ভালোবাসা কারে কয়,১৩,১৪

0
189

ভালোবাসা কারে কয়,১৩,১৪
শবনম মারিয়া
পর্ব ১৩

চন্দ্রা রাত জেগে পড়ছিল। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। এতো রাতে কে ওকে ফোন করল? সাধারণত চন্দ্রার তেমন বন্ধু নেই। সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে। ক্লাসের খোঁজ খবরের জন্য অল্প কয়েকটা মেয়ের সাথে একটু যোগাযোগ রাখে। তাই এতো রাতে চন্দ্রাকে কেউ ফোন করবে প্রশ্নই আসে না। হঠাৎ করে প্রণয়ের কথা মাথায় আসলো। হ্যাঁ, প্রণয় প্রায়ই ফোন করে। চন্দ্রা স্টাডি টেবিলে বসে ছিল। উঠে গিয়ে ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন প্রণয়ের সাথে। লোকটা অনেকক্ষণ বসে বসে পেঁচিয়ে কথা বলবে। প্রণয়ের কথা প্রায়ই মাঝে মাঝে বুঝে না৷ কি রকম যেন কথা বলে ফেলে। এখন নিশ্চয়ই জ্ঞান দিবে কতক্ষণ। এটা করবে না, ওটা করবে না। এই তূর্ণ আর প্রণয় দুজনেই এক কাজ করে। চন্দ্রাকে কোনো কিছু থেকে থামানো যায় না জেনেও ওকে মানা করে কি লাভ?
ফোনটা কেটে গেল। প্রণয় আবার ফোন দিল। প্রণের ভালো করেই জানা আছে চন্দ্রা আরেকটু দেরি করে ঘুমায়। ফোনটা আবার বেজে ওঠার পর বাধ্য হয়ে উঠে ফোনটা রিসিভ করল। রিসিভ করে চন্দ্রা সালাম দিল। প্রণয় সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছো?”
“ভালো। আপনি?”
“ভালো। আরও ভালো লাগল আমি কেমন আছি তাও জানতে চেয়েছো দেখে। সাধারণ খুব কমই জিজ্ঞেস কর।”
“মানে? আপনার এসব কথাই বুঝি না। আপনি কেমন কেমন করে যেন কথা বলেন।”
“ভাগ্যিস বুঝো না।”
“জি?”
“কিছু না। বলছিলাম আমার মতো মানুষকে বুঝার দরকার নেই।”
“এতো ভালো মানুষ হয়েও এরকম কথা বলেন!”
“আমি ভালো মানুষ?”
“অবশ্যই। আপনি ভালো নয় তো কি আমি ভালো মানুষ?”
বলে ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় চন্দ্রা।
“কে বলেছে তুমি খারাপ?”
“কেউ বলে নি। কেউ তো জানে না। তাই বলেও না। তবে আপনার কি মনে হয় আমি ভালো মানুষ? ভালো মানুষ হলে কেউ এসব করে?”
“তুমি ভালো মানুষ চন্দ্রা। তবে….” বলে থেমে যায়। চন্দ্রা হেসে বলল,
“তবে কি? হা হা হা।”
“তুমি ভালো। কিন্তু তোমার ঐ কাজটা…. ”
থেমে গিয়ে আবার বলে,
“ঐ কাজটা ভালো নাকি খারাপ তা বলতে পারি না৷ জানি না আমি। আমার শুধু তোমার জন্য চিন্তা হয়। এটা সঠিক পথ নয় চন্দ্রা। এতে তোমার ক্ষতি।”
“আমার জন্য কেন এতো চিন্তা?”
