ভালোবাসা কারে কয়,১৫,১৬
শবনম মারিয়া
পর্ব ১৫
(সতর্কতা : আজকের পর্বে কিছু নৃশংসতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সকল কাহিনি ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।)
রাত গভীর। প্রণয় অফিসের গোডাউনের দিকে চলে গেল গাড়ি নিয়ে। এখানের একটা কোণায় একটা রুম আছে। যেই রুমে প্রণয় ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করে না৷ অফিসের সব দরজার চাবির অনেকগুলো কপি অনেকের কাছে আছে। তবে এই কোণার ছোট্ট ঘরটার চাবি প্রণয় ছাড়া করো কাছে নেই। বিশ্বস্ত লোক রফিকুল। তার কাছেও রেখে দেয় না চাবিটা। রফিকুল জানে এখানে কি চলে। বলা যায় প্রণয়ের অনেক কাজই রফিকুল করে দেয়। প্রণয় শুধু নির্দেশনা দেয়। সামনে দাড়িয়ে থাকে। এইসব কাজ নিয়ে কোনো রকমের বোকামি করা যায় না। এসব কাজ করতে হয় সাবধানে। প্রণয় দিনের বেলা কখনো আসে না এখানে। গভীর রাতে আসে। তাও পিছনের দিক দিয়ে। রুমে ঢুকেও কিছু পাওয়া যায় না৷ অনেকগুলো বাক্সে ভরা রুমটা। প্রণয় রুমে ঢুকলো। প্রণয়ের পিছে পিছে রফিকুলও ঢুকলো।
এখন রফিকুলের বয়স বাইশের কাছাকাছি হবে।
(অতীতের কাহিনী) রফিকুল তখন ছোট।
চন্দ্রা জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো যখন কাজটা করে তখন রফিকুলের সামনে কাজটা হয়। রফিকুলের মায়ের সাথে হয়ে যাওয়া ঘটনার জন্যই রফিকুলকে সাক্ষী হতে হয়েছিল এসবের। রফিকুল বস্তির সাধারণ ছেলে ছিল। ঐ ঘটনার পর প্রণয় রফিকুলকে সতর্ক করেছিল।
রফিকুলের এখনও মনে আছে দিনটা৷ এক পাশে রফিকুলের মায়ের লা`শ। অন্য পাশে একটা পি`শা`চের লাশ। পাশে ছু`রি পড়ে আছে। রূপবতী একটা মেয়ে হাত কাঁপছে। এই মেয়ে ওর মায়ের ধ`র্ষ`ক`কে মে`রে`ছে। এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। মেয়েটা কাঁপতে কাঁপতে নুইয়ে পরে গেল মাটিতে। পাশে থাকা সুদর্শন এক পুরুষ এসে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো। তাকে ডাকতে লাগলো,
“চন্দ্রা! চন্দ্রা! উঠো। কিছু হয় নি৷ কিছু হবে না৷ তুমি ঠিক আছো। তুমি কিছু করোনি। আমি আছি। কিছু হবে না তোমার। তূর্ণ আছে।”
কথাগুলো রফিকুলের কানে বাজছিল।
লোকটা পকেট থেকে ফোন বের কাকে যেন ফোন করে বলল,
“তূর্ণ চন্দ্রাকে পাওয়া গিয়েছে। অবস্থা খারাপ। তাড়াতাড়ি আয়। কিছু একটা করতে হবে।”
কিছুক্ষণ চন্দ্রা নামক মেয়েটার মাথা লোকটার কোলে রেখে বসেছিল। অনেক চিন্তিত ছিল। চিন্তিত না হওয়ার কিছু নেই। রফিকুল নিজেও ভাবছিল সেও হয় তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। রফিকুল মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। হঠাৎ লোকটা রফিকুলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই যে শুনছো? একটু পানি দিবে?”
রফিকুল নির্বিকার ভাবে উঠে দাড়ালো
তার হাত পা কাঁপছে। এগিয়ে গিয়ে পানির মগটা দিল। লোকটা পানির ছিটা দিয়ে মেয়েটাকে তুলছে। এরই মধ্যে আরেকজন লোক আসলো। দরজায় ধাক্কা দেয় নাই। ফোন করেছিল। লোকটাকে ফোন করেছিল। সে উঠে গিয়ে সাবধানে দরজা খুলল। মেয়েটা এক কোণে বসেছিল।
তারপর তূর্ণ নামক লোকটা আর অন্যজন কি কি যেন বলল নিজেদের মধ্যে। তারপর তূ্র্ণ নামক লোকটা নিয়ে গেল মেয়েটাকে। যাওয়ার আগে রফিকুলের দিক তাকিয়ে বলল,
“ওর কি করবি?”
