ভালোবাসা কারে কয়,৫৭,৫৮ শেষ
শবনম মারিয়া
পর্ব ৫৭
পরশি আর তূর্ণ ঘুরে এসে রিসোর্টে ফিরেছে। তূর্ণ পরশিকে বলল একটু রেস্ট নিতে। সারাদিনে অনেক ঘুরাঘুরি হয়েছে। পরশিও তূর্ণর কথা মতো রেস্ট নিচ্ছে। পরশি খাটে বসে আছে। তূর্ণ গিয়ে পরশির কোলে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। পরশি জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে?”
তূর্ণ বলল,
“কিছু না। অপেক্ষা করছি আমাদের বাবুকে কবে কোলে নিতে পারব।”
“দেরি আছে।”
“হু৷ মনে পড়লো প্রণয়ের কথা। প্রণয় প্রণয়িনীকে পেয়ে একদম পাল্টে গিয়েছিল। প্রণয়িনীকে প্রথম যখন কোলে নিয়েছিল তখন দেখেছিলাম প্রণয়ের চোখে পানি। বাবা মা হওয়ার অনুভূতিটাই আলাদা তাই না?”
“হুম। প্রণয়িনী কি মিষ্টি মেয়ে। প্রণয় ভাইয়া আর চন্দ্রার ঘর আলেকিত করে রেখেছে। দেখবে আমাদের সন্তানও আমাদের ঘর আলোকিত করে রাখবে।”
হঠাৎ করে তূর্ণর ফোন বেজে উঠলো। পরশি বলল,
“তোমার ফোন বাজছে।”
“এখন আবার কে কল দিল। থাক রিসিভ করব না। মনে হয় না ইম্পর্ট্যান্ট না।”
“না। দেখো। প্রণয় ভাইয়ার কল।”
“ও এখন হঠাৎ! দাও তো ফোনটা।”
পরশি তূর্ণর ফোনটা এগিয়ে দিল। তূর্ণ ফোনটা রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো প্রণয়, হ্যাঁ বল।”
“তূর্ণ তুই কেথায়?”
প্রণয়ের কন্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। তূর্ণ চিন্তিত স্বরে বলল,
“আমি আর পরশি তো সিলেট। কেন কি হয়েছে?”
“তুর্ণ, তুই ব্যাক কর প্লিজ।”
“প্রণয় হয়েছেটা কি তাড়াতাড়ি বল। আমি এখন ব্যাক করব কিভাবে? সব ঠিক আছে তো? চন্দ্রা ঠিক আছে?”
“চন্দ্রা ঠিক নেই তূর্ণ। চন্দ্রা হসপিটালে। আফজাল চৌধুরীর মৃ`ত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে চন্দ্রা কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছে। চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারিয়েছে।”
“কি? আফজাল চৌধুরী মা`রা গিয়েছেন?”
“হ্যাঁ। তুই প্লিজ আয়। আমি বুঝতে পারছি না কি করব। চন্দ্রার জন্য ভয় লাগছে। চিন্তা হচ্ছে।”
“আমি এখুনি ব্যাক করার ব্যবস্থা করছি৷ তুই প্লিজ চন্দ্রাকে সামলে রাখ।”
এই বলে তূর্ণ ফোনটা রেখেই ফ্লাইটের টিকিট খুঁজতে লাগলো। তাকে ভীষণ অস্থির আর চিন্তিত লাগছে। পরশি তূর্ণকে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে তূর্ণ?”
“পরশি আমাদের এখুনি যেতে হবে।”
“মানে কি তূর্ণ? এখন কিভাবে?”
প্রণয় ভাইয়া কি বলল ফোন করে?”
তূর্ণর মাথা ঠিক নেই। ও ঝারি মেরে বলল,
“উফ, পরশি এতো প্রশ্ন করো না৷ যেতে হবে মানে যেতে হবে। বিনা প্রয়োজনে তো আর যাচ্ছি না তাই না? সবকিছু প্যাক করো। একটু পর একটা ফ্লাইট আছে ঢাকার। আমি টিকিট কাটছি।”
পরশির অভিমান হলো তূর্ণর এমন ব্যবহারে। কি এমন হয়েছে? ওকে কিছু বলছে না৷ তারপর আবার ওর ওপর রাগ দেখাচ্ছে। পরশি রাগ হয়ে প্যাক করা শুরু করল। সে মনে মনে ভাবছে, হয় তো সেরকম কিছুই হয় নি। তূর্ণ চন্দ্রার ব্যাপারে বেশিই পোসেসিভ। কি এমন হয়েছে যে প্রণয় ফোন করলেই যেতে হবে? সে এখানে তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে। স্ত্রীর থেকে বোন বড়? বোনের জন্য স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করবে? বুঝিয়ে বললেই তো পারতো। কোনো সিরিয়াস ব্যাপার হলে কি আর পরশি না করতো? চন্দ্রার জন্য এখন ট্যুর ক্যানসেল করছে তূর্ণ। তূর্ণর কাছে কি তার স্ত্রী সন্তান রেখে বোন, তার জামাই আর মেয়ে বড়? পরশির অনেক অভিমান হচ্ছে।
তূর্ণ যত দ্রুত সম্ভব পরশিকে নিয়ে রওনা হলো। ভাগ্য ভালো সন্ধ্যায় ফ্লাইটের টিকেটটা পেয়েছিল। তূর্ণ আর পরশি ঢাকায় পৌছানোর পর তূর্ণ পরশিকে বলল,
“পরশি আমি তুমি বাসায় যেতে পারবে?”