এই কথার উত্তর জানা নেই প্রণয়ের। আবার হয় তো জানা আছে। তবে এটা সে কখনো অন্য কাউকে জানাতে চায় না। এই কথাগুলো কাউকে বলা যায় না। এই অনুভূতিগুলো কাউকে বলা যায়। হ্যাঁ, মন কেমন করে। মনে হয় সত্যি কথাটা বলে দিলে বুঁকের থেকে বড় একটা বোঝা নেমে যাবে। কিন্তু ভয় হয়। এই কথা বলাতে যদি মানুষটা যেটুকু কাছে আছে সেটুকু কাছেও যদি তাকে না পাওয়া যায়? যদি তাকে হারিয়ে ফেলে একেবারের জন্য। যদি তার ঘৃণা পায়। তার থেকে এই মনে সুপ্ত কথাগুলো, এই অনুভূতিগুলো লুকিয়ে থাকুক। কেউ না জানুক। আর যাকে নিয়ে অনুভূতি সে একদমই না জানুৃক।
প্রণয় বলল,
“কেন করি? জানো না? তুমি তূর্ণর বোন। তূর্ণকে আমি আপন ভাই থেকে কম কিছু মনে করি না। ওর জন্য জান দিয়ে দিতে পারি। যা করি ওর জন্যই করি। তোমার কিছু হোক তা আমি আর তূর্ণ চাই না।”
“আমারও ভয় লাগে না। চিন্তা হয় না। কারণ আমি জানি আপনি আর তূর্ণ ভাইয়া আমার কোনো রকমের ক্ষতি হতে দিবেন না। আমার কোনো ক্ষতি হয় না। আমি কেন যেন এগুলোতে শান্তি পাই। বলেন আপনি সবসময় আমাকে বাঁচাবেন না? কখনো আমার ক্ষতি হতে দিবেন?”
“কখনোই না। যতদিন বেঁচে থাকব তোমার তোমার কোনো ক্ষতি হবে না চন্দ্রা। তবে কি নিজেকে আঘত করাটা বন্ধ করতে পারো? রেগুলার মেডিসিন নিবে৷ বাহিরে সবার সাথে মিশবে। কথা বলবে। হাসবে।”
“নিজেকে এখন বেশি একটা আ`ঘা`ত করি না৷ কিন্তু মাঝে মাঝে রাগ উঠে, নিজেকে বিরক্ত লাগে। তখন আ`ঘা`ত করতে ইচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেছি ঘুমের ওষুধ না নিয়ে ঘুমাতে। কিন্তু পারি না। চোখ বন্ধ করলে মায়ের চেহারা ভেসে উঠে। মা কেঁদে কেঁদে বলে, এই পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষেরা ঠকায়৷ তখন উঠে নিজেকে আ`ঘা`ত করি বাধ্য হয়ে। মন চায় মরে যাই।”
বলতে বলতে কান্না শুরু করে চন্দ্রা। প্রণয়ের কষ্ট হয় চন্দ্রার কান্না জড়ানো কন্ঠ শুনে। মন চায় একটু জড়িয়ে ধরতে পারত! একটু কাছে টেনে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলতে পারতো, চন্দ্রমল্লিকা কান্না করবে না। আমি আছি তো। ভালোবাসায় সবাই ঠকায় না চন্দ্রমল্লিকা। কেউ কেউ ভালোবাসতে জানে। পাগলের মতো ভালোবাসতে জানে৷ তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখব। আর ওরকম দুঃস্বপ্ন দেখবে না তুমি৷
কিন্তু প্রণয় তা বাস্তবে বলতে পারে না। তবুও বলে,
“চন্দ্রমল্লিকা! কান্না করো না। তুমি অনেক শক্ত মনের। তুমি ভেঙে যাওয়ার মতো মেয়ে না। তোমার মধ্যে আ`গু`ন আছে। সেই আ`গু`ন এভাবে অশ্রুরূপে ফেলে নষ্ট করো না। তুমি ঘুমাতে পারো না তো? আচ্ছা এক কাজ করা যায়।”
চন্দ্রা কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি কাজ?”
“তুমি এভাবেই আমার সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমাবে। দেখো ওসব ভুলে যাবে।”
“কিন্তু আপনি কেন রাত জেগে আমার সাথে কথা বলে আমাকে ঘুমাতে সাহায্য করবেন?”
“একটু চেষ্টা করব। হয় তো সবসময় পারব না সময়ের অভাবে। কিন্তু যেটুকু পারি।”
“আচ্ছা।”
চন্দ্রার আরও কান্না পাচ্ছে। কেন প্রণয় ওর জন্য এতোটা করতে চায়? কেন ভাবে ওর কথা?