“আমি একটা ব্যবস্থা করে নিব।”
“সাবধানে করিস।”
“তুই যা চন্দ্রাকে নিয়ে। আমি বাকিটা দেখে নিব।”
কথাগুলো শুনে রফিকুল নিশ্চিত এখন তার জানও যাবে। ঠিক যেভাবে তার মার ধ`র্ষ`কে খু`ন করা হয়েছে। তাকেও খু`ন করা হবে৷ কিন্তু সে বাঁচতে চায়। মৃ`ত্যু কঠিন৷ মৃ`ত্যুকে কাছ থেকে দেখলে মানুষ বুঝতে পারে৷ তখন বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। চালিয়ে যায় আ`র্ত`না`দ।
লোকটা রফিকুলের দিক এগিয়ে আসলো। রফিকুল মাথা নিচু করেই বসেছিল। প্রণয় জিজ্ঞেস করলো,
“নাম কি?”
কাঁপা স্বরে উত্তর দিল,
“রফিকুল।”
“বাবা কি করে?”
“অনেক আগেই ম`ইরা গেসে।”
“মা কি করতো?”
“মাইনষের বাসায় কাম করতো।”
“এই লোকের বাসায়ও?”
“হ।”
“পড়ালেখা করো?”
“না। খাওন পাই না। পড়মু কেমনে? দোকানে কাম করি।”
“বেতন কতো?”
“দেয় অল্প।”
রফিকুল উত্তরগুলো ভয়ে থেকে দিচ্ছিল। যেন যতক্ষণ উত্তর দিবে ততক্ষণ তার প্রাণ থাকবে।
এবার প্রণয় আরেকটু কাছে এগিয়ে ফিসফিসে বলল,
“বাবা নাই৷ মা মা`রা গেল। তোমার তো বাঁচতে হবে তাই না?”
এই কথা শুনেই রফিকুল আ`র্ত`না`দ করে বলে উঠলো,
“আমারে মা`ইরেন না ভাই৷ আমি কিচ্ছু দেখি নাই। একটু আগে আমি আমার মায়রে হারাইছি। আমি বাঁচতে চাই। আমি বাঁচতে চাই। আমি কিছু দেখি নাই৷ কাউরে কমু না৷ কেন কমু? যে এই হা`রা`মিরে মা`রসে উনি ভালো মানুষ। হা`রা`মিগো রে মা`রলে পা`প নাই৷ আমার মায়ের মৃ`ত্তুর প্র`তিশোধ আমি নিতে পারতাম না। কিন্তু উনি নিসে। আমি কাউরে কমু না৷ ভুইলা যামু কইলাম।”
প্রণয় সামান্য হাসলো। যদিও এই কাজে তার হৃৎস্পন্দনের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। তবু তূর্ণর বোনের জন্য, তূর্ণর জন্য এগুলো করতে পারবে সে। প্রণয় বলল,
“আমি কখনো তোমার ক্ষতি করব না। তোমার সাহায্য করব। যদি তুমি আমার ক্ষতি না করে সাহায্য করো।”
“আমি কেমনে সাহায্য করমু আপনার?”
“বললে তো হা`রা`মি মানুষকে মা`রলে পা`প নেই। তাহলে এই হা`রা`মির মাং`সগুলো টু`করো করো। টু`করো করে কুকুরদের দিয়ে দিবে। তবে এখানে বসে নয়। বস্তায় করে অন্য এলাকায় নিয়ে যেয়ে করবে। যেখানে তোমায় কেউ চিনবে না।”
“আইচ্ছা। কিন্তু কেউ যদি জানে?”