বলেই তূর্ণর মনে হলে এই রাতের বেলায় পরশি এই অবস্থায় কিভাবে একা যাবে। তূর্ণর মাথা একদমই কাজ করছে না। সে না ভেবেই বলে ফেলেছে। তার মাথায় শুধু ঘুরছে চন্দ্রার কথা। চন্দ্রা কি অবস্থায় আছে কে জানে। তূর্ণ পরশি কিছু বলার আগেই বলল,
“আমি তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসছি।”
পরশি অভিমান করে বলল,
“তার কোনো দরকার নেই। তুমি যাও। আমি যেতে পারব।”
“উফ, পরশি! যা বলছি শুনো।”
পরশি আর তূর্ণ বাসায় যাওয়ার পথে পরশি কথা বলতে চাইলো না। কিন্তু ওর মনের মধ্যে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে। পরশি জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
“কি এমন হয়েছে যে আমাকে বলতে পারছো না? আর আমি সাথে গেলেই কি?”
“পরশি এখন হসপিটালে গিয়ে তুমি কি করবে? তোমার রেস্ট নেওয়া দরকার। আমার জন্য তোমার এতো জার্নি করতে হলো।”
পরশি এবার অবাক হয়ে বলল,
“হসপিটাল? কি হয়েছে চন্দ্রার?”
“জানি না। দেখে আসি। তারপর জানাবো।”
পরশি আর কিছু বলল না। তার অভিমান নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। পরশির নিজের এই মুড সুইংগুলো ভালো লাগে না। ও যেখানে রিঅ্যাক্ট করতে চায় না সেখানে রিঅ্যাক্ট করে ফেলে। এই যেমন একটু আগে রাগ হচ্ছিল। এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। পরশি বলল,
“আমিও যাব তোমার সাথে।”
“না, তুমি বাসায় যেয়ে রেস্ট নাও। দাদা দাদি হয় তো জানেন না। আবার জানতেও পারে। তাদের একটু সামলে নিও পারলে।”
“ঠিকাছে।”
তূর্ণ পরশিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে হসপিটালের দিকে গেল। গিয়ে দেখে প্রনয় ভীষণ চিন্তত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্ণ গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“প্রণয় কি হয়েছে? চন্দ্রা এখন কেমন আছে।”
প্রণয় নরম স্বরে বলল,
“জ্ঞান ফিরার পরে আবার পাগলামি শুরু করেছিল। চিৎকার করে কান্না করছিল। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।”
তূর্ণ প্রণয় কাঁধে হাত রেখে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রণয় কিছু বলল না। চুপচাপ রইল। তূর্ণ আবার বলল,
“চন্দ্রার সাইক্রেয়াটিস্ট এখন দেশে নেই। কিন্তু উনি ছাড়া আমরা অন্য কারো কাছে যেতে পারব না। তাহলে অনেক সমস্যা হয়ে যাবে। উনি চন্দ্রার সম্পর্কে সব জানেন।”
“আমি সেটাই ভাবছি।”
“আমি উনাকে ফোন করে কথা বলছি।”
তূর্ণ চন্দ্রার সাইক্রেয়াটিস্টের সাথে ফোনে কথা বললেন। তিনি বললেন তূর্ণকে চন্দ্রার সাথে কথা বলতে। চন্দ্রাকে বোঝাতে। তিনি জানেন চন্দ্রা তূর্ণর কথা ভালোভাবে শুনে। তূর্ণ কিছু বললে চন্দ্রা শান্ত হয়ে তা শুনে। এটা প্রণয়ও জানে। তাই সে তূর্ণকে এভাবে ডেকে এনেছে।
তূ্র্ণ আর প্রণয় অপেক্ষা করছে চন্দ্রার ঘুম থেকে উঠার। প্রণয় বলল,
“এতোদিন চন্দ্রা ভালো ছিল। ভেবেছিলাম পরিবর্তন আসছে। হ্যাঁ, খু`ন করেছে। কিন্তু নিজেকে আঘাত করে নি। নিজে কষ্টে কান্না করেনি। ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে সব ঠিক হবে। চন্দ্রাকে এই জীবনে যতবার বলেছি চন্দ্রা খু`নাখু`নি ছেড়ে দেও, তখনই সে বলেছিল আফজাল চৌধুরীকে খু`ন না করা পর্যন্ত সে থামবে না। চন্দ্রার একটা কথাই ছিল, আফজাল চৌধুরীর খু`ন হবে তার জীবনের শেষ খু`ন। এরপর সে আর কেনোদিন খু`ন করবে না। চন্দ্রা জ্ঞান হারানোর আগেও বলছিল আফজাল চৌধুরী ম`রে গেল, সে খু`ন করতে পারল না। তার মায়ের মৃ`ত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারল না। জানি না চন্দ্রা এখন কি করবে। তবে এটা তো আমরা জানতামই আফজাল চৌধুরীকে চন্দ্রা কখনোই খু`ন করতে পারবে না। কিন্তু তার মৃ`ত্যুর খবর শুনে যে চন্দ্রা এরকম রিঅ্যাক্ট করবে তা কে জানতো!”
