ভালোবাসা কারে কয়,২৩,২৪

0
155

ভালোবাসা কারে কয়,২৩,২৪
শবনম মারিয়া
পর্ব ২৩

পরশির অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত ৮ টা৷ অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিল৷ সকালে যা রান্না করা ছিল তাই ফ্রিজ থেকে বের করে গরম করে খেয়ে নিল। তারপর বারান্দায় গিয়ে অন্ধকারে বসে রইল। ব্যস্ত শহরের রাস্তার জ্যাম দেখা যাচ্ছে বারান্দা থেকে। আশেপাশের আলো এসে পড়েছে পরশির বারান্দায়। সেই মৃদু আলোতে বসে থাকতেই ভালো লাগছে। হঠাৎ খেয়াল করল রাত সাড়ে দশটা বাজে। কিছুকক্ষণ পর তো ওর ছাদে যাওয়ার কথা। তূর্ণ বলেছিল ছাদে বসে কথা বলবে। পরশি উঠে রুমে গিয়ে লাইটটা অন করল।
আয়নার সামনে গিয়ে খেয়াল করল সারাদিনের ক্লান্তিতে চেহারাটা কেমন যেন হয়ে আছে। এমনিই ওতো একটা ফর্সা নয় পরশি। কিন্তু চোখের নিচে ক্লান্তিটা ঠিকই দেখা যায়। সে যাই হোক, চেহারা দিয়ে কি হবে। কিন্তু চুলগুলো এমনভাবে এলোমেলো হয়ে আছে মনে হচ্ছে পাগল। আয়নার সামনে বসে চুলগুলো একটু আঁচড়ে নিল। চুল আঁচড়ানো বরাবরই পরশির কাছে ঝামেলা লাগে। সময় নেই চুলের যত্ন নেওয়ার। এইজন্য একটু ছোট করে রাখে। গত কয়েক মাসে চুল কাঁটারও সময় পায় নি তাই একটু লম্বা হয়েছে। আবার কাঁটতে হবে। যদিও পরশির ঘন, কালো লম্বা চুল ভালো লাগে। কিন্তু যত্ন করতে আলসেমি লাগে।
পরশি চুল আঁচড়ে বেঁধে নিল।
আলমারি থেকে একটা ওড়না বের করতে গিয়ে হাতে আসলো তূর্ণর দেওয়া ওড়নাটা৷ পরশি হাতে নিয়ে ভাবলো, লোকটা কি পাগল! নষ্ট হয়েছে না হয় একটা ওড়না৷ এইজন্য গিফট করতে হবে?
ওড়নাটা পরশি আবার আলমারিতেই রেখে দিল। এতো ভালো ওড়না বাসায় পরা যায় না৷ সাধারণ সুতি একটা ছোট্ট স্কার্ফ নিয়ে নিল গলায়।
পরশি ঘড়ির দিক তাকিয়ে দেখল এতোক্ষণে মাত্র দশ মিনিট সময় পার হয়েছে! আরও বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।
পরশির মনে প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা তূর্ণর যদি মনে না থাকে?
পরক্ষণেই ভাবলো, না থাকলে নেই। সে এমনিই ছাদে যাবে।
কিছুক্ষণ বসে থাকলো। এগারোটা বাজতে তিন মিনিট বাকি। পরশি ভাবলো এখন ছাদে যাবে। রান্না ঘরের সামনে দিতে যেতে যেতে ভাবলো দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে গেলে বেশ হয়। তূর্ণ বেচারা বসে বসে পরশির বকবক শুনবে। এমনি এমনি! কফি তো খাওয়ানো উচিত। কিন্তু দেখা গেল পরশি কফি নিয়ে ছাদে বসে আছে। অথচ তূর্ণর মনে নেই৷ সে ছাদেও আসেনি। তখন?
কিছুক্ষণ ভাবলো পরশি কি করবে। পরে ভাবলো তূর্ণকে একটা ফোন করে জিজ্ঞেস করে নেওয়া যায়। ফোনটা করতে গিয়ে আবার কেন যেন করল না৷ কি ভাববে তূর্ণ এই ভেবে।
পরশি সব ভাবনা দূর করে অগ্রসর হলো ছাদের দিক। ছাদে গিয়ে দেখল ফাঁকা। কেউ নেই এখানে। স্বাভাবিক। কিন্তু সে আশা করছিল তূর্ণ থাকবে। কিন্তু তূর্ণও নেই!
ফোনের দিক তাকিয়ে দেখলো সবে এগারোটা পাঁচ বেজেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত পরশির। শুরু করল অপেক্ষা। ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে।
ঠিক এমন সময়ই ফোনটা বেজে উঠলো।

.
তূর্ণ রোগী দেখতে দেখতে বেশ ক্লান্ত। আজ তার দশটায় বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোগী দেখতে দেখতে কখন দশটা পেরিয়ে ঘড়ির কাটা এগারোটার দিক চলে যাচ্ছে তা আর খেয়াল নেই। তূর্ণর রোগী দেখা শেষে সে প্রস্তুতি নিচ্ছিল হসপিটাল থেকে বের হবে। এমন সময় ইভা আসলো। তূর্ণ জিজ্ঞেস করল,
“তুমি?”
