ভালোবাসা কারে কয়,৩৯,৪০
শবনম মারিয়া
পর্ব ৩৯
পরশির সাথে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে ইদানীং তূর্ণ। পরশিকে একা থাকতে দিতে চায় না। মানুষ একা থাকলেই দুঃখগুলোকে মনে করে। কষ্ট পায়। কারো সাথে থাকলে, সময় কাটালে তখন ওসবে ব্যস্ত থাকে। তখন শত দুঃখের মাঝেও মানুষ হেসে ফেলে। সেদিনের পর তূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে পরশির ভালোবাসা চাইবে না। তবে একজন ভালো বন্ধু হিসেবে সবসময় পাশে থাকার চেষ্টা করবে। তূর্ণ তাই করছে।
সেদিন যখন তূর্ণ বাসায় ফিরেছিল তারপর রোকেয়া, মিরাজ, প্রণয়, চন্দ্রা জানতে চেয়েছিল তূর্ণর কাছে কি হয়েছিল। তূর্ণ শুধু হাসি মুখে বলেছিল,
“কাউকে ভালোবাসলেই তার ভালোবাসা পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। শুধু নিজে ভালোবেসে এই জগতে টিকে থাকা যায়। ভালোবাসলেই সেই মানুষটাকে নিজের করে পাওয়া লাগে না৷ না পেয়েও ভালোবাসা যায়।”
তূর্ণকে এরপর আর কেউ বিরক্ত করে নি এই ব্যাপার নিয়ে। তবে তার দাদা দাদি নিরাশ হয়েছেন। তারা চেয়েছিলেন তূর্ণ আর পরশির মাঝে কিছু হোক। ওরা একে অপরের হোক। একে অপরের জন্য বাঁচুক। কিন্তু তা হলো না।
অন্যদিকে প্রণয় বুঝতে পারছে তূর্ণর ভেতরকার কষ্ট। কাউকে ভালোবাসো কিন্তু তার ভালোবাসা কখনোই পাবে না, তাকে ভালোবাসার কথাগুলো বলতে পারবে না, অনুভুতি প্রকাশ করতে পারবে না এসব ব্যাপারগুলো অনেক ব্যথা দেয়।
প্রণয় তূর্ণর সাথে এই নিয়ে অনেক কথা বলেছে। বন্ধুকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছুই পায় নি প্রণয়। শুধু তাকে বুঝিয়েছে যা ভালো লাগে তাই করতে। পরশির আশেপাশে থাকতে ভালো লাগলে তাই থাকবে। কিন্তু ওকে বুঝতে দিবে না৷
তূর্ণও তাই করছে। সে সত্যিই পরশির আশেপাশে থাকতে চায়। পরশির সাথে সময় কাটাতে চায়। পরশির কষ্টগুলো কম করতে চায়।
পরশিও দিন দিন তূর্ণকে দেখে অবাক হচ্ছে। এই মানুষটাকে কি তার কষ্টগুলো মুছে দিতেই পাঠানো হয়েছে? ওর যখনই মন খারাপ থাকে তখনই তূর্ণ ওর মন ভালো করে। যেভাবে পারে ওর সাহায্য করে। পরশি কখনোই বিরক্ত হয় না তূর্ণের কর্মে। বরং মুগ্ধ হয়। পরশি ইদানীং দ্বিধায় ভুগছে। তূর্ণকে বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে তূর্ণকে বললেই সে শান্তি পাবে। কিন্তু সে পারছে না। পরশি চায় তার অতীতকে ভুলতে। আচ্ছা, এমন একটা কথা যা সে কোনোদিনও কাউকে বলতে চায় নি অথচ আজ কেন তার মনে হচ্ছে কথাটা তূর্ণকে বললে সে শান্তি পাবে? কেন তার তূর্ণর প্রতি এতোটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছে? কেন তার মনে হচ্ছে তূর্ণ তাকে বুঝতে পারবে? তূর্ণর প্রতি পরশি এতোটা দূর্বল কেন হচ্ছে?