“আমিও বুঝতে পারছি না প্রনয়, কি করব? এই আফজাল চৌধুরী আমার বোনের জীবনটা শেষ করে দিল। ভেবেছিলাম নতুন জীবন শুরু করেছে। ভালে থাকবে। সে ভালো ছিলও। কিন্তু এই আফজাল চৌধুরীই ওকে এই অবস্থায় নিয়ে আসলো।”
“যে করেই হোক চন্দ্রার মাথা থেকে আফজাল চৌধুরীর ব্যাপারটা ঝেরে ফেলতে হবে।”
“কি করে?”
“আমার ল্যাপটপ দিয়েই চন্দ্রা ওর একটা ডকুমেন্ট খুঁজছিল। মেইলটা নিশ্চয়ই আমার ল্যাপটপে আছে। আমি ল্যাপটপটা নিয়ে আসছি। তুই একটু থাক।”
“আচ্ছা।”
প্রণয় দ্রুত বাসা গেল। প্রণয়কে জাহানারা আর এহসান জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছিল। আর চন্দ্রা কেমন আছে। প্রণয় সত্যিটাই বলল। সে বলল,
“চন্দ্রার বাবা মা`রা গিয়েছেন। এই খবরটা পাওয়ার পরে চন্দ্রা রিঅ্যাক্ট করে অসুস্থ হয়ে যায়।”
তারা দুঃখ প্রকাশ করলেন। এহসান সাহেব প্রণয়ের সাথে হসপিটালে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রণয় তখন তাকে মানা করেছিল। এখনও তিনি যেতে চাইলে বললেন,
“চন্দ্রা এখন ঠিক আছে। যাওয়ার দরকার নেই।”
প্রণয় তার রুমে গিয়ে দেখলো ল্যাপটপটা ঠিকমতো আছে। ভাগ্যিস চন্দ্রা এটা ভাঙেনি। প্রণয় ল্যাপটপটা নিয়ে হসপিটালে গেল। তারপর তূর্ণ আর সে ইমেইল পড়লো। তূর্ণ প্রণয়কে বলল,
“কিন্তু কিভাবে সামলাবো চন্দ্রাকে?”
প্রণয় কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বলল,
“দেখ তূর্ণ, আফজাল চৌধুরী তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। আর চন্দ্রাকেও তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন।”
“হ্যাঁ, কিন্তু এতে কি এমন হবে? চন্দ্রা তো এগুলো পড়ার পরেও পাগলামি করছে কারন ও খু`ন করতে পারলো না সেজন্য।”
“আমাদের চন্দ্রাকে এটা রিয়েলাইজ করাতে হবে যে আফজাল চৌধুরী অনুতপ্ত। আর সে চন্দ্রাকে অনেক ভালোবাসতেন।”
“কিভাবে?”
প্রণয় বলল,
“ওর সাথে কথা বলে বুঝাতে হবে।”
“ও বুঝবে না প্রণয়।”
“ও বুঝবে।”
“আচ্ছা চেষ্টা করে দেখি।”
অনেক রাত হয়ে গিয়েছ। তূর্ণ এখনও ফিরছ না। পরশির খুব চিন্তা হচ্ছে। ভয় হচ্ছে। পরশি তূর্ণকে ফোন করল। তূর্ণ ফোন রিসিভ করল। পরশি বলল,
“কি হয়েছে? তুমি এখনো আসো না কেন?”
“পরশি আমার দেরি হবে। তুমি ঘুমিয়ে যাও।”
“তূর্ণ কি হয়েছে বলো। আমার চিন্তা হচ্ছে।”
“চিন্তা করো না। খেয়ে ওষুধ খেয়ে ঘুমাও। সব ঠিক আছে।”
পরশি রাগ হয়ে ফোন কেটে দিল।
প্রণয় তূ্র্ণকে বলল,
“তুই বাসায় যা। ভাবি চিন্তা করছেন৷ এই সময় এতো টেনশন দিস না।”
“অসুবিধা নেই। আমি চন্দ্রাকে রেখে যেতে পারব না।”
“সরি রে। আমি তোদের ট্রিপটা নষ্ট করে দিলাম।”
“প্রণয়, চন্দ্রা আমার বোন। ওর এই অবস্থায় তুই জানাবি না? আমি আসবো না? কি বলিস তুই?”
প্রণয় আর কিছু বলল না।
সকালে চন্দ্রার ঘুম ভাঙলো। ওষুধের প্রভাব কিছুটা রয়েছে। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। চন্দ্রা শান্ত হয়ে বসে আছে। তূর্ণ চন্দ্রার পাশে গিয়ে বসলো। তারপর চন্দ্রার মাথায় হাত রেখে বলল,
“কি হয়েছে? এতো চুপচাপ কেন?”