প্রণয় বলল,
“আবার কি ভেবে কান্না বাড়িয়ে দিলে?”
“কোথায়? না তো।”
“আচ্ছা। এবার লাইট অফ করে শুয়ে পড়ো। আর আমার সাথে গল্প কর।”
চন্দ্রা লাইট অফ করে প্রণয়ের কথামতো শুয়ে পড়ল। তারপর বলল,
“শুয়েছি।”
“লেখাপড়া কেমন যাচ্ছে?”
“ভালোই।”
“ফাইনাল কবে?”
“দুইমাস পর।”
“পরীক্ষা শেষে কি করবে কিছু প্ল্যান করেছো?”
“বিয়ে।”
“কিহ্?”
চন্দ্রা হেসে দিল। এতক্ষণ পর মনে হয় আবার প্রণয় চন্দ্রার সেই সুন্দর হাসিটা শুনতে পেল। এই হাসিটা শোনার জন্য যেন এতক্ষণ কাতর হয়েছিল মনটা।”
চন্দ্রা বলল,
“নানু বলে। কালও বলেছে পরীক্ষার পরেই নাকি ছেলে দেখা শুরু করবে।”
“তুমি বিয়ে করবে?”
“মনে হয় আপনার? আমি কাউকে ভালোবাসতে পারব?”
“আচ্ছা, ওসব কথা বাদ দাও।”
“হুম।”
“জব নিয়ে ভেবেছো কিছু?”
“না, আগে তো ইন্টার্নশিপ করতে হবে।”
“দরকার হলে আমাকে বলো। আমাদের কোম্পানিতে প্রায়ই ইন্টার্ন হায়ার করে।”
“আচ্ছা। আগে পরীক্ষাটা হোক। তারপর।”

কথা বলতে বলতে সত্যিই চন্দ্রা ঘুমিয়ে পড়েছে।প্রণয় বুঝতে পেরে খুশি হলো। খুব ভালো লাগছে। ফোনটা রেখে প্রণয়িনীর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“তোর বাবা এতটাও অপদার্থ না। চন্দ্রা আন্টিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।”
প্রণয়িনী ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠে। তারপর হঠাৎ করে বাবার গায়ের উপর হাত পা তুলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে। প্রণয়ের বড় শান্তি লাগে। তার জীবনটা তার মাঝে মাঝে খুব ভালো লাগে। তার এই জীবনে চন্দ্রা আর প্রণয়িনী আছে বলে।

.
সকালবেলা এদানিং পরশি একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠছে। ওষুধের জন্য ঘুম কাটেই না। ছুটিতে আছে বলে অসুবিধা নেই। ঘুম থেকে উঠে সময় দেখার জন্য ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অফিস থেকে ফোন এসেছিল। পরশি কলব্যাক করে জিজ্ঞেস করল,
“বলুন, কোনো খোঁজ পেয়েছেন ঐ মেয়ের?”
“জি স্যার। মেয়ে গত এক বছর ধরে সিলেট। তার শ্বশুরবাড়ি।”
“তার মানে মেয়েটার বিয়ে হয়েছে?”
“জি স্যার। বিয়ে পারিবারিক ভাবে।”
“মেয়েটার সাথে ছেলেটার কিছুদিন সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এরপর আর সম্পর্ক টিকে নি। এরপর আর যোগাযোগ হয় নি অনেকদিন।”
“আচ্ছা। এই কেস এখানেই বন্ধ করে দাও।”
“কিন্তু স্যার?”