“হ্যাঁ। বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম। তা দেখি তুমি আছো। ভাবলাম দেখা করে যাই।”
“ওহ্। আমিও বাসায় যাচ্ছিলাম।”
“ওহ্। খুব ক্লান্ত লাগছে যে।”
“হ্যাঁ, একটু। তা বলো তোমার কি খবর?”
“এই তো। রাতে খেয়েছো?”
“না। বাসায় যাব, তারপর।”
“চলো অনেকদিন তো কথা বলারও সময় পাই না। তুমিও ব্যস্ত আর আমিও। কোথাও বসি। আমার তরফ থেকে ট্রিট।”
তূর্ণ হেসে বলল,
“তোমার তরফ থেকে ট্রিট! সেই একটা সুযোগ পেয়েছি তোমার টাকা শেষ করার। কিন্তু সত্যি বলতে, বাসায় যেতে হবে। বাসায় একটু কাজ আছে।”
ইভা হেসে বলল,
“তূর্ণ, তুমি পাল্টাবে না। বাহানা ভালোই দিতে জানো। কি হবে আমার সাথে ডিনারে গেলে?”
“আরে সত্যি একটু ব্যস্ততা আছে।”
“জানি, ওসব বাহানা ছাড়া কিছুই না। এমন করছো যেন ডিনার ডেটের জন্য বলেছি। সে রকম কিছুই না। শুধু বসতাম, গল্প করতাম। এইটুকুই। তবে তুমি তো তাতেও রাজি না।”
“কেন বিশ্বাস করো না? বাসায় কাজ আছে তো।”
“কেন বিশ্বাস করব? বাসায় তোমার কিসের কাজ থাকতে পারে? এমন তো না বাসায় বউ বাচ্চা আছে। না খেয়ে তোমার জন্য ওয়েট করছে।”
তূর্ণ হেসে বলল,
“তোমার সাথে কথায় পারব না ভাই।”
“তাহলে কি যাচ্ছো?”
“বিশ্বাস করো, এক জনের সাথে একটা মিটিং আছে। তাকে কথা দিয়েছিলাম হসপিটালের পর তার সাথে দেখা করব।”
“কে সে?”
“তেমন কেউ না। এমনি পরিচিত।”
ইভার ব্যাপারটা ভালো লাগলো না একদমই। কে এমন যে তার কথা ইভাকে বলা যাবে না?
ইভা বলল,
“আচ্ছা ঠিকাছে। তাহলে আর কি করার৷ যাও।”
তূর্ণ বলল,
“থ্যাংকস। আর হ্যাঁ, ট্রিটটা কিন্তু পাওনা থাকবে। ছাড়বো না।”
ইভা মৃদু হাসলো। হাসিটা যে একেবারে জোর করে আনা তা বোঝাই যাচ্ছে না।
দুজন বের হলো একসাথে। তূর্ণ আর ইভা দুজনেই রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। বহু কষ্টে একটা পেয়েছে। তূর্ণ ইভাকে বলল, “তুমি যাও। আমি আরেকটা নিয়ে চলে যাব।”
ইভা বলল,
“তুমি যাও। আমি অন্য রিকশা পেয়ে যাব। তোমার দেরি হচ্ছে। পরে আবার যে অপেক্ষা করছে সে রাগ হয়ে যাবে।”
“উফ, বেশি কথা বলো তুমি৷ উঠে পড়ো না।”
ইভা আর কথা না বাড়িয়ে উঠে। তারপর বলে,
“তূর্ণ!”
“কি বলো?”
“তুমিও আসে। সামনে নেমে যেও। বাকিটুকু হেঁটে যেতে পারবে। যদি সমস্যা না থাকে তবে আসতে পারো।”
তূর্ণ ভাবলো, ইভা কথা খারাপ বলে নি। যাওয়া যায়। রিকশাও এখন তেমন একটা দেখছে না৷ তূর্ণ উঠে গেল। কিছু দূর যাওয়ার পর তূর্ণ বাসার গলির সামনে নেমে গেল।

.
পরশি দেখতে পেলো তার ফোনের স্ক্রিনে ‘এসপি রেহানা’ নামটা ভেসে উঠেছে। এই মানুষটার কল পেয়েই পরশির মুখে হাসি ফুটলো। অনেকটা খুশি হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিল। সালামের উত্তর দিয়ে এসপি রেহানা বললেন,
“কেমন আছো পরশি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ম্যাম। আপনি কেমন আছেন?”