চন্দ্রা তূর্ণর দিক তাকালো তারপর আবার কান্না শুরু করল। তূর্ণ বলল,
“চন্দ্রা শান্ত হও। মাথা ঠান্ডা কর। পাগলামি করিস না চন্দ্রা। তুই কি ভুলে গিয়েছিস তুই মানুষ? একটা মানুষ ম`রে গিয়েছে আর তুই কান্না করছিস তাকে খু`ন করতে পারবি না এই জন্য? তুই পাগলামি করছিস, নিজেকে আ`ঘাত করছিস এই জন্য? লোকটা তোর বাবা ছিল।”
চন্দ্রা তূর্ণর দিক তাকালো। তারপর বলল,
“না, না। ঐ লোক আমার মাকে খু`ন করেছে। ওকে আমি খু`ন করতে চেয়েছিলাম।”
প্রণয় বলল,
“চন্দ্রা, উনি তোমার মাকে খু`ন করেন নি৷ তোমার মা সুই`সাইড করেছিলেন। উনার সাথে ঝগড়া করে সুই`সাইড করেছে মানে তিনি খু`ন করেছেন এমন না। তিনিও অনুতপ্ত। তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন চন্দ্রা। তিনি তোমাকে ভালোবাসতেন।”
চন্দ্রা প্রনয়ের দিক তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর বলল,
“ভালোবাসতেন! তাহলে আমাকে কেন একা ফেলে গেলেন।”
তূর্ণ বলল,
“তিনি তোকে একা ফেলেননি। তুই যেতে চাসনি চন্দ্রা।”
প্রণয় চন্দ্রাকে বলল,
“মেইলটা আবার পড়ো ভালো করে।”
চন্দ্রা বলল,
“না, না। আমি পারব না।”
“তুমি পারবে। পড়ো চন্দ্রা।”
চন্দ্রা পড়লো। একবার নয়, দুইবার করে পড়লো।তূর্ণ আর প্রণয় চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। মেইল দুটো পড়া শেষ চন্দ্রা কান্না শুরু করলো। সে বুঝতে পারছে। সে এবার কান্না করছে তার বাবার জন্য। এতক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে সে এই জীবনে সে আজীবন তার বাবাকে ভুল বুঝে গিয়েছে। তার বাবার দোষ থাকলেও তার বাবা তার মাকে তার থেকে দূর করেনি৷ আর তার বাবা তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত। চন্দ্রা এতোদিন জানতো তার বাবা তাকে ভালোবাসে না। তাকে একা ফেলে গিয়েছে। কিন্তু এই লোকটা তাকে একা রেখে চলে যেতে চায়নি। বরং তার সাথেই নিয়ে যেতে চেয়েছিল। চন্দ্রার কাধে প্রণয় হাত রাখলো। চন্দ্রা প্রণয়ের দিক তাকালো। তারপর বলল,
“প্রণয় আমি এতোদিন আমার বাবাকে ভুল বুজেছি। তিনি আমাকে ভালোবাসতেন! তিনি আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগেও আমার কথা ভেবেছেন! আর আমি কি না তাকে খু`ন করার জন্য পাগল হয়ে ছিলাম। প্রণয় আমি এমন কেন? মা ছেড়ে গিয়েছিল। বাবা পাশে থাকতে চেয়েছিলেন। আমি পাশে থাকতে দেই নি। এখন তিনিও চলে গিয়েছেন!”
প্রণয় চন্দ্রাকে বলল,
“চন্দ্রা শান্ত হও। যা হওয়ার ছিল তা হয়ে গিয়েছে। এখন কিছু করার নেই চন্দ্রা৷ তোমার বাবা মা চাইতেন তুমি ভালো থাকো। তাই তোমাকে এখন ভালো থাকতে হবে।”
চন্দ্রা নীরবে কেঁদে গেল। তূর্ণ প্রণয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“খেয়াল রাখিস।”
এই বলে তূর্ণ চলে আসলো। তূর্ণর মনে হলো তার আর এখানে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। চন্দ্রাকে প্রণয়ের মতো করে আর কেউ সামলে রাখতে পারবে না। তূর্ণ ভেবে পাচ্ছিল না কি করবে। আর প্রণয় সেখানে সব সামলে নিল। যেই চন্দ্রার মনে একটু আগেও ভুল বুঝাবুঝির স্তুপ ছিল, সেই চন্দ্রাও বুঝেছে ভুলটা কেথায়।
চলবে….
ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ৫৮ (অন্তিম পর্ব)
চন্দ্রা এখন কিছুটা স্বাভাবিক। তবে তার মন খারাপ। চুপচাপ বসে থাকে। প্রণয়িনীকেও তার বাবা বলেছে তার মা অসুস্থ যেন ডিস্টার্ব না করে। প্রণয়িনীও ডিস্টার্ব করে না। প্রণয়িনী চুপচাপ সন্ধ্যাবেলায় নিজের মতো বই নিয়ে গিয়ে বসেছে চন্দ্রার পাশে। চন্দ্রা প্রণয়িনীকে কাছে টেনে নিল। তারপর বলল,
“কি হয়েছে আমার মেয়ের?”
প্রণয়িনী বলল,
“কিছু না, মা।”
চন্দ্রা প্রণয়িনীকে কাছে টেনে বলল,
“কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে। আমার চঞ্চল প্রণয়িনী আজ এতো চুপচাপ কেন?”
“তুমি তো অসুস্থ মা। বাবা বলেছে তোমাকে ডিস্টার্ব না করতে।”
চন্দ্রা বলল,
“আমি তো এখন সুস্থ হয়ে গিয়েছি।”
“সত্যি?”