এগুলো ভাবতে ভাবতেই পরশির ফোনে কল আসলো। পরশির বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। হার্ট অ্যাটাক করেছেন৷ পরশিকে তার বাসার কেউ জানায় নি। জানিয়েছে তার চাচাতো ভাই। সে মনে করেছে পরশিকে ব্যাপারটা জানানো শ্রেয়। পরশি জানার পর হসপিটালে ছুটে গিয়েছে। গিয়ে দেখলো তার বাবার অবস্থা বেশি ভালো না। দ্রুত সার্জারী করা প্রয়োজন। সার্জারীর জন্য তার ভাই টাকা জোগাড় করতে পারছে না। তাই সে ডাক্তারের কাছে সময় চেয়েছে। এইদিকে সময় দেওয়া সম্ভব না৷ এই নিয়ে পরশি ও তার ভাই পরশের আবার ঝগড়া লেগেছে। পরশি বলেছে,
“সময় চাচ্ছো কিভাবে ভাইয়া? বাবার অবস্থা দেখেছো?”
“তো আমি কি করব? এভাবে তো আমার পক্ষে টাকা নিয়ে আসা সম্বব না তাই না? আমার তো টাকার ফ্যাক্টরি আছে তাই না? তুই যা এইখান থেকে। নাক গলাতে আসবি না।”
পরশির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ও বলল,
“আমিই নাক গলাবো। তোর নাক গলানো লাগবে না৷ শ্বশুরের চিকিৎসার সময় টাকা দিতে পারিস, বউয়ের আবদার পূরণ করতে টাকা উড়াতে পারিস, এখন বাবার সার্জারীর সময় এসব কথা বলিস কোন সাহসে? আমার বাবার সার্জারী আমি করাবো। এখনই করাবো।”
পরশির এসব কথা বলায় পরশ রেগে গিয়ে পরশির গালে থাপ্পড় মারতে গেল। তূর্ণ এসে পরশের হাত ধরে ফেলে। তূর্ণকে পরশি হসপিটালে আসার সময়ই ফোন করেছিল৷ ডাক্তারের ডিটেইলস নিতে। পরশি জানতে পেরেছিল তূর্ণ যেই হসপিটালের ডাক্তার সেখানেই তার বাবাকে ভর্তি করা হয়েছে। তাই সে তূর্ণকে ফোন করে বলেছিল। তূর্ণ একটু ব্যস্ত ছিল তাই আসতে দেরি হয়েছে। কিন্তু সে এসেই দেখে পরশ পরশির সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। এমনকি পরশির গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছে। তূর্ণ জানে পরশ কেমন। তাই ওকে তূর্ণ সহ্যই করতে পারে না।
কয়েকদিন আগে তূর্ণকে নিয়ে পরশি ওদের বাসায় গিয়েছিল ওর বাবার সাথে দেখা করাতে। তূর্ণকে পরশি তার ভালো বন্ধু মনে করে তাই। পরশির বাবাই তূর্ণর গল্প শুনে তার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। তখন পরশ তূর্ণ আর পরশিকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলেছে। সেদিনও তূর্ণর ভীষণ রাগ হয়েছিল। মন চেয়েছিল পরশকে মারতে। কিন্তু সে পরশির বাবা মাকে শ্রদ্ধা করে। ঝামেলা করতে চায় না বলে শুধু কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে পরশিকে নিয়ে চলে এসেছিল।
তূর্ণকে দেখে পরশ আরও বেশি চটে গেল। পরশ তূর্ণকে ধমকে বলল,
“তোর কতো বড় সাহস তুই আমাকে আটকাস?”
তূর্ণ আরও শক্ত করে পরশের হাত চেপে ধরে বলল,
“বেশ করেছি। যে যেমন তার সাথে তেমনটাই করতে হয়।”
“হাত ছাড়।”
তূর্ণ হাত ছেড়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,
“আপনার সাহস কি করে হয় পরশির সাথে এরকম ব্যবহার করার?”
