাবা হিসেবে প্রতিটা মুহূর্তে যেন নিজেকে ব্যর্থ লাগে। চায় মেয়েটাকে ভালোবাসায় আগলে বড় করতে। অনেকেই বলে প্রণয়ের নিজের মেয়ে নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু বাস্তবে মেয়েকে সে চোখে হারায়।
ঘুমন্ত মেয়ের ছোট ছোট হাতগুলো হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে দেয় প্রণয়। হঠাৎ মনে পড়ে চন্দ্রার কথা। চন্দ্রা বলেছিল, মেয়েটা বড় হচ্ছে। বাবার সঙ্গ পেতে চায়। প্রণয় ভাবলো সত্যিই এখন থেকে প্রণয়িনীর সাথে সময় কাটাবে।
প্রণয়িনীর কপালে চুমু খেয়ে প্রণয় বলল,
“তোর চন্দ্রা আন্টি বলেছে তোকে সময় দিতে। এখন থেকে সত্যিই তোকে সময় দিবো মা। আমার বেঁচে থাকার মানেই তুই আর তোর চন্দ্রা আন্টি।”

হঠাৎ প্রণয়ের পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠে। তূর্ণ ফোন করেছে। প্রণয় ফোন রিসিভ করে বলল,
“কি খবর ডাক্তার সাহেব?”
“এই তো। সারাদিন হসপিটালে দৌড়ে যা হয়। তুই বল, তোর কি খবর?”
“এই তো ভালো।”
“প্রণয়িনী কেমন আছে?”
“ভালো আছে। ঘুমাচ্ছে।”
“চন্দ্রার সাথে কথা হলো। বলল তুই এসেছিলি।”
“হুম। দেখা করতে গিয়েছিলাম সবার সাথে। আর চন্দ্রার সাথে। মেয়েটা মোটামুটি শান্ত আছে কয়টাদিন।”
“কিসের শান্ত! কাল রাতেও যা করেছে।”
একটু ঘাবড়ে গিয়ে প্রণয় জিজ্ঞেস করলো,
“কি করেছে?”
তূর্ণ আগেরদিনের ঘটে যাওয়া কাহিনি বলল প্রণয়কে। সেগুলো শুনে প্রণয়ের মাথা গরম হয়ে গেল৷ প্রণয়ের এই জিনিসটা একদমই সহ্য হয় না যে চন্দ্রা নিজেকে আঘাত করুক।
প্রণয় বলল,
“তোর বোন কি বুঝবে না?”
“কি করব? বুঝাতে পারিনি তো।”
ফোনের এপাশে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে প্রণয়৷
তূর্ণ বলল,
“শুনলাম চন্দ্রা নাকি প্রণয়িনীর সাথে সময় কাটাতে চায়।”
প্রণয় প্রণয়িনীর দিক তাকিয়ে বলে,
“হুম। বলল তো ছুটির দিনগুলো কাটাতে চায়।”
“ভালো তো। বাচ্চাদের সাথে থাকলে ওর মন ভালো থাকবে।”
“হ্যাঁ এই জন্য ও বলার পরেই আমি রাজি হয়ে গিয়েছি। আমার মেয়েটাও একটা সঙ্গ পাবে আর চন্দ্রাও।”
“হুম। আচ্ছা রাখছি৷ ঘুমা। আমিও ঘুমাই।”
“আচ্ছা। গুডনাইট।”
ফোন রেখে প্রণয় গিয়ে প্রণয়িনীর পাশে শুয়ে পড়ে।

.
তূর্ণ কল কাটার পর খেয়াল করলো ডায়াল লিস্টে একটা নাম্বার। তারপরেই মনে পড়লো তার ফোনটা সে পরশিকে দিয়েছিল। হঠাৎ করে কেন যেন আবার মেয়েটির চেহারা ভেসে উঠলো। তার সেই কাঁদো কাঁদো গলাটা মনে পড়ে গেলো। মেয়েটার কথা ভাবতেই খারাপ লাগতে লাগলো।মনে প্রশ্ন আসলো,
“ভদ্রমহিলা কি ঘুমাতে পেরেছেন? নাকি এখনো মন খারাপ করে বসে আছেন?”