“আমি তো ভালো আছি বাবা। কিন্তু মনে হচ্ছে ভুল করলাম। এই সময় ফোন করা উচিত হয় নি। বেশি রাত হয়ে গিয়েছ মনে হচ্ছে। কিন্তু তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল।”
“না ম্যাম। এসব কি কথা। আমাকে ফোন দিতে আপনার আবার টাইম নিয়ে ভাবতে হবে? যখন খুশি তখন ফোন করবেন৷ আমি বেশকিছু দিন ধরে আপনাকে ফোন করব ভাবছিলাম৷ কিন্তু হয়ে উঠছে না৷”
“আমিও ভেবে ভেবে আজ ভাবলাম ফোন দিয়েই দিই।”
“ভালো করেছেন ম্যাম।”
“তোমাকে কিন্তু একটা সুখবর দিতে ফোন করেছি। যেটা শুনে তুমি সব চেয়ে বেশি খুশি হবে আমি জানি।”
“কি ম্যাম?”
“সেটা বলব। আগে বলো তোমার শরীরের এখন কি অবস্থা? ভালো আছো তো? যে বিপদ গেলো তোমার উপর দিয়ে!”
“এখন একদম ঠিক আছি ম্যাম।”
“একা একা ভালো লাগে?”
“হ্যাঁ, একাই ভালো আছি ম্যাম৷”
“আমার শুধু তোমাকে নিয়ে চিন্তা হয় পরশি। জানোই তো তুমি আমার মেয়ের মতো। আমার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই। ছেলেটা তো থেকেও নেই। মাকে পরিচয়ই দেয় না। তুমিই সব আমার।”
“ম্যাম আবার এসব কথা বলে মন খারাপ করছেন। এসব কথা বাদ দিন।”
রেহানা হেসে বললেন,
“ওহ্, আমার মেয়ে তো আবার আমার মন খারাপ দেখতে পারে না৷ হাসি খুশি থাকতে হবে।”
“হ্যাঁ। একদম৷ এখন বলুন তো ওষুধ খেয়েছেন ঠিক মতো?”
রেহানা চুপ করে গেলেন৷ পরশি ব্যাপারটা৷ বুঝলো। পরশি এবার একটু রেগে বলল,
“এসব কিন্তু একদম মানবো না।”
“দেখো পরশি মিথ্যা তোমাকে বলতে পারি না৷ তাই বলছি না। আমার ভালো লাগে না রোজ রোজ ওষুধ খেতে। ইনসুলিন নিতে। তাই মাঝে মাঝে হয়ে যায় একটু অনিয়ম।”
“এটা কেমন কথা ম্যাম। ভালো না লাগলেও আপনাকে ওষুধ খেতে হবে।”
“আচ্ছা। তোমার কথা ফেলতে তো পারব না।”
“ম্যাম এবার বলুন সুখবরটা কি?”
“সুখবর আমার আবার ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে।”
পরশি শুনে ভীষণ খুশি হলো। পরশি রেহানাকে ভীষণ ভালোবাসে।
“কিহ্! ম্যাম, সত্যি বলছেন?”
“হ্যাঁ রে বাবা। তোমার কাছে আসছি। জানতাম তুমি খবরটা শুনলে এরকম খুশিই হবে।”
“ম্যাম কবে আসবেন? আমি আর ওয়েইট করতে পারছি না।”
“আসব শীঘ্রই।”
“আচ্ছা ম্যাম। আর হ্যাঁ আমার বাসায়ই থাকতে হবে। আলাদা বাসা নিলে চলবে না।”
“আচ্ছা বাবা সেটা দেখা যাবে। আমিও কি তোমার থেকে দূরে থাকতে পারি নাকি বলো?”
“না পারেন না। আমিও পারি না। তাড়াতাড়ি আসুন।”
“আচ্ছা। এখন রাখি৷ রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়বে কিন্তু।”
“ঠিকাছে ম্যাম। শুভরাত্রি।”

.
পরশি ফোনটা রেখে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। না সাড়ে এগারোটার বেশি বাজে। তূর্ণ এখনও আসেনি৷ হয় তো আসবেও না। তার হয় তো মনে নেই। পরশি ভাবলো, ভালো লাগছে না৷ এখন তার বাসায় চলে যাওয়া উচিত। এই ভেবে সে নিচে চলে গেল। অন্যদিকে তূর্ণ তাড়াহুড়ো করে লিফটে উঠলো। অন্যদিকে উপর থেকে পরশি লিফট কল করল। তূর্ণ লিফটে উঠে গিয়ে উপরে পৌঁছে গেল। লিফটের দরজা খুলতেই তূর্ণ তাড়াহুড়ো করে লিফট থেকে বের হতে গেল। আর পরশিও দাঁড়িয়ে ছিল লিফটের বাহিরে। পরশিকে দেখে সে বলল,
“পরশি!”
পরশিও তূর্ণকে এমন সময় আশা করে নি। তাই তূর্ণকে দেখে অবাক হলো।
“তূর্ণ! আপনি?”