“আমার বোন। আমি যা খুশি করব। কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।”
পরশি বলে উঠলো,
“আছে। একশো বার হস্তক্ষেপ করার অধিকার আছে।”
তূর্ণ পরশির কথা শুনে অবাক হলো। কিন্তু সেদিকে আর সময় নষ্ট না করে পরশকে বলল,
“ভালোর ভালো বলছি, যা করার পরশিকে করতে দিন। কোনো রকমের ঝামেলা করবেন না। এই হসপিটালে আমার কথার অনেক দাম আছে মনে রাখবেন।”
পরশ রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। তারপর সবরকমের ব্যবস্থা তূর্ণ করেছে। কিন্তু পরশির বাবার অবস্থা বেশি একটা ভালো না। অন্যদিকে পরশির মা, বোন দুজনেই ভেঙে পড়েছে, কাঁদছে। তূর্ণ তাদেরও আশ্বাস দিয়েছে। যদিও পরশির বোন পরিও তূর্ণকে অপছন্দ করে। সেও তূর্ণর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। তূর্ণ সে সব গায়ে মাখেনি৷ তূর্ণর জন্য জরুরি পরশি। পরশিও তার বাবার এইরকম অবস্থায় অনেক ভেঙে গিয়েছে।
গভীর রাত। পরশির মা আর তার বোন ওটির বাইরে বসে আছে। পরশিও ছিল। তবে কিছু ওষুধ নিতে সে গিয়েছে তূর্ণর সাথে। ওষুধ নিয়ে তূর্ণ আর সে আসছিল। পরশির অনেক খারাপ লাগছে। অনেক বেশি কান্না পাচ্ছে। সে জানে না কি হবে। তার বাবার খারাপ কিছু হবে না তো! এসব চিন্তায় পরশি থাকতে পারছে না। তার মাও কথা বলছে না কোনো। মায়ের এমন অবস্থায় মায়ের সামনেও পরশি শক্ত হয়ে আছে যেন তারা ভেঙে না পড়ে। কিন্তু পরশির সত্যিই ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। তার একটা কাঁধ প্রয়োজন যেখানে মাথা রেখে সে কান্না করতে পারবে। যেখানে সে একটু ভরসা পাবে। একটু সান্ত্বনা পাবে। একটু শান্তি পাবে।
পরশি হাঁটতে হাঁটতে হুট করে একটা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লো। এখন রাত তিনটা। এই সময় এইদিকে তেমন কেউ নেই। শুধু যাদের আপনজনরা জীবন নিয়ে লড়ছে তারাই থাকে এতো রাতে হসপিটালে। পরশির হঠাৎ গিয়ে বসে পড়ায় তূর্ণ একটু অবাক হলো। এরপর আরও অবাক হলো যখন দেখলো পরশি কান্না শুরু করেছে। তূর্ণ দ্রুত গিয়ে পরশির পাশে বসলো। তার কাঁধে হাত রাখলো। তারপর বলল,
“পরশি!”
পরশি তূর্ণর দিক তাকালো। তারপর আচমকা তূর্ণকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। তূর্ণ পরশির পিঠে হাত রেখে বলল,
“পরশি আশা ছাড়বেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পরশি তূর্ণকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে কেঁদে বলে,
“বাবার কিছু হলে আমার কি হবে তূর্ণ? আমি একেবারে একা হয়ে যাব। নিজেকে অনেক একা লাগছ। অনেক একা লাগছে। আমার কেউ নেই তূর্ণ। দেখুন না মা কিভাবে পরিকে জড়িয়ে ধরে আছে। আর আমার সাথে ঠিকমতো কথাও বলছে না। একটু কি পারতো না আমাকে জড়িয়ে ধরতে? আমি কার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদবো তূর্ণ? আমি আর পারছি না তূর্ণ। এসব থেকে মুক্তি পেতে চাই।”
তূর্ণ মলিন কন্ঠে পরশিকে বলল,
“আমি আছি তো। যা বলার আমাকে বলুম। আমার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদবেন। আমাকে জড়িয়ে ধরবেন। এখন যেভাবে আছেন। আমি আপত্তি করব না পরশি। আমি আপনার পাশে থাকবো। আপনাকে একা হতে দিব না৷ আর আংকেলও সুস্থ হবেন। একটু আশা রাখুন।”
অনেকক্ষণ পরশি তূর্ণর কাধে মাথা রেখে বসে ছিল। তারপর পরশি নিজেকে সামলে উঠে। তূর্ণ আর পরশি ওষুধ নিয়ে যায়। নার্সকে ওষুধগুলো দিয়ে দেখে পরশির মা পরিকে জড়িয়ে ধরে বসেই ঘুমিয়ে আছে। পরিও ওখানেই বসে আছে। পরশি গিয়ে পরির মাথায় হাত রেখে বলল,
“ঘুম এসেছে পরি?”