“এই রাতে কেউ জানবে না।”
“আচ্ছা।”
“আর শুনো মোহাম্মদপুর আমার অফিস হচ্ছে। সেখানে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। কাল থেকে ওখানে কাজ করবে। ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। গিয়ে বলবে প্রণয় স্যার পাঠিয়েছে।”
সেই থেকে রফিকুল প্রণয়ের কাজ করে আসছে। আজও করে। এখানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে সে। প্রণয়ের অফিসের বিল্ডিংয়ের কাজ চলাকালীন প্রণয় আর তূর্ণ বুঝতে পারলো চন্দ্রা যা শুরু করেছে তা থামানো কঠিন৷ তাকে বাঁচাতে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। সতর্কতার জন্য প্রণয় বিশেষভাবে তার অফিসের নিচেই এই রুম বানিয়েছিল। আর এই রুমের নিচে সুরঙ্গপথ।
(বর্তমান কাহিনী) প্রণয় রুমে ঢুকে রফিকুলের দিক তাকালো। রফিকুল মেঝের টাইলস সরালো। একটা তালা দেওয়া দরজা। প্রণয় রফিকুলের হাতে চাবিটা দিল। চাবিটা দিয়ে রফিকুল সুরঙ্গের দরজা খুলল। প্রণয় টর্চ নিয়ে নিচে নামলো। তারপর সেখানের ঘরে আলো জ্বালালো। জায়গাটা৷ ভীষণ গন্ধের। বমি আসছে। তবুও প্রণয় নিজেকে সামলে নিল। রফিকুল বস্তাটা নিয়ে নিচে নামলো। তারপর কাজ শুরু করলো৷
প্রণয় এগিয়ে আসতে যাচ্ছিলো, তখন রফিকুল বলল,
“স্যার এদিকে আপনি আগাবেন না। আপনি হলেন ভালো মানুষ। আপনারে এসব মানায় না৷ আপনি আল্লাহর বান্দা। নামাজ পড়েন৷ এইগুলা আমার উপর ছাইড়া দেন।”
প্রণয় মৃদু হাসলো। তারপর বলল,
“আমি ভালো মানুষ! তবে এগুলো কেন করি?”
“স্যার আপনি নিজের জন্য করেন না৷ কাছের মাইনষের জন্য করেন।”
“কাছের মানুষ?”
“তা ম্যাডাম তো আপনার কাছের মানুষই। নাইলে কেডা এতো বছর ধরইরে নিজের জান হাতে লইয়া এগুলা করে? এতো বছর আপনেগো চিনি। একটু তো বুঝি।”
এই বলে দাঁত কেলিয়ে হেসে দিল রফিকুল। প্রণয় হেসে বলল,
“আজকাল বেশি বুঝো। বিয়ের বসয় হয়েছে। এবার বিয়ে করে ফেলো।”
“না স্যার। বিয়া করলে এই রাতের বেলায় বউ আপনার কাজ করতে আসতে দিব না।”
এই বলে আবার দাঁতগুলো বের করে দিল রফিকুল। প্রণয়ও হাসলো।
আবার প্রণয় গম্ভীরতার সাথে বলল,
“কখনো তূর্ণ আর চন্দ্রা যেন না জানতে পারে। তূর্ণ জানে আমি ওর বোন দেখেই চন্দ্রার জন্য এগুলো করি৷ তূর্ণ কখনো ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না। ও এগুলো জানলে আমার সাথে রাগ করবে। আর চন্দ্রা জানলে দূরে সরে যাবে। তাই যেন না জানে।”
রফিকুল বলল,
“জানবে না স্যার। আপনি কিছু বলছেন আর আমি শুনি নাই এমন হইসে?”