“উপর থেকে নির্দেশ। আমি একটা সু`ই`সা`ই`ড কেস নিয়ে কেন পড়ে আছি। ঐ মেয়ের হাজব্যান্ডও পুলিশে আছেন। আর এখানে উনার ওয়াইফের কোনো হাত নেই। এটা একটা সু`ই`সা`ই`ড কেস হিসেবেই ধরে নাও।”
“আচ্ছা স্যার। আপনি বলেছিলেন বলে গত দুইদিনে আমি ওনার নিকটস্থ বন্ধুদের কাছ থেকেও খবর নিয়েছি। তারাও বলল ছেলের সাথে কারো শ`ত্রুতা নেই।”
“হুম বুঝেছি।”

পরশি ফোনটা রেখে দিল। ভাল্লাগছে না। পরশি হয় তো বেশিই ভাবে। সিম্পল কেসগুলোকে সিরিয়াস নিয়ে বসে থাকে। এতো কিছু ভেবে ভালো লাগছে না। পরশি উঠে দেখল বাসার জন্য এখনও অনেক কিছু কিনতে হবে। ছুটি আছে এই সুযোগ। এরপর সময় পাবে না। এমনিও গত দুইদিন থেকে আজ একটু ভালো লাগছে শরীরটা। পরশি বেরিয়ে গেল সাংসারিক জিনিসপত্র কেনায় উদ্দেশ্যে।
আগে ফার্নিচারের দোকানেই গেল। আগের দিন যখন রোকেয়া বেগম গিয়েছিলেন পরশি তাকে চেয়ারে বসতে দিয়েছিল । ব্যাপারটা পরশির ভালো লাগে নি। একটা সোফার দরকার। সুন্দর করে সাজাতে চায় বাসাটা পরশি। ওর মনের মতো করে।
ফার্নিচারের শো-রুমে ঢুকলো পরশি। সেখানে ফার্নিচার দেখতে দেখতে একটা সুন্দর দৃশ্যে চোখ আটকে গেল পরশির। দু’জন কপোত-কপোতী এসেছে নতুন সংসারের জন্য ফার্নিচার নিতে। তাদের কথপোকথন শোনা যাচ্ছে। স্ত্রীর পছন্দ তার স্বামীর সাথে যাচ্ছে না। আবার তার স্বামীর পছন্দও স্ত্রীর পছন্দ হচ্ছে না। শেষমেশ না পেরে লোকটা তার স্ত্রীকে বলল,
“তোমার সংসার। অবশ্যই তোমার ইচ্ছে মতো সাজাবে। তোমার যা খুশি নাও।”
এই কথাটা শুনে পরশির কারো কথা মনে পড়ে গেল। দুজনকে দেখেও পরশির দুজনের কথা মনে পড়ছে। আবছা হয়ে আসছে চোখ৷ একসময়ের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলোর কথা মনে পড়লে চোখ এভাবেই আবছা হয়ে আসে। চারপাশের সবকিছুই ঝাপসা লাগে। মনে হয় জীবনটাই ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। এই ঝাপসা জীবনের গল্পগুলো কেউ জানে না।

চলবে….

ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ১৪

পরশি অফিস থেকে ফিরে রান্না করছে। গত দুটো মাসে বাসাটা সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলেছে ইচ্ছা মতো। রান্না করতে গিয়ে অসাবধানতার কারণে হাতটা পুড়ে গেল। ভালোই পুড়েছে। পরশির আর ভালো লাগছে না। মনটা আজকে ভালোই ছিল। হঠাৎ হাতটা পুড়ে গিয়ে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। বার্ন ক্রিমও নেই বাসায়। খুব জ্বলছে হাতটা। আর কোনো উপায় না পেয়ে একটু টুথপেষ্ট নিয়ে লাগিয়ে দিল। কিছুটা হলেও জ্বলা কম মনে হচ্ছে। বিরক্ত লাগছে। করবে না রান্না। খাবে না। ভালো লাগে না। একা থাকলে এই এক সমস্যা ঠিক মত খাওয়া হয় না। রান্না করতে মন না চাইলে, রান্না করা হয় না৷ না খেয়েই ঘুমিয়ে থাকা যায়। চুলাটা বন্ধ করে রেখে দিল।
রুমে গিয়ে বসে থাকল। কান্না পাচ্ছে। একা একা কেন লাগে মাঝে মাঝে? কিসের জন্য এতো কষ্ট হয়? একা থাকার কারণে এতো কষ্ট কিসের? মানুষ তো একাই। কেউ তো নেই কারো কথা ভাবার জন্য। এই পৃথিবীতে সকলে ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। তাহলে দিন শেষে তো সকলে একাই। কেউ যদি অন্য কারো জন্য ব্যস্ত হতো, অন্য কারো জন্য সময় দিত। অন্য জনের জন্য ভাবতো তাহলে হয় তো মানুষ একা হতো না৷ কিন্তু এই পৃথিবীতে কেউ কারো জন্য ভাবে না। সকলে নিজেদের নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে। পরশিও নিজের কথাই ভাবছে। নিজের জন্য ভাবলে, নিজের ভালো করলে সেই মানুষের ভালো থাকার কথা। পরশির ভালো থাকার কথা। তবে কেন তার মাঝে মাঝে মনে হয় সে একা? কেন মনে হয় এই জীবনে পাশে কাউকে প্রয়োজন৷ কিন্তু কাউকে পাশে প্রয়োজন হলেই কি তাকে পাওয়া যায়? যায় না। মানুষ অনেক কিছুর প্রয়োজনই অনুভব করে থাকে জীবনে। অথচ সব পায় না। কোথাও এক জায়গায় না পাওয়াটা থেকেই যায়। সেভাবে একাকিত্বও থেকে যায়। এখন হয় তো পরশির মনের মধ্যে থাকা কিছু কথাগুলো যদি কাউকে বলতে পারত। যদি অল্প সময়ের জন্য কারো সাথে গল্প করতে পারত। তাহলে হয় তো ভালো লাগত।
যার সাথে পরশি জীবনের সব গল্প করতে চেয়েছিল, যার সাথে সময় কাটাতে চেয়েছিল, যার হাত ধরে সম্পূর্ণ জীবন পার করতে চেয়েছিল, সেই মানুষটাই পরশির জীবন শূন্য করে, ওকে একা ফেলে চলে গেল। তাও পরশি একা হয়েই বেঁচে আছে। এভাবেই বেঁচে থাকবে। না জীবনে নতুন কাউকে চায় না পরশি৷ অনেক মানুষ ওকে মানা করেছে এই একার জীবন কাটাতে। নতুন জীবন সঙ্গী খুঁজে নিতে বলেছিল। কিন্তু এটাও কি সম্ভব? নতুন কারো সাথে সংসার বাঁধলেই কি সে জীবন সুন্দর হবে? এর থেকে একা থাকা ভালো। মন ও মস্তিষ্কে একবার কাউকে জায়গা দেওয়া হলে তাকে ভুলানো এতোটা সহজ হয় না৷ তাকে ভুলিয়ে অন্য কারো সাথে নতুন জীবন শুরু করা সহজ না। তাই পরশি একাই থেকেছে। কিন্তু এই একাকিত্ব কেন পরশিকে মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়? কেন মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ থাকুক ওর পাশে। কেউ বুঝুক ওকে। কেউ ভাবুক ওর কথা। এগুলো করার মানুষ নেই। দরকারও নেই।
যে একা, যার মন ভালো করার জন্য এই পৃথিবীতে কেউ নেই। তার মন নিজে থেকে ভালো করতে হয়। এই ভেবে পরশি নিজের মন ভালো করতে চাইল। বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেল বারান্দায়। আজকের চাঁদটা সুন্দর। বাহিরের আবহাওয়াটাও সুন্দর। একটু ছাদে গেলে ভালোই লাগবে। পরশি ছাদে গেল।
এই বাসার ছাদটা ওর ভালো লাগে। এতোগুলো ফ্ল্যাট তাও বেশি একটা মানুষ আসে না ছাদে। খুব অল্প মানুষই আসে। তাও বিকেলবেলা। বাচ্চারা আসে খেলাধুলা করতে। আর শুক্রবার বিকেলবেলা ছাড়া পরশির ছাদে আসা হয় না। ভোরবেলা আসে। তখন দেখা হয় চন্দ্রার সাথে। ফজরের নামাজের পর প্রতিদিনই চন্দ্রা আর পরশি আসে। রাতেও আসে পরশি। এতো উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে রাতের বেলা শহরটাকে সুন্দর লাগে। আশপাশে কি-ই বা দেখা যায়? এমন উঁচু বিল্ডিংগুলোই তো। তাও একটা শান্তি আছে। উপরে তাকিয়ে আকাশ দেখা যায়। অন্ধকার আকাশ দেখতেও ভালো লাগে। পূর্ণিমার সময় রাতের আকাশটাকে আরও ভালো লাগে। বাতাসটা যখন গায়ে এসে মিশে তখন আলাদা অনুভূতি। সামান্য গাছপালা। নিচের দিক তাকালে রিকশা-গাড়ির ভীরে ঢাকা রাস্তা। ভালোই লাগে এগুলো দেখতে৷
আজও মন ভালো করার জন্য ছাদে আসলো। বেশ বাতাস। ঝড়ো হাওয়া। তবুও খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। মনের মধ্যে থাকা ঝড়কে তাড়াতে মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়ার প্রয়োজন। আবহাওয়াটা উপভোগ করায়ও আলাদা মজা আছে। সেগুলোই উপভোগ করছে পরশি।

.