“হুম।”
প্রণয়িনী চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরল। প্রণয় রুমে আসলো।প্রণয় এসে জিজ্ঞেস করল,
“মা মেয়ে কি নিয়ে গল্প করছে শুনি।”
প্রণয়িনী দৌড়ে গিয়ে বলল,
“বাবা, মা সুস্থ হয়ে গিয়েছে।”
“হু।” বলে প্রণয় চন্দ্রার দিক তাকালো। চন্দ্রা প্রণয়ের দিক তাকিয়ে সামান্য হাসলো। তারপর চন্দ্রা বলল,
“আমি ঠিক আছি।”
প্রণয় বলল,
“তুমি ঠিক থাকলেই সব ঠিক।”
চন্দ্রা বলল,
“আপনাকে আর চিন্তায় ফেলবো না।”
প্রণয় হাসলো। চন্দ্রাও হাসলো।
রাতেরবেলা প্রণয়িনী আর প্রণয় ঘুমিয়ে আছে। ঘুমায়নি চন্দ্রা। সে উঠে বারান্দায় গিয়ে বসে আছে। প্রণয়ের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় চন্দ্রাকে না দেখে সেও উঠে পড়লো। তারপর চন্দ্রাকে ডাকলো। বারান্দা থেকে চন্দ্রা বলল,
“আমি এখানে।”
প্রণয় উঠে গেল। তারপর বারান্দায় গিয়ে চন্দ্রার পাশে বসলো। চন্দ্রা প্রণয়ের কাঁধে মাথা রাখলো। তারপর দুজনে আকাশের চাঁদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। প্রণয় চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করল,
“ঘুম আসছে না?”
“না।”
“একা বসে ছিলে কেন? আমাকে ডাকতে।”
“আপনি অনেক ক্লান্ত। ঘুমের প্রয়োজন আপনার৷ তাই ডাকিনি।”
“আচ্ছা অসুবিধা নেই আমারই ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তা একা একা বসে কি ভাবছিলে?”
“কিছু না।”
প্রণয় আর কিছু বলল না। চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরল। চন্দ্রা হঠাৎ করে বলল,
“একটা কথা রাখবেন?”
“তোমার কোনো কথা ফেলেছি?”
“আমি একবার আমার ছোট চাচার সাথে দেখা করতে চাই৷ বাবা যাওয়ার আগে কি বলে গিয়েছিলেন জানতে চাই।”
“ঠিকাছে, কাল সকালে যাব।”
সকালে চন্দ্রা আর প্রণয় গেল তার চাচার বাড়িতে। তার চাচা চন্দ্রাকে প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে চিনেছেন। তিনি খুশি হয়েছেন চন্দ্রা আর প্রণয় যাওয়াতে। তিনি অনেক কথা বললেন চন্দ্রার সাথে। আফজাল চৌধুরী চন্দ্রার জন্য কতটা পাগল ছিলেন তাও বললেন। চন্দ্রা জিজ্ঞেস করল,
“বাবা কেন আমাকে আপনার সাথে দেখা করতে বলেছিলেন?”
“তোমার বাবা তার বাংলাদেশ থাকা সকল সম্পদ তোমাকে দিয়ে গিয়েছেন। সবটা বুঝে নেওয়ার জন্যই আমার সাথে দেখা করতে বলেছেন। লোকটা তোমায় অনেক ভালোবাসতো মা। তুমি বুঝতে ভুল করেছিলে।”
কথাগুলো শুনে চন্দ্রা অবাক হলো। তার বাবা তাকে কতোটা ভালোবাসতো। অথচ চন্দ্রা জানতেই পারেনি।
চন্দ্রা কিছু বলল না। চুপচাপ রইল। তারপর বলল,
“বাবার ঐ বাড়িটা বাদে আমি আর কিছু চাই না। বাড়িটা আমি চাই কারণ ওখানে বাবা মায়ের সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে। বাড়িটা থাকুক স্মৃতি হিসেবে। আর বাকি সব আমি দান করে দিতে চাই।”
এই বলে চন্দ্রা চলে আসলো।
গাড়িতে বসে প্রণয় জিজ্ঞেস করল,
“তুমি ঠিক আছো চন্দ্রা?”
“হুম।”
প্রণয় বলল,
“চন্দ্রা মনে কোনো কষ্ট থাকলে আমাকে বলতে পারো।”
চন্দ্রা বলল,
“আমি নিজেই জানি না। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রণয়, আমি আমার বাকি জীবন সুন্দরভবে কাটাতে চাই। প্রণয়িনী আর তোমার সাথে। আমি স্বাভাবিক হয়ে যাব প্রণয়। আমি আর ওসব করব না। আমি স্বাভাবিক সুন্দর জীবন চাই।”
প্রণয় চন্দ্রার দিক তাকিয়ে ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল,
“তুমি পারবে চন্দ্রা। তুমি পারবে।”
কয়েক মাস পর….
পরশির হঠাৎ রাতেরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। সে ভীষণ অস্থির হয়ে গিয়েছে। সে ঘেমে যাচ্ছে। ভীষণ ভয় পেয়েছে। সে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। তূর্ণও তখনো ঘুমায়নি। পরশিকে এভাবে উঠে যেতে দেখে সে চিন্তিত হয়ে পরশিকে বলল,
“পরশি কি হয়েছে? খারাপ লাগছে?”
“তূর্ণ আমি স্বপ্নে দেখলাম তোমার খুব বিপদ। পুলিশ তোমাকে তাড়া করছে। তূর্ণ আমার ভয় লাগছে। খারাপ কিছু হবে না তো?”