পরশির কন্ঠ কেমন যেন শুনালো। পরির কেমন যেন ভালো লাগলো। না জানি কতদিন পর এরকম তার বোন তার মাথায় হাত রেখেছে। আগে তাদের এমন সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল না। সবই মধুর ছিল। পরশির অনেক আদরের ছিল পরি। পরি শীতল চোখে বোনের দিক তাকিয়ে কাঁদো কন্ঠে বলল,
“আপু বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?”
পরশি জানে না কি হবে। চুপ হয়ে আছে। তূর্ণ একটু কাছে এগিয়ে বলল,
“হবে। দোয়া করো।”
পরি কিছু বলে না। পরশি পরির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“কষ্ট হয়ে যাচ্ছে না তোর?”
“না আপু। তুমি বসো। তোমারও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনেক।”
পরশি বসলো।
দুই বোন মিলে হঠাৎ শুরু করলো ছোটবেলায় কাহিনি৷ তার বাবার সাথে কাটানো সুন্দর সময়গুলো মনে করতে লাগলো৷ পরশির হঠাৎ পরশের কথা মনে পড়ে মন খারাপ হলো। তারপর পরশি পরশের কথা জিজ্ঞেস করলো পরিকে।
পরি বলল,
“হ্যাঁ, ভাইয়া অনেকবার কল করেছিল। ভাইয়া অনেক টেনশনে আছে। কাল সকালে এসে দেখে যাবে বলেছে।”
“আচ্ছা।”
পরশির বাবার জ্ঞান ফিরলো পরেরদিন দুপুরে। আগের থেকে অবস্থা অনেকটাই ভালো। কিন্তু সে তার তিন ছেলে মেয়েকে এক সাথে ডেকে অনুরোধ করেছে যেন তারা তাদের মধ্যকার ঝগড়া থামিয়ে দেয়। বাবার কথা মতো পরশি পরশ কথা বলে। একে অপরের কাছে মাফ চেয়ে নেয়। পরিও পরশির কাছে মাফ চায়। পরশ তূর্ণকে ডেকেও মাফ চায় আর ধন্যবাদ জানায় পাশে থাকার জন্য।
পরশি কয়েকদিন ওর বাবার বাড়িতেই ছিল। পরশির ভাবি নিজে পরশিকে বলেছেন বাসায় ফিরে আসতে। কিন্তু পরশি চাচ্ছে না। তার ওখানে ভালো লেগেছে। পরশ আর তার স্ত্রী জোর করেছে অনেক। কিন্তু পরশি বলেছে,
“তোমাদের নিজেদের সংসার আছে। আমার তো নিজের সংসার নেই। কিছু নেই। ওখানে একা থেকে ভালো লাগছে। নিজের ছোট একটা বাসা। আলাদা একটা শান্তি। অবশ্যই তোমাদের সাথে থাকলে আমার ভালো লাগবে। তাই প্রায়ই আসবো। সময় কাটাবো একসাথে।”
এরপর ওর ভাই ভাবি আর জোর করেনি ওকে। তবে পরশিকে পরশ বলল,
“পরশি সত্যি বলতে আই এ্যাম হ্যাপি ফর ইউ। তুই সব ভুলে অন্য কারো সাথে জীবন শুরু করছিস। অন্য কাউকে ভালোবাসিস এটা আমার ভালো লাগছে। আগের কাহিনি থেকে বের হতে পেরেছিস এর থেকে বড় খুশির আর কি হতে পারে? বাবা মাও খুশি হবে।”
পরশি বলল,
“মানে?”