তূর্ণর ভেবে খুব খারাপ লাগছে। সত্যিই সবার বাবা মা এমন হয়? তার বাবা মা যেমন তাকে কখনো ভালোবাসেনি, তার কথা ভাবেনি, সে রকম কি পরশির ক্ষেত্রেও? তূর্ণর তো তাও দাদা দাদি, চন্দ্রা এরা ছিল। পরশির তো তাও নেই৷ মেয়েটা গু`লি লেগে মৃ`ত্যু শয্যা থেকে ফিরে এসেছে। অথচ কেউ একজন আসলো না? আচ্ছা হসপিটালে রাতে যদি ওর কিছু লাগে তাহলে কাকে বলবে? পাশে থাকার একটা মানুষও নেই। যেই মেয়ে সবার কথা কতটা ভাবে! মানুষকে বাঁচানোর জন্য জীবনের চিন্তা করে না, এমনকি একটা বাচ্চাকে তার বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে নিজের জীবনের চিন্তা করেনি, সেই মেয়ের জন্য চিন্তা করার মতো একটাও মানুষ নেই এই পৃথিবীতে!
আচ্ছা ওর জন্য কেউ তো চিন্তা করছে না। তাহলে ও কেন চিন্তা করছে? এই পৃথিবীতে কি ওর জন্য চিন্তা করার শুধু তূর্ণই আছে? না তা হবে কেন?
এসব কি ভাবছ তূর্ণ? ও বুঝতে পারলো না।
নিজেকে সব ধরনের চিন্তার জগৎ থেকে বাহিরে নিয়ে এসে একটু ঘুমাতে চায় তূর্ণ। জোর করে চোখের পাতাদুটো এক করতে চাইলেও পারে না।
কিছুক্ষণ পরেই আবার চিন্তায় মায়াবী সেই মেয়েটার চেহারা ভেসে উঠে।
তূর্ণ শোয়া থেকে উঠে পরে। আজ আর ঘুম হবে না তার। কিন্তু কেন? এমন তো হয় না?

চলবে……

ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ৮

তূর্ণ সকাল সকাল বেড়িয়ে যায় হসপিটালের জন্য৷ এতো তাড়াতাড়ি তূর্ণকে হসপিটালে দেখে তার এ্যাসিসট্যান্ট জিজ্ঞেস করলেন,
“স্যার কোনো সমস্যা?”
“না। কোনো সমস্যা না। সকলে ঠিক আছে তো কাল যারা যারা আ`হ`ত হয়েছিল?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা।”
“আর কিছু স্যার?”
তূর্ণর মাথায় কেন যেন পরশির কথাই গেঁথে গিয়েছে। তবে সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। না, অন্য কারো কাছে না, নিজের কাছেই প্রকাশ করতে পারছে না। কিসের যেন একটা সংকোচ। কিন্তু কিসের সংকোচ? তাও তো জানা নেই তূর্ণর। তূর্ণ একটু চোখ বন্ধ করে সবটা ভুলার চেষ্টা করে। অথচ, মাথায় পরশির কথাই আসে। ভীষণ আশ্চর্য ব্যাপার! এই পেশেন্টের জন্য এমন কেন হচ্ছে? প্রতিনিয়ত কতো পেশেন্টের কত গল্প শুনে। এই মেয়ের গল্পে কিংবা এই মেয়ের মধ্যে কি আছে? কেনই বা এই মেয়ের গল্প শুনতে হন্য হয়ে হয়েছিল? এটার উত্তর অবশ্য তূর্ণ পায়। পরশির শীতল চোখের অশ্রু! এই অশ্রুতে যেন পরশির দুঃখ ছিল। মনে গাঁথা হাজারো কষ্ট। যা তূর্ণর মনের ভীতর খোঁচাচ্ছিল। তূর্ণ হঠাৎ মন চেয়েছিল গল্প শুনে পরশির কষ্ট কমাতে। কিন্তু কেন? আবার এই প্রশ্নে এসে ঠেকে গেল তূর্ণ। নিজেকে প্রশ্ন করেই নিজে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে তূর্ণ।
তূর্ণর এ্যাসিসট্যান্ট বুঝতে পারছে না কি করবে। বেচারা তূর্ণর উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তূর্ণ মনে হচ্ছে গভীর ভাবনার ভীড়ে হারিয়ে গিয়েছে। সে তূর্ণকে জিজ্ঞেস করলো,
“স্যার।”
তূর্ণ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে চোখ খুলে বলে,
“হুম।”
“কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত স্যার?”