“হ্যাঁ। আসার কথা ছিল না কি? বলেছিলাম না তোমার গল্প শুনবো। হ্যাঁ, সরি দেরি করে ফেলেছি।”
পরশি অবাক হয়ে গেল। তূর্ণর তাহলে মনে ছিল! সে নিশ্চয়ই কোনো কাজে আটকে গিয়েছিল। আর হসপিটাল থেকে সোজাসুজি ছাদে চলে এসেছে! বাসায়ও যায় নি মনে হয়। তার মানে পরশির কথা মনে ছিল! পরশির বেশ ভালো লাগল। কেউ তো কথা রাখে। এতেদিন মনে হয়েছিল সবাই কথা দিয়ে ভুলে যায় কিংবা হারিয়ে যায়। অথচ তূর্ণ তা করেনি। তূর্ণ সাথে তো ওর কোনো রকমের সম্পর্ক নেই৷ চেনা পরিচিতি নেই৷ অল্প দিনের পরিচিতিতে কে এভাবে একজন মানুষকে গুরুত্ব দেয়? তবে কি চেনা মানুষই দূরে ঠেলে দেয় আর অচেনা মানুষই গুরুত্ব দিয়ে আগলে রাখে? কথা দিয়ে কথা রাখে? এখানে তো তূর্ণর কোনো স্বার্থও দেখা যাচ্ছে না।
অথচ একটু আগেও পরশি ভাবছিল তূর্ণ ভুলে গিয়েছে সে কি কথা দিয়েছিল। ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরশি কে যে তার জন্য তূর্ণ তার সময় নষ্ট করবে? এসব ভেবেই তো ফিরে যাচ্ছিল। অথচ এই তূর্ণই তার ভুল ভেঙে দিল ক্ষণিকে।
পরশি এগুলো ভাবতে থাকলো। তূর্ণ পরশিকে ডাক দিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
পরশি ফিরে এলো তার ভাবনা জগৎ থেকে।
“হ্যাঁ! না, কিছু হয় নি তো।”
“কি ভাবছেন?”
“ভাবছি, আপনার তাহলে মনে ছিল ব্যাপারটা। আমি মনে করেছিলাম ভুলে গিয়েছেন। কারণ ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তেমন জরুরি কোনো বিষয় না যে মনে রাখবেন।”
“জরুরি কেন নয়? অবশ্যই জরুরি৷ কোনো কিছুকেই কম গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন না। আমি দুঃখিত। ভেবেছিলাম দশটার মধ্যে বাসায় ফিরব। কিন্তু আমি কাজ শেষ করে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।”
“এভাবে বলবেন না৷ আপনি এসেছেন এটাই অনেক। ভাগ্যিস সঠিক সময়ে এসেছিলেন৷ না হলে আমি চলে যাচ্ছিলাম। আরেকটু পরে আসলে আমাদের দেখা হতো না।”
“হুম। আচ্ছা চলুন ছাদে যাই।”
“কিন্তু আপনি মাত্র ফিরেছেন। ফ্রেশ হবেন না? খাবেন না?”
“ওসব পরে দেখা যাবে।”
“কেন পরে কেন?”
“কারণ আগে তারা গুনতে হবে। গল্প শুনতে হবে।”
“যেই গল্পগুলো শুনতে এতোটা ব্যাকুল হয়ে আছেন গল্পগুলো কিন্তু সুন্দর না৷ চরম অগোছালো।”
“হলো অগোছালো। মাঝে মাঝে অগোছালো গল্পগুলো ভালো লাগে। যার কোনো শুরু শেষ, আগামাথা নেই৷ তবুও সে সব গল্প অনুভব করা যায়।”
পরশি আর তূর্ণ ছাদে উঠলো। পরশি আকাশের তাকিয়ে তারপর হেসে বলল,
“তারা গুনার কথা বলেছিলেন৷ অথচ তারাগুলো মেঘেদের মাঝে লুকিয়েছে। তারারাও চায় না আমাকে৷ ওরাও আমাকে পছন্দ করে না।”
“হ্যাঁ। ওদেরও পছন্দ হয় না আপনাকে। ওদের হিংসে হয়। কারণ আপনি ওদের থেকেও সুন্দর তাই।”
পরশি হেসে দিল। তারপর বলল,
“মজা ভালোই করতে পারেন ডাক্তার সাহেব।”
“তবু আপনার মুখে হাসি আনতে পেরেছি তো।”
“ওহ্, এইজন্য ধন্যবাদ।”
“তা বলেন গল্প।”
“সব গল্প একদিনে বলতে নেই।”
“কেন?”