“তূর্ণ আর তুই! দুইজন একদম পারফেক্ট।”
“ভাইয়া তোর ভুল হয়েছে। ওরকম কিছু না।”
“আমি এতোই বোকা? কিছুই বুজি না? তোদের দু’জনকে দেখলেই বোঝা যায়। তূর্ণ তোর জন্য কি না করে? এগুলো তো এমনি এমনি না। আর তুইও তূর্ণর কাছে ভরসা পাস। এই কয়টা দিনে দেখে বুঝেছি। তূর্ণ তোর জন্য সব জায়গায় হাজির থাকে।”
“ভাইয়া সত্যি বলতে আমি জানি না তূর্ণ কি মনে করে। আমার তো মনে হয় ও সব বন্ধু হিসেবেই করে। কিন্তু সত্যি বলতে তূর্ণ আমার জন্য অনেক কিছু করেছে। আমি কনফিউজড আমি ওর জন্য কি ফিল করি।”
“কি জানি। তবে তুই সুখে থাক এটাই চাই।”
পরশি কথা না বাড়িয়ে চলে আসে। তবে পরশের প্রত্যেকটা কথা তাকে ভাবাচ্ছে। পরশি সব কিছু ভেবে দেখছে।
আজ সকালে অফিসে কিছু ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না পরশি। হঠাৎ করে ড্রয়ারে একটা ব্যাগ দেখলো। ব্যাগের মধ্যে দুইটা উপন্যাসের বই। আর একটা শুকনো গোলাপ। পরশি একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করল এটা তার ড্রয়ারে কি করছে। উত্তরে লোকটা বলল,
“ম্যাম সেদিন এক স্যার এসেছিলেন। আপনাকে খুঁজেছিলেন। তিনি রেখে গিয়েছিলেন টেবিলের উপর। পরে আমি সরিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম যেন হারিয়ে না যায়। কিন্তু আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছি।”
“আচ্ছা, ঠিকাছে। ধন্যবাদ।”
পরশি বইয়ের পাতাটা খুলল। প্রথম পাতায় লেখা,
ভালোবাসা কী তা আমার জানা নেই, তবে তুমি আমার জন্য স্পেশাল এটা আমি ফিল করেছি। ভালো লাগে তোমায়। ভালো লাগে তোমার সঙ্গ। ভালো লাগে তোমার সবকিছু। ভালোবাসি পরশি।
~তূর্ণ।
পরশি পড়ে অবাক হয়ে কতক্ষণ লেখাগুলোর দিক তাঁকিয়ে থাকলো। তারপর ঠোঁটের কেণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
চলবে…..
ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ৪০
তূর্ণর বাসায় হঠাৎ ইভা এসেছে। ইভাকে দেখে তূর্ণ অবাক। বেশ কিছু দিন ইভার সাথে সেরকম একটা কথা হয় না দেখা হয় না। আজ হঠাৎ ইভা তার বাসায় চলে আসলো!
তূর্ণ বলল,
“আরে ইভা তুমি?”
“হ্যাঁ, আসলাম৷ কেন আসতে পারি না?”
“না, তা কেন। অবশ্যই আসবে। তুমি তো ইদানীং মনে হয় অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে থাকো তাই না। কথাই বলো না আজকাল।”
“হ্যাঁ, একটু ব্যস্ত বলা যায়। আর আজ হঠাৎ করে এমনি এমনি আসিনি। একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছি।”
তূর্ণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“উদ্দেশ্য?”
ইভা হেসে বলল,
“চিন্তার কিচু নেই।”
তূর্ণ কিছুই বুঝতে পারে না। তারপর ইভা একটা বিয়ের কার্ড এগিয়ে দেয় তূর্ণের দিকে। তূর্ণ অবাক হয়ে কার্ডটা খুলে। কার্ডটা খুলে দেখে ইভা আর অফিসার রিফানের বিয়ের কার্ড। তূর্ণ অনেক বেশি অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল,
“সিরিয়াসলি ইভা?”
“হ্যাঁ।”
তূর্ণ খুশি হয়ে বলল,
“ওয়াও! কংগ্রাচুলেশনস। বাট এগুলো কবে কখন হলো? আমাকে অন্তত জানাতে পারতে। তুমি তো আমার থেকে কিছু লুকাও না।”
“তুমিও তো লুকাতে না। আজকাল তো অনেক কিছুই লুকাও। আমাকেও তো জানাও নি তোমার আর পরশির কথা।”
“ইভা আমার আর পরশির মধ্যে শুধু ফ্রেন্ডশিপ। আর কিছু না।”
“ফ্রেন্ডশিপ আমাদের মধ্যেও ছিল। কখনো তো আমাকে হসপিটালে জড়িয়ে ধরে বসে থাকো নি। তোমার কাঁধে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে যাই নি।”
তূর্ণ চুপ হয়ে গেল। সেদিন পরশি তূর্ণর কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল। তূর্ণ চুপচাপ বসে ছিল।
তূর্ণ বলল,
“পরশির বাবা অনেক অসুস্থ ছিল। ও অনেক ভেঙে পরেছিল।”
“আচ্ছা। তোমাদের ব্যাপার। আমার কিছু যায় আসে না। এসব বলা উচিত হয় নি সরি।”
“ইটস ওকে। কিন্তু ইভা, রিফান কি পরশির ফ্রেন্ড না? মানে ইনিই কি?”