তূর্ণ বেখেয়ালে হুম বলেও পরে বলল,
“না।”
“স্যার আমি আসি?”
“না।”
“কিছু বলবেন?”
“আজ অপারেশন আছে কি?”
“হ্যাঁ। দুটো আছে। সেটাও তো রাতে সময় দিয়েছিলেন।”
“ওহ্। আচ্ছা ঠিকাছে। এখন তো রোগী নেই। আমি বরং রাউন্ডের জন্য যাই।”
“এতো তাড়াতাড়ি?”
“হ্যাঁ। এতোটাও তাড়াতাড়ি না।”
“আচ্ছা স্যার। আপনি যা ভালো মনে করেন।”
“হুম।”

.
তূর্ণ রাউন্ডে গিয়ে সব রোগী দেখছে। সে ইচ্ছে করে কেন যেন পরশিকে এড়িয়ে গেল। তার কেবিনের দরজার সামনে দিয়ে গেলেও তার রুমে গেল না৷ সাথে থাকা নার্স আর জুনিয়র ডাক্তার জিজ্ঞেসও করলো,
“স্যার এখানেও তো আপনার পেশেন্ট। যাবেন না?”
“হুম। কিন্তু পরে। উনি কালকে একটু লেট করে ঘুমিয়েছিল। ডিস্টার্ব না করি।”
তূর্ণ এই কথায় সবাই অবাক হলেও কিছুই বলল না। তূর্ণও জানে না সে কেমন এমন করলো! একটু আগেই তো পরশির খবর জানার জন্য ছটফট করছিল। অথচ এখন মনে হচ্ছে পরে যাবে!

.
পরশি ঘুমিয়েছিল। একজন পুলিশ এসে পরশিকে ডেকে জানালো তার বস আসবেন একটু পর দেখা করতে। পরশি সেভাবেই প্রস্তুত হয়েছিল। এর মধ্যেই তূর্ণ আসলো। তূর্ণ এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন কেমন ফিল করছেন অফিসার?”
পরশি সামান্য হেসে বলল,
“বেটার।”
“মানসিকভাবে?”
“ভালো।”
“পিঠে কি ব্যাথা হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, হয়েছিল একটু রাতে।”
“নার্সকে ডাকেন নি? ওষুধ দেয়নি? আমি তো বলেছিলাম ব্যথা বাড়লে ওষুধ দিতে।”
“না ডাকা হয় নি।”
“তাহলে তো ঘুমও হয়নি নিশ্চয়ই।”
“না ঘুমিয়েছিলাম একটু। তবে ব্যথায় অল্প কষ্ট হয়েছিল।”
“নেক্সট টাইম থেকে এমন করবেন না। অবশ্যই নার্সকে ডাকবেন।”
“ঠিকাছে।”
তূর্ণ পরশির চেকাপ করছিল। এর মাঝেই পরশির বস চলে আসলেন। পরশি উঠে বসতে চাইলে তূর্ণ বলল,
“উঠবেন না। ব্যাকে ব্যথা লাগবে।”

পরশির বস বললেন,
“প্লিজ অফিসার উঠবেন না। আপনি রেস্ট নেন। দেখা করতে আসলাম। ধন্যবাদ জানাতে এসেছি৷ মূলত আপনাকে কেউ স্পেশাল থ্যাংক দিয়েছে।”
পরশি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“স্যার এটা তো আমার কর্তব্য। কিন্তু কে স্পেশালি আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন স্যার? জানতে পারি কি?”