তূর্ণ পরশিকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,
“শান্ত হও। কিছু হবে না। দেখবে সব ঠিকঠাক হবে।”
তূর্ণ পরশিকে সামলে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
পরের দিন সকালে তূর্ণকে প্রণয় ফোন করে। প্রণয় তার অফিসে বসে আছে। সে বেশ চিন্তিত। চিন্তিত হওয়ারই কথা। কারণ অনেক বড় ঝামেলায় পড়ে গিয়েছে। বুঝতে পারছে না কি করবে। তূর্ণ গেল। তূর্ণ প্রণয়কে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে? এভাবে ডাকলি কেন?”
“অনেক বড় ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। চন্দ্রা ঐদিনের কাহিনির পরে আর খু`ন করেনি। অথচ আমার অফিসের গোডাউনের বাহিরে খু`ন হয়েছে। আর রফিকুল পলাতক। তার মানে খু`নটা ও করেছে। শুনেছি, এখানের এক গার্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছিল। তাকেই মে`রেছ। আর পুলিশ সেটা জেনে গিয়েছে। তারা রফিকুলকে খুঁজছে। পুলিশ আমাকে এসে জিজ্ঞেস করেছে। ভাগ্য ভালো গোডাউনের বাইরে খু`নটা হয়েছে। তাই পুলিশ গোডাউনে যেতে পারেনি। পুলিশ এই কেইস নিয়ে অনেকদিনই ঘাঁটছে। পুলিশ ধারণা করেছে এই পর্যন্ত যতগুলো মানুষ নিখোঁজ হয়েছে সেগুলো খু`ন। আর তারা সেই সিরিয়াল কিলারকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পুলিশ রফিকুলকে খুঁজে পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
“কি করব এখন?”
“জানি না। তবে আমি একটা ব্যবস্থা করেছি।”
“কি?”
“চন্দ্রাকে বাঁচাতে হবে। আমি খুব দ্রুত চন্দ্রা আর প্রণয়িনীকে এই দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিবো।”
“তারপর? তারপর কি হবে?”
“জানি না। তবে চন্দ্রাকে বাঁচাতে হবে।”
রফিকুলের খবর সারাদেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। পুলিশ ধারণা করেছে রফিকুলই আসল খু`নি। কারণ খু`ন করে রফিকুল একইভাবে লা`শটা গায়েব করেছে। কিন্তু রফিকুল পলাতক আর গার্ডের সাথে মারামারির খবরটা সবাই জানে। তার পরেই গার্ড নিখোঁজ৷ আর প্রণয়কেও অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু প্রণয় সবটা এড়িয়ে গিয়েছে। সে বলেছে সে কিছু জানে না। সে শুধু জানে তার অফিসের গার্ড আর রফিকুল দুজনেরই খবর নেই।
প্রণয় বুঝতে পারল তাদের এখন পুলিশের কাছে ধরা খেতেই হবে। এই নিয়ে প্রণয় আর তূর্ণ অনেক চিন্তিত।
.
রফিফুলকে পুলিশ সাতদিন পর খুঁজে পেল৷ তাকে রিমান্ডে নেওয়া হলো। রফিকুলের সাথে শেষ প্রণয়ের কথা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রফিকুল স্বীকার করেছে সে শুধু একটা খু`ন করেছে। এর আগে যত খু`ন হয়েছে সব করেছে এহসান ইন্ডাস্ট্রির মালিক, প্রণয় এহসান।
তূর্ণর কিছু আচরণ পরশির ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তূর্ণ কিছু নিয়ে বেশ চিন্তিত। আর পরশির কাছ থেকে সে কিছু লুকাচ্ছে। পরশিও তূর্ণর কাছ থেকে সবটা জেনে ছাড়লো। তূর্ণ সবটা পরশিকে বলেছে। পরশির কাছে আর লুকাতে পারে নি। পরশি সবটা শোনার পর ভীষণ ভয় পেল। সে বিশ্বাস করতে পারছে সে এতদিন কিসের মধ্যে ছিল। তার স্বামী এই সবের সাথে জড়িত! আর চন্দ্রা এগুলো করেছে? পরশি জানে এই কেসের একদম শেষ পর্যায় চলে এসেছে পুলিশ। দীর্ঘ এগারোটা মাস ধরে পুলিশ এই কেইস নিয়ে ইনভেস্টিগেট করছে। চন্দ্রা পুলিশের কাছে ধরা খাবেই। তাহলে তূর্ণ? তূর্ণর কি হবে? না, পরশি তূর্ণর কিছু হতে দিবে না। পরশি কিছুতেই কাউকে জানতে দিবে না তূর্ণ এসবের সাথে জড়িত। আর তূর্ণকেও শাস্তি পেতে হবে না। না, পরশি তূর্ণকে হারাতে পারবে না।
পরশি তূর্ণকে বলল,
“তূর্ণ যা হওয়ার হবে। এখানে আমরা কিছু আটকাতে পারব না। কিন্তু তূর্ণ তুমি এসবের থেকে দূরে থাকো তূর্ণ। তুমি চন্দ্রা আর প্রণয় ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দাও৷ তূর্ণ তোমার কিছু হলে আমি মেনে নিতে পারব না।”
তূর্ণ রেগে গেল। সে পরশিকে বলল,
“পরশি তুমি কি পাগল? চন্দ্রাকে আমার বাঁচাতে হবে। চন্দ্রা আর প্রণয়ের এমন সময় আমি ওদের পাশে থাকব না।”
“কিন্তু তূর্ণ এখন কি করার আছে? চন্দ্রা আর প্রণয় ভাই ধরা খেলে তুমি এর সাথে জড়িত ছিলে এটাও জানবে সবাই। তখন কি হবে?”