“আচ্ছা৷ কাজ করো এখন৷ এই মাস থেকে স্যালারি বাড়িয়ে দিব।”
প্রণয় এই বদ্ধ ঘরে রুমাল দিয়ে মুখ চেপে বসে থাকলো যতক্ষণ না কাজ শেষ হয়েছে। তারপর বাসায় চলে গেল। এখন আর এক ঘন্টার জন্য ঘুমাবে না। ভোর হয়ে যাবে। মেবাইলটা নিয়ে বসলো। তখন দেখতে পেল তূর্ণ ম্যাসেজ দিয়েছে। ঐখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। তাই তূর্ণ ফোন দিয়ে না পেয়ে ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছিল।
“সব ঠিকঠাক করেছিস? কাল দেখা করিস। আমি তোর অফিসে যাব। দশটার দিক একটু সময় করে থাকিস।”
প্রণয় রিপ্লাই দিল,
“আজ শুক্রবার। অফিস বন্ধ। আমি তোর বাসায় আসব। তখন কথা বলিস।”
কিছুকক্ষণ পর অনলাইনে গিয়ে দেখল চন্দ্রা ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে,
“কাল কিন্তু শুক্রবার। প্রণয়িনী আর আমার দিন। আগের সপ্তাহে নিয়ে আসেননি৷ খুব রাগ করেছিলাম। কাল নিয়ে আসবেন অবশ্যই।”
প্রণয় ম্যাসেজটার রিপ্লাই দিল। তারপর স্ক্রল করে উপরের দিক গেল। আগের ম্যাসেজগুলো পড়ছে প্রণয়। চন্দ্রার পাগলামি মার্কা কথাবার্তা পড়তে ভালো লাগে। এগুলো পড়ে চন্দ্রার প্রোফাইলে ঢুকলো। চন্দ্রার এই প্রোফাইলের ছবিটা প্রণয়ের ভীষণ পছন্দের। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে পিছন দিকে ফিরে আছে। প্রণয় ঘন্টার পর ঘন্টা মনে হয় এই ছবিটা দেখে পার করে দিতে পারবে।
প্রণয় প্রথমে চন্দ্রাকে তূর্ণর বোন হিসেবেই রক্ষা করতো। সে তার স্ত্রীকে ভালোবাসতো। স্ত্রী ছাড়া অন্য মেয়ের প্রতি কোনো রকমের ভাবনা সে মনে আনে নি। স্ত্রী বেঁচে থাকতেই একটা বড় ধাক্কা খেয়েছিল সে। তার নিজেকে একা ভাবতে শুরু করে। এরপর স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তূর্ণ বন্ধু হিসেবে পাশে থাকতো। যেহেতু চন্দ্রা সকল ব্যাপার জানতো তাই চন্দ্রা প্রণয়কে এভাবে দেখতে পারছিল না। পরে তাকে বোঝায়। একটু সময় দেয় বন্ধুর মতো। এভাবে একসাথে অনেক সময় কাটে। অনেক কথা হয়। আগে এতো কথা হতো না। কিন্তু তখন হতে শুরু করলো। কয়েক মাস পর প্রণয় বুঝতে পারলো চন্দ্রার সাথে তার সময় কাটাতে ভালো লাগে। সে চন্দ্রাকে খেয়াল করতে শুরু করলো। আগে যেই চন্দ্রাকে মানসিক রোগী মনে হতো। তখন সেই চন্দ্রার প্রতি গভীর মায়া অনুভূত হতে লাগলো। এরপর সে আস্তে আস্তে চন্দ্রার প্রতি দুর্বল হয়ে যায়। এক সময় উপলব্ধি করে চন্দ্রাকে ভালেবাসে সে। সে চেষ্টা করেছে চন্দ্রার প্রতি এসব অনুভূতিকে মন থেকে দূরে রাখতে৷ তবে পারেনি। তবে সে জানে এই অনুভূতি সে চন্দ্রাকে জানতে দিতে পারবে না। কারণ সব অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না। কিছু অনুভূতি মনের কোণে লুকিয়ে রাখা ভালো।
চলবে….
ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ১৬
(কয়েক ঘন্টা আগের কাহিনি)
পরশি দাড়িয়ে আছে ছাদের রেলিং ঘেষে। বাতাসে চুলগুলো উড়ছে। পরশির ওড়নাও উড়ছে। তূর্ণ ছাদে এসে পিছন থেকে দেখেই চিনতে পারল এটা পরশি। কিন্তু এই সময় একা একা ছাদে কি করছে?
তূর্ণ নির্দ্বিধায় এগিয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে নিজেও রেলিং ঘেষে পরশির পাশে দাড়ালো। পরশির থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখেই দাড়িয়েছে তূর্ণ৷
কাছে আসার পরেই কারো উপস্থিত টের পেয়ে পরশি তাকিয়ে দেখে। তূর্ণকে দেখে সৌজন্যতার হাসি বিনিময় করে। তূর্ণ জিজ্ঞেস করল,
“আরে অফিসার, আপনি? এখানে কি করছেন?”
“এই তো একটু হাওয়া বাতাসের স্বাদ নিতে এসেছিলাম। তা আপনি এ সময় হঠাৎ?”
“আমিও ঐ হাওয়া বাতাস খেতেই এসেছি। প্রায়ই আসি বলতে গেলে।”
“ওহ্৷ কিন্তু এই দু মাসে তো আজই দেখলাম। মানে আমি ডেইলিই আসি সময় পেলে।”
“ওহ্। হ্যাঁ বেশ কিছুদিন ছাদে আসা হয় নি। হসপিটালে ব্যস্ত থাকি। তারপর যেদিন একটু সময় পাই দেখা যায় বন্ধুর সাথে আড্ডা দেওয়া হয়। আজ ও ব্যস্ত তাই বাসায়ই এলাম।”
“ওহ্। বাসার সবাইকেও সময় দেওয়া উচিত ডাক্তার সাহেব।”
“জি অবশ্যই।”
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। পরশি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কি কোনো কিছু নিয়ে খুব আপসেট? না মানে মনে হলো আরকি তাই জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করবেন না।”
তূর্ণ পরশির চোখে চোখ রাখলো। তারপর বলল,
“আমার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে আমি আপসেট?”
“সরি। মানে আমি এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। আমার মনে হলো। আমি হয় তো ভুল।”
“না আপনি ভুল না। আমি সত্যিই একটু আপসেট। কিন্তু আমার চেহারায় বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটায় অবাক হলাম। সাধারণত আমি আপসেট থাকলে কেউ বুঝে না।”
পরশি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এটা না বোঝার কি আছে? বোঝা যায় তো।”
“কেউ কখনো আমি আপসেট হলে বুঝে না আমি আপসেট। সবাই বুঝে আমি রেগে আছি। কিন্তু আপনি বুঝলেম আমি আপসেট তাই।”
“আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনি রাগী।”
তূ্র্ণ এবার হেসে দিল।
“কি বলছেন? বাসায় আর হসপিটালে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। কেউ বলবে না আমি রাগী না৷”
“বাসায় জিজ্ঞেস করলে হয় তো তা বলতে পারে। কিন্তু হসপিটালে মনে হয় না রাগী থাকেন। রোগীদের সাথে এমনভাবে কথা বলেন যে রোগী ব্যবহারেই মনোবল পেয়ে যায়।”
“আরে ওটা তো ডাক্তারদের সিস্টেম। রোগীদের সাথে তো আর রাগ দেখানো যায় না।”
পরশি সামান্য হাসলো। তারপর বলল,
“জানেন রাগী মানুষগুলো মনের দিক দিয়ে ভালো হয়। তারা উপর দিয়ে রাগী হলেও ভিতর দিয়ে কোমল হয়। মনে প্যাঁচ নেই।”
“তাই? আমার মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য আছে কি?”
“অবশ্যই আছে। আপনি মানুষের সাথে অনেক সুন্দর করে কথা বলেন। আর আমি তো আপনার রাগ দেখিইনি। কিভাবে বুঝবো?”
“থাক রাগ দেখা লাগবে না। না দেখলেই ভালো। তখন আর এভাবে বুঝবেন না আমি আপসেট।”
এই বলে তূর্ণ নকল হাসি দিল।
“আচ্ছা তা না হয় না দেখলাম। এবার বলুন তো আপসেট কেন?”
তূর্ণ চুপচাপ আকাশের দিক তাকিয়ে আছে। পরশি একটু অপরাধ বোধ নিয়ে বলল,
“সরি। অনধিকার চর্চা করে ফেললাম। আমার এভাবে জিজ্ঞেস করা উচিত হয় নি। আপনার পারসোনাল ইস্যু হতে পারে।”
তূর্ণ বলল,
“না না। সরি বলার কিছু নেই। আপনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন। মানুষ বরাবরই কৌতুহলী। আপনিও সেই কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন।”
“কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করিনি। আপনার মন ভালো করতে পারি নাকি সেই সেই চেষ্টায় করেছি। এই পৃথিবীতে অনেক মানুষের মন খারাপ থাকে। তারা মন খারাপের কথা বলতে একটা মানুষ খুঁজে। কিন্তু পায় না। মনে হয় বলতে পারলে ভালো হতো। তাই বলেছিলাম। তার থেকেও বড় ব্যাপারটা কি জানেন?”
“কি?”