“কালকের দুর্ঘটনায় আপনি একটা বাচ্চাকে বাঁচিয়লছিলেন। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়েই তো আপনি আহত হয়েছিলেন। বাচ্চার বাবা মা ভীষণ সন্তুষ্ট। বাচ্চার বাবার হাত অনেক দূর পর্যন্ত । উপর মহলে। ডিআইজি স্যারকে ফোন করে স্পেশালি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আপনার কথাও বলেছেন।”
কথাগুলো তূর্ন শুনছিল। সে পরশির কাজকর্মের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
পরশি বলল,
“স্যার, এতোটুকু ব্যাপারের জন্য ডিআইজি স্যারকে ফোন করেছেন লোকটা!”
“জি। বুঝেন না, যার হাত যতোদূর। তবে আপনাকে আর আপনার টিমকে অভিনন্দন৷ আপনারা অনেক ভালো কাজ করেছেন। সত্যিই প্রশংসনীয়।”
“অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। আমার দেশের প্রতি এটা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য।”
“আচ্ছা আপনি রেস্ট নেন। আমি আসি।”
এই বলে পরশির বস চলে গেলেন। তূর্ণ এতোক্ষণ দাড়িয়েছিল। তূর্ণ পরশিকে বললেন,
“এই বাচ্চাটার কথাই কাল বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ। বেশ চিন্তিত ছিলাম বাচ্চাটাকে নিয়ে। স্যারের কথা শুনে শান্ত হতে পেরেছি।”
তূর্ণ একটু অবাক। এটা শুধু একজন পুলিশ হিসেবে পরশি যেমন দায়িত্বশীল, মানবতার দিক দিয়ে পরশি অসাধারণ!
তূর্ণ আর কিছুই বলে না। শুধু বলল,
“আসি। কোনো সমস্যা হলে নার্সকে জানাবেন।”
এই বলে চলে গেল।

.
সন্ধ্যাবেলা তূর্ণ আবার যাচ্ছিলো পরশির কাছে। একদিনে সে কোনো ইমার্জেন্সি ছাড়া সাধারণ দ্বিতীয়বার পেশেন্টের চেকাপে যায় না। কিন্তু কেন যেন পরশির সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে। তূর্ণ নিজ মনে বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলো,
ভদ্রমহিলা বড়ই অদ্ভুত! কাল পেইন হয়েছে তাও নার্সকে ডেকে বলেনি৷ ব্যথা নিয়েই নাকি ওভাবে ঘুমিয়েছে। একদম কেয়ারলেস নিজের ব্যাপারে। অথচ কাজের দিকে একদমই কেয়ারলেস বলে মনে হয় না।
তূর্ণর পরক্ষণেই মনে হলো পরশির যত্ন নেওয়ার জন্য তো কেউ নেই। পরিবারের কেউ নেই ওর পাশে। সব পেশেন্টই অসুস্থ হলে তাদের কাছের মানুষেরা পাশে থাকে। পরশি কি এতোটাই একা? তার এমন সময়ও আপন কেউ নেই? পরশির বাবা মাও কি সেপারেটেড? হয় তো তাই হবে। না হলে এভাবে অযত্নে কেন থাকবেন?