“জানি না পরশি। তবে এখন চন্দ্রাকে বাঁচাতেই হবে।”
পরশি অনেক চিন্তিত। সে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। তূর্ণর কিছু হলে তার আর তাদের সন্তানের কি হবে?
তূর্ণ পরশিকে বলল,
“পরশি কিছু হবে না। তুমি চিন্তা করো না। আমি এখন আসছি। আমাকে প্রণয়ের কাছে যেতে হবে।”
পরশি তূর্ণকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল,
“সাবধানে থেকো। তোমার কিছু হলে আমি মেনে নিতে পারব না তূর্ণ।”
তূর্ণ পরশিকে বলল,
“কিছু হবে না দেখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তূর্ণ বাসা থেকে বের হলো। মাঝ রাস্তায় গিয়েই তার মায়ের ফোন পেল। এখন ফোন রিসিভ করার সময় নেই। তূর্ণ ফোনটা রিসিভ করল না। কিন্তু রেহানা কল দিয়েই যাচ্ছেন। তূর্ণ ফোনটা রিসিভ করল। রেহানা তূর্ণকে জানালো পরশি ভীষণ অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছে। এটা শোনার পর তূর্ণ আরও চিন্তায় পড়ে গেল। এসব কি হচ্ছে? বিপদ একটার পর একটা লেগেই আছে। তূর্ণর এখন হসপিটালে যেতে হলো।
তূর্ণ প্রণয় আর চন্দ্রার সাহায্য করার জন্য যেতে চেয়েও যেতে পারছে না। পরশি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তার বলেছে এখনই সি-সেকশন করতে হবে। না হলে মা আর বাচ্চা দুজনেরই বিপদ।
তূর্ণ পড়ে গিয়েছে মহা বিপদে। একদিকে নিজের বোন আর বন্ধু আরেকদিকে নিজের স্ত্রী আর সন্তান। দিন শেষে মানুষ স্ত্রী আর সন্তানের কথাই আগে ভাবে। ভালোবাসার মানুষের কথাটা আগে ভাবে। নিজের ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকা জরুরি ওর জন্য। তূর্ণ গেল না।
.
প্রণয়ই শেষবারের মতো রফিকুলের সাথে যোগাযোগ করে বলে দিয়েছিল যেন সে চন্দ্রার নাম না বলে প্রণয়ের নাম বলে দেয়। তাই রফিকুল প্রণয়ের নামই বলেছে। প্রণয় সেই রাতেই চন্দ্রাকে বলল,
“চন্দ্রা, সব শেষ।”
চন্দ্রা আতঙ্কিত হয়ে বলল,
“সব শেষ মানে? ওরা জেনে গিয়েছে?”
“একদিন তো জানারই ছিল।”
“প্রণয় এখন কি হবে?”
“তুমি দ্রুত তোমার আর প্রণয়িনীর সবকিছু প্যাক করো।”
“কোথায় যাব আমরা?”
প্রণয় চন্দ্রার হাতে কাগজ পত্র ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এই যে তোমার আর প্রণয়িনীর পাসপোর্ট, টিকেট আর বাকি ডকুমেন্টস। তুমি আর প্রণয়িনী এখনই আজ রাতেই এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে।”
“কিহ!”
“হ্যাঁ চন্দ্রা। তাড়াতাড়ি কর। আমাদের হাতে সময় নেই।”
“আপনি কি করবেন? আপনি যাবেন না?”
“আমারটা পরে দেখবো। আগে তোমার আর প্রণয়িনীর ব্যবস্থা করতে হবে।”
চন্দ্রা কিছু বুঝতে পারছে না সে কি করবে। তার মাথা কাজ করছে না। সবকিছু ঘোরের মতো লাগছে। সে জানে না তাদের সাথে কি হতে চলছে। সে প্রণয়ের কথা মতো সব গুছিয়ে প্রণয়িনীকে নিয়ে রেডি হয়ে গেল।
সারা দেশে সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে গেল আসল সিরিয়াল কিলার এহসান ইন্ডাস্ট্রির মালিক প্রণয় এহসান। তিনিই একেক পর এক খু`ন করেছেন। রফিকুল ছিল তার সহযোগী।
খবরটা দেখে চন্দ্রার বুঁক কেঁপে উঠলো। সে প্রণয়ের দিক তাকালো। প্রণয় অপরাধীর মতো চন্দ্রার দিক তাকিয়ে আছে।
.
তূর্ণ এই সংবাদ দেখে অবাক হয়ে গেল। প্রণয় সব নিজের মাথায় নিয়ে নিল? প্রণয় ওকে বারবার বলছিল যে করেই হোক নিজের জান দিয়ে হলেও চন্দ্রাকে বাঁচাবে। প্রণয় সত্যিই তাই করল? এখন কি হবে ওর সাথে? তূর্ণ ভাবতে পারছে না। ওর মাথা ঘুরছে।
.
চন্দ্রা প্রণয়ের কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। প্রণয় চন্দ্রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। প্রণয়ের চোখেও অশ্রু। চন্দ্রা কান্না করতে করতে বলল,
“এমন কেন করলেন আপনি? আমি, আমি পুলিশের কাছে গিয়ে সবটা সত্যি বলে দিব। সব দোষ আমার। আপনি কিছু করেন নি।”
প্রণয় বলল,
“পাগলামি করে না চন্দ্রা। যা হচ্ছে হতে দাও।”
“না, এসব আমি মানি না। আপনি এমন কেন করলেন, বলুন?”
“চন্দ্রা আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম আমি তোমাকে আজীবন রক্ষা করব। নিজের জান দিয়ে হলেও তোমায় বাঁচাবো।”
“কেন কথা দিয়েছিলেন?”
“পাগলামি করে না চন্দ্রা। হাতে বেশি সময় নেই। তুমি প্রণয়িনীকে নিয়ে চলে যাও। তোমাকে ভালো থাকতে হবে। প্রণয়িনীর জন্য। প্রণয়িনীকে নিয়ে সুখে থাকবে। কথা দাও।”
“আপনাকে ছাড়া আমি পারব না।”
“না, চন্দ্রা তোমাকে পারতেই হবে। আমার একটা কথা রাখো। তুমি প্রণয়িনীকে নিয়ে চলে যাও। আমি চাই না আমার মেয়ে এগুলো কিছু জানুক। ও এখানে থাকলে সুস্থ পরিবেশে বড় হতে পারবে না। ওর জন্য হলেও তোমাকে যেতে হবে। আমাদের মেয়ের জন্য চন্দ্রা।”
প্রণয়িনী ঘুমিয়ে ছিল। প্রণয় গিয়ে মেয়েকে চুমু খেতে লাগলো। তার চোখে পানি। মেয়েকে আদর করে বলল,
“ভালো থাকিস, মা। বাবা তোকে অনেক ভালোবাসে। বাবা তোকে একা ছেড়ে দিয়েছে বলে বাবার উপর অভিমান করিস না। বাবা তোর সাথে তোর মাকে দিচ্ছে। তোর মা তোকে ভালো রাখবে।”
প্রনয় চন্দ্রার কাছে গিয়ে বলল,
“চন্দ্রমল্লিকা, শেষবারের মতো বলতে চাই, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার জীবন সার্থক হয়েছে তোমাকে পেয়ে। আমি এই জীবনে আর কিছু চাই না। আমি এখন হাসিমুখে সকল শাস্তি মেনে নিতে পারব। তোমার কথা ভেবে হাসিমুখে মৃত্যুবরণও করতে পারব। তুমি আর প্রণয়িনী শুধু ভালো থেকো। এটাই আমার শেষ চাওয়া। হয় তো এই জন্মে আমাদের আর দেখা হবে না, যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে পরকালে আবার দেখা হবে৷ আর তখন তোমার থেকে দূরে যাব না।”
এই বলে প্রণয় চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরলো। দুজনের চোখেই অশ্রু।
প্রণয় প্রণয়িনীকে কোলে নিয়ে চন্দ্রার কোলে তুলে দিয়ে বলল,
“তাড়াতাড়ি যাও, চন্দ্রা। দেরী করো না। প্রণয়িনীর জন্য যাও, প্লিজ।”
চন্দ্রা চোখ মুছে বলল,
“আমি কথা দিলাম প্রণয়, আমি আমাদের মেয়েকে আগলে রাখব।”
এই বলে চন্দ্রা চলে গেল।
প্রণয়কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। প্রণয় সব স্বীকার করল। প্রণয়ের শাস্তি হলো। চন্দ্রা আর প্রণয়িনীও এই দেশ ছেড়ে দূর দেশে চলে গেল নতুন জীবনের সূচনা করতে।
তূর্ণ পুত্র সন্তানের পিতা হলো। তার আর পরশির জীবন সুখে ভরে গেল৷ শুধু তূর্ণর মনে আজীবনের একটা দুঃখ রয়ে গেল, সে প্রণয়ের জন্য কিছু করতে পারল না। তার অতি আদরের বোন চন্দ্রার জন্য কিছু করতে পারল না।
অন্যদিকে চন্দ্রা নতুন দেশে মেয়েকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলেও প্রণয়কে ভুলতে পারল না। প্রণয়ের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে চায় সে বাকিটা জীবন। যাওয়ার আগে সে প্রণয়ের আলমারি থেকে ঐ বাক্সটা নিয়ে গিয়েছিল। যেখানে প্রণয় চন্দ্রাকে নিয়ে লেখা চিরকুটগুলো রেখেছিল, চন্দ্রার ছবি রেখেছিল। রেখেছিল কিছু শুকনো চন্দ্রমল্লিকা ফুল। চন্দ্রা সেগুলো আগলে রেখেছে।
আমরা প্রতিনিয়ত ভালোবাসার সংজ্ঞা খুঁজি। প্রশ্ন আসে, ভালোবাসা কারে কয়?
ভালোবাসার জন্য কেউ স্বার্থপর হয়ে উঠে, কেউ ভালোবাসার জন্য বাঁচে। আবার হয় তো কেউ কেউ ভালোবাসার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়। হয় তো একেই ভালেবাসা বলে।
সমাপ্ত।
(গল্পটির সকল কাহিনি আর চরিত্র কাল্পনিক। কোনো ভুল ত্রুটি করে থাকলে ক্ষমা করবেন৷ পড়া শেষে অবশ্যই জানাবেন কেমন লেগেছে।)