“হ্যাঁ। অফিসার রিফান।”
“একে কি করে চিনলে?”
ইভা বলল,
“কেউ একজন মন ভেঙে দিয়েছিল। সেই মুহুর্তেই মন গড়ার জন্য হাজির হয়েছিলেন রিফান।”
“মানে?”
“মানে কিছু না৷ প্রথম একদিন হসপিটালে দেখেছিলাম। পরবর্তীতে তার মা আমার পেশেন্ট হয়ে আসেন। অনেক অসুস্থ ছিলেন। ওনার মায়ের ট্রিটমেন্টের সময় আমাদের দেখা। উনিও ভালোবাসার রাস্তায় ঠকে যাওয়া এক পথিক। কথা হতে হতে এক সময় একে অপরকে ভালো লেগে যায়। তার থেকেও বড় কথা ব্যাপারগুলো রিফানের মা খেয়াল করেছেন। আমাকে তার পছন্দ। আমার পরিবার নেই, কেউ নেই জানা সত্ত্বেও আমাকে তিনি তার পুত্রবধূ করতে চেয়েছেন।”
ইভা আর তূর্ণ কথা বলছিল। এমন সময় তোহরাব সাহেব আসলেন। তিনি ইভাকে দেখে খুশি হলেন। ইভা তাকে দেখে সালাম দিল। তারপর কুশল বিনিময় করল। তারপর ইভা বলল,
“আংকেল একটা সুখবর দিতে এসেছিলাম। আপনাকে পাবো ভাবতেও পারি। অনেক ভালো লাগছে আপনাকে পেয়ে।”
“কি খবর মা?”
“আংকেল সামনের শুক্রবার আমার বিয়ে। প্লিজ আপনি আসবেন। আমাকে মেয়ে ডেকেছিলেন না? আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে।”
ইভার বিয়ের কথা শুনে তোহরাব সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। সে মনে প্রাণে চেয়েছিলেন ইভার বিয়ে তূর্ণর সাথে হোক। তূর্ণর জন্য ইভার থেকে ভালে মেয়ে আর হয় না। তূর্ণ রাজি না হলেও তিনি আশা রেখেছিলেন কোনো একদিন তূর্ণ রাজি হবে। আর ইভার সাথেই তার বিয়ে হবে। কিন্তু তা হলো না। তোহরাব সাহেব নিজের মুখের হাসি ধরে রেখে বললেন,
“সত্যিই ভালো খবর। আমি অবশ্যই আসবো মা। দোয়া করি অনেক সুখী হও।”
এমনি সময় হলে তূর্ণ উঠে যেত তোহরাব সাহেব আসাতেই। কারণ ইভা ভালো করেই জানে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক। কিন্তু আজ ইচ্ছা করেই বসে রইল ইভার বিয়ের কথা শুনে তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। তোহরাব সাহেব উঠে চলে গেলেন।
তারপর তূর্ণ বলল,
“আই এ্যাম সো হ্যাপি ফর ইউ ইভা। আমি জানতাম তুমি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো। তুমি একদিন পারফেক্ট কাউকে পাবে।”
“আসলেই৷ এখন বুঝতে পারছি আমার ভাগ্য অনেক ভালো। তাই তো আমার রিফানের মতো কারো সাথে দেখা। রিফান অনেক ভালো। ওর সাথে থাকলে আমি হ্যাপি ফিল করি। ও আমাকে সুখী করার জন্য অনেক কিছু করে। আমাকে ভালোবাসে। এখন বুঝতে পারছি সত্যিকার ভালোবাসা কি। রিফান আমাকে ভালোবাসা শিখিয়েছে।”
“দুজনে সুখী হও।”
“এসব বললে হবে না। বিয়েতে কিন্তু আসতে হবে।”
“হ্যাঁ। আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে আমি মিস করব তা কি হয়? অবশ্যই আসবো।”
“দাদু আর দাদিকে, চন্দ্রাকে, আংকেলকে নিয়ে আসবে। পরশিকেও। যদিও পরশিকে রিফান আলাদা করে দাওয়াত করেছেন। তবে আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড হিসেবে তো দাওয়াত দেওয়াই যায় তাই না?”