তূর্ণ পরশির রুমের দিক গিয়ে দেখলো দরজাটা খোলা। কথার আওয়াজ আসছে। রুমে কোনো পুরুষ মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কথা শুনা যাচ্ছে। তূর্ণ খেয়াল করে দেখলো পরশি একটু উত্তেজিত হয়েই বলছে,
“জানিয়ে কি লাভ হতো? আমার কিছু হলে কি তোমরা খোঁজ নিতে? জানো পুলিশের চাকরি করি। তারপরেও এতো বড় দুর্ঘটনা হয়ে যাওয়ার পর কি আমার খোঁজ করেছিলে?”
“তোর দায়িত্ব ছিল এটা জানানো।”
লোকটার কথাগুলো শুনেও বুঝা যাচ্ছে বেশ রেগে আছেন। কিন্তু লোকটা কে? তূর্ণর মনে প্রশ্ন জাগে।
পরশি বলল,
“সব আমার দায়িত্ব? দায়িত্ব! আর কত দায়িত্ব চাপাবে আমার উপর? মরে গেলেও আমার উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিও নিজের দাফনের।”
“পরশি! বেশি বাড়াবাড়ি করবি না। তুই অসুস্থ, এটা না জানালে কিভাবে জানবো? জানাস নি, জেনেছি। এসেছি। তাও এরকম ব্যবহার করছিস? তোর মতো মেয়ে পেয়ে আমার বাবা মায়ের অপমান। সত্যি বলেছিস, তুই মরলে কারো কিছু যায় আসবে না। একটা বোঝা যাবে বাবা মায়ের উপর থেকে। কি করেছিস? দিন দিন টেনশন দিয়ে গিয়েছিস সবাইকে। তারপর আবার সমাজে তোর জন্য কথাও শুনতে হয়। তুই থাক এখানে। কেউ আসবে না। আমার ভুল এসেছিলাম৷ পারলে আর বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। প্লিজ আসিস না। তোর জন্য এমনিই পরিবারে ঝামেলা হয়। আমার সংসারেও ঝামেলা করিস তুই। চাকরি করিস! পুলিশ অফিসার হওয়ার যোগ্যতা রাখিস কি করে? এতোটুকুতেই তো নেতিয়ে পরলি। গুলি খেয়ে পরে আছিস।”
তূর্ণ বাহির থেকে এগুলো শুনে আর নিজেকে আটকাতে পারলো না নিজেকে। কেমন লোক কে জানে! এরকম করে কথা বলার মানে কি? তূর্ণ রুমে ঢুকে গিয়ে পরশির ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এক্সকিউজমি। আপনার কি সমস্যা জানতে পারি? এটা হসপিটাল। এখানে এসে এভাবে চেঁচামেচি করে সকলকে ডিস্টার্ব করার কোনো রাইট আপনার নেই।”
পরশির ভাই কপাল কু্ঁচকে তূর্ণ দিক তাকিয়ে বলল,
“দেখুন এটা আমাদের পারসোনাল ম্যাটার। ইন্টারফেয়ার করবেন না।”
“আমি পারসোনাল ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করিনি। আপনি হসপিটালের ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করছেন না। উনি অসুস্থ। ওনার সাথে এখন এভাবে কথা বলবেন না৷ পারসোনাল ম্যাটার পারসোনালি হ্যান্ডেল করুন। বাড়িতে বসে হ্যান্ডেল করুন। হসপিটালে না৷ এখানে অনেক রোগী, ডাক্তার, স্টাফ আছেন। সকলের কাজে ব্যাঘাত ঘটে এসবের মধ্যে দিয়ে। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি।”
পরশি তূর্ণর কথাগুলো শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল। তার ভাইয়ের এমন ব্যবহারের কারণে সে ভীষণ লজ্জিত। পরশির ভীষণ রাগ হচ্ছে ভাইয়ের উপর। পরশি ঠান্ডা গলায় বলল,
“ভাইয়া, প্লিজ চলে যা। আর আসার দরকার নেই। বাবা মা যদি জানতে চায় তাহলে বলিস বেঁচে আছি। ভালো আছি৷”
পরশির ভাই রাগে গজগজ করতে করতে বেড়িয়ে যায়। পরশি তূর্ণকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি ভীষণ দুঃখিত। ভীষণ লজ্জিত। আমার জন্য আপনাদের সকলের সমস্যা হয়েছে। আই এ্যাম সরি৷”
“না না, আপনার কোনো দোষ নেই।”
“না, আমার জন্যই তো।”
“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, ক্যান আই আস্ক আ পারসোনাল কোয়েসচেন?”
“জী।”
“ভদ্রলোক কে ছিলেন? আর আপনার সাথে এভাবে কেন কথা বলছিলেন?”
তূর্ণর কন্ঠে বেশ উত্তেজনা। বোঝা যাচ্ছে লোকটার উপর সে ক্ষুব্ধ হয়ে আছে।
পরশি শান্ত কন্ঠে বলল,
“আমার বড় ভাই। কিভাবে যেন জানতে পেরেছে আমার কথা। তাই কথা শুনাতে এসেছিল। আমি কেন বাসায় জানাইনি এগুলো।”
“আশ্চর্য! এতোটুকু তো বোঝার কথা, একটা মানুষ এভাবে গু`লি`বি`দ্ধ অবস্থায় কিভাবে জানাবে? আর আপনি তো গিয়েছিলেন একটা মিশনে। তা কি জানেন না আপনার পরিবারের লোকজন?”
পরশি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“সে সব কোনো কিছুই না। আমার দায়িত্ব বাসায় জানানো। আর আমি দায়িত্ব আমি পালন করিনি।”
“খুবই অদ্ভুত তো!”
“সে সব বাদ দিন তো। আমার জন্য আপনার সময় নষ্ট হলো। আই এ্যাম সরি।”
“না না আমি ফ্রি আছি।”
“বাসায় যাবেন না?”
“না, ঘন্টাখানেক পর একটা ওটি। তারপর।”
“ওহ্।”
“আসলে হঠাৎ মনে হলো, আপনি মানসিকভাবে আবার অসুস্থ হয়ে গেলেন। তাই মনে হচ্ছে আমার কথা বলা উচিত।”
পরশি সামান্য হাসলো। এই ডাক্তারটা খুব বেশিই ফ্রেন্ডলি। এতোটা ফ্রেন্ডলি আর কোনো ডাক্তার আছে নাকি তা পরশির জানা নেই। হয় তো আছে। মানুষটা অনেক ভালো। কথা দিয়ে যে ডাক্তারটা রোগীকে অর্ধেক সুস্থ করে ফেলতে পারেন, এমন একটা কথা প্রায়ই মানুষ বলে। তূর্ণ মনে হয় সেই প্রকৃতিরই ডাক্তার।
“আমার কলিগ ছিলেন না? অফিসার রিফান? হাতে গু`লি লেগেছিল? উনার খবর কি জানেন?”
“না উনি আমার পেশেন্ট না। তবে শুনেছি ভালো আছেন।”
“ওহ্ আচ্ছা।”
“আপনার দেখাশোনা করার জন্য কেউ নেই? কিছু লাগলে কাকে বলেন?”
“আমার অফিসের লোকজন আমায় ভীষণ ভালো জানেন। কিছু বললে স্যার স্যার করে সব করে দেয় হাসিমুখে। আজ বলেছিলাম একটা ফোন এনে দিতে। এনে দিয়েছে।”
“বাহ্ ভালো তো।”
“হুম।”
তূর্ণ বুঝতে পারছিল না কি বলবে। তাই সে পরশিকে বলল,
“আচ্ছা কাজ আছে। এখন আসি। কোনো কিছুর দরকার হলে অবশ্যই জানাবেন। আর আজকে আগে থেকেই ওষুধ দেওয়া হয়েছে আপনাকে। ভালোভাবে ঘুমাতে পারবেন।”
“ধন্যবাদ।”
তূর্ণ চলে যায়। পরশি তার যাওয়ার দিক কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর শুয়ে পড়ে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here