“গল্প শেষ হয়ে যাবে। গল্প শেষ হয়ে গেলে বলার আর কিছু থাকবে না। তখন চুপচাপ বসে থাকতে হবে তাই ধীরে ধীরে গল্প শুনাবো।”
“আইডিয়া খারাপ না।”
“আচ্ছা একটা ব্যাপার শেয়ার করি।”
“জি বলুন।”
“আজ আমি একটা কারণে অনেক খুশি।”
“বাহ্। এটাতো ভালো কথা।”
“হ্যাঁ।”
“তো খুশির কারণ কি জানতে পারি? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড।”
“অবশ্যই। আমার একজন প্রিয় মানুষ আছে। মূলত ম্যামের সাথে চাকরি করতে গিয়েই দেখা। আমার বস ছিলেন৷ আমার পোস্টিং যখন ফরিদপুর হয় তখন ম্যামের সাথে পরিচয়। কিভাবে যেন এতো ভালো বন্ডিং হয়ে গিয়েছে। ম্যামের পোস্টিং আবার ঢাকায় হয়েছে। আবার দুজন একসাথে হবো। সেটা ভেবেই খুব ভালো লাগছে।”
পরশি খুব খুশি হয়ে কথাগুলো বলছিল। তূর্ণ তাকিয়ে দেখছিল ওর সেই খুশিটা। তূর্ণ বলল,
“বাহ্। ভালো তো। যাক কাউকে কাছে পাচ্ছেন তবে।”
“হ্যাঁ।”
“আশা করছি আর মন খারাপ হবে না।”
পরশি থমকে যায়৷ তারপর বলে,
“মন খারাপের তো কত কারণ থাকে। মন খারাপ কি শেষ হয়?”
“আচ্ছা, আপনি বলছিলেন আপনার কি রকম সমস্যা হচ্ছে। এটা নিয়ে বলুন।”
“পরে কখনো বলি? এখন ইচ্ছে করছে না৷ ভালো লাগছে।”
“আচ্ছা। আপনার যখন ভালো লাগে। আর যদি প্রবলেম সল্ভ হয়ে যায় তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ।”
“কিছু প্রবলেম কখনো সল্ভ হয় না৷ বাড়তেই থাকে।”
“বাড়বে না। যেটুকু আছে সেটুকুতে সীমাবদ্ধ করতে শিখুন৷ দূর করে দিন সমস্যাগুলো।”
“আপনার কথায় কিছু একটা আছে।”
“কি?”
“জানি না৷ তবে খুব উৎসাহ পাই।”
“সে রকম কিছু না৷”
“আচ্ছা। আমার মনে হচ্ছে আপনি অনেক টায়ার্ড। আজ তবে বাসায় গিয়ে রেস্ট নিন।”
“ধন্যবাদ। আপনিও রেস্ট নিন। আবার অন্য একদিন তারা গুনা হবে। আজ তো হলো না।”
পরশি হেসে বলল,
“আচ্ছা। সময় পেলে জানাবেন।”
“জি, অবশ্যই।

চলবে….

ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ২৪

আজকাল প্রায়ই কথা হয় তূর্ণ আর পরশির। ছাদে গিয়ে অনেক গল্প হয় যখন দুজনের সময় হয়। তূর্ণ আগে হসপিটাল থেকে দেরি করতে আসতো। আজকাল যেন তাড়াতাড়ি আসে পরশির সাথে কথা বলার জন্য। এই কয়দিনে দুজনের মধ্যে ভালোই সখ্যতা হয়েছে৷ আজও ছাদে বসে পূর্ণিমা দেখছে দুজনে একসাথে। চাঁদটার দিক তাকিয়ে আছে পরশি। যখন থেকে ছাদে আছে ঠিক তখন থেকেই তাকিয়ে আছে চাঁদটার দিকে। তূর্ণ এসেছে তখন শুধু ওর দিক তাকিয়েছিল। তূর্ণ এসে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল কি খবর। কিন্তু পরশি নির্বিকার তাকিয়ে রইলো চাঁদের দিকে। তূর্ণও জোর করলো না। মাঝে মাঝে একটু সময় দেওয়া উচিত। পরশির বলার হলে পরশি নিজেই বলবে ওর কি হয়েছে।
কতক্ষণ দুজন নীরবে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ আজ যেন দুজনের সাথে চাঁদ এসে কথা বলার সঙ্গী হয়েছে। তূ্র্ণ কিছুক্ষণ পর পরশির চোখের দিক তাকিয়ে দেখল এই মায়াবী চোখদুটো থেকে অশ্রুবর্ষণ হচ্ছে। তূর্ণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“পরশি!”
পরশি তাকালো।
“আপনি কাঁদছেন কেন?”
পরশির কান্না বেড়ে গেল। তূর্ণ বলল,
“পরশি! প্লিজ কান্না করবেন না।”
পরশি তাকিয়ে বলল,
“কান্না থামাবো কি করে? খুব কান্না পাচ্ছে তো।”
“আচ্ছা ঠিকাছে। অল্প কাঁদেন। বেশি কান্না করবেন না। তাহলে চোখ ফুলে যাবে।”
পরশি তূর্ণর কথা শুনে কান্নার মাঝেই হেসে দিল বাচ্চাদের মতো করে। তূর্ণ আবার দুষ্টুমি করে বলল,
“এই কাজ প্রণয়িনীকে করতে দেখেছি, চন্দ্রাকেও করতে দেখেছি। আপনিও যে কান্নার মাঝে হেসে দিবেন ভাবিনি। সত্যিই অবাক হলাম।”
পরশি এবার কান্না থামিয়ে বলল,
“যার আশে পাশে আপনার মতো মানুষ থাকবে সে কান্নার মধ্যে না হেসে পারবে না৷ আপনার কথায় না হেসে পারা যায় না৷ মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথা বলেন।”
“আমি বুঝি না কখন আপনি আমার প্রশংসা করেন আর কখন দুর্নাম। এই তো কখনো বলেন আমি সুন্দর সুন্দর কথা বলি যেগুলো নাকি মনে গেঁথে যায়। আবার এখন বললেন অদ্ভুত কথা বলি।”
পরশি আবার হেসে দিল। তূর্ণ বলল,
“তবে যাই বলেন আমার এই অদ্ভুত কথা আপনার কান্না থামিয়ে মুখে হাসি এনেছে। এবার চোখের পানিটা মুছে ফেলুন তো। শুকিয়ে গিয়ে মুখে দাগ হয়ে যাচ্ছে। জানি এই কথায়ও হাসবেন। আর হাসার জন্যই বলেছি।”
পরশি আবার মুচকি হাসলো। তূর্ণ বলল,
“এবার কি বলতে চান কি হয়েছে?”
“তেমন কিছু না। বাবার কথা মনে পড়েছে।”
“হঠাৎ এরকম মনে পড়ে গেল যে?”
“জানি না। খুব যেতে ইচ্ছে করছে বাসায়।”
“তো যেয়ে ঘুরে আসুন। আংকেলের সাথে দেখা করে আসুন।”
“না। লাস্ট টাইম গিয়ে আমার মানুষগুলোর প্রতি ঘৃ`ণা ধরে গিয়েছে। এখন যাওয়ার ইচ্ছে নেই।”
“কেন কি হয়েছিল?”
“আমার ভাই ভাবী কেমন মানুষ জানেনই তো। বোন আর মাও তেমন পছন্দ করেন না। শেষ যখন গিয়েছিলাম তখন ভাই ভাবী ছিল না বাসায়। আমি যাওয়ার পর জানতে পেরে মাকে ফোন করে বেশি কথা শুনিয়েছিল ভাবী৷ আর তারপর মা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। রাগ হয়ে চলে আসছিলাম তখন আবার চাচী এসে বেশি কথা শুনিয়েছিল। এই নিয়ে প্রচুর মেজাজ খারাপ হয়ে আছে ওদের উপর। তাই বেশ কিছুদিন যাব না ভাবছি।”
“আচ্ছা। বুঝলাম। কিন্তু একটা জিনিস পরশি, আপনার ভাবীর না হয় বুঝলাম সমস্যা আছে। কিন্তু বাকি সবার কি? মানে আন্টি কেন রিঅ্যাক্ট করে? আর আপনার ছোটবোনই বা কেন?”
“সে অনেক কাহিনি। যদি শোনার মতো সময় থাকে তবে বলতে পারি।”
“সময় আছে। আপনার বলার ইচ্ছে থাকলে বলুন।”
“আমার মেইন সমস্যা আমি বিয়ে করিনি। বিয়ে করছি না। চাকরি করে চলছি। সংসার করি না৷ বয়স পেড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে অবিবাহিত মেয়েরা এভাবে থাকলে লোকে আজে বাজে কথা বলে। মানে আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। কথাগুলো তো এদের আমাকে বলার সাহস নেই৷ এসে আমার মাকে বলে। তারপর আবার ভাবী ঝামেলা করে দেখেও মা বিরক্ত। তারপর পরীর বিয়ে দিতে পারছে না৷ পরী, মানে আমার ছোট বোন। চন্দ্রার থেকে বয়সে একটু বড় হবে হয় তো। সে বিয়ে করতে রাজি৷ কিন্তু লোকে বলে বড় মেয়ে বিয়ে করে নি কেন। সেটা পরের কথা। পরী এক বখাটে টাইপ ছেলেকে ভালোবাসে। গুন্ডা টাইপ। একটা না শত প্রেম করে। অথচ এই জিনিস পরীকে বুঝাতে পারি না৷ বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল পরীর ছেলেটার সাথে৷ আমি তখন ঢাকার বাইরে ছিলাম৷ এসে ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য পেয়ে বিয়ে ভেঙে দেই। এরপর থেকে আমার আদরের ছোট বোনও আমাকে সহ্য করতে পারে না। মাও সহ্য করতে পারে না আমি বড় বোন হয়ে ছোট বোনের এতো বড় সর্বনাশ কি করে করলাম। এর মাঝে ভাবী আর আত্মীয় স্বজনরা আরও ফালতু কথা ঢুকিয়ে রেখেছে। এইসব ঝামেলা আর নিতে পারি না৷ বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। রোজ বাসায় এগুলো ভালো লাগতো না৷ তাই এখন একা থাকি।”
“বুঝলাম। বিশাল ঝামেলা।”
“হ্যাঁ। আমিই ঝামেলা।”
তূর্ণ এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
“একদমই না। এসব কথা ভাবেন কি করে?
” সমস্যা কোথায় জানেন?”
“কেথায়?”
“এই মানুষের চিন্তাধারায়। নিম্ন মস্তিষ্কের মানুষরাই এসব বলে, চিন্তা করে। আপনি অবিবাহিত বলে আপনাকে এসব কথা শুনাচ্ছে! আমি অবাক হলাম, মানুষের চিন্তাধারা এরকম কেন!”
“এই সমাজ এগুলোতে অভ্যস্ত। কোনো নারী নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, স্বাধীনভাবে চলবে এটা এই সমাজের সহ্য হয় না৷ পুরুষ সমাজ লাখ লাখ টাকা উপার্জন করলে কোনো সমস্যা নেই৷ কেউ খোঁজ করে না কোন পথে উপার্জন করছে। একজন নারী সফল হলে, সম্মানিত চাকরি করলে এই সমাজের মানুষ তাকে নিয়ে কটু কথা বলবে। তাও শুধু অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে। রাত করে বাড়ি ফিরলে কত রকমের জঘন্য কথা শুনতে হয়! ছিহ্!”
কথাগুলো বলল আর চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। তূর্ণ স্বাভাবিকভাবে বলল,
“ইউ আর স্ট্রং। আপনি এসব কেন কানে লাগান?”
“এখন লাগাই না। প্রথম প্রথম গায়ে লাগতো। তখন পাল্টা জবাব দিতে পারতাম না৷ এরপর একজন চমৎকার মানুষের সাথে দেখা হলো। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে মানুষকে জবাব দিতে হয়।”
“কে সে?”
“বলেছিলাম না ম্যামের কথা? ম্যাম শিখিয়েছেন। ম্যাম আমার আদর্শ। আমি প্রতি ক্ষেত্রে ম্যামকে ফলো করার চেষ্টা করি।”
“ভালো। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রে একজনকে অনুসরণ না করে নিজর থেকেও কিন্তু কিছু করা উচিত। প্রতিটা মানুষকে তার নিজের মধ্যকার বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকা দরকার।”
“হ্যাঁ, তা ঠিক।”
“মাইন্ড করলেন নাকি এই কথায়?”
“না না৷ একদমই সেরকম না৷ কথাটা সুন্দর বলেছেন৷”
“থ্যাংকস।ভালো কথা, আপনার ম্যাম আসবে বলেছিলেন। আসেন নি?”
“না, একটু দেরি হবে৷ এসে জয়েন করেই ছুটিতে চলে গিয়েছেন৷ একমাসের ছুটিতে।”
“ওহ্ আচ্ছা।”
কতক্ষণ আবার নীরবতা বিরাজ করলো দুজনের মধ্যে। পরশি গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তূর্ণ পরশিকে দেখল। তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। আজকাল বুঝতে পারে না ওর আসলে কি হচ্ছে। পরশির দিকে কেন বারবার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে? কেন ওর সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে? কেন বাহানা খুঁজে বেড়ায় পরশিকে দেখার জন্য, পরশির সাথে কথা বলার জন্য, পরশির কথাগুলো শোনার জন্য? কেন পরশির প্রতি ওর এতোটা মায়া? এই যে পরশি তার গল্পগুলো শোনায়, পরশি হয় তো নিজেকে হালকা করার জন্য, নিজের মনকে শান্ত করার জন্য, কষ্টগুলো ঝেড়ে ফেলার জন্য, মানসিক চান্তির জন্য তূর্ণকে বলে। কিন্তু তূর্ণর কেন মনে হয় পরশি একা। কেন ওর জন্য মায়া হয়? কেন মন চায় পরশির গল্পগুলো শুনে পার হয়ে যাবে অনন্তকাল। থামবে না দুজনের কথা। তূর্ণর বন্ধুরা, বোন, দাদা দাদী থাকতেও মনে হতো কথা বলার কেউ নেই৷ কিন্তু পরশিকে পাশে পেলে এমন লাগে কেন যে কথা বলার একটা মানুষ আছে? কেন একটা শান্তি আসে মনে? এগুলো কি বিশেষ অনুভূতি? কেমন অনুভূতি? জানা নেই তূর্ণর।
পরশি খেয়াল করল তূর্ণ গম্ভীরতার সাথে কি যেন ভাবছে। চাহনিতে একটা অস্থিরতা বিরাজমান৷ এই অস্থিরতা কিসের? তূর্ণ কি কোনো সমস্যায় আছে তবে? পরশি আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি ভাবছেন?”
তূর্ণ ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে পরশি প্রশ্নের উত্তরে বলল,
“কিছু না।”
“কিছু তো ভাবছিলেন৷ আপনার চেহারায় সেই ভাবনা স্পষ্ট।”
“সত্যিই স্পষ্ট?”
“হু।”
“বুঝতে পারছেন কি আছে সেই ভাবনায়? এই ভাবনার শুরু কোথায়, শেষ কোথায়? চেহারা কি স্পষ্ট আছে এগুলো?”
পরশি বলল,
“এখন তো আমি একদম শিওর আপনি কোনো ঝামেলায় আছেন৷ না হলে এগুলো বলতেন না।”
তূর্ণ চুপ হয়ে যায়৷ কিছু বলে না৷ পরশি আবার বলল,
“বলুন না কি হয়েছে? সব সময় তো আমার কথাই শুনেন। আমারও কিন্তু আপনার কথা শোনা উচিত।”
তূর্ণ বলল,
“জানি না। ইদানিং কেমন যেন অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি৷ কিছু ভালো লাগছে না৷ এই অনুভূতিগুলো কেন হচ্ছে জানা নেই৷ এগুলো কিসের জন্য তাও জানা নেই। এরকম আগে হয় নি। হঠাৎ হঠাৎ আজকাল ভাবনার জগতে ভেসে যাচ্ছি৷ অনেক ভেবেও এসব অনুভূতির কোনো ডেফিনিশন পাচ্ছি না। খুঁজতে গেলে যেন হারিয়ে যাই৷ এই অনুভূতি ভালো লাগার না খারাপ লাগার তাও বুঝি না৷”
পরশি কিছুক্ষণ ধরে বুঝতে চেষ্টা করছে তূর্ণর কথাগুলো। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“এই অনুভূতিগুলো কি কোনো মানুষের জন্য হয়? তার আশেপাশে থাকলে হয় কিংবা কাউকে নিয়ে ভাবলে এমন লাগে?”
“হয় তো। শিওর না।”
“হয় তো যেই মানুষটার জন্য অনুভূতিগুলো জন্মে থাকে তাকে ভালোবাসেন৷ কিন্তু বুঝতে পারছেন না।”
তূর্ণ এবার পরশির দিক তাকিয়ে বলল,
“না, ভালোবাসি না৷ আমি কাউকে ভালোবাসতে পারব না৷ ভালোবাসা বলতে কিছু নেই৷ সবই মোহ। আর মোহ কেটে একটা সময় পর যায়।”
“হয় তো। কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা বলেও কিছু আছে।”
“এসব হয় নি শিওর।”
তূর্ণর কথায় বিরক্তি স্পষ্ট। আর তা পরশির চোখ এড়ালো না। পরশি বলল,
“সরি। হয় তো ভুল কিছু বলে ফেলেছি যা আপনার পছন্দ হয় নি।”
“না সে রকম কিছু না আসলে। মানে প্রেম ভালোবাসা, বিয়ে, সংসার এগুলোর প্রতি আমার একদমই ইন্টারেস্ট নেই। আমার মনে হয় কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী না৷ এক সময় দু’জনের মানুষের মাঝের সম্পর্কের অবসান ঘটবে।”
“সত্যিই কি তাই?”
“জানি না৷ এক এক জনের কাছে এক এক রকমের মনে হয়। যেমন আমার দাদু দাদীর ধারণা উল্টোটা। তাদের সম্পর্ক টিকে গিয়েছে। তাই তারা ভালোবাসায় বিশ্বাসী৷ অন্যদিকে যাদের সম্পর্ক টিকে নি তারা ভালেবাসায় বিশ্বাসী না।”
“আপনি যাকে ভালোবাসতেন তার সাথে কি আপনার সম্পর্কটা টিকেনি?”
প্রশ্নটা করে পরশিই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে পরক্ষণেই বলল,
“সরি। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করে ফেললাম। এক্সট্রিমলি সরি। কিছু মনে করবেন না।”
“ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি। তবে আপনার ধারণা ভুল। আমার নিজের সম্পর্কে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি, ব্যাপারটা তা নয়। আমি ছোটবেলায় খুব কাছের মানুষদের বিচ্ছেদ হতে দেখেছি। ভালোবাসার জন্য মানুষের থেকে কষ্ট পেয়ে মৃত্যুকে গ্রহণ করেছে এমন মানুষদেরও খুব কাছে থেকে দেখেছি। তাই এসবের প্রতি ঘৃণা চলে এসেছে।”
“আপনি বলেছিলেন আপনার বাবা মা সেপারেটেড! আংকেল আন্টির সেপারেশন হয়েছিল কি নিয়ে?”
“সে অনেক কাহিনি। অন্য একদিন না হয় বলি। আজ থাকুক। অন্য কোনো একদিন অবশ্যই বলব।”
পরশি আর কথা বাড়ালো না৷ সে ভাবলো তূর্ণ হয় তো বলতে চাচ্ছে না৷ না বলতে চাইলে থাকুক। এমনিও বেশি পারসোনাল প্রশ্ন করাটা উচিত হয় নি। তাই পরশি বলল,
“ঠিকাছে। অসুবিধা নেই। আজ তবে উঠি? অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।”
“জি অবশ্যই। চলুন।”
দুজন এরপর কথা বলতে বলতে নিজেদের ফ্লোরে পৌঁছালো। তারপর মধ্যকার কথোপকথনের অবসান ঘটিয়ে যার যার বাসায় ঢুকলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here