তূর্ণ বিরক্ত হয়ে বলল,
“সি ইজ নট মাই গার্লফ্রেন্ড।”
“স্বীকার করতে অসুবিধা কি তোমার? না কি এখনও বিশ্বাস করো ভালোবাসা বলে কিছুই নেই।”
“হ্যাঁ, ভালোবাসায় বিশ্বাস করি। কিন্তু পরশি হয় তো আমার হবে না।”
“কেন?”
“কারণ সবাই সবাইকে পায় না।”
ইভা তাকিয়ে রইল তূর্ণর চোখের দিক। রিফানের ফোন পেয়ে ইভা বিদায় নিয়ে চলে আসলো।
ইভা আর রিফান বিয়ের শপিং করতে বেরিয়েছে একসাথে। ইভা হঠাৎ রিফানকে জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা তোমার ফ্রেন্ড পরশি কি সিংগেল?”
রিফান অবাক হয়ে বলল,
“কেন বলো তো?”
“না এমনি।”
“হ্যাঁ, ও সিংগেল।”
“কাউকে পছন্দ করে?”
রিফান থমকে গেল এমন প্রশ্নে। তারপর বলল,
“হঠাৎ পরশিকে নিয়ে পড়লে কেন? এতো তো সুস্মিতার কথাও জিজ্ঞেস করো না।”
ইভা রেগে বলল,
“কারণ সুস্মিতার সম্পর্কে জানার কোনো ইচ্ছা নেই। আমাদের মধ্যে ওকে টানতে চাই না।”
রিফান ইভার গাল হাত দিয়ে বলল,
“সরি। দুষ্টুমি করেছি।”
“ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি।”
“কিন্তু হঠাৎ পরশির কথা কেন?”
“আমার মনে হয় পরশিকে কেউ পছন্দ করে। পরশি কি তাকে পছন্দ করে?”
“কে?”
“তূর্ণ।”
“তোমার ফ্রেন্ড?”
“হু।”
“আমার মনে হয় না পরশি কখনো কাউকে ভালোবাসবে।”
“কেন?”
“ওর পারসোনাল ম্যাটার। বিয়ে করলে ও এতো বছরে করতো।”
ইভা আর রিফান ওদের নিয়ে আর কথা আগায় না। তবে ইভার ভেবে একটু খারাপও লাগে। যেই তূর্ণ কোনোদিনও ভালোবাসায় বিশ্বাস করতো না সেই তূ্র্ণও বদলেছে। কিন্তু যার জন্য বদলেছে সেই তাকে ভালোবাসে না! ইভার এমনটাও মনে হয় না৷ কারণ হসপিটালে ও নিজ চোখে দেখেছে পরশি তূর্ণর কাঁধে কি সুন্দর মাথা রেখে ঘুমিয়েছে। ওদের মধ্যে কিছু না থাকলে এমন করবে কেন পরশি?
.
ইভা আর রিফানের গায়ে হলুদ। রিফানের সাথে সুস্মিতার বন্ধুত্ব আছে। সুস্মিতা ইভা আর রিফানের সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি করেনি। বরং সুস্মিতা নিজেই রিফানকে বলেছিল,
“রিফান আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি তোমার সাথে। তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো। এই জন্য আজও আমি অপরাধবোধ করি। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। আমি খুশি হয়েছি তুমি ইভার মতো কাউকে পেয়েছো। তোমাদের নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। প্লিজ আমাদের মধকার বন্ধুত্বের সম্পর্কটা থাকুক। যদি ইভার আপত্তি না থাকে।”
রিফান জানিয়েছিল ইভার কোনো আপত্তি নেই। আর রিফান সব ভুলে সুস্মিতাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। ইভার মনে মনে সুস্মিতাকে পছন্দ না হলেও সে রিফানের জন্য হাসিমুখেই জানিয়েছে সে যেন রিফানের বন্ধু হয়ে থাকে। আর তাদের বিয়েতে থাকে। সুস্মিতাও বিয়েতে সব দায়িত্ব পালন করছে। সব নিজে থেকে দেখছে৷ যদিও রিফানের মা একদম সহ্য করতে পারছে না সুস্মিতাকে। তারপরেও ইভার কথা শুনে মেনে নিচ্ছে।
গায়ে হলুদের দিন চন্দ্রা আর পরশি এসেছে। তূর্ণ পরে আসবে। পরশি সুস্মিতার সাথে সব দেখাশুনা করছে। আর চন্দ্রা ইভার কাছে বসে ওকে রেডি হতে সাহায্য করছে। চন্দ্রা আগ্রহী হয়ে ইভার কাছে সুস্মিতার গল্প শুনছে। চন্দ্রা সেদিনের হসপিটালের কাহিনি ভুলেনি। তার স্পষ্ট মনে আছে সুস্মিতা রিফানকে ঠকিয়েছে। চন্দ্রা চুপচাপ সব শুনলো। তবে ইভাকে বুঝতে দিল না কেন শুনছে চন্দ্রা এগুলো। সে শুধু ইভা আর রিফানের সম্পর্ক কিভাবে হলো সেই গল্প শুনার বাহানাতেই এগুলো শুনছে।
.