সন্ধ্যা বেলায় তোহরাব সাহেব এসেছেন বাসায়। চন্দ্রা দরজা খুলতেই মামাকে দেখে সালাম দিল। সালামের উত্তর দিয়ে তোহরাব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, মা বাবা কোথায়?
চন্দ্রা বলল,
“ভিতরে আছে। নানা তো আগের থেকে আরও অসুস্থ হয়েছে।”
“হ্যাঁ, শুনেছি। মায়ের সাথে কথা হয়েছিল। তা তুমি কেমন আছো মামনি?”
“ভালো আছি মামা। আপনি কেমন আছেন? এতোদিন পর কেন আসলেন?”
চন্দ্রাকে তোহরাব সাহেব অনেক আদর করেন। নিজের বোনের মেয়েকে বোনের মৃ`ত্যুর পর নিজের মেয়ে হিসেবেই মনে করেন৷ বোনকে অনেক ভালোবাসতেন। বোনের মৃ`ত্যুতে অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন। এই ছোট্ট মেয়েটার জন্য খারাপ লাগতো। চন্দ্রা অনেক কান্নাকাটি করেছিল সে তার বাবার কাছে থাকবে না। পরে তোহরাব সাহেব চন্দ্রাকে বলেছিলেন,
“তোমার বাবার সাথে থাকতে হবে না মামনি। তুমি নানা নানু আর মামার সাথে থাকবে।”
যদিও চন্দ্রা বাবার অনেক ঝামেলা করেছিল। মেয়েকে সে তার কাছেই রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু মিরাজ সাহেব আর তোহরাব সাহেব ভীষণ রেগে ছিলেন তার উপর। তাই চন্দ্রাকে তার সাথে দেন নি৷
চন্দ্রা মামাকে শ্রদ্ধা করে অনেক। যদিও তূর্ণর সাথে তোহরাব সাহেবের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। তবুও চন্দ্রার কাছে দুজনেই সমান।
তোহরাব সাহেব চন্দ্রার কথার উত্তর দিয়ে বললেন,
“এই তো আসলাম মামনি। জানোই তো পোস্টিংটা ঢাকার বাইরে। তাই বেশি আসতে পারি না। আর কয়েকটা মাস। তারপর রিটায়ারমেন্ট। এরপর সারাদিন এখানেই থাকব। পরে কিন্তু বলো না মামা শুধু জ্বালায়।”
চন্দ্রা মামার কথায় হেসে বলল,
“উহু, একদম এরকম কথা বলব না। উল্টা তোমাকে জ্বালাবো। এতোদিন তো চাকরির কথা বলে দূরে দূরেই থেকেছো।”
“আচ্ছা ঠিকাছে। তা তোর ভাই কোথায়?”
মামার মুখে ভাইয়ের কথা শুনতেই মনে পড়লো তূর্ণ আবার ওর মামাকে নিয়ে ঝগড়া করবে৷ মনে করতেই মন খারাপ হয়ে যায় চন্দ্রার। চন্দ্রা মামার প্রশ্নের উত্তর দিতে বলে,
“ভাইয়া আর কোথায় থাকবে? হসপিটালে আছে।”
“কখন আসবে?”
“ঠিক নেই। তবে দেরি করেই আসে বেশিরভাগ সময়।”
“ওহ্।”
কথা না বাড়িয়ে তোহরাব সাহেব চলে যান মিরাজ সাহেব আর রোকেয়া বেগমের সাথে দেখা করতে।

আজ আর কাজ না থাকায় তূর্ণ বাসায় চলে আসে। প্রণয়কে ফোন দিয়েছিল বাহিরে কিছুক্ষণ বসে আড্ডা দিতে। কিন্তু প্রণয় জানালো আজ তার তাড়াতাড়ি বাসায় যেতেই হবে। গত চারদিন ধরে প্রণয়িনীকে বলেছে তাড়াতাড়ি আসবে একদিন অফিস থেকে। কিন্তু তা হয় নি। আজ প্রণয়কে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতেই হবে। তাই তূর্ণ আর কিছু বলল না। প্রণয়কে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বাসায় যেতে বলল। আর নিজেও বাসার উদ্দেশ্য রওনা হয়। বাসায় আসালে দরজা খুলে চন্দ্রা।
চন্দ্রা দরজা খুলেই তূর্ণকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো ভাইয়া?”
এমন প্রশ্নে তূর্ণ অবাক হয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছি মানে? কেমন থাকব? এই প্রশ্ন কেন হঠাৎ? কাহিনি কি?”
“না তেমন কিছু এমনিই বললাম।”
“এমনি এভাবে তুই জিজ্ঞেস করিস না চন্দ্রা। সত্যি করে বল।”
“আসলে জিজ্ঞেস করার ছিল তোমার মন ভালো না খারাপ আজকে?”
“কি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করছিস? সোজা করে বল না বাবা৷”
“মানে তুমি কি রেগে আছো? মানে সারাদিন এতো খাটাখাটুনি করে মন মেজাজ ভালো বলে মনে হয় না।”
“না৷ আজ মন খারাপ না। তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে গিয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি ফিরলাম। প্রণয়ের সাথে আড্ডা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও বলল আজ প্রণয়িনীকে সময় দিতে হবে। তাই চলে আসলাম। কিন্তু তুই কি বলছিস?”
“কিছু না।”
তূর্ণ নিজের রুমের দিক যাচ্ছিল। ঠিক তখনই চন্দ্রা পিছুডাক দিল। তূর্ণ ফিরে বলল,
“বল।”
“আসলে ভাইয়া তোমাকে বলা হয় নি।”
“কি?”
“মামা এসেছন।”
কিছু হয় নি এমন ভাব করে তূর্ণ বলল,
“ওহ্। তো আমি কি করব?”
“প্লিজ ভাইয়া কিছু বলিস না মামাকে।”
“আশ্চর্য আমি কি বলব? তার বাসা সে অবশ্যই আসবে। তার বাবা মা থাকেন। তুই, তার ভাগনি থাকিস। আর মূলত বাসাটা তো তারই। মনে নেই এপার্টমেন্টটা তিনিই কিনেছিলেন। আমি এখানে থাকতে চাইনি কখনো। কিন্তু দাদা দাদি আর তোর জন্য এখানে থাকতে হয়েছে। তো উনি আসবে কি আসবে না, থাকবে কি থাকবে না এটা তার ব্যাপার। আমি কি করব? শুধু তোর মামাকে বলে দিস আমার সাথে যেন কোনো রকমের কোনো কথা যেন না বলতে আসে। আমাকে একা থাকতে দিবি।”
এই বলেই তূর্ণ নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা লক করে দিল।
চন্দ্রা আর কিছু বলল না। তূর্ণ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কতক্ষণ রুমেই বসেছিল। অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে মনে হলো এক কাপ কফি দরকার। তূর্ণ রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো কফি বানাতে। তখনই ডাইনিং রুমে বসে সবাই খাচ্ছিল। তোহরাব সাহেবের সামনে দিয়েই তূর্ণ গেল। তোহরাব সাহেব সবসময়ই ছেলের সাথে কথা বলতে চান। কিন্তু তার ছেলে তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। আজ অনেক দিন পর ছেলেকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“তূর্ণ কেমন আছো বাবা?”
তূর্ণ না শোনার ভান করে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছিল। তোহরাব সাহেব আবার বললেন,
“এখন কফি কেন পান করবে? সারাদিন পর হসপিটাল থেকে এসেছো। এখন খাবারটা খেয়ে নাও। কফি পরে খাবে।”
তূর্ণ তার বাবার কথা শুনে গা জ্বলে যাচ্ছিলো রাগে। ও জিনিসপত্র সব শব্দ করে রাখছিল। ব্যাপারটা রোকেয়া বেগম খেয়াল করে রেগে গেলেন। তিমি তূর্ণকে উদ্দেশ্য করে কড়া কন্ঠে বললেন,
“তূর্ণ এসব কি? তোমার বাবা কিছু বলছে। কিছু জিজ্ঞেস করছে। তুমি তার উত্তর দিচ্ছো না কেন? কেমন ছেলে তুমি? এতোদিন পর বাপটা বাড়ি আসছে। বয়স্ক মানুষ তার সাথে এতো কিসের রাগ? কথা বললে কি ক্ষতি? উল্টা মেজাজ দেখাচ্ছিস। এতো মেজাজ দেখালে হয় না। অনেক হয়েছে। এখন এসব বাদ দাও।”
দাদির কথা শুনে আবার তূর্ণর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আর রাগটা আটকে রাখতে পারল না। রাগ নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“দাদি হাজারবার তোমাকে মানা করেছি এসব কথা বলতে। আমাকে আমার মতো থাকতে দিবে না কেউ একটু? আমাকে প্রশ্ন করছো কেমন ছেলে আমি? কই একবার কি তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছো কেমন বাবা সে? সব দায় দায়িত্ব ছেলের। বাবা মায়ের দায়িত্ব নেই? তারা তাদের মতো সুখে জীবন কাটাবে? শুধু নিজেদের ভালোটুকুই বুঝবে? এমন স্বার্থপর মানুষদের সাথে আমি কথা বলতে পারব না। যা খুশি তাই কর তোমরা। কিন্তু প্লিজ আমাকে আমার ইচ্ছায় বাঁচতে দাও। আমার জীবনে এভাবে নাক গলাতে আসবে না। মনে রাখবে তোমাদের জন্য এই বাসায় আছি।”
এই বলেই কফির মগটা ফেলে দিয়য়ে চলে গেল তূর্ণ।
তোহরাব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাবা মায়ের দিক তাকিয়ে বলল,
“ঠিক এই জন্যই আসতে চাই না এখানে। আসলেই তোমার নাতির চেঁচামেচি, ভাংচুর এগুলো দেখতে হয়। একদম মায়ের মতো স্বভাব। ভেবেছি রিটায়ারমেন্টের পর তোমরা যতদিন আছো তোমার কাছে এসে থাকব। কিন্তু তোমাদের নাতির সমস্যা হবে। ছুটি থাকতেও নিজের বাসায় আসতে পারি না শুধুমাত্র তোমাদের নাতির জন্য।”
এই বলে টেবিলে খাবার রেখেই উঠে গেলেন তোহরাব সাহেব৷ রোকেয়া আর মিরজ সাহেব অসহায়ের মতো বসে রইলো। তাদের আর কিছু বলার নেই। এই জীবনে কতবার তারা চেষ্টা করেছে এই বাবা ছেলের মাঝের ঝগড়া মেটাতে। কিন্তু কিছুই হয় নি। প্রত্যেকবার এরকমই হয়।
ঠিক এই জিনিসটার ভয়েই ছিল চন্দ্রা। প্রত্যেকবার এই মানুষগুলো এভাবে ঝগড়া করবে।

তূর্ণর মেজাজ ভীষণ খারাপ। ভাবলো মন ভালো করতে একটু ছাদে যাক। অনেকদিন যায় না। একটু বাতাস খেয়ে আসুক। বাসার মধ্যে দম আটকে আসছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here