“আপনার কাছে আমি ঋণী। আপনি একবার আমার মন খারাপের সঙ্গী হয়ে ছিলেন। তখন আমি ভেঙে পরেছিলাম৷ আপনার কিছু কথা আমাকে শক্ত করেছে। অনুপ্রেরণা দিয়েছে। আপনার হয় তো বিষয়টা মনে নেই। হসপিটালে যখন ছিলাম তখনকার কাহিনী। বলেছিলেন শারীরিক সুস্থতার সাথে মানসিকভাবে সুস্থ থাকাটাও জরুরি। আর ডাক্তার হিসেবে রোগীকে সুস্থ করা আপনার দায়িত্ব। যদিও আমি ডাক্তার না৷ তবে আমার মনে হয় না কারো মন খারাপের গল্প শুনতে, তাকে মানসিক সুস্থতা প্রদান করতে ডাক্তার হওয়াই লাগবে। মানসিক সুস্থতা একজন ভালো বন্ধুও দিতে পারে।”
তূর্ণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো পরশির দিকে কতক্ষণ। এই মেয়ের মধ্যে কি যেন আছে। কেমন যেন একটা মুগ্ধতা, স্নিগ্ধতা কাজ করছে। এই রাতের আলোতে উজ্জ্বল লাগছে পরশিকে। মুখে লেপ্টে থাকা হাসিটা কেমন যেন। এই হাসিতে যেন বিষন্নতা মিশে আছে। তবুও সুন্দর লাগছে। পরশির বলা প্রতিটা কথা ভীষণ সুন্দর লাগছে। কথাগুলো কি আছে? তূর্ণর কেন যেন মনে হলো পরশিই এখন হয়তো ওর মানসিক অসুস্থতার প্রকৃত চিকিৎসক। তূর্ণ হঠাৎ কিছু না ভেবেই বলা শুরু করল,
“কিছু মানসিক অসুস্থতা বছরের পর বছর থেকে যায় গাঢ় হয়ে চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট বিশেষ যন্ত্রটায় যন্ত্রণা হয়ে। এই যন্ত্রণা মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। শক্ত করে তুলে উপর থেকে। তবে ভিতরে দগদগে ঘা হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে প্রচুর কষ্ট হয়। সবার জীবনেই এই অসুস্থতা থাকে। তবে এক এক ঘটনা এক এক কারণ৷”
পরশি মনোযোগ দিয়ে তূর্ণর কথাগুলো শুনছিল। তার চোখ ভিজে আসছিল। তূর্ণ যেন পরশির অবস্থাই বর্ণনা করছে। পরশিও তো কত বছর ধরে এমন ঘা নিয়ে বেঁচে আছে।
তূর্ণ বলল,
“আমার ঘটনা অবশ্য কাউকে বলতে মন চায় না৷ কারণ আমার ঘটনা কিছুই না। আমার কষ্ট মানুষের পাওয়া কষ্টের কাছে তুচ্ছ। তাই কখনো কাউকে বলি না৷ তবে কষ্টা অনেক ছোটবেলা পেয়েছিলাম৷ আামর বাচ্চামন ব্যাপারগুলো মেনে নিতে পারেনি। তাই কাউকে বলি না। কিন্তু আপনি যখন বললেন তখন কেন যেন মনে হচ্ছে বলি আপনাকে। যদি সত্যিই মানসিক শান্তি মেলে কাউকে বলে। আপনি তো শুনতে চেয়েছেন তাই।”
পরশি নরম স্বরে বলল,
“বলুন৷ মানুষের দুঃখ শুনতে খারাপ লাগে না। তখন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করতে ইচ্ছে হয়। অন্যান্য সবার থেকে আমাকে কম কষ্ট দিয়েছেন। ভালো রেখেছেন এই ভেবে।”
তূর্ণ কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। ঠিক তখনই জোরে কারো একজনের চিৎকার ভেসে আসলো তূর্ণ আর পরশির কানে। চমকে উঠলো দুজন। আবার শোনা গেল আর্তনাদ। কেউ বেঁচে থাকার জন্য চিৎকার করে যাচ্ছে।
“বাঁচাও, বাঁচাও।”
পরশি তূ্র্ণর দিক তাকিয়ে বলল,
“সামওয়ান নিডস হেল্প। কেউ বিপদে আছে।”
“হ্যাঁ। তবে চিৎকারটা কোথা থেকে আসছে? ভীষণ আবছা শোনা যাচ্ছে।”
“হ্যাঁ। নিচে থেকে। বিল্ডিংয়ের পিছনের দিক। আমাদের যাওয়া উচিত।”
“চলুন।”
পরশি আর তূর্ণ দৌড়ে যাওয়া ধরলো। আচমকা তূর্ণ যেতে গিয়ে বাড়ি খেল ছাদের দরজার সাথে। চিৎকার করে উঠল। লোহার দরজার কোণে সরু ভাবে কিছু একটা ছিল। তাড়াহুড়োতে তূর্ণর হাতে লেগে যায়। অনেকটা কেটে গেল। র`ক্ত বের হচ্ছে। পরশি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“অনেকটা কেটে গিয়েছে৷”
তূর্ণ বলল,
“ব্যাপার না।ঠিক হয়ে যাবে। নিচে চলুন।”
“কিন্তু আগে আপনার র`ক্ত বন্ধ করতে হবে।”
“সামান্য এটা। কিছু হবে না।”
পরশি বুঝতে পারল না কি করবে। সে তাড়াতাড়ি ওড়নাটা খুলে হাতে পেঁচিয়ে দিল। তূর্ণ বলল,
“আরে কি করছেন?”
“অসুবিধা নেই। এবার চলুন।”
এতো উপর থেকে সিড়ি দিয়ে গেলে দেরি হবে। তারপর তাড়াহুড়োতে দূর্ঘটনা একটা ঘটেছে। তাই পরশি বলল,
“লিফট দিয়েই চলুন।”
লিফটেও দেরি হলো। গিয়ে বিল্ডিংয়ের পিছনের দিকটায় খুঁজলো। কিন্তু কিছুই পেল না।
তূর্ণ বলল,
“এদিকে তো কিছুই নেই পরশি। কোনো মানুষ নেই।”
“কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনেছি এদিক থেকেই।”
তূ্র্ণ বলল,
“কেউই নেই। খুব সম্ভবত এমনিও ছেলেপেলেরা মজা করে করেছে। কত ছেলে পেলে আছে না দুষ্টুমি করে।”
পরশির বিষয়টা মাথায় আসলো। আসলেই তো। এমন হতেই পারে। শুধু শুধু এতোটা চিন্তিত হয়ে গেলো সে।
পরশি বলল,
“হয় তো।”
“চলুন।”
দুজনে উপরের দিক উঠলে লাগলো। পরশি বলল,
“সরি আমার জন্য আপনার সমস্যা হলো। আসলে আজকাল কেস নিয়ে এতোই ডুবে থাকি সব কিছুতে কেস খুঁজতে থাকি। এই বলে পরশি হাসলো। তূর্ণও হাসলো৷ কিন্তুর পরশির মন মানছে না। মনকে মানাতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।
তূর্ণ বলল,
“বাসায় যাওয়া উচিত। আপনি বাসায় গিয়ে রেস্ট নিন।”
“আপনিও রোস্ট নিয়েন। আর অবশ্যই হাতটা ক্লিন করে ব্যান্ডেজ করে নিবেন৷ ইনফেকশন হবে নাহলে।”
এটা বলেই পরশি হেসে বলল,
“দেখুন না, ডাক্তার আপনি জ্ঞান দিচ্ছি আমি। হা হা হা।”
তূর্ণ বলল,
“দিন অসুবিধা নেই। বুঝতে পারছি এটা রিভেঞ্জ।”
“রিভেঞ্জ?”
“ঐ যে আপনি অসুস্থ হয়েছিলেন পর আমি এভাবে বলতাম তাই আজ সুদে আসলে নিয়ে নিচ্ছেন।”
পরশি হাসলো।
দুজনে দুজনের বাসার দরজার দিকে যাচ্ছিল। পরশি ঘুরে বলল,
“ও হ্যাঁ, আপনাকে মানসিকভাবে সুস্থ করতে পারলমা না৷ উল্টা শারীরিক ভাবে অসুস্থ করে দিলাম। আসলেই ডাক্তার নই তো। তাই ব্যর্থ হলাম।”
তূ্র্ণ হেসে দিয়ে বলল,
“ভুল। এ্যাডভেন্চার দিয়ে মন ভালো করে দিয়েছেন।”
“এর মানে কি পজিটিভলি নিব? মানে বিরক্ত হয়ে বললেন না তো?”
“না না না। সত্যি বলতে ধন্যবাদ দিতে চাই।”
“ধন্যবাদ কেন?”
“কারণ আপনাকে যেটুকু বলেছি ভালো লেগেছে। সুন্দর সময় কেটেছে। ধন্যবাদ।”
পরশি সামান্য হেসে বলল,
“আপনাকেও ধন্যবাদ। আমারও মন খারাপ ছিল। আপনার কথাগুলো শুনে ভালো লাগছিল। সবটা অনুভব করছিলাম৷”
“মন খারাপ ছিল? আপনার মন খারাপের কারণটা জানা হলো না যে। থাক অন্য একদিন জেনে নিব। একদিনে সব শুনলে পরে আর কথার টপিক থাকবে না। তাই কিছু কিছু কনভারসেশন ধীরে ধীরে চলা ভালো।”
“আসি। গুড নাইট।”
“গুড নাইট।”
.
তূর্ণ ঘরে ঢুকেই সোজা চন্দ্রার ঘরে গেল। দরজায় নক করল। চন্দ্রা চোখ ডলতে ডলতে দজরা খুলে এমন ভাবে বলল,
“কি হয়েছে ভাইয়া?” যেন সে ঘুমিয়েছিল আর তূর্ণ তার এতো কষ্টের ঘুম নষ্ট করে দিয়েছে।
তূর্ণ রাগী কন্ঠে বলল,
“এতো ঢং করতে হবে না।”
চন্দ্রা আচমকা খিলখিলিয়ে হেসে দিল। তূর্ণ মুখ চেপে ধরে বলল,
“আস্তে। বাসায় তোর মামা আছে৷ শুনে ফেলবে।”
“শুনলে কি হবে? আমি হাসতে পারি না?”
“এই রাত দুপুরে তুমি খিলখিলিয়ে সবার ঘুম ভেঙে হাসবে এটা কি স্বাভাবিক।”
“অস্বাভাবিক কিছু না।”
“দিন দিন বয়স আর সাহস বাড়ছে। বুদ্ধি বাড়েনি তাই না?”
“উফ, আবার! একটু আগে প্রণয় ভাইয়াও বলেছে একই কথা। আমার নাকি বয়স বাড়ে কিন্তু বুদ্ধি কমে। প্রণয়িনীরও নাকি আমার থেকে বেশি বুদ্ধি। কি সব কথাবার্তা তাই না? আমিও ভয় দিয়ে দিয়েছি প্রণয়িনীকে সব শিখিয়ে দিব।”
“উফ, প্রণয়িনীকে নিয়ে কেন ওর সাথে এরকম মজা করিস। ওর এক মাত্র দুর্বলতা ওর মেয়ে।”
“ভাইয়া তুমি কেন সিরিয়াস হও? প্রণয় ভাইয়া মজা হিসেবেই নিয়েছে।”
“তা যাই হোক। প্রণয় এসেছিল এটা জেনেই স্বস্তি পেলাম। ও সব সামলে নিয়েছে তাহলে।”
চন্দ্রা খেয়াল করল তূর্ণর হাতের দিকে। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে হাতে ভাইয়া?”
“ব্যথা পেয়েছি৷ ছাদের দরজায়।”
“ওড়না কার?”
“পরশির।”
“পরশি আপুর ওড়না কেন?”
“আরে বাবা ও ছাদে ছিল। চিৎকার শুনে নিচে যাচ্ছিল। আর তখন।”
“আচ্ছা বুঝেছি।”
“যাক যখন বুঝেছো এরপর কাজ কর্ম ঠিকঠাক করো।”
এই বলে তূর্ণ নিজের রুমে চলে গেল। রুমে গিয়ে পরশির কথা অনুযায়ী হাগে ব্যান্ডেজ করে নিল। কেন যেন পরশির কথাগুলো ভালো লাগে। সেই কথাগুলো ভাবছিল আর আপন মনে হাসছিল তূর্ণ। হঠাৎ ওড়না হাতে নিল। কেমন যেন একটা সুঘ্রাণ। নাকে নিল। এরপর ওড়নাটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।
চলবে….