তূর্ণ এসেছে। পরশি বারবার তূর্ণর দিক তাকাচ্ছে। যখনই তূর্ণ তাকাচ্ছে পরশি চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তূর্ণ দেখছে পরশিকে কতটা সুন্দর লাগছে। আর পরশি ভাবছে তূর্ণ তাকে ভালোবাসে। কিন্তু বলে না কেন? বইয়ের মধ্যে লিখে সেটা অফিসে কেন রেখে এসেছে। কেন তাকে সামনাসামনি বলে না? বললেই তো পারে? পরশি তো তাকে ফিরিয়ে দিবে না। কারণ সে যে পরশির মন কেড়ে নিয়েছে। সেদিন বইয়ের পাতায় লেখাগুলো পড়ে পরশি বুঝেছে সে যেরকম তূর্ণর প্রতি দুর্বল হয়েছে তূর্ণ আরও আগেই তার প্রতি দুর্বল হয়েছে। কোনো বাধা নেই। দুজনেই দুজনের মনে স্থান পেয়েছ। তবে কেন বলছে না তূর্ণ। ও কি অপেক্ষায় আছে পরশি বইয়ের লেখাটি দেখে ওকে এসে বলবে? তাহলে তো পরশির বলা উচিত। কিন্তু তূর্ণও তো ঐ ব্যাপারে কিছু বলেনি আর। পরশির মনে পড়ল সেদিন হসপিটালে তূর্ণ ওকে বলেছিল ওকে জড়িয়ে ধরতে, ওর কাধে মাথা রাখতে, ওর দুঃখগুলো ওকে বলতে! তাহলে কি তূ্র্ণ এগুলোর মাধ্যমে তার ভালেবাসার প্রকাশ করেছে? তবে কেন এখনো পরশির চোখের আড়ালে থাকে। পরশি তাকালেই কেন চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তূর্ণ৷ এসব প্রশ্ন পরশিকে পাগল করে দিয়েছে। পরশির কি উচিত তূর্ণকে গিয়ে সবটা বলা?
পরশির ভাবনায় আসলো, আচ্ছা তূর্ণ কি আবিরের কথাগুলো শুনে পিছিয়ে আছে? পরশি জানেও না তূর্ণ কবে পরশির অফিসে ঐগুলো রেখে এসেছে। আবিরের কথা শোনার পরে না আগে। যদি আগে হয় তাহলে কি তূ্র্ণ সবটা শোনার পরেও পরশিকে মেনে নিবে? পরশি তো আবিরকে ভুলতে পারছে তূর্ণকে পেয়ে। পরশির ভাবনা জুড়ে এখন শুধু তূর্ণর বসবাস। পরশি আর ভাবতে পারে না আবিরের কথা। পরশির এখন তূর্ণকে নিয়ে সব রকমের ভাবনার সৃষ্টি হচ্ছে। পরশি বুঝতে পেরেছে ও তূর্ণকে ভালোবাসে। কারো জন্য ভালোবাসার অবসান ঘটে অন্য কারো জন্য ভালোবাসার সৃষ্টি হতে পারে। পরশি ভেবে নিয়েছে সে তূর্ণর সাথে যত দ্রুত সম্ভব কথা বলবে। আর পারছে অনুভুতিগুলোকে এভাবে চেপে রাখতে। যেখানে তূর্ণ ওকে ভালোবাসে, আর ও নিজেও তূর্ণকে ভালোবাসে সেখানে ভালোবাসার প্রকাশ পাওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলবে….